নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, এথনোগ্রাফার এবং গল্পকার

সায়েমার ব্লগ

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক

সায়েমার ব্লগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভয় আর হতাশা শাসনের হাতিয়ারঃ হতাশাবাদীর সঙ্গ পরিত্যাজ্য

২০ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:২৩

নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশে যারা সাবালক হয়েছিলাম,তারা স্বৈরাচার বিরোধী এক মহা-অভ্যুত্থানের সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী একটা নতুন প্রজন্ম তখন এক আধুনিকমনস্ক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কল্পনা করেছিল।এই কল্পনায় অনেক চিন্তা যুক্ত হয়েছিল যা মুসলিমপ্রধান বহুজাতির বাংলাদেশে জাতির যৌথ পরিচয়কে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। আমরা সে সময় পূর্ণ কিশোর- সদ্য গণতন্ত্র, রাজনীতি দেশগঠন নিয়ে নিজেদের মতো করে ভাবতে শিখছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের কাছেই বদরুন্নেসা কলেজে পড়তাম।সেই সুবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী প্রতিরোধী এক চেহারা, এক বীরোচিত চরিত্র আর জাতির গণতান্ত্রিক চিন্তার বিকাশের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছি।অসামান্য ঐতিহাসিক সেই ঘটনাগুলো, জনতার মিছিলের নগরী দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নেতৃত্ব, সাহস,আর সংগঠনের শক্তি দেখে নবীন নাগরিক আমি জীবনের শক্তি, সাহস ও আনন্দের জায়গা খুঁজে পেয়েছিলাম।আমার কিশোর মনে সেই আগুনঝরা দিনগুলো চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। স্পষ্ট মনে আছে রউফুন বসুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনাটি, পত্রিকার পাতায় তাঁর মৃতদেহের ছবি।বসুনিয়া তোরণের সামনে দিয়ে গেলে এখনও আমার লোমহর্ষ হয়।এক দশক ধরে স্বৈরাচারে পীড়িত,আশাহত,অন্ধকারাচ্ছন্ন পথহারা জাতির জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মনে হতো এক একটি বাতিঘর যেন। মাত্র ১৮-৩০ বছরের তরুনেরা সেখান থেকে বাংলাদেশের দিকনির্দেশনা সৃষ্টি করছিল। তারা ছিল আমাদের রিয়েল লাইফ সুপার হিরো। জেগে উঠেছিল গোটা দেশ।

