নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক
চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ব্যাপক অস্বস্তি-আপত্তিগুলো, চারুকলার বৈশাখী/মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইসলামিক ইনক্লুসিভ করবার যে আকাঙ্ক্ষা কিছুদিন ধরে প্রকাশিত হল, তা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মত (উদাহরণ, ফাইজ তায়েব আহমেদ)। কোন আমলে, কোন রেজিমে বসে কোন সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে, প্রথমে সেটা unpack করে নেয়া চাই। আমরা, কোন রেজিমে কোন সংস্কৃতি করা হচ্ছে, সেটাকে ফোকাসে রাখবো।ইসলামের যে ধারাগুলো এখন ক্ষমতার সাথে মিশে আছে(সেগুলোর অন্যতম প্রধান ওয়াহাবি/আহলে হাদিস),সেই পন্থায় শিল্পচর্চা/সঙ্গীতের কোন বিদ্যালয়েরই অস্তিত্ব থাকবার কথা নয়, সেখানে সঙ্গীত, চারুকলার কোন চর্চাই থাকা সম্ভব নয়। তাই, পহেলা বৈশাখের এই শোভাযাত্রা এর সাথে by default mutually exclusive ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই বিরাট আলোচনা/বাহাসকে খুব সংক্ষেপে সমস্যায়িত করলে বলা যায়, সংস্কৃতির কোন উপাদান, কোন অভ্যাসই চিরায়ত নয়।এই ভাবনাটাই ঔপনিবেশিক। এই "চিরায়ত" "চিরায়ত" করাটা এসেছে ব্রিটিশ ফাংশনালিস্টদের অপশ্চিমের সংস্কৃতিকে "অনড়" "অচল" "গতিহীন" দেখানোর চর্চা থেকে। এই কলোনিয়াল অবস্থান অনেক বছর হল খোদ পশ্চিমেও প্রত্যাখ্যাত হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের মূলধারায় হয় নাই।পণ্ডিত আনিসুজ্জামান/সূফী মুস্তাফিজদের মত "চিরায়ত হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি"র প্রবক্তারা একে প্রায় একটা ধর্মীয় ধরনের আনুগত্যের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যা দিনের শেষে দেশীয় বুর্জোয়াদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে সমর্থন যোগায়। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের পত্তনকালে ইউরোপেও জাতীয়তাবাদী/সুশীলরা গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে তাদের পছন্দ মত উপাদান বাছাই করে গোটা জাতির সংস্কৃতি বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, যেমন নরওয়ের কথা বলেছেন নরওয়েজিয়ান নৃবিজ্ঞানী এরিক্সেন। জাতীয় পরিচয় ও প্রতীক গড়ে তুলতে নরওয়ের গ্রামীণ সংস্কৃতির কিছু উপাদানকে শহুরে এলিটরা খুঁজে খুঁজে তুলে নিয়ে আসে।ফেলে আসা জীবনের প্রতি এক ধরনের এগ্রিকালচারাল নস্টালজিয়ার অনুভূতি উদযাপন করে। "একদিন বাঙ্গালী ছিলাম রে" - ধরনের এক মোহময় বেদনা বোধ করে। বাংলা নববর্ষের ক্ষেত্রেও খানিকটা কাছাকাছি জিনিসই ঘটেছে।কৃষক-শ্রমিক-আম জনতার সংস্কৃতির বিরাট বৈচিত্র্যময় উপাদানগুলোকে অদৃশ্য করে, বা অস্বীকার করে, জাতি গঠনের নামে সুবিধাজনক কিছু কিছু জিনিস বাছাই করে সুশীলরা জাতীয় সংস্কৃতিকে এক প্রকার হাইজ্যাক করে ফেলে। পকেটস্থ করে। তারা ক্ষমতার দাপটে এমন ট্র্যাডিশনকে ইনভেন্ট করে, যার আদতে কোন অস্তিত্বই ছিল না, যে কারণে অভিজাত নাগরিকদের মধ্যে পান্তা খাওয়ার মকারি চলে, যেমন মঙ্গল শোভাযাত্রার মত ট্র্যাডিশনের সূচনা করা হয়। এই শোভাযাত্রাসহ নাগরিক নববর্ষ পালনের তরীকা একটা আবিষ্কৃত সংস্কৃতি হলেও সেটা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং জনপ্রিয় হয়েছে।দিনে দিনে দেশজুড়ে প্রসারিত হয়েছে।আবিষ্কৃত হয়েছে বলে তাকে বাতিল করা যায় কি? সংস্কৃতি সব সময়েই মানুষের প্রয়োজন-পরিস্থিতিতে আবিষ্কৃত ও চর্চিত। এই শোভাযাত্রার উপর ক্রমাগত নানামুখী আঘাত আসাই বলে দেয়, এর সাথে ক্ষমতার স্বার্থ আছে, তৎপরতা আছে, সারভেলেন্স আছে।