নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুমনজাহিদ

T

সুমনজাহিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মেহেদির অজানা ভূবনেঃ

২১ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০২

মেহেদির অজানা ভূবনেঃ



প্রায় ১৫ হাজার বছর ধরে পৃথিবীবাসি তার রূপ সৌন্দর্য্যে ব্যবহার করে এসেছে প্রকৃতি প্রদত্ত নানান রঞ্জক। সকল রঞ্জকের ভিতরে মেহেদীর শ্রেষ্ঠত্ব আজ বিশ্বব্যাপি প্রতিষ্ঠিত ৫ হাজার বছর ধরে। মেহেদী শুধু নারীর অঙ্গ সৌন্দার্য্যায়নের চিরায়ত আকাঙ্খাকেই ধারণ করেনা বিশ্বব্যাপি নানা ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠিতে মেহেদীর রয়েছে বিচিত্র ব্যবহার। মেহেদির ক্রমবর্ধমান ও ক্রমপরিবর্তিত আঙ্গিকসহ পৃথিবীর সকল দেশের ট্রেডিশনাল ও মডার্ন ডিজাইন সম্পর্কে একটি সমন্বিত ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো।



০১. মেহেদীর ইতিহাস :

সারা পৃথিবী জুড়ে খুঁজে পাওয়া নানান ফসিল ও প্রত্নতাত্বিক গবেষণার মাধ্যমে নৃবিজ্ঞানিরা নিশ্চিত হয়েছেন প্রায় ১৫০০০ বছর ধরে নর-নারীরা প্রকৃতির নানান উপাদান দিয়ে অঙ্গসজ্জ্বা করতেন। সুই ফুটিয়ে শরীরে স্থায়ীভাবে অলংকরণ করা যাকে আমরা ট্যাটু বলি সেটি করা হতো মূলত দুটি কারণে একটি হচ্ছে অঙ্গসজ্জ্বা আরেকটি হচ্ছে তার আইডেনটিফিকেশন।



সভ্যতার ইতিহাস ধরা হয় ৫০০০ বছর। কিন্তু মেহেদির ইতহাস তারও পুরনো। নিওলিথিক বা নব্যপ্রস্তর যুগ (১০০০০-৪০০০ খ্রী.পূ.) থেকে মেহেদির প্রথম ব্যবহার দেখা যায় উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলে। প্রায় ৯০০০ বছর আগে মরুবাসীরা প্রচন্ড গরম থেকে বাঁচার জন্য তাদের পা মেহেদি পেস্ট দিয়ে আচ্ছাদন করে রাখতো যা গোটা শরীরকে ঠান্ডা রাখতো। বিশেষত যোদ্ধাদের ভিতরে এর প্রচলন ছিল বেশী। তারপর যখন দেখলো শুকিয়ে গেলে চমৎকার রং ধারণ করে সেই থেকেই শুরু হয় অঙ্গসজ্জ্বায় মেহেদীর ব্যবহার। এতদ্বাঞ্চলে যে ৪টি প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল- মিশরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা ও এ্যসিরিয় সভ্যতা প্রতিটি সভ্যতায় রঞ্জক হিসেবে মেহেদি ব্যবহার পাওয়া যায়। চিত্রকলার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ মার্কিন অধ্যাপক Dr. Marilyn Cvitanic-এর মতে For over five thousand years henna has been a symbol of good luck, health and sensuality in the Arab world. দক্ষিণ চীনে প্রায় তিন হাজার বছর ধরে প্রাচীন দেবী সংস্কৃতির সময় থেকে মেহেদী ব্যাপকভাবে প্রেমমূলক র্ধমানুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।



প্রাচীন মিশরের খুশি, আনন্দ ও ভালোবাসার প্রতিক রানী নেফারতিতি (খ্রী.পূর্ব ১৩৭০-১৩৩০) ও ইতিহাসে সর্বকালের সেরা সুন্দরী ও আবেদনময়ী রানী ক্লিওপেট্রা (খ্রী.পূর্ব ৬৯-৩০) নিয়মিত মেহেদী ব্যবহার করতেন। ক্লিওপেট্রা কন্যা সেলেনা (Selene also known as Cleopatra VIII of Egypt, খ্রী.পূর্ব ৪০-০৬) মেহেদীর নানা রকমের ব্যবহার জানতেন। মিসরের পিরামিডে ফারাও সম্রাটদের মমিতে মেহেদির ব্যবহার হতো। মধ্যযুগের কিছু চিত্রকলায় দেখা যায় কিং সলোমানের সাথে রানী সেবা যখন দেখা করতে যায় তখন রানী মেহেদী ব্যবহার করতেন। ভারতের অজন্তা গুহাচিত্রেও অঙ্গসজ্জ্বায় মেহেদির ব্যবহার দেখা গেছে। উপমহাদেশে ১২০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে মেহেদীর ব্যবহার শুরু হয় ও মোগল আমলে প্রাকৃতিক প্রসাধনি হিসেবে মেহেদীর ব্যপকতা ছড়িয়ে পরে। মোগল সম্রাট শাহজাহান পত্নি মমতাজকে মিসরের রাজা রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে মেহেদি ও মেহেদি চারা উপহার দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।



০২. মেহেদির পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত কিছু তথ্য:

বাংলা শব্দ মেহেদী, কোথাও মেদি, মেন্দি, কোথাও মৌকা নামে আমাদের দেশে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে নিরি মুল্লকা, মদয়ন্তিকা, গিরিমল্লিকা, নখ রঞ্জিকা, বনমল্লিকা নামে মেহেদির বেশ কিছু কাব্যিক নাম পাওয়া যায়। মেহেদি- হিন্দি ও উর্দুতে মেহেন্দি, ইংরেজীতে হেনা (Henna), মধ্য-প্রাচ্যে হেন্না, মধ্য-এশিয়ায় ‘আল-খান্না’ নামে পরিচিত যা আরবী শব্দ আল-হিন্না (Al-Hinna) থেকে এসেছে। এর ইউনানী নাম হচ্ছে হেনা, আয়ুর্বেদিক নাম মদয়ন্তিকা, বোটানিক্যাল নাম হচ্ছে লসোনিয়া ইরামিস (Lawsonia Inermis) যা লেথরেসিয়া (Lythreaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।



মেহেদিগাছ গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ। ঘন শাখা ও পাতা বিশিষ্ট। এটি সাধারণত দুই থেকে ছয় মিটার বা প্রায় ২০ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। পাতাগুলো সরল, প্রতিমুখ বা বিপরীতভাবে সাজানো থাকে, বৃন্তক দেখতে অনেকটা লেন্সের মতো এবং পাতার অগ্রভাগ সুঁচালো। পাতায় বিশেষ গন্ধ থাকে। কান্ড ছোট এবং আংশিক কাঁটাযুক্ত। ফুল ছোট এবং গুচ্ছাকারে ফোঁটে। ফুলের রঙ হলুদাভ সাদা বা হালকা গোলাপি। বৃতি দেখতে লাটিমের মতো। ফুলের পাপড়িগুলো পুরু এবং ভাঁজবিশিষ্ট। পুংকেশরগুলো জোড়ায় জোড়ায় সাজানো থাকে। ফল আকারে মটর দানার সমান এবং ধূসর বর্ণের। ফলের ভেতরে ছোট ছোট ৮৫-৯৫টি বীজ থাকে। শুকনো গুড়া মেহেদীতে ৯% ময়েশ্চার, ১৪.৮% এ্যাশ (ধংয) ও ১০.২% তানিন (ঞধহহরহ) থাকে ।



০৩. মেহেদির বিশ্বব্যাপি ব্যবহার:

মেহেদির সবচেয়ে প্রাচীন ব্যবহার দেখা যায় ন্যাচারাল কুলিং সিস্টেম হিসেবে আরব বিশ্বের মরু অঞ্চলে। প্রচন্ড গরমে একটু আরামের জন্য মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মরুবাসিরা পায়ে মেহেদি পেষ্ট লাগাতো। প্রাচীন মিসরের ফারাও সম্রাজ্যে এটির ব্যাপক প্রচলন ছিল। সুসজ্জ্বা ও সুরক্ষার জন্য পিরামিডের মমিদেহের হাত ও পা মেহেদি পানিতে চুবানো হতো। ভারতবর্ষ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে প্রাচীনতম কসমেটিক হিসেবে মেহেদীর ব্যবহার প্রায় ৫০০০ বছরের পুরনো। ব্রোঞ্জ যুগ থেকেই দুনিয়াবাসীরা রঞ্জক হিসেবে মেহেদি ব্যবহার করে আসছে। ভারতীয় আদালতে চুলের রঙ হিসেবে মেহেদির ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে যেটা প্রায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দের। ছত্রাক-রোধী হিসেবেও মেহেদি কার্যকর। কাপড় ও চামড়া সংরক্ষণেও এর ব্যবহার হয়। মেহেদি ফুল থেকে সুগন্ধী তৈরি হতো বহু প্রাচীনকাল থেকেই। পোকা দমনেও মেহেদি ব্যবহৃত হয়। লসোন (Lawson) নামক এক প্রকার পদার্থের উপস্থিতির জন্যই মেহেদিতে রঙ হয়।



মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রীস্টান, শিখসহ বিভিন্নধর্মে ঐতিহাসিকভাবে মেহেদী পবিত্রতা ও আধ্যাতিকতার সঙ্গে যুক্ত। পৃথিবীর নানা জাতি ও অধিকাংশ আদিবাসী সমাজে সুস্বাস্থ্য, উর্বরতা, জ্ঞান, সুরক্ষা এবং আধ্যাতিক জ্ঞান হিসেবে প্রতিটি সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ডিজাইনের আলাদা অর্থ রয়েছে। কখনো এটি শরীরে স্থায়ী রূপ দেয়ার জন্য ট্যাটু ও সাময়িক সজ্জ্বার জন্য মেহেদী দিয়ে ডিজাইনগুলো করা হয়।



বাংলাদেশে ঈদ ও বিয়ে উপলক্ষে এর ব্যবহার অনেকটা আবশ্যিকরূপে প্রচলিত। দুনিয়ার বহু দেশে এটি উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রাক বিবাহ, বিবাহ, গর্ভাবস্থার আটমাস, সন্তান জন্মের ৪০ দিন, সন্তানের নামকরন প্রভৃতি পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আবহমানকাল থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মেহেদির বাহারি ব্যবহার হয়ে থাকে। আফ্রিকার অনেক জায়গায় আরোগ্য মুক্তি উপলক্ষ্যে এবং আরব্য সংস্কৃতির বিয়েতে মেহেদি সন্ধ্যা একটি জনপ্রিয় প্রথা যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহেও দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আয়ুর্বেদীয়, ইউনানী ও বিভিন্ন প্রকার অর্গানিক চিকিৎসায় মেহেদীর ব্যবহার হয়ে থাকে।



০৪. মেহেদীর চাষ ও বিশ্বব্যাপি মেহেদীর উৎপাদন:

৩৫-৪৫ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রা মেহেদী চাষের জন্য উপযোগী। আদ্র আবহাওয়ার তুলনায় অধিক শুষ্ক ও উষ্ণ তাপমাত্রার উম্মুক্ত স্থানে উন্নততর মেহেদী জন্মে। ১১ ডিগ্রি তাপমাত্রার নীচে মেহেদি জন্মে না। মেহেদী পাতা পরিপক্ক হতে ৪-৫ বছর সময় লাগে। ২৫ বছর পর্যন্ত লাভজনক পাতা উৎপন্ন হয়। ৫০ বছর বয়সী গাছও পাতা দিতে সক্ষম। সামান্য বৃষ্টিপাতেই এটি নতুন ডাল ও পাতা ছাড়ে। গ্রীষ্ণের শেষদিকে মূলত: মেহেদী পাতা তোলা হয় কেননা এই সময়ই মেহেদী পাতা বেশী প্রলম্বিত হয় ও বেশী লসোন (Lawson) ধারণ করে যা গাড় লাল দাগ তৈরীর উপযোগী। শীতের শুরুতে পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে ও পাতা ঝরা শুরু হয়। ক্রান্তিয় দেশসমূহতে রপ্তানিযোগ্য মেহেদীর চাষ করা হয়। মেহেদী চাষে বৃষ্টি ও সারের প্রয়োজন অনেক কম। তবে সবদেশে একইভাবে মেহেদি উৎপাদিত হয় না। দেশভেদে চাষের ভিন্নতা রয়েছে। আফ্রিকার দেশসমূহে মাটি কর্ষণ, সার ও পানি ভারতের তুলনায় অনেক বেশী ব্যবহৃত হয়। ভারতে যে সমস্ত এলাকায় বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ৪০০ মি.মি. সেখানে মেহেদী ভালো জন্মে। কীটনাশকের ব্যবহারও তেমন প্রয়োজন পড়ে না। ২০হাজার থেকে ২ লাখ গাছ হেক্টর প্রতি লাগানো যায় যা নির্ভর করে পানির প্রাপ্যতার উপর। বীজ থেকে নার্সারি করে অথবা কলম করে মেহেদীর চাষ হয়। বীজতলার জন্য হেক্টর প্রতি ৩-৫ কেজি বীজ লাগে। হেক্টর প্রতি ১০০০ থেকে ৩ হাজার কেজি পাতা উৎপন্ন হয় যা শুকনো গুড়ো করলে ১৫০০ থেকে ৪৫০০ কেজি পর্যন্ত গুড়ো মেহেদী পাওয়া যায়। মেহদী পাতা বছরে ২ থেকে তিনবার তোলা হয়। কাচা পাতা শুষ্ক ও অন্ধকার বা কম আলোতে শুধু প্রাকৃতিক বাতাসে শুকানো হয়। শুকনো ঝরঝরে হলে একটি সেমি অটোমেটিক মেশিনে বাছাই করা হয় যাতে পাতা ছাড়া অন্য সকল কিছু যেমন পাথর, কান্ড, বীজ, আবর্জনা ইত্যাদি রিমুভ হয়। তারপর কয়েকটি প্রসেসে গুড়ো করা হয়। গুড়ো মেহেদীকে আদ্রতামুক্ত করতে আরেকটি মেশিনে প্রসেস হয়ে ল্যাবটেষ্টের পরে প্যাকেট করা হয়।



সাহারা মরুভূমির দেশসমূহ, মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তান-ভারতের মরু অঞ্চলে বানিজ্যিকভাবে মেহেদী চাষ হয় ও এখান থেকেই সারা পৃথিবীর মেহেদীর যোগান দেয়া হয়। মেহেদীর উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশসমূহ হচ্ছে ঃ মরক্কো, মিশর, সুদান, ওমান, ইরাক, পাকিস্তান, ভারত এছাড়া আভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য বানিজ্যকভাবে মরুতানিয়া, লিবিয়া, চাঁদ, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, সৌদি আরব, ইরান, ইজরাইল, ইয়েমেন, স্পেন, তুরস্ক, তিউনেশিয়া ও অষ্ট্রেলিয়ায় মেহেদীর চাষ করা হয়। বাংলাদেশের মত উপক্রান্তিয় দেশসমূহে, ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহ ও দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রাকৃতিকভাবেই যুগ যুগ ধরে মেহেদী জন্মে আসছে যা প্রতিটি দেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত।



আমাদের দেশের অনুর্বর, শুষ্ক ও পরিত্যক্ত মাটিতে যে জায়গা সব্জিচাষের অনুপযোগী সেই মাটিতে বানিজ্যিকভাবে মেহেদীর চাষ সম্ভব। সাভারের কিছু জায়গায় ইতোমধ্যেই বানিজ্যিকভাবে মেহেদী চাষ শুরু হয়েছে। সাভারের সালামাসি গ্রামের কৃষক মোঃ কসিমুদ্দিন নামের এক কৃষক দশ বছর ধরে মেহেদী চাষ করছে। তার দেখাদেখি এখন বেশ কিছু জমিতে এখন মেহেদী চাষ করছে সাভারের অনেক কৃষক।



০৫. বিশ্বব্যাপি মেহেদীর বাজার ও বিপনন:

একাবিংশ শতাব্দিতে বিশ্বব্যাপি মেহেদির চাহিদা ও যোগান সম্পর্কিত কার্যকর কোন গবেষণা হয়েছে বলে জানা যায় না। গত শতাব্দির ৮০ এর দশকের পরে বিশ্বব্যাপি সার্বজনিন সৌন্দর্য্য চর্চায় মেহেদী একটি বিপ্লব এসেছে। ন্যাচারাল হেয়ার ডাই হিসেবে এর চাহিদা খুবই ক্রমবর্ধমান। যার কারনে গত কয়েক দশকে মেহেদীর চাহিদা কয়েকশত গুন বেড়েছে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাহারি প্রকারের কৃত্রিম পেস্ট মেহেদী বাজারজাত করছে। বিজ্ঞানের কল্যানে এর ব্যবহারিক গুনমান কখনো কখনো প্রাকৃতিক মেহেদীকেও ছাড়িয়ে যায়। আজকের পৃথিবীতে আজো কোটি কোটি পরিবার বাড়ির বাগানের মেহেদি গাছ থেকে পাতা উত্তোলন করে সরাসরি ব্যবহার করে আর এর পাশাপাশি নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে গুড়ো মেহেদী ও পেষ্ট মেহেদী। যার কারনে মেহেদীর সামগ্রিক চাহিদা প্রক্কলন করা জটিল গবেষণার বিষয়।



১৯ শতকে শুধু ইস্তাম্বুলের নারীরা প্রতি বছর চুলে ১৫০০০ পাউন্ড মেহেদী ব্যবহার করতো। ১৯৫৫ সালে ভারতে ২৮০০ টন মেহেদী উৎপন্ন হয়েছিল। একাবিংশ শতাব্দির প্রাক্কালে পাকিস্তানে বছরে ১৫০০০ মে.টন মেহেদী উৎপন্ন হয় যার অর্ধ্বেক তারা রপ্তানি করে। ভারত, মিশর ও সুদান ১৯৭৫-১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর মোট গড় রপ্তানি ছিল ৬০০০-৮০০০ হাজার টন। ফাও এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮৮-১৯৯৩ পর্যন্ত ৪৫০০-৭৬০০ টন মেহেদী বছরে রপ্তানি করতো। ১৯৯২ সালে বিশ্ববাজারে টনপ্রতি মেহেদীর মূল্য ছিল ২৫০-৭০০ ইউ এস ডলার। মেহেদীর প্রকরণ ও মানের কারনে দামের এই তারতম্য হয়। ২০০৩-৪ এ শুধু রাজস্থানেই উৎপন্ন হয়েছে ৩৭৫৪০ টন। তন্মেধ্যে রপ্তানী করেছে ১০৫০০ টন যার মূল্য ৯১ কোটি ভারতীয় রুপি। আর আজকের ভারতে প্রচুর মেহেদি প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠেছে যার কোন কোনটির উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার টনেরও বেশী। গুজরাটের পালি জেলার সুজাত নগরে এরুপ শতাধিক শিল্প কারখানা তৈরী হয়েছে যারা ভারতে বানিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মেহেদীর ৯০ ভাগের যোগান দেয়।



৮০ এর দশকে গড়ে প্রতি বছর সৌদি আরব ৩০০০ টন, ফ্রান্স ২৫০ টন, ব্রিটেন ১০০ টন, আমেরিকা ৪০০ টন মেহেদী আমদানী করেছে। পাশ্চত্য দেশগুলোতে বিগত দশ/বারো বছরে বিশাল বাজার তৈরী হয়েছে। যদিও ওসব দেশে ইদানিং মেহেদী চাষ শুরু হয়েছে তবে তা একেবারেই সৌখিন পর্যায়ে। রপ্তানিকারক দেশসমূহের মধ্যে ভারতই প্রধান। ভারত ছাড়াও মরক্কো, মিশর, সুদান, ওমান, ইরাক, পাকিস্তান ও অষ্ট্রেলিয়া মেহেদী রপ্তানি করছে। বিগত তিন দশকে মেহেদীর চাহিদা বেড়েছে কয়েকশত গুন। যদিও এর সিংহভাগ অংশই কৃত্রিম মেহেদীর দখলে। এর মূল কারণ প্রাকৃতিক মেহেদী দিয়ে ভালো রঙ আনতে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা সময় লাগে শুকনোর জন্য সেখানে কৃত্রিম পেস্ট মেহেদীতে রঙ হয় কয়েক মিনিটে।



০৬. বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেহেদির কিছু ব্যতিক্রমি কার্যকর ব্যবহার:

বিশ্বব্যাপি নর-নারীরা নখ, চুল, হাত, পা সহ দেহের প্রায় সকল অংশেই মেহেদীর ব্যবহার করে। সৌন্দর্যায়ন ও ঔষধি ব্যবহার ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় ও লোকজ বিশ্বাস ও সংস্কারের সাথে এটি সম্পর্কিত। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহুবিধ কাজে মেহেদীর বিচিত্র ব্যবহৃত রয়েছে। মেহেদীর পাতা ছাড়াও এর ফুল, বীজ, বাকল, কান্ড, ফলের খোসাও নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন কাল থেকেই মেহেদী ফুল থেকে সুগন্ধি তৈরী হয়। উত্তর ভারত ও জাভায় বানিজ্যিকভাবে মেহেদী ফুল থেকে সবুজ রঙের খুবই দামী সুগন্ধি তৈরী করা হয়। প্রাকৃতিকভাবে কালো রং পাওয়ার জন্য মেহেদীর সাথে Indigo (নীল) মিশ্রন করা হয়। উল ও সিল্ক জাতীয় কাপড়ে অর্গানিক কালারের জন্য, ঘোড়ার কেশর ও লেজের চুল রঙিন করতে মেহেদীর ব্যবহার হয়। মরক্কোসহ উত্তর আফ্রিকায় এখনও চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে মেহেদি ব্যবহার করে। সানব্লক হিসেবে বিভিন্ন আদিবাসি মানুষ ছাড়াও গৃহপালিত পশুর নাকে মেহেদী পেস্ট ব্যবহার করা হয়।



০৭. মেহেদির প্রকরণ:

প্রাকৃতিকভাবে আহরিত মেহেদি মূলত অঙ্গসজ্জ্বা ও চুলের রং হিসেবে হাজার বছর ধরে মানুষ সরাসরি পেষ্ট করে ব্যবহার করে আসছে। মেহেদি সংরক্ষণের জন্য মেহেদী পাতা বাতাসে শুকিয়ে পউডার তৈরী করা হয়। আজও এভাবেই বিশ্ববাসি বাজার থেকে সরাসরি মেহেদীগুড়ো সংগ্রহ করে প্রাকৃতিক মেহেদীর চাহিদা মিটায়। তবুও ফ্যাশনপ্রিয়তার প্রয়োজনীয়তার কারনে যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে মেহেদীর প্রকরণেও বৈচিত্র এসেছে। তবুও বাজারে যে প্রাকৃতিক মেহেদী পাওয়া যায় তা মূলত তিন প্রকার:



০১. ব্ল¬াক হেনা (Black Henna): আমাদের দেশে ইংরেজ আমলে নীল চাষ হতো আমরা জানি। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সূচনা কালিন সময় শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমাদের দেশের নীল বা ইন্ডিগো অর্গানিক কালারের চাহিদা মিটিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে কালো মেহেদী বলতে মেহেদীর সাথে ইন্ডিগোর মিশ্রণকেই বুঝায়। চুল ও ত্বকের জন্য এই কালো মেহেদীই একসময় সবাই ব্যবহার করতো। কিন্তু প্রাকৃতিক নীল বা ইন্ডিগোর দুস্প্রাপ্যতার কারণে মেহেদীর সাথে পিপিডি বা প্যারা-ফেনিলেনডিয়ামাইন (para-phenylenediamine) নামক এক প্রকার রাসয়নিক পদার্থ সংমিশ্রন করে। সারা পৃথিবীতে কালো মেহেদী বলতে এটাকেই বুঝানো হয়। কালো মেহেদী মূলত চুলের জন্য হলেও অনেকে ত্বকের ডিজাইনে এটি ব্যবহার করে। কিন্তু যাদের এলার্জি সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এটির ব্যবহার অনেক সময় ত্বকে চুলকানি বা ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে।



০২. লাল মেহেদী (Red Henna): লাল মেহেদী হচ্ছে সবুজ রঙের পাউডার যা থেকে খড়ের মত গন্ধ আসে যা মূলত লসোনিয়া ইনারমিস (Lawsonia Inermis) বিশ্বব্যপি যা হেনা নামে পরিচিত। প্রাকৃতিক মেহেদীর ভিতরে এই লসোন নামক পদার্থটি মূলতো গাঢ় লাল বর্ণ তৈরী করে। এই লাল মেহদী ত্বক ও চুলের জন্য খুবই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর। চুলের জন্য এটি সর্বোত্তম কন্ডিশনার। ত্বক ও চুলের ধরণের উপর রঙের সেড নির্ভর করে। এটিই মূলত ন্যাচারাল হেনা।



০৩. হোয়াইট হেনা (Neutral Henna) : নিউট্রাল হেনা এক প্রকারের সবুজ পাউডার যা থেকে কাটা কাঁচা ঘাসের মত গন্ধ আসে। এটি চুলে কোন রঙ তৈরী করে না। নিউট্রাল হেনা আসলে কোন হেনা নয় এটি সেনা ইটালিকা (Senna italica) নামক গাছের গুড়ো যাকে ক্যাসিয়া ওবোভাটা ও (Cassia Obovata) বলে। এর ভিতরে এক প্রকারের প্রাকৃতিক এসিড রয়েছে যা এন্টি ফাঙাল, এন্টি মাইক্রোবিয়াল ও এন্টি ব্যাকটেরিয়াল যা চুলকে লম্বা, উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান করে। এটি চুল পড়াও রোধ করে। এটি চুলে কোন রং তৈরী করে না কিন্তু চুলে কিছুটা সোনালী রং আনে। এটি মিশরীয় এলাকায় পাওয়া যায়। মেহেদীর সাথে দারুচিনির মিশ্রণ করেও প্রায় নিউট্রাল হেনা বলে বিক্রি করে।



প্রাকৃতিক এই মেহেদিগুলো ছাড়াও বাজারে নানা প্রকারের টিউব ও কোনে নানা রঙের পেস্ট মেহেদী পাওয়া যায় বডি ডিজাইনের জন্য। প্রাকৃতিক মেহেদীতে প্রকৃত রং আসতে অনেক সময় লাগে এবং রঙের বৈচিত্রও খুব সীমাবদ্ধ বিধায় প্রাকৃতিক মেহেদীতে প্রাপ্ত উপাদান বিশ্লেষণ করে কৃত্রিমভাবে তৈরী মেহেদীর চাহিদা সবচেয়ে বেশী। রঙিণ মেহেদী, গ্লিটার মেহেদী পুরোটাই কৃত্রিমভাবে তৈরী। চুল ও ত্বকের জন্য বাজারে হাজার রকমের মেহেদী পাওয়া যায় তবে আমাদের দেশে মেহেদীর মান নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় অনেক কোম্পানির পন্যের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।



০৮. বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মেহেদি ডিজাইনের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য:

আফ্রিকান ডিজাইন: আফ্রিকান ডিজাইনে তাদের লোকজ, বিচিত্র, বন্য-সাহসী সংস্কৃতির প্রতিরূপ ফুটে উঠে। তাদের অধিকাংশ ডিজাইনগুলো জ্যামিতিক আকারে মোটা দাগে করা। আদিবাসী সংস্কৃতিতে তাদের কিছু পবিত্র প্রাণী, দেবতা ও অদ্ভুত কিছু প্রতিক সম্বলিত যা স্থান ও সময়ের বিভিন্নতায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ স্বাভাবিক দর্শনে তা অন্যের কাছে অর্থহীন মনে হতে পারে। হাত-পা ছাড়াও মুখমন্ডলসহ শরীরের যে কোন স্থানে তারা ডিজাইন করে। কিছু কিছু ডিজাইন বিশেষ সামাজিক স্বীকৃতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে নির্দিষ্ট জনের জন্য নির্ধারিত থাকে।



এরাবিয়ান ডিজাইন: এরাবিয়ানরা সংক্ষিপ্ত সরল ডিজাইন পছন্দ করে। মুসলিমরা অনেকে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আরবী ক্যালিগ্রাফিক ডিজাইন পছন্দ করে। মেয়েরা লতাপাতাসহ ফ্লোরাল ডিজাইন খুব পছন্দ করে। গোটা হাত কিংবা শরীরে ভরাট ও বড় আকৃতির ডিজাইনের প্রচলন কম। এবস্ট্রাক্ট লাইন ডিজাইনের প্রচলন রয়েছে।



ইন্ডিয়ান ডিজাইন: ভারত উপমহাদেশে মেয়েরা ভরাট, দীর্ঘ, কারুকার্যময় জটিল ডিজাইন পছন্দ করে বিশেষ করে বিয়েতে কন্যার বাহুর গোড়া থেকে আঙুলের নখ পর্যন্ত ধারাবাহিক গল্পের মত ডিজাইন করে। নানা রঙের মেহেদীর সাথে গ্লিটার ও ষ্টোনের ব্যবহার লক্ষনীয়। নানা রকম কালার শেড ও ডট ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। নন মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থানীয়প্রানী যেসন মাছ, ময়ুর, হাতি, পাখি ইত্যাদির ডিজাইন দেখা যায়। পশ্চিম ভারতের লোকজ সংস্কৃতিতে সূর্যের বিচিত্র ডিজাইন লক্ষনীয়। সনাতন ধর্মের বেশ কিছু প্রতিক ও আদিবাসীরা নিজস্ব সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের কিছু পবিত্র প্রতিক মেহেদীর ডিজাইনে ফুটিয়ে তোলে। পাকিস্তানের ট্রাডিশনাল ডিজাইনে ফ্লোরাল ডিজাইনের পাশপাশি চাঁদ-তারার ব্যবহার দেখা যায়। ইদানিং উপমহাদেশের ডিজাইনে সাধারণ, হাল্কা ও আধুনিকতার ছাপ পড়েছে।



০৯. মেহেদির পেস্ট বানানোর পদ্ধতি: বাজারের পেষ্ট মেহেদী এখন খুবই সহজলভ্য। টিউব কিংবা কোনাকৃতির এই মেহেদীগুলো কৃত্রিম উপায়ে বানানো হয় বলে সকল কোম্পানির পণ্যের গুণগতমানের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। বাজারে অবশ্য আমদানীকৃত গুড়ো মেহেদীও পাওয়া যায় তবে তার মানও প্রশ্নাতীত নয়। তবে সবচেয়ে উত্তম হাতে বানানো মেহেদী। বাড়ীতে মেহেদী গাছ না থাকলেও কাচা বাজারে ডালসমেত মেহেদীপাতা পাওয়া যায়। কাচা পাতা থেকে মেহেদী বানানোর পদ্ধতি হচ্ছে:



১. পরিষ্কার কাঁচা পাতা মিহি করে বেঁটে নিতে হবে।

২. মিহি করে বাটা কাঁচা পাতার পেস্টের সাথে একটু লেবুর রস মিশিয়ে নিতে পারেন।

৩. কাঁচা পাতার পেস্টের সাথে চা বা কফির কড়া লিকার মেশাতে পারেন। এতে মেহেদির রং গাঢ় হয়।

৪. কাঁচা পাতার পেস্টের সাথে সামান্য পান খাওয়ার খয়ের মেশাতে পারেন। এতেও রং গাঢ় হবে।

৫. মেহেদি পাতার শুকনো গুঁড়ো হলে তা পেস্টে পরিণত করার জন্যে একটু গরম পানিতে মিশিয়ে ১ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। তাহলেই পেস্ট ব্যবহারের উপযোগী হবে।

৬. গুঁড়ো পেস্টের সাথেও লেবুর রস, চা বা কফির লিকার বা খয়ের মেশাতে পারেন।

৭. পেস্টের ঘনত্ব ঠিক করার জন্যে প্রয়োজনমতো লেবুর রস ও একটু চিনি গোলানো পানি পেস্টের সাথে মিশিয়ে নিতে পারেন।

৮. মেহেদীর রং কালো করতে চাইলে মেহেদীর গড়োর সাথে প্রাকৃতিক নীল (Indigo) মেশাতে হবে।



এই পদ্ধতি মূলত বডি ডিজাইনের জন্য। বাড়ির মেহেদী হলে চুলেও লাগাতে পারেন সেক্ষেত্রে খয়ের ও চিনি পানি মিশাবেন না। তবে বাজার থেকে গুড়ো মেহেদী কিনলে অবশ্যই ব্যবহার বিধিটি ভালোভাবে বুঝতে হবে। প্যাকেটের গায়ে ব্যবহার বিধি ও পণ্যের মেয়াদ দেখে কিনতে হবে। বাজার থেকে কেনা হেয়ার ডাই দিয়ে ত্বকে ডিজাইন করবেন না। প্রাকৃতিক এই মেহেদিগুলো ছাড়াও বাজারে নানা প্রকারের টিউব ও কোনে নানা রঙের পেস্ট মেহেদী পাওয়া যায় বডি ডিজাইনের জন্য। প্রাকৃতিক মেহেদীতে প্রকৃত রং আসতে অনেক সময় লাগে এবং রঙের বৈচিত্রও খুব সীমাবদ্ধ বিধায় প্রাকৃতিক মেহেদীতে প্রাপ্ত উপাদান বিশ্লেষণ করে কৃত্রিমভাবে তৈরী মেহেদীর চাহিদা সবচেয়ে বেশী। রঙিণ মেহেদী, গ্লিটার মেহেদী পুরোটাই কৃত্রিমভাবে তৈরী। চুল ও ত্বকের জন্য বাজারে হাজার রকমের মেহেদী পাওয়া যায় তবে আমাদের দেশে মেহেদীর মান নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় অনেক কোম্পানির পন্যের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।



১০. মেহেদির ব্যবহার বিধি:

বডি ডিজাইনের জন্য মেহেদী লাগানোর নানা রকমের পদ্ধতি রয়েছে। আগে প্রায় সর্বত্রই কাঠি বা টুথপিক দিয়ে মেহেদি লাগানো হতো। এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে কোন পদ্ধতি। ফয়েল পেপার, সিলোফেন বা পিভিসি বা ওয়াটার প্র“ফ পেপার দিয়ে এই কোনগুলো হাতে বানানো যায়। বাজারে অবশ্য বিভিন্ন দেশে কোনকৃত পেষ্ট মেহেদী পাওয়া যায়। এছাড়া জ্যাকার্ড বোতল, ক্যারোট ব্যাগ ও ব্যবহৃত হয়। মরক্কোতে সিরিঞ্জ পদ্ধতি খুব জনপ্রিয়। যে পদ্ধতিতেই মেহেদী লাগান না কেন মেহেদী ব্যবহারের সময় আরো কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিৎ।



১. মেহেদি লাগানোর আগে হাত ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। ময়েশ্চারাইজার বা লোশন-জাতীয় কিছু লাগানো যাবে না।

২. মেহেদি রাতে দিলে সকালে এর রংটা বেশি ভালো লাগবে। ঈদের মেহেদী তাই চাঁদ রাতে লাগানোর রীতি রয়েছে।

৩. টিউব মেহেদি দেয়ার আগে হাতে একটু লাগিয়ে দেখুন অ্যালার্জি হয় কি না। সব টিউব মেহেদী গুণগতমান সম্পন্ন নয়।

৪. মেহেদি লাগানোর পর যদি দেখেন উঠে যেতে চায় তাহলে লেবুর রস ও চিনি গোলা পানি ভিন্ন পাত্রে নিয়ে তুলোতে ভিজিয়ে মেহেদির প্রলেপের ওপর আস্তে আস্তে চেপে চেপে দেবেন। এতে পেস্ট ঝরে পড়বে না।

৫. দুই থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত মেহেদি হাতে রাখা উচিত। পুরো মেহেদি শুকিয়ে যাবার পর ভোঁতা ছুরি কিংবা চামচ দিয়ে তুলে ফেলবেন।

৬. মেহেদি ওঠানোর পরে হাতে একটু চিনির সিরাপ লাগিয়ে নিলে রঙ ভালো হয়। তারপর ৪/৫ মিনিট আগুনে হাত সেঁকে নিন।

৭. পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে হাতে সরিষার তের মেখে নিন। সম্ভব হলে পরবর্তী ছয় ঘণ্টা পানি লাগাবেন না। সাবান পানি থেকে হাত যতটা সম্ভব দূরে রাখুন।

৮. চুলের জন্য চুল ভালোভাবে শ্যাম্পু করে শুকিয়ে নিতে হবে। চিরুনি ও ব্রাশ দিয়ে

৯. মেহেদি কেনার আগে অবশ্যই ভালো কোম্পানি দেখে মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ দেখে নিবেন।



ইন্সট্যান্ট মেহেদীর দাগ উঠানো সম্ভব নয়। ন্যাচারাল প্রসেসে নখ কিংবা ত্বকের পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই মেহেদীর দাগ দুরভিত হয়। এবং সেটাই উত্তম। সাধারনত ২ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত দাগ থাকে। তবে চাইলে এ সময়টি কমিয়ে আনা সম্ভব। সেক্ষেত্রে প্রচুর পানি দিয়ে বার বার ঘষতে হবে। ক্লোরিন ব্যবহারে দাগ হাল্কা হয়। ব্রাশে টুথপেষ্ট মিশিয়ে নিয়মিতভাবে ঘষলে উপকার পাওয়া যায়। Alpha-Hydroxy Acid or Beta Hydroxy acid দিয়ে ভিজিয়ে রাখলে দাগ হাল্কা হবে। যে কোন ফার্মেসীতে এটি পাওয়া যায়। তবে কোনভাবেই ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা উচিৎ নয় কেননা এটি ত্বকের ক্ষতি করে।



১১. শিল্পে মেহেদির ব্যবহার:

মেহেদী বা হেনা সুপ্রাচীন কাল থেকে চামড়া ও কাপড় ডাইংয়ে ব্যবহার হতো। শিল্প বিপ্লবের পরে এর ব্যবহার বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পরে। সুদান, মরক্কো, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, চীন ও অষ্ট্রেলিয়াসহ নানা দেশে বানিজ্যকভাবে হেনা উৎপন্ন হতে থাকে অর্গানিক ডায়িংয়ের জন্য। ভারতবর্ষের কৃষকদের এই সময় ইংরেজরা জোড়পূর্বক নীল চাষে বাধ্য করেছিল শিল্পে ইন্ডিগোর ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের জন্য। সিল্ক ও উল জাতীয় কাপড়ে কালচে গাঢ় লাল রংয়ের জন্য হেনা ব্যবহৃত হয়। পার্শিয়ান কার্পেটেও এর ব্যবহার হয়। চামড়ার সাথে লৌহ ও লবনের সংমিশ্রনে dark-blue or greenish-black রঙ তৈরী হয়। হেনাসহ যেকোন প্রাকৃতিক তানিন পশুর চামড়ারকে ফ্লাক্সিবল ও ষ্ট্রং করে। চামড়ার রেসিন্ট্যান্স বাড়ায়। পরবর্তিতে কৃত্রিমভাবে তানিন আবিস্কৃত হবার পর এর চাহিদা খুবই কমে যায়। কিন্তু একাবিংশ শতাব্দিতে এসে উন্নত বিশ্বে অর্গানিক পন্যের নতুন চাহিদা তৈরী হয়। জাপানসহ পৃথিবীর উন্নতদেশের এক্সক্লুসিভ অনেক বায়াররা এখন অর্গানিক পন্যের দিকে ঝুকে পড়েছে বিধায় শিল্পে মেহেদীর নতুন করে চাহিদার তৈরী হয়েছে। পোষাক ও চামড়া শিল্প ছাড়াও অন্যান্য শিল্পেও মেহেদীর তানিন ব্যবহার হচ্ছে।



১২. মেহেদি গাছের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার তুলে ধরবো:

মেহেদীর পাতা, ফল ও ফুল ছাড়াও এর কাঠ ও বাকলের রয়েছে বহুবিধ ঔষধিগুণ। এর বাইরেও নানা প্রকারের ব্যবহারিক জিনস তৈরী মেহেদীর কাঠ ও বাকল দিয়ে। মেহেদীর কাঠের ফাইবার খুবই সুন্দর শক্ত প্রকৃতির। ভারতে এ কাঠ দিয়ে তাবুর ক্লিপ ও নানা প্রকার টুলসের হাতল তৈরী হয়। ইন্দোনেশিয়ায় মেহেদীর ডাল দিয়ে বানানো হয় টুথব্রাশ। মেহেদী গাছের বাকল দিয়ে কেনিয়ায় সুদৃশ্য বাস্কেট তৈরী হয়। তবে উৎকৃষ্টমানের জ্বালানি হিসেবে এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশী।



মেহেদি গাছের বিভিন্ন অংশের ঔষধিগুণঃ



শিকড় : লেপরোসি (Leprosy), স্কিন ডিজিজ, অ্যামের্নোহা (amenorrhoea), ডাইসমের্নোহা (dysmenorrhoea), প্রিমেচিউর গ্রেয়িং হেয়ার.

পাতা : বানিং সেনশন, ডাইরিয়া, ডিসেন্টিরি, লেপরোসি (leprosy), বয়েলস (boils), লিওকডেরমা (leucoderma), স্ক্যাবিস, এনেমিয়া(anemia), হেমোরহাগস ( hemorrhages), হেয়ার, হেয়ার গ্রেনেস, আমের্নোহা (amenorrhoea), এ্যান্ড জন্ডিস (jaundice).

ফুল : বানিং সেনশন, কারডেওপ্যাথি (cardiopathy), এমেনিয়া (amentia), ইনসোনিয়া (insomnia), এ্যান্ড ফিভার (fever).

ফল : ইন্টেলেক্ট প্রোমটিং (Intellect promoting), কন্সটিপেটিং (constipating), ইন্টারমিটেন্ট ফিভারস (intermittent fevers), ইন্সানিটি (insanity), এমেনিয়া (amentia), ডাইরিয়া, ডিসেন্টিরি, এ্যান্ড গ্যাস্ট্রোপ্যাথি (gastropathy).



১৩. মেহেদির ঔষধি গুণঃ

মেহেদী মানব সমাজের জন্য প্রকৃতির এক অনবদ্য দান। এর রয়েছে এন্টি ফাঙাল, এন্টি মাইক্রোবিয়াল, এন্টি ব্যাকটেরিয়াল, এন্টি-ইনফ্লেমেটরী, কুলিং, হিলিং ও সিডেটিভসহ অনেক গুনাগুণ যা মানব দেহ ও মনের বিভিন্ন রোগ প্রশমনকারী। তাই হাজার হাজার বছর ধরে মানব জাতি পাথ্য হিসেবে মেহেদী গাছের বিভিন্ন অংশ নানা কারনে ব্যবহার করে আসছে। এর ঔষধি গুণাগুণের ব্যাপকতা এত বিশাল যে দু একটি পর্বে তা সম্পর্কে সাম্যক কোন ধারণা দেয়া সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করবো পরবর্তি প্রতিটি পর্বে কয়েকটি রোগ নিয়ে কথা বলতে।



জন্ডিস, শ্বেতপ্রদহ ও শুক্রমেহ রোগে মহেদী গাছের ব্যবহার:

১. জন্ডিস : আঙুলের মতো মোটা মেহেদি গাছের মূল (কচি হলে ভালো) অর্ধভাঙা আতপ চাল ধোয়া পানি দিয়ে ঘষে (চন্দন পাটায় ঘষলে ভালো হয়) দুই চা চামচ পরিমাণ নিয়ে ৮-১০ চামচ ওই চাল ধোয়া পানি মিশিয়ে সকালে ও বিকেলে দুই বার খেতে হবে। এভাবে চার-পাঁচ দিন খেলে আরোগ্য হয়। এ সময় ডাবের পানি বা আখের রস খেলে কাজ হবে না।

২. শ্বেতপ্রদহ (Leucorrhoea) : ২৫ গ্রাম মেহেদিপাতা সিদ্ধ করে সেই পানিতে উত্তর বস্তি (ডুস দেয়া) দিলে সাদাস্রাব ও অভ্যন্তরে চুলকানি (Itching) প্রশমিত হয়। স্থানভ্রষ্ট জরায়ুর ক্ষেত্রেও উপরোল্লিখিত পদ্ধতি প্রয়োগ করলে অসুবিধা কমে যায়।

৩. শুক্রমেহ রোগ : মেহেদী পাতার রস এক চা চামচ দিনে দুই বার পানি বা দুধের সাথে একটু চিনি মিশিয়ে খেলে এক সপ্তাহের মধ্যে উপকার পাওয়া যায়।



১৪. মেহেদির ঔষধি গুণঃ মাথা ও চুলের বিভিন্ন রোগে মহেদী গাছের ব্যবহার :