দশ বছর আমাদের স্কুল জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে স্বৈরশাসনে। শুনতাম এরশাদের ক্ষমতা অসীম। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। আমরা ভাবতাম, এরশাদের বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই করবার নেই। স্বৈরশাসনে থাকাই আমাদের মেনে নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ তখন বহুদূরে বনবাসে।স্কুলের বইপত্রে ইতিহাসের জাতিয়াতি আর কারচুপির চোরাই কারবার। কিন্তু তারপরও কিভাবে যেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছু পড়ে ফেললাম, মনে নেই কিভাবে। কিন্তু মনে আছে তখন থেকেই মস্ত বড় ঘাপলা টের পেতাম।ভয়ের শাসন কাকে বলে সেটাই শিখতে শিখতে কলেজ পর্যন্ত পৌঁছলাম। আমার আব্বা সেই সময়ের জাতীয় দৈনিক, দৈনিক বাংলা, তে কাজ করতেন। কবি শামসুর রাহমান ছিলেন সম্পাদক। কবি আহসান হাবিব সহ-সম্পাদক। দৈনিক বাংলা থেকেই প্রকাশিত হতো বিচিত্রা। সম্পূর্ণ সরকারের অধীন।তা সত্ত্বেও অনেক বড় বড় লেখক-সাংবাদিক-কবিদের মোড় ঘুরানো চিন্তার সাথে পরিচিত হতে পেরেছিলাম এর ঐতিহ্য ও সাহচর্য থেকে। আব্বা দেশি-বিদেশি সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকার সৌজন্য সংখ্যা পেতেন।আমি সর্বভুক পাঠকের মতো সব গোগ্রাসে গিলতাম।সেই সময়ের অসাধারণ সেই সব লেখালেখি-আলোচনা থেকে আমার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপুষ্টি এবং চেতনার ডালপালা ছড়িয়ে বড় হতে থাকা।তাদের মধ্যে কয়েকজন উত্তরকালে আমার শিক্ষক হয়েছেন, যেমন আনু মোহাম্মদ, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রেহনুমা আহমেদ, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রমুখ।এঁরা আমার জীবনের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন, দীক্ষা দিয়েছিলেন এক মহত্তর জীবনের মন্ত্রে। ১৯৯০ সালের মহাঅভ্যুত্থানের সময় যখন আমি কলেজে পড়ছি, তার অল্প কিছুদিন আগেও এরশাদের চতুর, শঠ, নির্লজ্জ, নোংরা, যৌনপীড়নমূলক, স্বৈরশাসনকালের কখনও অবসান ঘটবে বলে মনে হতো না। প্রায়ই শুনতাম এসিডে ঝলসে গেছে কোন মেয়ে। হঠাৎ শুনতাম অপহরণ করা হয়েছে কাউকে, তারপর কি হয়েছে কেউ বলত না। ভয়ে শিটিয়ে যেতাম। সন্ধ্যার পরে এক মুহূর্ত বাইরে থাকতে পারতাম না। রাস্তায় মেয়েরা একা চলতে পারতো না। মানুষজন ফিশফিসিয়ে কথা বলত আর তাদের রক্তে বইয়ে যেত হিমশীতল ভয়ের স্রোত। আম্মা প্রতিমুহূর্তে ভয়ে ভয়ে থাকতেন যদি কারো বাড়ি ফিরতে দেরী হতো। এখন বুঝি কেন? দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরত তাঁকে।হতাশা আর ভয় ছিল আমাদের নিত্যদিনের সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনের অবধারিত বাস্তবতা। সুখের কথা হোল, আম্মার কোন দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়নি, সত্যি হয়েছে আমাদের নিয়ে আম্মার স্বপ্ন। আব্বার বেতন-বোনাস ভিত্তিক মধ্যবিত্ত পারিবারিক জীবনে কায়ক্লেশে বেঁচে থাকা ছাড়া আমাদের সামনে একটাই স্বপ্ন ছিল, প্রথম প্রজন্মের উচ্চশিক্ষিত নারী হয়ে পেশাদারি জীবন গড়ে তোলার নতুন দিগন্তের হাতছানিতে ছুটে যাওয়া।আম্মা মেয়েদের লেখাপড়াকে তাঁর জীবনের মিশন হিসেবে নিয়েছিলেন। আমরা ভাবতাম উচ্চশিক্ষাই মুক্তির চাবিকাঠি। শিক্ষাকে ইবাদতের মতো আঁকড়ে ধরেছিলাম।ভয়ের শাসন থেকে, নিষ্পেষণ থেকে, অপরের ইচ্ছার অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে লিখতে পারবার,বলতে পারবার,আত্মপ্রকাশের ও আত্মবিকাশের জন্যে, জীবনকে আনন্দে ঐশ্বর্যে ভরে তুলতে কি করতে হবে জানবার জন্যে পথে পথে বড় মানুষের সন্ধান করতাম, বন্ধুর সন্ধান করতাম, সংগঠনের সন্ধান করতাম, যারা এই হতাশা থেকে বেরিয়ে সৃষ্টির পথ দেখাবে, আশাহীনের বুকে আশা জাগাবে।ঢাকা শহরে পাওয়া যায়,সমস্ত বইয়ের দোকান, লাইব্রেরিগুলো আতিপাতি করে কি যেন খুঁজতাম।

