নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, এথনোগ্রাফার এবং গল্পকার

সায়েমার ব্লগ

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক

সায়েমার ব্লগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

দীর্ঘতম বিপ্লবের অন্তহীন পথঃ মার্কসবাদ ও নারীবাদ এর বাদ-বিসম্বাদ প্রসঙ্গে

২২ শে আগস্ট, ২০২২ রাত ১০:১২

মাকর্সবাদী তত্ত্ব যে শক্তিমত্তা নিয়ে শ্রেনী নিপীড়নের ব্যাখ্যা দিয়েছে, নারীর নিপীড়নের ব্যাখ্যার তেমন শক্তিশালী একক কোন তত্ত্ব নেই। অথচ, নারীর নিপীড়ন দুনিয়া জোড়া এবং মানবজাতির সমগ্র ইতিহাস জোড়া; এই নিপীড়ন বিচিত্র অজস্র রূপে, একঘেঁয়ে সমরূপে চলে আসছে। সংস্কৃতিভেদে এর চেহারা বদল হলেও এর মূলসুর স্থায়ী এবং বিশ্বজনীন। তাহলে মানবজাতির সমগ্র ইতিহাস যদি শ্রেনীসংগ্রামের ইতিহাস হয়ে থাকে, সেটা কেবল শ্রেনীদ্বন্দ্বই হতে পারে না। অর্থাৎ, কেবল শ্রেনীদ্বন্দ্ব বলাই যথেষ্ট হবে না। মানবজাতির সমগ্র ইতিহাস তবে লিঙ্গীয় সংগ্রামেরও ইতিহাস। তবে মানুষের সমগ্র লিখিত ইতিহাস হল নারীর নিপীড়নের ইতিহাস।

নারীর নিপীড়ন ব্যাখ্যাকারী উপযুক্ত তত্ত্বের অভাবে মার্কসবাদী বিশ্লেষণ ব্যবহার করে নারী প্রশ্নের জবাব খোঁজার অসংখ্য চেষ্টা চলেছে।

মার্কসবাদ সেভাবে সন্দেহাতীতভাবে নারীর লড়াইয়ের ভিত্তি। যেমন, যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে যে, নারী হল পুঁজিবাদের সংরক্ষিত শ্রমশক্তি (reserve force), কিংবা নারীর নিম্নমজুরী পুঁজিপতির অতিরিক্ত উদ্বৃত্তের যোগান দেয়, কিংবা পারিবারিক ভোগের ব্যবন্থাপকের ভূমিকায় নারী পুঁজিবাদী ভোগেরই উদ্দেশ্য সাধন করে - ইত্যাদি । আরো বড় উদ্দেশ্য নিয়ে গৃহকর্ম এবং শ্রমের পুনরুৎপাদনের সম্পর্ককে সুনির্দিষ্ট করে নারীর নিপীড়নকে পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করে বেশ কিছু অনস্বীকার্য মূল্যবান রচনা আমরা পেয়েছি।এতে করে ন্যায়সঙ্গতভাবে নারীকে শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণ করে পুঁজি তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে- পুঁজিবাদের সংঙ্গার মধ্যে স্থাপন করে - সেটা পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু নারী পুঁজির জন্য কতখানি সহায়ক সেটা এক কথা,আর এই কাজের হওয়াটা দিয়ে নারীর নিপীড়নের উৎপত্তিকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া একেবারে ভিন্ন কথা।