বিশেষ করে এই ট্র্যাডিশন এসেছে পাকিস্তান আমলে চাপিয়ে দেয়া ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে, যা আমাদের কালেক্টিভ মেমরির অংশ, এবং সেটা আমরা ভুলে যেতে পারি না। কেন ভুলে যাব যে, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামেওমঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল? মঙ্গল শোভাযাত্রা ঔপনিবেশিক রূপান্তরের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধের চৈতন্যের অংশ, হতে পারে তা খণ্ডিত এবং দেশজ বুর্জোয়াদের করায়ত্ব।
কয়েকদিন ধরে বাংলা ভাষার "মঙ্গল" শব্দটির প্রতি ( ইংরেজিতে well- being/wellness) অসহিষ্ণুতা বেশ বিস্ময়কররকম বর্ণবাদী শোনাচ্ছে।মঙ্গলের বিরোধিতা করতে গিয়ে "নববর্ষ উদযাপন হাজার বছরের নয়, ইসলামের সংস্কৃতি হাজার বছরের" - এমনটা শুনতে বেশ চটকদার শোনায়, কিন্তু এই ধরনের বাৎচিতের ঝামেলা হল, সেই কালেক্তিভ মেমরিকে অস্বীকার করা। কোন সংস্কৃতিকেই প্রাচীনত্বের গুণে তাকে বেশী ভ্যালিড ভাবা, আরেকটিকে খারিজ করা এক ধরনের অপরাজনীতি।কোন ক্ষমতার মধ্যে আমরা এই মুহূর্তে বাস করছি, সেটা আমলে না এনে, "চিরায়ত", "স্থির", "অনড়", "পরিবর্তনহীন", "সমাজসংহতি গঠনকারী" এক একক বাংলা সংস্কৃতিকে কল্পনা যেমন জাতীয়তাবাদী সুশীল সমাজের প্রকল্প এবং বহুবাদের অস্বীকৃতি, তেমনি বাংলার ইসলামকে হাজার বছরের এক অখণ্ড সংস্কৃতি হিসাবে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গীও একেবারেই অনৈতিহাসিক। বাংলার ইসলামের প্রবর্তন, ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে এবং আমজনতার ধর্ম রূপে কায়েম করাবর কাজ যারা করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন আরব, সিরিয়া, ইয়েমেন, তুরস্ক, ইরান - অঞ্চল থেকে আগত সূফী-সাধক।১২০৭ এ বখতিয়ার খলজির রাজনৈতিক বিজয়ের আগেই দ্বাদশ শতাব্দীতে ময়মন্সিংহে প্রথম ইসলামের প্রবর্তনে দুজন সূফী সাধকের কথা জানা যায়।এই হাজার বছরের ইতিহাসের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকা সবচেয়ে ইনক্লুসিভ ধারা সূফীবাদকে এখনকার উত্তর-ঔপনিবেশিক জমানায় প্রায় কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে।শত শত বছর ধরে সারা বাংলা জুড়ে সূফী-সাধকদের ধর্ম-সাধনায় সর্বজাতি-ধর্মের মানুষের বৈচিত্র্যকে মেনে নিয়ে যে সংস্কৃতির শেকড় অরগানিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছিলো, সেখান থেকে ইসলামী জীবনধারার গভীর এক ঔপনিবেশিক রূপান্তর ঘটেছে, বিপ্লবী এবং প্রতিক্রিয়াশীল- উভয়ধারাতেই ইসলামী ভাবধারার বিকশিত হয়েছে, চর্চা করা হয়েছে (এখানে মনে রাখা ভাল যে, পবিত্র কোরআন ঐশী ও অপরিবর্তনীয়, কিন্তু যেভাবে মানুষ তাকে আমল করে তা কিন্তু ইহজাগতিক।ঐশী কোরআন পরিবর্তন অসম্ভব, কিন্তু একে চর্চার সংস্কৃতি মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এবং বিভিন্ন সময়ে একরকম ছিল না, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তাফসীর ও আমলের ভেদ হয়েছে)। সুতরাং ইসলামী সংস্কৃতি বলে কোন এক পন্থা নাই। সংস্কৃতি হিসেবে ইসলাম এক নয়, অনেক রকম।
