নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, এথনোগ্রাফার এবং গল্পকার

সায়েমার ব্লগ

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক

সায়েমার ব্লগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

তফুরা

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:২৩

আশ্বিনের শেষাশেষি। খোলপেটুয়া নদীতে ভেসে উঠেছে বিসর্জিত দুর্গা দেবীর মুখখানা। সাদা সাদা কাশের গোছ ফুলে উঠে হাওয়ায় হাওয়ায় একটা নির্মল শুভ্রকান্তি শান্তি ছড়িয়ে আছে আকাশে আকাশে। নোনা বাতাস নোনা পানিতে দুই সপ্তাহে আমার চুল পড়ে ঘর ভরে যাচ্ছে। মেঘনা গুহঠাকুরতা আর আমি ফিল্ড ওয়ার্ক করতে দুই সপ্তাহ হল সাতক্ষীরায় এসেছি। আমি বাংলাদেশে এক বছর থাকবো, এর ছয়-আট মাস সাতক্ষীরাতে কাটাব, মেঘনাদি এসেছেন মোটে এক মাসের জন্যে । মেঘনাদি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের দুঁদে অধ্যাপক। সুন্দরবন নিয়ে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য। সুন্দরবনের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে তিনি প্রায় ১০-১৫ বছর ধরে চষে বেড়াচ্ছেন।পরিবেশ নৃবিজ্ঞানে তাঁর বিশেষজ্ঞতা, ক্ষেত্র বিশ্ব জলবায়ুর পরিবর্তন। আমি কাজ করছি চিংড়ী চাষের ফলে কৃষক পরিবারগুলোর রূপান্তর নিয়ে, পিএইচডি করছি নেদারল্যান্ডসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।মেঘনাদি এখন সেখানকার ভিজিটিং প্রফেসর এবং আমার গবেষণার পরামর্শক। দুর্গা পূজার সময়টা আমরা এখানেই ছিলাম। শ্যামনগরে একটা অতিথিশালায় আমাদের থাকার বন্দবস্ত হয়েছে। এখানে অনেকগুলো এনজিও কাজ করে। তাদের কর্মীদের জন্যে রয়েছে থাকার বন্দোবস্ত। আমরা উঠেছি সুশীলনের অতিথিশালায়। এখান থেকে টানা লম্বা ঝুল বারান্দা থেকে দেখা যায় নদী, নদীর ওপারে সুন্দরবন, যাকে বলে মনোহর দৃশ্য। আমরা রোজ সকালে কাজ করতে গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াই, সাক্ষাৎকার নেই। সঙ্গে থাকে আমাদের সহকারী এবং অনুবাদক স্থানীয় কলেজের এক ছাত্র বাদশা মিয়া। স্থানীয় কথ্যভাষার ধরনগুলো বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। মেঘানাদির শৈশবে তাঁর বাবা-মা সাতক্ষীরা থেকে ১৯৭১ সালে ভোমরা স্থল-বন্দর দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ইন্ডিয়া চলে যায়। জ্যাঠা মশাইরা থেকে যান। তাঁর মৃত্যুর পর জ্যাঠাতো ভাইবোনেরা ধীরে ধীরে চাকুরী উপলক্ষ্যে ঢাকায় চলে যায়। মেঘনাদিরা বাড়িতে সাতক্ষীরার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। তাই, তিনি আমার চেয়ে সহজে কথাবার্তা চালাতে পারেন। কিন্তু, অনেক সময় তারও বাদশা মিয়ার সাহায্য লাগে। বাদশা মিয়া সুশীলনের তৃনমূল পর্যায়ের কর্মী হিসেবেও কাজ করে, চৌকস আর বুদ্ধিমান ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। অতিথিশালায় রাঁধুনি আছে, বাজার করবার লোক আছে। অতিথিদের তত্ত্বাবধান করে মোসাম্মৎ তফুরা। সুশীলনের অফিসার ইকবাল সাহেব এখানে থাকেন। সদাশয় মানুষ। আমাদের থাকা-খাওয়ায় সব ব্যবস্থা উনিই করেন। তফুরাকে তিনি এই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। পরিচয় করবার সময় বলেছিলেন, স্বামী নাই, পাঁচ বছরের ছেলে নিয়ে মেয়েটার জীবনটা তো চালাতে হয়।

