নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক
ইংরেজি বলা মানুষকে আমরা মনের গভীর গহনে ভয় পাই, ঘৃণা করি, ঈর্ষা করি, বিদ্বেষ বোধ করি, আবার সমীহ করি বা করতে বাধ্য হই। তার সাথে আমরা বুঝে-শুনে হিসাব করে কথা বলি। ইংরেজি বলা মানুষের প্রতি আমরা দূরত্ব বোধ করি, শত্রু জ্ঞান করি। এটা আপনার আমার কোন ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতা বা নীচতা নয়। আমার আপনার অদক্ষতা নয়। ইংরেজিতে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কিম্বা কথার উত্তরে ইংরেজি ব্যবহার করলে আমরা ভীষণ চটে যাই। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্থ মানুষে মত আচরণ করি। এটা খুব ছোট বেলা থেকেই লক্ষ্য করে এসেছি। এটা নতুন কিছু না। আমরা জ্ঞান হওয়ার শুরু থেকেই বুঝে গেছি, কেউ আমাকে ইংরেজিতে কিছু বল্ল মানেই, ক্ষমতা প্রদর্শন করলো - আমাকে কোন নির্দেশ দিল, যা আমার মতের বিরুদ্ধে, আমার আত্মমর্যাদার বিরুদ্ধে। যা না পালন করবার উপায় আমার নাই। এই যে কেবল এক দোকানী "hold on" এর মত একটা নিরীহ কথা তরুণ মাজিস্ট্রেটকে বলাতে তিনি বোধবুদ্ধি হারানো একটি ক্রোধ বোধ করলেন, সেটা কোন সামান্য বিষয় নয়। ওই মাজিস্ট্রেটের ব্যক্তিগত 'টেম্পার' নয়। আমাদের কালেক্টিভ মেমরিতে দুইশত বছর ধরে ইংরেজিতে শোনা জবরদস্তিমূলক আদেশ-নির্দেশ যে ক্রোধের সঞ্চার করেছিল, রক্তে সেই উদ্বেগের কর্টিজল হরমোন, সেই সেলফ ডিফেন্সকে ডাক দেয়। সেটা দেখতে এমন যুক্তিবুদ্ধিহীন দেখায়।
ইংরেজি কেবলই একটা ভাষা মাত্র নয়। এটা পূর্বের কলনিয়াল কিম্বা বর্তমানের বিশ্বশাসকের সব চাইতে শক্তিশালী হাতিয়ায়। ইংরেজির মত শক্তিশালী সফট পাওয়ারের বাহন হাল জমানার দিগন্তে এখনও উদিত হয় নাই। একজন জার্মান, কিম্বা ফরাসী বা ডাচ যখন ইংরেজি শোনে তাদের রক্ত প্রবাহে সেই উত্তেজনার কোন ইতিহাস নাই। ইংরেজি তাদের জীবনে নেহায়েতই একটা অতি দরকারি যোগাযোগের মাধ্যম মাত্র। তাদের জন্যে একটা নতুন দক্ষতা মাত্র। ইউরোপীয় কোন জাতির জন্যে ইংরেজি আলাদা করে কোন দুঃস্বপ্নময় স্মৃতিকে ডেকে আনে না। ব্যক্তিগত স্মৃতি তার প্রজন্মগতভাবে বাহিত যৌথ স্মৃতির কড়িবর্গার কাঠামোতে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। তাই বাঙ্গালী যখন ইংরেজি শোনে, তৎক্ষণাৎ তার শত বছরে গড়ে ওঠা পরাভূত, সংগ্রামী ও প্রতিরোধী চৈতন্যের গভীরে বিচিত্র, মিশ্র সব দৃশ্যকল্প, অনুভূতি, ক্ষমতাহীনতার বিস্বাদ, অক্ষমতার যন্ত্রণা, নিষ্পেষণ, অবমাননা, আবার একই সাথে শাসকের জাতে ওঠে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে উঠার আত্মপ্রসাদ - মিলে-মিশে জটিল কোন জৈব-রাসায়নিক, সাইকো-সোমাটিক প্রতিক্রিয়া হয়। বাঙ্গালীর ইংরেজি শেখা তাই নিতান্তই ফার্সি, আরবি, চাইনিজ এমন যে কোন একটা ভাষার দক্ষতা অর্জন মাত্র নয়। ইংরেজি বাক্য শ্রবণে উপনিবেশিত জীবনের যন্ত্রণা, ক্রোধ, প্রতিরোধ, আপোষ - সব একাকার হয়ে যায়।
