![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১.
মানিকখালী রেলওয়ে স্টেশনটা ব্যস্ত স্টেশন না। ভৈরব জংশন থেকে প্রায় ৩৯ কিলোমিটার দূরে। ভৈরব জংশন আর কিশোরগঞ্জ স্টেশনের অনেকটা মাঝামাঝি জায়গা মানিকখালী । স্টেশনটা তেমন গুছানো না। স্টেশন মাস্টারের একটা কক্ষ আর একটা ছোট্ট গুদাম ঘর ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই। প্লাটফর্মের অপর পাশে দুটি খাবার হোটেল। এর মধ্যে একটির নাম ' বিসমিল্লাহ্ হোটেল ' । যদিও এ নামে এই হোটেলকে কেউ চেনে না। এখানকার সবাই এ হোটেলকে চেনে 'মতিনের হুটেল' নামে। এরা 'হোটেল' শব্দটা ঠিক মতো উচ্চারন করতে পারে না। এ হোটেলের মালিক মতিন সরদার। মধ্যবয়সী, হালকা পাতলা গড়নের। বয়স তেমন হয়নি তারপরও কুঁজো হয়ে হাটেন মতিন। প্রতিদিন তিনি হোটেলের সামনে ছোট্ট একটা টেবিল নিয়ে বসেন। সারাদিন পান চিবোন আর হোটেলের কাজে রাখা দুটো ছেলেকে ধমকান। স্টেশনের মতো এটাও তেমন ব্যস্ত হোটেল না। ব্যবসা ভালো হয়না তার মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকে। এজন্য কাজে রাখা ছেলে দুটোকে আরও বেশী করে ধমকান।সবচেয়ে বেশী ধমকান বকুকে ।বকুর বয়স বার বছর। প্রায় দু বছর হয় বকু মতিনের হোটেলে কাজ করছে। বকু স্টেশন থেকে দূরেই চাচার সাথে থাকে। বকুর আসল নাম 'বকুল' ।বকুর চাচা 'বকুল' কে 'বকু' বলে ডাকেন। পুরো নাম তিনি উচ্চারন করতে পারেন না। বকুর চাচা কোনো কাজ করেন না। সারাদিন ছনের খুপড়িতেই থাকেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি।বয়সের ভারে অনেকটা নুয়ে পড়েছেন। তিনি একা। বকু ছাড়া তার আর কেউ নেই। বকু যা কামাই করে তা দিয়ে কোনোরকম চলে। ছোট্ট এই ছেলেটাকে দিয়ে কাজ করাতে তার দ্বিধা হয়। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় নেই। তিনি চেয়েছিলেন বকুকে স্কুলে ভর্তি করাবেন। কিন্তু বকু স্কুলে গেলে কামাই করবে কে? এজন্য তিনি বকুর পড়ালেখার চিন্তা বাদ দিয়েছেন।তবে তার ইচ্ছা একদিন বকু স্কুলে পড়বে এবং তিনিই বকুকে স্কুলে ভর্তি করাবেন।
২.
