![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটা ছিল গল্প ছোট, বুকের মাঝে ক্ষতর মত।
০১.
তনু হার্ডবোর্ড হাতে নিয়ে স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে বেখেয়ালে পেন্সিলের পেছনটা কামড়ে নিচ্ছে। অনিন্দ্য স্টেজে চোখ বুজে গাইছে। ছেলেটার গলায় কেমন যেন ঘোর মেশানো, শুনলে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। তনু সেদিকে মন দিতে পারছে না। লাইটিং এর ছেলেটা আজো ফাঁকি মেরেছে, অন্যখান থেকে ইলেকট্রিশিয়ান ম্যানেজ করে কাজ করতে হচ্ছে। আবার নতুন করে বোঝাও, নতুন নতুন প্রবলেম সলভ করো। তনুর কিচ্ছু ভাল লাগছে না, সব ছেড়েছুড়ে বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। লাইটিং এর ছেলেটাকে গলা উঁচু করে ডাকলো। জাফর পেছন পেছন ডাকতে এসেছিল, তনুর গলা শুনে ফের পেছন দিকে ছুট লাগালো। লাইটিং এর ছেলেটাকে দেখে মেজাজপারদ বিপদসীমার উপরে উঠে গেল তনুর। কি অদ্ভুত! ফিক ফিক করে হাসছে, যেন দেশ উদ্ধার করে ফেলেছে।
“তোমাকে না বলেছিলাম মাল্টিকালার লাইটগুলো লাগিয়ে দিতে, এগুলো কি লাগিয়েছ?”
“যা আপনি দিয়েছেন, সাদা দিয়েছেন সাদা লাগিয়েছি”।
তনু একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। নিশ্চয়ই জাফরের কাজ, লাইটের টাকা মেরে দিয়েছে। নাহ! এবার একে তাড়াতে হবে।
“আচ্ছা তুমি যাও, তোমার তো শেষ?”
“জ্বি দিদিমনি”।
“একেবারে চলে যেও না যেন, প্রোগ্রামটা শেষ হোক। প্রোগ্রামের মাঝে কোন গন্ডগোল হলে তোমার পেছন পেছন ছুটতে পারবো না। প্রোগ্রাম শেষে টাকা পেয়ে যাবে”।
“আচ্ছা দিদিমনি, তবে আমাকে সামনেতে দাঁড়াবার একটু জায়গা করে দিন। অনিন্দ্যদার গান শুনব”।
“আচ্ছা, আচ্ছা যাও”।
তনু জাফরকে খুঁজতে বেরুল, ব্যাকস্টেজে থাকবার কথা, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, নিশ্চয়ই পালিয়েছে।
জাফরকে আসলেই খুঁজে পাওয়া গেল না, তনু রেগেমেগে একাকার হয়ে গেল। ফোঁসফোঁস করতে করতে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। আজকাল কেন যেন কোন কিছুই ঠিকঠাক মত হচ্ছে না। ও থিয়েটার করতে এসেছিল, কি এক গাড্ডায় পড়ে এসব ইভেন্ট করতে হচ্ছে। মুন্না ভাইয়ের ইভেন্ট, কোন গন্ডগোল পাকালে মুন্না ভাই নিশ্চয়ই ছেঁড়ে দিয়ে কথা বলবে না।
অনিন্দ্য হাতের গিটারটা টিউন করতে করতে জনমের দিকে তাকালো। “কিরে তোর সেই ম্যাডাম কই? তার না ঠান্ডা ফান্ডা কিছু আনাবার কথা। আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ। এই জন্য মেয়েদের দিয়ে ইভেন্ট করাতে হয় না”।
জনম একবার চোখ পাকিয়ে তাকালো। “তোর ম্যাডাম” কথাটা ঠিক পছন্দ হলো না। কি বোর্ডে নতুন একটা টিউন তোলার চেষ্টা করছিল, টিউনটা খুব একটা ভালো হচ্ছে না। টিউন ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত কথা বলবে না বলে ঠিক করে রেখেছে। অনিন্দ্য সকাল থেকে কথা বলার চেষ্টা করছে, জনম টু শব্দটিও করছে না। অনিন্দ্য বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে, কিছু একটা মাথায় ঢুকলেই জনম এইরকম করবে। সেই কিছু একটা কি? সেটা ধরতে পারছে না। অনিন্দ্য গিটারটা টিউন করে উঠে দাঁড়ালো। ইভেন্টের মেয়েটা আসলে কিছু কথা শোনাতে হবে, আপাতত নাহয় গানটা আরেকবার তোলা যাক।
মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে তনু। জাফরের গালে হাত, মুন্না ভাই বেশ জোরেশোরে চড় দিয়েছে। তনু আড়চোখে তাকালো, জাফরের গালে বোধহয় পাঁচ আঙুলের দাগ পড়ে গেছে।