ঠিক এই জায়গায় এসে কেবল পুঁজিবাদের বিশ্লেষণ নারীর নিপীড়ন ও নারী বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে থেমে যায়। পুঁজি নারীকে পৃথকভাবে শোষণ করতে পারে কেন? নারীর শোষণের পৃথক প্রকৃতি রয়েছে বলেই নিশ্চয়। যে সব সমাজগুলোকে কোনক্রমেই পুঁজিবাদী বলা চলে না, সেখানে নারীর অধস্তনতাকে তাহলে কি দিয়ে বুঝবো? আমাজন উপত্যকায় এবং পার্বত্য নিউ গিনিতে যখন দেখা যায়, সাধারণ সব পুরুষালি ত্রাস কায়েমের পদ্ধতি নারীদের “জায়গা মত রাখতে” কাজ করে না, তখন জায়গা মত রাখতে তাদের ঘন ঘন গণধর্ষণ করা হয়। ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের শায়েস্তা করে “সোজা রাখা” হয়। এ প্রসঙ্গে এক মুন্ডুরুচু পুরুষ বলেন, “আমরা আমাদের মেয়েদের কলা দিয়ে বশ করি”। নারীদের “জায়গা মত রাখার” কাজে নানা রেওয়াজে এথনোগ্রাফিক রেকর্ড ভর্তি হয়ে আছে ঃ পুরুষের গুপ্তবিদ্যা, গোপন দীক্ষা, পুরুষের কাল্ট - এ রকম বহু কিছু। আর পুঁজিবাদ-পূর্ব ইউরোপ এমন কোন সমাজ ছিল না, যেখানে যৌনবাদ (sexism) ছিল না। নারী ও পুরুষের বিভেদ পুঁজিবাদ আসবার আগে থেকে বহুযুগ ধরেই চলে আসছিল, পুঁজিবাদ তাকে নিজের চেহারায় সজ্জিত করে নিয়েছে মাত্র। পুঁজিবাদের অধীনের শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের কোন বিশ্লেষণই চীনা ফুট বাইন্ডিং, গ্রীকদের চেস্টিটি বেল্ট, অথবা বাইজেন্টাইনদের সকল অবমাননার ‘ফেটিশ’ এর অবিশ্বাস্য সব ধারাকে ব্যাখ্যা করতে পারবে না। পদানত রেখে দেবার আরও সাধারণ মাপের যত চলন , কলা-কৌশল বিভিন্ন দেশে ও কালে নারীর উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, সেসব কথা না হয় বাদই থাকল। শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের বিশ্লেষণ এমনকি এরও ব্যাখ্যা দিতে পারে না যে, কেনইবা পুরুষ নয়, সব সময় নারীকেই গৃহস্থালী কাজের একঘেঁয়ে ক্লান্তিকর ভার বইতে হয়।

এবারে এখানে আমাদের মার্কসের শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের আলোচনায় ফিরে যাওয়ার কৌতুহল জাগে। শ্রমিকের পুনরুৎপাদন করতে কি কি আবশ্যক তা আংশিকভাবে ঠিক হয় মানবদেহের জৈবিক চাহিদা অনুসারে, আংশিকভাবে সে যেখানে থাকে তার অবস্থা অনুসারে এবং আংশিকভাবে সাংস্কৃতিক ধারা অনুযায়ী ঠিক হয়। এক্ষেত্রে মাকর্সের পর্যবেক্ষণ হল ঃ ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেনীর পুনরুৎপাদনে বিয়ার দরকার আর ফ্রান্সের শ্রমিক শ্রেনীর পুনরুৎপাদনে দরকার ওয়াইন।

... the number and extent of his [worker’s] so-called necessary wants, as also the modes of satisfying them, are themselves the product of historical development, and depend therefore to a great extent on the degree of civilization of a country, more particularly on the conditions under which, and consequently on the habits and degree of comfort in which, the class of free labourers has been formed. In contradistinction therefore to the case of other commodities, there enters into the determination of the value of labour-power a historical and moral element..... (Marx, 1972: 171)

