নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কাজী অনন্য শেখর

সপ্নচোরা

বিশ্বকে জানি এবং বিশ্বকে জানাই

সপ্নচোরা › বিস্তারিত পোস্টঃ

লেজ কামড়া-কামড়ি

২২ শে অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৩:১৬

শরৎ এর শেষ বিকেল।রোদটা তেমন প্রখর নয়। দখিণের আকাশটায় ঘন কাল মেঘ স্থির হয়ে শূন্যে ভাসছে। ঝুম বৃষ্টির সময় আকাশের মেঘমালা স্থির থাকে। হয়তো ওদিকটায় বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি ভেজা শীতল বাতাস আমার গায়ে এসে লাগছে।মাথার চুলগুলো বাতাসের আঘাতে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। আমি বৃষ্টি ভেজা বাতাসের পরশ নিতে নিতে পুকুরের পাড় ধরে সামনে এগুচ্ছি। আমার বাড়ীর দক্ষিনে পাকা রাস্তার এপাশটায় গায়ে গায়ে লাগা অনেকগুলো পুকুর। একটার পাড় ছাড়ালেই আরেকটা। এভাবে এক কিলোমিটার দুরের আমাদের পুকুর অবধি পুকুরের পাড় ধরে ধরেই যেতে হয়। মাষকলাইয়ের চারা গাছ গুলো পুকুরপাড়ের পায়ে হাঁটা পথে নুইয়ে আছে। পায়ের সাথে ধাক্কা লেগে চারাগুলোর দু-একটা সবুজ কচিপাতা ছিড়ে ছিড়ে যাচ্ছে। যে পাড়ে মাষকলাইয়ের চারা নেই সে পাড়টা লেংড়ায় ভর্তি।লেংড়া মানে প্রেকাঁটা।আমাদের গ্রামে প্রেমকাঁটাকে লেংড়া বলে। বইয়ে পড়ার আগে এটাকে আমি লেংড়া নামেই চিনতাম। প্রেমকাঁটা গাছগুলো পায়ের ধাক্কায় সরে যাওয়ার আগে আমার লুঙ্গিতে দু-একটা কাটা গেঁথে দিয়ে যাচ্ছে। প্রেমকাঁটা একবার লুঙ্গিতে লাগলে এমনি এমনি লুঙ্গি থেকে সরেনা আবার না সরালে হাঁটুতে উরুতে যেখানে লেগে থাকে সেখানেই খোচায়। সরানোটাও বেশ কষ্টসাধ্য। একটা একটা কাটা ধরে অনেক সময় নিয়ে সরাতে হয় । অনেকটা প্রেমিকা মতোই! ছাড়াও কঠিন না ছাড়লেও যন্ত্রনা!! সম্ভবত এই জন্যেই এর নাম প্রেমকাটা!! :)



আমি যে পুকুর পাড়গুলো দিয়ে হাঁটছি এখানে এক বৎসর আগেও পুকুর ছিলনা। সবুজ ধানক্ষেত আর ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে সীমানা নির্ধারন করা ছোট ছোট আকাঁবাঁকা আইল ছিল। আমি বাড়ী আসলে বিকেলে সবুজ ধারালো কচিপাতা ঠেলে ঠেলে অথবা হলদে পাকা ধানের ছড়ার মড়মড় শব্দ শুনতে শুনতে ধানক্ষেতের ভিতরের পথ ধরে হাঁটতাম। সময় বদলে গেছে। আমাদের কৃষি নির্ভর এই গ্রামটা এখন হয়ে গেছে মৎস্য নির্ভর! মাছ চাষে লাভের পরিমাণ বেশী হওয়াতে সবাই ধানের ক্ষেত কেটে পুকুর বানিয়েছে। একসময় যেখানে সবুজ ধানের চারাগুলো বাতাসে দোলখেত এখন সেখানে ছোটবড় পাঙ্গাস মাছেরা লাফালাফি করে। শুয়োরের পালের মতো একটা আরেকটার গায়ে লেগে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে খাবার খায়। আর সেই পাঙ্গাস বিক্রি করা আয় দিয়ে গ্রামের মানুষের সংসার চলে। যাদের জমি নেই বা পুকুর লিজ নেয়ার মতো টাকা নেই তারা আকিজ সিরামিকস কোম্পানীতে কাজ করে। পুকুরগুলোর ওল্টাপাশেই প্রায় একশ একর ধানের জমিতে তৈরি করা হয়েছে আকিজ সিরামিকস ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরীর জন্য জমি বেঁচাকেনা করে অনেকে লাখপতি হয়েছে আবার অনেকে নিজের বাপ-দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি হারিয়ে হয়েছে নিঃস্ব। গ্রামের প্রভাবশালী দালালেরা অনেক অসহায় কৃষকের জমির জালদলিল করে বিক্রি করে দিয়েছে আকিজ কোম্পানীর কাছে।ফলে জমির মালিক হয়েছে পথের ফকির আর দালালেরা ফুলেফেঁপে হয়েছে কলাগাছ। কয়েকদিন আগে শুনলাম আামদের এলাকাকে নাকি শিল্প এলাকা হিসাবে ঘোষনা দেয়া হয়েছে। মানে আশেপাশের আরও ধানের ফসলি জমিতে ফ্যাক্টরি করতে এখন আর কোন বাঁধা নেই। যদিও সমতল ভূমির এই এলাকাটিতে একসময় প্রচুর ধান হতো। সেই ধান সাপ্লাই হতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এখন সিরামিকস ফ্যাক্টরী থেকে সাপ্লাই হবে টাইলস,সিরামিকসের বাসনকোসন, ইটখলা থেকে উন্নত মানের ইট অথবা কোন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে উন্নতামানের পোশাক! আমার প্রিয় সবুজে ঘেরা এই গ্রামটিতে বড় বড় মেশিনের খটর খটর শব্দ, আকাশমুখী ইটখোলার কাল ধোয়ার স্রোত অথবা নদী নালা দিয়ে কাপড় ডাইং এর উচ্ছিষ্টের স্রোতকে আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। আমার মেনে নেয়া না নেয়াতে কিচ্ছু যায় আসেনা,আমার কথায় দেশ চলেনা,গ্রাম চলেনা বা শাসক গোষ্ঠিও চলেনা। তাদের প্রয়োজনে তারা যা খুশি করতে পারে! আমি বা আমরা বাঁধা দেওয়ার কেউ নই!!