ইউনানি চিকিৎসকদের মতে চুল উঠে যাওয়া বা পাকায় একটি হরীতকী ও ১০-১২ গ্রাম মেহেদিপাতা একটু থেতো করে ২৫০ মিলি পানিতে সিদ্ধ করে ৬০-৭০ মিলি থাকতে নামিয়ে ছেঁকে ঠান্ডা হলে মাথায় লাগালে উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়া খুশকি দূর করতেও এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক মেহেদীর ভিতরে এক প্রকারের প্রাকৃতিক এসিড রয়েছে যা এন্টি ফাঙাল, এন্টি মাইক্রোবিয়াল ও এন্টি ব্যাকটেরিয়াল যা চুলকে লম্বা, উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান করে। এটি চুল পড়াও রোধ করে। অনেক বিশেষজ্ঞ মেহেদীকে বলেছেন পৃথিবীর সেরা কন্ডিশনার। প্রাকৃতিক মেহেদী পেস্ট মাথা ঠান্ডা রাখে ও মাথা ব্যাথা দূর করে। ২৫০ গ্রাম সরিষার তেল একটি পাত্রে সিদ্ধ করার সময় ৬০ গ্রাম হেনা পাতা ক্রমান্বয়ে যোগ করা হয়; তারপর একটি কাপড় দিয়ে ছেঁকে বোতলে সংরক্ষণ করা হয়। এটি নিয়মিত মাখলে চুলের স্বাস্থ্যবান বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এটি মাথার টাকের চিকিৎসারও সহায়ক।



১৫.মেহেদির ঔষধি গুণঃ স্কীন ও ওরাল ডিজিজ : অত্যান্ত উপকারি ভেষজ হেনার পাতা ও ফুল হতে আহরিত তেল অনেক চর্ম-মলম তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। চামড়ায় ক্ষত, পোড়া ও চামড়ার ফ্যাকাসে হলুদ দাগ চিকিৎসায় অত্যান্ত কার্যকরী ঔষধ হিসাবে ব্যবহার হয়। স্কেবিস, চর্মের চুলকানি জাতীয় ও নখের ফাটার চিকিৎসায় হেনা পেস্ট ব্যবহার হয়। ত্বকের বিভিন্ন রোগ যেমন- একজিমা, খোসপাঁচড়া, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন, ঘা, কুষ্ঠু, শ্বেতী ইত্যাদি রোগে মেহেদিপাতার রস উপকারী। পাতার রস দিনে দুই বার আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। এ ছাড়া যাদের গায়ের বা মুখের চামড়া কুঁচকে ঢিলে হয়ে বা ঝুলে গেছে, তারা এই পাতার রস দিয়ে তৈরি তেল মাখলে অনেকটা স্বাভাবিক হবে। গরমকালে যাদের শরীওে ঘাম বেশি হয়ে দুর্গন্ধ হয় তারা বেনামূল (Vetiveria zizanioides) মেহেদিপাতা সিদ্ধ পানিতে গোসল করলে উপকার পাবেন। দেহ হতে পানি হ্রাস প্রতিরোধ করে; আবার ময়েশ্চার ধারণের ফলে কোন অঙ্গ স্ফিতীর রোধে এক প্রকার ডিসল্ভিং ফ্যাক্টর গঠনে কাজে লাগে। হাত-পা জ্বালায় পাতার পেস্ট পুরু করে লাগিয়ে রাখলে উপকার পাওয়া যায়। কারণ মেহেদিতে আছে শীতলকারক উপাদান। গর্ভবতী মায়ের ৮ মাসের সময় তার নাভীসহ গোটা তলপেটে মেহেদীর ভরাট ডিজাইন করলে গর্ভজনিত কারণে চামড়ার ফাঁটা ও দাগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।



পাঁচ-সাত গ্রাম পাতা জ্বাল দিয়ে সেই গরম পানি দিয়ে দিনে তিন-চারবার গড়গড়া করলে মুখ ও গলার ক্ষত সেরে যায়। দীর্ঘস্থায়ী কাঁশি সারতে ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে এ চিকিৎসা কার্যকর। মেহেদী পাতার সাথে অল্প খয়ের মিশিয়ে দাঁতের গোড়ায় লাগালে পায়োরিয়া সেরে যায়। মেহেদীর ডাল দিয়ে উত্তম মেসওয়াক তৈরী করা হয় যা দাঁতের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।



১৬. মেহেদির ঔষধি গুণঃ মানসিক স্বাস্থ্য : অনিদ্রাসহ নানা রকমের মানসিক অসুখের দাওয়া হিসেবে প্রাচীন কাল থেকে মানুষ মেহেদী ব্যকহার করছে। আগের দিনে নবাব বাদশাহদের অনিদ্রা (Insomnia) রোগ হলে ইউনানি চিকিৎসকেরা মেহেদি ফুলের বালিশে ঘুমানোর পরামর্শ দিতেন। ফুলে আছে লাইলাকের (আধুনিক এক প্রকার প্রসিদ্ধ সুগন্ধি) গন্ধ। চরক সংহিতায় বলা হয়েছে গন্ধটি পার্থিব সত্তায় সমৃদ্ধ এবং বায়ুবাহিত হয়ে নাসারন্ধ্র পথে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। তখনই মন হয় অন্তর্মুখী, সেটাই নিদ্রার পূর্বরূপ। আস্তে আস্তে আসে স্নায়ুতন্ত্রের অবসাদ, তারই বাস্তবরূপ তন্দ্রা। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যাদের শরীরে মেহেদীর অলংকরণ থাকে তারা তুলনামূলকভাবে সুখী ও পরিতৃপ্ত মানুষ।



১৭. মেহেদির ঔষধি গুণঃ অন্যান্য রোগ : মাথাব্যাথা, জ্বর ও ভিটামিন-বি এর ঘাটতি জনিত পায়ের পাতার জ্বালা পোড়ার ক্ষেত্রে দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে স্বস্তি প্রদান করতে পারে। এর ফুলের পেস্টের সাথে ভিনেগার মিশিয়ে কপালে প্রয়োগ করলে রৌদ্রজনিত কারণে মাথা ব্যাথার উপশম হয়। গলা ব্যাথা উপশমে হেনা পাতা দিয়ে গরম করা পানি দিয়ে কুলকুচা করা যায় বা আক্রান্ত স্থানে প্রয়োগ করা যায়। অস্থিও জোড়ায় প্রদাহ, ফোলা ও থেতলে যাওয়া অঙ্গে পাতার পেস্ট স্থানীয়ভাবে প্রয়োগ করা যায়। মেহেদী পাতার রস ও সরিষার তেল মালিশ করলে ব্যাথা কমে। মেহেদী পাতার রস গরম করে দুই ফোঁটা করে চার-পাঁচ দিন কানে দিলে কান দিয়ে পুঁজ পড়া বন্ধ হবে। আবার অনেকে এই পাতার রস দিয়ে তৈরি তেলও ব্যবহার করে থাকেন। অল্প কয়েকটা পাতা থেঁতো করে, গরম পানিতে ফেলে রেখে কিছুক্ষণ পরে ছেঁকে সেই পানির ফোঁটা চোখে দিলে চোখ ওঠা রোগ ভালো হয়। বাকলের রস জন্ডিস, প্লীহা বড় হয়ে গেলে, কুষ্ঠ এবং সহজে সারে না এমন চর্মরোগ নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। প্রাচীনপন্থী বৈদ্য সমপ্রদায়েরর মতে, শরীরে হিমোগ্লোবিন সঠিক পরিমাণে আছে কি না জানার জন্য মেহেদিপাতা ব্যবহার করা হয়। মেহেদিপাতা বাটা হাতের তালুতে লাগালে রঙটা লালচে আভা দিলে ভালো, না হলে হিমোগ্লোবিন কম আছে বলে ধারণা করা হয়।



১৮.পাশ্চত্য চিকিৎসায় মেহেদিঃ

পাশ্চাত্যে কিছু চিকিৎসা বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখিয়েছে মেহেদী ব্লাড প্রেসার কমায়, হার্টবিট নিয়ন্ত্রন করে, পেশী সংকোচন রোধ করে। মেহেদী জ্বর, ব্যাথা, জ্বালা ও উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর। দেহের আভ্যন্তরীন ক্ষতের চিকিৎসায় বিশেষত পাকিস্থলির প্রটোজন ইনফেকশন, নেমাটোড ওর্মস্ দ্বারা তৈরী ইনফেকশন সারাতে মেহেদীর এ´ট্রাক্ট্স (Extracts) ব্যবহৃত হয়। ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্য মেহেদীর Antimicrobial preparations এর প্যাটেন্ট লাভ করেছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে মেহেদীর দুটি উপাদান লসোন (lawsone) ও আইসোপ্লামবাজিন (isoplumbagin) ক্যান্সার প্রতিরোধক এবং মেমব্রন ড্যামেজ (membrane damage) থেকে সিক্ল সেলের (sickle cells) সুরক্ষা দেয়।



১৯. ইসলাম ধর্মে মেহেদিঃ

১৫০০ বছর ধরে মুসলিম নারীরা মেহেদী ব্যবহার করে আসছে। নবীজি মুসলিম নারীদের হাতে মেহেদীর নক্সা করাকে উৎসাহিত করতেন। নবী কন্যা ফাতেমা নিয়মিত হাতে মেহেদীর ডিজাইন করতেন। নবীজী নিজেও তার দাড়িতে মেহেদী ব্যবহার করতেন। ইসলামী খেলাফতের সময় থেকে মুসলিম বিশ্বে মেহেদীর ব্যবহার ধর্মীয় রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

রাসূলে পাক (সা:) মেহেদির পাতাকে বিভিন্ন রোগে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতেন। (১) ফোড়া পাকানোর জন্য (২) শরীরে কাঁটা ফুটলে, (৩) মাথাব্যথায়।- হজরত সালমা বিনতে উম্মে রাফে (রা:) হতে বর্ণিত আছে, ‘যখনই রাসূলে পাক (সা:)-এর কোনো ফোড়া, পাঁচড়া বের হতো অথবা কাঁটা বা এই প্রকারের কিছু ঢুকে যেত, তখনই রাসূলে পাক (সা:) আমাকে বলতেন এর ওপর মেহেদি লাগিয়ে দাও।’ (মিশকাত, তিরমিযী)

- অন্যত্র এক হাদিসে ইবনে মাজার বরাত দিয়ে আল্লামা ইবনে কাইয়্যুম (রহ:) বলেন যে, যখন রাসূলে পাক (সা:)-এর মাথাব্যথা দেখা দিত তখনই তিনি মাথায় মেহেদি লাগাতেন এবং এরশাদ ফরমাতেন, ‘আল্লাহর হুকুমে এটা মাথাব্যথার শেফাদানকারী।’ কিতাবুল মুফরাদাতের উদ্ধৃতি

মেহেদি রক্ত পরিষ্কারকারী এবং চর্মরোগের জন্য উপকারী। কুষ্ঠরোগী, আগুনে পোড়া এবং পান্ডব রোগের জন্যও মেহেদির ব্যবহার খুব উপকারী। মেহেদির প্রলেপ ফোলা, ফোস্কা, আগুনে চামড়া পুড়ে যাওয়া রোগীর জন্য খুবই উত্তম প্রতিষেধক। মেহেদির ঠান্ডা বৈশিষ্ট্যের কারণে এটা হয়ে থাকে। (কিতাবুল মুফরাদাত, খাওয়াসুল আদভিয়া, পৃষ্ঠা : ৩৫২)



২০. মেহেদির খ্রী.পূ. ইতিহাস ক্রোনলজিঃ

খ্রী.পূ. ৩৪০০ : মিশরীয় পিরামিডে প্রথম মমির চুলে মেহেদীর ব্যবহার আবিস্কৃত হয়

খ্রী.পূ. ১৯০০-১৫৫০ : ঐবহহধবফ মানুষের ক্যানন প্রদেশের জেরিকোতে পরচুলে মেহেদীর ব্যবহার আবিস্কৃত হয়

খ্রী.পূ. ১৩০০-১২০০ : ইউগ্রীসের বাল ও আনাথের কিংবদীন্তে মেহেদীর উল্লেখ পাওয়া যায়

