নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

স্বাপ্নিক

তানভীর মুহাম্মাদ

মানুষের সৌন্দর্য তার চিন্তায়; তার কল্পনায়। আমাদের চিন্তা ও কল্পনার জগত অধিকতর সুন্দর হয়ে উঠুক। এ-ই কামনা।

তানভীর মুহাম্মাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অঙ্গার

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০৮

দেহের ছিন্নাংশ নাও
আমার মা’র
আমার বাবার
আর অমূল্য সম্পদ হারানো
আমার প্রিয় বোনটির;
পাঠিয়ে দাও বিশ্ববিবেকের কাছে
ওদের বলো,
আমি এখন সন্ত্রাসী…

খুব সুন্দর একটা বাড়ি আমাদের। জাঁকজমকপূর্ণ নয়। তবে সাজানো-গোছানো। এলাকায় আমাদের বাড়িটার সামনে এসেই পথিকের চোখ আটকে থাকে। হয়তো মনে মনে ভাবে, “ইশ! এরকম একটা বাড়ি যদি বানাতে পারতাম!” অথবা ভাবে, “শালা বাড়িওয়ালা নিশ্চয় বিদেশিদের দালাল। এতো টাকা পায় কোত্থেকে?”

আব্বু যথেষ্ট হিসেবী মানুষ। অপচয় করতে দেখি নি কখনও। বাজারে ভালো একটা দোকান আছে। ছোটো একটা পরিবার চালাতে কোনো বেগই পেতে হয় না। মাসশেষে কিছু সঞ্চয়। এভাবেই আব্বু করেছেন বাড়িটা। অবশ্য অনেকে সন্দেহ করে আব্বুকে নিয়ে। কথার গুঞ্জণ আমার কানেও আসে। কিন্তু কেউ সরাসরি বলতে সাহস পায় না। যদি ধরিয়ে দিই বিদেশিদের হাতে! স্বপ্ন ভেঙ্গে সব চুরমার হয়ে যাবে তাহলে। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে শতবর্ষী বৃদ্ধ। কেউ বাঁচে না ওদের নির্মমতা থেকে। এই তো সেদিন। পাশের বাড়ির একমাত্র মেয়েকে ধরে নিয়ে গেলো। তার মা সহ্য করতে পারে নি। চিৎকার করে উঠেছিলো। সাথে সাথে গর্জে উঠেছিলো আগ্নেয়াস্ত্র। মায়ের লাশ পেছনে ফেলে মেয়েটা যেতে বাধ্য হলো মৃত্যুপুরিতে। তখন সবাই সন্দেহ করেছিলো, এর মূল হোতা আমার আব্বু। কিন্তু আমি দেখেছি। আমিই দেখেছি। ঘটনার সময় আব্বুর চোখে অশ্রু।

এসব আমার কিশোরমনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। উচ্ছ্বল থাকার চেষ্টা করলেও প্রায়ই বেদনার কালো মেঘ আমার হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে। বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ। বন্ধুদের দেখি, খেলছে। হাসছে। গাইছে। ওদের মনে এতো আনন্দ কীভাবে বাসা বাঁধে?

এক দুপুরে। মা’র পাশে বসে গল্প করছি। ছোট্ট বোনটি সামনে এসে বসেছে। চুলের বেণী করে দিতে হবে তাকে। ছোটকাল থেকেই আমার কাছে ওর নানা আবদার। ফিরিয়ে দিই নি কখনও। বেণী করে দিচ্ছি। মা গল্প শোনাচ্ছেন, “ফযর পড়েই আমরা ছুটতাম মক্তবে। কী আনন্দের দিন ছিলো!” তখনই। বাবার করুণ স্বর শুনতে পেলাম। আমার কাছে খুব অপরিচিত। নাহ, এ আমার বাবার কণ্ঠ নয়! আশঙ্কায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এ ভরদুপুরে বাবার কী হতে পারে? শরীর খারাপ, না…? ভাবতে ভাবতেই চমকে উঠলাম। শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেলো। দরজায় লাথির আওয়াজ। মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছে। বিকট আওয়াজে ভেঙ্গে পড়ছে আকাশটা।