“ভেবেছিলাম তোমাকে দিয়ে হবে তনু, তুমি পারবে। এখন দেখছি ভুল হয়ে গেছে। তুমি বরং আগের মতন হেল্পারগিরি করো, ফুল গোছাও, মেয়েলি কাজগুলো সারো ইভেন্টের। আর তুই”, জাফরের দিকে আঙ্গুল তুলে মুন্নাভাই “তুই দুর হ সামনে থেকে আর একদিনও যদি আমার সামনে দেখছি, থাপড়ে তোর সবকটা দাত ফালায় দিব হারামজাদা। লাইটের থেকে টাকা সরানো, তোর ইয়ে দিয়ে লাইট ঢুকায় দিবো, যা এখান থেকে”।
মিনিট পাঁচেক পর তনু বেড়িয়ে এল। মুন্না ভাই ওর পাওনা পুরো টাকাটাই দিয়ে দিয়েছে। এজন্য বেশি খারাপ লাগছে৷ তনু আসার পর মুন্না ভাইকে কোন ইভেন্টের জন্য এই প্রথম কথা শুনতে দেখেছে। তনু টাকাগুলো নিতে চায় নি, মুন্নাভাইয়ের চোখমুখ দেখে না নেবার কথা বলে উঠতে পারে নি।
বড় রাস্তায় এসে দেখে জাফর টং দোকানে বসে চা খাচ্ছে। তনুকে দেখে দৌড়ে কাছে এসে দাঁড়ালো।
“আপা আপনি কিছু মনে কইরেন না, মুন্না ভাই এইরকমই। হেয় যে কত গাইল পারছে। আপনে বাড়িত যায়া ঘুম দেন। ইভেন্টের কাম আইলেই ডাক পড়ব। আর এই জাফর থাকতে আপনারে ডাকব না মানে”।
কত্ত বড় বেহায়া! রাগে গা রিরি করছে তনুর, মুন্না ভাইয়ের মতন পাঁচ আঙুল ছাপানো চড় মারতে ইচ্ছে করতেছে জাফরকে।
“তুমি এখন যাও জাফর, তোমার চেহারা দেখতে ইচ্ছে করতেছে না। টং দোকানে যেয়ে চা খাও, সিগারেট খাও আমার সামনে আসবা না”।
“এইটা কোন কথা কইলেন আপা এখন বাজে রাত বারোটা। আপনে যাইবেন গুলশান টু মিরপুর! আপনারে সি এন জি ঠিক কইরা দিতে হইবো না। আপনে আমার বইন লাগেন, সেই হিসাবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না”।
তনু কিছু না বলে পেছন ফিরে হাটতে লাগল। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সি এন জি পাওয়া যাবে না। কিছুটা আগিয়ে মোড় পর্যন্ত যেতে হবে। জাফর পিছন পিছন আসছে। ছেলেটাকে এখন খুব একটা খারাপ লাগছে না। অন্ধকার রাস্তায় পেছনের মানুষটার স্যান্ডেলের শব্দ কেমন যেন একটা নির্ভরতা জোগাচ্ছে।
অনিন্দ্য গিটারে বেহিসেবী টুংটাং শব্দ তুলছে। কেমন যেন খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। অডিও বক্সের সাথে গতকালও মিটিং হয়েছে। নতুন কোন এলবাম চাইছে ওরা। পুরোনো এলবামের গরমে এটাকে হট কেক বানিয়ে বিক্রি করতে চাইছে। অনিন্দ্যর মাথায় কিছু আসছে না। নতুন সুর নতুন গান কি আর আসবে না! সব কি শেষ হয়ে গেল এর মাঝে! একটা এলবাম আর ব্যাস সব শেষ। জনমকে খোঁচাতে হবে, টিউন গুলো ও ঠিক করুক। দরকার পড়লে বাইরে থেকে গান লেখাতে হবে। যেভাবেই হোক নতুন কিছু চাই অনিন্দ্যর। অনিন্দ্যর এই বেহিসেবি ভাবনাগুলো জনমকে ছুঁয়ে দিতে পারছে না, অন্যমনস্ক হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। কিবোর্ডটার দিকেও খুব একটা আগ্রহ দেখাতে পারছে না। সেই রাতটার পর থেকে মেয়েটা কেমন যেন বুকের ভেতর লেপ্টে গেছে। সেই ক্লান্ত মায়া মায়া মুখ, হাত জোর করে মাফ চাইছে। আচ্ছা অনিন্দ্য কিভাবে পারলো? একটা মেয়েকে এভাবে সবার সামনে মাফ চাওয়াতে! ওর কি এতটুকু দুঃখ বোধ হলো না! জনমের অস্থির লাগতে লাগলো, আজকাল কিবোর্ডের কি গুলো বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেছে, ছুঁতে নিলেই মেয়েটাকে মনে পড়ে যাচ্ছে।
০২.
“তুমি কে?”
“আমি?”
“হুম তুমি?’
“আমি তোমার আটান্ন নম্বর প্রেমিক?”
“আটান্ন নম্বর?”
“হুম”।
“কই আমি তো বাকি সাতান্নের কোন হদিস খুজে পাই নি?”
“আমার মাঝে খুঁজে নাও, দেখো! দেখো! এইমাত্র আমি উনষাট বার তোমার বা পাশের তিলটার প্রেমে পড়লাম’।
“তুমি অদ্ভুত”।
“আমি? হয়ত”।
“হুম তাই, কেউ কি তিলের প্রেমে পড়ে?”
