নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, এথনোগ্রাফার এবং গল্পকার

সায়েমার ব্লগ

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক

সায়েমার ব্লগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফেস বাই ফেসঃ সাইবর্গ প্রেম ও যৌনতার উপাখ্যান

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১:৩১

যদিও আমি সাংবাৎসরিক পাঠক, প্রতি বছর বইমেলার মৌসুমে সবার মত কিছু নতুন বই পড়ার একটা ঝোঁক আসে আমার । লেখক- সাহিত্যিক বন্ধুদের পোস্ট থেকে তাদের বিভিন্ন লেখার খবরা-খবর পাই। বই কিনে সংগ্রহে রাখি। বাংলা সাহিত্যের পাঠে ও রসাস্বাদনে বড় হয়েছি আমি । তাছাড়া আমি একজন পেশাদার পাঠকও বটে । সেসব মেলা মেলা ভাবনা ও আড্ডার আলোচনা লিখে ফেলবার আলস্য অতিক্রম করে ওঠা হয় না। কিন্তু আজকাল পড়বার আনন্দে বঞ্চিত নাগরিকদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, যা পড়েছিলাম, যা আমার হৃদয়-মনকে তৈরি করেছিল, তাতে এই (পাঠ) বঞ্চিতদেরও ভাগ দেয়া যেতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই পাঠক আমি এবার লেখক চরিত্রে আবির্ভূত হতে চাইলাম।কয়েক বছর ধরে আমি ঠাহর করতে চেষ্টা করছিলাম যে, এই মুহূর্তের বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কুশীলব লেখক কারা? আমার নিজের বিবেচনার উপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিলাম না। আমার লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের সাথে আলাপও করেছি। কিন্তু সেই আলাপ অসমাপ্ত উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হয়েই রয়ে গেল। শেষ অধ্যায়ে পোঁছানো গেল না। তার চেয়ে বরং এক এক করে পঠিত লেখাগুলোর ভেতর আমার ভ্রমণের কাহিনী এবারে লিখিতভাবে সাহিত্যের আড্ডায় পেশ করি।

এক। ফেস বাই ফেস

এবার বই মেলায় যাওয়ার আগেই তরুণ লেখক মাহবুব মোর্শেদের কয়েকটি বই রকমারি থেকে কিনে নিলাম। অনেক দিন হাল আমলের লেখকদের বই তেমন করে পড়া হয়নি। বিশেষ করে উপন্যাস পড়বার আর সময়ই পাই না। শুরু করলাম "ফেস বাই ফেস" দিয়ে। ফেসবুক জমানার সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে ১০ বছর আগে প্রকাশিত মাত্র ১২০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি দুই টানে শেষ করে ফেললাম।

এক কথায় ফেসবুকের বৃন্দাবনে প্রেমলীলার কাহিনী। এই প্রেমকানন ট্রাফিক জ্যামে অচল নগরী ঢাকা আর প্রেমরসের রসিকেরা হলেন অবরুদ্ধ নিঃসঙ্গ নাগরিক, যৌন-পীড়িত বহু ও বিচিত্রগামী নারী ও পুরুষ। কিম্বা বলা যেতে পারে প্রেম ও যৌনতা প্রবঞ্চিত নির্বান্ধব নারী ও পুরুষ। এটি এমন একটি নিকৃষ্টতম নগরের কাহিনী যেখানে স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক মিলনের চরিতার্থতার কোন স্থানিক পরিসর প্রায় নেই।নেই সময়, কিম্বা জোরদার আকাঙ্ক্ষাও। শরীরী উপস্থিতি সমেত মানবিক বিনিময়ের স্থান-কাল সংকুচিত হয়ে পড়লে বাকি থাকলো দুটো যন্ত্র, কম্পিউটার আর মোবাইল ফোন। এই দুই যন্ত্রের ঘটকালি ছাড়া নারীপুরুষের মিলনের আর কোন পথ নেই। এই নগরীর নারী ও পুরুষ এই দুই যন্ত্রে প্লাগ ইন করে নিজের জৈবসত্তাকে যন্ত্র আর জৈবদেহের হাইব্রিড সাইবর্গে পরিণত করেই কেবল প্রেমের বৃন্দাবনে প্রবেশাধিকার পায়।আইডি আর পাসওয়ার্ড দিয়ে বৃন্দাবনের নাগরিকত্ব লাভ করে। যত দূর চোখ যায়, অরগানিক প্রেমের মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই ঠাহর হয় না। মরীচিকায় তেষ্টা মেটানোর জন্যে নারী থেকে নারী, পুরুষ থেকে পুরুষে ছুটে চলে এই সাইবর্গ মানব-মানবী। তাদের শরীরী তৃষ্ণার সঙ্গীত অশরীরী তারে তারে বাইট বাই বাইট স্পন্দিত হয়। অথচ, এই শরীরী কামনা খোদ শরীর-বিচ্ছিন্ন, অশরীরী, মাটি থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়া, মহাকাশে ভেসে বেড়ানো কক্ষপথহারা ফ্রি পার্টিকেলের জ্বলে উঠা ও নিভে যাওয়া। সেখানে না আছে উত্থানের চরম পুলক, না পতনের আবেশ। শরীরমুক্ত, যৌন-নৈতিকতার বাঁধামুক্ত সাইবর্গ মানব-মানবীরা শরীরের স্বাদ খুঁজে মরে।