দু দিন ধরে শীত একেবারে জেঁকে বসেছে। রাতে কনকনে শীতে ঘুমানো যায়না। দুপুরের আগে সূর্যের দেখা মেলে না।দুপুরের আগ পর্যন্ত চারিদিক কুয়াশায় ঢাকা থাকে।কনকনে ঠাণ্ডায় কেউ বের হতে চায় না। মানিকখালী স্টেশনের প্লাটফর্মের কাছেই কিছু লোক আগুন জ্বেলে তাপ পোহাচ্ছে। স্টেশন একেবারে জনশুন্য। স্টেশনে শুধু স্টেশন মাস্টার রহমতউল্লাহ্ আছেন।সবাই উনাকে 'রহমতউল্লাহ্ মাস্টার' নামেই চেনে। চাকরীর একেবারে শেষ বয়সে এসে গেছেন তিনি। বড় জোর আর এক বছর বাকী আছে। এ কনকনে শীতে জনমানবহীন স্টেশনে বসে থাকাটা বিরক্তিকর। কিন্তু তিনি নিরুপায়। স্টেশনে থাকতেই হবে তাকে। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কিশোরগঞ্জগামী আন্তঃনগর ট্রেন আজ দুপুর ১২ টার দিকে মানিকখালী স্টেশনে থামার কথা রয়েছে। প্রতিদিনই এ ট্রেন স্টেশন পার হয়ে যায় কিন্তু থামে না। আজ থামবে কারণ ঠিক সেই সময় ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা লোকাল ট্রেন মানিকখালী পার হয়ে যাবে। লোকাল ট্রেনটি মানিকখালী স্টেশন পার না করা পর্যন্ত কিশোরগঞ্জগামী ট্রেনটি থেমে থাকবে মানিকখালী স্টেশনে। রেলক্রসিং। লোকাল ট্রেনগুলোর কোনো ধরাবাধা সময় থাকে না।চলেও ধীরে। ঠিক কতক্ষণে লোকাল ট্রেনটা স্টেশন পার হবে আর ঠিক কতক্ষণ আন্তঃ নগর ট্রেনটি দাঁড়িয়ে থাকবে তা নিয়ে রহমতউল্লাহ্ মাস্টার চিন্তিত। ঘড়িতে সকাল ১১ টা ২৫ মিনিট। এখনও সূর্যের দেখা নেই। আকাশ কুয়াশার চাদরে ঢাকা। বেলা পড়ে এলেও ঠাণ্ডা এতটুকু কমেনি। রহমতউল্লাহ্ মাস্টার প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন ট্রেনের অপেক্ষায়। তার কাছে মনে হল তিনি ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছেন। এক কাপ চা খেতেই হয়। প্লাটফর্মেই দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন- " মতিন, এক কাপ চা পাঠাও।"
জবুথবু হয়ে বসে ছিল মতিন। মাস্টার সাহেবের ডাকে সাথে সাথে সাড়া দিলে বলল -" অনেক জার( শীত) করে মাস্টর ছাব ?"
রহমতউল্লাহ্ মাস্টারকে সে 'মাস্টর ছাব' বলে ডাকে। পিছনে পিছনে আবার বুইড়া বলেও ডাকে। মতিনের সাথে মাস্টার সাহেবের খুব খাতির। যদিও মতিন মাস্টার সাহেবকে পছন্দ করেনা। মাস্টার সাহেব প্রায়ই তাকে ধমকায়।
-"হুম, বকুরে দিয়া আমার টেবিলে চা পাঠাও।"
-" মাস্টর ছাব, আইজকা কোনো ট্রেন আইবো?"
-"হ, আইজকা ১২ টায় এগার সিন্দুর ট্রেন আসবো"
-" হেইডা তোহ প্রেত্যেক দিনই আহে"
-"আইজকা থামবো"
-"কন কি"
-"রেলক্রসিং"
মতিন সরদার খুশি হয়ে গেল। ট্রেন থামলেই ব্যবসা বাড়বে। লোকজন তার হোটেলে আসবে।আজকে তার ব্যবসা তাহলে ভালোই হবে। " ও বকু, ছাবের টেবিলে এক কাপ চা দিয়া আয়, ইসপেশাল চা দিবি।"
বকু চা দিতে গেল। ঠাণ্ডায় তার হাত কাঁপছে। হাতে কাপ, কাপটা পিরিচ দিয়ে ঢাকা। খট খট শব্দ হচ্ছে। মাস্টার সাহেবের রুমে ঢুকে চা টেবিলে রাখল বকু। বকু ছেলেটার জন্য খুব মায়া হয় রহমতউল্লাহ্ মাস্টারের ।সুন্দর মায়াকাড়া চেহারা ছেলেটার, বয়সের তুলনায় তেমন লম্বা হয়নি। অনেকটা আধমরা শরীরের গড়ন, চুল উসকো খুসকো, গায়ে কালচে ময়লার ছোপ ছোপ দাগ। এই ঠাণ্ডায় বকু লাল রঙের আধমময়লা জামা পড়ে আছে। মাস্টার সাহেব বললেন-" কিরে, জার করে?"
-"জি ছার"
-"ছুয়েটার নাই ?"
