নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সন্ধ্যা প্রদীপ

আমার সমস্ত চেতনা যদি শব্দে তুলে ধরতে পারতাম

সন্ধ্যা প্রদীপ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ চায়ের হাঁড়ি

১১ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:১৮

এই বাড়ির ছোট্ট স্টোররুমটি জিনিসপত্রে একদম বোঝাই।একপাশের দেয়ালের তাক জুড়ে রাজ্যের হাড়িকুড়ি বাসনপত্র,অন্যপাশের তাকে খোকাদের পুরোনো বইপত্র আর যন্ত্রপাতি।ঘরের অনেকটা জুড়ে রাখা চৌকিতে অনেকটা করে পেঁয়াজ রসুন আর আলু থরে থরে সাজানো।চৌকির নিচে বাতিল কাপড়ের বস্তা আর বাক্স-প্যাটরা ছাড়াও আরো কি কি যে আছে তা হয়ত বাড়ির গৃহিনীও বলতে পারবেন না।তবে সেখানে মহানন্দে ঘর বেঁধেছে এক ইঁদুর দম্পতি আর তাদের প্রতিবেশি হিসাবে অসংখ্য তেলাপোকার বসবাসকে তারা খারাপ চোখে দেখে বলে মনে হয় না।চৌকির আর এক পাশের দেয়ালের মাঝের জায়গাটুকুতে চাল,ডাল আর আটার ড্রাম ঠেশে রাখার পরে যে জায়গাটুকু বাকি ছিল সেখানে রাখা হয়েছে একটা বড় কাগজের প্যাকিং বাক্স।এই বাক্স বোঝাই রাজ্যের সব বাতিল মালামাল,ঘিয়ের কৌটা,তেল-শ্যাম্পুর বোতল,জুতা-স্যান্ডেল,সয়াবিন তেলের খালি বোতল,ভাঙ্গা গ্লাস-বাটি ইত্যাদি।এসবের সাথেই এই প্যাকিং বক্সে এখন আমার বর্তমান আবাস কারন আমি নিতান্তই এক বাতিল চায়ের হাঁড়ি।বহুদিনের ব্যবহারে আমার শরীর তোবড়ানো,কালি মাখা।শুধু তাই নয় কিছুদিন হলো আমার শরীরে একটা ফুটোও হয়েছে।একসময় আমি ছিলাম এই পরিবারের নিত্যসঙ্গী আর এখন আমি এই অন্ধকার স্টোররুমে ভ্যাপসা গন্ধের মাঝে ইঁদুর,তেলাপোকা আর টিকটিকির ঘর সংসার দেখে দিন পার করি।

আমার বয়স কত হবে?হুম---তা পঁয়ত্রিশ বছরের বেশি তো হবেই।এতগুলো বছর ধরে কত বিচিত্র জিনিসই না দেখলাম।ফ্যাক্টরির চুল্লীতে একতাল গলিত এলুমিনিয়াম থেকে যখন আমাকে আলাদা করা হলো তখন প্রথম আমি আমার অস্তিত্ব অনুভব করি।সে এক অদ্ভুত অনুভুতি!আদি নেই অন্ত নেই শুধু আমি আছি কিন্ত তাও যেন পুরোপুরি নেই,শুধু একটুখানি আছি।তারপর যখন আমাকে আকৃতি দিয়ে শীতল করা হলো তখন আমি প্রথম চোখ খুলে তাকালাম,নিজের অস্তিত্বকে পুরোপুরি অনুভব করলাম।পালিশ করা গোলগাল শরীর নিয়ে কয়েক হাত ঘুরে যখন আমাকে দোকানের ডিসপ্লেতে সাজানো হলো তখন নিজের ভেতরে বেশ ভয় অনুভব করছিলাম।কি জানি কেমন সংসারে না যেতে হয়,কেমন মনিব জোটে কপালে?কারন দোকানের বর্ষীয়ান মস্ত ডেগ এর কাছে শুনেছি লক্ষীমন্ত গিন্নি না হলে নাকি হাঁড়ি-বাসনের কপালে অনেক দুঃখ থাকে।

