নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কিছু কথাবার্তা

আমার চিন্তাভাবনা

সাইমুম পারভেজ

[email protected]

সাইমুম পারভেজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ক্ষুধা

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৫:২২



অনার্স পাশ করার পরই কেমন করে জানি একটা চাকরি জুটিয়ে ফেললাম। ছাত্র হিসেবে খুব একটা ভালো ছিলাম না। কিন্তু যে চাকরিতে ঢুকলাম সেখানে খুব একটা ভালো রেজাল্টের দরকারও ছিলো না। বেসরকারি প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং অফিস। কার কাছে কিভাবে মাল গছাতে হবে, কোম্পানির বিক্রি বাড়াতে হবে, বিক্রেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা, সুন্দর করে কথাবার্তা বলা এসবই আমার কাজ। মাস শেষে হাজার দশেক টাকার বেতন। সকালে আসি সন্ধ্যায় যাই। অফিসে আসতে ইচ্ছা না হলে বলি গুরুতর অসুস্থ। ডুব দি চার পাঁচ দিনের মত।



এই ডুব দেয়া সময়গুলোতেই এ গল্পটার কথা প্রথম শোনা। যে গল্পটা এখন বলতে চাচ্ছি। ডুব দেয়া সময়ের প্রথম দিনটা আমি বাড়িতেই কাটাই। ঘুম থেকে উঠি ৯ টার দিকে। তারপর আবার ঘুমাই। আসলে প্রথমে যে এই ৯ টার সময় উঠলাম,সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়। কারণ তখনই আমি ঠিক করি আমি অফিস যাবো না। বসকে একটা এসএমএস পাঠিয়ে দি। বস কল ব্যাক করলে কুঁই কুঁই করে শরীর খারাপের ভান করি। ঘুম ভাঙা গলায় অভিনয়টা মোটামুটি উতরে যায়। অথবা ওপ্রান্তের লোকটা হয়তো বুঝতে পারে আমার অভিনয়। যাই হোক,ফলাফলটা এই যে আমি অফিস যাই না। সেদিন আবার ঘুমাই। ১২টায় উঠি। প্রথমদিন আমার সিনেমা দিবস। একটানা ৩-৪টা সিনেমা দেখি। দ্বিতীয় দিন আর ঘরের মধ্যে থাকতে ইচ্ছে করেনা। তখন বাইরে যেতে হয়।



সেবার ডুব দেয়ার তৃতীয় দিনে কামালের সাথে আমার দেখা। চারুকলার সামনের গেটে একটা সিগারেট ধরানোর জন্য থেমেছি। দড়ির আগায় আগুন। আমি টান দিয়ে আগুনটা আামার সিগারেটে নেয়ার চেষ্টা করছি। এমন সময়ই কামাল ডাক দিলো।



‘ কি সাইমুম ভাই। কি করেন? আমারে একটা সিগারেট কিনা দেন।’



কামালের আয় আমার চাইতে বেশি। কিন্তু বরাবরই চা, সিগারেট তো দূরের কথা একসাথে ভাত খাইলেও আমাকেই তার বিল টানতে হয়। এ আচরণ আমাকে অবশ্য খুব একটা বিরক্ত করেনা। কারণ বিল দেয়ার মধ্যে এক ধরণের কর্তৃত্ব কাজ করে। আর আমি সেটা পছন্দ করি।



‘ আবার অফিস বাদ দিসেন। কখন যে চাকরিটা যাইবো আপনার। মিয়া...।’



শেষের মিয়া শব্দটা টেনে টেনে হাসি আর আমার জন্য করুণার একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করে সিগারেটটা ধরালো কামাল। অথচ আমি নিশ্চিত আমি যে অফিস ফাঁকি দিয়েছি, হঠাৎ করে ওর সাথে দেখা হয়েছে এতে কিন্তু কামাল খুশীই হয়েছে। ও যে নিজে খুব একটা ফাঁকিবাজ তা কিন্তু নয়। তাছাড়া স্বভাবেও কামাল বেশ লাজুক। খুব একটা কথাবার্তা বলেনা। কিন্তু কি কারণে জানিনা, ও আমার সাথে কথাবার্তা ভালোই বলে। এ শহরে এসে তার কোথায় কি অসুবিধা, শহরের গতির সাথে তার তাল মেলাতে না পারা, অথবা তাল মেলাতে পারিনা একথা বলার রোমান্টিকতা,বন্ধুদের গালিগালাজ,বান্ধবীর জন্য চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস - সব কিছুই কি এক অজানা কারণে সে আমাকে বলে। একবারে নয়। একটু একটু করে। একটু একটু করেই তার কথার গাড়ি এগিয়ে যায়। চারুকলার পাশে যেখানে একটা ক্যান্টিন ছিলো একসময়, সেখানে পড়ে থাকা একটা স্লাবের উপর বসে। অথবা পুকুরের পাড়ে , যে পুকুরের কথা উঠলেই কামাল বিরক্তির স্বরে বলে, শালার পুকুরে পানি নেই। তার এখনো বিয়ে হয়নি, তারপরও গার্লফ্রেণ্ডকেও অনেকে বউ বলে। আমার জানা মতে তার কোন গার্লফ্রেন্ডও নেই। তাছাড়া একটা পুকুরের সাথে সম্পর্ক পাতানোটাও একটা জটিল ব্যাপার। তাই কিভাবে পুকুর তার শালা হলো তা কখনোই বুঝে উঠিনা। অবশ্য কামালের সম্পর্ক নিয়ে আমি কখনো প্রশ্ন তুলিনা। আর প্রশ্ন তুলি না হয়তো তাই তার ভেতরে আমার ব্যাপারে একটা নির্ভরতার জন্ম দেয়, অন্তত তার কথা তার গল্প যে আমি বিশ্বাস করি অথবা বিশ্বাস না করলেও মন দিয়ে শুনি এ ব্যাপারটা সে বুঝতে পারে। আর বুঝতে পারে বলেই সে আমার কাছ থেকে সিগারেট খায়, আমাকে তার নানা দুঃখ বেদনা আর চাপা ক্রোধের কথা বলে। আমরা না থাকা ক্যান্টিনের পাশে বসে কাকের আবহ সঙ্গীতের সাথে তাল মিলিয়ে নানা কথা বলি। আসলে কামালই বলে, আর আমি শুনি। যেহেতু আমি আর কামালই সেখানে বসে থাকি, তাই অন্য কারো শোনার সম্ভাবনা কম থাকে। যদিও একটু দূরেই কয়েকজন বসে থাকে, তাদের মধ্যে একজন আরেকজনের ঘাড় ধরেও থাকে, কোনটা ছেলে কোনটা মেয়ে সেটা বোঝা যায়না, আমরা বোঝার চেষ্টাও করিনা। তারা কামালের কথা শোনার চেষ্টা করে বলে আমার মনে হয়না, আর আমরাও তাদের কথা শোনার চেষ্টা করিনা। কারণ, কামাল তখন নানা কথা বলে, আর আমিও তার মনোযোগী শ্রোতা। কাকগুলো মাঝেমাঝেই কা কা করে জানান দেয় যে তারা আছে। তবে তারা আসলে কামালের কথা বোঝে কিনা আমি জানি না। কারণ তারা কা কা ছাড়া আর অন্য কোন ভাবে ডাকেনা, অথবা ডাকলেও আমি ঠিক বুঝতে পারি না তারা আসলে কি বোঝাতে চাচ্ছে।



