নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, এথনোগ্রাফার এবং গল্পকার

সায়েমার ব্লগ

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক

সায়েমার ব্লগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঙালীর ভালবাসার অবসর || বিশশতকের গোড়ায় উচ্চকোটি বাঙালীর পূর্বরাগ ও বিয়ে : শেষের কবিতার ছবিতে দেখা ||

০৪ ঠা জুন, ২০২০ রাত ১১:৪৭

এক।

ঔপনিবেশিক কলকাতার ইঙ্গবঙ্গ সমাজ নারী ও পুরুষের বৈবাহিক ও অবৈবাহিক সম্পর্ক কী হবে তার পুনঃসঙ্গায়নে এবং পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেছিল। তাদের সমাজসংস্কার আন্দোলনের একটি প্রধান জায়গা ছিল নারী ও পুরুষের সম্পর্কের সংস্কার। বাল্যবিবাহ এবং বহুগামিতা ও বহুবিবাহকে নিরুৎসাহিত করা, বিবাহের বয়স বৃদ্ধি, বিধবা-বিবাহের প্রচলন, স্বামী ও স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য হ্রাস ও তাদের সম্পর্কে অনুরাগের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালীর সংসার, তার ঘর-গৃহস্থালীতে পরিবর্তনের একটা প্রবল হাওয়া এসে পড়েছিল। এসেছিল নতুন প্রজন্মের জীবনযাপনের নতুন পন্থা— শেষের কবিতার চলতি হাওয়ার পন্থা। চলতি হাওয়ার পন্থিরা তাদের জীবনে নারীকে পেতে চেয়েছিল তার বরাবরে, পাশাপাশি আসনে— তারা একসাথে সাদা কুরুশের কাজের ঢাকনি বিছানো ভিক্টোরিয়ান ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে চেয়েছে, টুং টাং চায়ের আসরে পিয়ানোতে শুনতে চেয়েছে সিম্ফনি কিংবা একই সাথে সমবেতভাবে উপভোগ করতে চেয়েছে স্বদেশী মেঘদূত। রন্ধনখানা ও শয়নমন্দির থেকে গৃহের নতুন একটি কক্ষে, বৈঠকখানার আসরে কিংবা উদ্যানে বনভোজনে অনাত্মীয় সুহৃদ সমাবেশে নারীসঙ্গ আধুনিক পুরুষের আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠেছিল। বৈঠকখানা বাহির জগতকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল আর এই নতুন পরিসরে আবির্ভূত হওয়াই সেকালে নারীর জন্য ঘর থেকে বাইরে আসা; এখানে সে বাইরের বৃহৎ জীবনের বৃহত্তর ঘটনার সঙ্গে সংযুক্ত হয় যুদ্ধ, রাজনীতি, স্বদেশিয়ানা, স্বরাজ, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আলাপচারিতায়। বৈঠকখানার এই আলাপচারিতায় পাংক্তেয় ও যোগ্য হয়ে ওঠে পুরুষের উৎসাহে ও প্রেরণায় পশ্চিমা সাহিত্য পাঠ করে। তারা ’আধুনিক, সভ্য ও সুসংস্কৃত’ গৃহস্থালী গড়ে তুলতে চেয়েছে এভাবে পরিশীলন ও পরিমার্জনার অনুশীলন করে। জড়বৎ কাঠের পুতুল, বশ্য দাসিরূপ নারীর পরিবর্তে তারা নারীর লীলাময়ী সখিরূপের আরাধনা করেছে। ভ্রমরের চেয়ে রোহিনীর, আশার চাইতে বিনোদিনীর, গৃহিনীর চাইতে প্রেমিকার জন্য তারা উন্মুখ হয়েছে (হয়ত নারীও কখনও চেয়েছে ভূপতি’র চেয়ে অমলকে, ঘরের নিখিলেশের চেয়ে বাইরের সন্দীপকে)। একটু উচাটন হবার অবসর খুঁজেছে মডার্ন বাঙালী। গার্হস্থ্য সুখের চেয়ে প্রেমের অসুখের জন্য তাকে ভুতে কিলিয়েছে। একের পর এক সর্বনাশা গৃহদাহের পর দেখেছে কত নষ্টনীড়।