“হুম পড়ে। কে জানে, ঐ তিলটাকে ঘিরে কত মহাকাব্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তোমার পুরো শরীর জুড়ে”।
“তুমি এভাবে ভাবো?”
“না আমি এভাবে ভাবি”
বলে তিলটুকু ছুঁয়ে দেয় অসীম, তনু লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়।
“বেশ হয়েছে তনু” সামনের সিট থেকে রাজনদা চেঁচিয়ে ওঠে, “অসীম, তুমি ছুঁয়ে দেবার সময় লজ্জা পেয়ো না, তোমাকে নির্লজ্জ হতে হবে। আর তনু, তুমি আবার লজ্জা পেতে ভুলে যেয়ো না”।
“ঠিক আছে রাজনদা, আমি কি আসবো তাহলে?” তনু তখনো মাটির দিকে তাকিয়ে।
“আসবে কি! আরো দুটো সিন আছে তো। শেষ করে যাও। শোয়ের কিন্তু খুব বেশি দিন বাকি নেই”।
“রাজনদা আজ নাহয় ছেড়ে দিন, বাকি টা কাল করে নেব। নটা বেজে গেছে, ঐ দেখুন নবু কি রকম হাই তুলছে” অসীম বলে ওঠে।
“যাবে? ঠিক আছে যাও” গাল ভর্তি দাড়ি চুলকোন রাজনদা এক ফাঁকে “তবে কাল সময় মত এসো। তনু তুমি আবার কাট মেরো না”।
“না না রাজনদা কাট মারবো না বিশ্বাস করুন, সেদিন বাসায় ওরকমটা না হলে কিছুতেই কাট মারতাম না”।
“ঠিক আছে ঠিক আছে। অসীম তুমি নাহয় তনুকে পৌছে দিয়ে এসো। ওদিকেই তো যাবে”।
কাঁধে ব্যাগটা ফেলে তনু বেড়িয়ে পড়ে, অসীম পিছু নেয়। অনেকটা পথ হেটে যেতে হবে। তনু চুপচাপ হেটে যায়। অসীম ইতস্তত করতে থাকে। তনুকে ওর কতকিছু বলার থাকে। তনু কি কখনোই ওকে নিজের করে নেবে না!
“তনু, এই তনু?” তনু মুখ ফিরিয়ে তাকায়।
“আমি কি খুব খারাপ কিছু বলেছিলাম?” অসীম লজ্জায় মিইয়ে যায়।
“না অসীম ভাই, খারাপ কেন হবে। আমার জন্য যে সে রাস্তাটা বন্ধ হয়ে আছে”।
সারাটা রাস্তা অসীম আর কিছু বলল না। প্রত্যাখ্যান হবার জ্বালা নিয়ে তনুকে বাসায় পৌছে দিলো।
বাসায় ঢুকে মায়ের একগাদা কথা শুনতে হলো, এখনো চেঁচিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে খুব একটা আমল না দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল তনু। আজ কেমন পচা গরম পড়েছে, জামাটা পুরো লেপ্টে গেছে গা জুরে। গায়ে পানি ঢেলে হু হু করে কেঁদে ফেলল তনু। বন্ধ দরজায় আলতো আলতো করে কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে।
“দিদি ও দিদি”।
তনু কান্নাটাকে গিলে “হু” করে উত্তর দিলো।
“শোন না, আমি না পেন্সিল হারিয়ে ফেলেছি। মা শুনে কি মারটাই না মারলো, তুই আমাকে একটা পেন্সিল কিনে দিবি? ও দিদি, দিদি? শুনতে পাচ্ছিস?”
তনু একের একের পর এক মগ পানি ঢালছে গায়ে। কানের কাছে কমলের কথাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
জনম ফোন করবে কিনা ভেবে উঠতে পারছে না। ফোন করবার থেকে সরাসরি দেখা করে কথা হলে ভালো হতো। সরাসরি দেখা করবার সাহস করে উঠতে পারছে না, দেখা করবার কথাটা বলতে হলেও ফোনটা করা দরকার। দোমনা হয়ে ফোনটা তুলে নিল।
“হ্যালো, হ্যালো কে বলছেন”।
“আমি, আমি আসলে……”
“জ্বি আপনি?”
“আমি আসলে আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম”
“জ্বি বলুন”
“আপনি তনু তো?”
“জ্বি আমিই তনু”
“আমি কি আপনার সাথে দেখা করতে পারি?”
“সরি আমি কি আপনাকে চিনি?”
“জ্বী”
“আপনার নামটা?”
