নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুমনজাহিদ

T

সুমনজাহিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কিংবদন্তির কোলে দুই বছর- সুমন জাহিদ (ঢাকা কলেজ-৯১) -প্রথম পর্ব

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১৬

পরবর্তি প্রজন্মের কথা জানিনা, নিজেদেরটা বলতে পারি আমরা যারা ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম তাদের প্রায় সকলেরই জীবনে খুব সংক্ষিপ্ত অথচ সবচেয়ে আনন্দময়-উজ্জ্বলতম সময় তথা জীবনের টানিং পয়েন্ট ছিল ঢাকা কলেজের দুটি বছর। সর্ব্বোচ্চ বাউন্ডুলেপনার পরও আশ্চর্যজনকভাবে দিন শেষে প্রায় সবাই জয়ী হয়েছিলাম। স্মৃতির জাবর কেটে পিছনে ফিরলে একটু ভয়ও হয়তোবা লাগে, কেননা যে পরিমান পিচ্ছিল পথে আমরা হেঁটেছিলাম তাতে শুধু হোঁচটই নয়, সেই ঝুঁকিপূর্ণ পথে দুর্ঘটনাও দৈব ছিল না। আমাদের বর্নিল কলেজ জীবনের দু’বছরের দিনপঞ্জি স্ক্যান করলে যে চিত্রটি ভেসে উঠে তাকে বয়োঃসন্ধিকালের ডানপিটামি কিংবা দুষ্টামী বলে জাষ্টিফাই করাটা হয়তো ঠিক হবে না। নৈতিকতার মানদন্ডে এগুলোকে সরাসরি ক্রাইম না বলা গেলেও নিঃসন্দেহে এগুলো গর্হিত কাজই ছিল; আজকের প্রেক্ষিতে ট্যাবুও বলা যেতে পারে। গর্বকরে এগুলোর স্মৃতিচারণও কতটুকু ইতিবাচক কিংবা যৌক্তিক বলা মুস্কিল। আমাদের প্রজন্মকে আমি বলি স্বাধীন দেশের প্রথম মুক্ত প্রজন্ম। এই প্রজন্মের সবচেয়ে মেধাবীদের প্রথম তারুণ্যের দিনগুলো যদি পুরোটাই অব্যক্ত থেকে যায় তবে একটি দুর্দান্ত সময়ের ফ্রেম থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই হয়তো চিরদিনের মত হারিয়ে যাবে।







তিন দিক নদী দিয়ে ঘেরা দক্ষিণের প্রান্তিক জেলাশহর পটুয়াখালীতে আমার শিকড় প্রোথিত। মফস্বলের দুরন্ত শৈশব ছিল আমাদের। খুবই স্বপ্নময় সাহসী শৈশব। মধ্যবিত্ত পারিবারিক শাসন ও স্কুলের শৃঙ্খল ভাঙার দিনগুলোতে স্বপ্ন দেখতাম রঙিন এক অপার্থিব অলীক ভবিষ্যতের। দিন কাটে মাঠে আর গাছে। তারপর পদচারণা মফস্বলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আঞ্চলিক পর্যায়ে বরিশাল, বিভাগীয় পর্যায়ে খুলনা আর জাতীয় পর্যায়ে ঢাকায় আসতে হয়েছে অনেকবার। পিতার পকেট কেটে সঞ্চিত টাকা আর প্রতিযোগিতায় প্রাপ্ত যাতায়ত ভাতা বাঁচিয়ে একটা ওয়াকম্যান কিনলাম ঢাকা থেকে। বাজারে যত আবৃত্তির ক্যাসেট আছে প্রায় সবগুলোই কিনে নিয়েছিলাম। কাজী সব্যসাচী, গোলাম মুস্তফা, শিমুল মুস্তফা..। কোন এক ক্লাশে পাঠ্য ছিল কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতা। কবিতা আমার কৈশরকে খুবই আলোড়িত করেছিল। আবৃত্তিকারদের কন্ঠে কবিতাগুলো নির্জনে এক একা শুনতাম; কেননা দেবতার গ্রাস, উদ্বাস্তু, মাগো ওরা বলে, কবিতাগুলো শুনলেই, চোখের জল লুকাতে পারতাম না। ‘মধুর ক্যান্টিনে যাই, অরুনের চায়ের কাপে মুখ দিতে দিতে, বসু তোমাকে মনে পড়ে যায়; খুব মনে পড়ে’ শিমুল মুস্তফার কন্ঠে মোহন রায়হানের এই কবিতাটি যখন শুনলাম তখন মনে হলো বৃথাই এ জীবন, জীবনে যদি মধুর ক্যান্টিন, কবি শামসুর রাহমান, গোলম মুস্তফা কিংবা মোহন রায়হানের দেখা না পাই! টুকটাক লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতাও লিখি। কবি হওয়ারও যে বাতিক ছিলনা তা নয়। বাসায় মা খুব বই পড়তো। বাসার সামনেই পাবলিক লাইব্রারী। সুতরং বইয়ের প্রতি আগ্রহটা সহজাত। চানক্য সেনের ‘পুত্র পিতাকে’ বইটি পড়ে মাথা পুড়াই ওলট পালট। ইস যদি বাপ-মাকে একটু পড়াতে পারতাম! সেবা কিংবা হুমায়ুন আহমেদের ছেড়ে কবিতা, ইতিহাস কিংবা প্রবন্ধের বই বেশী ভালোলাগে এসএসসি পরীক্ষার পর। পটুয়াখালীতে আমাদের পাড়ায় সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল। আমার চাচা, মামা, খালা, চাচাতো ভাই মানে নিকটাত্মীয় প্রায় সকলেই আমাদের বাসায় থেকেই লেখাপড়া করেছে। আমাদের সবচেয়ে বড়ভাই (বড় চাচার বড় ছেলে) হারুন ভাইয়া ছিলেন আমার শৈশবের আইডল, তিনি ছাত্র ইউনিয়ন করতো। সুতরং স্কুল জীবনেই একটি রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে উঠেছিল। পাড়ার বড় ভাইরা অনেকেই ছাত্র রাজনীতি করে। তবে সবাই জাতীয় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। প্রায় সকলেই আমাকে মোটিভিশন করতো। পাশের বাসার মঞ্জুভাই একটু বেশী এগিয়ে ছিল। মঞ্জুভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিওলজিতে পড়তেন। আমার এসএসসি পরীক্ষার পর মঞ্জুভাই বললো তুই কি জানিস যাদের কবিতা পাড়স কিংবা শুনিস তারা কিন্তু প্রায় সবাই ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রেই যারা নেতৃত্ব দেয় তাদের সিংহভাগই ঢাকা কলেজের ছাত্র। স্কুল হিসেবে আমার পটুয়াখালী সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফলে বরাবরই জেলায় প্রথম হতো। যদিও গড়ে ৯০ শতাংশ ছাত্রই পাশ করতো প্রথম বিভাগে কিন্তু স্টার মার্কস পেত দু/তিনজন, বোর্ডে স্ট্যান্ড করতো দু’একযুগ পর। সেখানে প্রতি বছর ঢাকা কলেজের রেজাল্ট দেখে খুবই অবাক হতাম। ঢাকা বোর্ডে যতজন স্ট্যান্ড করে তার প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকা কলেজের। আমাদের স্কুলে যতভাগ ছাত্র প্রথম বিভাগ পায়, ঢাকা কলেজে ততভাগ পায় ষ্টার মার্কস। সুতরং তব্দা লাগারই কথা। এসএসসিতে যারা স্ট্যান্ড করে তারা যে কোন ধরণের চিড়িয়া সেটা দেখার খুব কৌতুহল ছিল। মানে তারা দেখতে কেমন, কি খায়, কি পড়ে এদের কি কোন বন্ধু থাকে, এইসব আর কি! শুধু খবরের কাগজেই দেখতাম; যদি একবার ছুঁয়ে দেখতে পারতাম; অন্ততঃ চর্মচোক্ষেও যদি একবার দেখা যায় ! মুগ্ধতার আরো কারন আছে, দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম কলেজ এমন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও প্রাচীন! এইসব ভাবছি। তার উপর মঞ্জুভাই বললো ঢাকা গিয়ে সোজা জহুরুল হক হলে আমার রুমে উঠবি। আমার বন্ধুরা বেশীরভাগই ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্র। কোন সমস্যা নেই। আমাদের শহর থেকে ঢাকায় আসতো খুব কম ছেলেরাই। হয় পটুয়াখালী না হয় বরিশাল বিএম কলেজ। প্রতি বছর দু’চারজন ঢাকা কলেজ কিংবা নটরডেমে টেষ্ট দেয় কিন্তু ঢাকা কলেজে কেউই টেকে না দু একজন টিকে তা নটরডেমে। এর আগে ৮৪র ব্যাচে একজন টিকেছিল জানতাম।