পাশ্চাত্য আধুনিকতার মনষ্কতাকে গ্রহণ করবার পর তাদের প্রয়োজন হয়েছে বান্ধবীর, বা বান্ধবী স্থানীয় স্ত্রীর— যার সাথে হেগেল, স্টুয়ার্ট মিল থেকে রমা রঁল্যা, মিকেলেঞ্জেলো থেকে গগিন, ডারউইন… বাগানের গুল্মের ল্যাটিন নাম নিয়ে সমানভাবে আলোচনা করা যাবে, বন্ধুদের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়া যাবে,— এমত গুণসম্পন্ন স্ত্রীর অধিকারী হিসেবে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব অনুভব করা যাবে। উচ্চশ্রেণিতে পরিণয়পূর্ব পরিচয় ও অনুরাগের সামাজিক স্বীকৃতি ও অনুশীলন শুরু হয় শিক্ষা, রুচি ও আভিজাত্যের নয়া প্রকাশভঙ্গিরূপে। আধুনিক শিক্ষা ও রুচিতে নির্মিত নতুন স্ত্রী এবং নতুন ধরনের দাম্পত্য সভ্যতা ও প্রগতির স্মারক হিসেবে প্রগতিবাদিরূপে পরিচিত হতে আগ্রহী যুবসমাজে আকাঙ্ক্ষিত ও আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। বাদশাহী আমলের প্রাচীন অভিজাত বংশের প্রথম এম. এ. পাশ, ‘ঘরে-বাইরে’র নিখিলেশ সাবেক নিয়ম ভেঙে একেলে হয়ে ওঠে স্ত্রীর সাথে তার সম্বন্ধের রীতি-রেওয়াজকে বদলে দিয়ে। বিমলা বলছে: ‘আমার স্বামী বরাবর বলে এসেছেন, স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি সমান অধিকার, সুতরাং তাদের সমান প্রেমের সম্বন্ধ’।
এভাবে বাংলার কৃষকসমাজের জীবনাচরণ, কৃষকসংস্কৃতি, মূল্যবোধকে পেছনে ফেলে মুঘল নগর ইসলামাবাদ, জাহাঙ্গীরনগর বা মুর্শিদাবাদের সমাজজীবনকে বিস্মৃতকালের গর্ভে রেখে দিয়ে আধুনিক কলকাতা নগরীতে পত্তন হয়েছিল আমাদের আজকের আধুনিক ঘর-সংসারের ভিটে-মাটি।
অনুরাগনির্ভর দাম্পত্য প্রেয়সিরূপ স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ততা ও একনিষ্ঠতা দাবি করে। এখানে প্রেম অর্থ তাই। কৃষকসমাজে পুরুষের একাধিক সম্পর্ক সামাজিকভাবে স্বীকৃত ও বৈধ ছিল, সমাজের দশজনের কাছে এবং নিজের কাছেও; ফসল তুলতে, খামার-গৃহস্থালীতে শ্রমের চাহিদা মেটাতে, জমি-জোতের রক্ষণাবেক্ষণে বহুপুত্রের জন্ম দিতেও প্রয়োজন একযোগে একাধিক স্ত্রীর, তারা একত্রে গৃহে বাস করত সহকর্মীর মতো ঈর্ষা ও সহমর্মিতার সম্পর্কে। ভূ-স্বামী ও জমিদার পরিবারে ঘরে ও বাহিরে— দু’প্রকার নারীর সাথে পুরুষের দু’রকমের সম্পর্কের প্রতি সমাজের ছিল অবাধ প্রশ্রয়। আধুনিক সংসারে পুরুষকে এক নারীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হল। কারণ সে এবার বলে— সে ভালবাসে, সে শুধু কর্তব্যের ভারবাহী নয়, সে রসিক, রূপ ও গুণের অনুরাগী, সমর্পিত হৃদয়, সে রমণীর প্রণয়লিপ্ত এবং সেই প্রণয়িনীর সাথেই সংসারধর্ম। ভালবাসা তৈরি করে নিরংকুশ অধিকার যেখানে আর কারো স্থান থাকতে পারে না। মতাদর্শিকভাবে এখানে বৈবাহিক অথবা অবৈবাহিক কোনোভাবেই আর তার অপর কোনো নারীর সাথে সম্বন্ধ সম্ভব নয়— যৌন তো নয়ই, বৈষয়িক, এমনকি মানসিকও নয়। এবং তা চিরকালের জন্য। এই হচ্ছে আধুনিকতার চূড়ান্ত আদর্শ। এর যে কোনো মাত্রার স্খলন পরস্পরের প্রতি চুক্তিভঙ্গের নামান্তর। কেবলমাত্র ঠাট্টার সম্পর্কে আর কাব্যিক কল্পনার মধ্যে হয়ত এর কোন ব্যত্যয় হওয়া সম্ভব ছিল, অন্য কোথাও নয়। অনেক স্ত্রীর মধ্যে প্রিয় ভার্যা, কোন পাটরাণী, সুয়োরাণী, দুয়োরাণী, বিবি