“আমি আসলে দেখা করে বলতে চাচ্ছিলাম”।
“সরি ভাই, আমি আসলে খুব ক্লান্ত, এসব ওয়ার্ডপ্লে ভালো লাগছে না। আপনি বরং অন্য কারো সাথে চেষ্টা করুন” বলে ফোনটা কেটে গেল। জনম হেসে ফেলল, মেয়েটা বেশ। নামটা বলতে পারত, বললে চিনে নিত। আসলে, সেই দিনটার পর আজকে এভাবে নাম বললে তনু দেখা করত কি না বোঝা মুশকিল। আচ্ছা দেখা যাক। একবার না পারিলে দেখ শতবার। জনম কি বোর্ডটা নিয়ে বসল। বুকটা কি এক অদ্ভুত ভালোলাগায় জেগে থাকতে লাগলো। কই আগে তো কখনো এমন কিছু হয় নি!
০৩.
তনু হাতের কলমটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিলো। কেমন ছাড়া ছাড়া লিখছে। আরেকটা কলম বের করে নিতে গিয়ে দেখলো বক্সে কলম নেই, ব্যাগে রয়ে গেছে। সামনে গিয়ে নিয়ে আসলো। কলমের মাথাটা অভ্যেসমতন কামড়ে লিখতে বসলো। আজকে রিহার্সালে যাওয়া হবে না, পরীক্ষার ব্যাপারটা ভুলে খেয়ে নিয়েছিল। জানাবার জন্য রাজনদা কে অনেকবার ফোন করেছে, পায় নি। কি আর আজকেও বকাবকি করবেন। পরীক্ষা শেষ হতে হতে পাঁচটে। তিনটের দিকে রিহার্সেল হবার কথা। ইডেন থেকে টি এস সি হেটে যেতে যেতে ঘন্টা খানেক লেগে গেল। সবাই বসে আছে। অসীমের সাথে ফর্সামতন একটা একটা মেয়ে হেঁসে হেঁসে কথা বলছে। রাজনদা তনুকে দেখেও কিছু বললেন না। স্বভাববিরুদ্ধ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। তনু চুপচাপ রাজনদার পাশে গিয়ে বসলো।
“প্লে টা আর হচ্ছে না তনু” নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে রাজনদা বলে উঠলো “আজকে সময়মত না এসে ভালো করেছিস”।
“কেন কি হলো?”
“ভেন্যুর টাকা জোগার হয় নি। যার টাকা দেবার কথা ছিল, সে না করে দিয়েছে”।
তনু আর কিছু বলল না। নিজেকে অপয়া মনে হচ্ছে, যেটার কাছাকাছি যাচ্ছে, কি এক অদ্ভুত সুতোর টানে ছিঁড়ে যাচ্ছে। অসীমকে বড্ড সুখি সুখি লাগছে। মেয়েটার হাতে হাত রেখে কি সব গল্প করে যাচ্ছে । এসব হওয়া না হওয়া ওদেরকে ছুঁতে পারছে না।
“মন খারাপ করেছিস?”
“না না রাজনদা” তনু চটজলদি উত্তর দেয়।
“আমি কিন্তু প্লে র কথা বলছি না” চোখ দিয়ে অসীমকে দেখায় রাজনদা, তনু হেসে ফেলে।
“আমি জানতাম ও আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না, ঠিক কাউকে জুটিয়ে নেবে। আমি খুশি রাজনদা, ও অন্তত কাউকে খুঁজে পেয়েছে। আমার আর যাই হোক, ঘর বাঁধা হয়ে উঠবে না”।
“নিজেকে এত খেলো ভাবিস কেনো?”
তনু রাজনদার এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিলো না। উত্তরের কোনটাতে ঘন হয়ে থাকা অন্ধকারে চোখ দিয়ে বসে রইল।
দুদিন ধরে তনুর মনে হচ্ছে কে যেন ওকে ফলো করছে। ভার্সিটিতে যাবার পথে একটা মুখ বার বার চোখে পড়ছে। ঠিক ধরে উঠতে পারছে না। আজকে নীলক্ষেত ঢুকতে হবে, কিছু বই কিনতে হবে, কমলটার জন্য পেন্সিল, কলম খাতা৷ দুদিন পর পর সব হারাবে আর দিদির কাছে এসে বায়না করবে। মা শুনলে আচ্ছা মতন লাগিয়ে দেয়, সেই ভয়ে মাকে বলতে সাহস পায় না, যত আব্দার দিদির কাছে। আজকেও তনুর মনে হচ্ছে কে যেন ওকে ফলো করছে। কাঁধের কাছটা শির শির করছে। পেছন ফিরে ভালো করে দেখে নিল, মানুষগুলো হুড়োহুড়িতে ব্যস্ত। এত ভিড়ে আলাদা করে কাউকে চোখে পড়ছে না। তনু এগিয়ে কেনাকাটাগুলো সেরে নিলো। ন নাম্বার লোকাল বাসে আজ বেজায় ভিড়, উঠতে নিয়ে জান বেরিয়ে গেল তনুর। ভিড়ের মাঝে কে যেন গায়ে হাত রেখেছে। মেয়েদের সিটের দিকে চেপে এল তনু, হাতটা পেছন ছাড়ছে না। ব্যাগ থেকে সেফটিপিন বের করে আচ্ছাসে ফুটিয়ে দিলো। তরিঘড়ি করে হাতটা সরে গেল। সংসদ ভবন আসতেই একটা সিট পেয়ে গেল৷ জানালা দিয়ে ছুটে চলা মানুষগুলোকে কেমন যেন রোবটের মতন দেখাচ্ছে। তনু সিটে মাথা হেলিয়ে দিলো, খুব ক্লান্ত লাগছে। শহরটা চেপে বসেছে পুরো শরীরজুরে, যেন খেয়ে ফেলবে।
“আপনি কি খুব ব্যাস্ত?”