-"না ছার"
রহমতউল্লাহ্ মাস্টার মতিন সরদারের মতো অনুভূতিহীন নন। এততুকু একটা বাচ্চা এই ঠাণ্ডায় একটা পাতলা জামা পড়ে কাঁপছে এ দেখে রহমতউল্লাহ্ মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কি ভাগ্য এ ছেলেটার!! তার টেবিলের পাশেই একটা পুরনো ট্রাঙ্ক আছে। ওতে কিছু কাপড় আছে। ট্রাঙ্ক ঘেঁটে একটা একটা ছেড়া শাল বের করলেন। ওটা ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই যা বকুর গায়ে হবে। শালটা গায়ে জড়ালে একটু ঠাণ্ডা কম লাগবে বকুর। শালটা বকুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন-"নে, এইটা গায়ে দে, জার কম লাগবো"
-"না ছার "
-"আরে নে"
বকু এবার হাত বাড়িয়ে শালটা নিল। শালটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে মাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। সে মায়াকাড়া হাসি মাস্টার সাহেব তাকিয়ে দেখলেন। তিনি দেখলেন বকু আর আগের মতো কাঁপছে না। কিছুক্ষন আগের বকুর বিষণ্ণ মুখটা এখন হাসিমাখা। ছোট্ট একটা কাজ করলেন তিনি কিন্তু পেলেন অনেক বড় কিছু। বকুর হাসিমাখা মুখ। মাস্টার সাহেব ভাবলেন- জীবন বড়ই বিচিত্র!!
৩.
আরিফুজ্জামান সাহেব আজ বড়ই বিরক্ত। একেতোহ ট্রেন একঘন্টা লেট করে ছেড়েছে তারওপর আবার জনশুন্য এক রেলস্টেশনে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রেলক্রসিং। অজানা স্টেশন। জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখলেন সাদা সাইনবোর্ডে কালো কালি দিয়ে লেখা- মানিকখালী। ট্রেনের বাকী সবাই তার মতই বিরক্ত। আরিফুজ্জামান ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। তার কাঁধে তার অফিস ব্যাগ। দু দিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছেন। কিশোরগঞ্জ নামবেন। অফিস ব্যাগে পড়নের কিছু কাপড় আর একটা নতুন সোয়েটার। সোয়েটার কিনেছেন তার মেয়ের জন্য।নেভি ব্লু রঙের, স্কুলের জন্য। যা শীত পড়েছে এবার। ট্রেন থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকালেন আরিফুজ্জামান। ষাটোর্ধ বয়সী একজনকে দেখলেন হাসি হাসি মুখে ট্রেনটাকে ভালো মতো দেখছে। লোকটা ট্রেন যাত্রী নয়। আরিফুজ্জামান লোকটির দিকে এগোলেন।কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন-"চাচা, স্টেশন মাস্টার কোথায় বলতে পারেন?"
লোকটি হাসি মুখে জবাব দিল-" আমিই স্টেশন মাস্টার"
আরিফুজ্জামান অবাক হলেন। এই লোকটাই যে স্টেশন মাস্টার হবে তিনি তা ভাবতে পারেননি। অনেকটা ইতস্তত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন-" ট্রেন ছাড়বে কখন?"