আয়েশার সাথে দাম্পত্য প্রণয়ের লীলা এই আদর্শ গ্রহণ করে না। এদিক থেকে এক অর্থে এই আধুনিকতা পুরুষের ব্যাপক পরিশীলনের প্রকল্প; পুরুষ তার সামাজিকভাবে বৈধ ও প্রশ্রয় পাওয়া বহুগামিতা চর্চার সুবিধাকে ক্ষণকালের জন্যে স্থগিত করে রাখে এবং আশ্চর্যজনকভাবে নিজেই এই সামাজিক আন্দোলনের উদ্যোক্তা হয়ে। শিক্ষায়-রুচিতে, সহবতে-শিষ্টাচারে, স্বভাবে-চরিত্রে, ভাবনায়-ভঙ্গিতে, আবরণে-আভরণে, সাজ-সজ্জায়, ছলায়-কলায় আধুনিক নারী তৈরিতে পুরুষকেই প্রধান ও প্রবল উদ্যোক্তা রূপে দেখা গেছে, যার সাথে সে সূচনা করতে চেয়েছে নতুন যুগের নতুন সংসার। নারী তার হৃদয়ের রানী এবং তার গৃহের একছত্র কর্ত্রী। পুরোনো দাম্পত্য ছিল কর্তব্যনির্ভর, সংসার ছিল ধর্ম, ব্যক্তিগত ভালবাসা ছিল অপ্রাসঙ্গিক ও গৌণ— এমনকি দায়িত্বহীন গর্হিত আচরণ। সকল ত্যাগ ছিল কর্তব্য ও ধর্মের উদ্দেশ্যে, আনন্দ ও কল্যাণ ছিল তারই চরিতার্থতায়। বাঙালি জীবনে সেদিন প্রেম আসে একটি নতুন আদর্শ হিসেবে যার প্রতি সমর্পণ, যার জন্যে ত্যাগও সমাজে উচ্চ আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে থাকে। এরকম প্রেম-ভালবাসা হল উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি, সূক্ষ্মতর বুদ্ধিবৃত্তি ও সংবেদনশীলতার মূর্ত প্রকাশ যার সাথে কবিতা, চিত্রকলা, সংগীতের মতো সূক্ষ্ম সুকুমার কলার সুরসংগতি তৈরি হয়; যার মাধ্যমে জৈবিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনের সীমাকে ছাড়িয়ে জীবনের গুণগত উৎকর্ষ ঘটানো সম্ভব বলে মনে করা হয়। রোজকার ঘরোয়া প্রয়োজন, বৈষয়িক হিসাব-নিকাশ, দৈনন্দিনতার পুনরাবৃত্তি, একঘেঁয়ে অভ্যস্ততা, ক্লেশ ও অবসাদ থেকে বেরিয়ে এক ধরনের মুক্তি, মানসিক আনন্দ, কম্পন, শিহরণ, হর্ষ, উল্লাস লাভের পথ হিসাবে পুনরাবিষ্কার করা হয়। যেমনটি বলে বিমলা : ‘…তাই যেমন-তেমন এলোমেলো হয়ে আমাদের মিলন ঘটতে পারতো না। আমাদের মিলন যেন কবিতার মিল; সে আসত ছন্দের ভিতর দিয়ে, যতির ভিতর দিয়ে’।
এই পুনরাবিষ্কারের আনন্দ রেনেসাঁ সাহিত্যের পাতায় পাতায়। নারী-পুরুষ নিজেদের সম্পর্ককে নতুনভাবে তাকে সহর্ষে আবিষ্কার করেছে— তারা কেবল সংসারের জগদ্দল পাথর ঠেলার সাথী নয়, নয় বংশধারার বাহক, মশালচিকি নিশানবাহিমাত্র— তারা একত্রে প্রকৃতির বর্ণচ্ছটার মুগ্ধ দর্শক, তারা ক্রিড়োচ্ছ্বাসপূর্ণ হংসমিথুন, পরান সখা, প্রিয় বান্ধব। প্রজাতি রক্ষার জৈবিক ও পোষ্য পালনের অর্থনৈতিক দায়িত্বের বাইরে এসে আকাশ পানে চেয়ে দেখে—আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, দেখে— কত অমৃত রস উথলি যায় অনন্ত গগনে। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসে, আস্থায়, নির্ভরশীলতায়, রঙ্গরসে, ক্রিড়ায়-ব্রিড়ায়, রাগে-অনুরাগে তৈরি হয় যুগল প্রেমের মূর্তি— একজন পুরুষের সাথে একজন নারী— আধুনিক দম্পতি; এই মূর্তির ভাবমূর্তি হল, এরা অবিচ্ছেদ্য, একাকার, জন্ম-জন্মান্তরের। আধুনিক দম্পতির এই মূর্তি অদ্যাবধি আদর্শ; যদিও আধুনিক দম্পতির ভাবমূর্তির ভাঙনের শব্দ শোনা গেছে অনেকদিন আগেই।