“কে বলছিলেন?”
“আমি কিন্তু প্রশ্নটার উত্তর পাই নি?”
“না সেরকম কিছু নয়। কে বলবেন প্লিজ?”
“তাহলে ফোন ধরলেন না যে? আধাঘন্টার ভেতর দুবার ফোন করে ফেলেছি”।
“ধুর ভাই আজাইরা প্যাচাল, ফোন রাখেন”।
তনু খুব বিরক্ত হয়ে ফোনটা কাটলো। কমলের বেশ জ্বর, থেকে থেকে গা মুছিয়ে দিতে হচ্ছে। বেচারা রাতে কিছু খায়নি। মায়ের কাছে দুধ পাউরুটির বায়না করে ঘুমিয়ে গেছে। তনু আসবার সময় নিয়ে এসেছে, এসে দেখে প্রচন্ড জ্বর নিয়ে বেচারা ঘুমিয়ে গেছে। জনম ফোনটা রেখে হেসে ফেলল। তনুর সাথে এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে।
মাঝরাত্তিরে কমলের জ্বরটা বেশ বেড়ে গেল, ছেলেটা মুখে উ আ করছে। তনু ঘাবড়ে গেল, সারা রাত ভাইয়ের মাথার কাছে বসে রইল। মাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ছোটবেলার মায়ের সাথে বড়বেলার মায়ের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তনু কিংবা কমলের শরীর খারাপ হয়ে গেলে, মায়ের মাথা খারাপের মতন হয়ে যেত। রাতকে রাত জেগে বুকে জড়িয়ে রাখত। সকাল বেলা কমলকে টেনে নিয়ে মোড়ের ডাক্তারখানায় বসে রইল তনু। ছেলেটা ঢলে ঢলে পড়ছে, কমলের জ্বর সহ্য হয় না। ডাক্তার ভদ্রলোক খুব সময় নিয়ে দেখলেন। ঔষধ লিখে দুপাতা সিভিট ধরিয়ে দিলেন কমলের হাতে। তনু কমলকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আজকে আর কোথাও বেরুবে না। জহির ভাইকে ফোন করে দুটো টিউশনির কথা বলে রাখবে। এসব ইভেন্টের চক্করে আর পড়বে না। থিয়েটার করাটা আর হয়ে উঠবে কিনা বুঝে উঠতে পারছে না। শখ কিংবা ইচ্ছেটাকে প্রফেশনে পরিণত করে নেবার খুব জোর চেষ্টা করেছে, কোন উপায় হচ্ছে না। দুধ পাউরুটি ভিজিয়ে কমলের মুখে তুলে দিলো তনু। বেশ খানিকটা খেলো, জল খাইয়ে দিতেই পুরোটা উগলে দিলো তনুর গায়ে। তনু সেভাবে ঠায় বসে রইল। পর্দাটা কাঁপছে, পর্দার পেছনে একজোড়া পা দেখা যাচ্ছে। তনুর অনেক অনেকদিন পর অভিমানগুলো উথলে উঠলো, চোখ পর্যন্ত ভেসে যাবার আগে নিজেকে সামলে নিলো।
০৪.
“আজকেই কি তবে শেষ?”
“কি শেষ?”
“এইযে আমাদের দেখা? একসাথে ভালবাসাগুলো ভাগাভাগি করে নেয়া?”।
“শেষ বলতে তুমি কি বোঝ বলতো?”
“আমি শেষ বলতে বুঝি তুমি। তোমার আঁচলটা আমার কাছে রেস ট্রাকের ভিক্টোরি ফ্লাগের মতন শেষ। বাতাসে যখন তুমি আঁচল সামলাতে হিমসিম খাও, তখন আমি একটু একটু করে শেষ হয়ে যাই”।
“এভাবে হয় না বুঝেছো, এভাবে হবে না, তুমি হওয়াতে পারবে না। তুমি ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত”।
“সেটার জন্য কি তুমি দায়ী নও?”
“দায়! উহু তোমার দায় শুধু তোমার। আমি ওসব দায় নিতে পারবো না। আমার আকাশের বন্দী হতে মানা। তুমি তোমার আকাশটাকে জোর করে আমার বানিয়ে দিতে চাইছো। এ হয় না, হবে না”।
“শেষবারের মতন তোমার হাত ছুঁতে পারি?”
