![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শুভ মাহমুদ
প্রশ্ন : দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
আকবর আলি খান : দেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক সংকট চলছে এটা নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে দেশের দুটি বিবাদমান দল সংঘাতের রাজনীতি সৃষ্টি করে চলেছে। অতীতের ধারাবাহিকতায় এই সংকট এসেছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত দুটি প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই তীব্রতা আরও বাড়তে থাকবে। বর্তমান যে সংকট সেটা মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। যারা বাংলাদেশের রাজনীতি গত এক দশক ধরে বিশ্লেষণ করছেন তাদের কাছে এ ধরনের সংকট অবশ্যই অপ্রত্যাশিত নয়।
প্রশ্ন : নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই প্রধান জোটের যে বিপরীতমুখী অবস্থান তা দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে? আপনি কি মনে করেন? এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কি?
আকবর আলি খান : সংঘাত তো চলছেই, সমস্যাটা তো শুধু সেখানে নয়Ñ যদি সমঝোতা ছাড়া একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে দেশেও তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না এবং বিদেশেও এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবেÑ কাজেই দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংহত করার জন্য এমন একটি নির্বাচন প্রয়োজন যে নির্বাচন প্রধান দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এখন পর্যন্ত এমন কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন : সরকার তার মেয়াদের শেষবছর অতিক্রম করছে। গত চার বছরে বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় মহাজোট সরকার বৃহত্তর জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেÑ এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
আকবর আলি খান : আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে গণতান্ত্রিক সরকার যত জনপ্রিয়তা নিয়েই আসুকÑ শেষের দিকে তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। এটা শুধু এই সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, অতীতের সরকারগুলোর ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে। আমার মনে হয় সরকারগুলোর সুশাসনের ওপর গুরুত্ব না দেবার ফলে এটি ঘটে থাকে।
প্রশ্ন : মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার ব্যর্থতা। বিষয় দুটিকে আরও একটু খুলে বলিÑ একদিকে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ১২ শতাংশ এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১০.১৬ শতাংশ। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
আকবর আলি খান : এই হিসেবটি বোধহয় গত বছরের কিন্তু গত চার বছরের গড় হিসাবে যদি আমরা দেখি তবে দেখব মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের কতিপয় লোক উপকৃত হয়েছে; ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আপামর সাধারণ মানুষ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এটি সুশাসনের অভাবকেই স্পষ্ট করে। এর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিকর দিক হচ্ছেÑ সরকার যে প্রবৃদ্ধির আশা করছে সেই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ আসবে নাÑ তাই সার্বিক অর্থে ক্ষতির সম্মুখীন হবে অর্থনীতি। ব্যাহত হবে উন্নয়ন।
প্রশ্ন : পদ্মা সেতু থেকে বিশ্ব ব্যাংকসহ সব দাতা সংস্থা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে- পদ্মাসেতু নিয়ে সরকার নানা নাটকীয়তার প্রদর্শন করেছে। সার্বিকভাবে বিষয়টি কি দাঁড়াচ্ছে?
আকবর আলি খান : সরকারেরও ইচ্ছে ছিল পদ্মাসেতু বিশ্বব্যাংক এবং বিদেশী ব্যবস্থাপনায় তৈরির যে কারণে দুর্নীতির প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সেগুলোর আলোকে দুইবার নানা পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পদ্মাসেতুর মত একটি বড় প্রকল্প যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে বাস্তবায়ন না করা যায় তবে দফায় দফায় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাবে। দেশীয় তত্ত্বাবধানে আমাদের বাস্তবায়নকৃত বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রায়ই এটা ঘটতে দেখা যায়। পদ্মাসেতু দেশীয় ব্যবস্থাপনায় বাস্তবায়ন করতে গেলে সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবেÑ এর সঙ্গে আমাদের অর্থনীতিকে একটি ধকলের মুখে পড়তে হবে। আবেগ এবং বাস্তবতা এক নয়Ñ এক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরিখে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রশ্ন : কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ভেতর দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব হয়েছেÑ সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টার এই দাবির গ্রহণযোগ্যতা কতখানি? প্রকৃত বাস্তবতাই বা কি এ বিষয়ে?
