নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাধারণ একজন মানুষের কথা

রীফাত

রীফাত › বিস্তারিত পোস্টঃ

সহোদর

১৬ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১২:৫৫

অ্যাডাম ছোটবেলা থেকে শহরে বড় হয়েছে। আবদুল তার চাচাতো ভাই। দুইজনের বয়সই কাছাকাছি। অ্যাডাম স্ট্যান্ডার্ড ফাইভ এ পড়ছে। আর আবদুল ক্লাস ফাইভ এ।
মাঝে মাঝে আবদুলরা ঢাকায় বেড়াতে আসে। অ্যাডাম মনে করে আবদুল একটা খ্যাত। ও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে না, গ্রাম্য ভাষায় টেনেটেনে বিদঘুটে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। অ্যাডামের খুব হাসি পায়। আর অ্যাডাম তো আজকাল বাংলা বলা ছেড়েই দিয়েছে। মা বলেছে, বাংলা না জানলেও চলবে, কিন্তু ইংলিশ এ তুখোড় হতে হবে। আর আবদুলের পেটে বোমা মারলেও ইংলিশ বের হবে না।
ওইদিকে আবদুলের মা, মানে অ্যাডামের চাচীর ছেলেকে নিয়ে খুব গর্ব। ছেলে স্কুলে ফার্স্ট বয়। পিএসসি’তে গোল্ডেন ফাইভ তো পাবেই, বৃত্তিও পাবে। আবদুলের মা ছেলেকে নিয়ে বড় ভাবীর সাথে খুব গর্ব করে কথা বলেন। এইদিকে অ্যাডামের রোল নম্বর আবার দশের ঘরের বাইরে। আরেকজনের ছেলেকে নিয়ে ভালো ভালো কথা কত সহ্য করা যায়! অ্যাডামের মায়ের মাঝে মাঝে ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে। এই গ্রাম্য মহিলাকে কে বুঝাবে যে, শহরের স্কুলে কত কম্পিটিশন। গ্রামে কি কোন পড়ালেখা আছে নাকি। না আছে ভালো স্কুল, না ভালো টিচার, না ভালো স্টুডেন্ট। আর অ্যাডামদের স্কুলে কী মারাত্বক কম্পিটিশন। এখানে ২০ এর মধ্যে থাকা আর গ্রামের স্কুলে ফার্স্ট হওয়া সমান কথা।
অ্যাডাম অবশ্য আবদুলকে পছন্দও করে। যদি শুদ্ধ বলতে গিয়েও সে মাঝে মাঝে পানিকে হানি বলে ফেলে মুখ ফসকে, তারপরও ছেলেটা মজার আছে। নানা বিষয়ে ছেলেটা এক্সপার্ট। সে চাইলে যে কোন পশু-পাখির ডাক দিতে পারে। অ্যাডামের সবচেয়ে ভালো লাগে আবদুল যখন ছাগলের মত করে ম্যা ম্যা ডাক দেয়। একেবারে নিখুঁত!
আবদুলরা যখন চলে যায় তখন কিছুদিন অ্যাডামের উপর ঝড় বয়ে যায়। অ্যাডামের মা তাকে ক্লাসের রেজাল্ট এর জন্য নানা বকা-বাদ্য করেন। তখন অ্যাডাম মনে মনে আবদুলকে ইংরেজিতে গালি দেয় (বাংলা গালি খ্যাত শোনায়, ইংরেজি গালির মধ্যেও একটা স্মার্টনেস আছে)। অ্যাডাম ভাবে, এই গ্রাম্য ইঁদুরটা তাদের বাসায় আসার কারণেই তাকে শুধু শুধু বকা খেতে হচ্ছে।
ওইদিকে আবদুল বাড়ি গিয়ে অ্যাডামের জন্য খুব মন খারাপ করেছে। আবদুল অ্যাডামকে খুব পছন্দ করে। আবদুল তার বন্ধুদের সাথে ভাইকে নিয়ে গল্প করে, এতটুকু একটা ছেলে, কিন্তু ইংরেজির ওস্তাদ! অ্যাডামকে নিয়ে গল্প করতে করতে আবদুলের ছাতি একটু যেন ফুলে উঠে। রাতে বাসায় পড়তে বসে আবদুল এখন প্রথম যে বইটি হাতে নেয়, তার নাম English for Today। আবদুল ইংরেজি কিছুই পারে না। আবদুলকেও একদিন অ্যাডামের মত ইংরেজিতে দক্ষ হতে হবে।