তাই যখন উজ্জ্বল কমলা রঙের শাড়িপরা গোলগাল বৌটি হাসি মুখে আমায় হাতে তুলে নিল তখন আমার মন খুশিতে নেচে উঠল।পাশে দাঁড়ানো তরুন কর্তাটি মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিতেই দোকানের লোকটি পুরোনো খবরের কাগজ দিয়ে বেশ করে জড়িয়ে বেঁধে আমাকে গৃহিনীর হাতে ধরিয়ে দিল।কেনাকাটা শেষে ঘরে ফিরে কর্তা যখন আবদার করে বলল,গিন্নি দেখি চা বানাও তো এক কাপ।খেয়ে দেখি কেমন চা বানাতে পারো!বৌটি তখন বাঁধন খুলে সুবাস ময় সাবানের ফেনা দিয়ে আমায় বেশ করে মেজে দু কাপ পানি দিয়ে চুলায় চড়িয়ে দিল।নিচে গরম আগুন আর ভেতরে ঠান্ডা পানি,কি যে অপূর্ব অনুভুতি হচ্ছিল আমার সদ্য মাজা চকচকে শরীরে!!পানি ফুটে উঠতে বৌটি সদ্য প্যাকেট খোলা এক চামচ চা পাতা দিয়ে দিল পানিতে।কিছুক্ষনের মাঝেই চায়ের সুবাসে একরুমের ছোট্ট বাসাটি মোহিত হয়ে গেল আর আমার শরীর অদ্ভুত এক আনন্দে ঝিমঝিম করতে লাগল।সেই সন্ধ্যায় আলুর চপ আর ডাল পুরীর সাথে সুবাসিত চা খেয়ে কর্তার মুখে যখন প্রশংসার বন্যা বয়ে চলছিল তখন মিটিমিটি হাস্যরত বৌটির মনে যে সুখ আর গর্ব ছিল সে গর্বের ভাগীদার সেদিন আমিও ছিলাম।

সেইদিন থেকেই এই দুজনের পরিবারের আমি অবিচ্ছেদ্য সদস্য।একটি ভাতের হাড়ি,একট কড়াই,দুটি থালা,দুটি বাটি,ছয়টি চা চামচ,দুটি কাপ,একটি খুন্তি আর একটি বড় চামচ,আমি ছাড়া মাত্র একয়টি বাসনপত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল এই সংসার।এদের সবার মধ্যে আমার ব্যস্ততাই ছিল সব চেয়ে বেশি।বাড়ির কর্তা খুব চা পছন্দ করেন তাই দিনে পাঁচছয়বার আমাকে চুলায় চাপতেই হতো।বৌটিও খুব যত্নের সাথে কাজটি করতেন।ছোট চাকুরী,অল্প আয়,ছোট্ট সংসার কিন্ত এই দুজনের মনে সুখের কোনো কমতি ছিলনা।দুজন দিব্বি হংসমিথুনের মত প্রেমে হাবুডুবু খেত।কর্তা মাঝ রাতে উঠে বৌকে মৃদু ঠেলা দিয়ে বলত,ওগো!খুব চা খেতে ইচ্ছা করছে।গৃহিনী কিন্ত একটু বিরক্ত না হয়ে ঠিকই উঠে আসত,অগত্যা আমাকেও জাগতে হতো।আহা! কিসব দিন ছিল তখন!