এখন জানি সেদিনের নবীন কিশোর কিসের সন্ধান করতো। আমি সন্ধান করতাম আশা। আমি সন্ধান করতাম স্বপ্ন। আমি সন্ধান করতাম মুক্তির পথ। যন্ত্রণা থেকে বাঁচার উপায়। নির্ভয় নিঃশঙ্ক উচ্চশির জীবন। বেঁচে থাকবার গৌরব। জীবনের উল্লাস।পথে পথে অগণিত ছিন্নবস্ত্র, রুগ্ন, ক্ষুধার্ত শিশুদের, তাদের নিরন্ন মায়েদের অবজ্ঞা করে আমরা পথ চলেছি। এই ছিল এক চির-অপরাধী বেঁচে থাকা। ঘরে ঘরে অসংখ্য মেয়েদের নির্ভরশীল নিষ্পেষিত নিষ্ফল বিবাহিত জীবনের বাইরে নতুন কোন প্রেমময় পরিবার সন্ধান করতাম। বাংলাদেশের নারীদের জন্যে মর্যাদাকর জীবনের তালাশ করতাম।

নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের বিজয়ের দিনটি আমার মনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। রাজপথে জনস্রোতে লোকজন বলাবলি করছিল, যারা ১৯৭১ এ বিজয় দেখেনি, এটা তাদের জন্যে এক বিজয় দেখা। আব্বাদের দৈনিক বাংলা বিচিত্রাসহ দেশের সব পত্রিকা ২৭ দিন বন্ধ ছিল। খালেদা-হাসিনা এক সাথে রাজপথে ছিলেন। এমন জনস্রোত আর কখন দেখিনি। তো আমি সেই বিজয় দেখেছি। কিভাবে ভয়ের শাসন অপসারিত হয়, কিভাবে হতাশাকে অমর কবিতায় পরিণত করা যায় আমি তার সাক্ষী। আমি দেখেছি, গভীর হতাশার নিকষ আঁধারে, ভয়ের শীতল স্রোতে সেই সময়ে লেখা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের নতুন অমর কবিতা, গান, গল্প ও উপন্যাস।দেখলাম বাংলাদেশের একজন কলেজ না পড়া গৃহিণী নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেনাবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করলেন। আম্মা ভাবছিল শাড়ি পরে কিভাবে কুচকাওয়াজে যোগ দেবে। টিভির পর্দায় সে এক আশ্চর্য দৃশ্য!

জীবনে দুইবার আমি দেখেছি ভয় আর হতাশা কিভাবে গ্রাস করে আমাদের অধঃপতিত করে,আবার কিভাবে গভীরতর অন্ধকারের ভেতর একটা – দুটো তারা জ্বলতে শুরু করে। প্রথমবার দেখেছি এরশাদের পতন। দ্বিতীয়বার দেখেছি জাহাঙ্গীরনগরে মানিকগোষ্ঠীর পতন। ১৯৯৮ এর অগাস্টে যেদিন ছাত্রাবাসের মেয়েরা রাতে প্রথম মিছিল বের করে, তার ঠিক আগেও রক্তবাহিকায় ভয়ের স্রোত নেমে গিয়েছিল। আমার রুমমেট আমাকে বলেছিল,“আপা, সাবধানে থাইকেন, মানিকের হাত কত লম্বা আপনারা কল্পনা করতে পারছেন না”।দীর্ঘ অবস্থান ধর্মঘট-অবরোধের সময় ভয়ভীতি দেখানোর কোন অন্ত ছিল না। হতাশার চাষবাস করবার লোকেরও কোন অভাব ছিল না। ১৯৯০ এর গণআন্দোলন আর ১৯৯৮ এর ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন এর অব্যবহিত পূর্বে চরম হতাশা আর ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই দুই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হিসেবে আমি দুটি অমূল্য মুক্তিদায়ী শিক্ষা গ্রহণ করেছিঃ এক। যে কোন ক্ষমতাই চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব; কোন ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়, দুই। ভয় আর হতাশা সংক্রমণ থেকে নিজেকে এবং অপরকে বাঁচিয়ে রাখুন। ভয়ের চোখে চোখ রাখুন, হতাশার পালে হাওয়া দেবেন না। এই দুই বৈপ্লবিক মুহূর্তে আমি উপলব্ধি করেছি যে, ভয় আর হতাশা হোল আধিপত্য, নিপীড়ন, স্থিতাবস্থা পোক্ত রাখার হাতিয়ার। ভয় আর হতাশার পালে হাওয়া দেওয়া কোন পরিবর্তনকামীর জন্যে বিধেয় নয়। ভয় আর হতাশা শাসনের মোক্ষম অস্ত্র। পরিবর্তনকামীর অস্ত্র হোল আশাবাদ, প্রয়োজনে প্রমিথিউসের অন্ধআশাবাদ। বাস্তববাদী হতাশাবাদীর চাইতে অন্ধআশাবাদী অনেক শক্তিশালী। পরিবর্তনকামীর অস্ত্র, হিম্মত রাখা, হিম্মত না হারানো। পরিবর্তনকামীর অস্ত্র নিরন্তর সৃষ্টিশীল থাকা, সংগঠিত থাকা, হিম্মত ধরে রাখা। পরিবর্তনকামীকে ব্যাকল্যাশ হজমের ধৈর্য পরীক্ষা দিতে হবে।দুঃখ বরন করবার মন তৈরি রাখতে হবে। কিভাবে আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চাকে অকার্যকর থেকে কার্যকর করে নিতে হবে, তা আমাদেরই উদ্ভাবন করতে হবে। গণতন্ত্রের বা পার্লামেন্টের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি গড়ে তুলবার জন্যে প্রতিটি নাগরিক দায়িত্বশীল। যৌথ সমাজ যৌথ চেতনার সৃষ্টিশীলতার মধ্যে সরকারের রূপরেখা তৈরি হবে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।মনে রাখতে হবে,আমাদের প্রত্যেকের কথা ও কাজ, ক্রিয়া এবং নিষ্ক্রিয়তাই ইতিহাসের গতি ঠিক করছে। আপনি নিজেই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী। কোন বুদ্ধিজীবীর মুখপানে তাকিয়ে থাকবার প্রয়োজন নেই। নিজের অন্তরের সাথে কথা বলুন। সেখানেই আসল জবাব পাবেন।

