![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১
সামনে মিডটার্ম , টেনশন যে একবারে নেই আমার মধ্যে নেই তা নয়। তবে,হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে গেলেন সুমন স্যার। এইমাত্র বলে গেলেন আসছে সোমবার আমাদের পিকনিক। খবরটা শুনেই সবাই আনন্দে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। শুধু নীপাকে দেখলাম স্রোতহীন নদীর মত স্থবীর। দেখে সামান্য খারাপ লাগলো। আগ বাড়িয়ে তাই জিজ্ঞেস করে বসলাম-‘তোমার মন খারাপ ?‘নাতো !’ বলে আবারো ফ্যাকাশে চাঁপার মত চুপসে গেলো ও। আমি আর কথা বাড়ালাম না।মোটকথা, কে যাবে না যাবে তা নিয়ে আমার মোটেই মাথাব্যথা নেই। আমি যাচ্ছি সেটাই প্রকৃত সত্য। সত্যি বলতে, সত্যের বাইরে আরো বেশ কিছু সত্যি থাকে যেটা বেশীরভাগ সময়ই থেকে যায় দৃষ্টীর অগোচরে।সেরকমই একটি অদৃশ্য সত্য হচ্ছে নীপা না গেলে শুধু আমার পিকনিকটাই মাটি হবে তা না,সারাটা দিনের জন্য আমার মনটাও খারাপ থেকে যাবে। খুব বেশীদিন নয়,এইতো সামান্য কদিন হয় যেদিন থেকে আমি নীপাহীন জীবন কল্পনা করতে পারছিনা।সেদিন বাইরে বৃষ্টি ছিলো প্রচন্ড। আমি ছাতা মাথায় দিয়ে, মাথা ছাড়া শরীরের বাকি অংশকে স্নান করিয়ে ক্লাস শুরুর দশ মিনিট পর এসেছিলাম। আজমল স্যারের ক্লাস চলছিল। নাক সিটকে সামান্য অপমান করে আমাকে বসতে বললেন। জমের সাথে আমিও কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ পেছনে গিয়ে বসে পড়লাম। ডান দিকে ঘুরতেই চোখ পড়ল নীপার দিকে। নীপাশাড়ি পরে আছে। ওর শাড়ির রঙ লাল। কপালে একটা টিপও পরেছে। টিপটার রঙও সন্দেহাতীতভাবে লাল।শুধু লাল নয়,অপূর্ব লাল। স্যারের পড়ানোর দিকে আমার মন নেই। আমি বারবার তাকাচ্ছি শাড়ীপরা মেয়েটির দিকে। স্যার টের পেয়ে বললেন- ‘এইযে ব্লু-শার্ট দাঁড়াও। কি যেন নাম? ওহ্,হ্যাঁ,মনে পড়েছে দীপ্ত। বলোতো রেজিস্ট্রেশন বলতে কী বুঝ? আমি বরাবরই এ ব্যাপারে বকলম। স্যার প্রশ্ন করলে জানা উত্তর দিতেও আমার কথা আটকে যায় মুখে। দুবার যথারীতি আটকে যাবার পর স্যার আমাকে পুরো ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। আমিও মনে মনে তথাস্তু বলে দাঁড়িয়ে থাকলাম নীপার দিকে মুখ ফিরিয়ে। সেদিন আর বাসায় ফিরে বই খুলে দেখা হয়নি,যা দেখেছি তা হচ্ছে শাড়ীপরিহীতা নারী, পরিপূর্ণ নারী ।
২
আজ সোমবার। আমাদের পিকনিক। উত্তেজনায় ঘুমাতে পারিনি পুরো রাত।ভোরবেলাই হাজির হয়েছি ক্যাম্পাসে। বন্ধুরা এখনো কেউ এসে পৌছাঁয়নি। একা একা ঘুর ঘুর করছি। আজমল স্যার খুব আদর করে ডেকে বললেন-বাবা দীপ্ত,একটু ওপরে আসো তো। আমি অনোন্যপায় হয়ে স্যারের পিছু পিছু ওপরে ছুট দিলাম। পাঁচতলায় ওঠার পর স্যার আমাকে যা বললেন তা শুনে আমার কলিজা শুকিয়ে যাবার মত অবস্থা। আমার শরীর খুব বেশী হালকা নয়। এর উপর যাকে বলে মাঞ্জা মেরে এসেছি। আর আমাকে কিনা টানতে হবে বিশ লিটার পানির বোতল ! তাও আবার একবার নয় দুবার! কি আর করা! পরেছি যবনের হাতে খানা খেতে হবে সাথে। স্যারের ডিউটি শেষ করে বেশ একটা পাট নিয়ে গায়ে হাওয়া লাগালোর জন্য নিচে দাঁড়ালাম। মনের মধ্যে অপেক্ষার ঘড়ি থেমে নেই। বাস্তবিক সময় সাতটা কিন্তু অপেক্ষার ঘড়িতে বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। অথচ বাস ছাড়বে সাড়ে সাতটায়। এই জানুয়ারীর শীতেও আমার শরীর ঘেমে যাচ্ছে। বুঝতে পারছিনা এখনো নীপা পিকনিকে যাবে কিনা!
