নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গাঙচিল

আমার লেখালেখি এবং চিন্তাভাবনা নিয়েই আমার ব্লগ।

সালেহ মাহমুদ

আমি একজন কথাশিল্পী। অনেকটা শখের বশেই লিখি। প্রধানত ছোটগল্প-ই লিখি। মাঝে মাঝে দু'একটি কবিতাও লিখে ফেলি কেমন করে যেন। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থের পান্ডুলিপি'র নাম দিয়েছি "কয়েকটি কুকুর অথবা মানুষ"। গল্পগ্রন্থটি প্রকাশের পথে। এই গ্রন্থের সবগুলো গল্পই আমার ছোটগল্প বিভাগে পড়া যাবে।

সালেহ মাহমুদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অনামিকা

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ রাত ১২:১৬

এক.

নাছোড়বান্দা ভদ্রলোক মনে হয় তার জীবন-বৃত্তান্ত না শুনিয়ে উঠতেই দেবেন না। আমি যে তিতিবিরক্ত হচ্ছি সেদিকে তার একদমই খেয়াল নেই। ওদিকে আবার ভদ্রলোকের সাথে রাগও করতে পারছি না। কি করে করি, একেবারে বাবার বয়সী যে!

রমনা পার্কে বৈকালিক ভ্রমণ সেরে বেরুবার আগে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি বেঞ্চিতে বসে। ঠিক সে সময়ই কেড্স, কালো প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি পরা ভদ্রলোকটি আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি লোকটির দিকে তাকাতেই লোকটি একগাল হেসে বলে, তোমার পাশে একটু বসতে পারি বাবা?

অবশ্যই, অবশ্যই, না বলবো কেন? বসুন। লোকটিকে বসার জায়গা করে দেই একটু নড়েচড়ে, যদিও তার কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ, সিমেন্টে বাঁধানো এ বেঞ্চিতে এখনো আরো দু'জন অনায়াসে বসতে পারে। লোকটি বেঞ্চিতে বসেই আরামের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। আবারো তার সারা মুখে ফুটে ওঠে বিশাল হাসি। ঠিক তখনই আমার কেন জানি মনে হয় লোকটি আমাকে জ্বালাতন করে ছাড়বে। ঠিক তাই ঘটছে এই কিছুক্ষণ যাবত।

আমার এদিকে যাওয়ার তাড়া, আর উনি গল্প ফেঁদে বসেছেন। মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করছেন, তোমার নাম জেনো কি বললে? তোমার দেশের বাড়ী তো মাদারীপুর, না না গাজীপুর। আরে দেখো পুরে পুরে গুলিয়ে ফেলছি। কোথায় গাজীপুর আর কোথায় মাদারীপুর...! আসলে সবই বয়সের দোষ বুঝলে। বেশী বয়স যদি না পেতো মানুষেরা তাহলে খারাপ হতো না, কি বলো? লোকটি ঘাড় কাত করে হাসিমুখে তাকান আমার দিকে। আমি কি জবাব দেবো না দেবো তা ভাববার আগেই উনি আবার বলে ফেলেন, আসলে মন্দ হতো না। অন্ততঃ কেউ ভুলো-মন বিষয় নিয়ে মশকরা করতো না। আবার আর একটা ব্যাপার কি জানো, এ রকম বুড়ো মানুষদের দরকারও আছে সমাজে। বুড়ো মানুষেরা একটু-আধটু ভুল করে বলেই তো সবাই হাসতে পারে, নাকি? আর হাসে বলেই তো সবার মনটাও একটু ভালো থাকে, কি বলো তুমি বাবা?

আমি আর কি বলি, সব তো উনিই বলছেন। তারপরও কিছু একটা বলতে হয় তাই বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছেন আপনি। প্রশান্ত হাসে লোকটি। এমন ধৈর্যশীল শ্রোতা হয়তো তিনি ইহজনমে আর দ্বিতীয়টি পান নি। লোকটি আবার বলতে শুরু করে, তা বাবা শোন ঐ যে মেয়েটার কথা বলছিলাম। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয়টা কিভাবে হয়েছিল জানো?

