নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সরল মেয়ের সহজ কথন

কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। তাই কয়লাকে পুড়তে দিতে হয়। - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

সরল মেয়ে

সহজ, সরল আর সাধারণ একজন মানুষ।

সরল মেয়ে › বিস্তারিত পোস্টঃ

লাল নিশান

২০ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:২৫

বৈশাখ মাস। বাড়ির উত্তর পাশে গিয়ে দাঁড়ালে অনেক

দূর পর্যন্ত শুধু ফসলের মাঠ চোখে পড়ে। সবুজ আর

সবুজ। সবুজ মাঠ পেরিয়ে অনেক দূরে আরেকটি গ্রামের

লম্বা রেখা দেখা যায়। বাড়িঘর স্পষ্ট বুঝা যায়

না এতো দূর থেকে। তবে সূর্যের প্রচণ্ড রকমের

ঝকঝকে আলোতে দূর গ্রামের দু'একটি জায়গায় মনে হয়

বিজলি চমকাচ্ছে। রোদের আলোয় বৃষ্টি ছাড়াও

এরা বিজলি চমকায়। এই বিজলি জ্বলে টিনের

তৈরি দু'একটা নতুন চাল থেকে। গ্রীষ্মের রোদের

প্রচণ্ড আলোর সাথে টিনের চাল

মিতালি করে রূপালি আলো ছড়ায়। তাই এই পাশের দূর

গ্রাম থেকেও ছোট্ট মেয়েটির উৎসুক

দৃষ্টিতে রূপালি আলোর ঝিলিক ধরা দেয়। তবে এই

বালিকার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু নতুন টিনের

চালের ঝলক দেখা নয়। তার উৎসুক দৃষ্টি অন্য কিছু

খোঁজে। সেই গ্রামের শেষ প্রান্তে বিশেষ কিছুর

চিহ্ন খোঁজে।

ঐ যে সেই লাল নিশান দেখা যাচ্ছে। এই নিশান

প্রতিবছর বৈশাখ মাসে দেখা যায়। দীর্ঘ একমাস

উড়তে থাকে পতপত করে। এটা যেনতেন লাল নিশান নয়। এর

সাথে দূর-দূরান্তের চার পাঁচ গ্রামের

ছেলেমেয়েদের আনন্দ লুকিয়ে আছে। এই বালিকাও নিশান

দেখা মাত্রই সেই নির্মল আনন্দ অনুভব করলো নিজের

মনে।

রানু দৌঁড়ে আসলো দাদার কাছে।

দাদাকে খবরটা আগে দিতে হবে। দাদাই তো নিয়ে যাবে সেই

আনন্দ কিনতে।

- দাদা গাজীপুরের লাল নিশান উড়তাছে।

দরগা শুরু অইছে তাইলে?

- হ, দুই দিন দইরা শুরু অইছে। তুই

আউজকা দেকলি নিশান!

- আমগোরে নিয়া যাইবা না দাদা?

- এইদো শুরু অইলো। আর কিছু দিন যাউক।

দরগা ভালো কইরা বইয়া লইক। তারপরে নিয়া যামু নে।

দুই দাদা নাতনী মিলে দরগার

মেলা নিয়ে গল্পে মশগুল হয়ে গেলো। দরগার

ওখানে নাকি কোন এক মাজার আছে। সেই মাজারের

উপরের মিনারের সাথে বাঁশ বেঁধেই মূলত

নিশানটা উড়ানো হয়। রানু এই মাজারের বা দরগার

কোন ইতিহাস জানে না। তার জানতে ইচ্ছা হয় নাই

কখনো। তার আগ্রহ কেবল সেই

দরগা ঘিরে বসা মাসব্যাপী মেলা নিয়ে। সে এক বিশাল

মেলা। তিন চার বার দাদার সাথে ছোট ভাইসহ গিয়েছে।

কিন্তু কখনো নিজ চোখে সে মাজারটাই দেখেনি। অনেক

মুরুব্বিদের অবশ্য খাসী, মুরগি, চাল

ইত্যাদি নিয়ে যেতে দেখেছে। ওগুলো নাকি বিশেষ কিছু

চেয়ে মাজারের জন্য দান করে। মুরুব্বিরা তাদের

মনের ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে গেলেও রানুর মত ছোট

ছোট ছেলেমেয়েরা যায় মেলা দেখতে।

প্রতিদিনই গ্রামের কোন না কোন

ছেলেমেয়ে মেলা থেকে ঘুরে আসে। তারা সবাই কতকিছু

কিনে নিয়ে আসে মেলা থেকে। রানু আগ্রহ নিয়ে তাদের

হাতে করে নিয়ে আসা জিনিসগুলো দেখে। ইচ্ছে করে নিজ

হাতে নিয়ে দেখতে। কিন্তু লজ্জা পেয়ে কখনো নিজ

হাতে ধরে দেখে না। ওদের হাত থেকেই দেখে। ওরা অবশ্য

অনেক কিছুই কিনে আনে। সব দামী দামী খেলনা।

কিন্তু রানুর অতসব দামী খেলনা চাই না।

ছোটখাটো জিনিস নিয়েই সে খুশি।একটু অধৈর্য্য

লাগছে রানুর। কবে যাওয়া হবে মেলায়!