খ্রী.পূ. ১৪০০-১১০০ : গ্রীসের সুগন্ধি শিল্পে মেহেদীর ব্যবহার শুরু হয়

খ্রী.পূ. ১২০০-১১০০ : ইউগ্রীসে ঔষধের ব্যবস্থাপত্রে মেহেদীর উল্লেখ পাওয়া যায়

খ্রী.পূ. ১২০০-১১০০ : মিশরের মমিতে মৃতদেহের নখে মেহেদীর রং পাওয়া যায়

খ্রী.পূ. ৫০০-৩০০ : হযরত সোলাইমান (সাঃ)-এর সময় রচিত পবিত্র সংগীত সঙ অব সঙসে একটি মিষ্টি ওষুধের নাম হিসেবে মেহেদীর নাম রয়েছে

খ্রী.পূ. ৪০০-১০০ : গ্রিক সুগন্ধি ছাড়াও রঞ্জক হিসেবে মেহেদির ব্যবহারের কথা গ্রিক কবিগণ লিখে গিয়েছেন।

খ্রীষ্টের জন্মের ১০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত : গ্রিক ও রোমান প্রকৃতিবিদ ঈধহধধহ এবং মিশরে একটি ঔষধ এবং একটি ডাই হিসাবে মেহেদির ব্যবহার বর্ণনা রয়েছে।



২১. পাশ্চত্য সভ্যতায় মেহেদিঃ

মেহদেী বা হেনা ডিজাইনের প্রাচীন ওরিয়েন্টাল ঐতিহ্য সারা পৃথিবীর মানুষ আজ গ্রহণ করেছে। পাশ্চাত্যে ঔষধি হিসেবে মেহেদীর ব্যবহার থাকলেও চুলে মেহেদীর ব্যবহার উনবিংশ শতাব্দিতে আর পাশ্চাত্যে বডি ডেকরেশনে মেহেদীর ব্যবহার ৮০ এর দশক থেকে। একাবিংশ শতাব্দিতে এসে পাশ্চাত্যে এখন যেকোন উৎসব যেমন মিউজিক ফ্যাষ্টিভল, হেনা পার্টি, গডেস পার্টি (goddess parties) অথবা নারীদের যে কোন গেট টুগেদারে মেহেদীর ব্যবহার আজ একটি স্বাভাবিক অনুষঙ্গ।

ইউরোপে মেহেদীর বাজার তৈরী হয়েছে মূলত তুরস্কের মাধ্যমে। তুর্কি নারীদের দেখে ইউরোপের নারীরাও হেনা ব্যবহারে আগ্রহী হয়। হেনা ছাড় অন্যকোন প্রাকৃতিক উপায়ে এই রঙ হয় না। আধুনিক সময়ে বিশ্ব বিখ্যাত কিছু সেলিব্রেটি যেমন Madonna, Gwen Stefani, Yasmine Bleeth, Liv Tyler, Xenaসহ পাশ্চাত্যের অনেক রোল মডেল গর্বিতভাবেই মেহেদী ব্যবহার করে। ১৯৯৮ সালে ম্যাডোনার মিউজিক ভিডিও “Frozen” -এ কোটি কোটি দর্শক দেখলো তার হাতের মেহেদীর ডিজাইন। ইউরোপ ও আমেরিকায় হেনা টাট্টু এখন খুবই জনপ্রিয়।



১৮৮০ সালের দিকে পাশ্চাত্যে নারীদের ভিতরে লালচুলের জনপ্রিয়তা হঠাৎ করেই ব্যাপক বেড়ে যায়। ১৮০০ শতাব্দিতে ইউরোপের শিল্প-সংস্কৃতিতে এসথেটিক মুভমেন্ট (Aesthetic Movement) ও প্রি-রফেলাইট (Pre-Raphaelite) আন্দোলনের সাথে জড়িত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেত্রীরা মেহেদীকে জনপ্রিয় করে। পরবর্তিতে এলিজাভেদ সিডল (Elizabeth Siddal) অপেরা শিল্পী এডলিনা পাতি (Adelina Patti), পার্সিয়ান কাটেসান কোরা পার্ল মেহেদী রাঙা চুলকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ১৯৫০ সালে জনপ্রিয় টেলিভিশন শো ও Love Lucy তে লুসি রিকার্ডো ও লুসলি বল পাশ্চাত্যে প্রাচ্যের ন্যায় মেহেদীকে জনপ্রিয় করে।

আমেরিকায় রাস্তার ধারের ট্যাট্রু শপগুলোতে Temporary Tattoo হিসেবে কালো মেহেদীর ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। কিন্তু কালো মেহেদীতে PPD (Para-phenylenediamine) থাকায় তা মূলত চুলের জন্য তৈরী হয় ত্বকের জন্য নয়। কালো মেহেদী ব্যবহার করায় অনেকের ত্বকে সমস্যা তৈরী হয়। ১৯৯৭ সালে আমেরিকায় FDA (Food and Drug Administration) বডি ডিজাইনে কালো মেহেদীর ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। বডি ডিজাইনে প্রাকৃতিক মেহেদী ব্যবহারের জন্য পেশাদার বিউটিশপকে বিশেষ লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ICNHA (International Certification for Natural Henna Arts) নামক সংগঠনটি বিশ্বব্যাপি পেশাদার মেহেদি শিল্পীদের আর্ন্তজাতিক সনদ প্রদান করে।



২২. ডিজাইন এবং প্রতীকীবাদ : সংস্কৃতিভেদে মেহেদীর ডিজাইনে ভিন্নতা আছে সত্য তবুও কিছু কিছুল সিম্বল বা চিহ্ন ব্যবহার করা হয় যার কিছু সার্বজনিন জন্মার্থ রয়েছে। কয়েকটি সিম্বলের অর্থ আপনাদের জানাবো :



জয়েনিং লাইণ - জীবনের দ্বৈততা

ত্রিভুজ ঊর্ধ্বমুখী - পুরুষ চিহ্ন,যা আগুন এবং স্বর্গ আরোহনের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিক

ত্রিভুজ নিম্নমুখি- নারী চিহ্ন জল এবং স্বর্গ থেকে সাজানো নারীর প্রতিক

স্টার - দেবত্ব এবং আশার উপস্থিতি

ফাইভ পয়েন্ট স্টার - পাঁচটি উপাদান-আগুন, পানি, মাটি, বায়ুু এবং স্বর্গ

স্কয়ার - স্থায়িত্ব, সততা এবং আশ্রয়

ডায়মন্ড - আলোকায়ন (&enlightenment)

অষ্টভূজ (Octagon) - সুরক্ষা

ক্রস - মহাজাগতিক প্রতীক

বৃত্ত - অন্ডতা চিহ্নিত

অর্ধচন্দ্র - নবজাতক

সূর্য - জ্ঞান ও অমরত্ব

পদ্ম - সতীত্ব, জীবন বৃক্ষ, নারীত্ব, বিশুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন

ময়ুর - প্রেম, বাসনা, আবেগ সৌন্দর্য,

উজ্জ্বলতা - কুমারিত্ব

খেজুর ডাল - উর্বরতা

ডান চোখ - সূর্য (পুংলিঙ্গ ক্ষমতা)

বাম চোখ - চাঁদ (স্ত্রীলিঙ্গ ক্ষমতা)



২৩. অন্যান্য ধর্মে মেহেদীর ব্যবহার : অনেকেই মনে করেন মেহেদী শুধু ইসলাম ধর্মেই ধর্মীয় অনুসঙ্গ বিবেচিত। কিন্তু আদতে মেহেদী প্রায় সকল ধর্মেই ঐতিহাসিক ভাবে আধ্যাতিকতার সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে মেহেদীর বর্ণনা রয়েছে। বাইবেলের কিং জেমস ভার্সনে মেহেদীর কথা উল্লেখ রয়েছে। ওল্ড টেস্টামেন্টে সং অব সংস্ (Song of Songs 7:11-13) এবং সঙ অব সলোমন এর ভিতর মেহেদীর কথা অনেকবার উল্লেখ হয়েছে। ভারত বর্ষে অজন্তা গুহায় আবিস্কৃত বৌদ্ধ দেয়াল চিত্রে মেহেদীর ব্যবহার দেখা যায়। সুশ্র“ত সংহিতায় মেহেদীকে বলা হয়েছে নখরঞ্জিকাহিসেবে। বেদে বলা হয়েছে 'ওগো মেন্ধে, তুমি আমার শরীরের দুটি বাহু, মনিবন্ধ ও অঙ্গুলিকে সাজিয়ে দাও, আমার প্রিয়তম আলিঙ্গন করে সুখী হবে।' এই বৈদিক তথ্যকে কেন্দ্র করে ভেষজের পরীক্ষা-নিরীক্ষালব্ধ জ্ঞান ভান্ডারকে মানবকল্যাণে কাজে লাগানো হয়েছে। মুসলমানরা দুটি ঈদ ও মহানবীর জন্মদিন ঈদে মিলাদুন্নবীতে মেহেদী ব্যবহার করে। হিন্দুরা দেওয়ালীসহ নানান পুজা পার্বনে, ইহুদিরা পুরিম ও পাসওভার উৎসবে, খ্রীস্টানরা বড় দিনে, জরোস্থ্রীয়ানরা (Zoroastrians) নওরোজ উৎসবে মেহেদী ব্যবহার করে। প্রায় সকল ধর্মাবলম্বিরাই বিয়ে অনুষ্ঠান, গর্ভধারণ, নবজাতকের জন্ম ও জন্মোত্তর বিভিন্ন সময়ে মেহেদীর ব্যবহার করে থাকে।



২৪. ঈদ উৎসবে মেহেদী ট্রেডিশন:

সারা পৃথিবীর মুসলিমদের মত আমাদের দেশেরও প্রধান উৎসব ঈদ। রমজানের ঈদ ও কোরবানীর ঈদ। শুধু বাংলাদেশেই নয় গোটা মুসলিম বিশ্বে দুটি ঈদে মেহদীর ব্যবহার একটি প্রবাহমান ঐতিহ্য।

ঈদ উল ফিতরঃ আরবী রমজান মাসের সংযমী ৩০ দিনের পরে আসে কাঙ্খিত ঈদ বা ঈদুল ফিতর। নতুন পোষাকের পাশাপাশি মেহেদীর সাজ আমাদের দেশেও বহু পুরাতন একটি ঐতিহ্যবাহী সামাজিক রীতি। সবাই মূলতঃ লোকজভাবে উৎপাদিত বাড়ির গাছ থেকেই পাতা সংগ্রহ করে মেহেদী পেস্ট বানাতো। অনেকে শুকনো মেহেদীপাতা গুড়ো করে বোতলে রেখে দিত। রমজানের শেষদিকে সেটি ব্যবহার করতো। পুরান ঢাকাসহ দেশের অনেক অঞ্চলে এ সময় মেহেদী উৎসব হয়। তবে বাঙালি নারী মেহেদী দেয় মূলত চাঁদ রাতে। সেই সাথে এটি শিশুদের জন্য ও একটি আকর্ষনীয় উৎসব। ঈদের নতুন চাঁদ উঠার সাথে সাথেই শুারু হয় মেহেদী লাগানো।