আমি যে কি করি! ব্যস্তভাবে ঘড়ির দিকে তাকাই। যাহ্, সময় পার হয়ে গেছে। বাসায় গিয়ে আর ফোনটা রিসিভ করা হলো না। এক ঝলক বাতাস বয়ে যায় পার্ক জুড়ে। বেশ ফুরফুরে ভাব এসে ভর করে আমার ওপর। আমার ভেতরের তাড়াহুড়ার ভাবটা কেটে যায়। লোকটির দিকে মনোযোগ দেই।

লোকটি আবার বলতে শুরু করে, শোন, আমি তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েছি। একেবারে আনকোরা ইউনিভার্সিটিয়ান। উড়ুউড়ু মন। সবার সাথেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় নিমিষে। তুমিও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তাই না?

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ি। এই বয়সেও ভদ্রলোকের কথার স্টাইলে আমি চম্কিত হই। সেই বয়সটাতে তিনি নিশ্চয়ই আরো অনেক বেশী বাকপটু ছিলেন! এমন লোকের সাথে তো যে কারোরই বন্ধুত্ব সম্ভব। ভদ্রলোক আবার শুরু করে,

তোমাদের এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আর তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কিন্তু এক ছিল না। তোমাদেরকে দেখে আমার রীতিমতো ঈর্ষা হয় মাঝে মাঝে। তোমরা এখন যে রকম স্বাধীনতা ভোগ কর তখন তো এর সিকি আনা কল্পনাও করা যেতো না।

আমার ঔৎসুক্য বেড়ে যায়। ভদ্রলোকের সমস্ত গল্প শুনতে ইচ্ছে করে। আগ্রহ নিয়ে তাকাই তার দিকে। ভদ্রলোক পকেট থেকে বেনসন সিগারেটের প্যাকেট বের করেন। নিজে একটা ধরান আর একটা বাড়িয়ে দেন আমার দিকে। আমি ভীষণ সংকুচিত হয়ে পড়ি। না না, আমি খাই না, আপনি খান।

আহ্ হা..., তোমার ঠোঁট বলছে তুমি সিগারেট খাও। নাও ধরো, আমি কিছুই মনে করবো না।

ভদ্রলোক এক রকম জোর করেই আমার হাতে সিগারেট গুঁজে দেন। আমি সসংকোচে তাতে অগি্নসংযোগ করি।

কি যেন বলছিলাম! লোকটি আবার শুরু করে। স্বাধীনতা। আরে তোমরা তো এখন মহা স্বাধীন। আর আমাদের সময় কথা বলাটাই ছিল এক আশ্চর্যের ব্যাপার। জানো, কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে হলে রীতিমতো প্রভোস্টের কাছে লিখিত দরখাস্ত করতে হতো। প্রভোস্ট রাজী হলে পরে প্রভোস্টের রুমে বসে প্রভোস্টের সামনেই কথা বলতে হতো, বোঝো ঠ্যালা।

আমি মিষ্টি হাসি। বেশ চমৎকার মনে হয় লোকটিকে। কি মজা করে কথা বলছেন। মনে হচ্ছে যেন বহুকাল ধরে তার বুকের ভেতর বন্ধ হয়েছিল কথার বাক্সটি। আজ হঠাৎ করেই তার মুখ খুলে গেছে।

তো একদিন হলো কি- আমাদের ক্লাস শেষ হতে না হতেই শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি। বিজলী চমকাতে লাগলো পৃথিবী আলো করে। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে প্রকম্পিত হতে লাগল চারদিক। তুমি ভাবতে পারবে না সে সময়ের কথা। একেকটা বজ্রপাত হয়, আর কেঁপে কেঁপে ওঠে কার্জন হলের সব কটা জানালা-কপাট। আমরা বসে বসে প্রমাদ গণছিলাম বাসায় আদৌ যেতে পারবো কি-না।