নির্ভুলভাবে এই “historical and moral element” ই ঠিক করে, একজন শ্রমিকের জীবন-ধারনের আবশ্যিক জিনিসগুলোর মধ্যেই রয়েছে একজন ‘স্ত্রী’, তা-ই ঠিক করে পুরুষ নয়,ঘরের কাজ করবে নারী, এবং পুঁজিবাদ হল সুদীর্ঘ এই ধারারই উত্তরাধিকারী যে, নারী নেতৃত্ব দেবে না, নারী সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে না, নারী স্রষ্টার সাথে কথা বলতে পারে না এবং স্রষ্টাও নারীর সাথে কথা বলবে না। এই “historical and moral element” ই পুঁজিবাদকে নারীত্ব ও পৌরুষের বিষম গড়নের অব্যাহত সাংস্কৃতিক একটি ধারা উপহার দিয়েছে। এই হল সেই “historical and moral element” যার ভেতর যৌন, যৌনতা এবং যৌন নিপীড়নের (sex, sexuality and sexual oppression ) সমগ্র এলাকা ঢুকে আছে। এ বিষয়ে মার্কসের এই মন্তব্য এর ব্যাপক বিস্তীর্ণ সামাজিক জীবনের ওপর জোর দেয়। অতি সংক্ষিপ্ত এই ভাষ্যে এখানে একটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এই সুবি¯তৃত সামাজিক জীবন বিশ্লেষণের আওতার বাইরে থেকে গেছে ভবিষ্যতে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য। কেবল এই “historical and moral element” কে বিশ্লেষণের অধীনে এনেই যৌন নিপীড়নের কাঠামোর চেহারাটা ধরা সম্ভব। এই কাজটি মাকর্স ভবিষ্যতের চিন্তুকদের জন্য রেখে গেছেন। এবং এই ইঙ্গিত ধরে আরও অগ্রসর বিকাশ হওয়া দরকার। মার্কসকে পয়গম্বর ধরে, তার কিতাবকে শেষ কিতাব ধরে সেটা সম্ভব নয়।

লিঙ্গীয় বৈষম্যের শেকড় সমাজসংস্থার গভীরস্থলে এবং জটিলতম সংগঠনে। তাই নারী মুক্তি সংগ্রামের পথ দীর্ঘতম।

যৌন নিপীড়ন আর্থব্যবস্থার প্রত্যক্ষ কোন ফল নয়, যদিও অর্থনৈতিক বলের সাথে সমন্বিত হয়ে তার রূপ বদল ঘটে। যখন আমাদের পক্ষে যৌনের এই স্বতন্ত্র জগতের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা সম্ভব হয়, তখন এটা উপলদ্ধি করাও সম্ভব হয় যে, নারী আন্দোলন শ্রমিক আন্দোলনের সদৃশ হলেও তাদের অঙ্গ-সংস্থান ভিন্ন। দু’টি বিষয় মানুষের জীবনের ভিন্ন ভিন্ন বঞ্চনার, অসন্তোষের, বেদনার উৎসকে লক্ষ্য করে। মার্কসের দৃষ্টিতে শ্রমিক শ্রেনীর আন্দোলন কেবল তার নিজের শোষণের শৃংখলই উৎপাটিত করবে না, এমনকি তা সমগ্র সমাজের বদল ঘটানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করে মানুষকে সব ধরণের শোষণ থেকে মুক্ত করবে, শ্রেনীহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা করবে। তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা যৌন নিপীড়নকে উৎখাত করবে না। সমাজ বদলের একই রকম কাজ লিঙ্গহীন সমাজ গড়ে তুলতে নারীর আন্দোলনেরও রয়েছে যা মাকর্সের বিশ্লেষণে কেবল অসম্পূর্ণভাবে এসেছে। যে জন্য গড়ে তুলতে হয়েছে নারীর ওপর নিপীড়নের ব্যাখ্যার পৃথক তত্ত্বঃ নারীবাদ।

নারীবাদ ঘোষণা করেঃ যৌন/লিঙ্গ ব্যবস্থার (sex-gender system) নিপীড়ন পরিবর্তনের অযোগ্য নয়। বরং এর প্রথাগত ক্রিয়াকর্মের গুরুত্ব ইতোমধ্যেই লোপ পেয়েছে। তা সত্ত্বেও, আপনাআপনি ‘সময়ের প্রবাহে’ এটা হারিয়ে যাবে, তা ভাবলে ভুল হবে। যৌন ও লিঙ্গের সামাজিক বোঝাটা সে বহন করে চলেছে। সস্তান মানুষ করা, মানুষের আসল সত্ত্বা কেমন সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াতেও এই ব্যবস্থা পুরোনো ভার বহন করে চলছে। তাছাড়াও, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতেও এই ব্যবস্থাকেই কাজে লাগানো হচ্ছে।

তাই, বৈষম্যমূলক যৌন/লিঙ্গ ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে বৈষম্যবিহীন যৌন/লিঙ্গ ব্যবস্থার পুর্ণগঠনের উপায় হল রাজনৈতিক সক্রিয়তা।

