নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আপন মনে, আপন সুরে

I do not agree with what you have to say, but I'll defend to the death your right to say it.

শূন্যবতী

না প্রেমিক না বিপ্লবী

শূন্যবতী › বিস্তারিত পোস্টঃ

সিরিয়ায় পোস্টপেইড নোবেলজয়ীর প্রিপেইড যুদ্ধ!

৩০ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:১১

বারাক ওবামার নোবেল পুরস্কার ছিল ইতিহাসের প্রথম পোস্টপেইড নোবেল পুরস্কার। তিনি কী করেছেন তার জন্য নয়, ভবিষ্যতে কী করবেন, তার জন্যই তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। নোবেল কমিটির বিনিয়োগ বৃথা যায়নি। ইরাক ও আফগানিস্তানে বুশের শুরু করা যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে এবং সোমালিয়া ও পাকিস্তানে ড্রোন হামলায় নিরীহ মানুষ হত্যা করে নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক দেনা শোধ করেছেন। বাকি অর্ধেক শোধের জন্য সিরিয়ায় হামলার আয়োজন চলছে। ইরানকে ঘায়েলের অংশহিসেবে এটা তাঁকে করতেই হবে। যুগে যুগে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশই যুদ্ধবাজ ছিলেন, ওবামারও এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকাই প্রমাণ করে, যুদ্ধবাজেরাই এর প্রধান গ্রাহক। একজন মার্টিন লুথার কিং বা একজন ম্যান্ডেলা বা ইয়াসির আরাফাতরা ব্যতিক্রম। এশিয়ার ঘাতক হেনরি কিসিঞ্জার থেকে শুরু করে ইসরায়েলি যুদ্ধবাজ মেনেশেম বেগিন, আইজ্যাক রবিন, শিমন পেরেজ অথবা সব কটি মার্কিন যুদ্ধের সহযোগী ইউরোপীয় ইউনিয়নের নোবেল পাওয়ার পর এই পুরস্কারের আসল চরিত্র নিয়ে বড়াই করার কিছু থাকতে পারে না।

অনেকে বলেন, দুনিয়াকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশলে বশে রাখায় আমেরিকার প্রধান হাতিয়ার ইসরায়েল বা যুক্তরাজ্য নয়, ঘোষিত শত্রু আল-কায়েদাই পেন্টাগনের মানিকজোড়। যাঁরা অন্য কথা বলতেন তাঁরা এবার জব্দ হবেন। যুক্তরাষ্ট্র যদি সিরিয়ায় সরাসরি আক্রমণ করে, তবে এবারেই প্রকাশ্যে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ আল-কায়েদা ও মার্কিন বাহিনী থাকবে এক পক্ষে, অন্য পক্ষে থাকবে ‘সন্ত্রাসী’ সিরিয়া, হিজবুল্লাহ ও ইরান। এবংঅবশ্যই পশ্চিমা মিডিয়ার প্রচারণাও থাকছে বিশেষ ভূমিকায়।

হ্যাঁ, ইরাকের মতো সিরিয়ায় হামলার জন্যও দারুণ এক অজুহাত সাজানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী দামেস্কের কাছে রাসায়নিক হামলায় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। মানুষ নিহত হয়েছে সত্য, কিন্তু কারা তাদের হত্যা করেছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। সাদ্দামের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মতো সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রও রূপকথা মাত্র। বাশার আল-আসাদ যুক্তি দিয়েছেন, জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকদের দামেস্কে ডেকে এনে তাঁদের হোটেলের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে রাসায়নিক অস্ত্রে মানুষ হত্যা করে নিজের ক্ষতি আমি কেন করব? কথা সত্য, আল-আসাদ খারাপ শাসক হতে পারেন, বোকার হদ্দ নন। রবার্ট ফিস্ক জানিয়েছেন, সিরিয়ার পক্ষে লড়াই করা তিন হিজবুল্লাহ যোদ্ধাও রাসায়নিক অস্ত্রের শিকার হন। সিরিয়ায় অবস্থানকারীজাতিসংঘের পরিদর্শক কার্লা ডেল পন্টেও জানিয়েছেন, শক্ত ও জোরদার সন্দেহ যে, বিদ্রোহীরাই এ কাজ করেছে। যখন পশ্চিমা-সমর্থিত বিদ্রোহীরা পরাজয়ের মুখে, তখন সরাসরি মার্কিন হামলার অজুহাত তৈরির জন্য ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আলেকজান্দর লুকাশেভিচও প্রশ্ন তুলেছেন: ঘটনা ঘটবার কয়েক ঘণ্টা আগেই কী করে রাসায়নিক হামলার অভিযোগ ও তথ্যপ্রমাণাদি ইন্টারনেটে ছড়িয়েযায়? ঘটনাপরম্পরা খেয়াল করলেও ফাঁকিটা ধরা পড়ে। বারাক ওবামা হুমকি দিলেন, আসাদ সরকার ‘লাল দাগ’ ডিঙালে আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে। তারপর পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন লাল দাগ অতিক্রমের অভিযোগ উঠল। যুদ্ধের দামামাও বাজল। অথচ অভিযোগের পক্ষের প্রমাণটাই কেউ দিচ্ছে না।