একেবারে শেষ বিকেলে ধরে এলো ঝড়। কিন্তু বৃষ্টি পড়তেই লাগলো টিপ-টিপ করে। কি আর করা! এ রকম বৃষ্টি মাথায় করেই রওয়ানা দেই বাসার দিকে। আমি তখন তেজগাঁয়ে এক বাসায় থাকি। এ রকম আবহাওয়ায় তো আর তখনকার দিনে গাড়ী-ঘোড়া পাওয়ার কোন জো নেই। পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দিলাম।

আমি তখন অর্ধেক রাস্তাও যেতে পারি নি, আবারও হঠাৎ করেই ঝড় আর বজ্্রবৃষ্টি শুরু হলো। আমি দৌড়ে কাছাকাছি একটা বড় গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠিক তখনই বিকট শব্দে কাছাকাছি কোথাও একটা বজ্রপাত হলো। আর আমার মনে হলো আমার ঠিক আশেপাশে ভয়ার্ত কোন তরুণী চিৎকরা করে উঠলো। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। সন্দেহ কাটাতে গাছের ওপাশে দেখতে গিয়েই দেখি ভয়ে জড়োসড়ো এক তরুণী ভয়ে অথবা ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে। সালোয়ার-কামিজ ভিজে সেঁটে আছে গায়ের সাথে। তরুণীটি আমাকে দেখে আরো ভড়কে গেলো। আমি যে কি করি ভাবতে পারছিলাম না। মুহূর্ত মাত্র, তারপরই আমি দ্রুত আমার গায়ের শার্ট খুলে ফেলে তরুণীটির দিকে এগিয়ে দেই। বলি, নিন মাথাটা বাঁচাতে পারেন কি না দেখেন। তরুণীটি কিছু না বলে শার্টটি নিলো আর যতদূর পারলো গা ঢাকার চেষ্টা করলো।

একটু দম নেন ভদ্রলোক। আর আমার কি হয়, একেবারে ছোট্ট সুবোধ বালকের মত প্রচন্ত কৌতুহল নিয়ে তার দিকে চেয়ে থাকি। লোকটি আবারো হাসে মুখ ভরে। আমি ঘোর কাটাতে কিংবা আলসেমী ঝাড়তে একটু আড়মোড়া দিতে চেষ্টা করি। বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে দু'হাত উপরের দিকে টানটান করে মেলে ধরি যতদূর যায়। ঘাড় কাত হয়ে যায় পিছনের দিকে। আমি দেখতে থাকি- আমাদের ওপর উপুড় হয়ে আছে মস্ত আকাশ, যেন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে আমাদের কথা। আমি হেসে ফেলি ফিক করে।

ভদ্রলোক এতক্ষণে মনে হয় একটু বুঝতে চেষ্টা করেন আমাকে। কিন্তু ভুল বোঝেন। বলেই বসেন, আচ্ছা, তুমি কি আমার কথাগুলোকে বানোয়াট মনে করছ? ভাবছো আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি এসব?

আমি বলি, নাহ। একদমই না। আমি আপনার সব কিছুই সত্যি বলে মনে করছি এবং ভাবছি, আপনি হয়তো আর কখনো অন্য কাউকে এই গল্পটি বলেন নি, আমিই এর প্রথম শ্রোতা, তাই না?

ভদ্রলোক অবাক হন। চেখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, আরে তুমি তো জ্যোতিষির মতো কথা বলছ, তোমার এস্ট্রোলজি স্টাডির অভ্যাস আছে না কি?

আমি সলজ্জ হাসি। মাথা নাড়ি ডানে-বামে। এমনিই যা মনে হলো তাই বলেছি। বলুন, তারপর কি হলো?

