![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নোভা
রুহুল গনি জ্যোতি
‘এই যে নোভা, এই- এ ই যে, এদিকে দেখো-, দেখো, দেখো-, দেখো, তাকাও- । নোভা-, ছোট্ট সোনামনিলে আমার এই যে আমি, দেখি মা তাকাও তো’- এভাবে আরো কত কি বলে মা সুপ্রভা তার ছোট্ট শিশু নোভার দৃষ্টি আকষর্ণের চেষ্টা করেন। কিন্তু নোভার সে দিকে কোন ভ্রক্ষেপ নেই। এক মনে নিজের দু’হাত নিয়ে কি যেন খেলছে সে। আবার যেন খেলছে না। কেমন যেন উদাস উদাস ভাব। পৃথিবীর কারো দিকেই যেন তাকাবার সময় নেই তার।
মা সুপ্রভার বিষয়টি বেশ ক’দিন ধরেই খেয়াল করছেন, তার ছোট্ট সোনামণিটিকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি। কি যেন নেই, ঠিক ধরা যাচ্ছে আবার যাচ্ছেও না -এমন কিছু দেখছে সে এই দেড় বছরের ছোট্ট নোভার মধ্যে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে দৃষ্টিভ্রম নয় তো। আবার ঠিক ঠিকই চোখে পড়ছে।
স্বামী অপূর্বর সঙ্গেও এ নিয়ে প্রায়ই কথা হচ্ছে তার। কিন্তু তারা কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এখন কি করবে তারা। নোভার আসলে কোন সমস্যা নাকি এমনিতেই এমন করছে পরে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
নোভার মা-বাবা দু’জনেই কর্মজীবী। সারাদিন নানা ব্যস্ততায় কেটে যায়। বাসায় বলতে গেলে কাজের মেয়ে জরিনার কাছেই বাচ্চাটার লালন পালনের ভার। মাঝে মাঝে ময়মনসিংহ থেকে সুপ্রভার মা এসে দু’চার দিন কাটিয়ে যান।
সংসারের নানা ব্যস্ততার মাঝেও মা চেষ্টা করেন মেয়ে সুপ্রভার দিকে একটু বিশেষ ভাবে নজর দিতে। তাই, সময় পেলেই ঢাকায় ছুটে আসেন। কিন্তু ইদানিং তার মনেও নোভাকে নিয়ে একই উদ্বেগ জমাট বেঁধে আছে। এসব নিয়ে মেয়েকে কিছু বলতেও তার মনে কেমন যেন দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে। তিনি আসলে এ নিয়ে একটু দ্বিধার মধ্যেই আছেন। ঠিক বুঝতে পারছেন না সমস্যা এই ছোট্ট শিশুটির নাকি তার নিজের।
বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে তার নিজেরই তো কত সমস্যা কি দেখতে কি দেখছেন তার ঠিক নেই। তবে তার কাছে কিছুতেই নোভার বিষয়টি ভাল মনে হচ্ছে না। কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। একদিন মেয়ে- জামাইকে এক সঙ্গে পেয়ে নোভার অস্বাভাবিক আচরণের বিষয়টি বলেই ফেললেন তিনি। বললেন, বাবা তোমরা ওকে একজন ভাল শিশু রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখাও। হয়তো তেমন কিছু নয় তবু একজন ভাল ডাক্তারকে দেখিয়ে নেয়াই ভাল। আল্লাহ না করুন- যদি তেমন কিছু হয় তবে আগে থেকেই চিকিৎসাটাও শুরু করা যাবে হয়তো।
অবশেষে সময় করে একদিন ওরা নোভাকে নিয়ে ছুটলেন দেশের বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. আলতাফ আরাফের কাছে। ডাক্তার নোভাকে অনেকক্ষণ ধরে ভাবে দেখলেন । তার পর বাবা-মা দুজনকেই ডেকে জানালেন, নোভা অটিজম আক্রান্ত। ভাল করে বুঝিয়ে বললেন, ভয় পেলে চলবে না। মন শক্ত করে ধৈর্যের সঙ্গে নোভাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অটিষ্টিক শিশুদের নিয়ে অনেক আশার কথাও বললেন।
অটিজম শব্দটি তখনো এত ব্যাপকভাবে প্রচারিত ছিল না। ফলে ওদের এ রোগ সম্পর্কে বলতে গেলে তেমন কোন ধারণাই ছিল না।