এই কাহিনীর নায়ক শুভ বায়িং হাউসে মাঝারি গোছের চাকরী করা এক যুবক। মফস্বল থেকে ঢাকা শহরে আগত প্রথম প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত চাকুরে।কাজের বাইরে দিনের অনেকটা সময় কাটে ফেসবুকে। তার সামাজিক জীবনের কর্মকাণ্ড অনেকটাই সঙ্কুচিত। এই নগরে আত্মীয়তার সম্পর্কও নুন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, অফিসের সহকর্মী, মফস্বলে ফেলে আসা বন্ধু - এই মোটামুটি তার ক্ষীণকায় সামাজিকবৃত্ত। তার পরিবারের তেমন কোন উপস্থিতি এই নগরজীবনে অন্তত দেখা যায় না। ঘোর জ্বরেও সহপাঠী ছাড়া তার পাশে থাকবার মত কেউ নেই।সে কে, কার পুত্র, কোথা থেকে এসেছে, কোন বা দেশে ঘর - এই সব প্রশ্ন, তার ইতিহাস, বিত্তান্ত - এই উপন্যাসে অপ্রাসঙ্গিক। তিন্নি , নাজিয়া, সুপর্ণা, সাবিনা, রওনক - বিবাহিত, অবিবাহিত, ডিভোর্সি, সমকামী - তরুণী, প্রৌঢ় - তাহার প্রেমের বিস্তার বহু ও বিচিত্রগামী। এই পাত্র-পাত্রীরা পাঠকের কাছে এক ধরনের অচেনা আগন্তুক, এদের অতীত কি, ভবিষ্যৎই বা কি তার কোন স্পষ্ট ধারনা করা কঠিন। ভবিষ্যতে এরা কেমন বিশ্ব, কেমন সংসার গড়ে তুলবে- তা আমাদের অজানা। আমরা জানি না, কি তাদের সংস্কার, ধর্ম, নৈতিক চরিত্র - তথা চৈতন্য। সম্ভবত চরিত্রেরা নিজেরাও সে বিষয়ে স্পষ্ট নয়। এদের আলাপচারিতা থেকে ধরে নেয়া যায় মোটামুটি সেকুলার মধ্যবিত্ত যুক্তিশীল ভোক্তার দল।

নয়া-উদার সমাজের চাকুরে ও ব্যবসায়ী কনজিউমার নেটিজেন নাগরিকেরা ফেসবুকের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে খুঁজে বেড়ায় সঙ্গ, প্রেম ও কাম।এই নেটিস্থানের সীমানা বাংলাদেশ থেকে শুরু হয়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া অবধি- গোটা বিশ্বের দেশী সমাজ।বদ্ধ এই শহরের বাইরে পালাতে চায় কনজিউমার সিটিজেন নারী- পুরুষ। তারা কিনে নেয় হরেক রকম ট্যুর - জাহাঙ্গীরনগর, রাজস্থান, চীন কিম্বা তিব্বত । শাং রি লা, বকসাগর, মানস সরবর, রাজস্থানের মরুভূমি - এই সব ফ্যান্টাসিল্যান্ডে যাবার কল্পনায় এই সতৃষ্ণ নাগরিকেরা দিনে পর দিন অতিবাহিত করে।