তফুরা কেবল আমাদের খাওয়া পরিবেশনই করে না, বসে বসে অনেক গল্পও করে। দুর্গা দেবীর সাথে তাঁর চেহারার আশ্চর্য সাদৃশ্য। কুমোররা সম্ভবত তফুরার মতো চেহারাকে মডেল করে মূর্তি তৈরি করেন। তার ছেলের নাম, দৌলৎ, তফুরার মা, আসিয়া বিবির সাথে থাকে। তফুরা রাতে অতিথিশালার পাশে বাড়ি চলে যায়।

আমি মাঝে মাঝে তফুরাকে গল্পসল্প করবার জন্যে রেখে দেই।ছেলে নানীর ন্যাওটা, মায়ের জন্যে বায়না করে না। তফুরার বাবা ছিলেন সুন্দরবনের বাওয়ালী। বাঘের হাতে প্রাণ দেন। সকাল থেকে গ্রামে গ্রামে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে আমরা অতিথিশালায় ফিরে আসি। খেতে খেতে বেলা পড়ে যায়। বিকালে ফিল্ড নোট লিখি তারপর মেঘনাদির সাথে চা খেতে খেতে গবেষণার বিভিন্ন তাত্ত্বিক আলোচনা করি। সাতক্ষীরা-কলারোয়া রোড ধরে মেঘনাদি মাঝে মাঝে পদ্মপুকুরে তাঁর ঠাকুরদার বাড়ী দেখতে যান, জ্ঞাতিগোষ্ঠীর অবশিষ্টদের সাথে দেখা করেন। আমিও একবার গিয়েছি। মেঘনাদিকে আমি বলি, আপনি তো পুরোপুরি এখানকার নেটিভ। মেঘনাদি বলেন, তুমিও তো নেটিভ।
-আমি তো খুলনার আঞ্চলিক ভাষার আলাপ করতে পারি না। আমি নোয়াখাইল্যা।
-হুম।
এরপর আমরা গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় ঢুকে পড়ি।
মেঘনাদি নৌকায় করে সুন্দরবনে করে যায়। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরি। চিংড়ী চাষের রমরমা বাণিজ্য একটু থিতিয়ে পড়েছে। সাদা সোনার আগের দিন আর নেই। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে চিংড়ী চাষের ফলে ফসলী খেতগুলো অনাবাদী হয়ে গেছে। মেঘনাদির জ্যাঠাতো দাদা বলেন, শ্যামনগর দুধের আর মিষ্টির ভাণ্ডার ছিল। এখানকার মিষ্টি খেয়ে আমি তো বাড়ীর জন্যে পোটলা বাঁধার জন্যে মুখিয়ে আছি। বরুণদা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। বলেন, তুমি যা খাচ্ছ, ও কিছুই না। খেতে যদি ভোলা ময়রার মিষ্টি, সেই স্বাদ মুছে ফেলা যায় না। আর্মিরা তার পুরো পরিবারকে মেরে ফেলেছিল।

মেঘনাদির কর্ম-উদ্দীপনা আর দমের সাথে আমি পাল্লা দিতে পারি না। খাঁটি নিরামিষ-ভোজী, স্বল্পাহারী। আমি একবেলা কাজ করে সুশীলনে ফিরে পেট পুরে মাছভাত খাই, জিরাই, লেখালিখি করি। তাছাড়া, আমাকে ধীরে সুস্থে আগাতে হবে। অনেক সময় আছে। তফুরার ছেলেটা মাঝে মাঝে আসে, আমাকে ডাংগুলি খেলা শেখায়। আমি আর তফুরা প্রায় সমবয়েসী, অনেকদিনের বান্ধবীর মতো গল্প করি। মেঘনাদি কোথায় কোথায় বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় আর ল্যাপটপে বসে রাত জেগে ঘণ্টার পড় ঘণ্টা লেখে। আমি সন্ধ্যে ঘনাতেই রাতের খাবারের পাঠ চুকিয়ে কাঁথার নিচে পা ঢুকিয়ে ফেলি।