দুই।

সমাজ তার আদর্শের ছাঁচে চলে, আবার চলেও না। দু’টোই সত্য। তার সংগঠকের জাগতিক ও মনোজাগতিক সকল প্রয়াস সত্ত্বেও অবিরাম সজীব চৈতন্যের নড়াচড়ায় স্থাপিত হতে থাকে অজস্র বিপরীত ও বিচিত্র নজীর। শিক্ষিত বাঙালির দাম্পত্য আদর্শ ভিক্টোরিয় কঠোর নীতিবাগিশ একগামিতার আদর্শ অনুসরণে রচনা করলেও ঊনবিংশ শতকের সেই নবজাগরণে জাগরিত সাহিত্যেই নারী-পুরুষের মধ্যে এই আদর্শের পরিষ্কার বিচ্যুতি দেখা যায়। সামাজিক আদর্শ একটি বিষয় এবং অনুশীলন হল ভিন্ন আরেকটি বিষয় যেখানে বিচ্যুতি হরহামেশা ঘটতে থাকে এবং আদর্শের সাথে বিচ্যুত অনুশীলনের সংঘাতে নতুন প্রথার জন্ম হতে থাকে, নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠা পায়। এই বিচ্যুতিকে রবীন্দ্রনাথ প্রাণধর্ম বলে স্বাগত জানিয়েছেন এবং নীতির কেতাব আউড়ানো তোতা পাখিদের শুকনো কথায় একঘেয়েমি বোধ করেছেন এবং বার্ধক্যেও তরুণ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি যুবকের হৃদয় দিয়েই এঁকেছেন। সজীব প্রাণময়তাকে কোনো আদর্শের শেকলে আঁটসাট করে বাঁধাবাঁধি তাঁর রুচিবিরুদ্ধ। যেকোনো গৃহকাঠামোর বায়ু সঞ্চালন পথের মতো সম্পর্কেরও প্রয়োজন অপরিহার্য ছিদ্রপথ, পেছনের খিড়কি দরজা, লুকিয়ে থাকবার চিলেকোঠা, একান্তের শয়নকক্ষ এবং সদর-মহলের আনুষ্ঠানিকতা। সেটা তাঁর কাছে প্রাণের মুক্তি।
রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়েসের লেখা শেষের কবিতা আমাদের মধুরতম উপন্যাস। শিক্ষিত বাঙালীর কাছে তা ভীষণভাবে আদৃত হয়েছে এর চমৎকারিত্বে, বাকচাতুর্যে, অভিনবত্বে; সেটা ভাষায়, ভঙ্গিতে এবং আইডিয়ায়। একটি তাজা সপ্রতিভতা শেষের কবিতার পাতায় পাতায় ছত্রে ছত্রে পাঠককে বছরের পর বছর আকর্ষণ করেছে। দৃশ্যমাধ্যমের প্রবল প্রতিপত্তির এই যুগেও তা এক বহুল পঠিত বাংলা উপন্যাস।