কেউ কেবল নারী হিসেবে নিপীড়িত - তাই নয়, নারী যে হয়ে উঠতে হয় - সেটাই নিপীড়ন ও দমনমূলক। পুরুষ হয়েও কেউ জন্মায় না, বৈষম্যমূলক যৌন/লিঙ্গ ব্যবস্থায় সে পুরুষ হয়ে ওঠে। নিপীড়ন আয়ত্ত্ব করে, পুরুষ সত্তার অর্ন্তগত করে ফেলে। এর থেকে নারী ও পুরুষের সত্তাকে বিচ্ছিন্ন করা অন্তরে-বাহিরের একটা দীর্ঘতম সংগ্রামের ব্যাপার। এই সংগ্রাম প্রথমে নারীর হলেও পুরুষ এর আবশ্যিক অংশ। এই সংগ্রামের লক্ষ্য হবে বাধ্যতামূলক যৌনতা ও যৌন ভূমিকার উচ্ছেদ ঘটানো। এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা যেখানে যৌন সামাজিক লিঙ্গতে বৈষম্যমূলকভাবে বিন্যস্ত হতে না পারে। লিঙ্গহীন সমাজ সৃষ্টি (যৌনহীন নয়), যাতে যৌনতার দমন-পীড়নমূলক ব্যবহার সম্ভব না হয় বরং নিখাদ প্রেম-ভালবাসা মুক্ত পাখনায় ভর করে উড়তে পারে।

মে ৫, ২০২১

ব্যবহৃত পাঠের ঠিকুজীঃ

1. Women, Class and the Feminist Imagination, A Socialist-Feminist Reader- Karen V. Hansen and Ilene J. Philipson, Temple University Press, Philadelphia, 1990

২. লেভি-স্ট্রাউসকে ফিরে দেখাঃ “নারী বিনিময়” অধ্যায়ের পরের অধ্যায়- সায়েমা খাতুন, উত্তরাধিকার, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১০

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে আগস্ট, ২০২২ রাত ১১:২০

কামাল৮০ বলেছেন: লিখিত ইতিহাসের আগের ইতিহাস আধিবাসী সমাজ গুলি বহন করে।সেখানে নারীর উপর অত্যাচার নাই।এমন কি কোন কোন আধিবাসী সমাজ নারী প্রধান সমাজ।নারীই পরিবারের প্রধান।
নারীরা পরাধীন হতে থাকে কৃষি ব্যবস্থা আবির্ভাবের পর থেকে।যখন মানুষ উদবৃত্ত খাদ্য মজুত করতে শিখলো।তার উতবৃত্ত খাদ্দ্যের উত্তরাধিকার কে হবে।এর আগে সন্তান ছিল সামাজিক সন্তান।(কোন কোন আধিবাসী সমাজে এখনো এই প্রথা প্রচলিত আছে)উত্তরাধিকারী নিশ্চিত করার জন্য বিবাহ প্রথার আবির্ভাব।আর নারী হয়ে গেল বন্ধী।
মার্কসবাদ আসছে পুঁজিবাদের আবর্ভাবের পর।পুঁজির শোষণ থেকে শ্রমিকের মুক্তির জন্য।পুঁজির শোষন কমলে নারীও কিছুটা মুক্তি পাবে।নারীর সম্পুর্ণ মুক্তি নারীকেই অর্জন করতে হবে।আলোকপ্রাপ্ত কিছু পুরুষ তাতে সহযোগিতা করতে পারে মাত্র।কিন্তু মুল কাজ নারীকেই করতে হবে।

২| ২৩ শে আগস্ট, ২০২২ দুপুর ২:০৮

রাজীব নুর বলেছেন: মার্কস আর লেলিনবাদ এসে ভর করে ছিলো ভারতে। তৈরি হলো নকশাল। নকশাল বেশ ভালো খেইল দেখিয়ে ছিলো। কিন্তু তাঁরা টিকতে পারেনি।

৩| ২৩ শে আগস্ট, ২০২২ দুপুর ২:১১

মোহাম্মদ গোফরান বলেছেন: মৌলবাদ এর চেয়ে অন্যসব মতবাদ সুন্দর।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.