তফুরা আমার ইন্টারভিউ করে। আমার ব্যক্তিগত অনেক কথা জিজ্ঞেস করে নাড়ী- নক্ষত্রের খোঁজ বের করে ফেলে। আমি যে কথা হয়তো বন্ধুদের সাথেও বলিনি, তাকে বলতে শুরু করি। তফুরার প্রশ্ন করবার দক্ষতায় আমার পেটের সব কথা বেরিয়ে আসতে থাকে। একটু ঘনিষ্ঠ হতেই সে জানতে চায়, টুম্পা আপা, তোমার এখনও বিয়া হয় নাই? বিয়ার তো বয়েস হয়ছে মেলা দিন! আমি বলি, আরে বিয়ে কি জীবনের সব নাকি, বোকা ? জীবনে কত কিছু করার আছে, দেখার আছে! বিয়ে করে ফেললে তো আটকে গেলে। আমিও এই সুযোগে তাকে জিজ্ঞেস করি, তোমার বয়েস কম, অল্প বয়েসে বিধবা হয়েছ, এখন আবার তাহলে বিয়ে করো। ইকবাল ভাইকে বলে গ্রামের একটা ছেলে দেখব নাকি?
- আমি বিধবা না আপা।
- মানে? ইকবাল ভাই যে বল্ল তোমার স্বামী নেই।
- স্বামী আছে।
- কোথায় সে?
- ইন্ডিয়ায়, সন্দেশখালি, হেই কালিন্দীর অই পার।
- ইন্ডিয়ায় কেন? তোমার সাথে যোগাযোগ আছে?
- না। আমি কইতে পারি না সে কোথায় আছে।
- এই যে বললা সন্দেশখালি।
- ইন্ডিয়ার এক লোক বাংলাদেশে এসেছিল, সে বলিল, সে তাকে ইটের ভাঁটায় কাজ করতে দেখেছে।
- তোমার স্বামীর নাম কি?
- মোহাম্মদ দুলাল।
- তোমাদের কি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?
- না, আপা। সে চইলে গেছে।
- কেন, চলে গেল কেন ?

মেঘনাদি এই সময় ফিরে এলো। আমাদের আলাপে ছেদ পড়ে গেল।
- এই তোমারা কি আলাপ করছিলে টুম্পা?
- মেঘনাদি, তফুরা আমার ইন্টারভিউ করছিল।
- বাহ, তোমার যেমন ওদের জানার আগ্রহ, তেমন তোমাকেও ওদের কাছে অজানা থাকলে চলবে কেন? তোমাকেও প্রকাশিত হতে হবে।

এখানে সুন্দর সুন্দর কাঁথা পাওয়া যায়। সুশীলনের প্রোগ্রামে বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত, রোজগারের উপায়বিহীন মেয়েদের এই প্রোগ্রামে কাজে লাগান হয়। সে রকম সুন্দর একটি কাঁথায় নিচে শুয়ে আমি ভাবছিলাম, তফুরার কথা। এখানে একটা গ্রাম আছে, বলে বিধবাদের গ্রাম।সেখান থেকে এত লোক সুন্দরবনে ঢুকে আর ফেরেনি যে বিধবাদের একটা গ্রামই গড়ে উঠেছে। তফুরার মা তাদের মধ্যে একজন। তফুরাও সেই বিধবাদের দলেই চলে।