বন্ধুরা সবাই এসে গেছে। এসে গেছে তপন,নিশাত,রিফাত,রুম্পা,লোপা সবাই। তবু আমি একটু সরে এসে সামনে দৃষ্টি ছুড়ে চলছি। এমনই এক দৃষ্টির তীরে বিদ্ধ হলো নীপার শরীর। আমি ওর ক্লাসমেট। ওকে আমি ভয় পাবো কেন এমন ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আমি কেঁপে চলছি। আমার ভীষণ পা কাঁপছে। কাঁপন বাড়িয়ে দিয়ে আমার ঠিক পাশে এসে দাঁড়াল ও। আমাকে বলল-তীর্থ পিকনিকে যাচ্ছেনা,আমার ও ছাড়া কোন ভালো বন্ধু নেই,তা তুমি জানো। সমস্যা না থাকলে আমার সাথে বসবে? আমি পড়ে গেছি দোটানায়। বন্ধুরা যে বাসে ওঠছে ও সেটাতে উঠছেনা। আমি কি করবো ভেবে না পেয়ে ওরই পিছু নিয়ে ওঠে পড়লাম। ও ভেতরের দিকে গিয়ে পাশে আমাকে জায়গা করে দিলো। বসতে না বসতেই ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরতে ভয় লাগছে। নিশাত ফোন দিয়েছে। ধরলেই ঝাড়ি নিশ্চিত। তবু ইন্না আন্তা সুবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমীন পড়ে বুকে একবার ফুঁ দিয়ে ফোন ধরে বললাম – দোস্ত,সরি। ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো–তোর সরির গুষ্টি কিলাই,শালা স্বার্থপর,এই জন্যই তোদের এলাকার লোকজন ঢাকায় চাকরী পায় না। ফোন রেখে দিয়ে আমি বোকার মত হাসি হাসি মুখ করে তাকালাম নীপার দিকে। ও হাসি দিলো একটু। আমি মনে মনে বললাম – আমার এতেই চলবে।
৩
সামনে পেছনে পিকনিকের সাতটা বাস চলছে। এগুলোর মাঝখানটায় জায়গা করে নিয়ে চলছে আমাদের বাসটাও।চেহারা থেকে সব দুঃশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলার তীব্র ইচ্ছে কাজ করছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু এই ইচ্ছে পর্যন্তই,যাচ্ছেনা। খুব একা বোধ করছি। নীপা ব্যপারটা হয়তো বুঝতে পেরেছে। ওর আনা ক্যামেরাটা তাই আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো – আমার একটা ছবি তুলে দেবে? মনে মনে বললাম বিলক্ষণ। মুখে অবশ্যই বলে ক্যামেরাটা হাতে নিলাম। টানা আট দশটা শুধু ওর ছবিই তুলেছি। ও মুখে একটা কৃত্রিম রাগ ফুটিয়ে তুলে বললো –হয়েছে,এবার আমাকে দাও,তোমার ছবি তুলে দিচ্ছি। আমি মুখ বাঁকা করে একটা পোচ দিলাম,মৃদু হাসি দিয়ে দিলাম আরেকটা। ছবি তোলার পর, ওগুলো দেখে নিজের গালে চড় দিতে ইচ্ছে করছে।
সাভারের বুক চিরে আমরা যাচ্ছি।দুপাশে রাস্তার ঢাল। ঢালের নীচে কোথাও কোথাও সামান্য জল ভীড় করে আছে। আর জলের ভেতর সাঁতার কাটছে হাসের বাচ্চা। নীপা চোখ বড় বড় করে বাইরের দিকে তাকিয়ে এসব দৃশ্য দেখছে। আমি তাকাচ্ছি ওর চোখের দিকে। এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম ওর চোখগুলো কতটা মায়া ধারণ করে আছে।