এমন যখন পরিস্থিতি, মনোযোগ যখন মন আর সঙ্গীর সাথে সংযুক্ত, সেরকম এক সময়েই কামাল একদিন বললো, সে আমারে একটা গল্প শোনাবে। ঠিক গল্প না, একটা ঘটনা শোনাবে। আর যেহেতু এটা তার জীবনেই ঘটেছে, সেই এ ঘটনার নায়ক, এ ঘটনাটা সে কোনদিন কারো কাছে বয়ান করেনি, সেহেতু ঘটনাটা বলতে সে সময় নেয়। আমতা আমতা করে। গল্প শুরু না করে অন্য কোন প্রসঙ্গে ফিরে যায়। এবং শেষ পর্যন্ত সেদিন সে গল্পটা বলেনা। আর এ কারণেই আমি গল্পটা শোনার জন্য উৎসাহী হয়ে পড়ি। আমি তার পেছনে লেগে থাকি। তার গল্প বলার পেছনে আগ্রহ আর অনীহার মিশেল আমাকে ভালো একটা ঘটনা শোনার ইঙ্গিত দেয়। আমি গন্ধ পাই। গন্ধের ট্রেইল ধরে ধরে আমি এগিয়ে যাই তার না বলা গল্পের দিকে। তারপরে যেদিন আমার সাপ্তাহিক ছুটি ,স্বাভাবিকভাবেই সেদিন আমার অফিস নেই, যদিও সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও মাঝে মাঝে আমার অফিসে যেতে হয়, সেদিন যেতে হয়নি বলেই আর গল্পটা শোনার আগ্রহেই আমার সাথে কামালের দেখা হলো। কিন্তু সেদিনও সে আমাকে ঘটনাটা বললো না। আমার চোখের সামনেই, বলতে গেলে আমার পুরো শরীরটাই সামনেই সে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। কোথায় গেলো তা জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাবেন না, কারণ আমি উত্তর পাইনি।

তারপরে আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। আমি আর এ ধরনের কোন ঘটনা শুনতে চাই না, অন্তত কামালের কাছ থেকে নয়।



আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, কামালের জীবনের সে ঘটনা, বা কোন ঘটনা সম্পর্কেই আমি কোন আগ্রহ দেখাবো না, ঠিক তখনই সে আমারে ফোন দিলো। সেদিন আমার অফিস ছিলো, ব্যস্ততাও ছিলো, তাই আমি আসবো না বলে জানালাম। কিন্তু পাঁচটার মধ্যেই হঠাৎ করে আমার অফিসের কাজ শেষ হয়ে গেলো। তাই আমি ভাবলাম, যাই ঘুরেই আসি।



কামাল একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাজ করে। এখন তো ঢাকায় বহুত টিভি চ্যানেল। ইউনিভার্সিটির পোলাপানরাই দখল করে ফেলে নতুন এ চাকরির এলাকা। যে চ্যানেল খুলি, সেখানেই দেখি পরিচিত মুখ। তবে পর্দার পেছনে আরো অনেকেই কাজ পায়। কামাল এরকমই একটা কাজ করতো। নানা অনুষ্ঠানের নান্দনিক সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টা, সেইসাথে প্রযুক্তির নানা মিশেল। চাকরিতে সে কেমন করেছিল তা আমি ঠিক জানতাম না। কারণ, আমি জানার কখনোই কোন চেষ্টা করতাম না। ও আমাকে চাকরি নিয়ে কোন কথাও বলতো না।



অফিসে ঢুকে দেখলাম কামাল ব্যস্ত। নিজের করা একটা কাজ কতটা সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন হয়েছে তা সে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তবে তার লাজুক ভঙ্গীর কারণে একটু পরপরই থেমে যাচ্ছে। আমাকে দেখেই বাইরের বারান্দায় বসতে বললো।



এ অফিসের বারান্দাটা সুন্দর। বারান্দাটা এতই বড় যে ছাদ ছাদ লাগে। আসলে ছাদের একটা অংশেই বারান্দাটা। বিশ তলার উপর থেকে ঢাকার অনেকখানি দেখা যায়। খালি বাড়ি আর বাড়ি। শালার ঢাকায় একটুও সবুজ নেই। সবুজ নিয়ে আক্ষেপটা যখন বেশ একটা দানা বাঁধতে শুরু করেছে তখনই কামাল ফিরে আসলো।



‘ কতক্ষণ ধরে বসে আছেন? খারাপ লাগতেসে নাকি একা একা বসে থাকতে?’



