নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, এথনোগ্রাফার এবং গল্পকার

সায়েমার ব্লগ

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক

সায়েমার ব্লগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মরণশীলতা ও হোমা সাপিয়েন্সের ঘরে ফেরা

০৭ ই মে, ২০২০ সকাল ১০:০২

হোমো সাপিয়েন্সকে বধ করবার জন্য এক তুচ্ছাতিতুচ্ছ অদৃশ্য শক্তি মর্ত্যে আগমন করেছে, যা ঠিক পুরোপুরি জীবকোষও নয়, জীব ও জড়ের মাঝামাঝি এক তুচ্ছাতিতুচ্ছ জৈবকণা। হোমো সাপিয়েন্সের অর্থ ‘জ্ঞানী মানুষ’। এই কোভিড-১৯ ভাইরাস কেবল এই ‘জ্ঞানী মানুষ’কে বধ করে, আর কোন কম জ্ঞানী প্রাণীকে বধ করে না। মানুষের শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ে অন্য মানুষের শরীরে। অতিদ্রুত বংশবৃদ্ধি করে বন্ধ করে দেয় ফুসফুসের স্বাভাবিক কাজকর্ম। অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করে রক্ত সংবহনতন্ত্র। দম আটকে মারা যায় মহামরাক্রমশালী এই জ্ঞানী মানুষ। এত জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সম্পদ, অর্থনীতি, যুদ্ধজাহাজ, ব্যালেস্টিক মিসাইল, কৃত্রিম উপগ্রহ, পারমানবিক শক্তি উৎপাদন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বর্ডার, ইমিগ্রেশন আইন - কিছুই এই তুচ্ছাতিতুচ্ছ ভাইরাসকে আটকাতে পারেনি। অপ্রতিরোধ্য এই ভাইরাসের সাথে কোন বর্ডার, কোন ‘নাইস টল ওয়াল’ তৈরি করা গেল না। বর্ডারের ওপাশে আটকে থাকলো কেবল প্রান্তে আটকে পড়া উন্নয়নের কুফলে বিষাক্ত হয়ে পড়া মানুষের লোকালয়। ধনী, কর্পোরেট, রাজনৈতিক, আমলারা রাষ্ট্রযন্ত্র এবং বৈশ্বিক শক্তি ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে, নিজেদের অদক্ষতা ও স্বার্থপরতারকে ধামাচাপা দিতে মিডিয়া দখল করে মহামারি সম্পর্কে সত্য গোপন করে গোটা দুনিয়াকে বিপদগ্রস্থ করে ফেলেছে। অতি মুনাফার জন্য প্রতিদিন করোনায়, ক্ষুধায়, বেকারত্বে হাজারে হাজারে মানুষের মৃত্যুকে ‘নিও নরমাল’ করে ছেড়েছে। গরীব, বেকার, দূর্বল, রোগাক্রান্ত, বৃদ্ধ, কৃষক, শ্রমিক, অভিবাসী, আদিবাসীদের উপর মৃত্যুর শাসনতন্ত্র জারি করেছে। নির্লজ্জভাবে অপরের প্রাণের বিনিময়ে নিজেরদের জন্য টেস্ট কিট, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ ইউনিট, ভ্যাকসিন দখল করে নিজে একা বেঁচে যেতে চাচ্ছে।