'বর্তমান সরকার অথবা আগের সরকার কেউই ভাল নয়, না খালেদা- না হাসিনা।' 'বামেদের কোন আশা নেই।' 'তৃতীয় কোন শক্তি নেই।' ' ভোটের মধ্যমে নির্বাচিত করবার অপশনগুলোও ভাল না।' কিন্তু আপনার -আমার ভাল নাগরিক হতে কোন বাঁধা কোথায়? প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের চিন্তা ও কাজের জন্যে দায়িত্বশীল। আমার কথা ও কাজের জন্যে আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। আমার জিহ্বার মালিক তো আমিই, জিহ্বাকে সংযত রাখার দায়িত্ব তো আর সরকার নিতে পারে না। দায়িত্বহীন, লাগামহীন কথাবার্তা, মুর্খামি, নিষ্কর্মা, অপদার্থ নাগরিকত্বের দায়ভার আপনার নিজের। অহং ত্যাগ, কাম-ক্রোধ-লোভ নিয়ন্ত্রণের মালিক কেবল আপনি নিজে। আমার সৃষ্টিশীল, উদ্যমী হওয়ার দায়িত্ব তো আমার নিজেরই। আপনার জীবনের মিশন কি, বিপ্লবী না, আপোষকামী হবেন, কখন সরব হবেন আর কখন নীরব বিপ্লব করবেন, কবে আগাবেন, কবে পিছিয়ে যাবেন - সবই আপনি নিজেই ঠিক করবেন আপনার বিবেক-বুদ্ধি অনুসারে। আমার জীবনের মুহূর্তগুলো দিয়ে আমি কি করবো, সে-ও আমি ঠিক করি। তাই, প্রত্যেক ব্যক্তি শাসন কাঠামোর সম্মতি তৈরি করে। রাষ্ট্রের এবং পরিবারের ক্ষমতা জায়েজ করতে সম্মতি দেয়।যৌথ পরিচয়, যৌথ চেতনা সৃষ্টির কাজেও আপনি নিয়োজিত হবেন।সরকার জনগণের কর্তা নয়, দেশেরও মালিক নয়।এই কথাটা প্রথম আপনাকেই বিশ্বাস করতে হবে।জনগণ সরকারের স্রস্টা ও কর্তা।কদিন আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে বাচ্চারাই বলে গেল, আপনি কে?– দেশের মালিক। এবার আপনি ড্রাইভিং সিটে বসেন। দেশের দায়িত্ব নিন।অতন্দ্র পাহারায় থাকুন, দেশের ক্ষতি করলে বাঁধা দিন। আপনি স্টার্ট দিলেই দেশ চলবে। দেশ সেদিকেই যাবে, যেদিকে আপনি চালাবেন। হতাশাবাদীতা কয়েক দশক ধরে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।মহামারীর মত নাশ করে দিচ্ছে জনগণের মনোবল।এর সংক্রামক শক্তি থেকে দুরে থাকুন, বিশেষ করে বাচ্চাদের সবুজ আশার শক্তি ক্ষয় করবার চেষ্টা করবেন না, বরং পারলে পশ্চাদপসারন করুন, তফাৎ যান, যাতে নবীন আশা পথ করে নিতে পারে। হতাশাকে জাতীয় চরিত্রের অংশ করে তোলা আত্মঘাতী। নব্বইয়ের দশক থেকে দেখলাম, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাবে বলে লোকজন আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আমার শহর উত্তরার পাড়াকে পাড়া সাফ হয়ে গেল দেশান্তরের স্রোতে।তার তিরিশ বছর পরেও বাংলাদেশ বহাল তবিয়তে এখনও বঙ্গোপসাগরের তীরেই মৌসুমি বৃষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ আবাদী আছে। বাংলাদেশে বহু মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছে,পরিবার, সমাজ গড়ে তুলেছে। আবার বাংলাদেশ থেকে মানুষ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে। জৈব নৃবিজ্ঞান আমাদের জানায়, মানুষের আন্তঃ মহাদেশীয় দেশান্তর লক্ষ বছর ঘটে চলছে, চলবে। মোটে ৪০-১০০ বছরের আয়ুর ছোট এক জীবনের জন্যে মহাপ্রলয়ের ভয়ে ভয়ে সারভাইভাল মোডে কাটানোর মত বোকামি কি হতে পারে? বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশা ছড়িয়ে বেড়ানো নির্বোধ দায়িত্বহীনতা ছাড়া আর কিছুই না।গবেষণার নামে এরকম বহু কাজ আছে। আমরা অনার্সে পড়েছিলাম, "সীমিত সম্পদের প্রতিযোগিতা" নামে এক গবেষণা ভবিষ্যৎবানী করেছিল যে বাংলাদেশের সামনে আছে দুর্ভিক্ষ আর মহামারী। অথচ এখন বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।এসব গবেষকের কল্পনা পরিষ্কারভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করে। বরং নতুন প্রশ্ন করা যাক, আমার দায়িত্বে থাকা কাজগুলো সব করেছি তো? আমার ক্ষেত আমি চাষ করছি তো? আমার মানবজমিন আমি রোজ আবাদ করি তো? মৃত্যুর আগে বলে যেতে পারব তো, আমার কাজগুলো শেষ করে গেছি?