ডাক্তার বললেন- অটিস্টিক শিশুরা অস্বাভাবিক আত্মমগ্ন থাকে। এটি মস্তিস্কের ¯œায়ুগত একটি অব্যবস্থা, যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির যোগাযোগ দক্ষতা, সমাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সামর্থ্য এবং পরিবেশের প্রতি যথাযথ ভাবে সাড়া দেয়ার সামর্থ বাধাগ্রস্থ হয়। অটিজম একটি জন্মগত সমস্যা যা পরবর্তীতে মানসিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে, মাতৃগর্ভে মস্তিস্কের বৃদ্ধি বা পূর্ণতা লাভ বাধাগ্রস্থ হলে শিশুদের অটিজম দেখা দেয় বলে কেউ কেউ ধারণা করেন। সাধারণত অটিষ্টিক শিশুদের বুদ্ধিমত্তা খুবই কম থাকে। কিছু কিছু অটিষ্টিক শিশু গণিত, সংগীত বা ছবি আঁকায় অত্যন্ত পরদর্শী হতে পারে। তবে সেটা নিতান্তই ব্যতিক্রমী ঘটনা। সারা দুনিয়ায় প্রতি হাজারে ২/১ জন অটিষ্টিক শিশু জন্মগ্রহন করে। ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে অটিজম হবার আশংকা মেয়ে শিশুদের ৩ থেকে ৪ গুণ বেশী। সাধারণত শিশুর ১৮ মাস থেকে ২ বছর বয়সের সময় থেকে বাবা মা বুঝতে পারেন যে, শিশুটি স্বাভাবিক নয়। অটিজম আক্রান্ত শিশুর খিঁচুনিও হতে পারে। তাদের শিশু মানসিকরোগ হওয়ার আশংকা অন্য শিশুদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এ জন্য তাদের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সহায়তার প্রয়োজন হয়। অটিস্টিক শিশুরা দেখাশোনা এবং শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাড়াচাড়াতে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখায়।
অটিজমের কারণ সম্পর্কে এখনও কোন নির্দিষ্ট বিষয় চিহ্নিত করা যায়নি। ধারণা করা হয়, জেনেটিক কারণে অটিজম হয়ে থাকে। এছাড়াও খাদ্যাভ্যাস, পরিপাক তন্ত্রের সমস্যা, পারদের বিষক্রিয়া, ভিটামিনের অভাব, গর্ভাবস্থায় মায়ের হাম হওয়া প্রভৃতি কারণে অটিজম হতে পারে বলেও ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তবে, এর কোনটাই প্রমাণিত নয়। অটিজমের কারণ চিহ্নিত করার জন্য গবেষণা এখনও চলছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, যদি পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ দেয়া হয় তবে, একজন অটিজম শিশুরও রয়েছে সাধারণ শিশুর মতো অফুরন্ত সম্ভাবনা। প্রধান যে তিনটি সমস্যা সব অটিস্টিক শিশুর মধ্যে দেখা যায় তা হল -স্বাভাবিক সামজিক আচরণগত সমস্যা, মৌখিক ও অমৌখিক যোগাযোগ সমস্যা, পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ এবং ক্রিয়াকলাপ সমস্যা।
যেহেতু অটিজমের একক কোনো বিশেষ কারণ নেই তাই, এর আরোগ্য লাভ কোনো সহজ কাজ নয়। এ রোগ থেকে মুক্তির জন্য একটি সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি দরকার- যার মধ্যে থাকবে ওষুধ, থেরাপি, বিশেষ শিক্ষা, খাবার ব্যবস্থাপনা, ভিটামিন, এনজাইম এবং হরমোনজনিত বিষয়ে পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু।
ডাক্তারের কাছে এসব শোনার পর সেদিন সুপ্রভা বেশ ভেঙ্গে পড়েছিলেন। যদিও পরে নিজেকে সামলে নেন। এর পর থেকেই শুরু হয় মেয়েকে নিয়ে তাদের জীবন সংগ্রাম। ডাক্তারের পরামর্শেই পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন সুপ্রভা। অপূর্বও তার কর্মস্থল পরিবর্তন করে পোষ্টিং নিয়ে এমন জায়গায় চলে এলেন যেখানে কাজ করে মেয়েকে সময় দিতে পারবে ঠিকই তবে সেইভাবে আর ক্যারিয়ার হবে না। শুরু হলো মেয়েকে নিয়ে তাদের প্রাণান্তকর কষ্টের সাধনা ও জীবন সংগ্রাম। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আজ তারা সবকিছর সঙ্গেই মানিয়ে নিয়েছেন। সেদিন তাদের সেই সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল আজ আর সে বিষয়ে তাদের মনে অন্তত কোন সন্দেহ নেই।