আকবর আলি খান : কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন একটা স্বল্পকালীন ব্যবস্থা। এটি দীর্ঘ মেয়াদের জন্য নয়, মাত্র তিন বছরের জন্য নেয়া হয়। কুইক রেন্টাল থেকে অনেক উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় করতে হচ্ছেÑ ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ছে। কুইক রেন্টালের ফলে দীর্ঘ মেয়াদী বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর ওপর থেকে সরকারের প্রয়োজনীয় মনোযোগ বিচ্যুত হচ্ছেÑ ফলে কুইক রেন্টাল থেকে কতিপয় মানুষ লাভবান হলেও দীর্ঘ মেয়াদে দেশের বেশির ভাগ মানুষ এবং অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব এই কুইক রেন্টালের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রশ্ন : আপনি নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখা দিয়েছেন। সেটি নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা হয়েছে; সেসবের প্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে আপনার সর্বশেষ চিন্তা-ভাবনা কি?
আকবর আলি খান : দেশের সংঘাতের রাজনীতি থেকে মুক্তি পেতে এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলুন বা তত্ত্বাবধাযক সরকার বলুন তার বিকল্প নেই। দেশের বড় দল দু’টির মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত পরমত সহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক আচার আচরণ ও সুশাসনের প্রতি অঙ্গীকার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হবেÑ এগুলোর চর্চা না হবে ততক্ষণ নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন উপলব্ধ হবে।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পদ থেকে আপনারা কয়েকজন পদত্যাগ করেছিলেন; যে জন্য আপনার ভাগ্যে খেতাব জুটেছে ‘ব্যর্থ লোক’ বলে। এ প্রসঙ্গে আপনার উপলব্ধি কি?
আকবর আলি খান : কেউ যদি সংবিধান রক্ষার শপথ গ্রহণ করে কোন সরকারী দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং কার্যক্ষেত্রে গিয়ে যদি দেখেন তিনি সেই শপথের মর্যাদা রক্ষা করতে পারছেন না তবে সংবিধানই তাকে সে পদ থেকে সরে দাঁড়াবার পথ রেখেছে। সংবিধান প্রদত্ত এই নৈতিকতা থেকেই আমরা কয়েকজন পদত্যাগ করেছিলাম। এটা আমাদের ব্যর্থতা ছিল নাÑ ব্যর্থতা ছিল সেই সরকারের। দেশ কেবল কয়েকজন মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা চালান নাÑ চালান সরকার প্রধান। ইয়াজউদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সার্বিক ব্যর্থতার কারণেই ওয়ান ইলেভেনের আরেকটি সরকার গঠনের প্রয়োজন হয়েছিল।
আমাদের দেশে সাধারণত কেউ একবার ক্ষমতার মসনদে বসলে সে মসনদ ছাড়তে চান না। তাই আমাদের পদত্যাগের পেছনে যে নৈতিক অবস্থানের বিষয়টি ছিল সেটা তারা বুঝতে পারেন না। আমরা পদ আঁকড়ে থাকিনি। দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে।
প্রশ্ন : দেশের শেয়ার বাজার লুণ্ঠন, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম নিয়ে আপনার সার্বিক পর্যবেক্ষণ ও মতামত জানান।
আকবর আলি খান : শেয়ার বাজারের ঘটনায় দেশের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ আর্থিকভাবে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এই কারচুপির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকার কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি এমনকি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টটির অলোকেও কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এটি একটি খারাপ উদাহরণ। আবার ডেসটিনি এবং হলমার্কের বিরুদ্ধেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ব্যাংকিংখাতে হলমার্কের যে ঘটনা তা ব্যাংকিং খাতের জন্য একটা অশনি সংকেত রূপে বিরাজ করছে। শোনা যাচ্ছে এই ধরনের আরও কেলেংকারি রয়েছে যা প্রকাশ পাচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনা দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করবে।
প্রশ্ন : আপনি দীর্ঘদিন আমলা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতিকদের দ্বারা প্রশাসন দলীয়করণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল কি হয়েছে প্রশাসনে?