এখানে এসে বসার সময় কামালকে বলে এসেই বসেছি। তারপরও কতক্ষণ ধরে বসে আছে তা জিজ্ঞেস করার কোন মানে হয় না। আর একা একা বসে থাকলেতো একটু খারাপ লাগবেই। তাই শেষ পর্যন্ত এসব অবান্তর প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম।



কামাল একটা সিগারেট ধরালো। শহরের বাড়তে থাকা সীমানার দিকে তাকিয়ে সিগারেটে জোরে টান দিলো। ছাইটা যখন পড়বে পড়বে করে পড়ছেনা এরকম একটা অবস্থায় আছে, তখন হঠাৎ করে একরাশ ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে বললো



‘ আপনারে ঘটনাটা কই।’



আমি কোন কথা বললাম না। আমি তখন ঘটনাটা শুনার আগ্রহ আর অপেক্ষার বিরক্তির মাঝামাঝি।



‘ বছর খানেক হয়ে গেলো। আমি তখন চাকরি বাকরি করি না। একা একা খুব লোনলি লাগে। বন্ধুবান্ধবের সাথেও তো ঠিকমত মিশতে পারি না। খুবই অসহ্য লাগে। বিশেষ করে রাতের বেলাটা কাটতেই চায়না। এমন একটা সময়েই একদিন একটা কল এলো। মেয়ে কণ্ঠ। কিন্তু রং নাম্বার। রাত তখন দেড়টা হবে। রং নাম্বার বুঝতেই ফোনটা কেটে দিলো। বুঝছেন, আমার তখন খুবই খারাপ অবস্থা। এমনিতে তো মানুষের সাথে বেশি কথা বলতে পারিনা। আর মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে কেমন যেন বুক কাঁপে। তারপরও কল ব্যাক করলাম। প্রথমে খুবই গালাগালি খাইলাম। খারাপ ভাষায় না। কিন্তু ভালো ভাষায়ও কিন্তু ভাই বুঝায়ে দেয়া যায় যে আর ফোন কইরো না। তারপরও আমি আবার ফোন দিলাম। যদিও আমি ফোনে ডিস্টার্ব করা মোটেও পছন্দ করিনা, নিজেরে কাপুরুষ মনে হয়। তারপরও দিলাম। এবার কিন্তু একটু নরম হইলো। আমার সাথে কথা বলতে শুরু করলো। সেই যে শুরু হইলো, তারপর প্রতিদিনই কথা বলতাম। মিনিট থেকে শুরু করে ঘন্টার হিসেবে। প্রথম প্রথম নিজেদের অল্প অল্প পরিচয়, কি খাইসি, সারাদিন কি করলাম এগুলোই কথা বলতাম। পরে নিজেদের মধ্যে কেমন বন্ধু বন্ধু, মানে একটা প্রেমের মত সম্পর্ক হয়ে গেলো। ’



একনাগাড়ে কথাগুলো বলে সিগারেটের শেষ অংশে টান দিলো কামাল। এ ফাঁকে আমি একটু হতাশ হবার সময় পেলাম। কি মোবাইল ফোনে প্রেমের বস্তাপচা না ময়লাপঁচা ঘটনা শোনার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছি। নিজের উপরই এবার বিরক্তি লাগলো। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে আবার শুরু করে কামাল।



‘ প্রেমের সম্পর্ক। একদম কি কমু, লদকা লদকি সম্পর্ক। ফোনের মধ্যেই রাগ অনুরাগ , ফোনের মধ্যেই বঞ্চনা ভালোবাসা, দুঃখ বেদনা। সব কিছু শেয়ার করা। ফোনের মধ্যেই ধমক খাইতাম দেরী করে খাওয়ার জন্য, অনিয়ম করার জন্য, নির্দেশ পেতাম আজ কোন রঙের শার্ট পরবো। মোটা হয়ে যাচ্ছি, তো দুপুরে কি খাবো। জ্বর জ্বর লাগছে কোন চিকিৎসার আশ্রয় নিবো, কোন ট্যাবলেট যাবে পেটের মধ্যে। এরকম নানা রকমের প্যাচাল। প্যাচাল বলাটা মনে হয় ঠিক হচ্ছেনা। তখনতো ভালোই লাগতো। মনে হতো আমার কেউ একজন আছে। যে আমার সাথে আছে। যে আমাকে ভালোবাসে। আদর করে । চুমু দেয়। ফোনের ইথারেই ভেসে আসে চুমুর শব্দ। এ অদ্ভুত যন্ত্রের কল্যাণে আমার জৈবিক চাহিদার অনেকখানিও যেন মিটতে শুরু করলো। একটা শরীর আরেকটার কাছাকাছি আসার অন্যতম শর্ত যখন কাছাকাছি আসা, মানে স্পর্শ করা, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা এ তোমার চুল, রেশমি বা কোঁকড়ানো, এ তোমার নাক, ইরানিদের মত খাড়া বা চিনাদের মত ছোট, এ তোমার ঠোঁট, অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মত নাকি পাতলা কাগজের মত, এ তোমার স্তন , আমার স্বপ্ন এখানেই হয়তো মিশে, আমার হাতেই কি ভাঙে অথবা গড়ে। এমন কোন স্পর্শ ছাড়াই তাকে আমি স্পর্শ করতাম। আর আমাকে সে। আমার শরীরের নানা জ্যামিতিক গঠন তার কাছে পরিচিত হয়ে উঠলো, যেমন তারটা হয়েছিলো আমার কাছে।’



এবার কামাল একটু দম নেয়। আকাশ থেকে তার দৃষ্টিটা নীচে নেমে এসে দিগন্ত রেখায় মেশে।



‘ এ একরকম স্বপ্ন। কোনদিন দেখিনি। চিনিনা, জানিনা। প্রথম এক সপ্তাহ জিজ্ঞেসই করিনি নাম কি, বাড়ি কোথায়, কি বৃত্তান্ত। আস্তে আস্তে জানলাম। না জানলেও হয়তো কোন ক্ষতি হত না। তারপরও কেন জানি জানা হয়ে যায়। জানতে হয়। পরিচিতির বেড়াজাল এসে আমাদের চারপাশে ভীড় করে। হাজার কথার মাঝে কোন একদিন জানলাম, তার নাম স্নিগ্ধা। এই ঢাকা থেকে অনেকদূরে এক বন্দর শহরে তার বাস। আমাদের ভালোবাসার নানা কথা শত মাইল পেরিয়ে বারবার আসা যাওয়া করে দেশের মধ্য থেকে আরেক প্রান্তে। এ রকম স্বপ্নের এক সময়ে সে একদিন আমাকে ডাকলো।’



‘ ডাকলো মানে। আপনারে কি বাসায় যাইতে কইলো। নাকি ঐ শহরে।’ শেষপর্যন্ত আমি একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম।