আরব সংস্কৃতিতে গ্রামীন মেয়েরা ঈদের আগের সন্ধ্যায় দলবেধে হাম্মাম খানায় যায়। একটি গ্রামে এক বা একাধিক হাম্মাম থাকে যেখানে অনেক লোক একসাথে গোসল করে। সারামাসের ক্লান্তি দূর করতে তারা ভালোভাবে গোসল করে। গায়ে সুগন্ধি মাখে। চুলে মেহেদী দেয়। হাত ও পায়ে মেহেদী দিয়ে নকশা করে। চোখে সুরমা দেয়। ঘোড়া, উট, কুকুর জাতীয় গৃহপালিত পশুদের মাথা ও লেজে মেহেদী ব্যবহার করে। পৌত্তালিক মুসলিম নারীরা শরীরকে রোম মুক্ত করে এবং অন্তর্বাস এলাকার স্কীনরাশ দূর করতে মেহেদী ব্যবহার করে। বাহারইনের ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ী গোষ্ঠি ঈদ উদযাপনের জন্য দল বেঁধে গাধার গাড়িতে করে নতুন কোন উৎসবস্থলে চলে যায়। তারা তাদের প্রিয় গাধাগুলোকে গোসল করায় এবং মেহেদী দ্বারা গাধাগুলোকে অলংকারিত করে। এসময় অধিকাংশ মুসলিম সমাজে বিয়ের ধুম পরে।



ঈদ উল আযহা : মহানবী হজরত মোহাম্মাদ (সঃ)-এর জন্মের ও প্রায় ২৮০০ বছর পূর্বে হজরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর মহান ত্যাগের মহিমাকে স্মরণ করে মুসলিম বিশ্বে ঈদ উল আযহা উদযাপিত হয়। খ্রী.পূ ২২০০ থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত আরবরা সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য ও পাপমুক্ত হওয়ার বাসনায় ধহ ধহহঁধষ ংঢ়ৎরহমঃরসব ংধপৎরভরপব ড়ভ ধহরসধষং হিসেবে পশু জবাই করতো। এই পশুগুলোকে জবাইয়ের কয়েকদিন আগে থেকেই মেহেদী দিয়ে সাজাতো। মহানবীর সময় ইসলাম যখন সৌর বছর থেকে চন্দ্রবছরে আবর্তিত হল তখন কোরবানীর বিধি বিধান প্রবর্তিত হয়। রিচুয়াল হিসেবে কোরবানীতে মেহেদীর ব্যবহার অব্যাহত থাকে। আরব বিশ্বে মুসলিম বিয়েতে মেহেদী সন্ধ্যায় যেভাবে কনেকে সাজানো হয় কোরবানীর পশুকেও তেমনি কনের ন্যায় প্রিয় করে তোলতে মেহেদী, সুরমাসহ ফুল দিয়ে সাজানো হয় পরিবারের প্রিয় একজন সদস্যের মত। পশুর গা নকশাকৃত চাদর দ্বারা আবৃত রাখা হয়। পার্সিয়ানরা পশুর গায়ে কাশ্মিরী শাল জড়িয়ে রাখে ও জবেহ্র আগে পশুর মুখে মিষ্টি দেয় হয়। প্রায় সকল মুসলিম নারী এ সময় হাতে পায়ে মেহেদীর ডিজাইন করে। কুয়েতের বেদুঈনরা তাবুতে নাচ গানের অনুষ্ঠান করে। মুখে নেকাব পড়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে মেহেদীর আল্পনা করে মেয়েরা নৃত্য করে। উত্তর আফ্রিকার কিছু দেশে কোরবানির আগে পশুকে মেহেদী পাতা খাওয়ানো হয়। খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই জবেহ্ করে। মরক্কোতে জবাইকারীর দুই হাত মেহেদী রাঙানো থাকে।



২৫. মেহেদী সন্ধ্যা :

পশ্চিমা দুনিয়ায় ব্রাইডাল শাওয়ার, বা রিহার্সাল ডিনার বলে বিয়েপূর্ব একটি অনুষ্ঠান হয়। ব্যাচেলর নাইট বলেও বরকে কেন্দ্র করে একটি বিয়েপূর্ব পশ্চিমা রীতি রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠি ঐতিহ্যগতভাবে বিয়েপূর্ব সার্বজনীন যে অনুষ্ঠান উদযাপন করে সেটি হলো মেহেদী সন্ধ্যা বা হেনা নাইট যা বিশ্বের দাম্পত্য ধর্মানুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। মধ্য ও উত্তর আফ্রিকা, ভূমধ্য সাগরীয় কিছু দেশ, গোটা মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়াসহ দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশের প্রায় সকল ধর্মেই নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী বিচিত্রভাবে হেনা নাইট উদযাপন করে।

আমাদের দেশের মুসলিম সংস্কৃতিতে গায়ে হলুদ হল এক প্রকারের মেহেদী সন্ধ্যা। জাতি, ধর্ম, স্থান, তথা সংস্কৃতিভেদে আয়োজনের ভিন্নতা থাকলেও মূল কনসেপ্ট কনে সাজানো। বাংলাদেশে বর ও কনে আলাদাভাবে গায়ে হলুদ বা মেহেদী সন্ধ্যার আয়োজন করে তবে এটিও কিছুটা ব্যতিক্রম। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই সংস্কৃতিভেদে কিছুটা ব্যতিক্রম থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কমন অনেক বিষয় থাকে।

মেহেদী সন্ধ্যা মূলত কনের পারিবারিক উৎসব। কনের বন্ধু, শুভাকাঙ্খী ও নিকট আত্মীয়রা মূলত নিমন্ত্রিত থাকে। বিয়ের ঠিক আগের দিন কনের বাড়িতে এটি অনুষ্ঠিত হয়। ঘনিষ্ঠদের ভিতরে যদি মেহেদী শিল্পী না থাকে তবে পেশাদার মেহেদী শিল্পী নিয়ে আসা হয়। বাড়ির সাজসজ্জ্বা, কেক, মোমবাতি, কুকিজসহ আনুষঙ্গিক সকল সাজের ভিতরে মেহেদীর আল্পনা স্টাইলের ছাপ থাকে। আমন্ত্রিত অতিথিদের হাতেও ছোট করে একটি কমন ডিজাইন করে দেয়া হয়। খাওয়া-দাওয়া, নাচ-গান তো থাকেই। নানা জাতিতে মেহেদী সন্ধ্যা নিয়ে নানা প্রকারের সংস্কার ও বিশ্বাস বিদ্যমান রয়েছে

২৬. বিভিন্ন দেশে মেহেদী সন্ধ্যা :

বিয়ে উপলক্ষে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রীতি হিসেবে মেহেদী সন্ধ্যা পৃথিবীর একটি বৃহৎ বেশী জনগোষ্ঠির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়। লোকজ ঐতিহ্য হিসেবে মেহেদী সন্ধ্যা দেশ ও জাতিভেদে বেশ বৈচিত্রময়ঃ



প্যালেষ্টাইনী কনেদের কাছে বিয়ের পোষাকের সাথে মানানসই ফ্লোরাল ডিজাইন বেশী পছন্দের। খেজুর গাছ ও পাতা ডিজাইনও এখানে জনপ্রিয়।



তুরস্কে বিয়েতে মেহেদী সন্ধ্যা খুবই জমকালো হয়ে থাকে। কনের বন্ধু ও আত্মীয়রা গানের তালে নৃত্য পরিবেশন করতে থাকে যতক্ষন পর্যন্ত কনে না কঁদে। ক্রন্দন পর্বেও সাথে সাথে শুরু হয় মেহেদী লাগানো।



সৌদি আরবে বিবাহিত এক নিকট আত্মীয়া দ্বারা কনেকে সাজানো হয় তবে শর্ত থাকে যে নিকট আত্মীয়া এই মেহেদী শিল্পীকে অবশ্যই সুখী হতে হবে অন্যথায় কনের জন্য খারাপ ভাগ্য অপেক্ষা করবে।



তিউনেশিয়ায় বিয়ে উপলক্ষ্যে ৭দিন ব্যাপি মেহেদী উৎসব হয়। ৩য় দিন কনেকে সাজানো হয় ও বিয়ের পোষাক পরিধান করে। কনের হাত, পা ও শরীরে মেহেদীর ডিজাইন করা হয়। ৬ষ্ঠ দিনে বরকেও মেহেদী দেয়া হয়। মরুতানিয়াতেও বরকে মেহেদী ব্যবহার করতে হয়।



ভারতে কনের হাতে যতদিন মেহেদীর রঙ থাকবে ততদিন তাকে কোন গৃহকর্ম করতে হয় না। মেহেদীর রঙ যত উজ্জ্বল ও ভালো হবে কনে তত ভালো শ্বাশুড়ি পাবে। রঙ তারাতারি উঠে গেলে তা দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে বলে মনে করা হয়। পাকিস্তানে মেহেদী সন্ধ্যাকে বলা হয় জধংস-ঊ-ঐবহহধ যেটা বর ও কনে দু বাড়িতেই আলাদাভাবে উদযাপন করা হয়।



আলজিরিয়ায় কনের হবু শ্বাশুড়ি কনের জন্য গয়না ও সাজানোর সামগ্রী নিয়ে আসে ও তিনিই কনেকে সাজান।



সুদান একবার বিয়ে হলে কনেকে সারাজীবন মেহেদী দিতে হয় অন্যথায় সমাজ সেটি কটু দৃষ্টিতে দেখে।



২৭. গর্ভবতি মা ও নবজাতকের জন্য মেহেদী :

উত্তর আফ্রিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ ও ভারতে গর্ভবতী মায়েদের মেহেদী ব্যবহার রীতি প্রচলিত আছে। আধুনা পশ্চিমের নারীরাও এর ব্যবহার শুরু করেছে। গর্ভধারণের ৭ মাসের মাথায় মায়ের পেটে বৃহৎ আকারের মেহেদী দিয়ে ভরাট একটি ডিজাইন করা হয়। এ সময় মায়েদের পেটের চামড়া স্ফীত হয়ে ফেটে যায়। এটা ঠেকানোর জন্য মেহেদী সর্বোৎকৃষ্ঠ পন্থা। তাছাড়া এটি সান ব্লকেরও কাজ করে। এ ডিজাইনও অঞ্চল ভেদে আলাদা হয়ে থাকে।



জন্মের পরে নবাতজককে অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মেহেদী ব্যবহারের রীতি উত্তর আফ্রিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে প্রচলিত। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী সামাজিক অনুষ্ঠান। জন্মের ৭দিন পর প্রথম বারের মত শিশুর শরীর পরিস্কার করা হয় অলীভওয়েল অথবা মাখনের সাথে মেহেদী মিক্সড করে শিশুর শরীর ধৌত করে। চোখে সুরমা ও হাত-পায়ে মেহেদী দিয়ে শিশুকে অলংকৃত করা হয়। যদিও এটি সব সময় সব শিশুর জন্য স্বাস্থ্য সম্মত নয়। শিশুটি ছেলে সন্তান হলে তার সম্মানে একটি ভেড়া জবাই করে শিশুর নাম ঘোষণা করা হয়।



২৮. প্রাচ্যের সংস্কৃতিতে হেনা :