আকবর আলি খান : রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট আমলা দিয়ে দেশ চালাতে গিয়ে ধারাবহিকভাবে দেশের ক্ষতি করে চলেছেন। দেশের মানুষের আস্থা হারিয়েছে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা দলীয়করণকে প্রাধান্য দেওয়ায়। মেধাবী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজনৈতিক রোষের শিকার হয়ে দেশকে যা দিতে পারতেন তা দিতে পারছেন না। রাজনীতিকদের এই দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে দেশের স্বার্থে।
প্রশ্ন : শাহবাগের প্রজš§ চত্বরে তরুণদের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির আন্দোলন সম্পর্কে বলুন-Ñ
আকবর আলি খান : শাহবাগের প্রজš§ চত্বরের সমবেত তরুণেরা জাতির ৪১ বছরের সুপ্ত আকাঙ্খাটিরই ধ্বনি রূপ দিয়েছেন মাত্র।
প্রশ্ন : এবারের মেলায় আপনার বই ‘জবর আজব অর্থনীতি’ বেরিয়েছেÑ এতে কি আপনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনের সার্বিক নৈরাজ্যকে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন?
আকবর আলি খান : বইটিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ থাকলেও আমি আসলে এতে অর্থনীতির তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর বৈচিত্র্য তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। যাতে পাঠক অর্থনীতি বিষয়টাকে তার পাঠে দুরূহ গণ্য করে দূরে সরিয়ে না রাখেন।
প্রশ্ন : বিদেশী বিভিন্ন কাগজ আমাদের অর্থনৈতিক পূর্বভাসের বরাত দিতে জানাচ্ছে, আগামী পঞ্চশ বছরে বাংলাদশে এগিয়ে যাবে শক্তিশালী অর্থনীতির দিকে। আপনার অভিমত কি?
আকবর আলি খান : রাজনৈতিক সংঘাত, অস্থিরতা, সুশাসনের অভাবÑ এ সমস্ত কিছুকে পেছনে ফেলে এদেশের মানুষ তার সৃজনশীল শ্রমশক্তির ওপর ভরসা করে এগিয়ে গেছে। এক সময় যে দেশটিকে বিদেশীরা ‘তলা বিহীন ঝুড়ি’ বলেছে, তারা আজ যে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের কথা বলছে তা সত্য। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সেটি বাস্তব কারণ এদেশের মানুষ সংগ্রামী। শত প্রতিকূলতাকে জয় করে তারা এগিয়ে যাবার পথ করে নেয় নিজস্ব সৃজনশীলতায়।
প্রশ্ন : লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এদেশের স্বৈরশাসকরা বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষ নেয় এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিতরা বিকেন্দ্রীকরণের পথ আটকে থাকেÑ কেন?
আকবর আলি খান : সামরিক স্বৈরশাসকরা বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যদিয়ে গণভিত্তি পেতে চায়। অতীতে আইয়ুব আমল থেকে এরশাদ আমল পর্যন্ত এই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। অপর দিকে রাজনৈতিক সরকারগুলো ভাবে তাদের জনসম্পৃক্তি যথেষ্টই আছে ফলে বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন বোধ করে না।
আমাদের দেশে বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন সুশাসনের প্রয়োজনে। কেন্দ্রীভূত সরকারের কানে তৃণমূলের নির্যাতিত সিংহভাগ মানুষের বক্তব্য পৌঁছানো দুরূহ। কিন্তু স্থানীয়ভাবে তার প্রতিকার করা গেলে সুশাসন ও জন অধিকার সুরক্ষিত হয়। সুশাসন এবং উন্নয়নের জন্য আমাদেরকে বিকেন্দ্রীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে।
©somewhere in net ltd.