আমরা ভুলে যাই যে, পাকিস্তানের মাত্র ২৬ বছরের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাত্র দুই যুগ আগেই আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দুইশত বছর সংগ্রাম করেছিলাম।অগণন যোদ্ধা কোন স্বাধীন দেশ দেখে মরতে পারেনি, কিন্তু তারা জন্মজন্মান্তর ধরে অন্ধআশাবাদের তারা জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছে। সেই তারায় পথ দেখে মানুষের নতুন মিছিল যোগ দিয়েছে। রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন ব্রিটিশ শাসনের প্রথম একশ বছরেই দেড় শতাধিক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল এবং সেই অক্লান্ত সংগ্রাম-আন্দোলনগুলো ব্রিটিশ রাজত্বের শাসনের ছক ঠিক করেছিল।তারও আগে মুঘলরাও বাংলা সহজে পদানত করতে পারে নাই। স্বাধীন সুলতানের, বারো ভুঁইয়ারা বাংলা শাসন করতেন।বাংলা কোন এক দুই দশকের জনপদ নয়। বহুবার বহু অন্ধকার যুগ আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে। পাল আমলের স্বর্ণযুগের ঠিক আগে গুনে গুনে একশত বছর অরাজকতার অন্ধকারে আমদের পূর্ব পুরুষ-নারী কত প্রজন্ম কাটিয়ে দিয়েছেন।তার পর অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছিল এক মহা ঐশ্বর্যশালী যুগ। বঙ্গোপসাগরে এর আগেও ডুবেছে জনপদ, আবার ভেসেও উঠেছে। যদি মানব সভ্যতার দশ লক্ষ বছরের বিরাট ক্যানভাসে দেখি, তাহলে শতশত প্লাবন, দুর্যোগ, বরফ যুগ পেরিয়ে মানুষ এখনও পৃথিবীতে টিকে আছে। কখনও অধঃপাতে গেছে, গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে, প্রকৃতি ও প্রাণ-বৈচিত্র্য ধ্বংস করেছে, আবার সৃষ্টিশীল সমাজে জ্ঞান ও ঐশ্বর্যের শিখরেও উঠেছে।