‘শেষের কবিতা’র প্রথম ধাক্কা হল এর সৌন্দর্য ও রসের; শ্রীভূমি শ্রীহট্ট-শিলং এর নিটোল কমলালেবুর মতো সুন্দর ও রসালো। আমাদের মনপ্রাণকে একেবারে হরণ করে নেয়। আমরা তাতে বুঁদ হয়ে আছি দীর্ঘকাল। আমরা নির্বাক। আহা শিলং পাহাড়ে ছুটি, দয়িত/দয়িতার সাথে খাসিয়া গ্রামের ধারে পানের লতায় ঘনিয়ে ওঠা বনের ছায়ায় ফিসফিসিয়ে জন ডানের কবিতা পড়া, ভালবাসার অবসর, এমনি ছুটির দিন, ভালবাসার স্বাধীনতা… আমাদের কেন হয় না?— আমাদের দীর্ঘ নিরবতা ভঙ্গ হলে গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে স্বগোক্তি করি।
শিলং পাহাড়ে একা একা নির্জনে ছুটি কাটাতে এসে জনতার অভাবে যখন অমিতের নির্জনতার স্বাদ মরে গেল তখনই মিলল লাবণ্যের দেখা, হাঁপ ছেড়ে বাঁচল অমিত। অবসরের নির্ভার আনন্দের মধ্যে খানিক হালকা রোমান্স মন্দ কি? যদি উভয়পক্ষই জানে এর ঘনত্বের পরিমাপ এবং কোথায় গিয়ে থামার কথা তার হিসেব-নিকেশ— কে কতখানি দেবে এবং নেবে তার খতিয়ান। পেট ভরে খেয়ে বের হয়ে পথে যেতে যেতে দোকান থেকে ভেসে আসা টলস্টয়ের মিষ্টি পাউরুটির গন্ধের টানে পড়বার মতো। পৃথিবীর বহু বিচিত্র পুষ্পের আস্বাদ কি নেবে না মানুষ? কত শিলং পাহাড়, আঁকাবাঁকা পথ, কত নদী, সমুদ্র কি দেখতে যাবে না? কত মনোহর নর-নারী? কত উপভোগ্য তাদের সঙ্গ! নেবে না? কত হাসি, কত রঙ্গ-রস-তামাশা, আমোদ-প্রমোদ! করবে না? নীতিকথার কেতাব আউড়ে নিজেকে বঞ্চিত করে যাবে? সততার ক্লান্তিকর অভিনয়— আর আদর্শলিপি পাঠ করে যাবে? যাবে না কি তার কাছে প্রাণ যাকে চায়? উচিত আর অনুচিতের ডান-বাম কুচকাওয়াজ করে সারিবদ্ধ হেঁটে যেতে পারাই কি জীবনের একমাত্র চরিতার্থতা?
অমিত-লাবণ্য আমাদের শোনায় এক খোলা বাতাসের গান। পতপত করে হাওয়ায় ওড়ে পোশাকের ঘের। তার সাথে ওড়ে আমাদের মন। উদার নৈতিকতাবাদের স্থিতিস্থাপকতায় আমরা আন্দোলিত, তরঙ্গিত, সাত-সাগরের ফেনায় ফেনায় ভেসে মোরা যাই চলে দূর দেশে। আমাদের রোমহর্ষ হয়। এতটা মুক্তি এই বন্ধনহীন গ্রন্থিতে! নবযুগ তাতে স্বেচ্ছায় বাঁধা পড়তে চায়! একনিষ্ঠ প্রেমে আত্মসমর্পণ অচিরেই বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে শ্বাসরোধী হয়ে ওঠেছিল এবং তখন এমনই বিপদে-বেকায়দায় ‘শেষের কবিতা’এনে দিল সম্মানজনক পশ্চাদপসরণের দুর্লভ অবসর, নিজেরই গড়া আদর্শ থেকে, নিজের পণ থেকে পালাবার পথ।

