নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

রক্তের ঘ্রাণ!

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৫১

-‘তোদের বংশ হইছে আকাট মূর্খ! এই বংশের পোলার হইব পড়ালেহা। হইব না। এই আমি কইয়া রাখলাম। তোরা করবি হালচাষ। গোয়ালভর্তি গোবর সাফ করবি’।



ফোর ফাইভে পড়া আমার তখন পড়ালেখায় তীব্র অনীহা। আমাকে লক্ষ্য করে তাই আম্মার এমন বাণী বর্ষণ ছিল নিত্যকার ঘটনা। আমার কারণে আমার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার! রেহাই নেই। এই বংশের ওপর আম্মার তীব্র ক্ষোভ। বিয়ের সময় ঘটকের ডাহা সব মিথ্যা কথায় আমার নানা-নানী বিভ্রান্ত হয়েছিলেন বলেই এমন গোয়ার-গোবিন্দ, বকলম, মূর্খ বংশে আম্মাকে আসতে হয়েছে বলে আম্মার আফসোসের সীমা নেই। ঘটনা যেহেতু ঘটেই গেছে, এখন কি আর করা! ছেলে দুইটাকে পড়াশোনা করিয়ে এই বংশের ধুলা-বালি, কাদা-জল মুক্ত করতে পারলেই শান্তি! কিন্তু আম্মার সেই প্রচেষ্টা প্রায়শই সীমহীন শংকার মুখে পড়ে। পড়াশোনা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। বরং খাঁখাঁ রোদের দুপুর বেলায় যখন চাষিরা ক্ষেতের আলে বসে কাজের অবসরে কাঁচা লংকা দিয়ে গপগপ করে ভাত খায়, আমার কাছে এ ঢের লোভনীয়!



আম্মার অবশ্য চেষ্টার অন্ত নেই। বাবা-সোনা-মানিক বলে বোঝানো থেকে শুরু করে চটের বস্তার সাথে চকচকে ধারালো দা-বটি নিয়ে কল্লা কেটে সেই বস্তায় ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার হুমকী পর্যন্ত! কোন চেষ্টাই আম্মা কখনো বাদ রাখেন নি। কিন্তু বিশেষ এক প্রানীর লেজ যেমন কখনো সোজা হয় না, তেমনি এই বংশের পোলাপানের পড়ালেখার স্বপ্ন দেখাও বৃথা! আম্মার চেষ্টা, আফসোস এবং বকাঝকা তাই চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তেই থাকে!



সেদিন ভোরে ঘুমঘুম চোখে বাড়ি থেকে বের হয়েছি মক্তবে যাব। কিন্তু গেছি ফকিরদের জঙ্গলে। সেখানে আরও কয়েকজনের সাথে বিশাল মার্বেল খেলার ম্যাচ। আমাদের সকলের বগলের তলে আমপারা আর রেহাল। মাথায় টুপি। আমরা মার্বেল খেলার উত্তেজনায় নিমগ্ন। দিন-দুনিয়ার কোন খেয়াল নেই। হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কারো শক্ত হাতের বজ্র আঁটুনি আর পিঠের উপর কাঁচা ডালের শপাং শব্দে ফিরে তাকাই!



আম্মা! সাক্ষাৎ যমদূত হলেও বোধহয় এর চেয়ে ঢের ভালো ছিল!



ঘরের দরোজা আটকে মনের সুখে পিটিয়ে, দুনিয়ার যত গালমন্দ করে, চিৎকার করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেও যখন আমার কাছ থেকে কোন ধরনের বিদ্যাসাগর হওয়া সংক্রান্ত আশ্বাস পেলেন না, তখন সেই দা-বটি আর বস্তা থেরাপি শুরু। আজ আমার ‘কল্লা’ কেটে বস্তায় ভরে যদি নদীতে না ভাসাচ্ছেন, তাহলে তিনি সর্দার বংশের মেয়েই না।



দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ঢের ভালো!