এখনও আমরা গণহত্যার পরিণতি দেখছি, দারিদ্র্য এখনও আছে। আসল দারিদ্র্য হোল কল্পনার দারিদ্র্য,আর চিন্তার স্বল্পদীর্ঘতা, প্রেমের কার্পণ্য। সবচাইতে বড় ব্যর্থতা হোল - নিজেকে সম্মান করতে না পারা - নিজের জাতি, সম্প্রদায়, পরিবারকে সম্মান করতে না পারা। সবচাইতে বড় দুর্ভাগ্য হল, নিজের উপর বিশ্বাস হারানো। উপনিবেশিক দাসত্বের অধীন কলনাইজড আত্মা হয়ে পড়া। স্বাধীন কল্পনার ঐশ্বর্য আহরণ না করে এই প্রেতাত্মা হতাশার চাষাবাদ করে, এরা জাতির ঐশ্বর্য আবিষ্কারে অক্ষম। কীর্তিনাশা যেখানে থাকার সেখানেই আছে, কে সেখানে রূপ খুঁজে পায়? রূপসী বাংলা জীবনানন্দের রূপশালী কল্পনার সৃষ্টি, দেশপ্রেমের ফসল। বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপ, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, রিচুয়াল, জ্ঞাতিত্বের সম্পর্ক, সমাজের ঐশ্বর্য, সম্প্রদায়ের শক্তি আবিষ্কার করে নতুন জাতি কল্পনার জন্যে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, নন্দনতাত্ত্বিক, বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, নৈতিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। প্রত্যেকটি নতুন শিশুর সম্ভাবনার বাগানকে পরিচর্যা করতে হবে। শত ফুল ফুটতে দিতে হবে। তৈরি করতে হবে প্রতিটি বাচ্চাকে। কেউ বাদ পড়বে না। বাংলাদেশের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ প্রত্যেকটি মানুষ। মানুষ সর্ব উচ্চ সম্পদ। অথচ এখানে মানুষের জীবন ও সম্মান কত সহজে হরণ করা যায়! পরস্পরের প্রতি আমরা কি ভাষায় কথা বলি? পরিবারে কয়েকটিমাত্র মানুষের সাথে শ্রদ্ধাসমেত বাস করতে পারি না। সহকর্মীদের সাথে ঈর্ষা আর প্রতিবেশীদের সাথে হিংসা চরিত্রের অঙ্গ ! টেলিভিশনে আলাপচারিতার ন্যূনতম শোভন সীমার প্রয়োজন আমাদের নেই! এই কি আমাদের সামাজিক জীবন? প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে তার চিন্তার, ভাষার, তার আচরণের জন্যে দায়ী! আমরা ভুলে যাই যে, আমাদের মৃত্যুর পরেও বাংলাদেশ থাকবে, আর নতুন অনেক জীবন লক্ষ আশা অন্তরে নিয়ে বহুজাতির বাংলাদেশকে লক্ষ বছর আবাদ করে যাবে। ক্রনিক ভয়ের শাসন, কল্পনার দারিদ্র্য আর হতাশার চাষবাসে এই দেশকে বরবাদ করা যাবে না।