-" তা তোহ বলতে পারি না। লুকাল ট্রেন পার হইলেই ছারবো"
- "লোকাল ট্রেন কতক্ষনে আসবে?" আনিফুজ্জামানের প্রশ্নে অনেকটা বিরক্তিভাব।
-"তাও বলতে পারিনা, ঠিক নাই। আপনে বরং মতিনের দুকানে বইসা নাস্তা পানি করেন" এই বলে স্টেশন মাস্টার প্লাটফর্মের অপর পাশে একটা ভাঙ্গা চোরা হোটেলের দিকে আঙ্গুল উচিয়ে দেখালো।
আর কোনো উপায় না দেখে আরিফুজ্জামান সেদিকেই যেতে লাগলেন।
রহমতউল্লাহ্ মাস্টার আজ খুব খুশি। তার জনশুন্য স্টেশন এখন অতিব্যস্ত । বড় ট্রেন থেমেছে। কলা ওয়ালা, পেপার ওয়ালা ,পানি ওয়ালারা স্টেশনে ভিড় করেছে। ট্রেনের লোকজনও কিনছে সেসব। স্টেশন মাস্টার হবার পর থেকে এরকম ব্যস্ততা তিনি আর দেখেননি।
'মতিন হোটেল' এ আজ রমরমা ব্যবসা চলছে।প্রায় সব টেবিল ভরা। মতিনও খুব খুশি।মনে মনে বলছে-আইজকা দিনডা ভালোই। বকু ও রতন ও ব্যস্ত। তারাও কোনোদিন তাদের 'বিসমিল্লাহ্ হোটেল' এ এত মানুষ দেখেনি।
আরিফুজ্জামান সেই ভাঙ্গাচোরা হোটেলে ঢুকলেন।হোটেলে ঢুকতেই মধ্যবয়সী এক লোক তাকে দেখে বলল-" আসেন ছার,আসেন।বসেন, বকু ছাররে চা দে"
হোটেলে অনেক মানুষ। আরিফুজ্জামান একেবারে শেষ মাথায় একটা টেবিলে বসলেন। উপরের ছাদ বেড়ার । একটু বৃষ্টি হলেই ভেঙ্গে পড়বে। উপরে তাকিয়ে আরিফুজ্জামান ছাদের অবস্থা দেখছিলেন। হঠাৎ কে একজন বলল-" ছার,এই লন চা"
আরিফুজ্জামান তাকিয়ে দেখলেন বার তের বছরের একটা ছেলের হাতে চা আর পিরিচে কিছু বিস্কুট। ছেলেটার চেহারা মায়াবী। খাকি রঙের হাফ প্যান্ট পড়ে আছে। গায়ে একটা পুরনো ছেড়া শাল জড়ানো। শালটা অনেক বড় ছেলেটার চেয়ে। শালটার পিছনটা মাটি স্পর্শ করছে। আরিফুজ্জামান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন তার দিকে। ছেলেটা তার মেয়ের চেয়ে প্রায় দুই বছরের বড় হবে। অথচ ছেলেটা এই ঠাণ্ডায় ছেড়া শাল আর আর হাফ প্যান্ট পড়ে হোটেলে কাজ করছে। ছেলেটা চা রেখে চলে গেল। আরিফ সাহেব তার মেয়ের কথা ভাবছেন। মেয়ের জন্য আনা সোয়েটার ব্যাগ থেকে বের করে দেখতে লাগলেন। প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়ানো চকচকে নতুন সোয়েটার। আরিফুজ্জামান ব্যাগের উপর হাত বুলালেন। সোয়েটারটা দেখে হঠাৎতার মনটা ভালো হয়ে গেল ।
মানিক খালী স্টেশনের কাছাকাছি ময়মনসিংহের লোকাল ট্রেন পৌঁছে গেছে। ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। গোটা স্টেশনে হই রই পড়ে গেল। যে যেখানে ছিল সেখান থেকে স্টেশনে ফিরে ট্রেনে উঠে পড়ল। যারা হোটেলে ছিল তারা তাড়াতাড়ি খাবারের বিল চুকিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল। স্টেশন মাস্টারও তার রুমে থাকা ট্রেন আসার ঘন্টা বাজাতে লাগলেন। মতিন সরদার টাকা নেওয়ায় ব্যস্ত। তাড়াতাড়ি টাকা বুঝে নিচ্ছে সে। আরিফুজ্জামান ট্রেনের আওয়াজ শুনে চা শেষ করে বিল মতিন সরদারের হাতে দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লেন। যাবার সময় শাল পড়া ছেলেটার হাতে ৫ টাকা দিলেন।