ইংরেজি আমাদের মানস জগতকে চিরকালের মত বদলে দিয়েছে, না এটাই যথেষ্ট নয়, চিরকালের জন্যে আমাদের মানস জগতকে অধিকৃত করে ফেলেছে। আমাদের অস্তিত্বের জমিনের প্রতি ইঞ্চি, আত্মপ্রকাশের প্রতিটি ভঙ্গী এই ভাষার দখলে। আমদের সকল বৌদ্ধিক প্রকাশ, আবেগ-অনুভূতি সবই শাসকের ভাষার অধীনস্ত। এমন একজন স্বশাসিত মানুষ বেঁচে নাই যে আর নিজের ভাষায় আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম। যারা আমাদের পূর্ব-পুরুষদের ভূমিদাস ও মজুরে পরিণত করেছে, অগনিতভাবে হত্যা করেছে, আমাদের নারীদের ধর্ষণ করেছে, আমাদের জমি ও জীবনকে দখল করে রেখেছে, কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে আমাদের বংশসহ নিকাশ করেছে, আমার বিদ্যাকে কুসংস্কার নামে অভিহিত করেছে, আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে কে বরবাদ করেছে, সেই সব নির্দেশ আমরা ইংরেজিতে শুনেছিলাম।আমাদের পরাভবের বয়ান ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, এখনও হচ্ছে। ইংরেজিতে বলা বাক্য আমাদের কানে অসীম ক্ষমতাধর রাষ্ট্র-আমলাতন্ত্র-পশ্চিমাজ্ঞানের স্বর, যা অমোঘ অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ; আমার কানে আসে কেবল মান্য করবার জন্যে, কেবল আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আমার আত্মসম্মান-আত্মমর্যাদাকে, আমার সম্প্রদায়ের জীবনকে পদদলিত করবার জন্যে। আমার পারিবারিক- সামাজিক-সাম্রদায়িক সম্পদকে লুণ্ঠন করবার জন্যে, আমার মানস সম্পদের অবমাননা করবার জন্যে। ইংরেজিতে বলা বাক্যগুলো আমাদের সকল জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধিকে এক লহমায় নাকচ করে দেয়। আমার পয়েন্টকে ইনভালিড করে দেয়। ভদ্রলোকী বাংলা ভাষার কাঠামোও এংরাজ পাদ্রীদের নিজের হাতে তৈরি কৃত্রিম ভাষা। এই ভাষায় রিয়েল লাইফে কখনই বাঙ্গালী তার মনের কথা বলে নাই। তাই তরুণ মাজিস্ট্রেট আর দোকানীর কথোপকথনটিকে আমরা আমাদের অধিকৃত হয়ে থাকা মানসজগতের একটা বহুস্তরীয় টেক্সট হিসাবে গ্রহণ করতে পারি।এই কলনিয়াল সাইকোসিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মত আমাদের জীবনকে হরণ করে নিয়ে গেছে। আরও বহুযুগ এর সাথে আমাদের বসবাস করতে শিখতে হবে।
#সায়েমারলেখা
ছবিঃ উইলিয়াম কেরি এবং পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার
সৌজন্যঃ ডেইলি স্টার
https://www.thedailystar.net/.../the-missionaries-and-the...
©somewhere in net ltd.