দুবছর ঘুরতে না ঘুরতেই ঘরে খোকা এল।তখন চা বানানোর সাথে সাথে কতবার খোকার দুধের বোতল ফুটিয়েছি তার ঠিক নেই।যখন খোকা ছোট ছোট পায়ে ঘরময় দৌড়ে বেড়ায় আর আধো আধো করে রাজ্যের কথা বলে তখন খুকু এল।বাড়ন্ত সংসার তাই কর্তার চাকরি বদল হলো,শহর বদল হলো,বাড়ি বদল হলো।নতুন চাকরিতে বেতন ভাল,দুই রুমের বড় বাড়িতে খোকা খুকু খেলা করে মনের সুখে।দিন কাটতে লাগল পর পর আরো দুই খোকা এল।বাড়ি খোকা খুকুর কলরবে মুখরিত,চাঁদের হাট যেন একেই বলে।কিন্ত তখন কর্তার দম ফেলার সময় নেই,বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফিরে চা-নাস্তা খেয়েই আবার দৌড়।সংবাদ পত্রের অফিসে সন্ধ্যাকালীন চাকরিটা নেয়ার পরই এত ব্যস্ততা।অনেক রাতে ফিরে খাবার খেয়ে এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে না দিতেই ক্লান্তিতে ঘুমে ঢলে পড়েন তাই মাঝরাত করে আর কাওকে জাগতে হয়না।

তবে দিনে আমার বা গৃহিনীর কারো ব্যস্ততা কম নয়।সকাল থেকে গৃহিনী এই নাস্তা আর টিফিন দিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন,তারপর পাড়ার যত আণ্ডাবাচ্চা ছানা-পোনাকে পড়া শেখাচ্ছেন,দুপুরে খোকা খুকুদের খাওয়া,বিকেলে এলাকার মেয়ে-বৌদের সেলাই শেখানোর কাজ করছেন।উফ!!আর আমি দিনে কম করে আট দশবার চুলায় চাপি,বাড়ির লোক ছাড়াও খোকার মাস্টার,খুকুর গানের দিদি আরো যে কত লোকের জন্য চা বানাতে হয় তার ইয়াত্তা নেই।

নতুন চাকরিতে ভাল বেতন সত্তেও কর্তা গিন্নির এত ব্যস্ততা কেন জানা গেল একদিন।গৃহিনীর বাবা ব্যবসার শেয়ার বিক্রি করে মেয়ের জন্য একটুকরো জমি কিনে দিয়ে গেছেন মৃত্যুর আগে,সেখানে নিজেদের বাড়ি করতে গেলে যে অনেক টাকা লাগবে তাই সবার এত পরিশ্রম।পরিশ্রম সত্তেও কর্তা-গিন্নির মুখে হাসি।তা হবে নাই বা কেন ঘর ভর্তি ফুটফুটে সন্তান কলকল করছে,আগামীতে আরো সুখের হাতছানি।আহা! কি সুন্দর দিনগুলিই না ছিল!!

অবশেষে ছয়টি বছরের কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে বাড়ি উঠল তাও খরচে কুলায় না তাই গৃহিনীর গায়ের গহনা গেল।বিয়ের সেট আর বালা দিয়েও কিছু ঘাটতি থাকে তাই গলার সরু চেইন, লাল পাথরের লকেট আর কানে দুলদুল করে দোলা ছোট্ট ঝুমকো জোড়া।সেই সাথে হাতের সরু বালা যা আমাকে মাজার সময় আমার গায়ে লেগে টুনটুন শব্দ করত।গৃহিনী কর্তার হাতে হাসি মুখে গয়না তুলে দেয় কিন্ত কর্তার মুখ ভার,খোকাখুকুদের মুখ ভার।আহা!বড় কষ্ট হয়েছিল আমার সেদিন।