পরদিন বিকালে আমরা মুনশীগঞ্জে গিয়ে ঢাকা যাওয়ার টিকেট কনফার্ম করে আসলাম।খেয়াল করে দেখলাম অনেক ইটের ভাঁটা চারপাশে। আকাশ ঢেকে যাচ্ছে কালো ধোঁয়ায়।কাশের শুভ্রতার লেশ মাত্র নেই এখানে। বাদশা মিয়া আমাদের ইট ভাঁটার ফলে সুন্দরবনের ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে একটা লেকচার দিয়ে দিল। আমিও নোট করে ফেললাম। মেঘনাদি ঢাকায় একটা কনফারেন্স করে আমস্টারডাম যাবে।আমিও মেঘনাদির সাথে দুই সপ্তাহের জন্যে ঢাকা যাচ্ছি। আমাদের কাজ কিছুটা গুছিয়ে ফেলার সময় হয়ে এসেছে। গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে ইন্টার্ভিউগুলো বাকি। তফুরার স্বামীর গল্পটা আমার মাথায় ঢুকে গেল। কখন বাকি ঘটনাটা জানবার সুযোগ পাব সেই অপেক্ষায় থাকলাম।

সকালে উঠে দেখি, সাবধানতা সত্ত্বেও যা হবার তাই হয়েছে। ওরস্যালাইন খেতে খেতে আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকলাম, যাতে দিনগুলো খরচা হয়ে না যায়। মেঘনাদি বল্ল, তুমি আজ ঘরেই থাক। তফুরা আজ নিজে রান্না করে দিল। সামান্য মসলায় রান্না তরকারী দিয়ে বিরুই চালের ভাত অমৃতের মতো লাগলো। ইকবাল ভাই ডাক্তারের ব্যবস্থা করলেন। ডাক্তার দেখে বল্ল, ওষুধ- বিষুধ খামখা না খেয়ে বিশ্রাম করলেই ঠিক হয়ে যায়। ডাবের পানি আনবার ব্যবস্থা করা হোল। আজ আর আমার কাজের ব্যাপারে একেবারেই মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করল না। আমি শুয়ে শুয়ে হাসির গল্প পড়তে শুরু করলাম। খান মোহাম্মদ ফারাবির “মামার বিয়ের বরযাত্রী” আমি কত বার যে পড়েছি তার হিসেব নেই। এর মধ্যে তফুরা দৌলৎকে নিয়ে এলো। খবর দিল, ইকবাল ভাই সামনের সেশন থেকে সুশীলনের স্কুলে দৌলৎ এর ভর্তির সব ব্যবস্থা করবেন। আমি দৌলৎকে একটা ভুতের গল্পও বলে ভয় দেখাবার চেষ্টা করলাম। শক্ত ছেলে, ভয় পাওয়ার বান্দা না। বল্লাম,
- আমার সাথে যাবে?
- কোথায়?
- ঢাকায়।
- আম্মাও যাবে?
- যাবে।
- তোমার আম্মা আর তুমি। আমাদের সাথে থাকবে। মজা হবে, তাই না?
এর মধ্যে তফুরা এলে বলে,
- কি যে বলেন আপা। এখান থেকে কোথাও আমরা টিকতে পারবো না নে। আমার আম্মারে কেডা দেখপে?

দৌলৎ বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকতে পারে না। বাইরে বাচ্চাদের সাথে খেলতে চলে গেল।
বাচ্চারা গোল হয়ে কি যেন একটা ছড়া কেটে খেলছে। আমাদের কথা থেমে যেতেই ছড়াটা শোনা গেলঃ


“হাফসা বিবি
কলের চাবি
কল ঘুরাইলে পয়সা পাবি
পইসা লইয়া ঢাকা যাবি
ঢাকা গিয়া বিয়া ববি।”

পয়সা লইয়া বিয়া ববি, মানে কি, যৌতুক? আরে অর্থহীন ছড়া কাটা তো সুকুমার রায় বলেই গেছেন। ডক্টর যুসও সেইকথাই বলেছেন, ছড়ার অর্থ খোঁজার মানে নেই।