“এমনি এমনি কয় নাই। একদিন আমি খুব পাগলামি করতেসিলাম। মাথায় উইঠা যাওয়া কয় না ? ওইরকম। খালি উল্টা পাল্টা কথা বলসিলাম। তো স্নিগ্ধা কইলো,‘ খালি ফোনের মধ্যে এত কথা বলো। পারলে আসো সামনা সামনি।’ আমার খুব গায়ে লাগলো। সেই সাথে শরীরের একটা টানতো আছেই। সেটাই কইতে পারেন মেইন কারণ। তো আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।”



‘ কেন শরীরটাই কি মূল কথা হইলো। ওরে, মানে ঐ স্নিগ্ধারে দেখতে ইচ্ছে করেনাই।’



‘ দেখেন ভাই। সত্য কথা বলার এ এক বিপদ। হ্যা, এটা ঠিক, ওরে আমার দেখতে ইচ্ছা করতো। কেমন দেখতে হবে, এরকম চিন্তাও করতাম। কিন্তু খালি দেখতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিসিলাম এটা বললেতো মিথ্যা বলা হবে। তাহলে তো এমএমএস করেই পাঠাতে বলতে পারতাম, ওর ছবি। না, সেটাতো আমি কখনই বলিনাই। আসলে দেখার ইচ্ছাটা থাকলেও আসলে শরীরের টানেই গেসলাম। অন্য কাউরে হয়তো বলতাম না, আপনারে সত্য কথাটাই বললাম।’



আমি আর কোন কথা বলিনা। চুপ থাকি। আরেকটা সিগারেটের জন্য প্যাকেট হাতড়ালো কামাল। সিগারেট নাই। খালি প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ।



‘ আসলে কি জানেন, একা একা যাইতে ভয় লাগতেসিলো। তাই আমার এক বন্ধুরে যোগাড় করলাম। ওর বাড়ি স্নিগ্ধার বাড়ির ঠিক কাছাকাছি নয়, তবে এক জেলাতেই। ঠিক করলাম, থাকবো আমার বন্ধু মোমিনের বাড়িতে। ঢাকা থেকে গিয়ে ওর বাড়িতেই উঠবো। ব্যাগট্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে সময় সুযোগ মত দেখা করবো স্নিগ্ধার সাথে।

ঢাকা থেকে দীর্ঘ জার্নি শেষে বন্দর শহরটিতে পৌঁছে সব পরিকল্পনা উলট পালট হয়ে গেলো। মনের মধ্যে কেমন জানি তীব্র একটা বোধ, অদ্ভুত একটা অনুভূতি গ্রাস করলো। মনে হইলো আর কোথাও নয়, আর একটুও দেরি নয়, আমার এখুনি যাইতে হবে স্নিগ্ধার কাছে। মোমিন আমারে বোঝানোর খুব চেষ্টা করলো।

‘দ্যাখ, বলা যায়না, কি হয়। কার বাড়ি যাইতে কার বাড়ি যাবো। শেষ পর্যন্ত মার টার খাইবো কিনা কে জানে। পরে বুঝে শুনে যাবো। চারিদিকের পরিস্থিতি বুইঝা যাওয়া যাইবো না হয়।’

কিন্তু আমি তখন সব ধরনের বোঝাবুঝির উর্ধ্বে। যেভাবেই হোক আমার স্নিগ্ধার কাছে যাইতে হবে। শেষে মোমিন হাল ছাইড়া দিলো। বাড়িটা খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় লাগলো। আশেপাশে খুব একটা বাড়ি ঘর নেই। শান্ত রাস্তার পাশে আরো শান্ত একটা একতলা বাড়ি। পুরনো কাঠের দরজা। বন্ধ। দরজার সামনে গিয়ে দুজনেই অপেক্ষা করছি। দরজার আশেপাশে কোন কলিং বেল নেই। কড়া টাইপ লোহার একটা জিনিস আছে। আমরা দুই বন্ধু দুজনের দিকে তাকিয়ে। কেউ আর কড়া নাড়াচ্ছিনা। একবার ভাবলাম ফিরে আসি। চলে আসবো, চলে আসবো এরকম যখন মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি, তখনই কেন জানি আমার দুহাত আমারই অজান্তে দরজায় ধাক্কা দিলো।



না, কেউ দরজা খুললো না। আবার ধাক্কা দিলাম। কড়াও নাড়লাম। এবারো খুললোনা। ভেতরে নিশ্চয়ই কেউ আছে, কারণ বাইরে তো তালা দেয়া নেই। কি করা যায় এমন চিন্তা যখন করছি তখনই দরজাটা খুলে গেলো। লালনীল কাঁচের চুড়ি পড়া একটা হাত। চেহারার এক ফালি দেখা যাচ্ছে।



‘ কাকে খুঁজছেন?’ কণ্ঠটা ঠিক মিষ্টি বলা যাবেনা, একটু হাস্কি।

‘ স্নিগ্ধা নেই? মানে আমরা স্নিগ্ধার কাছে আসছিলাম।’

‘ ক্যান?’

ছোট্ট এ প্রশ্নটাই খুব ভারী মনে হলো আমার কাছে। কি কারণে আসছি আমি স্নিগ্ধার কাছে তা কিভাবে বলি। তাছাড়া ইনিই বা কি সেটাওতো বুঝতে পারছিনা। তবে একটু পরেই বুঝতে পারলাম।



‘ আমি স্নিগ্ধার বড় বোন। ওতো একটু বাইরে গেছে। একজনের আসার কথা বলে গেছে। আপনাদের কথাই মনে হয়। আসেন ঘরের ভেতরে এসে বসেন।’



ছোট্ট একটা ঘর। ড্রইংরুম বা বাংলা কেতায় বৈঠক ঘর যারে কয়। বেতের সোফা আছে একটা। বেশ পুরানা। কোণায় কয়টা মোড়াও আছে দেখলাম। দেয়ালে উলে বোনা একটা নকশা কাটা শোপিস। দেয়াল ঘড়ির কাটা বন্ধ। সূর্যাস্তের একটা পোস্টারও আছে। ধূলার ভারে ডুবন্ত সূর্য যেন আরো ডুবে গেছে। দুই বন্ধু কোন কথা না বলে বসে আছি। বোকার মত। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। পোস্টারের ফ্রেমের ফাঁক দিয়ে একটি ফর্সা টিকটিকি বের হয়ে এসে আবার ঢুকে পড়লো। আমাদের পছন্দ করতে পারে নাই মনে হয়।



আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিয়েই স্নিগ্ধার বোন ভেতরে চলে গেছে। উনার কাছে যে স্নিগ্ধার কথা কিছু যে জিজ্ঞেস করবো তারও কোন উপায় নেই। কি আর করবো। বসে আছিতো বসেই আছি। মিনিট দশেক পরে বাড়ির ভেতরের দিকের দরজাটা খুলে গেলো। হাতে একটা ট্রে। বেশ কিছু খাবার দাবার। শরবত বা জুস জাতীয় কিছু একটা আছে দেখলাম। দশ মিনিটের মধ্যেই এত খাবার দাবার বানাইলো ক্যামনে। আগে থেকেই বানিয়ে রাখছিলো কিনা কে জানে।

‘ নেন আপনারা একটু খাওয়া দাওয়া করেন। মুখ আমসি করে বসে আছেন দেখি। ঢাকা থেকে আসছেন না, সাত আট ঘন্টার জার্নি। ক্ষিধা তো লাগসে অবশ্যই।’

ক্ষুধা লাগসিলো এ কথা ঠিক। তাই খাওয়া দাওয়া করলাম মনোযোগ দিয়েই। একটু পরে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম- ‘ স্নিগ্ধার আসতে কি দেরি হবে। ও তো আগে থেকেই জানতো যে আমি আসবো। মানে, ফোনেতো এরকমই কথা হয়েছিলো। ও থাকবে বলেছিলো।’

‘ক্যান? এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ক্যান? আসবে, আসবে। মার্কেটে গেছে, শপিং করবে। প্রাইভেট পড়বে টিচারের কাছে , তারপর আসবে। আরও ঘন্টা দুই লাগবে। আপনারা আমার সাথেই গল্প করেন। নাকি, স্নিগ্ধা ছাড়া অন্য কারো সাথে কথা বলবেন না।’



এতক্ষণ দুজনকে উদ্দেশ্য করে কথা বললেও শেষ প্রশ্নটা কিন্তু আমার দিকেই আসলো। আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। আসলে স্নিগ্ধার সাথে দেখা হবে, কথা হবে, অন্য কিছু হবে অথবা হবে না , অথবা দেখাই হবে না -এরকম নানা রকম সমস্যা বা সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু স্নিগ্ধা বাসায় থাকবে না এরকম চিন্তা মাথায় আসেনি। তাই আমার মাথায় প্রশ্নের কোন ভালো উত্তর আসলোনা।

‘ না মানে, আপনার সাথে কথা বলতে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু ও থাকলে ভালো হইতো।’

ভালো যে হইতো তা উনিও যে বোঝেন তা তার আধো হাসিতেই বোঝা যাচ্ছিলো। কথা আর সামনে এগালো না। কিছুক্ষণ পর বললেন-

‘ যাই, আমার বাচ্চাটা কাঁদছে। এত সমস্যা। একটু কাছেনা থাকলেই চিৎকার শুরু করে।’

এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা বিরক্তিটি এবার আর চেপে রাখতে পারলো না মোমিন। তার গলায় স্পষ্ট রাগ আর বিরক্তি।

‘ আর কতক্ষণ থাকবি। বিকেল ৫ টার পর আর বাস থাকবেনা। বাড়ি যাইতে সমস্যা হবে। কালকে আসিস।’

আমার উত্তর না পেয়ে ওর বিরক্তি আরো চূড়ান্ত হলো।

‘ শালা , তুই জানোস এটা খুব খারাপ জায়গা। বিকেলের পর বের হইলে খবর আছে। সন্ধ্যা হইলেই খুন খারাপি শুরু হইয়া যায়। প্রত্যেক সপ্তাহে খুন হয়। তুই যাবি কিনা ক। না গেলে আমি যাই গা।’



তখন বাজে দুপুর ২টা। দুপুরে কই খাবো তারও ঠিক নাই। এ বাড়িতে খাওয়ার কথা না বললে তো খাওয়া যায়না। আর এভাবে কোন কারণ ছাড়া অদ্ভুতভাবে এসে খাইতে চাবো, কি মনে করবে কে জানে। মোমিনরে বললাম, চল যাই বাইরে থেকে খাইয়া আসি। টাইমটাও পাস হবে, আর খাওয়াও হবে। আমার বিরক্ত বন্ধু এ বাড়ি থেকে বের হতে পারলেই বাঁচে। তাই রাজী না হয়ে পারলো না।

বৈঠকঘরের দরজা পার হয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেই পাশাপাশি তিনটা ঘর। সামনে চওড়া বারান্দা। একটা উঠানও আছে। উঠানের এক কোনে টিউবওয়েল। একটা ডালিম গাছ,মেহেদী গাছও আছে। মেহেদীর বেশির ভাগ পাতাই ঝরে গেছে, মাথায় চিকন চিকন সবুজ পাতায় আলোর ঝলকানি। বারান্দায় কেউ নেই। ঘরে উঁকি দিলাম। বিছানায় বাচ্চার পাশেই শুয়ে আছেন। আস্তে আস্তে ফ্যানটা চললেও হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন।

‘ আমরা একটু বাইরে গেলাম। ঘুরে ফিরে আসি।’

আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন, ‘ ঘুরতে আসছেন নাকি। আমি তো শুনলাম স্নিগ্ধার সাথে দেখা করতে আসছেন। কারো কারো জন্য তো মানুষ সারা জীবন অপেক্ষা করে, আর আপনি ঘন্টাখানেক বসেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন দেখছি।’

আগ্রহ আর আকাঙ্খার গভীরতা নিয়ে যখন প্রশ্ন , তখন আর সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। আমি ফিরে আসলাম।

‘ মোমিন, তুই বাড়ি চলে যা। আমি এখানেই থাকি।’

‘ কি কস মামা। তোর মাথা কি খারাপ হয়ে গেলো। আমি তোরে ছাইড়া যামুগা। তারপর তোর যদি কিছু হয়?’