একটু পরে চায়ের জল চাপাতে এসে গৃহিনীর দু ফোটা চোখের জল চায়ের পানিতে মিশে গিয়েছিল।শুধু অঙ্গের গয়না তো নয় বাবার স্মৃতি,অনেক দিন আগে গত হওয়া মায়ের স্মৃতি।তখন হঠাত পেছন থেকে বড় খোকা মাকে জড়িয়ে ধরে আর বলে,তোমাকে আমি একদিন এর চেয়েও ভাল গয়না গড়িয়ে দেব।ছেলের কথা শুনে মা হাসে আর আমি সাক্ষী থাকি এই গোপন প্রতিজ্ঞার।কিছুক্ষন পর কর্তা ফিরে আসে।হাতে ছোট ঝাঁকা ভর্তি লাল,নীল,রঙ্গিন কাঁচের চুড়ি।গৃহিনীর হাত চুড়িতে ভরে ওঠে।খুকিও সরু হাতে ঢলঢলে চুড়ি পরে ঘরময় লাফিয়ে বেড়ায়।কর্তার চুলের এক পাশে রূপালী ছোঁয়া লেগেছে,গৃহিনীর উপরের কালো চুলের নিচেও খুজলে দু একটি পাকা চুলের অস্তিত্ব দেখা যাবে কিন্ত চুড়ি হাতে দিয়ে তার মুখে ফুটে উঠে প্রথম সংসারের সেই নববধূর সলাজ হাসি।সকলের মনের ভার নিমেষেই দূর হয়ে যায়।

অবশেষে এল নিজের বাড়ির সুখ।চারটি বেডরুমের বড়সড় বাড়ি।ছাদের খরচ কুলায়নি তাই টিনের চাল।সামনে প্রশস্ত বারান্দা আর পাশে ফুলে ছাওয়া কৃষ্ণচূড়া গাছ।বাড়তি আয়ের প্রয়োজন মিটেছে তাই কর্তা–গিন্নির ব্যস্ততা কম।এখন হাত পা ছড়িয়ে নিজের বাড়ির সুখ অনুভব করা।পানি,কারেন্ট এটা সেটা নিয়ে বাড়িওয়ালার খ্যাচখ্যাচানির ভয় নেই,বাচ্চারা যত ইচ্ছা দৌড়াক,চিল্লাক কারো অনুযোগ করার নেই।তাই বলে আমার ব্যস্ততা কমেনি।বড় খোকা সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে তারও বাবার মত চায়ের নেশা।বন্ধুরা আসলে তো কথাই নেই এমনকি রাত জেগে পড়ার সময়ও মা তার ঘরে গেলে বাবার মতই চায়ের আবদার তার করা চাইই।

সংসার বেড়েছে তাই সেই টুনাটুনির সংসারের হাঁড়ি কড়াই তুলে রেখে নতুন বাসন আনা হয়েছে কিন্ত আমি তখনও সে সংসারের নিত্যসঙ্গী।হবেই বা না কেন?দশ বারো কাপ চা আমি একাই বানাতে পারি তাছাড়া ঢালাই এলুমিনিয়ামের শক্তপোক্ত শরীর আমার।বাড়ির গৃহিনী নিজ হাতে ঘষে মেজে আমায় নতুনের মত চকচকে করে রাখেন তাই অন্যকিছুর বিকল্প আনলেও আমার কাজ আমিই করে যাচ্ছিলাম।সেই প্রথম দিন থেকে একদিনও আমার কাজ বাদ পরেনি এমনকি তখনও না যখন কর্তার বাবার মৃত্যুর জন্য সবাই দুসপ্তাহের জন্য গ্রামে চলে গেল।কর্তার অফিসের টাইপিস্ট ছোঁকড়াটার চা সিগারেটের খুব নেশা ছিল।রাতে বাসা পাহাড়া দেয়ার সাথে সাথে সে আমাকেও জ্বালিয়ে মেরেছে।

আমার কথায় একটু ভুল হয়ে গেল।হ্যাঁ,অল্প কিছুদিনের জন্য আমি ছুটিতে ছিলাম বটে।সেই যে যখন পাঁচ বছরের দুরন্ত ছোটখোকার লাশ কাছের এক পুকুরে ভেসে উঠল।এই হাসিখুশি পরিবারটির মাঝে যেন বজ্রপাত হয়ে গেল।একসময় সকলে একটু সামলে নিল কিন্ত গৃহিনীর কান্না আর শোক বাঁধ দিয়ে রোখা যায় না।তখন পাঁচটা দিন আমার ছুটি ছিল।কিন্ত এক সন্তানের শোকে অনাগত সন্তানটির জীবন তো নেয়া যায় না তাই খুকুমনি নিজ হাতে আমায় পরিষ্কার করে চা বানিয়ে বাবার হাতে দিল,পাউরুটি ভিজিয়ে মাকে খাওয়ালো সেই থেকে আমার ডিউটি আবার চালু হলো।