আমি পুকুরের পাড় ধরে ধরে চলে এলাম আমাদের পুকুরটার ধারে। আমাদের এই পকুর পাড়টার পাশেই একটা বিশাল তেতুল গাছ আছে । আমি গ্রামে এলে প্রায়ই বিকেলে হেঁটে হেঁটে এই তেতুল গাছটার নিচে এসে বসি। লোকে বলে এই গাছটায় নাকি ভূত থাকে এবং অনেকে ভূত দেখেছেও। সেদিন বিকেলে আমার স্ত্রী আমার ছোটবোনকে নিয়ে এই পুকুর পাড়ের দিকে আসতে চেয়েছিল। মা আসতে দেয়নি। বলেছে বিকেলবেলা অথবা সন্ধাবেলায় এই গাছের নীচে সর্বসাধারনের যাওয়া মানা। মেয়েছেলেদের তো প্রশ্নই আসেনা। যদিও আমি বহু সন্ধায় এখানে বসে বসে পড়ন্ত বিকালের সুর্যাস্ত দেখেছি এবং হাফমাইল পশ্চিমের বাড়ীর বাঁশঝাড় থেকে আসা শত শত বাঁদুড়ের কিচিরমিচির শব্দ শুনেছি কিন্তু কোনদিন ভুত দেখেনি অথবা কোন অজ্ঞাত ভুত বা জ্বীনের আছরে আমি অসুস্থও হয়ে যাইনি।

তেতুঁল গাছটার পশ্চিমদিকটায় গাছের নিজ থেকে বাঁদুড়ের কিচির মিচির করা বাড়ী পর্যন্ত বেশ কয়েক একর জমিতে এখনও ধানের চাষ হয়। সবুজ গর্ভবতী অথবা সদ্য প্রসুত ধানের গাছ গুলো মৃদু বাতাসের তালে তালে মাথা দোলায়। দু-একটা পাখি সবুজ ধানের উপর উড়ে উড়ে পোকামাকড় খায়। আর তেতুঁল গাছের পাতায় পাতায় সংঘর্ষের শনশন শব্দ কানে মিষ্টি-মধুর সঙ্গিতের তাল দেয়। পৃথিবীতে কোন বাদ্য যন্ত্র সম্ভবত এখনো তৈরি হয়নি যেটা এই প্রাকৃতিক শব্দটা তৈরি করতে পারে। এই শব্দ পেতে হলে প্রাকৃতির সান্নিধ্যে আসতেই হবে।অথচ আমরা এই প্রকৃতিকে ধংস করছি অবলীলায়, নির্মম নিষ্ঠুরতায়!!