‘ আমার আবার কি হইবো।’

‘ না মামা, তোমারে রাইখা আমি যামুনা। শালা, ঢাকায় সবাই জানে তুই আমার সাথে আসছস।’

‘ সবাই জানে মানে। কেউ জানে না। খালি রোকন আর নূরী জানে। আর জানলেই কি? তোর হুদাই এত ভয়।’

‘ কি আপনার বন্ধুর কি নিয়ে এত ভয়।’ কখন ও ঘর থেকে এসে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন তা বুঝতে পারিনি। মোমিনের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললেন,

‘ ভাই, আপনার বন্ধুর দায়িত্ব আমি নিলাম। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন উনার কোন ক্ষতি হইবোনা। আপনার এতদূর থেকে কষ্ট করে আসছেন, এখন কয়দিন থাকেন এখানে। ’

আমি এবার কথা বলে উঠি। ‘ ওর বাড়ি তো এখানেই। তাই ও বলতেসিলো ওর বাড়িতে যাইতে। কাল সকালে আবার না হয় আসবো।’



‘ আমি যতদূর জানি আপনি এ বাড়ির মেহমান। আপনার বন্ধু না চাইলে নিজের বাড়িতে চলে যাক। আপনি এ বাড়িতেই থাকবেন। একটু পরে দুপুরে খাবেন। এখন হাত পা ধোন। দরকার হলে গোসল করেন। বারান্দায় চেয়ারের উপর লুঙ্গি তোয়ালে রাখছি।’



মোমিন আমার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করলো না। ব্যাগটা নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে চলে গেলো।



আমি এবার একা হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবছি, কোন ঝামেলায় পড়লামরে বাবা। যাই হোক আসছি যখন, সিদ্ধান্ত নিলাম শেষ পর্যন্ত দেখে যাবো। বারান্দায় একটা চেয়ারের উপর শুকনো তোয়ালে, ধোয়া লুঙ্গি। একটা সাদা রঙের নতুন টি শার্টও আছে দেখলাম। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে, লুঙ্গি গেঞ্জি পড়ে ঠান্ডা বারান্দার উপর বসলাম। একটু আরাম লাগলো।



‘মেঝের উপর বসে আছেন কেন? খাবার দিয়েছি। খেয়ে রেস্ট নেন।’



খাবারের টেবিলে আমি একা। উনি মনে হয় আমার সাথে খাইতে যাচ্ছেন না। আমার অবশ্য একা খাইতে কোন অসুবিধা হইলোনা। আমি তো একা মানুষ। বহুদিন বাড়ির বাইরে। তাই একা একা খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে।

খাওয়ার পর অনেকদিন পর একটা ভাত ঘুমও দিলাম। জার্নির কারণে এমনিতেই ক্লান্ত ছিলাম। ঘুমটাও তাই ভালোই হলো।



কতক্ষণ ঘুমালাম জানিনা। উঠে আবার বারান্দায় এসে বসলাম। সূর্য ডুববে ডুববে ভাব। আকাশে নানা রঙের শেড। অন্যসময় হলে রঙ গুলো নিয়ে অনেক চিন্তা মাথায় আসতো। কোনটা ক্যানভাসে ফোটাতে পারবো, কোনটাতে অতৃপ্তি থাকবে, অথবা কোনটা প্রকৃতির নিজস্ব রঙের ডিব্বা থেকে নেয়া- এগুলা নিয়া বেহুদা চিন্তা আসতো মাথায়। আজও আসছে। কিন্তু কেমন খাপছাড়া, খালি মনে হচ্ছে স্নিগ্ধা কি বাড়ি ফিরে এসেছে। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো ওর জন্য।



ঠিক সে সময়ে ডাকটা শুনলাম। একটা ভরাট, পুরুষালি গলা। দরজার ওপার থেকে শব্দগুলো ভেসে আসলো,‘স্নিগ্ধা, কই তুমি, দরজাটা খোলো।’ জবাব এলো ঘরের ভেতর থেকেই। শাড়িটা ঠিক করতে করতে দরজা খুলতে গেলেন তিনি।”



কামালের গল্পের ভেতরে বেশ মজে ছিলাম। মেয়েটা কেমন হবে দেখতে তাও শুনতে ইচ্ছা করছিলো। হঠাৎ করেই এ ছন্দপতন ভালো লাগলোনা।

‘ দরজা খুললো কে ? স্নিগ্ধা সিনে আসলো কখন ? ও কি আপনারে ঘরের ভেতর থেকে দেখতেসিলো ?

‘ আরে ভাই , স্নিগ্ধা তো সিনে প্রথম থেকেই। ছোটবোন টোন বলে কিছু নেই। মানুষ একজনই। বুঝছেন মিয়া, এতক্ষণ ধরে আমার সাথে মজা লইতেসিলো।’

‘এতদিন ধরে কথা বলসেন, গলার স্বর চিনতে পারেননাই । এটা ক্যামনে হয়?’

‘ এটা একটা ভালো কথা কইসেন। ক্যানো যে বুঝতে পারলামনা। আসলে তখন চিন্তাও করেনি। খুব বেশি খটকাও লাগেনি। বোন বলসে, বিশ্বাস করসি। বোনে বোনে মিল থাকতে পারে এমন কিছুও মনে হয় চিন্তা করসিলাম।’

‘ তার মানে আপনার স্নিগ্ধা বিবাহিতা?’