এই মহামারির মহামরণশীলতার সামনে দাঁড়িয়ে, প্রত্যেক মানুষের মনে একবার হলেও মৃত্যুর ভীতি এবং বিগত জীবনের হিসাব-নিকাশ ভেসে উঠেছে, এমনকি ধনী ও ক্ষমতাবানরাও লাভ করেছে করোনার হিমশীতল স্পর্শ। মৃত্যুর মিছিলে আপনি-আমিও যে কেউ হতে পারি একটি নগণ্য সংখ্যা মাত্র। আমি, আমার পরিবার, আমার বন্ধু, প্রতিবেশী, প্রিয়জন - যাদের জীবন আমার কাছে পরম মূল্যবান, যারা আমার স্মৃতির অংশ- তাদের কারো না কারো মৃত্যু দেখে বেঁচে থাকতে হবে আমাকে। মানুষের মরণশীলতা এই মহামারির সময় বড়ই প্রত্যক্ষ সত্য হয়ে সকালে অমোঘ সূর্যের মত মাথার উপর ঝুলছে। এই রকম একটি সত্য প্রতিদিনের সকালের আলোর মত স্বাভাবিক মেনে নিয়ে আমাদের অনির্দিষ্টকালের লকডাউন জীবন চলছে। এমন সকালের মুখোমুখি দুনিয়ার মানুষ আর কখনও হয়নি। এই প্রথম বৈশ্বিক মহামারি, যা গোটা বিশ্বের চাকা গত প্রায় চার মাস ধরে একেবারে থামিয়ে দিয়েছে। গোটা দুনিয়াতে একযোগে এমন বন্ধ হয়ে যেতে কখনও দেখা যায় নি। আর কখনও গোটা পৃথিবীর মানুষ তাদের নিত্যদিনের ইহজাগতিক সব কাজ বন্ধ করে ঘরে বসে পড়েনি। প্রায় সমস্ত পৃথিবীর মানুষ ঘরে ফিরে এসেছে। উন্মাদের মত কাজের ছুটোছুটির ছুটি হয়ে গেছে। নতুন করোনা ভাইরাস মানুষের সাথে মানুষের মেলামেশা, সম্মিলিত হওয়া, সমাবেশ, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গড়ে ওঠা হোমো সাপিয়েন্সের সামাজিক জীবনকে তছনছ করে দিয়ে তাকে ঘরবন্ধ করে দিয়েছে। মানুষের সাথে মানুষের সাক্ষাৎ, মিলনমেলা, অনুষ্ঠান, বন্ধুত্ব, আড্ডা, সমাবেশ - সব স্বাভাবিক সামজিক প্রকাশকে বন্ধ করে দিয়ে গোটা বিশ্বকে কোন যুদ্ধ ছাড়াই একটানা অবরুদ্ধ করে রেখেছে মাসের পর মাস। কোন যুদ্ধ আয়োজন ছাড়াই এভাবে সব মানুষের নিজেদের লুকিয়ে ফেলা, শহরের জনমানবহীন রাস্তাঘাট, চৌরাস্তার মাথা -এক অভাবনীয় বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে। চারপাশে ছড়িয়ে রেখেছে এক পরাবাস্তব ভৌতিক ছায়া।

এই ঘরে ফিরে আসা আমাদের এক নতুন জীবন দিয়েছে, এক নতুন সমাজে বাঁচবার জন্য বাধ্য করেছে, যা আর কিছুতেই কখনও সম্ভব হয়নি। শত বছরের কোলাহল থেমে গেছে।গার্হস্থ্য সমাজ ছেড়ে চতুর্থ পর্যায়ের শিল্প সমাজে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। মানুষ আবার ফিরে এসেছে এক নতুন ধরনের গৃহভিত্তিক সমাজে। হয়ত আগামী কিছু সময় এই গৃহসমাজের ভেতরেই নিজেদের নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে নিতে হবে। নিজেদের আত্মজিজ্ঞাসার অন্ধকার টানেলের ভেতর থেকে আলোর রুপালী রেখা খুঁজে নিতে হবে।