সিরিয়ার বিরুদ্ধে এর আগে বিমান হামলা করে বেসামরিক নাগরিক হত্যার অভিযোগও অপ্রমাণিত থেকেছে। প্রমাণ না থাকলেও তো ইউটিউব আছে, সিএনএন, বিবিসি, আল-জাজিরা ও ফক্স নিউজ আছে। সেখানে ভূরি ভূরি ভিডিও, সাক্ষাৎকার ছবি ছড়িয়ে জনমত তৈরি করা হচ্ছে। আগেকার দিনে বিউগল-দামামা বাজিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করা হতো, এখন করা হয় বৈশ্বিক মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্যবোমা ফাটিয়ে। আগেকার দিনে স্বদেশের পার্লামেন্ট বা কংগ্রেস এবং বিদেশে জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়া যুদ্ধ ঘোষণা বেআইনি ছিল। এখন সেই অনুমোদন দেয় বৃহৎ মিডিয়া আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নামের খয়ের খাঁ গোষ্ঠী।

ক্ষমতাসীন হয়েই ওবামা ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের’ কথা বলেছিলেন। আসলে তিনি কথাটা নিয়েছিলেন ১৯৮২ সালে প্রণীত এক ইসরায়েলি নীলনকশা থেকে। ওই পরিকল্পনার মূল কথা ছিল, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাকে ভেঙেচুরে নতুন চেহারা দেওয়া। ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ওদেদ ইননের নামে এর নাম হয় ‘ইনন প্ল্যান’। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, সুদান, ইয়েমেন ও লিবিয়াকে সাম্প্রদায়িক ভাগে বিভক্ত করে বেশ কিছু তাঁবেদার রাষ্ট্র বানানোর কথা লিখেছিলেন জায়নিস্ট ইনন। ইসরায়েল ও আমেরিকার ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করতে হলে আরব অঞ্চলকে অস্থিতিশীল রাখা ছাড়া তাদেরও উপায় নেই। আরব জাগরণে পৃষ্ঠপোষকতা করে, সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সংঘাত উসকে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে সেই লক্ষ্যই তারা হাসিল করছে। সমগ্র মুসলিম দুনিয়াকে কৌশলে ইসলামি বনাম সেক্যুলার চত্বরে বিভক্ত করে জাতীয় সংহতি ধ্বংস করা গেছে। এই কাজে সহযোগীহয়েছে গণবিরোধীইসলামপন্থী দল এবং পরজীবী প্রগতিবাদীরা। জাতীয় সেনাবাহিনীগুলোকে দেখা যায় মীরজাফরের ভূমিকায়। স্বদেশ দখল ও স্বদেশি হত্যাই তাদের একমাত্র বীরত্ব।

কিন্তু পশ্চিমা স্ববিরোধিতা ফাঁস হয়ে যায় তখনই, যখন তারা মিসরে ইসলাপন্থীদের দমনে মদদ দেয়,আবার সিরিয়ায় পাঠায় ভাড়াটে জঙ্গি। সামাজিক-রাজনৈতিক ফাটল সৃষ্টির মাধ্যমে ইতিমধ্যে সুদান বিভক্ত হয়েছে। ইয়েমেন, ইরাক, লিবিয়া, লেবানন ও মিসর ভাঙন ও বিপর্যয়ের মুখে। তিউনিসিয়া থেকে বাহরাইন পর্যন্ত চলছে গভীর রাজনৈতিক অস্থিরতা। মধ্যপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুডকে হটিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। মুসলিমদের হাতে মুসলিমরা নিহত হচ্ছে। আরব জাহানের অমুসলিম জনগোষ্ঠীও বিপন্ন। রাজধানীগুলোতে গুপ্ত শক্তিগুলো নিয়মিত বোমা ফাটাচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হলেই সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে সহজ হয় সামরিক ও অর্থনৈতিক দাপট নিয়ে ঢুকে পড়া। শত শত বছর ধরে তারা চালিয়ে যাচ্ছে সাপ হয়েদংশন করে ওঝা হয়েঝাড়ার কারবার। এই সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষকেই মানবতাবাদী মুখোশ পরিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে করপোরেট মিডিয়া আর পক্ষপুটে রাখা বুদ্ধিজীবী-বিশ্লেষক-সাংবাদিক এজেন্টদের মাধ্যমে। তরুণদের একাংশের শর্টকাট বিপ্লবের বাসনাও আত্মঘাতী ফল বয়েআনছে।