- আফা, দুই সপ্তাহ পরে আবার আস্পেন তো? নাকি ভুইলা যাবেন? আমাগির পরান পুইরবে নে।
- আমার কাজ তো সবে শুরু। আমি যাব গরমের সময়।
- তাইলে তো আপনার সাথে অনেক দিন কাটাতি পাইরব।
- হুম।
- আফা, ঢাকায় কিসের লাগি যাতিছ?
- আমার বিয়া।
চোখ কপালে তুলে তফুরা বলে,
- বিয়া? তো আমাগির কইলে না? এই কইলে তুমি বিয়া করবা না?
- আরে তোমার সাথে একটু মজা করলাম। এখন কাবিন হবে। এই কাজ শেষ করে বিদেশ যাওয়ার আগে শুভ বিবাহ। তো বিয়ার মধ্যে এত কাজ নিলা ?
- হয়ে গেল।
- আসলে বিয়া-শাদী তো আর হিসাব করে আসে না। আপা, তুমি যারে বিয়া করতাছ, তাইন কি তোমার মনের মানুষ?
- মনের আবার মানুষ হয় নাকি, সংসার করার মানুষ হলেই হইল।
- শরের মানুষ, মেলা বিদ্যা, মেলা হিসাব-নিকাশ, তমার মন বইলা কিছু নাই?
- আমার কথা বাদ দাও, তোমার বিয়ার কথা বল। কেমনে তোমার বিয়া হইল?

দুলাল আমাগের পাশের গেরামের ছাইয়লা। ইশকুলে আমার উপরের কেলাসে পড়তো । সুন্দর গীত করতো। বনবিবির গীত। আমি ছুটো বেলায় বাবার সাথে নৌকায় মাছ ধরতে যেইতাম। তার বাপের লগে আমার বাপ একসাথে বনে ঢুকত, মধু, গোলপাতা আনত। আমার দাদাও বাওয়ালী ছিলা। আমি বাপের লগে নৌকায় খেলপেটুয়া নদীতে মাছ ধরতে যাইতাম শখ কৈরে। আরেক নৌকায় দুলালের আব্বা আর দুলালও থাকতো আমাগির সাথে। একবার তাঁরা বনের কাছে মামার পায়ের ছাপ আন্দাজ করতে বনবিবির দোয়া নিয়ে ভিতরে ঢুকল। কথা নাই, বার্তা নাই, আচানক বাঘটা আমাদের নৌকায় ঝাঁপ দেয়। আর একটু হলেই দুলালের ঘাড় মটকাত। আমি জানের ভয়ে দুলাল ভাইরে নিয়ে নৌকা এমন জোরে বাইলাম আর মামা কেন জানি আর শেষে আগাইল না। আব্বারা আইসে দেখে নৌকা একটা। তাঁরা ভাবসে আমরা তো শেষ। অই নৌকা নিয়া ঘাটে আইসা দেখে আমরা দুইজন থর থর কৈরে কাঁপতাছি। কিভাবে দুলালের জান বাঁচাইছি নিজেও কৈতে পারবো না। ডাঙ্গর হলি দুলাল বাপের সাথে কাজের লাইগে ইস্কুল ছাইরে দেয়। আব্বারে বাঘে নেয় যখন, আমি আসটো কেলাস পড়ি। আমার স্কুলে ছাড়ান হয়ে গেল। কেমনে কৈরে দিন কাইতেছে, বলতে পারবো না। ইন্ডিয়ান শাড়ি বেইচে আম্মা আমাগির বাঁচিয়ে রাখিসে। দুলাল ভোমরা বন্দর দিয়া ইন্ডিয়া যাওয়া- আসা করতো। শাড়ী আর কত তা আনত। ওপারের লোকের সাথে তার ভাল জানা শোনা আছাল। ওইখানে গেলি এক মসজিদে থাকতো। তুষখালি ঈদগাহ মাঠের ধারে। দুলাল বনবিবির পালা গাত। আমি শুনতে শুনতে ঘোরে চইলে জাতাম। পরান ভইরে পালা শুনতাম। আমার আম্মাও গীত গাত।