প্রেমিকাকে শুভের প্রতিটি চুম্বন বিড়ম্বিত, মিলন তো দূর অস্ত । নেটিস্থানে প্রেম ও কামের অনুষ্ঠানও অশরীরী, রিচুয়ালও দূরদর্শন।বাংলাদেশে জীবন সাহা অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী হুইলচেয়ারবাসী মাধবীর সাথে কেবল ফেসবুকের স্ট্যাটাস বদল করে সামাজিক পরিচয়ে বিবাহিত বলে পরিচিত হল। মাটির দেহের সাথে মাটির দেহের মিলন, জাগরণ ও পুনর্জন্মের স্বাদ সুদূর পরাহত।বাস্তব শরীরী মিলনের চেয়ে চৈতন্য দখল করে নেয় মিলন দৃশ্যের ভিডিও। প্রেম, বিয়ে, পরিবার, সংসার, সন্তান পালনের এক ভার্চুয়াল পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। চেনা চেহারার প্রথাগত কোন পরিবারকে সেখানে ক্রিয়াশীল অবস্থায় দেখা যায় না। সমাজ অনেকটা ধোঁয়াটে, অবয়বহীন! পরিবার ভেঙ্গে অনু-পরমাণুর টুকরাগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে নীহারিকার ধুলোর মত ফেসবুকের মহাকাশে।একে অপরের সাথে মিলনের আকাঙ্ক্ষাও খুব আলগা, ঢিলেঢালা, হলেও চলে, না হলেও মন্দ নয়, বিরহযন্ত্রণা-বিবর্জিত ইনস্ট্যান্ট তৃপ্তি খোঁজা অতৃপ্ত আত্মার ছায়াপথ। কার কি ধর্ম-সংস্কৃতি, তাতে কিছু ফারাক পড়ে না। জেনবাদ, সূফীবাদ, যোগ, মেডিটেশনের নয়া আধ্যাত্মিকতা সামান্য উঁকি- ঝুঁকি দেয়, তবু নোঙ্গর ফেলে না।

মাহবুব তার লেখার কলা-কৌশলে এই সব পাত্রপাত্রীর পরস্পরের যোগাযোগের সময় পৃথিবীতে আর কি ঘটেছে, দেশে কি চলছে তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব, হউক সেটা চালের দাম, স্টক মার্কেট কিম্বা রাজনীতি। ফেসবুকের প্রেমিক- প্রেমিকাদের ভাত-কাপড়ের সঙ্কট নেই । সেই জগতে ফেসবুকের বাইরে যাবার তেমন কোন ইচ্ছা, উপায় অথবা প্রয়োজনও দেখা যায় না। এইসব মানবিক প্রেম ও কামকাতরতা জগতের বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন - উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের সাথে তার সম্বন্ধ অজানা।হয়ত সে কারণেই এই প্রেম এক রকম ক্লাস্টোফোবিক। লেখক হিসেবে মাহবুব পাঠককে কোন রিলিফ দেয় না, না কোন মূল্যবোধ আরোপ করে। ফেসবুকের বন্ধুত্বেরই মত এক ইলিউশন সৃষ্টি করে সে - জাহাঙ্গীরনগরের কাছে নাকি এক বক সাগর আছে! হা হা হা ! থ্যাঙ্ক গড! এই বকসাগর, শাং রি লা - না থাকলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত।

লেখক মাহবুব আমাদের এক নতুন সাইবর্গের দুনিয়ায় অবতরণ করিয়ে দিয়েছেন, যে সমাজের সম্পর্কের মেনিফেস্টো এখনও নির্মাণাধীন।

ফেস বাই ফেস- মাহবুব মোর্শেদ, ভাষাচিত্র প্রকাশনী, ঢাকা ২০১০, পৃষ্ঠা ১২০।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১:৫৬

নীল আকাশ বলেছেন: আপনাকে আমার 'শবনম' পড়ার আমন্ত্রণ দিচ্ছি। পড়ার পর এভাবেই সমালোচনা করবেন। আমি সেটা পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকবো। এখানে কোন অবাস্তব কিছু লেখা হয়নি। চোখের সামনে দেখা কিংবা পত্রিকাতে আসা ঘটনা গুলিকেই গল্পের আকারে লেখা হয়েছে। এক রঙ্গা এক ঘুড়ির স্টলে আছে এটা।

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:৫৫

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: সময় করে নেব!

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৯:৫৪

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: আপনার বইটি পড়বার ইচ্ছা রইল! দেশে ফিরলে সংগ্রহ করে নিশ্চয়ই লিখবো!

২| ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ৮:৫৯

রাজীব নুর বলেছেন: মাহবুব মোর্শেদ কি আমাদের সামুর ব্লগার ছিলেন??

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:৫৬

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: হ্যাঁ!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.