আমি গাছটির নীচে ঘনসবুজ ঘাসে পশ্চিমদিকে মুখকরে বসে চারদিকে একবার চোখ ভুলালাম। আমার পিছনের দিকে বাতানের বিল নামে একটা মাঝারি সাইজের বিল আছে । এখানে মাঝে মাঝে বড়শী নিয়ে প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে উঠা মাছ ধরার জন্য বসে থাকতে দেখা যায় কিছু মৎস্য শিকারীকে। আজকে তাদের কাউকে চোখে পড়লোনা। ঈদের একদিন পর বলেই হয়তো তারা নেই। সবাই ঈদ আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত। বিলটির টানে তেতুঁলগাছটার দক্ষিন দিকে একটু উঁচু জায়গায় প্রায় একবিঘার মতো অনাবাদী জমি। সেখানে দু-একটা গরু বাধাঁ আছে। জমিটির চারদিকে বেশ কিছু খেজুর গাছ এবং বন্য গাছ জায়গাটিকে বিলের সাথে মিশে যাওয়া থেকে এটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাতানের বিলের দিকটার এই উঁচু জায়গার একটা অংশে দুটো কুকুর চেঁচামেচি করছে। স্বভাবসুলভ ঘেউ ঘেউ বা সতর্কবার্তার ঘেউ ঘে্উ নয়। আঘাত পাল্টা আঘাতের শব্দ। এ শব্দ শুনে সহজেই বোঝা যায় একটা আরেকটার সাথে ঝগড়া করছে। আমি ঘাড় ফিরিয়ে কি ঘটছে তা দেখতে চাইলাম। কুকুর দুটোর নড়াচড়ায় একটা সাদা পালক উড়ে একটা কুকুরের পিঠের উপর দিয়ে অন্য পাশে গিয়ে পড়লো। পালকটা যেখানে পড়লো সেখানে সাদা কি যেন একটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। আমি উঠে দাড়ালাম এবং কিছুটা অগ্রসর হলাম। কুকুরদুটো ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। আমার তাদের কাছাকাছি যাওয়াটা তাদের চোখে পড়েনি অথবা তারা এতটাই যুদ্দংদেহী অবস্থায় আছে যে আমার উপস্থিতিকে গুরুত্ত্ব দেয়নি। দুটো কুকুর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লড়াই করছে। কুকুর দুটোর পায়ের কাছে বড়সড়, রোগা,শরীরের বিভিন্ন অংশে ছাল উঠা জ্যান্ত অথবা অর্ধমৃত একটা সারস পাখি। সারসটির একটি পা কুকড়ানো,উপরের শক্ত চামড়া উঠা এবং রক্তাক্ত। এই কুকুরদুটোর কোন একটি অথবা অন্য কোন প্রাণী কামড়ে পা ভেঙে দিয়েছে। একটা কুকুর যখন সারসের পা অথবা ঘাড় ধরে সামনে নিয়ে যেতে চায় তখন অন্যটা তার লেজ কামড়ে ধরে পিছনে টান দেয়। টান খেয়ে সে কুকুরটি সারসটিকে ছেড়ে কুকুরটিকে পাল্টা কামড় দেয়। কামড় থেকে বাঁচতে দ্রুত শরীরটাকে সরিয়ে নেয় অপর কুকুরটি।সরে যাওয়ার সময় পায় দিয়ে সারসটিকে মাড়িয়ে যায়। পায়ের আঘাতে সারসের বুকের ছাল ছিড়ে যায়, শ্বাসনালীতে পা পড়ে শ্বাসরোধ হয়। পাখিটা গলাটা সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা।দুটো শক্তিশালী ক্ষুদার্ত,লোভী কুকুরের কাছে সে নিত্যান্তই নগন্য। তার গাঁয়ে এত শক্তিও নেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুরে কোথাও চলে যাবে !! কুকুরদুটি নিজেরা কামড়া কামড়িতে ব্যাস্ত হতে গিয়ে সারসটিকে ক্ষণিকের জন্য ছেড়ে দেয়। সারস হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কুকুরদুটোর দিকে তাঁকায়। গলা বাড়িয়ে,ঠোঁটদুটো প্রসারিত করে অসহায় গলায় ফ্যাসফ্যাসে আর্তচিৎকার করে। ঠোট দুটো চুপসানোর আগেই আবার একটি কুকুর চলে আসে। গলা কামড়ে ধরে।এভাবেই চলছে।কতক্ষন ধরে চলছে তা সারস জানে আমি জানিনা। তবে কতক্ষন চলবে সারস জানেনা,আমিও না। হয়তো তার মৃত্যু অবধি অথবা মৃত্যুর পরেও!! তবে মৃত্যুই যে তার শেষপরিণতি এতে কোন সন্দেহ নেই! মাঝখানে শুধু আতঙ্কগ্রস্ত,ব্যাথাতুর কিছুটা সময়!! আর জীবনের শেষ সময়ে অসহায় চেয়ে চেয়ে দেখা তাকে নিয়ে নিষ্ঠুর দুটো পশুর লেজ কামড়া-কামড়ি.............।



পশ্চিম আকাশে সুর্যটা লাল হয়ে ঝোপঝাড়গুলোর আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে! আকাশের ঘনকালো মেঘের সাথে সন্ধার অন্ধকার এক হয়ে যাচ্ছে। এই সময় আমার সেল ফোনটা শব্দ করে উঠলো..!! বন্ধু নয়নের ফোন...

-হ্যালো!তুই কই?

-আমি তো বাড়ী্র আশেপাশেই!তুই কই?

-আমি তোদের ভূইয়াবাড়ীর বাজারে, চলে আয়........!

আমি বাড়ীর পথ ধরে হাঁটছি আর ভাবছি-

অসহায়দের নিয়ে লেজ কামড়া-কামড়ি সকল শোষক শ্রেণীতে একই রকম। হোক সে ককুর অথবা মানুষ অথবা অন্য কোন প্রাণী!!





মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.