তিন।

‘শিল্প সত্যের খুব কাছাকাছি এক ধরনের মিথ্যা যা রসিককে আনন্দ দেয়’— যারা মনে করেন, সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাকে উপভোগ করতে পারবেন অমিত-লাবণ্য-কিটি-শোভনলালকথায়। এই অপরূপ মনোমুগ্ধকর যাদুকরী মিথ্যা আমাদের সকলকে আনন্দ দেয়। ঢেকে দেয় আমাদের সম্পর্কের কুশ্রী দাগগুলো, কর্কশ খাঁজগুলো, নিষ্ঠুর স্বার্থপরতাগুলো। রসিকের সাজে রস আস্বাদন, তার অ্যানাটমি করে সেই কদর্য কংকাল বের করা সাজে না; সেটা পজিটিভিস্ট সমালোচকের বা সমাজবিজ্ঞানীর কাজ। তবু আমাদের মনও কদাচিৎ নিরাসক্ত নিরস অরসিক অপ্রেমিক হয়ে ওঠে— হাছন রাজার মানা শোনে না, আমাদের মধুরতম গানগুলোও পরীক্ষা করে নিতে চায় পুনর্বার; বিশ্বাসীরাও এক আধ দিন হয়ে ওঠে ঘোর সংশয়ী। কোনো কোনো দিন আমরা শূন্য মন। আমরা পরখ করে দেখি! সবকিছু। এবং সবাইকে।

অমিত
উচ্চবিত্ত উচ্চশিক্ষিত অক্সফোর্ডের ব্যারিস্টার ইয়াংবেঙ্গল, কাব্যরুচিসম্পন্ন সাহিত্যমনষ্ক স্টাইলতাড়িত।

লাবণ্য
মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষিত কর্মজীবী স্বাবলম্বি নারী, সাহিত্যরুচিসম্পন্ন, ‘হলেও হতে পারতেন’ উচ্চবিত্ত গৃহিনী।

কিটি
উচ্চবিত্ত উচ্চশিক্ষিত অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট হাল ফ্যাশনের নারী, মূলত হবু উচ্চবিত্ত গৃহিনী।

শোভনলাল
উঠে আসা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পেশাজীবী, স্টাইলে সাদামাটা অন্তর্মুখী আপাত লাস্যবিহীন ধরনের অথচ দায়িত্বশীল পুরুষ।

— এই চারটি বিন্দু থেকে চিত্রাংকন করে কিছু জ্যামিতিক হিসেব কষে দেখা যেতে পারে নববঙ্গীয় সমাজের সম্পর্কের স্বরূপ :
‘ঠিক হয়ে গেল আগামী অঘ্রান মাসে এদের বিয়ে। যোগমায়া কলকাতা গিয়ে সমস্ত আয়োজন করবেন।’