লোকটির পুরো শরীর জুড়ে সচকিত ভাব প্রকট হয়ে ওঠে। যেন টানটান সতেজতায় আন্দোলিত তিনি। বলতে শুরু করেন, তারপর আর তেমন কিছু না, খুব সাদামাটা ঘটনা। তোমার হয়তো শুনতে খুব একটা ভালো লাগবে না।

না না বলুন, আমার ভালো লাগছে। আচ্ছা ঐ তরুণীকে কি আপনি সেদিন বাসায় পৌঁছে দিয়ে দিয়েছিলেন? খুব আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করি আমি। ভদ্রলোক মনে হয় একটু দুলে ওঠেন। হাসেন কেমন যেন, মনে হয় একটু সংকোচ বোধ করছেন। আমি গলা বাড়িয়ে তাকাই তার দিকে। লোকটি আবারও হাসেন। হঠাৎ করেই বলতে শুরু করেন,

আরে সেখানেই তো সবকিছু। আমার জীবনের সব কিছুই ঐ অল্পটুকু সময়ের মধ্যে এসে খাবি খাচ্ছে শুধু।

ফ্যান্টাস্টিক। রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি আমি। লোকটি কি এখনো সেই একই অবস্থায় আছে? চট্ করে জিজ্ঞেস করে বসি, আপনি কি এখনো খাবি খাচ্ছেন?

লোকটি হুট করে কোন উত্তর দেয় না। বড় একটা দম ছাড়তে ছাড়তে হেসে ফেলে অদ্ভূতভাবে। যেন অনেকটা নিজের মনেই বলেন, তুমি তো আমাকে বড্ড বিপাকে ফেললে বাবা। ঠিক আছে, তোমার এই প্রশ্নের উত্তর তোলা রইল। অবশ্যই তুমি এর জবাব পাবে, তবে কখন তা জানি না।

আমি লোকটির কথায় অবাক হই। তিনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন, ওনার সাথে আমার প্রতিদিন সকাল-বিকাল দেখা হয়। আমি লোকটিকে অনেকটা জেরার ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করি, আপনার সাথে কি আমার প্রতিদিন দেখা হয় নাকি যে, এখনকার জবাব পরে জানতে পারবো?

লোকটি হেসে ফেলেন খুব আপনভাবে। আরে আগে কি হতো না হতো তা চিন্তা করে কি লাভ। তুমি দেখে নিও, তোমার সাথে আমার প্রতিদিন না হোক সপ্তাহে একবার দেখা হবেই, তুমি দেখে নিও।

আমার মনটা ভরে যায় আনন্দে, কত আপন মানুষের মত কথা বলছেন ভদ্রলোক। আবার দেখা হবেই, এ ধরণের কনফিডেন্স ক'জনেরই বা আছে।

আমি একটু নড়েচড়ে বসি। নিঃসাড় হয়ে বেঞ্চি আঁকড়ে পড়ে থাকতে ভাল্লাগে না, বেঞ্চির সাথে ভাবটা আরেকটু জীবন্ত করে তুলি নড়েচড়ে। পায়ে সুড়সুড়ি লাগছে দেখে তাকিয়ে দেখি একটা ঘাস ফড়িং এসে সেন্ডেল বিহীন আমার উদাম পায়ের ওপর মহানন্দে বিচরণ করছে। একটু সুড়সুড়ি লাগলেও খুব ভালো লাগছে আমার। মনে হচ্ছে ঘাস ফড়িংটির সাথে আমার ভাব না জানি কত পুরনো।

মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যায় পুরো পার্ক জুড়ে। গাছের শুকনো ঝরা পাতারা যেন দল বেঁধে আমাদের চারপাশে এসে জমা হতে থাকে। আর কি হয়, ভদ্রলোক হঠাৎ করে বলে ওঠে, আচ্ছা আজ তাহলে এ পর্যন্তই থাক। বাকীটুকু কাল বিকেলে বলব, ঠিক আছে? ভদ্রলোকের কণ্ঠ কেমন ম্লান মনে হয়, মনে হয় যেন পুরনো কোন স্মৃতি এসে ঘায়েল করছে তাকে। তার চেহারায়ও সেই ছাপ স্পষ্ট লক্ষ করি আমি। মৃদু হেসে অস্ফুটে বলি, ঠিক আছে।



দুই.