আন্তঃ নগর ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। গন্তব্য কিশোরগঞ্জ। মুহূর্তের মধ্যেই মানিক খালী স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেল। পেপার, কলা ওয়ালারা তাদের ব্যবসার স্বার্থে অন্যত্র চলে গেল। হঠাৎ কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠা স্টেশন আবার কর্মহীন অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। রহমতউল্লাহ্ মাস্টারের হাসি হাসি মুখ এখন মলিন। তিনি তার ঘরে ফিরে গেছেন।চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছেন। মতিন তার মাত্র লাভ করা টাকা গুনছে। তার মুখ এখনও হাসি হাসি।
একেবারে শেষের টেবিলটায় পরিস্কার করতে গিয়ে বকু হঠাৎ দেখল টেবিলের বেঞ্চে একটা প্লাস্টিকে মোড়ানো ব্যাগ । কাছে গিয়ে বকু দেখল ব্যাগে একটা সোয়েটার। বকুর মনে পড়ল এই টেবিলে বসেছিল সেই লোকটা যে তাকে ৫ টাকা বখসিশ দিয়েছিল।ব্যাগটা নিয়ে সে দৌড়ে গেল স্টেশনের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখল পুরো স্টেশন ফাকা।কেউ নেই। মাস্টার সাহেবও নেই।বকু ব্যাগটা নিয়ে কি করবে ভাবল। মাস্টার সাহেবকে খুজে পাচ্ছে না সে, তাই ব্যাগটা তার মালিকের কাছে নিয়ে যাওয়াই ঠিক মনে করল বকু। মালিকের টেবিলের কাছে গিয়ে বলল-" ছার , এইডা পাইছি"
মতিন টাকা গুনছিল। না দেখেই অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করল-"কিতা?"
-"ছুয়েটার" বকু বলল।
-"ছুয়েটার??" মতিন এবার চোখ তুলে দেখল।
-"ওই ছার রাইখা গেছে, যে আমারে বখসিশ দিছিলো"
মতিন ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখল প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়ানো নীল রঙের সোয়েটার ।সে ভাবল-আইজকা দিনডা আসলেই ভালো!! মতিন ব্যাগটা তার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে বলল-"এইডা এখন আমার, আমার দুকানে ফালায়া গেসে,তাই জিনিস আমার"
বকু বলল-" ছার ফেরিত আইলে এইডা ফেরত দিয়া দিয়েন।"
-"যা, কাম কর" মতিন ধমকের সুরে বলল।
৪.
সন্ধ্যা নেমেছে। এখনও কিছু আবছা আলো আছে। স্টেশনের কিছু লাইট জ্বলছে। মতিন টেবিল ছেড়ে উঠে আগুনে তাপ পোহাচ্ছে। বকু এই সুযোগে টেবিলের ড্রয়ার খুলে ব্যাগে মোড়ানো সোয়েটারটা বের করে নিল। স্টেশনের ভেতর মাস্টার সাহেব তার রুমে আছেন। তার কাছে এ সোয়েটারটা দিতে হবে। বকু জানে এ সোয়েটার মতিন নিজের কাছে রেখে দিবে। বকু চায় এ সোয়েটার মাস্টার সাহেব রাখুক। বকু মাস্টার সাহেবের রুমে ঢুকল।রহমতউল্লাহ্ মাস্টার চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। বকু ডাকল-"ছার"
মাস্টার চোখ খুলে দেখলেন বকুর হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। বকু ব্যাগটা একটু টেবিলের দিকে এগিয়ে দিতেই মাস্টার সাহেব দেখলেন ব্যাগে নীল রঙের একটা সোয়েটার।
-"এইডা কই পাইলি ?" মাস্টার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
-"ছারে রাইখা গেছে আমাগোর দুকানে"
-"কোন ছার?"