উত্তর-আধুনিক জমানায় বিশ্বের মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ, এবং ইসলামোফোবিয়ার প্রেক্ষাপটে ও প্রতিক্রিয়ায়, প্যালেস্টাইন, আফগানিস্থান, ইরাক, সিরিয়ায় মুসলমানদের উপর ধারাবাহিক গণহত্যার ফুটন্ত বিক্ষোভে বৈশ্বিক মুসলমানদের এক আইডেন্টিটির সন্ধান চলছে। বাংলাদেশ এর পেটের ভেতরই বাস করে। এই প্রতিরোধী চেতনায় যেমন বিপ্লবী শক্তি আছে, তেমনি প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ারও সমূহ নজীর দেখা গেছে। প্রতিক্রিয়াশীল এমন এক ইসলামী ভাবধারাকে পুনঃপুনঃ শক্তিশালী করবার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, যা আবার বিপদজনক এক ধরনের Totalitarian Islamic State গঠন করতে চায়। এই অবস্থাটা একটা শাঁখের করাতের মত।এই শাঁখের করাতের এক ধারে সুশীলদের উদ্ভাবিত "আবহমান বাংলা সংস্কৃতি" যাতে ইসলামের উপাদানগুলোকে other করা হয়েছে, অন্যধারে Totalitarian Islamic State গঠনের প্রবল নড়াচড়া, যাতে কৃষক-শ্রমিক-আদিবাসী-নারী ও প্রান্তিক জনতার স্বার্থ রক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা নাই।
২| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ২:৩০
রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লিখেছেন।
মঙ্গল শোভাযাত্রা থাকবে। যতদিন থাকবে বাংলাদেশ।
৩| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৪:৪২
সোনাগাজী বলেছেন:
ভালো ধাণা
৪| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৭
সোনাগাজী বলেছেন:
টাইপো:
ভালো *ধারণা
৫| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ৮:৩৩
সোবুজ বলেছেন: চিরায়ত বা শ্বাশত এই ধারনাটাই ঠিক না।ঐশী বা অপরিবর্তনীয় ধারনাটাও ভুল।পরিবর্তন,জগতের একটা মৌলিক নিয়ম।প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়।যখন গুনগত পরিবর্তন হয় তখনি আমাদের কাছে প্রতিয়মান হয়।পরিবর্তন থেমে নেই এক সেকেন্ডাের জন্য।এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।পরিবর্তিত হতে হতেই আজকে আমরা এই অবস্থায় এসেছি।
৬| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১০:৪৭
গরল বলেছেন: সংস্কৃতিও চলমান ও পরিবর্তনশীল, যুগের সাথে আচার অনুষ্ঠানও পাল্টে যাবে এটাই স্বাভাবিক। না পাল্টালেই বড়ংচ ক্ষতির মুখে পড়বে বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যেমন ধরুন পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি কখনই আমাদের সংস্কৃতির পোষাক ছিল না কিন্তু আপামর জনসাধারণ যেহেতু এটা গ্রহণ করেছে এটা এখন সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। একসময় একতারা বা দোতরা দিয়ে বাউলরা গান করত, রবীন্দ্র নাথের সময় কিন্তু উনারা তখনকার আধুনিক সরঞ্জাম হারমোনিয়াম ও তবলা দিয়ে গান করতেন। এখন হারমনিয়াম ও তবলাও অচল তাই বলে কি রবীন্দ্র সং্ঘীত গাওয়া হবে না? ভালো লিখেছেন, সহমত আপনার সাথে।
৭| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ ভোর ৫:৩৮
জহিরুল ইসলাম সেতু বলেছেন: সভ্যতা ও সংস্কৃতি বহতা নদীর স্রোতের মতো। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বাঁধ দিয়ে এর গতিপথ রোধ করা যায় না। বড়জোড় সাময়িক ব্যাঘাত ঘটানো যেতে পারে। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সম্পূরক মিলনে এর গতিধারা সমৃদ্ধ ও বেগবান হয়। আপনার পোষ্টে পেশাদার একজন নৃবিজ্ঞানীর মতামত ও ব্যাখ্যার প্রতিফলণ ঘটেছে। অভিনন্দন আপনাকে। আর ধন্যবাদ জানি নিমো ভাইকে, যিনি লেখাটি পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন লিঙ্ক শেয়ার করে। মঙ্গল হোক সকলের।
©somewhere in net ltd.
১| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ১২:০২
প্রতিদিন বাংলা বলেছেন: ইসলামকে বাদ দিয়ে যদি ঐতিহা রোক্কার কথা বলি তবুও
পাপেড/মূর্তি/মুখোশ কিভাবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায় ,এটা বাঙালির বিকৃত রুচির বাং গালি ঐতিহ্য !!মাত্র ৩৫ বছরেই ধার করে আনা ঐতিহ্য