আমেরিকার এই অনন্তযুদ্ধের হাত থেকে মার্কিন জনগণও রেহাই পাচ্ছেন না। স্বাধীনতার লীলাভূমি বলে বিজ্ঞাপিত মার্কিন দেশের প্রতিটি নাগরিকই গোয়েন্দা নজরদারির অধীন। সেখানকার অভিবাসী, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার দিন দিন কমছে—যদিও প্রেসিডেন্টের পদে বসে আছেন কালো বর্ণের এক শ্বেতাঙ্গসেবী। রয়টার্সের এক জরিপবলছে, ৬০ শতাংশমার্কিন সিরিয়ায়আক্রমণের বিপক্ষে, আগ্রাসন চায় মাত্র ৯ শতাংশ। আরেকটা ইরাকি ট্র্যাজেডি ঘটানোর দায় নেওয়া ওবামার জন্যও বিপদের হবে। আবার হুমকি দিয়েহামলা না করলে পরাশক্তির আসন টলেযাবে। শ্বেতাঙ্গসেবী কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট আসলেই উভয়সংকটে!

বিশ্ব মিডিয়া খুবই চতুরভাবে গোপন রেখেছে যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্বদেশেও যুদ্ধের মধ্যেআছে। ৯-১১-এর হামলার তিন দিন পর জর্জ বুশ জরুরি অবস্থা জারি করে মার্কিন সংবিধানের অনেকগুলো মৌলিক অধিকার স্থগিত করেন। ক্ষমতাসীন হয়ে বারাক ওবামা ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে সেই জরুরি শাসনের মেয়াদ বাড়িয়ে চলেছেন। যে দেশ স্বভূমিতে গণতন্ত্রকে জিম্মি করেছে, অর্থনীতিকে তুলে দিয়েছে কতিপয় কোম্পানির কাছে, যারা দেশে দেশে রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে, যে দেশ মিসরে হাজারেরও বেশি গণতন্ত্র-সমর্থকের হত্যাকারী সামরিক শাসনের পৃষ্ঠপোষকতা করে, যে দেশ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের রাসায়নিক গণহত্যা ও ভূমি দখলের সক্রিয় সমর্থক, সেই যুক্তরাষ্ট্র যখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে যুদ্ধ করে, তখন বুঝতে হয় পৃথিবীতে এক মুখোশ পরা হিটলারের আবির্ভাব হয়েছে।

মিসর বা সিরিয়া কার শাসনে থাকবে, সেটা ওই সব দেশের জনগণের ব্যাপার। বিদেশিরা যা পারে তা হলো স্বৈরাচারীদের আন্তর্জাতিকভাবে বয়কট করা। অসভ্যকে সভ্য করা, নিরীহকে উদ্ধার করা, পশ্চাৎপদকে প্রগতির পথে ঠেলার নামেই তো দাসপ্রথা, উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদী শাসন ও দেশ দখল জায়েজ করা হয়েছিল। আরবের মুক্তির প্রধান বাধা ইরান বা সিরিয়া নয়, সৌদি আরব ও ইসরায়েল। যত দিন এদের দাপট থাকবে, তত দিন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে না।

যুক্তরাষ্ট্র যদি সিরিয়াকে আক্রমণ করেও, ব্যাপারটা ইরাকের মতো অত সহজ হবে না। এর আগে দুবার সিরীয় সেনাদের হাতে মার্কিন বিমান ভূপাতিত হয়েছিল। সিরিয়ার সঙ্গে রয়েছে হেভিওয়েট পরাশক্তি রাশিয়া, রয়েছে জাতীয়তাবাদী ইরান এবং অসম যুদ্ধে দক্ষ হিজবুল্লাহ। মাঠে রয়েছে মার্কিনবিরোধী আরব জনমত।

এই রক্তগঙ্গা পাড়ি দিয়ে কোন কূলে ভিড়বে দুনিয়া, তা বলার উপায় নেই; কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান চেহারা-চরিত্র বদলাবে। আরবজুড়ে যে দাবানল লেগেছে, তাতে মানুষ পুড়বে, সমাজ পুড়বে ঠিকই, কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন রাজা-বাদশাহ-খলিফাদের তখেত-তাউসও জ্বলবে। আমেরিকার অবস্থাও আর আগের মতো থাকবে না। হয়তো এটাই শেষের শুরু।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.