-"যে ছারের কান্ধে ব্যাগ ছিল, ওই ছার আমারে বখসিস ও দিছিল" বকু বলল।
রহমতউল্লাহ্ মাস্টার বুঝলেন বকু কার কথা বলছে। ওই লোকটা তার সাথেও কথা বলেছিল। সেই তাকে বকুর হোটেলে পাঠিয়েছিল।
-"আপনে এইডা আপনের টেরাঙ্কে রাইখা দে্ন, ছার আইলে ফেরত দিয়েন।" বকু অস্পষ্ট স্বরে বলল।
মাস্টার সাহেব বকুর কথা শুনে অবাক হলেন। যে ছেলের শীতের কাপড় নেই,যে ছেলে শীতে ঠক ঠক করে কাঁপে সে ছেলে একটা নতুন সোয়েটার পেয়ে একটা বারও নিজের কথা চিন্তা করেনি উল্টো তার কাছে নিয়ে এসেছে। মাস্টার সাহেব আর কিছু বললেন না। বকুকে তিনি ছেড়া শাল দিয়েছিলেন তার ট্রাঙ্ক থেকে। বকুকে এর চেয়ে ভালো কিছু তিনি দিতে পারেননি। তিনি ভাবলেন বকুকে এই সোয়েটারটা দিয়ে দিবেন।কিন্তু পরক্ষনে চিন্তা করলেন সেই লোকটা যদি সোয়েটার নিতে আসে? তাহলে কি হবে?
বকু বলল-" ছার,যাই"
মাস্টার সাহেব আর কিছু বললেন না। বকু গায়ের চাদরটা ভালোভাবে জড়িয়ে বেরিয়ে গেল।
৫.
আরিফ সাহেব কিশোরগঞ্জে পৌঁছে বুঝলেন তিনি তার সোয়েটার মানিকখালীর সেই হোটেলে রেখে এসেছেন। তিনি কি করবেন , বুঝতে পারছেন না।নিজের ওপর তার খুব রাগ হচ্ছিল, কেন তিনি ভুলে গেলেন সোয়েটার-টার কথা যেটা তিনি তার মেয়ের জন্য এনেছিলেন। এ মুহূর্তে আবার মানিক খালী যাওয়া সম্ভব না।তাই তিনি বাড়ী গেলেন। ঠিক করলেন পরদিন সকালে তিনি মানিকখালী যাবেন সোয়েটারের খোঁজে। সোয়েটারটা পাওয়া যাবে তোহ? চেষ্টা করে দেখতে হবে। ওটা অনেক দামি সোয়েটার।হ্যা, কাল সকালেই যাবেন তিনি।
৬.
আজও সূর্যের দেখা নেই। দুপুর পেরোলে সূর্যের দেখা মিলবে। রহমতউল্লাহ্ মতিনকে বলেছেন চা দিতে।মতিন সকাল থেকে খুব চিৎকার চ্যাঁচামেচি করছে।সে বকুকে বার বার ধমকাচ্ছে। মাস্টার সাহেব জানেন কেন। মতিনের ড্রয়ার থেকে সোয়েটার উধাও হওয়াতে বকুর হাত আছে বলে সে সন্দেহ করছে।
বকু চা নিয়ে মাস্টার সাহেবের টেবিলে রাখল।
-"বকু"
-"জী ছার"
মাস্টার সাহেব ট্রাঙ্ক থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়ানো সোয়েটারটা বের করে টেবিলে রাখলেন এবং বললেন-
"এইডা তুই নে"
-"কেন ছার?" বকু ভয়ে ভয়ে বলল।
-"এই ছুয়েটার তুই পড়বি, তোর কুনু ছুয়েটার নাই, জারে কষ্ট পাস" মাস্টার সাহেব বললেন।
বকু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কিন্তু কিছু বলতে পারল না।
-"না ছার, এইডা যার , তারে ফেরত দ্যান"
-"তোর ওই ছার আইব না,এইডা এখন থিকা তোর, ছুয়েটারটা গায়ে দে তোহ দেহি, আইজ ভালো জার পড়ছে।" ব্যাগটা খুলে সোয়েটারটা বকুর দিকে এগিয়ে দিলেন ।
বকু কাঁপা কাঁপা হাতে সোয়েটার হাতে নিল। ছেড়া শালটা পড়ে সোয়েটার পড়ল। সোয়েটারটা বকুর মাপের না , অনেকটা বড়। বকুর প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি চলে গিয়েছে। সোয়েটারটা বকুর খাকি রঙের ময়লা হাফ প্যান্টটাকে ঢেকে দিয়েছে। মাস্টার সাহেব বকুর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। কি সুন্দর লাগছে বকুকে। ছোট প্যান্টের সাথে এতো বড় সোয়েটার বেমানান কিন্তু বকুকে এতেই সুন্দর লাগছে। বকু মাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল, যেমনটা হেসেছিল ছেড়া শাল পেয়ে। মাস্টার সাহেব এখন নিজেকে অনেক হালকা মনে করছে। মনে করছে, এই বাচ্চার মুখে হাসি ফুটিয়ে অনেক বড় কাজ করে ফেলেছেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বকুকে নিয়ে স্টেশনের বাইরে এলেন। মতিনের হোটেলের সামনে গিয়ে মতিনকে দেকে বললেন-" ও মতিন, দেখ, আমাদের বকুরে কি সুন্দর লাগতাসে"
মতিন নিজের দুই চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। বকুই তাহলে তার ড্রয়ার থেকে সোয়েটার চুরি করেছে।
মাস্টার সাহেব বললেন-" মতিন, আমি এই ছুয়ে্টার বকুরে দিছি, বল, কাজটা ভালো করছি না ?"