বাপ মাকে পটাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। এর আগের বছর বড়ভাই নটরডেমে চান্স পেয়েও ভর্তি হয়নি, হোস্টেল ছিল না বলে। আমাকে বলা হলো আমার ছোট চাচার বাসা, রামপুরায় ওঠার জন্য। আমি চাচার বাসায় না গিয়ে সদরঘাট থেকে সোজা উঠলাম জহুরুল হক হলে। রুম নম্বর ১০৫, গোটা হলের একমাত্র গণরুম। ঢাকা কলেজের ছাত্র হতে হবে, অনেক বড় বিষয়। অনেক স্মার্ট হতে হবে। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে। শুদ্ধভাষায় স্কুলে অনেকবার উপস্থিত বক্তৃতা দিয়েছি; কিন্তু আটপৌরভাবে বরিশাইল্লা ভাষা ছাইড়া শুদ্ধভাষায় কথা বলতে হবে! মাঝে মাঝে দু একটা ইংলিশ শব্দও ঝাড়তে হবে। খুব কঠিন। প্রতিটা বাক্য ডেলিভারীর আগে মনে মনে একবার রিয়র্সাল দেয়ার চেষ্টা চালাই। হলে মঞ্জুভাইর বিশাল ফ্রেন্ড ষ্টাফ। আবীর, ইকবাল, পিচ্চি শামীম, শিশির...। সবাই খুব মেধাবী ও নামী ছাত্রনেতা তার উপর প্রত্যেকেই ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্র, ভাবই আলাদা! গোটা ক্যাম্পাস তাদের সমীহ করে! ভীরু ভীরু মন নিয়ে সবার সাথে আলাপ হলো। একটু আড়ষ্টতা ছিল কিন্তু প্রথম দিনেই বড়ভাইরা বললো ‘কি মিয়া ডর লাগে! বরিশাইল্লা পোলা সিনা উঁচাইয়া হাঁটবা! খালি বই মুখস্ত কইরা ঢাকা কলেজের ছাত্র হওন যায় না! স্মার্টনেসও লাগে। মনদিয়া এ কয়ডা দিন পড়া লেহা করো, কোন কিছু না বুঝলে জিগাবা’। স্মার্ট হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ জিন্স, কেডস, টি শার্ট, সিগারেট..। একা একাই জিজ্ঞেস করতে করতে পদব্রজে গুলিস্তান গেলাম। গিয়ে শুনলাম বঙ্গবাজার নামে বিশাল নতুন একটি আজব মার্কেট হয়েছে। ‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন’ কি নাই এখানে! দরদাম করে শার্ট প্যান্ট কিনলাম। কেড্স কিনলাম এ্যালিফেন্ট রোড থেকে। স্কুল জীবনের শেষ দিকে রোজ দু’একটি সিগেরেট খেতাম। ঢাকায় এসে বাংলা ফাইভ ধরলাম। হলের ক্যান্টিনে ৬ টাকা দিয়ে ভাত খাই। রাতে যখন পড়তে বসবো তখন দেখি একে একে অনেক মানুষ রুমে আসছে এবং প্রায় সবাই রাজনৈতিক কর্মী। ১০/১৫ জন মানুষ রাতে থাকে এখানে। বুঝলাম এটি আসলে একটি শরণার্থী শিবির। শামীম ভাই একটি ঢাকা কলেজ ভর্তি গাইড নিয়ে আসলো। বললো বিগত দিনের প্রশ্নগুলো এখানে আছে, কোন জায়গায় সমস্যা হলে বলবা। বুঝলাম পড়াশুনা আর রাজনীতির বইরে সাইড ইনকাম হিসেবে গাইডের ব্যবসাও আছে শামীম ভাইর। প্রথম রাতে আমি আরো বুঝলাম এই রুমে থাকলে খালি বাঘ-হাতিই মারা হবে! ঢাকা কলেজে চান্স পাওয়া হবেনা! কি করা যায় চিন্তা করছি। আমি জানতাম যে কোন পাবলিক লাইব্রারীতে পড়াশুনার ভালো পরিবেশ থাকে। মনে মনে সিন্ধান্ত নিলাম লাইব্রারীতেই যাব। এর মধ্যে ঢাকা কলেজ ও নটরডেমে ভর্তিফর্ম ছেড়েছে। পরদিন ভোরে ফর্ম তুলতে গেলাম। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হলেও ফর্ম কিনলাম মানবিকের। বিজ্ঞান খুব নিরস লাগতো। বিশাল যুদ্ধ করে ফর্ম তুললাম; হঠাৎই দেখি দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল! বিশাল মারামারি, ঢাকা কলেজ আর সিটি কলেজ। কলেজ প্রাঙ্গনে প্রথমদিনেই সেইরকম অভিজ্ঞতা! কয়েক ঘন্টা আটকে থাকার পর হলে ফিরলাম। নিজে নিজে পাবলিক লাইব্রারী খুঁজে বের করলাম। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এখানে বসে পড়া যায়, খুবই সুন্দর পরিবেশ। সুতরং নতুন ঠিকানা শাহবাগের পাবলিক লাইব্রারী।