“ছুঁতে পারো, তবে হৃদয় ছোঁয়ার চেষ্টা করো না”।
দুজন মানুষ চুপচাপ বসে থাকে।
“অসীম তোমার ভাংচুর স্বত্বাটাকে দেখতে পারছি না” রাজনদা হতাস কন্ঠে সামনে থেকে বলে ওঠে। “এভাবে হবে না, হচ্ছে না” মাথার চুলে হাত বোলায় রাজনদা। নবু পেছন থেকে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে। ঠিক যেন গর্ত থেকে মাথা বের করে থাকা শেয়াল। তনু সেদিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেলল, ফের সামনে তাকিয়ে জিভ কাটলো। রাজনদা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে কিসব যেন বলছেন, নিশ্চয়ই তনুকে বকছেন।
“আপনি কিভাবে সব ম্যানেজ করলেন?” চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্নটা করেই ফেলে তনু।
“তোর জেনে কি লাভ! যেভাবেই হোক, হয়ে গেছে ম্যানেজ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়ে গেছে, না হলেই ভালো হতো। তোরা দুজন যা শুরু করেছিস! সব গোলমাল করে দিচ্ছিস। এভাবে তো হয় না তনু” রাজনদার গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে।
তনু চোখ তুলে তাকাতে পারে না। প্লে হবে শুনে খুশির চোটে আজ সব গোলমাল করে ফেলেছিল। অসীম ও আজ অফট্রাকে ছিল পুরোটা সময়, ছেলেটার কি হলো কে জানে।
“তোরা আমাকে ডোবাস না তনু। এটা হয়ত আমার শেষ প্লে। এটা অন্তত আমাকে ভালোভাবে শেষ করতে দে” রাজনদার গলা বুজে আসে।
“এভাবে কেন বলছেন রাজনদা! আমি কথা দিচ্ছি আর হবে না, আমি আমার সবটা ঢেলে প্লেটা করবো”।
“করলেই ভালো”, চায়ের কাঁপটা নামিয়ে চলে যায় রাজনদা। কিছুটা এগিয়ে একটা রিকশা ধরেন। তনুর কাছে হুট করে ভ্যেনুর টাকা জোগার হবার বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। রাজনদা তার বাইকটা বিক্রি করে টাকা তুলেছে। তনুর মনে হল হুট করে কে যেন কাঁধে ভারী একটা বোঝা চাপিয়ে দিলো। সেই অদৃশ্য বোঝার ভারে নুয়ে পড়ল তনু।
রাস্তার মোড়টায় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জনম। আশেপাশে আরো দুটো বাইক দাঁড়িয়ে আছে, তিন চারটে ছেলে জড়ো হয়ে ফিক ফিক করে হাসছে। রাস্তায় দিয়ে কোন মেয়ে গেলেই ফিসফাস সাথে সীস। জনমের নিজেকেও ওদের মত লাফাঙ্গা বলে মনে হচ্ছে। সে নিজেও তনুকে দেখার জন্য বসে আছে। প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে যায় মেয়েটা, জনম লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। মাঝে মাঝে পেছন পেছন লুকিয়ে চুরিয়ে অনেকটা পথ হেটে আসে, সেদিন নীলক্ষেতে প্রায় ধরা পড়ে যেতে নিয়েছিল। আজকে সাহস করে বাইকের ওপর চেপে বসেছে, চোখে সানগ্লাস। রাস্তার ঐ পাড় থেকে তনুকে হেটে আসতে দেখে বুক মুখ শুকিয়ে গেল জনমের। বাইকটাকে ঠেলে দোকানটার পেছনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, এদিকে বাইকের লক খুলতে ভুলে গেছে, বাইক আগাচ্ছে না। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে তনু সোজা জনমের দিকে হেটে আসছে।
“আপনি এই বাইকটা কোথায় পেলেন?”
জনম তখনো বাইকটা ঠেলার চেষ্টা করছে, এক চুল নড়াতে পারছে না।
“আমি, আমাকে বলছেন?” বাইক ঠেলা বাদ দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে জনম।
“জ্বি আপনাকেই বলছিলাম”।
“আমার বাইক, কিছুদিন আগে কিনলাম”।
“রাজন নামের কারো কাছ থেকে?”
অবাক হয় জনম, তনু রাজনকে কিভাবে চিনলো!
“জ্বি, কেন বলুন তো!”
“এই বাইকটার একটা ইতিহাস আছে। আমি কি আপনার নাম্বারটা পেতে পারি?”
হড়বড় করে নাম্বার বলে জনম।
মোবাইলে নাম্বারটা তুলতে তুলতে তনু ভ্রু কুঁচকে তাকায়, একটু ভালোভাবে ছেলেটার মুখের দিকে তাকায়, “আজ আমার সময় নেই, কালকে ৫ টায় টি এস সি চলে আসবেন, কথা আছে”।
হতভম্ব জনমকে পেছনে ফেলে রেখে, চলে যায় তনু।
বসার ঘরে এক ভদ্রলোকের পেছন দেখা যাচ্ছে। মাত্র ঘরে ফিরেছে তনু, মা হেঁসে হেঁসে কথা বলছেন ভদ্রলোকের সাথে। তনু হিসেব করে বের করতে পারলো না যে, কতদিন সে মাকে হেঁসে হেঁসে কথা বলতে দেখেনি। পাশ কাটিয়ে যাবার পথে খুব পরিচিত একটা গন্ধ পেলো, এই গন্ধটা ভুলে গিয়েছিল, ভুলে যেতে হয়েছিল। তনু মুখ ফিরিয়ে তাকালো। মানুষটা হাঁসি হাঁসি মুখে তনুর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো “কেমন আছিস মা?” তনু প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে মায়ের দিকে ফিরে তাকালো, “এই মানুষটাকে কে ঢুকতে দিয়েছে মা?”