আমাদের গন্তব্য রাঙামাটী ওয়াটার ফ্রন্ট,গাজীপুর।স্পটের এরকম নাম শুনে এর নামকরণকারীর পুচ্ছদেশে একটা লাথি কষাতে আমার খুব ইচ্ছে করছিলো। এ আশা চেপে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় আমার ছিলোনা। এও আমার চেয়ে ভালো কেও জানতো না,তবু আশা তো আশাই। আশাতো আর এত হিসাব—কিতাব বোঝেনা।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে নামলাম। নামার পর চারপাশটা ঘুরে দেখে খারাপ লাগছেনা। বরং ভালোই লাগছে।ভাবলাম নামকরণকারীকে এবার মাফ করে দেয়া যায়। নামকরণের সাথে কোন মিল না থাকলেও জায়গাটা খুব খারাপতো নয়। সারারাস্তা যাদের ত্যাগ করে এসেছি তখন আর ওদের সঙ্গ নিতে যাবোনা। নিতে গেলেই নানা গঞ্জনা সহ্য করতে হবে। এমন ভেবেই নীপাকে বললাম –চলো,একসাথে থাকা যাক্ সারাজীবন। ও একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পরে ঠাট্রা বুঝতে পেরে বলল-‘ ঠিক আছে,চলো।’
৪
কি করবো ভাবছি। সারাটাদিন তো কাটাতে হবে। গান গাইলে গলা দিয়ে যে স্বর বের হয় তা ওর পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব , ও নিজে গান গায়। এই বেসুরো গলায় তাই গান গেয়ে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করছেনা। একটা কবিতা শোনালে মন্দ হয়না ভেবে ঠিক আবৃত্তি না বলে শিক্ষককে পড়া দেবার মত করে বকতে শুরু করলাম-বনলতা সেন। ওর ভালোলেগেছে। এখন ওর কাছে একটা গান শুনতে চাওয়া যায়। চারপাশটা গাছপালায় ঘেরা,আমাদের ঠিক সামনে একটা ছোট্র লেক। ওর ওপর অনেকগুলি লালপদ্ম ফুঁটে আছে। মনের ইচ্ছেটা বলতেই ও গাইতে শুরু করল-কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জণে। প্রায় ভরদুপুরে রাতের গান ওর কন্ঠে বেমালুম কি করে মানিয়ে গেল বুঝতে পারছিনা। নিজের অজান্তেই কখন ওর হাত আমার হাতে নিয়ে নিয়েছি বুঝতে পারিনি। হুঁশ ফিরে এলেও বাধা দিচ্ছেনা দেখে সামান্য অবাক হলাম। গান-কবিতা খেয়ে মন ভরলেও পেট ভরেনি। ওদিকে খাবার জন্য আমাদেরকে ডাকছে শুনে এগিয়ে গেলাম একসাথে। না ঘুমানোর ক্লান্তি এবং বাসের ধকল মিলে ক্ষুধাটা খুব কম লাগেনি। খাবার হাতে পেয়ে হাতটা ধুঁয়েই তাই খেতে শুরু করলাম। খাবারের ভালো-মন্দ কোন স্বাদ জীভ বুঝতে পারছেনা। তবু,পাকস্থলী বলছে খেতে হবে। আমি আদেশ মেনে খেয়ে চলছি। অর্ধেকটা খাবার পেটে চালান করে দিয়ে নীপার দিকে তাকালাম। নীপার প্লেটভর্তি খাবার এখনো পড়ে আছে। আমি বোকা মানুষ,তারপরো একটু অবাক না হয়ে পারলাম না। ওকে জিজ্ঞেস করতেই বললো-ওর ক্ষিদে নেই। আমার পেটে আর খাবার যাচ্ছেনা। ইচ্ছে করছে ,এই ক্ষুধার্ত মেয়ে যে খাবার সামনে রেখেও খাচ্ছেনা তার দিকে তাকিয়ে থাকতে। আমি সব ভুলে তাকিয়ে আছি। এমন সময় ও বললো-‘তুমি খাওয়া বন্ধ করে আছো কেন ?’ ‘এমনি,খেতে ইচ্ছে করছেনা একা একা।’ ‘ওমা! একি কথা! খাবার শেষ হয়ে এসেছে প্রায় আর এখন বলে কিনা খেতে ইচ্ছে করছেনা একা একা ?’ আমি খানিকটা লজ্জা পেলাম,এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম ও না খেলে আর খাব না। আমার মনের কথা বুঝতে পেরে ও খেতে শুরু করল। আমি হাত স্থির রেখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রশান্তিদায়ক দৃশ্য উপভোগ করতে শুরু করলাম।