ঢাকা কলেজে ভর্তি না হয়েও আমার আজন্ম কিছু স্বপ্নসাধ ইতোমধ্যে পুরণ হতে শুরু হয়েছে। তার ভিতর একটি মধুর ক্যান্টিন। একদিন বড় ভাইরা নিয়ে গেলেন মধুর ক্যান্টিনে। অরুনদার সাথে হ্যান্ডসেক করালেন। বিশাল উঁচু করে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মধুর ক্যান্টিনে প্রথমবার কবি মোহন রায়হানকে দেখলাম। পরিচয় হলো এক সময়ের দুর্দান্ত মেধাবী ছাত্র নেতা ঢাকা কলেজের ৮০-৮১’র ছাত্র সংসদের ভিপি কামরুল ভাইর সাথে। বড় একটি জটলার কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি। কামরুল ভাই বললো মোহন রায়হান কিন্তু আমার সাথে ঢাকা কলেজের নির্বাচনে জাসদ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। আমরা ছাত্রসভাগুলোতে দেই বক্তৃতা আর মোহন পড়ে কবিতা। বুঝলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিও ঢাকা কলেজের সাবেকদের নিয়ন্ত্রনে। প্রতিদিন সকালে মধুর ক্যান্টিনে নাস্তা করে লাইব্রারীতে চলে যাই। জীবনে ব্রেড বাটার দিয়ে কখনো নাস্তা করিনি। এটা নাকি ব্রিটিশ ব্রেকফাস্ট। দুপুরে পাবলিক লাইব্র্রারীর ক্যান্টিনে খাই। কয়েক জায়গায় বাকীর সিস্টেমও করে ফেললাম।







আশৈশব এত বিস্ময়কর জিনিসগুলো দেখে দেখে বড় হয়েছি, এখন বিস্ময়বোধ অনুভূতিটিই অনেক ভোঁতা হয়ে গেছে। কোন কিছুই এখন আর আমাকে অবাক করে না। অথচ ঢাকায় আসার পর নিত্য বিষ্মোরিত হতে থাকে কৈশরোত্তর নির্মল চোখ। একদিন রাতে সবাই ঘুমে, আমি জেগে ছিলাম। দেখি রাজপুত্রসম হ্যান্ডসাম একজন রুমে ঢুকলো কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে। আমার বড়ভাইদেরও বড় তিনি। আমার সাথে হাত মিলিয়ে বললেন আমিও ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। রুমের ঠিক মাঝখানে অনেকগুলো পেপার বিছানো হলো। একটা গামলা ভর্তি কালো কেরাসিন নিয়ে আরো দুজন রুমে ঢুকলো। সবাই যেহেতু ঘুমে, তাই চাপা স্বরে কথাবার্তা হচ্ছে। সবাই গোল হয়ে মেঝেতে বসা, মধ্যখানে গামলাটি। তার ভিতর থেকে নানা প্রকার লোহার ছোট ছোট যন্ত্রাংশ তুলে শুকনো কাপড় দিয়ে পরিস্কার করে নীচে রাখছে। আমি পাশের চেয়ার টেবিলে, কোন কিছুই বুঝছি না। আমাকে বললো এদিকে তাকিয়ে না থেকে নিজের কাজ করো। আগান্তুক যন্ত্রাংশগুলোকে জোড়া দিচ্ছে।আড়চোখে দেখলাম মোটামুটি ভারী একটি যন্ত্র তৈরি হলো। কৌতুহল আর চেপে রাখতে পারলাম না, বললাম ‘ভাই কি জিনিস বানাইলেন?’। একজন পাশ থেকে ধমক দিল- তোমারে না তাকাইতে মানা করছে, চুপচাপ শুইয়া পড়ো। এই প্রথমবারের মত একটু ঘাবড়ে গেলাম। আগন্তুক আবার উল্টো তাকে ধমক লাগালেন, ওর সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন? আমাকে বললেন এটার নাম কাটা রাইফেল। আস্ত রাইফেল কেটে কোমরে বহনযোগ্য আকার দেয়া হয়েছে বলে দেখতে একটু কিম্ভুত মনে হচ্ছে।







নিজের চোখকে তখন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা বেশ কয়েক প্যাকেট গোল্ডলিফ পুরনো সিগেরেটের প্যাকেট বের করলো একজন। একটা খোলা হলো। বুঝতে পারলাম ওগুলো রাইফেলের গুলি। এত মেধাবী, এত হ্যান্ডসাম ছেলেগুলো শুধু অস্ত্রবাজই নয় অস্ত্রের কারিগর! মেধাবীদের একটু অফট্রাক হওয়া দোষের কিছু নয়, তাইবলে এতটা ডেয়ার ডেভিল! সে রাতে আর ঘুমাতে পারিনি।