“এটা কি ধরণের কথা তনু, বাবা হয় তোর?”
“সত্যি মা! তোমার কথা শুনে হাঁসি পাচ্ছে। বাবা? তো তোমার সিঁদুর কোথায় মা, সিঁথি খাঁ খাঁ করছে কেন?” তনুর এ প্রশ্নে রা কাটে না সুজাতা দেবীর।
“আমি পড়িয়ে দেবো তনু। আমি ভুল করে ফেলেছিলাম রে মা। এই দেখ আমি ফিরে এসেছি, তোর মায়ের সিঁথি আবার লাল হয়ে উঠবে”।
কথাগুলো শুনে গা জ্বলে যায় তনুর, “আমার বাবার চিতায় মায়ের সিঁদুর পুড়েছে সেই কবে, আপনি তো শুনেছি বিয়ে করেছেন, তো হঠাত এত দরদ উথলে উঠলো কেনো? মায়ের গয়নাগুলোতো ধুয়ে মুছে খেয়েছেন। এখন এই বাড়িটা খাওয়ার ধান্দা তাই তো? শোনো মা আমি গোসলে যাচ্ছি। এসে যদি দেখি এই লোক এখনো বসে আছে, বটির কোপে বলি দিয়ে দিবো একদম” তনু কথাগুলো বলে ভেতর বাড়িতে চলে গেল। পর্দা পেড়িয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো, বুকটা থির থির করে কাঁপছে রাগে।
“তোমার ঐ নাচুনী মেয়ের এত দেমাগ কিসের বলতো? দেখো, কোথায় না কোথায়, কার না কার সাথে শুয়ে আসে। আমি কিছু জানি না ভেবেছো। যাত্রাপালায় রাত্তিরে শো ফো করা মেয়েগুলোর থেকে ও কম কিসে, দুদিন পর তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে” কথাগুলোর সাথে সাথে ঠাস করে একটা শব্দ ভেসে আসে। পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয় তনু। মা রাগে কাঁপছে, “বের হয়ে যা জানোয়ার কোথাকার, তোর কি মনে হয়? তোর মিষ্টি কথায় আমি ভুলেছি, আমাকে কচি খুকি পেয়েছিস না। এক্ষুনি বেড়িয়ে যা। ফের যদি এই বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়েছিস, তনু তোকে বলি দিক বা না দিক, আমি দিয়ে দিবো। তুই জানোয়ার ছিলি, আছিস, থাকবি। আর একটা কথাও যদি আমার মেয়ের নামে বলেছিস, জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো তোর হারামজাদা”।
মায়ের এমন রনাঙ্গিনি রূপ দেখে অবাক হয়ে গেল তনু। গালে হাত রেখে লোকটা বেড়িয়ে গেল। তনু পায়ে পায়ে এগিয়ে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
“তুই গোসলে যাবি না? যা যা তাড়াতাড়ি করে নে, ঠান্ডা লেগে যাবে, রোজ রোজ তোর এই দেরী করে গোসল করা একদম দেখতে পারি না বাপু। আর কমল এলে বকে দিবি, পড়াশুনো নেই খালি টইটই, একদম কথা শুনতে চায় না”।
তনু মায়ের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে রাখলো, মায়ের শরীর থেকে মা মা ঘ্রাণ তনুর গায়ে পায়ে মেখে গেল, আঁচল ভিজে যেতে লাগলো চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া টুপটাপ জলে।
০৫.
“আমাকে বিয়ে করবেন?” চায়ে চুমুক দিয়ে জিঙ্গেস করে তনু।
হতভম্ব হয়ে শার্টে চা ফেলে দেয় জনম।
“এখনি বলতে হবে না, আপনি সময় নিন। আচ্ছা আপনি আমার নাম জানেন তো? নাকি সেসব না জেনেই রাত বিরেতে ফোন করতেন?”
“জ্বি জানি, তনু”
“উহু ভুল জানেন” তনু চায়ের কাপটা পাশে রেখে হাত বাড়িয়ে দেয়, “আমি তনুশ্রী মিত্র, আপনি?”
জনম হাত বাড়িয়ে থমকে যায়, মিত্র শব্দটা বুকের বাঁ পাশে কোথায় যেন গভীর একটা ক্ষতের সন্ধান পাইয়ে দেয়, তনু হিন্দু!