‘ বাচ্চারে দুধ খাওয়াইতেসে সে কথা তো কইলামই, শোনেন নাই। বিয়া তো হইসেই। স্বামীটারেও দেখলাম। আমার সাথে পরিচয় করাইয়ে দিলো। দেখলাম, স্বামী জানে বউয়ের একটা বন্ধু আছে। ফোনে কথা হয়। তাতে তার এমন কোন আপত্তি আছে বলে মনে হইলো না। অন্তত আমার সাথে আচরনে খুব একটা যে রুড তা বলা যায়না। কথাবার্তা বললো , খোঁজখবর নিলো, কি করি কোথায় পড়ি এগুলা। আমিও জানলাম, ওনার নাম জাকির। ছোটখাটো ব্যবসা করেন। কি ব্যবসা করেন তা ঠিক বুঝতে পারলামনা। আমার সাথে খুব একটা কথাও বললেন না জাকির সাহেব। আমি ঘরে এসে বসলাম। মানে যে ঘরে দুপুরে ঘুমাইলাম। খাটের উপর বইয়া খালি সাত পাঁচ চিন্তা করি। আমার স্বপ্নের রানী বিবাহিতা। আমার কাছে গোপন করসে। স্বামীর কথা তো গোপন করসেই, সন্তানের কথাও কখনো বলে নাই। ক্যামনে এতদিন ধরে এগুলা লুকাইয়া রাখা যায়। এখন আমি কি করি, ফিরে যামু নাকি ওয়েট করবো। ওয়েট করলেও আসলে কিসের জন্য অপেক্ষা। আমার চিন্তার শেষ হয়না। অপরিচিত বাড়ীর কারণে এতক্ষণ কষ্ট করে সিগারেট না ধরিয়ে ছিলাম। কই না কই ছাই ফেলি। এবার আর বাধ দিয়ে রাখতে পারলামনা। আসলে তখন আর কিছু চিন্তা করার মত স্কোপই ছিলোনা। ধরাইলাম সিগারেট, বুকের মধ্যে ধোঁয়া দিই আর ভাবি, কি করি। কি করি।



আমার মতই স্নিগ্ধাও নিশ্চয়ই অনেক কিছু ভাবসে। আমাদের দেখা কিভাবে হবে, কিভাবে তার লুকোচুরি খেলা সে শেষ করবে, আমার চেহারা ক্যামন হবে, যার সাথে সুখ দুখ শরীর স্বপ্ন আনন্দ শেয়ার করেছে সে আসলে কেমন হবে। আমি তো তার কাছে কিছুই গোপন করিনি, আসলে গোপন করারও কিছু ছিলোনা।



আমার চিন্তার মাঝেই ছায়া ফেললো স্নিগ্ধা।

‘ কি , আমার উপর খুব রাগ হইসে। কি করবো বলো । তোমার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগতো তো , তাই।’

তাই আমার সাথে এমন খেলা খেললে তুমি, মনে মনে বললেও মুখ ফুটে কিছু বললাম না।

‘ আমি যদি বলতাম আমার বিয়ে হইসে, স্বামী আছে, একটা সন্তান আছে। তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে? হয়তো বলতে, কিন্তু এমন করে কি বলতে। আমার কাছেই হয়তো আসতেনা। আসলেও একটা বাধা থাকতো। থাকতো না?’

‘ তুমি আমাকে ডাকলে কেন, বলোতো? ’ আমার কন্ঠে কষ্ট মেশা আকুতি।

‘ এমন ভাবে আসতে চাইলে। আমি না করতে পারিনি। আর তোমায় দেখতে খুব ইচ্ছা করতো। ফোনের মধ্যে কি পাগল হয়ে যাও আমার জন্য।’

ওর দিকে ভালো করে তাকালাম আমি। সাধারণ একটা মুখ। ঠিক ফর্সা বলা যায়না। তবে মুখ জুড়ে একটা লাবন্য আছে। দেখার মত তার চোখজোড়া। তখনই আমি কি করবো ঠিক করে ফেললাম। ঐ আমন্ত্রনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম।

‘ আসো তোমায় একটু আদর করে দি।’

‘ না।’ না টা বেশ কঠিন। ‘ শোনো, ও আবার বাইরে গেসে। আমি ইচ্ছা করলেই তোমাকে দিতে পারি। কিন্তু দিবোনা।’

‘ কেন ? কেন দিবানা। ফোনে যে করতা। সবকিছুই তো করসো। কর নাই।’

‘ ফোনে আর এখানে এককথা হলো। আমার সন্তান পাশের ঘরে ঘুমিয়ে। আমার স্বামী আছে। আমি পারবো না। প্লিজ, তুমি চলে যাও।’

‘ চলে যাবো? এখনি চলে যাবো। রাতে তো বাস আছে ঢাকার।’

‘ না, রাতটা থাকো। সকালে যেও না হয়।’

আমি ওর দোটানাটা বুঝলাম। আর বুঝলাম আমি কি চাই। আসলে আমরা দুজনেই কি চাই। ওর না না সত্বেও ওকে আমি জড়িয়ে ধরলাম। পিষে ফেলতে চাইলাম বুকের মধ্যে। ওর ভরাট বুক যেন আমার শরীরে নরম মাখনের মত মিশে গেলো। ওর ঠোঁটের উষ্ণতা আমার ঠোঁট আগ্রহভরে শুষে নিতে চায়। ওর দশটা আঙুলের নখ বিধে যায় আমার পিঠে। আমি ওর সাড়া পেলাম। আমাদের দুটি শরীর যেন অনেকদিনের বিচ্ছিন্ন ভ্রমন শেষে এক হলো কোন এক চৌরাস্তায়। কামনার নদী এক হলো শরীরের মধ্যভাগের মোহনায়। চোখের পাতা, নরম গাল আর চিবুকে আমার ঠোঁট অনুসন্ধান শেষে যখন বুকের সুগন্ধ শুষে নিচ্ছে, তখন ওর না আরো তীব্র হলো। তবে এ না মনে হয় ফরাসী মেয়ের না নয়, যার মানে হ্যাঁ, এ নিখাদ বাঙালি মেয়ের না। তাই আমাকে ছুড়ে ফেলে সে দৌড় দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলো।



আমার মধ্যের আগুনটা নেভেনি। এত সহজে তো নেভার কথা না। ধিক ধিক করে শরীরের ভিতরে জ্বলতে থাকলো। লুঙ্গিটা কেমন তাবুর মত খাড়া হয়ে রইলো। তাবুটা আস্তে আস্তে চুপসে গেলো। হৃদয়ের কাঠকয়লাগুলো পুড়ে পুড়ে একসময় আগুনটাও একটু নিভে গেলো। এসব আগুন অবশ্য কখনোই নেভেনা। শরীরে শেষ হয়ে গেলেও তা মনের মধ্যে জ্বলে। তাই মনের মধ্যে আগুন নিয়েই বসে রইলাম। নিজেকে কেমন অবসাদে ভরা বলে মনে হলো।