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। আবদুল প্রাইমারীর গন্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে উঠেছে। তার আকাশটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। সামনে আবদুলের জেএসসি পরীক্ষা। মায়ের কড়া নজরদারি আবদুলের উপর। মোটামুটি একরকম গৃহবন্দি জীবন যাপন করছে বেচারা। ঠিক সেই সময়টায় অ্যাডামরা সপরিবারে আবদুলদের বাড়িতে বেড়াতে এল। অ্যাডামকে পেয়ে আবদুলের খুশি কে দেখে! অ্যাডামটা দেখতে দেখতে কেমন বড় হয়ে গেল। শহরের ছেলে-পেলে তো। ঠোঁটের নীচে কালো গোঁফের রেখা। ফর্সা মুখে সদ্য গজানো গোঁফে অ্যাডামকে মন্দ লাগছে না। অ্যাডামও বুঝি শহরের জীবনে একটু হাঁপিয়ে উঠেছে। কিংবা গ্রামে এলে হয়ত মাটির কিছু স্পর্শে সবার মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়ত আসে। অ্যাডামকে এখন আর আবদুলের দূরের কেউ মনে হয় না। শুধু ভাই না, বন্ধুও মনে হয়। অ্যাডামের সাথে সব সময়ই হয় ল্যাপটপ নয়ত স্মার্টফোন। অ্যাডামই আবদুলকে প্রথম কম্পিউটারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রথমদিন তো আবদুল ভারি লজ্জায় পড়ে গেল। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না কিভাবে ল্যাপটপ চালু করবে। সে নিয়ে অ্যাডামের একচোট হাসি অবশ্য সইতে হল। কয়েকদিনের আবদুল কম্পিউটারে বেশ দক্ষ হয়ে গেল। টিভিতে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পনির ইন্টারনেট অফারের কথা সে আগে শুনেছে। কিন্তু কখনো ইন্টারনেট ব্যবহার করে নি। মাকে একবার অবশ্য ইন্টারনেট ফোনের কথা বলেছিল। ফোন জুটে নি, জুটেছে কিছু গাল-মন্দ। আবদুল দেখল ইন্টারনেটে তো দারুণ মজা। তার পৃথিবীটা যেন আরো বড় হয়ে গেল। এক সময় অ্যাডামদের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এল। বিদায় নেবার বেলায় দুজনেরই সাংঘাতিক মন খারাপ। আবদুল জানাল সে ইন্টারনেটে যোগাযোগ করবে।
আবদুলদের স্কুলের লাইব্রেরিতে কতগুলো কম্পিউটার পড়ে আছে। বোধ হয় সরকার থেকে পাওয়া। আবদুল অনেক বলে কয়ে একটা কম্পিউটার চালু করতে পারল। কিভাবে কিভাবে যেন একদিন সে কম্পিউটারে ইন্টারনেটও লেগে গেল। আবদুল ইন্টারনেটে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে লাগল। শেষ যেবার সে ঢাকা গিয়েছিল, ওই সময় ঢাকাকে কত বড় ও দূরের একটা শহরই না তার মনে হয়েছিল। এখন আর ঢাকাকে তার খুব দূরের কোন শহর মনে হয় না। লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকার দূরত্ব তার কাছে মাত্র এক ক্লিকের। ইন্টারনেট আর কম্পিউটারে ডুবে থাকা যে তার জন্য শুধু পৃথিবীর দুয়ার খুলে দিয়েছে- তা না, মায়ের মুখের আগলও খুলে দিয়েছে। অতিরিক্ত কম্পিউটার আসক্তিতে আবদুল জেএসসি’তে প্রত্যাশিত ফল পায় নি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও সে কম্পিউটারে কিছু বিরতি দিল। এসএসসি, এইচএসসি দুটোই লক্ষ্মীপুর থেকে পাশ করল। রেজাল্টও খুব ভালো হল।
ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ঢাকায় ছুটতে হল। ঢাকায় গিয়ে উঠল অ্যাডামদের বাসায়। অ্যাডামটা কেমন যেন বদলে গিয়েছে। চুল-টুল এলোমেলো, শুকিয়ে কাঠ, চোখ দুটো সব সময় লাল হয়ে থাকে। অ্যাডাম এ লেভেল-ও লেভেল এ খুব ভালো ফল নাকি করেনি। বড় চাচীর সাথে অ্যাডামের সারাদিনই চিৎকার-চেঁচামেচি লেগে আছে। আবদুলের বড় খারাপ লাগে। ফিসফাসে শুনতে পায় অ্যাডাম নাকি ইয়াবা আসক্ত। আবদুলের অবশ্য ওসব চিন্তা করে সময় নষ্ট করার মত আদিখ্যেতার সময় নেই। সে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ ইউনিটে আবদুল চান্স পেয়ে যায়। গ ইউনিটে চান্স পেতে হলে ইংরেজিতে খুব ভাল করতে হয়। আবদুল অ্যাডামের প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধ করে। ইংরেজিতে এক সময় কী ভয়ানক দুর্বলই না ছিল আবদুল! অ্যাডামকে না দেখলে সে হয়ত কোনদিনও জানত না সে ইংরেজিতে কত দুর্বল ছিল।