নৃবিজ্ঞানীদের মতে চীনে হেনার ব্যবহার প্রায় ২০০০ বছর ধরে। এতদ্বাঞ্চলে সবার আগে ক্যান্টনসহ দক্ষিণ চীন অঞ্চলে হেনার ব্যবহার শুরু। নৃ বিজ্ঞানী সি হান (Xi Han) মতে রোম কিংবা আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর থেকে ৩০৪ খ্রীষ্টাব্দে চীনে হেনা প্রথম আসে। মারিয়ান অথবা খুশান সাম্রাজ্য (Mauryan Dynasty or the Kushan Dynasty) এর থেকেই চায়না মূল ভূখন্ডে হেনা প্রবেশ করে। অনেকে অবশ্য মনে করেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আরব বনিকদের হাত ধরে চায়নায় প্রথম হেনা আসে। বৌদ্ধ সভ্যতার প্রাথমিক সময়কার বেশ কিছু তথ্য অনুযায়ী মেহেদী তাদের কাছেও খুব পবিত্র বিষয়। অনেকের ধারনা গৌতম বুদ্ধ নিজেও মেহেদী ব্যবহার করতেন। কিন্তু বুদ্ধের সময় (খ্রী.পূর্ব ৬শতক) থেকে ৫শত বছরের ও পর আবিস্কৃত হয় অজান্তা গুহাচিত্র কিংবা শ্রীলংকার গুহা চিত্র। চীনের ট্রেডিশনাল মেডেসিনে (TCM) হেনার ব্যবহার অনেক পুরোনো যদিও অনেকেরই ধারণা তিব্বতীয় Traditional Tibetian Buddist Medicine (TTBM) থেকেই চীনারা হেনার মেডসিনাল ব্যবহার শিখেছে।



জাপানে হেনা সংস্কৃতি বিকশিত চীনাদের হাত ধরে। জাপনে স্থানীয় সংস্কৃতিতে ট্যাটুর ব্যবহার অনেক পুরনো। জাপানী মাফিয়া ইয়াকুজারা ঐতিহ্যগতভাবে সারা শরীরে ট্যাটু করে। ইয়াকুজার দীক্ষা নেয়ার সময় শিষ্যকে বুড়ো আঙুল নিজ হাতে কেটে গুরুদক্ষিণা দিতে হয়। তারপরই তার শরীরের প্রতি বর্গইঞ্চিতে ট্যাটু করা হয়। আধুনিক কালেও ইয়াকুজারা শহরের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করে। তবে স্থায়ী ট্যাটুর জায়গায় হেনা ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে। জাপানী ট্রেডিশনাল চিকিৎসায় ও হেনা ব্যবহার হয়। উল্লেখ্য চীন জাপানে এখনও হেনা বিত্তবানদের প্রসাধনী কিংবা মেডিসিন হিসেবে বিবেচিত। টাইওয়ান, কোরিয়া ও ফিলিপাইনসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মেহেদীর ব্যবহার প্রচুর। ইন্দোনেশিয়া ও অষ্ট্রেলিয়ায় ব্যাপকভাবে মেহেদীর চাষ হয়। চীনের ট্যুরিজম হেনা ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে একটি অত্যাধুনিক লাক্সারী ট্যুরিস্ট জাহাজের নাম রেখেছে হেনা।



২৯. আরব্য বসন্ত উৎসব:

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছে। সিরয়া, লেবানন, প্যালেষ্টাইনসহ এতদ্বাঞ্চলের মুসলিম, খ্রীষ্টান, ইহুদিসহ সকল ধর্মেও মানুষের মধ্যে এটা জনপ্রিয়। অর্থোডক্সদের ইষ্টার্ন সানডের পূর্ববর্তী ৬টি বৃহস্পতিবার এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। "Thursday-of-the-Animals" এটাই হলো উৎসবের থিম। প্রতি বৃহস্পতিবার নির্দিষ্ট একটি মাঠে সবাই জড়ো হয় তাদের সকল গৃহপালিত প্রানী নিয়ে। অংশগ্রহণকারীরা সবাই রঙিণ পোষাক পরিধান করে। গাড়ী, সাইকেল অথবা যে বাহনেই আসুক তা ফুল দিয়ে সাজানো হয়। উৎসবের মূল বিষয় হলো মেহেদী দিয়ে প্রানী সাজানো। এরাবিয়ান ঘোড়াগুলোর মাথায় মেহেদী দিয়ে সুন্দর ডিজাইন করা হয়। কেশর ও লেজের চুল মেহেদী দিয়ে রঙিণ করা হয়। তারপর সারা দিনের জন্য পশুগুলোকে উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। ঐদিন গৃহপালিত প্রানীরা কোন কাজ করবে না। সাধারণত তাদেরকে কোন বাঁধাও দেয়া হয় না। অধিকাংশ প্রানী প্রজননের কাজ সারে এই সময়। প্রানীদের সু-স্বাস্থ্য কামনা করে গান গাওয়া হয়। শেষ বৃহস্পতিবার মাঠ থেকে বাড়ী ফিরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাচ-গান করে।



৩০. হেনা - রাজপ্রসাদ থেকে কুড়েঘর :

রূপ, গুণ, বুদ্ধিমত্তা ও ত্যাগের কারনে হযরত আছিয়া (আঃ) কে ইসলামে বিশেষ স্থান দেয়া হয়। বনি ইসরাইলি গোষ্ঠির মেয়ে হয়েও রূপ, গুণের কারণে তাকে বিয়ে করেন ফারাও সম্রাট দ্বিতীয় রামেসিস বা ফারা আখেনাতেন যে ইসলামের দৃষ্টিতে পাপাত্মা ফেরাউন বলে পরিচিত। হযরত মুসা (আঃ)-এর অনুসারি হওয়ায় স্বামী ফেরাউনের অত্যাচারে হযরত আছিয়া (আঃ)-এর প্রাণ দিতে হয়। প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে হযরত আছিয়া (আঃ) নেফারতিতি (খ্রী.পূর্ব ১৩৭০-১৩৩০) নামে পরিচিত। মিশরের প্রাচীন পুথিপত্রে নেফারতিতিকে খুশি, আনন্দ ও ভালোবাসার প্রতিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মেহেদির ইতিহাসে পাওয়া যায়, নেফারতিতি রূপ লাবন্য ধরে রাখতে মেহেদীর ব্যবহার করতেন। মিশরের মমিতেও যেহেতু মেহেদী পাওয়া গেছে তাহলে ধরেই নেওয়া যায় ফারাও রাজ প্রাসাদে মেহেদীর খুব কদর ছিল।



ইতিহাসে সর্বকালের সেরা সুন্দরী ও আবেদনময়ী রানী ক্লিওপেট্রাও (৭) নিয়মিত মেহেদী ব্যবহার করতেন। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় শেষ ফারাও সম্রাট ক্লিওপেট্রা তার রূপ, লাবন্য ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বারবার মিশরকে বাঁচিয়েছিলেন। ক্লিওপেট্রার কারনে জুরিয়াস সিজারও রোমান সাম্রাজ্যে মেহেদীর প্রচলন করেছিলেন। রোমান সম্রাট অক্টোভিয়াসের হাত থেকে মিশরকে বাঁচাতে না পারায় খ্রী.পূর্ব ৩০ সালে ৩৯ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। তারকন্যা সেলেনা (ক্লিওপেট্রা-৮) মেহেদীর অনেক ব্যবহার জানতেন।



ভারতবর্ষে বৌদ্ধ সভ্যতার প্রাথমিক যুগে মেহেদীর ব্যবহার পাওয়া গেছে। খ্রীষ্টিয় ৪ শতকে ভারতীয় আদলতে বিচারকগণ চুলে মেহেদী ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। ভারতবর্ষে মোগল সম্রাজ্ঞী শাহজাহান পত্নি মমতাজের হাত ধরে মোগল হেরেম থেকে মেহেদী ব্যবহার পৌছে যায় জনগনের মাঝে। তৎকালীন মিশরীয় রাজা রাজ উপঢৌকন হিসেবে মেহেদী পাঠিয়েছিলেন মোগল সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগমের জন্য।



(এবারঈদ উপলক্ষ্যে মেহেদীর ব্যবসায় নেমেছি। এরআগে বিজ্ঞাপন নির্ভরকোন পণ্যের ব্যবসাকরেনি।টিভি বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি মাইটিভিতে রমজান মাসব্যাপি ‘আলফামেহেদী শো’ নামেএকটি অনুষ্ঠান শুরুকরেছি।সেমতে তথ্য সংগ্রহের নিমিত্তে এলেখা। মেহেদী সম্পর্কে যাদেরআগ্রহ রয়েছে তারাহয়তো উপকৃত হবেন। সংগৃহীত তথ্যঅধিকাংশই নেট থেকেনেয়া। আমি শুধু শতাধিকসাইট থেকে তথ্যনিয়ে আমার মতকরে সম্পাদনা করেনিয়েছি। যেহেতু ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার জন্যতৈরী তাই টাইমফ্রেমের দিকে তাকিয়েঅতিরিক্ত কাঁচি চালাতেহয়েছে বলে সুপাঠ্য নাওহতে পারে; তবেমেহেদীর ব্যাপকতা আপনাকেবিস্মিত করবে নিঃসন্দেহে)।



মন্তব্য ৫ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩৬

সোহেল সি এস ই বলেছেন: ব্যবসার সাফল্য কামনা করি। একটা প্রশ্নঃ টিউবে যেসব মেহেদী পাওয়া যায়, সংরক্ষনের জন্য এতে অন্য কিছু মিশ্রিত থাকে। এতে মেহেদী পাতা ছাড়াও কি কি ক্যামিকেল ব্যবহার করা হয়? এগুলো ক্ষতিকর কিনা? ধন্যবাদ।

২| ২১ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৫৬

সুমনজাহিদ বলেছেন: সোহেল সি এস ই-শুভকামনার জন্য ধন্যবাদ। অন্যদের বিষয় জানিনা তবে আমাদের দুটি ব্রান্ড, ‘আলফা একটিভ গোল্ড মেহেদী ’ও ‘এ্যাংকর ঝিলিক’ কোনটিই ত্বকের ন্যূনতম ক্ষতি করবে না। মেহেদীর ফর্মুলাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ৩ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পেষ্ট মেহেদী নিয়ে গবেষণা করে সন্তোষজনক অবস্থায় আসার পরই আমরা বাজারে এসেছি।

৩| ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:০৮

শরীফ হোসেন সাঈদ বলেছেন: গরমকালে যাদের শরীওে ঘাম বেশি হয়ে দুর্গন্ধ হয় তারা বেনামূল (Vetiveria zizanioides) মেহেদিপাতা সিদ্ধ পানিতে গোসল করলে উপকার পাবেনঃ

Vetiver সমন্ধে আমার একটু কৌতূহল ছিল! Vetiver এর বাংলা বেনামূল জেনে খুশি হলাম। এটা কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারেন? অথবা এর কোন আঞ্চলিক নাম আছে কি? উত্তর পেলে অনেক খুশি হব :)

৪| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ২:১০

তাহাসিন আহমেদ বলেছেন: আপনার অনুমতি সাপেক্ষে লেখাটি আমাদের অনলাইন দৈনিকে প্রকাশের অনুমতি প্রার্থনা করছি।

৫| ২৬ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১১:৪০

জল কনা বলেছেন: অনেক কিছু জানলাম! 8-| ঘরের মেহেদির তৈরি খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম এই পোস্ট! 8-| পোস্টের জন্য +++

আগে আমাদের একটা বুয়া ছিল, সে খুব সুন্দর করে মেহেদী পেস্ট বানায় আমাদের ছোট ভাই -বোনকে "মেহেদীর পেস্টের কোন" বানায় দিত!
ছোট ছিলাম! কি কি যে দিয়ে বানাতো মনে নাই! অনেক ভাল রঙ হইত! নেইল পলিস কি জিনিশ জানি না তখন। আম্মাও নখে মেহেদী লাগায় দিত এটাই মজা ছিল! ঈদ আগের আগের দিন মানে আঙ্গুলের মাথায় মেহেদী আর হাতের তালুয়ে বড় একটা গোল্লা :P

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.