সন্ধ্যার পর যখন বাসায় ফিরি তখন মা আমাকে জেরা করতে শুরু করেন। আমি মা'র আচরণে একটু অবাক হই। কারণ মা সাধারণতঃ আমাকে কখনো কোন কিছু জানার জন্য চেপে ধরেন না। জিজ্ঞেস করলেই উত্তর পেয়ে যান তিনি, চাপাচাপি করার কোন প্রয়োজনও পড়ে না। কিন্তু আজ এমন জেরা কেন? কোথায় ছিলাম এতক্ষণ, কি করেছি, সাথে কে কে ছিল না ছিল, বাসায় ফিরতে দেরী করলাম কেন, ইত্যাদি প্রশ্নে আমি প্রায় অতিষ্ঠ আর কি। কিন্তু এ সবের কোন হেতু খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাৎ করেই মা বলে ওঠেন, তোর বিয়ের ব্যাপারে সিরিয়াসলি চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই তোকে বিয়ে করাব আমরা।

আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়ি। প্রতিবাদ করে উঠি, এ কী বলছেন আপনি? এখনো মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হয় নি। কোন চাকরী-বাকরীও শুরু করি নি। এখুনি বিয়ে? না মা না, এখন আমি বিয়ে করব না।

বিয়ে তোকে করতেই হবে এবং তোর পছন্দের পাত্রীর সাথেই।

খুব জোরের সাথে বলেন মা। আমি আবার প্রতিবাদ করি- আমার কোন পছন্দ নেই মা। আমি এখন বিয়ে করব না। প্লিজ মা, আমাকে এমন শাস্তি দেবেন না।

আরে শাস্তির কি হলো এখানে! বিয়ে করবি, এই তো! নাকি হিমালয়ে চড়তে বলছি তোকে?

মা, হিমালয়ে চড়াও অনেক সহজ। কিন্তু বিয়ে! বাবারে! ও মা, আমাকে এবারকার মতো মাফ করো প্লিজ। আর ক'টা দিন। একটা চাকরী জুটিয়ে নিই, তারপর।

বলে আমি মায়ের দু'হাত জড়িয়ে ধরি। মা হাত ছাড়িয়ে আমার মাথায় হাত রাখেন। সস্নেহে বলেন, তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? তোর ওপর কোন কিছু চাপিয়ে দেব না আমি। তোর পছন্দের মেয়ের সাথেই বিয়ে দেবো, ঠিক আছে। আর যতদিন চাকরী না হয়, ততদিন তোর সমস্ত ভার আমাদের ওপর। তো না করছিস কেন?

আমি বুঝতে পারি মা হয়তো আমাকে সন্দেহ করছেন। ভাবছেন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কারো সাথে প্রেম করছি। কথাটা সত্যি না। তারপরও কিছুই বুঝতে পারছি না ভাব করে বলি, বেকার অবস্থায় বিয়ে করলে বউয়ের কাছে ছোট হয়ে থাকতে হবে না, মা? প্লিজ, অন্ততঃ ছোটখাট কিছু হলেও একটা কিছু জুটিয়ে নেই, তারপর আপনি যাকে বিয়ে করতে বলবেন তাকেই বিয়ে করবো।

না, যাকে-তাকে বিয়ে করতে হবে না। তুই যাকে পছন্দ করিস তাকেই বিয়ে করতে হবে এবং কিছুদিনের মধ্যেই। এখন বল তোর পছন্দের পাত্রীটি কে, তার পরিচয় কি?