তফুরা সুর করে গেয়ে উঠে ঃ

“সুন্দরবনের মাতলা নদী ছল্লাত ছল্লাত করে
এক কুমিরের সাতটা ছানা রৌদ্র পোহায় পারে
গগণচুমি গাছের মাথা মেঘে ঢুইলা পড়ে
আর সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ নাচেরই তাল ধরে।“

আম্মার জন্যি আমি গীত বাইন্ধে দিতাম। দুলাল তাতে সুর বসাত। বনবিবির পূজার সুমায়, সেসব সকলে মিলে করতাম।

- এখন হয় না?
- হয় । আগের মতো না। পুরানো লোকজন সব কোথায় হারায় গেছে।
- এখন তুমি গান লিখো?
- সে গান আর বান্ধা হয় না। সুর বসাবে কেডা? বনবিবির পালায় আর যাই না।
- দুলালের সাথে তোমার বিয়ে হোল কবে?

দুলাল সেময় ঘন ঘন ইন্ডিয়া যায়। শাড়ী আইনে মুনশীগঞ্জের দোকানে সাপ্লাই দেয়। সে বছর বনবিবির পালা গান খুব ভাল গেইল। নদীতে মাছ উঠল মেলাই।পালা শেষ হইতে হইতে অন্ধকার নাইমে আইল। খানিক বাদেই ভরা পূর্ণিমার চাঁদে চারধার ফর্সা হইয়ে গেল।নদীতে তেজ কটাল । জোয়ারের ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ ছাড়া আর কিছু নাই। দরিয়ার নোনা পানি ঢুকতেসে।দুলাল বলে, তফুরা আইজ তরে দুর্গা দেবীর মতো লাইগছে। মনে আছে তুই আমারে মামার হাত থেকে বাঁচাইছিলি। তার পর থাইকে যেন তর জইন্যে বেঁইচে রইছি। যত দিন যায়, মনে হয়, তুই জানি আমার নিজের মানুষ। তর লগে সংসার করি, মন কয়।

আম্মা আর মুরুব্বীরা আমাদের নিকাহ পড়ায় দিল। এরপর আমরা আহসান সাবের দরগায় দোয়া নিয়া আসলাম। বছর ঘুইরে গেল। সংসার টানতে ভোমরা বন্দর দিয়া দুলাল আবার গেল অই পারে। সন্দেশখালির ইট ভাঁটায় কে নাকি তাকে কাজ দেবে বলেছে।
- কেন এখানে কাজ খুঁজতে পারল না?
- সুন্দরবনের বাওয়াল ছেইলা। ইট ভাঁটায় কাজ করবে?
- অই পারেও তো ইট ভাঁটা?
- সেখানে কি আর সে বাওয়াল?
- তারপর?

একদিন সে আমারে বলেঃ তফু, আমি কাল ওপারে যাবো। তোমার জন্যি কিছু টাকা-পইসা রাইখা গেলাম।
আমি তো অবাক। সে এই যায়, আবার দুদিনে ফিরে আসে। তাঁর জন্যি এত টাকা রাইখে যেতে হবে কেন?
আমি বল্লাম আমি ভোমরা পর্যন্ত যাবো তোমার সঙ্গে।
- অতদুর যাওয়ার কাজ কি? অই বাস ইস্তিশনের বগল পর্যন্ত যাও।
আমার মন কেমন কৈরে উঠল। মন বলে, আর যদি দেখা না হয়? আবার মনকে বলি, কি সব অলুইখুইনা কথা শয়তান মনে ধুকাচ্ছে।