এতগুলো বছর এই পরিবারের সাথে থেকে আমি অনেক কিছু দেখেছি।ভাল দিন খারাপ দিন দেখেছি।প্রজন্মের আবর্তন দেখেছি।একজনকে হারানোর পরেই অন্যজনকে পাওয়া তাই ছোট্ট খোকা যেন সকলের কাছে দ্বিগুন আদরের।তার খরচ,সবার পড়াশোনার বাড়তি খরচ তাই মাসের শেষে টানাটানি পরে যায় কিন্ত সবাই কত সুখি ছিল।বড় খোকা ভাল ছাত্র কিন্ত কর্তার বজ্রকঠের কঠিন আদেশ তাই প্রাইভেট পড়িয়ে সংসারে কিছু যোগ করা সম্ভব হয়না।তিনি বাচ্চাদের কোনো কষ্ট করতে দেবেন না।গিন্নি সবাইকে লুকিয়ে চুপিচুপি বালিশ-কুশন কাভার,রুমাল,বাচ্চাদের জামায় এমব্রডারি করে খুকির কাছে দেন।খুকি কলেজে যাওয়ার পথে মোড়ের বুটিকের দোকানে দিয়ে যে টাকা মায়ের হাতে এনে দেয় তা রান্নাঘরের একটা কৌটার মধ্যে লুকানো থাকে।সে টাকা থেকে সপ্তাহে দুবার নাস্তায় সবার জন্য ডিম হয়।বাচ্চাদের জন্মদিনে পোলাউ আর পায়েস হয়।মা মেয়ের এই গোপন কর্মকাণ্ডের আমিই সাক্ষী।মাসের শেষে টানাটানির সময় চিনির খরচ বাঁচাতে কর্তা-গিন্নি চিনি ছাড়া চায়ের কাপে চুমুক দেন আর তৃপ্তির হাসি হাসেন।এখবর শুধু আমিই জানি।মাসের শেষে নাস্তায় নিজের ভাগের গুড়টুকু কর্তার পাতে তুলে দিয়ে কাজের অযুহাত দেখিয়ে পরে খাবেন বলে গিন্নি যখন সবার অলক্ষ্যে শুধু চায়ে রুটি ভিজিয়ে তৃপ্তি করে খান তখনও তার ভালবাসাটুকুর সাক্ষী ছিলাম আমি।আহ!কি চমতকার ছিল সেসব দিন!


মানুষ কত অল্পতেই না খুশি থাকতে পারে।এত হিসাব করে চলা তবুও কোনো অভিযোগ নেই। বিকেলে অফিস ফেরত কর্তার কাছে প্রায়ই বন্ধুরা আসে।চা আর মুড়ি মাখা বা চিড়া ভাজা এই আপ্যায়নেই সবাই কত খুশি।ঘরে কোনোদিন বেগুনী বা আলুর চপ হলে তো কথাই নেই কে বেশি খুশি বাচ্চারা না তাদের বাবা তাই বোঝা ভার হয়ে যায়।মেহমান আসলে গৃহিনী নিজ হাতে মাংস পোলাউ রেঁধে খাওয়ান।সবাই বলে তার হাতে স্রষ্টার আশির্বাদ আছে।

দিন যায় দিন আসে বড় খোকার চাকরি হয়।বাড়িতে আলো জ্বলে,সানাই বাজে ঘরে নতুন বউ আসে।বিয়ের পরদিন শশুরের চায়ের আবদার মেটাতে মেয়েটি রান্না ঘরে আসে।এতদিন ধরে খোকার সাথে পড়তে আসা লম্বা বেনীর কামিজ পড়া সোনাবরন মেয়েটিকে আজ হাত খোপা আর নতুন শাড়িতে কেমন যেন অচেনা লাগে।সে যখন পানি দিয়ে আমাকে চুলায় চাপায় তখন আমার হঠাত করে অনেক বছর আগের একটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ে যায়।কত দ্রুতই না মানুষের জীবন আবর্তিত হয়!