আমি সলজ্জ হেসে ফেলি, না মা, আমার পছন্দের কোন পাত্রী নেই। আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।

মা প্রাজ্ঞের হাসি হাসেন। বলেন, বাবারে, আমি চাই না সামান্য সঙ্কোচের জন্য সারা জীবন তোকে পস্তাতে হোক। কোন মা তার সন্তানকে এমন খোলামেলা কথা বলে কি-না জানি না। কিন্তু আমি তোকে বলছি, সঙ্কোচের কাছে হার মানিস না বাবা।

না মা, আপনার সন্তান কখনো সঙ্কোচকে প্রশ্রয় দেয় না। সত্যি করে বলছি, কোন মেয়ের সাথে আমার ভাব নেই।

মা যেন বিপাকে পড়েন। কেমন ঘোরলাগা মনে হয় তাকে। হিসেবে কোথায় যেন গড়মিল হচ্ছে, বের করতে পারছেন না তিনি। যেন অনেকটা আত্মজিজ্ঞাসার মতোই বলে ওঠেন, তাহলে বিকেলে যে মেয়েটা ফোন করল কে সে?

এতক্ষণ পর আমার কাছে সব কিছু স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। বুঝি, মা কেন এতটা বিচলিত হয়ে পড়েন আমাকে নিয়ে। আমি হেসে ফেলে বলি,

মা, আমিও চিনি না মেয়েটিকে। সম্ভবতঃ আমার কোন বন্ধু-বান্ধবের পরিচিত কেউ হবে। এই সপ্তাহখানেক যাবৎ খুব জ্বালাতন করছে। ঠিক বিকাল হলেই ফোন করবে মেয়েটি। প্রথম দিন আমিই রিসিভ করি ফোনটি, কি আশ্চর্য, মেয়েটি আমাকেই চায়, তাও নাম ধরে। আর তারপর থেকেই প্রতিদিন ফোন করছে সে।

নাম কি মেয়েটির? মা গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করেন।

জানি না মা। যতবার নাম জিজ্ঞেস করি, ততবারই হাসে, নাম আর বলে না।

কিন্তু আমাকে যে বললো।

কি বললো মা?

অনামিকা।

না না ওটা ওর নাম নয়, হেঁয়ালি মা। হয়তো অন্য কোন নাম হবে তার।

তুই কি করে বুঝলি?

না, মানে, খুব হেঁয়ালি করে কথা বলে কিনা, তাই মনে হলো।

আচ্ছা শোন, ওকে বলেছি তুই ঢাকায় নেই, আগামী পরশু আবার ফোন করতে। পরশু ফোন করলে ওর নাম-ঠিকানা সব জেনে নিবি, প্রয়োজন আছে আমার।

মা'র কথা শুনে আমি রীতিমতো ঘামতে শুরু করি। বুঝতে পারি মা সত্যি সত্যি তার ছেলের জন্য উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধানে লেগে গেছেন। আমি কথা ঘুরানোর জন্য পার্কের প্রসঙ্গ টেনে আনি। মা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনেন। ভদ্রলোকের কথা এবং ভাবভঙ্গী সবই আমি বলি তাঁকে। মা আমার কথা এমন মনোযোগ দিয়ে শেনেন যে, আমি অবাক না হয়ে পারি না। একবারই শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, লোকটি দেখতে কেমন রে? আমি তার পুংখানুপুংখ বিবরণ দেই, লোকটির বাম চোখের নিচের বড় জরুলটার কথা বলতেও ভুলি না। কারণ, ঐ একটা জরুলের জন্যই লোকটির চেহারা অনেক মোহনীয় হয়ে উঠেছে। মা আবারও জিজ্ঞেস করেন, লোকটির সাথে তোর আবার দেখা হবে?