মনে মনে ভাবছি যেভাবে বড় গলায় বড়ভাইরা আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, যদি চান্স না পাই তবে কেমনে সবাইকে মুখ দেখাবো! একটু জেদও চেপে গেল। সিন্ধান্ত নিলাম ঢাকায় পড়লে শুধু ঢাকা কলেজেই, অন্য কোন কলেজের ভর্তিফর্মও কিনবো না। নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা দিতে গেলাম। মনে আছে মঞ্জুভাই আর আবীর ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন। একটা গ্যালারী হলে আমার সীট। পরীক্ষা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। দৌড়ে পরীক্ষা কক্ষে প্রবেশ করলাম। এক ম্যাডাম ছিলেন দায়িত্বে; আবীর ভাইকে চেনেন। ‘আবীর, কেমন আছ তুমি? কে পরীক্ষার্থী?’ বললো ‘ছোট ভাই’। ‘ও তোম্গো ছোটভাই, লেইটতো একটু হবেই তাই না!’ অবশ্য মাত্র কয়েক মিনিট লেট। যাই হোক বেশ বুক ফুলিয়ে পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্টের দিন কাউকে না বলে একাই কলেজে গেলাম ; কেননা ভেবে রেখেছি যদি চান্স না হয় সেটি শুধু আমার জন্যই লজ্জাস্কর নয়, বড়ভাইরাও অনেকের কাছে ছোট হবে। তাই সিন্ধান্ত নিলাম দুঃসংবাদ হলে এখান থেকেই ভাগলপুর। মনে আছে সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট টানানো হয়েছে। প্রচুর ভীড়। কলেজের এক কোনায় দেখলাম একটি গ্রুপ হৈ হুল্লুড়ে মত্ত। বুঝলাম ওরা সবাই চান্স পেয়েছে। ভাবলাম একসাথে এতগুলো বন্ধু সবাই কেমনে চান্স পায়? পরে জেনেছি ওরা গভঃ ল্যাবরেটরিয়ান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ঢাকা কলেজের রাজত্ব, ঢাকা কলেজে আবার গভঃ ল্যাবরেটরির রাজত্ব। যাই হোক ভীড় ঠেলে দেখলাম বোর্ডে নামটি আছে। এক জীবনে অনেক অর্জন থাকে সত্য কিন্তু ঢাকা কলেজে যেদিন চান্স পেলাম এমন আনন্দময় দিন জীবনে আর দ্বিতীয়টি আসেনি। বৃষ্টি উপেক্ষা করে রিক্সা নিয়ে সোজা মধুর ক্যান্টিন। গিয়ে বড়ভাইদের খবরটি দিলাম, সবাই উৎফুল্ল হয়ে অভিনন্দন জানালো। মিষ্টি আমার খুব প্রিয় খাদ্য। মধুর ক্যান্টিনের মিষ্টিটা কিছুটা আমাদের সুধীর ময়রার মিষ্টির মতই সফট। সেদিন অনেকগুলো মিষ্টি খেতে হয়েছিল। যেই শুনে সেই ‘আমার পক্ষ থেকে একটি মিষ্টি খাও’। খুশীতে গদগদ হয়ে পটুয়াখালী ফিরলাম পটুয়াখালী ত্যাগের প্রস্তুতি নিতে।







এবার বাবার কঠিন নির্দেশ যতদিন হোস্টেলে সীট না পাই চাচার বাসায় থাকতে হবে। ঢাকায় এসে রামপুরায় উঠলাম। মধুতে গিয়ে সবার সাথে দেখা করলাম। কলেজে ভর্তি হলাম। রামপুরা থেকে ডাইরেক্ট কোন বাস ঢাকা কলেজ কিংবা নিউমার্কেট এলাকায় আসে না। মুড়ির টিন নামক একটি বাসে করে পল্টন আসতে হয়, ভাড়া আটআনা। সেখান থেকে আরেক বাসে কলেজে, ভাড়া ১ টাকা। কিছুটা জিপ গাড়ীর মতো দেখতে আজিব এক বাস এই মুড়ির টিন। এগুলো নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল মাল টানার জন্য। এর যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা বোধহয় আনলিমিটেড; অন্যান্য বাসের তুলনায় ভাড়া কম থাকায় এর দরজা-জানালা-বাম্পারেও লোক ঝুলে থাকে। দরজা দিয়ে যে পরিমান যাত্রী ঢুকে তার চেয়ে বেশী ঢুকে জানালা দিয়ে। জার্নিটা রক্তক্ষয়ী না হলেও খুবই ঘর্মক্ষয়ী, তার মধ্যে মহিলারা যে কিভাবে উঠে সেটি একটি বিস্ময়ের ব্যাপার।







একটি ভালো ছাত্রের যাপিত জীবনে যে বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী থাকা দরকার তার অনেক কিছুই হয়তো আমার মধ্যেও ছিল; অন্ততঃ প্রথম কয়েকমাস তদানুযায়ী একটা প্রচেষ্টা ছিল। ওরিয়েন্টেশন ক্লাশে সবাই পরিচিত হলাম। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সেরা ছাত্ররাই এখানে এসেছে। নানা সংস্কৃতির নানা মুখ। সবার ভিতরেই একটু স্বাধীন-স্বাধীন ভাব যেন হঠাৎ অনেকটা বড় হয়ে যাওয়া। ইউনিফর্ম নেই, সময়ের বাধ্যবাধকতা নেই, বাবা-মায়ের কড়া নজরদারিও নেই। প্রথম ঘরের ঘেরাটোপ ছেড়ে বেড়োনো একই মানসিকতার অনেক ছেলের এক মহা সম্মিলন। চলনবলন, কথাবার্তায় নিজের অন্তর্নিহিত গুণাবলি উপস্থাপনের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা রয়েছে সকলের মধ্যে। কলেজের প্রথম দিন মানেই দুরু দুরু মনে অনেক রকম অনুভূতির খিচুড়ি। প্রথম দিনেই অনেক বন্ধু হলো। কে কোন স্কুল থেকে এসেছে জানার চেষ্টা করলাম। ঢাকার ছেলেদের পরিচয়টা একটু দুর্বোধ্য মনে হলো। কোন স্কুল? -ল্যারেটরিয়ান, জোসেফহাইড, গ্রেগোরিয়ান..! পরে বুঝলাম স্কুলগুলো হচ্ছে গভঃ ল্যাবরেটরি, সেন্ট জোসেফ, সেন্ট গ্রেগরী স্কুল..। আমাকে জিগ্যেস করলে আমিও বলতে লাগলাম জুবিলীয়ান! মানে! পটুয়াখালী জুবিলী স্কুল। ততদিনে বুঝে গেছি নোয়াখালী আর বরিশাল সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা আছে প্রায় সকলের মধ্যে। শুদ্ধভাষাটা ভালোই রপ্ত করেছি। অনেকে বললো তুমি যে বরিশালের ছেলে তাতো বোঝাই যায় না। আমি বলি বরিশাল নয় পটুয়াখালী, ৬৯-এর ডিষ্ট্রিক্ট। কলেজের ক্যান্টিনের মামুর সাথে পরিচয় হয়েছিল ভর্তির সময়, বড়ভাইদের মাধ্যমে। ক্লাশের পর বাকি সময় ক্যান্টিনেই কাটলো। কলেজে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন মিছিল করলো নবীনদের স্বাগতম জানিয়ে। মিছিল শেষে বেশ কয়েকজন ছাত্র এসে নিজ থেকে পরিচিত হলো, তারাও আমার মতো ফার্স্ট ইয়ার। একটু অবাক হলাম প্রথম দিনেই মিছিলে। ওরা বললো আমরা ল্যাবরেটরিয়ানরা স্কুল পালিয়ে ঢাকা কলেজে মিছিল করি। মোটামুটি প্রথম দিনেই বেশ সন্তোষজনক পারফরমেন্স।