৫
বিকেল কারো কাছে এতটা সুন্দর হতে পারে আমার আগে কখনো মনে হয়নি। গাঁড় লাল আভা লেগে আছে সবার চোখেমুখে। সবাই সারি বেঁধে বসে আছে ভাগ্যদেবতার আশীর্বাদের আশায়। সবার সাথে একাত্ব হয়ে আমরাও। পিকনিকের লটারীর ফলাফল ঘোষনা চলছে। আমি টিকিট কিনেছে চারটা। নীপা কিনেছে একটা। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েরা একটু হাড়কিপ্টে টাইপের হয়। যাহোক, অপেক্ষার সময় কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। একে একে বিশটির মধ্যে উনিশটি পুরস্কারের বিজয়ী নির্ধারিত হয়ে গেছে। এবার বিশতম পুরস্কার ঘোষনার পালা। আমার ভেতর উৎকণ্ঠা,চারটা টিকিটের টাকা গচ্চা যাচ্ছে বলে। বিশতম পুরস্কার ঘোষনার সাথে সাথে দেখলাম-নীপা আমার পাশ থেকে দৌড়ে উঠে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম কি ঘটতে চলছে। ফিরে এল হাতে একখানা ছোট্র লাল ফুলের ঝুড়ি নিয়ে। ওর চোখে মুখে বিজয়ের আভা। আমি কখনোই ভাবতে পারিনি আমার এত ভালো লাগবে। আমি যদি একশটা টিকিট কিনেও কোন পুরস্কার না পেতাম এবং শুধু এর বিনিময়ে যদি নীপা কিছু পেত তবেও আমার কোন অতৃপ্তি থাকতোনা।
৬
সব ব্যাপারেই আজমল স্যারের তাড়াহুড়া লেগে থাকে। তিনি ছাত্রছাত্রীদের দৌড়ের উপর রাখতে যতটা পছন্দ করেন পৃথিবীর অন্য কোন কিছুই ততটা পছন্দ করেন না। তাইতো বয়স পয়ত্রিশ পার হতে চললেও বিয়ে করেননি। বোধহয়, মেয়ে মানুষও তাঁর ভীষণ অপছন্দ। আমি নীপার সাথে একপা একপা করে হেঁটে সুন্দর সন্ধ্যাটা অনুভব করছি। বাসে ওঠতে মাইকে ডাকছেন আজমল স্যার। এমন সময় ডাকছেন শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। মনে হয় তাঁর সাথে আমার কোন জাত শত্রুতা আছে! গাড়িতে ওঠে বসা ছাড়া আর কোন উপায় না পেয়ে একসাথে উঠলাম। নীপার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম ও ভীষণ অনিচ্ছায় বসল। আমার মত ওরো হাঁটতে ভালো লাগছিল হয়তো। মনের জোর থাকলেও বুঝতে পারছি শরীর অনেক ক্লান্ত। বসার অল্পক্ষণের মধ্যেই শরীর পুরোপুরি সঁপে দিয়েছি সিটটাতে। যে আলোয় আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। সে আলো এখন বিদায় নিচ্ছে। পরিচিত সেই একই রাস্তা অপরিচিতের খাতায় নাম ওঠাচ্ছে। হায়রে আলো! তোমার উপস্থিতি কতটা প্রয়োজনীয় একটি প্রশান্ত দিনে! আবার সেই তুমিই কতটা মূল্যহীন এ আঁধারে!