তনু হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়, “আমি কিন্তু আপনার পুরো নামটা জানি জনম মাহমুদ। ইভেন্টে প্রথম দেখেছিলাম তার পর আর দেখা হয় নি কখনো তাই ভুলে গেছিলাম। আপনি ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে গেছেন। আপনাকে বাইকের গল্পটা বলার ছিল, এখন আর বলতে ইচ্ছে করছে না। আপনাকে কেন যেন ভাববার সময় দিতে ইচ্ছে করছে। আপনি দুটোদিন সময় নিন। মিত্র আর মাহমুদে যুদ্ধ হোক। মিত্র জিতে গেলে দুদিন পর এখানে এসে দেখা করবেন, আমি অপেক্ষা করবো”। তনু ফিরে আসে, থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে হেঁসে ফেলে। মিত্র আর মাহমুদে, মিত্রের কখনো জেতা হয়ে উঠবে না। কালকে শেষ রিহার্সেল। পরশুদিন হাজার মানুষের সামনে নিজেকে একটা চরিত্রে গুছিয়ে ফেলতে হবে। রাজনদা কি করে যেন মধুমিতা চৌধুরীকে চিফ গেস্ট হিসেবে ম্যানেজ করে ফেলেছেন। বাইকের টাকাগুলো আর্ধেকই বোধহয় মধুমিতার পেছনে খরচ হয়ে গেছে।
০৬.
“তোমার সময়গুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে”।
“তুমি কি হাতঘড়ি দেখে আমাকে সময় দেবে?”
“হু, পাঁচ মিনিট। আর তিন মিনিট পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড বাকি”।
“এটা রাখো, পড়তে দুমিনিটের বেশি লাগার কথা নয়, আমি আসছি”।
প্রিয় মিত্রা,
তোমার মনে আছে? আমাদের প্রেমের প্রথম প্রহরে বুকপকেটে একরাশ বেলীফুলের সাথে তোমাকেও গুঁজে দিয়েছিলে। সেই তোমাকে খরচ করতে করতে আজকে হয়ত শেষ বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছি। কাল থেকে আমার পকেট শূন্য। রাত্তিরে চাঁদের সাথে তোমাকে কিছুটা খরচ করে আমার আর জোসনা বিলাস করা হবে না। হবে না ঘুটঘুটে অন্ধকারে জোনাকির মতন ফুটে ওঠা দুটো তারার সাথে ধোঁয়ায় ওড়ানো। তুমি চলে যাচ্ছ, যাওয়ার জন্যই এসেছিলে, এসেছিলে আমাকে ফুরিয়ে দেবার জন্য। তোমাকে খরচ করে যেই স্মৃতিগুলো কিনেছি, সেগুলো দিয়ে আমার বাকিটা জীবন অনায়াসে কেটে যাবে। শুধু বুকের মাঝে যে ক্ষতটা রেখে গেলে, সেখানকার প্রলেপ হিসেবে কি আরেকটা চিঠি দিতে পারবে মিত্রা? কিংবা তোমাকে ক্ষণে ক্ষণে ছুঁয়ে যাওয়া রুমালটা দিলেও চলবে। আমি জানি তুমি ভালো থাকবে, এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা আমাকে দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত ভালোথাকাগুলো তুমি কিনে ফেলেছো জানি। এই চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলো, অন্তত এটা জমিয়ো না।
অনিমেষ
ব্যাক্সস্টেজ থেকে অসীমের গলায় চিঠিটা শেষ হতে পুরো থিয়েটার থমকে গেল। একে একে শুরু হওয়া হাততালির গুঞ্জনে কান ভো ভো করতে লাগলো তনুর, চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে আসছে অনবরত। রাজনদা চোখে জল নিয়ে হাসছে। সবাই ছবি তুলতে আসছে, অটোগ্রাফ চাইছে। তনুর মনে হতে লাগলো তার কোথায় যেন যাওয়ার ছিল, কেউ একজনের আজকে হয়ত আসবার কথা ছিল। বাসন্তী রঙের শাড়ীটা কোনমতে গায়ে পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়ালো তনু। দ্রুত পায়ে বটতলায় এসে দাঁড়ালো। টং দোকানের নিচে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে, তবে কি মিত্র আর মাহমুদের যুদ্ধে মিত্র জিতে গেল? বুকটা ধক ধক করতে লাগলো তনুর। পা দুটো মাটির সাথে আটকে যেতে চাইছে, পাহাড়সম পাদুটোকে টেনে নিয়ে সামনের দিকে এগুলো তনু।
শহুরে একটা দেয়াল ভেঙ্গে পড়েছে, দুটো দাঁড়কাক ইলেকট্রিক তারে বসে চুপটি করে সেটা দেখছে।
২৩ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫৮
বিশাল শাহরিয়ার বলেছেন: ইচ্ছে ছিলো শেখার, সুযোগ হয়ে ওঠেনি। সুযোগ পেলেই গিটার ব্যাপারটা গল্পে এনে ফেলি তাই। ধন্যবাদ
২| ২৩ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:৩২
রাজীব নুর বলেছেন: এখন গিটার শেখা অনেক সহজ। শুধু ইচ্ছা টা করুন।
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫১
রাজীব নুর বলেছেন: আধুনিক গল্প লিখেছেন।
একসময় আমিও গিটার বাজাতাম। মন খারাপ হলেই আমি গিটার নিয়ে বসতাম।