‘ আমাকে খুব চাও তুমি?‘ সেই ঠোঁট, সেই চোখ, সেই মুখ। দরজার পাশে চেহারার প্রোফাইল। মনে মনে বলি, সোনা, এ প্রশ্নের কি কোন উত্তর হয়। তুমি কি বুঝো না আমি কি চাই। একটু ফিসফিসিয়ে আগুনমাখা গলায় ও বললো ‘ রেডি থেকো, আজ রাতে আসবো। দেখবো, কত পারো।’ তার কলকলে হাসি আর অবজ্ঞা আমাকে খুব আনন্দ দিলো। আনন্দ যেন তখন সব কিছু জুড়ে। সুখ তখন বাতাসে, সুখ তখন আমার শরীরের রক্তে রক্তে। কান আর গালে গরম ভালো লাগার অনুভূতি।



এ ভালো লাগার অনুভূতি নিয়েই প্রজাপতির পাখায় যেন রাতটা কেটে যেতে লাগলো। টেনশন, প্রতীক্ষা, আনন্দ আর শরীরের মাঝে লাভা নিয়েই হাসিমুখে জাকির সাহেবের পাশে বসে ভাত খাইলাম। গল্প করলাম। ঢাকার নানা দুর্নাম আর রাজনীতি নিয়েও মনে হয় টুকটাক আলাপও করেছিলাম। জাকির সাহেব অবশ্য হ্যা বা না এর মত এক শব্দে আমার কথার উত্তর দিচ্ছিলেন। মূলত আমিই কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার কথার ধারা শুনে স্নিগ্ধার মুখে মাঝে মাঝে একটু একটু হাসিও লক্ষ্য করলাম।



খাওয়া শেষে আবার ঘরে ফিরে যাওয়া। আসল প্রতীক্ষার শুরু। এ অপেক্ষায় সিগারেট ছাড়া আর অন্য কোন সঙ্গী নেই। এ শালা একা একা বসে থেকে কোন কিছুর জন্য নিজেরে তৈরী রাখা যে কি কঠিন তা বললে বুঝবেন না। রাত যেন আর শেষই হয়না। শেষ তো দূরের কথা গভীরও যেন হয়না সহজে। সময় কাটাবার জন্য কি করা শুরু করলাম জানেন। একটু পর কী করবো সেটাই ভাবা শুরু করলাম। কিভাবে ওরে আদর করবো সেটা। কোথা দিয়ে কিভাবে শুরু করা যায়। ও যখন কাছে আসবে আমি কি করবো। একদম প্রথমে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া যায়। চুলের গন্ধ শুঁকলাম। এক হাত চুলে থাকলো, আর এক হাত শরীরে ঘুরে বেড়াবে। বুকটাতে চাপ দেবে, পেটের নরম চামড়ায় স্পন্দন তুলে চলে যাবে দু পায়ের মাঝের উপত্যকায়। নাকি পিঠে মসৃনতা অতিক্রম করে গিয়ে উঠবে নরম দু পর্বতে। যেকোন একটা করা যেতে পারে, অথবা দুটোই করলাম। এত তাড়াতাড়ির কিছু নেই। কোন কিছুই তো শেষ হয়ে যাচ্ছে না। একদিক করলে আরেকদিক যে চলে যাবে, বিদায় নিবে চিরতরে তাতো নয়। আমি আমার মনকে বোঝাই, কোন তাড়াতাড়ি নেই। ড্রিলমাস্টারের মত নির্দেশ দিই। স্লো মার্চ হবে, স্লো মার্চ। তাল মিলিয়ে। রিলাক্স, রিলাক্স। কোন দুশ্চিন্তার কিছু নেই। জাকির সাহেব আছেন। থাকবেন। উনি ঘুমিয়েই থাকবেন। অসুবিধা কি। যদি ধরা পড়ি। তো কি। ধরাতো আরেকজনও পড়বে। ও তো ভয় পাচ্ছে না। ও তো আসবে বলেছে। আসবে, আমার বুকের মধ্যে আসবে। আমার ঠোঁট কামড়ে ধরবে, আমার বুকে কামড় দিবে। আমার নীচে ও শীৎকার দিবে, চিৎকারও দিতে পারে। প্রথম বারই অনেক আনন্দ দিতে হবে। না হলে সমস্যা।



এ রকম হাজারো চিন্তা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সময় যেন কাটছে না। গত দশ ঘন্টা ধরে যেন রাত বারোটাই বাজে। আমার শরীরের মধ্যে যেন রেলগাড়ি ঢুকে পড়ছে। কামের বাষ্পে যেন ছুটছে ধমনী আর শিরা কাঁপিয়ে। রেলগাড়ির ছন্দময় শব্দের তালে তালে আমি কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না।



ঘুম ভাঙলো চুমুতে। অথবা আসলে ঘুমের মধ্যে আমি বুঝিনি কিসে আমার ঘুম ভাঙলো। শুধু এটুকু মনে আছে আমার শরীরে আবার রেলগাড়িটা ফিরে আসলো। আসলো মানে ভালো মতই আসলো। কি তার শব্দ, কি তার ধোঁয়া। আর কি তার গতি। ইঞ্জিনে ইঞ্জিনে অদ্ভুত, অভাবনীয়,গতিময় ঘর্ষণে আমি পর্যুদস্ত হয়ে পড়লাম। অথবা সেও হয়তো হলো। যার কল্যাণেই আমরা কোন এক স্টেশনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। হঠাৎ করেই যেন বাষ্পময় রেলগাড়িটার বাষ্পীয় ভাব উড়ে তরল রূপ নিলো। রেলগাড়িটাও যেন হঠাৎ করে একটা শক্ত ব্রেক কষলো। আঘাত পাওয়া কুকুরের মত কুঁই কুঁই করে থেমে গেলো।



‘ এ জন্যই এতকিছু। শুরু না হতেই তো শেষ।’

আমার স্বপ্নের মধ্যে কোথায় যেন একটা শুঁয়োপোকা ঢুকে পড়লো। তার সাথে সাদা সাদা কয়েকটা তেলাপোকা। আমি আমার ক্লান্ত আমিকে বলতে শুনলাম,‘ প্রথমবার আমার একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।’ কৈফিয়তে যোগ হলো,‘ তাছাড়া টেনশনের জন্যও হইতে পারে।’



অন্ধকারের মধ্যেই ওর

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৫৭

হাসান শহীদ ফেরদৌস বলেছেন: বাকিটুকু কোথায়?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.