মতিন বলল-"জে ছার, ভালো করছেন।"
মতিন আর কিছু বলল না। মাস্টার সাহেব মতিনের ইতস্তত চেহারা দেখে বেশ আনন্দ পেলেন। মাস্টার সাহেব ভাবলেন এর চেয়ে ভালো কাজ তিনি আর জীবনে আর করেননি।
৭.
কিশোরগঞ্জ থেকে মানিক খালী প্রায় ২১ কিলোমিটার ।আরিফ সাহেব মানিকখালী স্টেশনে পৌঁছান সকাল এগারটায়। জনশুন্য স্টেশন। কোন ব্যস্ততা নেই। আরিফুজ্জামান প্লাটফর্মের ওপার থেকে মতিনের হোটেলটাকে দেখলেন।মতিন ছাড়া ছাড়া আর একটা মানুষও নেই। হোটেলের সামনে তিনি দুটো ছেলেকে দেখলেন আগুনে তাপ পোহাচ্ছে। এর মধ্যে একজনের গায়ে সেই নেভি ব্লু সোয়েটার। আরিফুজ্জামান বুঝতে পারলেন এই সেই মায়াবী চেহারার ছেলেটা। ছেলেটা হাসছে। ওর হাসিটা খুব সুন্দর। শেষবার যখন দেখেছিলেন তখন বাচ্চাটার গায়ে ছেড়া শাল ছিল।তখন তার মুখ ছিল মলিন। তখন সে ঠাণ্ডায় কাঁপছিল। আর এখন সে হাসছে, কথা বলছে, খেলছে। সোয়েটারটা তাকে খুব মানিয়েছে। আরিফুজ্জামান ভাবলেন। এ সোয়েটার এ ছেলের কাছেই থাকুক। এ সোয়েটার তিনি ফেরত নিতে চান না।তিনি ফেরত নিলে এ ছেলেটার এ হাসি আর থাকবে না। আবার বিমর্ষ হয়ে যাবে ওর মায়াবী মুখটা। তিনি এ ছেলেটাকে তার হাসি থেকে বঞ্চিত করতে চান না।
-"ভাইজান"
আরিফুজ্জামান চমকে উঠলেন। পিছনে ফিরে দেখলেন মাস্টার সাহেবকে।
-"আপনার ছুয়েটার আমি বকুরে দিছি, পুলাডা জারে কষ্ট পায়" মাস্টার সাহেব বললেন।
-"আমি আপনার জায়গায় হলে ঠিক এ কাজই করতাম" আরিফউজ্জামান বললেন। মাস্টার সাহেব অবাক হলেন। ভাবলেন, শুধু তিনিই নন, তার মতো আরও মানুষ আছে।
আরিফুজ্জামান এখন বকুর দিকে তাকিয়ে আছেন। বকুর হাসি দেখছেন, ছেলেটা হেসেই যাচ্ছে। ওর হাসি বোধহয় আজ আর থামবে না। তার কাছেও আজকে নিজেকে অনেক হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে তিনি আজ কোনো কিছু থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন।
..............................................^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^.............................................................
©somewhere in net ltd.
১|
১৭ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৯:৩৩
আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ভাত খাব| পরে পড়ে নেব খন