এরপরেও কত দিন কাটে,কালের সাক্ষী হয়ে থাকি আমি।খুকির বিয়ে হয়েছে।বড় খোকা পরিবার নিয়ে বিদেশে।এই সোনার দেশ সোনার ছেলেটির যোগ্য সন্মান দিতে পারলো কই? তাই তাকে বাধ্য হয়ে পাড়ি জমাতে হয় আমেরিকা যেখানে যোগ্য লোকের সন্মান করতে মানুষ জানে।বাবা মাকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা করে সে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।এখন এবাড়িতে অভাব নেই।মেজ খোকা মস্ত বড় চাকুরে।বাড়ির টিনের চালের বদলে ছাঁদ হয়েছে ।দোতলায় নতুন ঘর উঠেছে।বাড়িতে দুজন কাজের লোক।বাড়ি ঝকঝক চকচক করে।মেজ খোকার ছেলে মেয়েদের পদচারনায় বাড়ি আগের মতই গমগম করে।

মেজ বৌ উঁচু ঘরের উচ্চশিক্ষিত মেয়ে।নোংরা ময়লা পুরাতন জিনিস তার সহ্য হয় না।সে যখন চায়ের জন্য ঝকঝকে নতুন সসপ্যান কিনল তখনও গৃহিনী নিজে চা বানালে আমাকেই ব্যাবহার করতেন তাই আমি একেবারে বেকার হয়ে যাইনি তখনো।হবেই বা না কেন আমি তার প্রথম সংসারের সঙ্গী।তার অস্তিত্বের সাথে কোথাও না কোথাও আমি মিশে আছি।বাড়ির ছেলে বৌ নাতি নাতনীদের কাছে এটা তখন এক পাগলামী,সবার কৌতুকের বিষয়।সেও তো অনেক আগের কথা।তারপর একসময় গিন্নি রান্নাঘরে আসা বন্ধ করে দিলেন।বয়স হয়েছে তাছাড়া বাড়ির কর্তা এখন মেজ খোকা আর গৃহিনী হচ্ছেন মেজ বৌ।


এতদিনে আমার ছুটি মিললো।চা বানানো বাদ দিয়ে যত আজে বাজে কাজে আমায় লাগানো শুরু হলো।টক ডাল,বাসি তরকারি,নষ্ট দুধ আর কত কিছুই যে আমাতে রাখা হলো।কিন্ত গৃহিনী কখনোই আমাকে অন্য কাজে ব্যাবহার করতেন না চায়ে গন্ধ হবে বলে।সংসারে আরো উন্নতি হল,রান্নাঘরে ঝকঝকে টাইলস লাগল।এখন রান্না হয় সব ননস্টিক বাসনে।রান্না করে কাজের লোক।বাসায় মেহমান এলে এখন আর মাংস পোলাউ রান্না হয়না বরং রেস্টুরেন্ট থেকে চাইনিজ খাবার আসে।বাচ্চারা বেগুনী আলুর চপ খেতে চায়না তাদের পছন্দ বার্গার আর চাওমিন।এখন এবাড়িতে চা হয়না,সকলে কফি খায়।আমি মনে মনে ভাবি চা পাগল কর্তা কি পোড়া স্বাদের কফি খেয়ে চায়ের মত তৃপ্তি পান।তার কি চায়ের জন্য কষ্ট হয়না?