আমার কান তখন শেয়ালের মত উৎকর্ণ! বু কই? বু! এখনো আসেনা কেন! ত্রাতা! আমরা আমাদের দাদীকে ‘বু’ বলে ডাকি। আমার হাতভর্তি তখন বড় বড় ঘামাচি। সেই ঘামাচি মনের সুখে গায়ের জোরে চুলকালে ঘামাচির মাথা ফেটে টলটলে রক্তফোঁটা বের হয়। বু কোথাও ঘুরতে গেছিল। কেবলমাত্র বাড়িতে ঢুকেছে। তার গায়ের গন্ধ শুকে আমি বলে দিতে পারি। আমি সমানে আমার হাতের ঘামাচিগুলো চুলকাতে লাগলাম। আম্মা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন, ‘ঘটনা কি? এই ছেলে করে কি!’



আমার হাতের কনুই থেকে কব্জি অবধি তখন ফোঁটা ফোঁটা রক্তে সয়লাব। আচমকা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার, ‘ও বু... বু রে... ও বু... আম্মায় আমারে মাইরা বটি দিয়া হাত কাইটটা ফালাইছে। ও বু... খালি রক্ত! ও বু!!



ঘরের দরজায় দড়াম দড়াম লাথি! আম্মার অবাক চোখ জড়সড়। দরোজা খুলতেই বু শক্ত হাতে আম্মার চুলের মুঠি ধরে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার, ‘দাসীর ঘরের দাসী, তোর এত্তবড় সাহস! তুই আমার নাতীর গা’য় হাত দেস! তোর এত্তবড় সাহস। তোর হাত আইজকা কাইটটা ফালামু! দেহি কেডা কি কয়’!



আমি দৌড়ে গিয়ে বু’র আঁচলের তলায় লুকাই। কান্নার ভান করতে করতে সুযোগ বুঝে আম্মার ভীতসন্ত্রস্ত, হতভম্ব চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাদতেই চোখ টিপে দেই! বুঝছ মজা! আর মারবা!!



বু আমাকে তার বাকা শরীরে আদরে মমতায় থই থই কোলটাতে তুলে নেয়। তারপর তার চিড়া মোয়ার টিনের কৌটা খুলে মোয়া খেতে দেয়। তারপর আমাকে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হয়। আমার মা তখন ঘরের দাওয়ায় আঁচলে মুখ লুকিয়ে আক্ষেপে, হতাশায় তার যক্ষ্মের ধন, স্বপ্নের চাবিকাঠি পুত্রধনের তার দাদীর ‘লাই’ পেয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া দেখে নীরবে চোখের জল ফেলেন। এই বংশে বিয়ে করে জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেলো।



বু তার বৃদ্ধ-কোঁচকানো হাতে আমার তুলতুলে কচি হাতখানা শক্ত করে ধরে উঠানের কোনা দিয়ে রাস্তায় নামেন, আর আম্মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, ‘এহ আইছে! লন্ডন পাস পণ্ডিতের ঝী পণ্ডিত! তোর লন্ডন পাশের খেতা পুড়ি। আমার নাতীর শইলে আর একটা হাত দিলে হাত কুচিকুচি কইরা কাইটটা হাঁস-মুরগীরে খাওয়ামু। তোর এত্ত বড় সাহস! তুই আমার নাতীর শইলে হাত দ্যাস। আমার নাতীর শইলে হাত দিলে সেই ব্যাথা আমার শইলে লাগে! তুই বুঝস দাসীর ঘরের দাসী! আমার নাতীর পড়ালেখার দরকার নাই। আমার নাতীরে চাইরখান গরু কিন্না দিমু, সে হালচাষ কইরা খাইব! তোর কি? আমার নাতীরে মাইরা জজ বেরিস্টার বানাবি? তোর জজ ব্যারিস্টার আমি পাও দিয়াও পুছি না। থুঃ থুঃ মারি... থুঃ থুঃ...’