রামপুরা থেকে নিয়মিত কলেজে আসি, ক্লাশ করি, বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে অনেগুলো ছোট ছোট গ্রুপ তৈরী হয়েছে। কিছুটা বাঁধো, বাঁধো একটা ব্যাপার। কোনটা টেবিল টেনিস ও ইনডোর গেমস কেন্দ্রিক, কোনটা ফুটবল-ক্রিকেট খেলা কেন্দ্রিক, ছাত্র রাজনীতি কেন্দ্রিক, সাহিত্য-সাংস্কৃতি-আঁতলামী কেন্দ্রিক, কিংবা তাসের আড্ডা কেন্দ্রিক; এমনকি শুধু আড্ডার জন্য আড্ডা কেন্দ্রিক। সুনীলের পূর্ব-পশ্চিম, সমরেশের ত্রিলোজি কালবেলা-কালপুরুষ-উত্তরাধিকার ইত্যাদি বই অনেকের হাতে, ঘুরে ঘুরে সবাই পড়ে; কেউ কেউ ভোগে বিপ্লবের রোমান্টিসিজমে। এর ভিতর তাসের একটি গ্রুপ বসে ক্যান্টিনে-ব্রীজ খেলার জন্য, আরেকটি বসে গ্যালারীর উপর ছাদের কোনে ওরা থ্রিকার্ড খেলে পয়সা দিয়ে। ওই আড্ডায় রিয়াদ আরেফিনকে পেলাম। আমাদের সময়ে এসএসসিতে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম হয়েছিল অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে। খুবই অবাক হলাম এত ভালো ছাত্ররাও যে আমারমত প্রায় একই দোষে দুষ্ট হতে পারে জানতাম না। তারপর দেখলাম বেশ কিছু সুদর্শন ছেলে সবাই খুব মেধাবী। অনেকে বোর্ডে ষ্ট্যান্ড করা অনেকে স্ট্যান্ড না করলেও কাছকাছি। মেধাবীরাও এত সুন্দর হয়! শুধু সুন্দরই নয় সবাই খুব বিত্তশালী পরিবারের ছেলে, সেই রকম স্মার্ট। মাসুদ রোজ আসে নতুন নতুন গাড়ীতে। হাজী মকবুলের ছেলে মাসুদের একটা এক্সেল হোন্ডাও ছিল, কলেজের করিডোর দিয়ে ভোঁ ভোঁ করে চলে যেত পিছনে আরেক হ্যান্ডসাম অশ্রু ভাই। দু’জনের কেউই আজ আর জীবিত নেই। ইশতিয়াক, শুভ্র, পরশ, আবীর, মুক্ত..অর্থ-বিত্ত, জ্ঞান, সৌন্দর্য্য, কিংবা স্মার্টনেস- কোন কিছুরই কমতি নেই ওদের। বিধাতার এমন পক্ষপাতিত্বমূলক আচারণ দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। তবে ইন্টরেস্টিং বিষয় হচ্ছে মেধাবী এই রকবাজরা আবার শীর্ষস্থানীয় গালিবাজও। ওদের সাথে না পারা যায় মেধায় না যায় গালাগালিতে। ইউনিকসব টার্ম ও ব্যসবাক্যসহ সমাস মেধা যাচাইয়ের নতুন মানদন্ড। আহমেদ আর নাজমুল নামে আমার খুব ভালো দুজন বন্ধু ছিল। নাজমুলের বাসা শংকর জাফরাবাদে। আহমেদ পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে নবাবগঞ্জে; তার পাশেই আমলীগোলায় ছিল বন্ধু শহীদদের বাসা; পুরনো জমিদার বাড়ী, খুবই ব্যতিক্রমী ডিজাইনের, বাড়ীটির মাঝখানে পাকা উঠোন। সকল বাসায়ই কমবেশী আড্ডা হতো শুধু শহীদের বাড়ীতেই হিসাব ছাড়া। ইতোমধ্যেই সায়ীদ স্যারের তৈরী বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে অনেক বন্ধু সদস্য হলো। পরবর্তী জীবনে ওরাই আমার স্থায়ী বন্ধু হয়েছে। বিপ্লব, শহীদ, জয়, রিমু, মোর্তোজা, রঞ্জন, সোহেল, এ্যাপোলো, আখলাক, সোহাগ, শাকিল বেশ বড় একটি সার্কেল। আমরা নিয়মিত কেন্দ্রে আড্ডা দেই। বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বন্ধুর সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করা, কেয়ার করা, প্রয়োজনে বন্ধুর জন্য জীবন বাজী রাখা... এমনি একটা নিঃস্বার্থ সম্পর্ক গড়ে উঠতে লাগলো যা পরবর্তিতে সম্পদ হয়ে যায়। বন্ধুত্বের রং কী? ঠিক জানা নেই। তবে প্রেমের রং যদি লাল হয়, তবে বন্ধুত্বের রঙ আরও উজ্জ্বলতর হবে, হয়তো প্রথম সূর্য কিরণের চেয়েও।