জানি আমাকে এখানে মানায় না তবুও হয়ত গৃহিনীর জন্যেই আমাকে ছুড়ে ফেলা হয়নি।প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমি এসব বাজে কাজ করছি।কাজের মেয়েগুলোও ভীষন খচ্চর। এমন ভাবে ধরে,এমন ভাবে মাজে যে আমার গায়ে এখন অসংখ্য টোপ খাওয়া।কালিতে ময়লাতে আমি এখন এক কেলো হাঁড়ি।গৃহিনী এ অবস্থায় আমায় দেখলে নিশ্চয় খুব কষ্ট পেতেন।হাবিজাবি গরম করতে দিয়ে অসাবধানে পুড়িয়ে পুড়িয়ে আমার মজবুত তলাটা কাজের ছুঁড়িগুলো দূর্বল করে দিয়েছে তাই একদিন তলাটা ফুটো হয়ে গেল।রান্নাঘরের এক কোনায় অযত্নে পড়ে ছিলাম অনেকদিন তারপর যখন মেজবৌ চিল চিতকার দিয়ে আমাকে ওখান থেকে দূর করতে বললো তখন থেকেই আমার জায়গা হলো স্টোররুমের এই বাতিল মালের বাক্স।

ছয়মাস ধরে এখানেই আছি,জানতাম আর কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে সব বাতিল মালের সাথে ফেরীওয়ালার কাছে বেঁচে দেয়া হবে।তার আগেই এই পরিবারের সাথে কাটানো সময়গুলোর অভিজ্ঞতা আপনাদের বলে যেতে চেয়েছিলাম।এই পরিবার আগেও লোকজনে পরিপূর্ন ছিল এখনও আছে,শুধু পাত্রপাত্রী বদল হয়েছে।

ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি এই পরিবারের সুখে দুঃখে মিশে ছিলাম অবিচ্ছেদ্য ভাবে।সকলের কত মুহূর্তকে আমি সুবাসিত চায়ের মিষ্টতা দিয়ে অমর বানিয়েছি!!আজ আমি জীর্ন দূর্বল তাই আমার আজ আর কদর নেই,আমাকে বাড়ির এক অন্ধকার কোনে ফেলে রেখে সবাই ভুলে গেছে।আমি তো সামান্য চায়ের হাঁড়ি বই অন্য কিছু নই তাই আমার নিজের জন্য বেশি দুঃখ নেই।আমার আফসোস শুধু কর্তা-গিন্নির জন্য কারন আজ এবাড়িতে তাদের অবস্থা ঠিক আমার মতই!

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:১৫

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: চমৎকার গল্প! অন্য একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা গতানুগতিক জীবন।

১২ ই জুলাই, ২০১৫ ভোর ৫:৩১

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই।
নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে গেলে অনেকের কাছেই বাবা মা পুরনো বাসনের মত হয়ে যায়।তখন আর তাদের কদর থাকেনা,তারা হয়ে যায় বোঝা।অনেক বাড়ির এটাই করুন কিন্ত বাস্তবচিত্র।এই উপলব্ধি থেকেই গল্পটা লেখা।
ভাল থাকবেন।

২| ১১ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৭

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: চমৎকার গল্প! অন্য একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা গতানুগতিক জীবন। সহমত।

১২ ই জুলাই, ২০১৫ ভোর ৫:৩৪

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: ভাই আপনাদের মত গুনী ব্লগারদের প্রশংসা পেয়ে সত্যিই খুব ভাল লাগছে।ধন্যবাদ। শুভ কামনা রইল।

৩| ১২ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:০৮

ইমরান নিলয় বলেছেন: মনোরম গল্প

১৩ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৪৪

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

৪| ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:২৮

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: চমৎকার লেখাটি মুগ্ধ হয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। গল্পে ২য় ভালোলাগা সাথে ++++

এতো চমৎকার গল্পে পাঠক আর কমেন্ট এতো কম কেন? :(

ভাল থাকুন সবসময়, শুভকামনা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.