অথচ অমিত কেতকীর সাথে তার প্রথম বাগদান শুরুতে বোন সিসি-লিসি থেকে শুরু করে সকলের কাছ থেকে বেমালুম গোপন করেছিল। তারই ওপর সাজিয়েছিল তার জ্যোৎস্নালোকিত চোখধাঁধানো সংলাপসমূহ। কন্যা ও কন্যার অভিভাবকদের কাছে ধরে রেখেছিল নিজের বাজারমূল্য। অনূঢ়া কন্যাদের সাথে সাহিত্যবাসরে, সংগীতের আসরে, আবৃত্তিসভায়, বনভোজনে নিয়েছিল ঘনিষ্ঠতার সুযোগ। তার ইঙ্গবঙ্গ সমাজে সম্ভাব্য পাত্র হিসেবে বহুমূল্য হয়ে উঠেছিল। অক্সফোর্ডে পড়বার কালে তার সাথে প্রণয় এবং অঙ্গুরি দান বিস্মৃত হয়ে ফজলি আমের পরিবর্তে নতুন স্বাদের কমলা লেবুর সন্ধানে নতুন অভিসারে বেরিয়েছিল। লাবণ্যসংসর্গ করেছিল দুগ্ধফেননিভ মিথ্যার সমুদ্র পাড়ে। এইভাবে ভঙ্গির কসরৎ, ভান, শঠতা ও মিথ্যাচার দিয়ে নির্মিত হয়েছিল নারী ও পুরুষের মুক্ত সম্পর্ক।
বাগদত্ত পুরুষের দ্বিতীয় নারী গমনে অপমানিত ও ক্ষুদ্ধ কেতকী স্বয়ং সাথে করে সমাজের দড়িদড়া, হাতকড়া নিয়ে এসে নিজের অধিকার দাবি না করলে, অমিতকে কলকাতা থেকে উড়ে শিলং পর্যন্ত ধাওয়া করে হাতে-নাতে ধরে বেঁধে-ছেদে না নিয়ে গেলে অমিত হয়তো এভাবেই অপরূপ মিথ্যায় লাবণ্যকে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলত। আর কেতকীর জানবার ও আসবার ঘটনাটা সেই বিয়ের পর ঘটলেই-বা কেমন হত? কেমন লাগত অমিত-লাবণ্যের মানসী ও দীপকের সংসার?
কেতকী অমিতের ওপর তার অধিকার দাবি করার সাথে সাথে মুহূর্তেই আবার অমিতের আবেগের স্রোত নতুন খাতে বয়ে হয়ে গেল দিঘির শান্ত জল। অমিত গেল পর-নারী সংসর্গে, আর বেচারা কেতকীর পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে পড়ল টানাটানি। বেচারীর হাতে ধরিয়ে দেয়া হল সিগ্রেট। ভবিষ্যতে আর কোন কোন লবণের ঘাটতিজনিত লাবণ্যহীনতায় অমিত কাতর হবে কে জানে? কেতকীকে নিয়ে বড় দুশ্চিন্তার কথা, বিধাতার পৃথিবীর আঁকাবাঁকা পথে পথে কত রকম লাবণ্যের টান থেকে নিজের দিকে টানবার দড়ি টানাটানি খেলা তার বাকি জীবন বাকি থাকল, এইভেবে।
লাবণ্য বিদুষী বুদ্ধিমতী মেয়ে, কোন দড়ি টানাটানি না করে সপ্রতিভভাবে স্বত্বত্যাগ করে নিজের ও শুভাকাঙ্ক্ষিদের ইজ্জত বাঁচাল, অমিতেরও। না হলে অমিতেরও বেজায় মুশকিল হত কেতকীকে দেয়া হিরের এবং লাবণ্যকে মুক্তোর, দুই প্রকার নারীর জন্যে দুই প্রকারের আংটির মূল্য চুকাতে।
অমিত বিলেতি শিক্ষায় শিক্ষিত এমনই এক সুদর্শন প্রিয়ভাষী মিষ্টি মনোহর ধন-সম্পদশালী উপভোগ্য যুবক যাকে তিরস্কার করা যায় না, সে অত্যন্ত শক্তিশালী এক ভাবমুর্তি যাকে সমাজ ক্ষমা করে দিতে সদা প্রস্তুত। তাছাড়া লাবণ্য বা অমিতের কোনো পক্ষ থেকেই বিচ্ছেদের কোনো বেদনাও যেহেতু নেই, নেই তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি। বরং আছে রবি ঠাকুর থেকে অনবদ্য আবৃত্তি। সবশেষে ছড়িয়ে আছে এক আরামদায়ক স্বস্তি, যে স্বস্তি এসেছে এক প্রকারের অসীম ক্ষমার মধ্যে। কে কাকে ক্ষমা করেছে? কিসের জন্য ক্ষমা? দৃশ্যত লাবণ্য ও কেতকীর অসীম ক্ষমা। অথচ লাবণ্য বলেছে, ‘যে আমারে দেখিবারে পায়, অসীম ক্ষমায়, ভালমন্দ মিলায়ে সকলি…’, কেন লাবণ্যের ক্ষমা প্রয়োজন?— এইজন্য কি যে বিদ্যাও হয়তো লাবণ্যকে শ্রেণিগত হীনমন্যতা থেকে মুক্তি দেয়নি? তবে বাস্তববুদ্ধি দিয়েছিল : কোথায় টানতে হবে যতি।
নারী-পুরুষের এই সম্পর্কের হিসাব কি বরাবর? বরাবরই তো বটে; এক শিক্ষা, এক রুচি— তার বরাবরই। তবে তা ভাবের বরাবরই, বাস্তবতার নয়। তখনও পর্যন্ত ততখানি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরাবরই ফুটে উঠছিল, তখনও ফলে ওঠেনি শাখায় শাখায়।