আমরা কিছু শিক্ষক পেয়েছিলাম যাদের নিয়ে আমৃত্যু হয়তো গর্ব করতে পারবো। বাংলার আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার তেমনি একজন। অন্যকারো বিষয় জানিনা, আমাকে যদি আজও প্রশ্ন করা হয় তোমার প্রিয় শিক্ষকই শুধু নয়, প্রিয় চরিত্র কে? নিঃসন্দেহে আমি সায়ীদ স্যারের কথাই বলবো। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার সুযোগ পেয়ে ছিলেন, কিন্তু ঢাকা কলেজে প্রাণবন্ত, সপ্রতিভ, উজ্জ্বল ছাত্রদের পড়ানোর তৃপ্তি, শিক্ষক-জীবনের অনির্বচনীয়তম আস্বাদ ছেড়ে তিনি যেতে পারেন নি। রিটন ভাই (১৯৮০-৮১) তার স্মৃতি কথায় লিখেছিলেন শুনেছি সায়ীদ স্যার কয়েক যুগ ধরে ‘হৈমন্তী’ পড়ান। যথারীতি স্যার আমাদেরও ‘হৈমন্তী’ পড়াতেন। তার ক্লাশ আমরা কেউ মিস করতাম না। মূল গল্প ছেড়ে তিনি চলে যেতেন অন্য বিষয়ে। ‘কার সাথে প্রেম বা ভালোবাসা হয়? যাকে তুমি আরাধনা কর, তোমার চেয়ে অনেক বড়, অনেক উচ্চতায় যার অবস্থান-যা তুমি ছুঁতে চাও- তার সাথেই প্রেম হয়। যাকে তুমি ভাবো তোমার যোগ্য নয়, যাকে তুমি করুনা করো, তার সাথে অনেক প্রকার সম্পর্কই তোমার হতে পারে কিন্তু সেটাকে কোনভাবেই প্রেম বা ভালোবাসা বলা যাবে না।’ জীবনবোধ সম্পর্কে তার অসাধারণ সহজবোধ্য ব্যাখ্যাগুলো আমাদের চোখ খুলে দেয়। রবীন্দ্রনাথের উক্তিগুলো আমাদের হৃদয়ে তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন। ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’ কিংবা ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম...’ এই লাইনগুলো স্যার না থাকলে কোনদিনও এভাবে হৃদয়ঙ্গম হতো কিনা জানি না। স্যার কঠিন কো-এডুকেশনের পক্ষের লোক। আমরা যারা বয়েস স্কুল থেকে এসেছি তাদের জন্য স্যারের অনেক দুঃখ ছিল। বলতো ‘তোমরা স্কুলেও বান্ধবী পেলা না, কলেজেও পেলা না। আমার মত বুড়ো আর কতটুকুই পারে? পুরুষের অন্তর্গত সুকুমার শক্তিটি একমাত্র নারীই পারে টেনে বের করে আনতে’। তবে আমরাও হার্টথ্রব সুন্দরী এক নারীকে পেয়েছিলাম তবে ছাত্রী হিসেবে নন! তিনি আমাদের বাংলার শামীম আজাদ ম্যাডাম। এত স্মার্ট ও সুন্দরী মহিলা এর আগে দেখেছি বলে মনে হয় না। তিনি আমাদের ‘পূর্ব বাংলা’ কবিতাটি পরাতেন। আমরা আসলে ক্লাশে তার কথা শোনাতাম না, তার কথা বলা-দেখতাম। কী সুন্দরভাবে কথা বলে, হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। কি স্লিম ফিগার! মুখে কিছু ব্রনের দাগ থাকলেও তিনি এতটাই রূপ সচেতন ছিলেন ওগুলোকে আমরা বিউটি স্পট বলতাম। স্লিভলেস ব্লাউজের উপর নিত্যনতুন সুন্দর সুন্দর পাটভাঙা শাড়ী পরে আসেন। করিডোরের দুষ্টু বাতাসে উড়ে ওঠে তার শাড়ীর আঁচল। তার সম্পর্কে একটা গল্প ছিল। কোন এক রসিক ফার্স্ট ইয়ার ম্যাডাম কে সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখে তার বন্ধুদের মহা উত্তেজিতভাবে চাঁপা স্বরে বলছে ‘দোস্ত দ্যাখ দ্যাখ কি কঠিন এক মাল যাচ্ছে!’ দুর্ভাগ্যক্রমে ম্যাডাম তা শুনে ফেলে ব্যাক করলেন। ছেলেগুলো ভয়ে দৌড় দিতেও ভুলে গেল! ম্যাডাম ওদের সামনে এসে বললেন, ‘ফার্স্ট ইয়ার-তাই না, তোমরা কিন্তু এখন ঢাকা কলেজের ছাত্র, অন্য কোন কলেজের নয়, মন দিয়া লেখা পড়া করো, আমার চেয়েও ভাল মাল পাবে!’







শামীম আজাদ তখন প্রতিষ্ঠিত কবি, সেই সময়ের প্রধান সাপ্তাহিক বিচাত্রার প্রথমযুগের লেখক তিনি। কবিতা পরিষদের সুবাদে শামীমাপার সাথে পরবর্তিতে বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী তখন জীবন্ত কিংবদন্তি। বাঙালির সৃজনশীল মনন ও পরিশীলিত রুচি গঠনে বিচিত্রার ভুমিকা আজ প্রমানিত। পরবর্তিতে রঞ্জন, বিপ্লব আর মোর্তোজা শাহাদাত চৌধুরীর হাত ধরেই সাংবাদিকতা জগতে প্রবেশ করেছে। মোর্তোজা তো ক্যারিয়ারই গড়লো বিচাত্রায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদকের ছায়াসঙ্গী হিসেবে মোর্তোজা ছিলেন। মোর্তোজা এখন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সাপ্তাহিকের সম্পাদক। শামীমাপার হাত ধরে বিচিত্রায় গিয়েছি কয়েক বার। শাহরিয়ার কবীর, মাইনুল আহসান সাবের, চিম্ময় মুৎসুদ্ধিসহ নামী দামী অনেক লেখক-সাংবাদিকদের সাথে শামীমাপা আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন যারা অধিকাংশই ছিলেন আমাদের অগ্রজ সতীর্থ। শাহাদাৎ চৌধুরীকে দেখে মজা পেয়েছিলাম। তার কাজ শুধু সারাদিন নিউজপ্রিন্টের প্যাডের পাতা ছিঁড়ে গোল্লা বানিয়ে নিজের রুম ভর্তি করা। বুঝেছিলাম মেধাবীরা একটু মেন্টাল ও হয়।