আমি বু’র অপার মমতা মাখা পানের গন্ধ ভরা আঁচলের ভেতর আরও খানিকটা ঢুকে যাই। বু তার দাঁতহীন ফোকলা দাঁতে হাসে। তার মুখভর্তি পান। পানের রসে টুকটুকে লাল ঠোঁট। আমি বু’র গলা জড়িয়ে ধরে খুব সাবধানে, বু’র চোখ এড়িয়ে, বিজয়ীর ভঙ্গীতে আম্মার দিকে তাকিয়ে আরেকবার চোখ টিপি। আমাকে পৃথিবীর সব স্নেহ, সব আদর, সব মমতা, সব ভালোবাসা মেখে চুমু খান। সেই চুমু তার রক্তের, তার আত্মার।



আমি বু’র গায়ের গন্ধে ঘুমিয়ে পড়ি। বু ঘুমন্ত আমাকে কোলে নিয়ে পাড়ার আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে হাঁটতে থাকেন। আর সেই ঘুমন্ত আমার সাথেই কথা বলতে থাকেন, ‘হোন ভাই, মায়ের লগে বেদ্দপি করতে অয়না, মায়ের কথা শোনতে অয়। মায় কি আর খারাপ কিছু কয়?’



সেই কথা শোনার সময় কই আমার? আমি তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মমতা আর ভালোবাসার গন্ধে মাখামাখি হয়ে স্বপ্নের দেশে।

-----------------------------

বু মারা গেছেন প্রায় বছর দুই। তারআগেও ঘরে পড়েছিলেন প্রায় দশ বছর। কিন্তু সেই মমতারা, সেই ভালবাসারা, সেই পান খাওয়া ফোকলা মুখ, সেই গলা, সেই গায়ের গন্ধ এখনো ঠিক তেমনি আছে, বুকের ভেতর। ঠিক তেমনি...



তেমনি রবে...

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০৪

আসফি আজাদ বলেছেন: +++

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৫৯

সাদাত হোসাইন বলেছেন: :)

২| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:১৯

একাকী বালক বলেছেন: "দরোজা খুলতেই বু শক্ত হাতে আম্মার চুলের মুঠি ধরে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার, ‘দাসীর ঘরের দাসী, তোর এত্তবড় সাহস! তুই আমার নাতীর গা’য় হাত দেস! তোর এত্তবড় সাহস। তোর হাত আইজকা কাইটটা ফালামু! দেহি কেডা কি কয়’!"

>>> শ্বাশুড়ী দ্বারা বউ নির্যাতন।

__________________________________


আমি বু’র গলা জড়িয়ে ধরে খুব সাবধানে, বু’র চোখ এড়িয়ে, বিজয়ীর ভঙ্গীতে আম্মার দিকে তাকিয়ে আরেকবার চোখ টিপি।

>>> ফোর ফাইভে পড়া অবস্থায় চোখ টিপা শিখছিলেন। বাহ বেশ বেশ।

________________________________________


মোটেই ভাল লাগল না পুরা ব্যাপারগুলা। গালির তুবরি ভালই ছুটট মনে হয়।

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০০

সাদাত হোসাইন বলেছেন: :)

৩| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৯

ধুম্রজ্বাল বলেছেন: মায়ের শাসন আর বু'র যত্ন বৃথা হয়নি। আপনার লেখাতে তাই মনে হল

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০০

সাদাত হোসাইন বলেছেন: :)

৪| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:০৩

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: তেমনি রবে...আজীবন।

ভালো লেগেছে, সাদাত।

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০০

সাদাত হোসাইন বলেছেন: :)

৫| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ২:১২

মনে নাই বলেছেন: ছোটবেলায় মা যখন আমারে পিটাইতো তখন দুনিয়ার এমন কোন শক্তি ছিলোনা সামনে এসে দাড়ায়। আমারও ছিলো মা'র মত জেদ, যতই পিটাক না কেন, আমি যেটা করবনা বলেছি সেটা কিছুতেই করি নাই।
তবে হ্যা দাদা বাসায় থাকতে মা/বাবা কেউই আমাদের মারার সাহস দেখায়নি কোনদিন।

আপনার কাহিনী ভালো লাগলো, গালাগালিগুলো স্পেসিফিক না হলে হয়তো আরো ভালো লাগত।

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০১

সাদাত হোসাইন বলেছেন: :)

৬| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৩৩

আফসিন তৃষা বলেছেন: বাহ :)
আমার নাতীর পড়ালেখার দরকার নাই। আমার নাতীরে চাইরখান গরু কিন্না দিমু, সে হালচাষ কইরা খাইব!

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০১

সাদাত হোসাইন বলেছেন: :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.