আমরা যা রেখে যেতে পারি তাহলো আত্মত্যাগ, আশা ও সাহসের গল্প, ছড়িয়ে দিতে পারি আনন্দ, উদ্দীপনা ও উল্লাস। আমাদের উজ্জ্বল জীবনের লিগেসি। আমাদের বিপ্লবী নৃত্য।

মন্তব্য ১৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৩২

বনসাই বলেছেন: শিরোনাম দেখেই কৌতূহল হলো; পড়তে ঢুকে পড়লাম। খুব বেশিই মিস করে যেতাম আপনার ব্লগে না আসলে।

মনে হচ্ছিল আমার সময়কেই আমি আবার দেখছি। এরশাদের সময়ের ঘটনা, বসুনিয়া তোরনের অনুভূতি, ব্রেনড্রেন, আশাহারা জাতি- আমার আশেপাশেরই কাহিনী।
লেখার শেষ অংশের সাথে আমি একাত্ম।

২| ২০ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৪৫

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ বনসাই! বৃহত্তর একাত্মতা সৃষ্টিই আমাদের লক্ষ্য।

৩| ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:০০

কানিজ রিনা বলেছেন: সত্যই সত্য লিখেছেন সেই এরশাদ শেখহাসীনার
ছায়াতলে। অসংখ্য ধন্যবাদ।

৪| ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০০

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: ছবিটা উপরে দিবেন।

২২ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:২২

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কিভাবে উপরে করা যায় বুঝতে পারছি না।

৫| ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ২:২০

জুনায়েদ বি রাহমান বলেছেন: আপু, আমার জন্ম তো নব্বইয়ের দশকে। এরশাদের শাসন শুনেছি, ভালো ছিলো না। তবে এতোটা খারাপ ছিলো জানতাম না।

এরশাদ পতনের আন্দোলন আর ধর্ষকের বিরুদ্ধে করা আন্দোলন থেকে আপনি যে দুটো শিক্ষার কথা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।

৬| ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৫৫

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর ঝর ঝরে লেখা।
সহজ সরল ভাষা।
আচ্ছা, এখন কি আমরা ভালো আছি? এরশাদ খারাপ, খালেদা বা হাসিনার সরকার কি ভালো?

২২ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:২৬

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: আমি হাসিনা-খালেদা ভাল কিনা, আমরা এখন ভাল আছি কিনা, এর বাইরে গিয়ে বলার চেষ্টা করেছি, যে ভাল দিন গড়ে তোমার জন্যে আমরা প্রত্যেকে দায়ী। সরকার আমাদের ভাল দিন এনে দেবে না। আমরা আমাদের যোগ্য সরকার সৃষ্টি করবো।

৭| ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৫৫

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর ঝর ঝরে লেখা।
সহজ সরল ভাষা।
আচ্ছা, এখন কি আমরা ভালো আছি? এরশাদ খারাপ, খালেদা বা হাসিনার সরকার কি ভালো?

৮| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৩৯

পাঠকের প্রতিক্রিয়া ! বলেছেন: দারুন অভিজ্ঞতা। গণতন্ত্র ফিরে("!";) পাবার সেই দিনগুলো সত্যই অসাধারণ।


আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এটা কী তাঁর মাল্টি???:D

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৩:১১

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: প্রশ্নটা বুঝলাম না।

৯| ২৭ শে জুলাই, ২০২১ দুপুর ১২:৩২

অজ্ঞ বালক বলেছেন: ড্যাম! ইউ আর গুড! প্রথম পোস্টে কমেন্ট আর মুগ্ধতা রাইখা গেলাম। এখন থেইকা আপনার পোস্টের অপেক্ষায় থাকবো।

১০| ১৬ ই মার্চ, ২০২২ রাত ১১:০১

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: আপনাদের সহৃদয় মন্তব্যের জন্যে অশেষ ধন্যবাদ!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.