সম্ভবতঃ কালকেই হবে। কাল বিকেলে আবার পার্কে যাব। লোকটি যদি আসে তাহলে দেখা হওয়াটা অবান্তর কিছু না। আচ্ছ মা আপনি কি লোকটিকে চিনতে পেরেছেন?

কিভাবে চিনব, আগে কখনো দেখলে তো? অবশ্য তুই যেভাবে বলেছিস, তাতে আমি ভদ্রলোককে আপাদমস্ত চিনে ফেলেছি। একটু থামেন মা। আবার বলেন, আচ্ছা, লোকটি কি বিয়ে করেছে?

জানি না মা, আমি জিজ্ঞেস করি নি।

জিজ্ঞেস করে দেখিস, আমার ধারণা লোকটি বিয়ে করে নি। আজীবন কাটিয়ে দিয়েছে কোন অনামিকার জন্য।

মা'র কথায় আমি লজ্জ্বা পাই। আর কোন কথা না বলে এক প্রকার দৌড়ে পালাই সামনে থেকে।



তিন.

পরদিন আবার আমি এসে হাজির হই পার্কের সেই বেঞ্চিটাতে। দু'টাকার বাদাম কিনে খুব আয়েশী ভঙ্গীতে খেতে থাকি। লোকটি এসেছে কি আসেনি তেমন কোন ভাবনাই আমার ভেতর কাজ করছে না। কেমন উড়ুউড়ু ফুরফুরে ভাব আমার সারা অঙ্গে জড়িয়ে আছে। খুব ভালো লাগছে। একটা ছোট্ট চড়ুই উড়ে এসে ঠিক আমার সামনে ছোট্ট ফুল গাছটায় বসে আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, আবার উড়ে যায় ফুড়ুৎ করে। পার্কে বেড়াতে আসা এক পরিবারের দু'তিন বছরের ছোট্ট শিশুটি কি মনে করে দৌড়ে এসে দুই হাতে আমার প্যান্ট খামচে ধরে খিলখিল করে হাসতে থাকে।

আমি শিশুটির সাথে দুষ্টুমি করতে থাকি। এমন সময় সেই ভদ্রলোক যেন পাশের গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আসেন। আমার পাশে এসে বসতে বসতে তিনি বলেন, কি হে দেখলে তো, তোমার সাথে আবার দেখা হয়ে গেল!

আমি হেসে ফেলি, হঁ্যা তাই তো দেখছি। আপনি ভালো আছেন তো?

এই আছি বাবা এক রকম। একা মানুষ, খারাপ থাকি কি করে বলো! বলেই মজা করে হাসেন লোকটি।

আমি চট করে জিজ্ঞেস করে বসি, একা মানুষ মানে, আপনার কেউ নেই?

নেই মানে! আমার কত আপনজন আছে। তুমি আছ, প্রিয় ভাগ্নে শাবি্বর আছে, ভাতিজারা তো আমাকে ছাড়া ভাতই খায় না। কিন্তু ...

কিন্তু কি বলুন।

লোকটি নিরুপায় ভঙ্গীতে হাসেন। যেন ধরা পড়ে গেছেন তিনি। বলেন, কিন্তু আমার কোন ছেলেমেয়ে নেই।

কেন? আপনার কিংবা আপনার স্ত্রীর কোন সমস্যা আছে নাকি?

না না বাবা, তা নয়। আসলে আমি বিয়েই করি নি।

বলে লোকটি হাসেন। আমি হতবাক হয়ে যাই। এমন একটা মজার মানুষ বিয়ে করেন নি! কি আশ্চর্য! লোকটি সম্বন্ধে মা'র মন্তব্য মনে হলো। লোকটিকে বলি, জানেন, আমার মা'ও কিন্তু আপনার কথা শুনে বলেছেন, আপনি সম্ভবতঃ বিয়ে করেন নি।

তাই! তোমার মায়ের আইকিউ তো দারুণ শার্প। আচ্ছা তোমার মায়ের সাথে তোমার চেহারার কি মিল আছে?