ইস্টেশন পর্যন্ত দুই মাইল পথ আমরা হাঁটি। খুব জোরে হাওয়া দিচ্ছিল। ঝড়ের লক্ষণ। একটা চায়ের দোকান ছিল। আমারে চা-বিস্কুট খাওয়াইল। বাস ছাইরে দিতেসে, কিন্তু সে উঠে না। সেদিন তার চোখের দিকে তাকায়ে আমি চিনতে পারলাম না। যেন এক অচেনা মাইনসে। আমার মন কু ডাক দেয়, সে আর ফিরবে না।
- কোথায় গেল সে? বলে গেল না?
- না। তারপর থেকে ছয় বছর গেল। সে ফিরে আসে নাই।
- দুলালের জন্মের খবর জানে তো।
- নাহ। কেমনে জানপে?
- কোন খবর জানতে পেরেছ?
- আমদের বাড়ীর এক লোক তারে সন্দেশখালির ইটের ভাঁটায় দেখেছে।
- কি করে সেখানে?
- ভাল চাকরী পাইল। ইট ভাঁটা দেখাশোনা করে।
- সে তো ভাল খবর। তোমাদের টাকাপয়সা পাঠাবে, আসবে যাবে! এত দিনে ছুটি পাবে না?
- সংসার থেকে কি ছুটি হয়?
- সংসার?
- ইট ভাঁটার মালিক তারে পছন্দ করে রাইখে দিসে। তার মেয়ের সঙ্গে সংসার বসাইছে।
আমি অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলাম না। কি বলব, কি সান্ত্বনা দেব বুঝতে পারলাম না।

ঢাকায় যাওয়ার এসি ডিলাক্স বাসে মেঘনাদি আর আমি বেশ জমিয়ে বসলাম। মানে গল্পের বই আর এমপি থ্রি প্লেয়ার গুছিয়ে বসলাম, সঙ্গে শ্যামনগরের তিন বাক্স মিষ্টি। লম্বা একটা সময়। থেকে থেকে ঝিমাতে ঝিমাতে বাসের ঝাঁকুনিতে জেগে উঠি। না ঘুমাচ্ছি না জেগে আছি, এমন এটা অবস্থা।

মগজে ভ্রমরের মতো গুনগুন করে উঠল একটা চিন্তা, যদি আজ সৈকতের সাথে বিয়ে না হয়ে পলাশের সাথে হতো, তাহলে কি আমি বেশি সুখী হতে পারতাম? যদি পলাশ বিদেশে গিয়ে লা-পাত্তা না হতো? অন্য মেয়েকে বিয়ে না করতো? নাহ, এসব চিন্তা সেই আংটির মতো পদ্মপুকরে মাছের পেটে ফেলে এসেছি।






মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:২০

রাজীব নুর বলেছেন: খোলপেটুয়া নদী কি সাতক্ষীরায়??
চমৎকার গল্প।

০৯ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:১৮

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: হ্যাঁ, সাতক্ষীরায়! ধন্যবাদ আপনার সহৃদয় মন্তব্যের জন্যে!

২| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১০

মা.হাসান বলেছেন: শ্যামনগরের মিষ্টি কুড়ি বছর আগেও খুব ভালো দেখেছি।
খেটে খাওয়া মানুষের জীবন কাহিনী সব জায়গায়ই এক, খালি নামটা বদলে দিলেই চলে।
আপনার লেখা খুব ভালো লাগলো। নিয়মিত লেখার অনুরোধ করবো।

০৯ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:২১

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: আপনি কি দ' এর লেখক? অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছি।

৩| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৩২

মা.হাসান বলেছেন: আপনি কি দ' এর লেখক?

না ভাই , আমি কোন লেখক না। বিনে পয়সায় ব্লগে অনেক ভালো লেখা পাওয়া যায়, তাই পড়তে আসি।
দ নামের কোন বই পড়া হয় নি। লেখক-পাবলিশার এর নাম শেয়ার করলে খোঁজার চেষ্টা করে দেখতে পারি।

অনেক শুভ কামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.