অন্যদিকে অ্যাডামেরও বিদেশ যাওয়ার কিছু হল না। প্রেম-ট্রেমও কিছু করত বোধ হয়। সে প্রেমও নেই। নেশার কারণে প্রেম ভেঙেছে নাকি প্রেম ভাঙাতে নেশায় ডুবেছে কে জানে। বড় চাচার ব্যবসাও ভালো যাচ্ছে না। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সবচেয়ে নামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মত খরচ কুলানোর সামর্থ্য বড় চাচার হল না। খরচ কিছু কম- এরকম মোটামুটি মানের একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডামকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল অ্যাডামকে। চিন্তায়-হতাশায় বড় চাচীও কেমন যেন বদলে গিয়েছেন। যে মানুষটা আগে তীর্যক বাক্যবাণে আবদুলকে বিদ্ধ করতেন, তাকেই আবদুলের বড় আপন মনে হয়। এ মানুষটাকে আবদুল চিনে না, চিনতেও চায় না। তার মনে হল সে এই পরিবারের জন্য কিছু করতে চায়। কিন্তু কী করবে ভেবে কূল পায় না আবদুল।
আবদুল একদিন জোর করে ধরে-বেঁধে খুব ভোরে আলো ফোটার আগেই অ্যাডামকে নিয়ে বাসা থেকে বের হল। এতদিনে এই শহরে অ্যাডামের বাস, তবু যেন এ শহর ওর খুব অচেনা। তাকে এই শহরটা চিনতে হচ্ছে এমন একজনের কাছ থেকে, যে এই শহরে নতুন। রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম এ মানুষ ঘুমিয়ে আছে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। কী শান্তির ঘুম! এত শান্তির ঘুম অ্যাডাম কতকাল যে ঘুমায় নি। অ্যাডামের বড় ঈর্ষা হয় এই মানুষগুলোর প্রতি। একটু একটু করে দিনের আলো ফুটছে। প্রথম প্রহরের শীত শীত আলোয় কী যেন জাদু আছে। মানুষগুলোও একে একে জেগে উঠছে। চা-ওয়ালারা হাঁকডাক শুরু করেছে। অ্যাডামের খুব চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। এরকম ভয়ংকর আসক্তি কেবল তার ইয়াবাতেই হয়। কই চা এর জন্য তো কখনো তার এরকম আসক্তি হয় নি। অ্যাডাম আবদুলকে বলে, চা খাব রে। দাঁড়া, দিচ্ছি- বলে আবদুল পকেটে হাত দেয়। পকেট থেকে বের হয়ে আসে কয়েকটি ইয়াবার বড়ি। আবদুল বলল, তোর হাতে দুইটা অপশন- ইয়াবা কিংবা নোংরা চা, কোনটা নিবি। চা-ওয়ালার দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে অ্যাডামের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেয়।
অ্যাডাম হাত বাড়িয়ে দেয়, কার দিকে হাত বাড়িয়েছে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। আবদুলের দিকে নাকি চা-ওয়ালার দিকে। অ্যাডামের চোখে শিশির বিন্দু। ভোরের আলোতে শিশির কণা চকচক করছে। ঘাসে এবং চোখে। আবদুল ভাবছে, ঘাস আর চোখ কি সহোদর, যেমন আবদুল আর অ্যাডাম।
রাত কেটে যাচ্ছে, হাজার বছরের পুরনো রাত। দিনের আলো বাড়ছে। হাজার বছরের আশার আলো।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১:০০

চাঁদগাজী বলেছেন:


আ্যাডাম তো সবার আগে পৃথিবীতে এসেছেন, এখনো ৫ম শ্রেণীতে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.