হঁ্যা, তাতো কিছুটা আছেই। কিন্তু আপনি কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছেন?

না, এমনি। ভাবছি মায়ে-ছেলেতে দারুণ মিল থাকাটা খুব স্বাভাবিক, তাই না?

সরল হাসে লোকটি। আমিও হাসি। আবার ভাবি, এমন মজার লোকটি বিয়ে না করে সারা জীবন থাকতে পারলো কি করে? মা'র কথাটাই বলি লোকটিকে, আপনি কি সারা জীবন অনামিকা'র অপেক্ষায়ই কাটিয়ে দিলেন?

লোকটি চট্ করে একবার তাকালেন আমার মুখের দিকে। চোখে-মুখে তার উত্তেজনা। দ্রুত জিজ্ঞেস করেন, এই ছেলে, তুমি অনামিকা নামটা কোথায় পেলে?

আমি হেসে ফেলি, এমনি বললাম, কেন এই নামটি আপনার পরিচিত নাকি? তাছাড়া ঐ তরুণীর নামটাও তো বলেন নি আপনি। আচ্ছা, ঐ তরুণীর নাম কি তাহলে অনামিকা ছিল?

লোকটি অবাক বিস্ময়ে তাকান আমার দিকে। কেমন থতমত খেয়ে যান। বলেন, তুমি কি জাদু জান নাকি হে? সব কিছু বলে দিচ্ছ গড়গড় করে!

আমি পুলকিত হই। বেশ মজা লাগে। বলি, না না, মা'র কথাটাই বললাম আর কি। আমার কাছে এক অনামিকা প্রায়ই ফোন করে। মা সেটা ধরে ফেলেন, আর আপনার গল্প শুনে বলে ওঠেন, আমার ধারণা লোকটি বিয়ে করে নি। আজীবন কাটিয়ে দিয়েছে কোন অনামিকার জন্য।

কি জানি কি হয়, লোকটি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন আমার মুখের দিকে। যেন কোন কিছু আবিষ্কার করতে চাইছেন। আমি থতমত খেয়ে যাই। অস্বস্তি ভাব কাটাতে বলি, কি হলো স্যার, এভাবে কি দেখছেন?

লোকটি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলতে থাকেন, যে তরুণীর কথা তোমাকে বলছিলাম, যাকে আমি কথা দিয়েছিলাম তাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না, আমি যার ছদ্মনাম রেখেছিলাম অনামিকা, তার ছায়া আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার মুখে।

আমি লোকিটর কথায় মোহিত হয়ে যাই, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকি। লোকটি কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে যান। স্বগতোক্তির মতো বলেন, কি আশ্চর্য দেখো, আমার অনামিকা এত বছর পরও সেই আগের মতোই আছে। একটুও ভাঁজ পড়ে নি তার মুখে। ঐ দেখ, এদিকেই আসছে সে। দেখ বাবা দেখ, তুমি না আমার অনামিকার গল্প শুনতে চেয়েছিলে? এখন আর গল্প শোনার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি জীবন্ত অনামিকাকেই দেখ।

লোকটির কথায় আমি পিছন ফিরে তাকাই। চমকে উঠি মুহূর্তেই। আবার লোকটির দিকে তাকাই। লোকটি বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আবারো পিছন ফিরে তাকাই। হঁ্যা, আমার চোখ যা দেখছে তা সত্যি দেখছে। অনতিদূরে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে আর একজন, একজন অনামিকা, আমার মা।

[রচনাঃ ঢাকা 12.04.2004 ইং থেকে 10.05.2004 ইং]

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ ভোর ৬:০২

অরূপ বলেছেন: আপনি তো বেশ ভালোই লেখেন। এমনি পড়া হতো না। ব-লগের কল্যাণে হয়ে গেল!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.