সুপ্রভা এর মধ্যেই জেনেছেন যে, অটিজম আক্রান্ত শিশুকে অর্থপূর্ণভাবে কথা বলা, অন্যের সঙ্গে কমিউনিকেট করা, অন্যের ডাকে সাড়া দেয়া, অন্যের সঙ্গে আইকন্ট্যাক্ট করা, গ্রস মোটর অ্যাক্টিভিটি (হাঁটা, দৌড়ানো, হামাগুড়ি দেয়া, লাফানো, এক পায়ে লাফানো ইত্যাদি), ফাইন মোটর অ্যাক্টিভিটি (আঙুল দিয়ে কোন বস্তু যেমন- কলম, পেন্সিল ইত্যাদি) ঠিকভাবে ধরা, বোতাম লাগানো, কাগজ বা কাপড় ভাঁজ করা, হাত রগড়ে ধোয়া, হাত থেকে পানি ঝাড়া) ইত্যাদি কাজ শেখানো যে কি অকল্পনীয় ধৈর্য্য, সময় ও প্রাণান্তকর শ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার। স্বাভাবিক শিশুরা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকেই এতো স্বতঃফূর্তভাবে এসব শেখে যে, এই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখী না হলে তিনি কখনো কল্পনাও করতে পারতেন না যে এগুলো কোন বিশেষ কাজ কিনা আর এসব শেখাতেই বা হবে কেন?
নোভাকে কথা শেখানোর জন্য অনর্গল গল্প বলে যেতে হতো, অন্য কারো সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের সংলাপ আদানপ্রদানের পুনরাবৃত্তি অভিনয় করে দেখাতে হতো বার বার, শত বার, কখনো তা হাজার, লক্ষ বারও করতে হয়েছে।
ধীরে ধীরে ওদের জানা হয়েছে যে নোভা মাঝারি ধরণের অটিজমের শিকার। চেষ্টা করলে যাকে নিয়ে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। ফলে ওরা আরো বেশী করে আশায় বুক বেঁধেছেন।
নোভার আগ্রহ অনুযায়ী খেলনা নির্বাচন করা হতো, চারপাশের জীবজড় নির্বিশেষে সবার মুখে সংলাপ বসিয়ে গল্প বলে যেতে হতো। মাঝে মাঝে খুব হতাশ মনে হতো নিজেকে। এসব কাজ এত বিরক্তিকর- একঘেয়ে লাগে আর এ ক্ষেত্রে সাফল্য ও অগ্রগতি এত ধীরে ধীরে হয় যে কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। প্রতিদিন অন্তত আধাঘন্টা ধরে তাকে পেন্সিল ধরে লেখা শেখানোর চেষ্টা করতে হয়েছে। পেন্সিলটা শুধু ধরা শিখতেই তার বছর খানেক লেগে গেছে। এমনি ধরনের অসংখ্য ছোটখাট দৈনন্দিন কাজ পরম ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে শেখাতে হয়েছে তাকে। এসব শেখানোর সময় সবচেয়ে কঠিন কাজটা হলো তার মনোযোগ আর দৃষ্টি ধরে রাখার জন্য অনর্গল তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এমনভাবে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কথা বলে যাওয়া। সে এক নিরন্তর কষ্টের অধ্যবসায়। যার সাফল্য খুব সহজে চোখে পড়ে না। তার পরও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিনের পর দিন চালিয়ে যেতে হয়।
নোভাকে নিয়ে ওদের বড় কোন স্বপ্ন নেই, শুধু মেয়েটা যেন কিছুটা হলেও স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের আর দশটি শিশুর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে জীবনটাকে চালিয়ে নিতে পারে এইটুকুই চাওয়া। আজ ওদের বিশ্বাস এইটুকু সাফল্য নোভামণি পাবেই পাবে।
©somewhere in net ltd.