কলেজে ঢুকেই সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের খবরা খবর নেয়া শুরু করলাম। কবিতা পরিষদ ঢাকা কলেজের সম্মেলন হবে। বাংলার অনার্সের ছাত্র নিপুভাই, পাপ্পুভাই, রিপনভাই এরা কবিতা পরিষদ করে। তারা বেশ উৎসাহ দিলেন। পলাশ, নাহিদ, হেলালসহ আরো কিছু বন্ধু মিলে কবিতা পরিষদে কাজ শুরু করি। ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি টিএসসিতে কবিতা উৎসব হবে। টিএসসিতে উৎসব অফিসে যাওয়া শুরু করলাম। গিয়ে দেখি বাংলাদেশের প্রায় সকল কবি এখানে আসে। নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, মোহম্মদ রফিক, আসাদ চৌধুরী, রুদ্র মোহম্মদ শহীদুল্লাহ কে নাই। মাত্র এক বছর আগে যাদের খুব কাছ থেকে দেখার ষ¦প্ন দেখতাম এখন তারা প্রায় সবাই আমাকে চিনে এবং রীতিমত ¯েœহ করেন। এই প্রাপ্তির কথা আমি লিখে কোনদিন বুঝাতে পারবো না। আমার একটা ডাইরী থাকতো সাথে। সুযোগ পেলেই তা কবিদের কাছে দিতাম ঠিক অটোগ্রাফ নয় আরও কিছু বেশীর জন্য। রুদ্র দা খুব কম কথা বলে, গোঁফের ফাক দিয়ে মিচকি হাসে। খুবই ভালো লাগে। আমার ডাইরীতে তার সিগেরেট খাওয়া নিয়ে প্রায় পুরো এক পাতা লিখলেন। অন্যান্য কবিরাও কিছু কিছু লিখলেন। ডাইরীর এক পাশে আমার লেখা কিছু কবিতাও ছিল, চান্স পেলে তাও তাদের দেখাই। অনেকেই বাহাবা দেয়, অনেকেই বলে আরো পড়ো। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের আড্ডার সুবাদে লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম ও আসলাম সানি এই ছড়াকার ত্রি-রতেœর শুধু সান্নিধ্য নয় রীতিমত আস্কারা পেলাম। প্রথমোক্ত দুজন আবার ঢাকা কলেজেরই সাবেক ছাত্র। কবিতা পরিষদের রুমে আমাকে দেখে আমীরুল ভাইর দূর থেকেই ডায়ালগ ‘ঐ মিয়া গান্ডু, তুমি দেহি এহানেও আইয়া পড়ছো! তোমারে আর ঠেকায় কে?...আলাপ হইছে সবার লগে? ওই সামাদ ভাই, ঢাকা কলেজের এই মালটারে চিন্না লন সুমন, বহুত কামের পোলা! শিমুলের সাথে আলাপ হইছে? আবৃত্তিকার শিমুল মুস্তফা!’ কবি মোহম্মদ সামাদ কবিতা পরিষদের প্রান, মানে প্রধান সংগঠক। সামাদ ভাই ইতোমধ্যেই কিছু দায়িত্বও দিয়েছে। কিন্তু শিমুল মুস্তফা হিসেবে যে লোকটিকে পরিচয় করিয়ে দিল, গভীর বিষ্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে তার সাথে হাত মিলালাম। এই তালপাতার সেপাইর কন্ঠ দিয়ে কি মোটা, ভারী, দরাজ আওয়াজ বের হওয়া সম্ভব? মনে মনে ভাবছি আমীরুল ভাই কি আমাকেও হাইকোর্ট দেখাচ্ছে? তাদের দ্বারা এটি অসম্ভব নয়। শিমুল ভাই অবশ্য আমার মানসিক অবস্থা রীড করতে পেরে আমাকে ইজি করে দিয়েছেন। এই ত্রি-রতœ অতি বুদ্ধিমান মানুষকেও ভোদাই বানাতে ওস্তাদ। তাদের রসবোধ এতটাই গভীর এবং এ কাজটি তারা এত ক্ল্যাসিক্যাল ভাবে করে তাতে যে কেউই ধরা খেতে বাধ্য। তার কয়েকদিন পরের একটি ঘটনা বলি। বইমেলায় প্রতিদিনই এই ত্রি-রতœকে ঘিরে জম্পেশ একটি আড্ডা গড়ে ওঠে। গত দুইযুগ ধরে এটি বহমান। একটি কিশোরী মেয়ে রিটন ভাইর অটোগ্রাফ নিচ্ছে। পাশ থেকে সানি ভাই একটু চাপা স্বরে চাঁপা মারছে, ‘এই আমীরুল দ্যাখ দ্যাখ ঐ বোকা মেয়েটা আমগো সাজুরে ছড়াকার লুৎফুর রহমান রিটন ভাইবা অটোগ্রাফ নিচ্ছে! আর সাজু হালায়ও ভাবের সাথে পিনিক নিতাছে!’ মেয়েটি শোনা মাত্রই খ্যাট করে খাতাটা টান দিল, ‘লজ্জা করে না রিটন সাজতে? ইস গোফ থাকলেই বুঝি রিটন হওয়া যায়? বেসরম কোথাকার!’। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে সিনিয়র আড্ডাবাজদের ভিতরে আহমেদ মাযহার, খায়রুল আলম সবুজ ও আসাদুল হক শাহীন প্রমুখের বেশ নেক নজরে ছিলাম। এরাও ঢাকা কলেজ। শাহীন ভাই আবার পটুয়াখালীর ছেলে। রিটন ভাই বললো, ‘শাহীন কিন্তু ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ছিল দীর্ঘদিন। ও একবার ঢাকা কলেজের পুকুরের পানি বিক্রি করেছিল ৫০ হাজার টাকায়!’ মানে? ‘মানে কিছুই নয়, পুকুরের দক্ষিণে নিউমার্কেটের যে ভবনটি দেখছো ওটি তখন নির্মাণাধীন, ঠিকাদার পুকুরে পাইপ লাগিয়ে পানি নেয় নির্মাণ কাজের জন্য। শাহীনের মাথায় ধান্ধা এলো, পানির লাইন কেটে দিল। বেচারা আর পানি পাবে কই। অবশেষে ৫০ হাজার টাকায় সন্ধি হলো।’ এই শাহীন ভাইকে পরবর্তি জীবনে খুব কাছ থেকে দেখেছি। শিশুরমত সরল ও সৎ জীবন তার। এখন তিনি বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক।







ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের হাউস টিউটর ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক ওবায়েদ স্যার। স্যারের ওয়েট ৫ মনের কম হবে বলে মনে হয় না। খুবই নিরীহ, নির্বিবাদী মানুষ। কলেজের নীচতলায় প্রধান করিডোরের পাশেই ছিল তার কক্ষ। দরজার পর্দাটা বাতাসে উড়লেই ফাঁক দিয়ে দেখতাম কেউ না কেউ তার শরীর মেসেজ করছেন। হোস্টেলের তিনতলায় তার আবাসিক কোয়ার্টার। নীচ তলায় অফিস রুম। স্যারকে সব সময় কিছু না কিছু খেতে দেখতাম। স্যার তার অফিস কক্ষেই লাঞ্চ করতেন। বিষয়টা আমাদের মাথায় ঢুকতো না, বাসা থাকতে কেন তিনি অফিসে বসে লাঞ্চ করেন? নিঃসন্দেহে দাম্পত্য কলহ! স্যারের ছেলে আমাদের একব্যাচ সিনিয়র। তাকে জিগ্যেস করলে সে এড়িয়ে যেত। অনেকপরে বুঝেছিলাম- বিশাল ভুড়ি নিয়ে আসলে স্যারের নড়াচড়া করতেই খুব অসুবিধা হয় সেখানে সিড়ি মারাবেন কী করে? সকাল বেলা ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে নীচে নামতেন আর বাসায় যেতেন না। রাতে উঠতেন কোন না কোন ছাত্রের সাহায্য নিয়ে। আমাদের স্ট্যাট পড়াতেন খিজির হায়াত স্যার। তাকে খিজির (আঃ) বলে ডাকতাম। কেননা তার একক হেদায়েত ছাড়া স্ট্যাটে ভালো করা সম্ভব নয়। এই হেদায়েত পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে তার কাছে প্রাইভেট পড়া। তিনি আবার আমীরুল ভাইয়ের দুলাভাই; আমীরুল ভাই দু চোখে তারে দেখতে পারে না। খিজির স্যার কলেজের শিক্ষক কোয়ার্টারে থাকেন। তার দুটি সুন্দরী মেয়ে ছিল। বিকেল হলে তারা সাইকেল নিয়ে বেড়োতো। ছাত্ররা ওদের ভালোই বিরক্ত করতো। ওরাও কম বিতলা নয়, খুবই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ছাত্রদের নাম, রুম নম্বর জেনে নিত। পরে আবার বাবাকে বলে দিত। সাউথের টিউটর ছিলেন ম্যাথের ইউসুফ স্যার। খিজির স্যার মেয়ের নালিশানুযায়ী নাম-ধাম নিয়ে ইউসুফ স্যারকে দিয়ে ছাত্রদের হলের অফিস কক্ষে ডাকিয়ে এনে উত্তমরূপে শাসিয়ে দিতেন। এই ফাঁদে অনেকেই ধরা খেয়েছে। ভূগোল পরাতেন আলতাফুন্নেছা ম্যাডাম। তার ছেলে হাসিবও আমাদের সহপাঠি। অসাধারণ এক মহিয়সী নারী এই আলতাফুন্নেছা। খুব ভালো পড়ান। ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক ছাত্রের খবর নেয়ার চেষ্টা করতেন। ফাইনাল পরীক্ষার কয়েক মাস আগে তিনি জরুরী খবর দিয়ে আমাকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে গেলেন। ধানমন্ডী ৭ নং রোডে বিশাল বাড়ী। রমজান মাস। আমাকে দেখে বললেন-‘কীরে দেশ ও জাতিরে উদ্ধার করলেই কি চলবে, কয়েক মাস পরেই পরীক্ষা, তোকে তো গত ৬ মাস একদিনও ক্লাশে পায় নি! কেন?’ আমি মাথা নীচু করে আমতা আমতা করছি। আমাকে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গেলেন, কিছু সাদা কাগজ, কলম ও হাতে লেখা কয়েকটা প্রশ্ন দিয়ে বললেন ‘নামাজ, রোজাতো করো না জানি। টেবিলে খাবার রাখা আছে, ভাত খেয়ে যতটুকু পারিস ততটুকু উত্তর লিখে তারপর যাবি! আমি ঘুমাতে গেলাম, কাল কলেজে দেখা করবি’। আমি ভাত খেয়ে কোনমতে এক দুই পাতা যা পারি লিখে পাগার পার! পরদিন আর তার সামনেও পরিনা।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৪

ঈশান আরেফিন বলেছেন: আপনার এই দারুণ লিখাটা পড়ে আমারও জানাতে খুব ইচ্ছে করছে আমিও কিংবদন্তীর কোলে দুই বছর ছিলাম, আমিও ঢাকা কলেজের ছাত্র। অবশ্য কলেজ ছেড়েছি বেশীদিন হয়নি, এই তো কিছুদিন আগেই এইচএসসি এর রেজাল্ট বের হল। জী আমি ঢাকা কলেজ'১৩ এর গর্বিত ছাত্র। তবে আমাদের কলেজের শৌর্য মনে হয় এখন কিছুটা কমেছে :/ কিন্তু আসলে ঢাকা কলেজে যে পড়েছে সে ছাড়া কেউ বলতে পারবে না যে ঢাকা কলেজ জীবন যে কতটা আলাদা আর ইন্টারেসটিং :D আর এইটুকু বলতে পারি আপনাদের সময় থেকে এখনকার ঢাকা কলেজ অনেকটাই ভিন্ন। ধন্যবাদ আপনাকে এমন একটা লেখা লিখবার জন্য......

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৪৭

সুমনজাহিদ বলেছেন: মোট ৪টি পর্ব, বাকীগুলোএ পরবেন আশা রাখি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.