আজকে রানুর দাদা দুপুর গড়াবার আগেই বিল

থেকে ফিরে এসেছে। এসেই রানু আর তার

ভাইকে ডেকে বললো তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে একটু

বিশ্রাম নিয়ে নিতে। তারপর রোদের তাপ একটু

কমে এলে দরগার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। অনেক দূরের

হাঁটা পথ। খুব বেশি বিকেল করে ফেললে আবার

ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে।

রানু তার সবচেয়ে সুন্দর ফ্রকটা পড়েছে। এটা গত

ঈদে তার ছোট মামা দিয়েছিলো। গ্রামের ফসলী মাঠের

আল ধরে ছোট ছোট পায়ে দুই ভাইবোন দাদার

সাথে হেঁটে চলেছে। হাঁটতে হাঁটতে রানু ফসলী মাঠ

দেখছে। এইদিকে সজের জমিতে সাদা সাদা ফুল এসেছে।

সুন্দর ঘ্রাণ আসছে সেই ফুল থেকে। সজের কচি সবুজ

খাঁজকাটা পাতাগুলো রোদের আলোয় চিকচিক করছে।

আর ফুলের ঘ্রাণে ভ্রমর ছুটে এসেছে। ভন ভন

শব্দে এ ফুল থেকে ও ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরেকটু

এগিয়ে যেতেই রানু একটা নীল ফুলের জমি দেখতে পেলো।

রানু এগুলোর নাম জানে না। তাই দাদাকেই

শুধালো।

- এইগুলা কিয়ের গাছ দাদা?

- এইডি তিসির গাছ।

- ফুলডি কি সুন্দর! আমি একটা ডগা ছিড়া আনি?

- না না। কাছের কোন ক্ষেতে কেউ

থাকলে যদি দেইখালায়, তাইলে কইলাম গাল্লাইবো।

- তিসির গাছ দিয়া কি করে?

- তিসির ফুলেত্তে তেল অয়। অনেক ট্যাহা দাম।

মেলার কাছাকাছি পৌঁছাতেই পাহাড়ের মত উঁচু চরক

গাছটা চোখে পড়লো। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ

করে নিচে নামছে আর উপরে উঠছে। অনেকেই উঠেছে চরক গাছে।

বেশিরভাগই বড় মানুষ। ছোটরাও আছে কিছু। রানু

কখনো চরক গাছে চড়েনি। তাই দাদার

কাছে বায়না ধরলো চরক গাছে উঠতে। কিন্তু

দাদা বললো চরক

গাছে চড়লে নাকি মরে গেলে জাহান্নামে যাওয়া লাগে।

তাছাড়া একবার কোন এক মহিলা নাকি চরক গাছ

থেকে পড়ে মরে গেছে। তাই ভয়ে সেই বায়না বাদ দিলো।

অসহায় দৃষ্টিতে চরক গাছটার দিকে তাকালো। আসলেই

তো কত উপরে উঠে চরক গাছটা। যদি সত্যিই পড়ে যায়

ওখান থেকে। ভাবতেই রানুর গা শিউড়ে উঠলো।

আস্তে আস্তে মেলার ভেতরের দিকে গেলো। কত জিনিস!!

অবাক চোখে সেগুলো দেখতে লাগলো। এতকিছুর নামও

জানেনা সে। রঙিন রঙিন সব জিনিস। দেখলেই খুশি লাগে।

তবে এই জমকালো জিনিসগুলোর অনেক দাম।

এগুলো কেনা যাবে না। রানুর জন্য বিশ

টাকা দেয়া হয়েছে। এসব কিনতে গেলে তার শখের

জিনিসগুলো কেনা হবে না। তাই মাটির আসবাবপত্রের

দোকানগুলোর দিকে চলে গেলো। তার শখের মাটির পুতুল।

টুকটুকে লাল রঙ করা। তার উপর

সাদা ডোরাকাটা নকশা করা। এর আগেরবার ছোট

পুতুল নিয়েছে এক টাকা দিয়ে। এবার দুই

টাকা দিয়ে বড় পুতুলগুলো কিনবে।

বেছে বেছে সবচেয়ে নিখুঁত পুতুলটা নিলো রানু।

- দাদা এহন একটা চরকি গাড়ি আর বল কিনা দেও।

- বল দিয়া তুই কিরবি? পোলাগো খেলনা।

- না, আমি একটা বল নিমুই। ঐ

যে ফান্টা লেখা কমলা সাদা বলডি আছে না,

ঐডি কিনমু। কি সুন্দর ফুঁ দিয়া ফুলান যায়।

- আইচ্চা আইচ্চা। কিনা দিমু।

দুই ভাই বোনের আবদার পূরণ করলো বৃদ্ধ।

রানুকে দশ টাকা দিয়ে ফান্টা লেখা বল কিনে দিলো।

তারটা দেখে রানুর ভাইয়েরও একই বায়না। তাই

দুটোই কিনতে হল। পাঁচ টাকা করে কেনা হল চরকি গাড়ি।

মাটির উঠোনে চালালে চিকন করে ভোম ভোম শব্দে চলবে।

পাঁচ টাকায় কেনা মুরালী খেতে খেতে দুই ভাইবোন

বাড়ির পথে চললো। চিকন আলের পথ ধরে রানুর ভাই মাটির

তৈরি সুতাটানা ডুগডুগি চালাতে চালাতে পথ

চলছে। ডুগডুগির ডুমডুম শব্দ তাদের

আনন্দে ছন্দ দিয়ে দিলো। পড়ন্ত বিকেলের লাল হলুদ

আলো মিলেমিশে তাদের

আনন্দমাখা মুখে আরো বেশি দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে।এই

দ্যুতি, এই আনন্দ বিশুদ্ধ, নির্মল। ওদের জন্য

দুই টাকার মাটির পুতুল, পাঁচ টাকার ডুগডুগিই

অমূল্য সম্পদ। নিখাদ আনন্দের উৎস।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.