মানুষের গোটা প্রজাতি আজ ঘরবন্দী, আর বাকী সব জীব-জানোয়ার দুনিয়ার বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষের প্রজাতিকে দুনিয়া থেকে বহিষ্কার করে দিয়ে ঘরে আটকে ফেলে প্রকৃতির প্রতিশোধের পালা চলছে। ইউরোপের শহরের রাস্তা জুড়ে চরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ী ভেড়ার পাল। মানবসৃষ্ট দূষণে ফুটো হয়ে যাওয়া ওজন স্তর নিজেই নিজেকে এই অবসরে মেরামত করে নিয়েছে। বিশ্বজোড়া দূষণ বন্ধ হয়ে আবার নির্মল উজ্জল সবুজ স্বচ্ছল স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে বিশ্বপ্রকৃতি। এই নির্মল পৃথিবী এই কোভিড-১৯ ভাইরাসের উপহার। তাই ঝাড়েবংশে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও এই সামান্য ভাইরাসের অসামান্য অবদানের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।অনেক ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ককে জোড়া দিয়েছে, সেটা পত্রিকায় খবর হয়ে আসেনি, এসেছে গার্হস্থ্য সহিংসতার পরিসংখ্যান। কেবল স্বামী- স্ত্রী নয়,ঘরে ঘরে ভাইবোন, মা-বাবা-সন্তান - তাদের সম্পর্ককে পুনর্বিবেচনা করছে, দূরের বন্ধুরা আবার কাছে এসেছে। আবার অবনতি ঘটেছে অনেক সম্পর্কের। সন্তান মাকে জঙ্গলে ফেলে এসেছে! করোনার এই মহাভারত লিখতে আমাদের কয়েক জীবন শেষ হয়ে যাবে। মানুষের অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতার, মূর্খতা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতা, প্রকাণ্ড লোভ একদম উদাম হয়ে আছে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে। আর একই সাথে মানুষ যার যা আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ক্ষুধার্ত মানুষদের খাওয়াবার জন্যে, চিকিৎসার জন্যে, লাশ দাফন করবার জন্যে। একটা ফুল স্কেল মহাকাব্যে যা যা থাকা সম্ভব সব আরও বড় স্কেলে প্রত্যক্ষ করছি মানবিক ট্রাজেডি। নুহের মহা প্লাবনের পরে এটাই বৃহত্তম বৈশ্বিক দুর্দৈব। এমন সময় আমরা বেঁচে আছি, আমাদের মানবত্বের পরীক্ষা দেয়ার জন্যে। আজকের রোজকার তুচ্ছ কাজকর্মগুলোই সামনের নতুন পৃথিবী তৈরি করতে থাকবে। নতুন দুনিয়া কেউ আমাদের তৈরি করে দেবে না। নতুন বসতি আমাদের নিজেদের নতুন জ্ঞান, দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে একদম করোনার ভেতরে পাওয়া কাঁচামাল দিয়ে নিজের হাতে গড়ে নিতে হবে। সেই সমাজ কেমন হবে তা আমরা এখনও জানিনা, কিন্তু এটা জানি যে, তার রূপরেখা রচনা হবে আমাদেরই হাতে।

গভীর ভাবে চিন্তা করলে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে একটা নবজন্মের উপলদ্ধি আসতে পারে। নয়া উদার অর্থনীতির ব্যস্ততার উন্মাদনায় ভুলে যাওয়া এই চরম সত্য, এই মরণশীলতার সাথে রোজকারের সাক্ষাৎ, বেড়ে ওঠা সংক্রমণ ও মৃতদের সংখ্যার উর্ধ্বগামী গ্রাফ এক হিমশীতল সত্যকে প্রতিদিন দৃশ্যমান করে রাখে। এই দিব্যদৃষ্টি ‘জ্ঞানী মানুষ’কে আরেকটি নতুন বিবর্তনের পথে আহ্বান করছে। তাই ২০২০ সালের মোড়ে এখন বসে আছি নতুন প্রজাতির জ্ঞানী মানুষের পথ চেয়ে, যারা প্রকৃতির এঁকে দেয়া ভাইরাসের লক্ষণরেখা লঙ্ঘন করবে না, আর মানুষের সাথে মানুষের কোন কৃত্রিম বর্ডার তুলে দেবে না।

আজকের এই আইসোলেশন, মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক মেলামেশা বন্ধ হয়ে যাওয়ার এই বিচ্ছেদযন্ত্রণা নতুন করে সম্মিলিত জীবনের শক্তিতে আস্থা রাখতে শিখাবে কী? যদি এই যাত্রা আমরা বেঁচে যাই, নিজেদের রূপান্তর ঘটাতে পারবো কী গভীরতর জ্ঞানী নভেল হোমো সাপিয়েন্সে?

মে ৭, ২০২০
উত্তরা, ঢাকা

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই মে, ২০২০ সকাল ১০:২৮

চাঁদগাজী বলেছেন:


এটি একটি মেডিক্যাল সমস্যা, মহামারী; ইহাকে থামাতে হলে ভ্যাকসিন বানাতে হবে, প্রতিষহেধক বানাতে হবে; আপনাদের এলাকার লোকজন ভ্যাকসিন বানাতে হবে, প্রতিষহেধক বানাতে চেষ্টা করছেন?

২| ০৭ ই মে, ২০২০ সকাল ১১:০৩

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: আপনার শুভ কামনা সত্যি হোক এই আশা পোষণ করছি।

৩| ০৭ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: সারা জীবন স্বামী-সন্তানের জন্য জীবন ব্যয় করা নারীকে মধ্যরাতে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসেছে স্বামী-সন্তান মিলে, করোনা পজিটিভ সন্দেহে। নিজে বাঁচার জন্য মানুষ সব কিছু করতে পারে

৪| ০৭ ই মে, ২০২০ দুপুর ২:২১

নেওয়াজ আলি বলেছেন: আপনি কতজন প্রতিবেশী লোকের উপকারে আসছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.