শেষ কথা
প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্রে বিচিত্র আস্বাদনের সম্ভাবনায় চিত্ত পুলকিত হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে অসম শ্রেণীতে, সূক্ষ্মভাবে বললে উপশ্রেণীতে, বিয়েকে শেষযাত্রা যে ভাবেই হোক ঠেকানো গিয়েছিল। অমিতের আর্থিক অবস্থানে কিটির ফ্যাশন-ব্যাসনবহুল জীবন যেমন মানানসই, তেমনি সঙ্গতিপূর্ণ এবং মাস্টারের মেয়ে লাবণ্যেরও সুব্যবস্থা করে দেয়া গেছে তার মধ্যবিত্ত অনুরাগী মাস্টারগোত্রেরই গবেষক শোভনলালের সাথে বিবাহ স্থির করে। প্রেম কখনও কখনও পথ ভুলে শ্রেণিগত না-ও হতে পারে, বিবাহ আবশ্যিকভাবে পরিষ্কারভাবে শ্রেণিগত। শ্রেণিগত বিবাহের সাথে আপোস চলে না, মুক্তি মেলে না; আপোস চলেছে প্রেমের সাথে, মুক্তি মিলেছে প্রেমের দায় থেকে; প্রেমের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে মহত্ত্বের ভার, মুক্তি দেবার দায়িত্ব, সমাজ নিয়েছে রেহাই; সামাজিক মানুষ কাব্যের প্ররোচনায় যে ভুল/প্রগভলতা/বিহ্বলতা করেছে তা শুধরে নিয়ে সমাজের বাধা পথে নিরাপদে নিরুপদ্রবে আবার ফিরে যাবার সুযোগ পেয়েছে। প্রেমের অসুখ থেকে সেরে উঠে পথ্য নিয়ে গৃহের সুখে ফিরে এসেছে। প্রত্যাবর্তন করেছে যার যার সমাজে। রফা হয়েছে বিশ্বস্ততার পরিবর্তে ছলনার সামাজিক স্বীকৃতিতে। একতরফা ক্ষমা করে দিয়ে পরস্পরের কাছে ভান করেছে মুক্তির; লিবারেলের ভাবের মুক্তি।

শেষের কবিতার সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে এই যন্ত্রণাবিদ্ধ অনুভবের ভেতর।

চারবাক, বর্ষ ৫, সংখ্যা ৮, ফেব্রুয়ারি ২০০৬

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই জুন, ২০২০ রাত ১২:৩২

কল্পদ্রুম বলেছেন: পুরোটা পড়িনি।আসলে পড়তে পারি নি।যেটুকু পড়েছি ভাষার সৌন্দর্যে মুগ্ধতার কারণে পড়েছি।আর বাকিটুকু একটু দুর্বোধ্য লেগেছে।ওইটা আমার সীমাবদ্ধতা।আংশিক পড়ে কিছু মন্তব্য করা অনুচিত।প্রথম অংশটা যেহেতু ভালো করেছি।সেখান থেকে বলতে পারি কৃষক সমাজের ব্যক্তি ভালোবাসাকে লেখক অপ্রাসঙ্গিক ও গৌণ হিসেবে মত দিয়েছেন।আমার তা মনে হয় না।

২| ০৫ ই জুন, ২০২০ রাত ১২:৩৩

রাজীব নুর বলেছেন: গত এক যুগ ধরে আমি প্রতি বছর একবার করে শেষের কবিতা পড়ে যাচ্ছি।
ভালো লাগে।

৩| ০৫ ই জুন, ২০২০ সকাল ১০:৫৬

সায়েমার ব্লগ বলেছেন: আপনাদের ধন্যবাদ জানাই!

৪| ০৫ ই জুন, ২০২০ দুপুর ১:০৪

উদাসী স্বপ্ন বলেছেন: অক্সফোর্ড ক্যাম্ব্রিজ পাশ বাংলাদেশী উচ্চশিক্ষিতা যাদের দেখেছি তাদেরকে সেরকম স্টাইলিস মনে হয়নি। বরংচ কখনো কখনো তাদের কর্পোরেট বা প্রাতিস্ঠানিক রেসপন্সের ভারে ন্যুজ হয়ে ফাউন্ডেশন বা কালার ম্যাচিং জামা পড়তে ভুলে যায়। অথচ দেশে এখন স্কুলের মেয়েরা এগুলো করে।

এখনকার সমাজ ব্যাবস্থা অনেক এগিয়েছে। তারপরও মনে যে প্রশ্নটি থাকে কলকাতা থেকেই বা কত নারী অক্সফোর্ড ক্যাম্ব্রিজ পড়ার সামর্থ রাখতো যদি স্কলারশীপ প্রদান করা না হতো? আর যদি স্কলারশীপে যারা পড়েন তাদের অবস্থা কি সেরকম তথাকথিত হতো??

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.