অন্ধকারের একটা শক্তি আছে। অন্ধকার মানুষকে কাছে এনে দিতে পারে। বাস চলছে সেই একই রাস্তায়। তবে,ফেরার বেলা নীপাকে কেন জানিনা আরো বেশী কাছের মানুষ মনে হচ্ছে। কিছুদূর যাবার পরও দেখছি নীপা কোন কথা বলছেনা। যাবার সময় আমি চুপচাপ ছিলাম ,এবার ও। জিজ্ঞেস করলাম- ‘কি হয়েছে ?’ ‘মাথাটা একটু ধরেছে।’ বলল ও। আমি কাঁধটা পেতে দিয়ে বললাম-‘চাইলে এখানে মাথা রাখতে পারো,এটা এখনো খালি পড়ে আছে।’ ও একটু হেসে আমার কাঁধে মাথা রাখল। বেশ অবাক হলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু নিজের মধ্যে দ্বিধাও প্রচন্ড। দ্বিধা ঝেড়ে মুখফুটে বললাম-মাথায় হাত বুলিয়ে দিই একটু,ভালোলাগবে। ও কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কাঁধে হেলান দিয়ে আছে। আমি আলতো করে ওর চুলে বিলি কেটে চলছি।
কখন যে চারঘন্টা সময় পার হয়ে গেছে টেরই পাইনি। ক্যাম্পাসে এসে গেছি। এবার নামতে হবে। কিন্তু নামতে ইচ্ছে করছেনা। ইচ্ছে করছে পুরো জীবন এভাবে কাটিয়ে দিই। আমি সিট ছেড়ে দিয়ে নীপাকে নামার জায়গা করে দিলাম। নীপা ধীরপায়ে নামছে। আমি ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। নিয়নের হলুদ আলো ওর পায়ের গোড়ালীতে পড়ে পাদুটো অপূর্ব লাগছে। এমন সুন্দর দুটো পা আমি এর আগে সত্যি কখনো দেখিনি।
৭
পিকনিক শেষ । এবার মিড এর প্রিপারেশন নেয়া দরকার। কিন্তু আমি নিচ্ছিনা। ঝিম ধরে বসে আছি। কেন জানিনা নীপার সাথে গতকাল ঘটে যাওয়া সব ঘটনা মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যাচ্ছে।ক্লাসে সবাই আমাকে বিদ্যার জাহাজ না ভাবলেও ট্রলার প্রকৃতির কিছু একটা ভাবে। এই সুবাদে ক্লাসের প্রায় সবাই আমাকে নিজের ফোন নম্বর দেয় এবং আমারটাও চেয়ে নেয়। এ সুত্র অনুসারেই,নীপার কাছে আমার নম্বর আছে।ওর আমাকে ফোন দেয়ার কোন কারন নেই অবশ্য। যাহোক, কার্যকারন নীতির মুখে ছাঁই ঘসে নীপার ফোল এল রাত বারোটা পনের মিনিটে। আমি ফোন ধরে খানিকক্ষণ চুপ মেরে আছি। মুখে কোন কথা নেই। এখন কিছু বলতে গেলেই গুলিয়ে ফেলবো। এরচেয়ে বরং নীরব থাকাটাই আমার জন্য স্বাচ্ছ্যন্দের। ওপাশ থেকে নীলা বলে যাচ্ছে –শোনোনা, আজি কি হয়েছে ? বললাম-কী ? ও অনর্গল একটার পর একটা কথা বলে যাচ্ছে আর আমি গিলে যাচ্ছি কিন্তু আজমল স্যারের লেকচারের মত কিছুই বুঝতে পারছিনা।
[[পরিশিষ্ট : এভাবে প্রায় রাতেই ফোনে কথা চলল বেশ কমাস। শুধু কথাই নয় একসাথে ঘুরে বেড়ালাম,খেলাম,একে অন্যকে খুব ভালোভাবে জানলাম। মানবীটা সম্পর্কে যখন আমার দূর্বলতা চূড়ান্তে তখন একরাতে ফোন দিয়ে ও কাঁদলো কিছুক্ষণ। আমি পুরুষ মানুষ। পুরুষের কাঁদতে নেই। তবু আমিও ওর সাথে কাঁদলাম কিছুক্ষণ তফাৎ এটুকুই কেউ জানলো না। ওর কান্নাটা আমি আমার অস্তিত্বে ধারণ করে জিজ্ঞেস করলাম-কাঁদছো কেন? ও বলল-“মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।বন্ধু, আমি দূরে চলে গেলে তোমার খারাপ লাগবেনা ?” আমি বললাম-“লাগবেনা, তুমি এখনো আমার বন্ধু আছো,তখনো থাকবে। এতে খারাপা লাগার কি আছে? তোমার কি কোন জঙ্গীর সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে নাকি?” ও হাসল।
কত জঘন্য মিথ্যে যে আমি বলতে পারি সেদিন প্রথম আমি জেনেছিলাম। আর কিইবা করার ছিলো আমার। সেদিনই প্রথম নিজেকে খুব বেশী অসহায় লেগেছিল সমাজের কাছে,বাস্তবতার কাছে। যতটা অসহায় একটি শিশুরও লাগেনা ওর জন্মের সময়। আমি আজো তেমনি অসহায়ই আছি। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। গতবছর,ও অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। স্বামীর সাথে ওখানেই থাকছে। ওর স্বামী জঙ্গী নয়। তবুও আমার সাথে কথা হয়না। আর আমিও একজন বিবাহিত মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইতে পারিনা। ]]
©somewhere in net ltd.