একের পর এক লাথি মেরেই যাচ্ছে। উঠতে পারছি না কেউ। শরীরের শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ…। আবার চিৎকার করে উঠলো তারা। ভিনদেশি ভাষায় কী যেনো বলছে। তার মানে দখলদার সৈন্য! বাবা তাদের হাতে বন্দি। ভাবতে পারছি না। অজ্ঞান হয়ে যাবো মনে হচ্ছে। পৃথিবীতে যাদের চোখ আছে। যাদের কান আছে। যাদের হৃদয় আছে। তারা প্রত্যেকে জানে। পশুগুলির হাতে নিরপরাধ মানুষও নিরাপদ নয়…।

এক সময় দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়লো তারা। চেহারায় বুনো হিংস্রতা। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, বাবার আদর পায় নি কভু। মনুষ্যত্ব শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ওদের সভ্যতায় নেই। ওরা পশুর চেয়ে অধম। বাবাকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। চুল খামচে ধরে আছে একটা কীট। বাবা অজ্ঞান কি-না বুঝলাম না। কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছেন। অসীম স্নেহে যে চোখ দিয়ে তাকাতেন আমার দিকে। সে চোখে আজ এ কেমন দৃষ্টি! অজান্তেই আর্তনাদ করে উঠলাম। জড়িয়ে ধরলাম মাকে।

মা-ও যেনো পাথর হয়ে গেছেন। করুণ চাহনি দেখে খুব খারাপ লাগছে। বুকের ভেতর কিছু একটা ভেঙ্গে যাওয়ার শব্দ পেলাম। এমন বেদনা, এমন যাতনা কখনও সইতে হয় নি আমাকে। মা আমাকে আর ছোটবোনকে ধরে প্রাণভিক্ষা চাচ্ছেন। পৃথিবীর বুকে আর কয়টা দিন বেঁচে থাকার একটু আকুতি। নাহ! ওদের পাষাণ হৃদয়ে মা’র আর্তনাদ কোনো রেখাপাতই করতে পারলো না। অথচ মা’র আকুতি-মিনতির প্রতিটি শব্দ আমার কলজেতে শেলের মতো বিঁধছে। বিঁধবে প্রতিটি মানুষের কলজেতে। কিন্তু ওরা বুঝলো না অন্তরের ভাষা। প্রাণের ভাষা। কারণ, ওরা যে মাকে ভালোবাসতেই শিখে নি! অমানবিক আচরণ করলো। আমার মা’র সাথে। আমার বোনের সাথে। যাদেরকে জড়িয়ে আমার হাজারও স্মৃতি। নিষ্কলুষ ভালোবাসা।

ঘোর কাটতে কাটতে অনুভব করলাম, বাড়িতে আগুন জ্বলছে। লেলিহান অগ্নি এখনই গিলে নিবে কতগুলো প্রাণী। মা নেই ধরায়। বাবাও। আদরের ছোট্ট বোনটি আহত। কাঁতড়াচ্ছে। জ্ঞান নেই বোধহয়। রক্তেমাখা পুরো শরীর। কাঁধে তুলে নিলাম। তারপর দৌড়। পা যেনো নিশ্চল হয়ে গেছে। কষ্ট করে বের করে নিয়ে এলাম। আর কিছুক্ষণ দেরি করলেই আগুনের পেটে বিকৃত হয়ে যেতাম। মা-বাবার লাশ পুড়তে থাকলো। পুড়তে থাকলো আমার অস্তিত্ব। পুড়তে থাকলো আমার সভ্যতা।

দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে। আজ কোথায় ঘুমাবো। আমার ঘর নেই। আশ্রয় নেই। নিজ ভূমি থেকে মানুষকে এভাবে তাড়িয়ে দেয়া যায়? ছোট বোনকে জড়িয়ে ঘুমালাম রাতে। চৌরাস্তার বড়ো দোকানটার সামনে। সকালের কথা মনে পড়ছে। ওর মিষ্টি কণ্ঠটাও কানে বাজছে। “ভাইয়া, ওই যে! ওই চকোলেটটা দাও!” মা-বাবাকে হারিয়ে ও কি এখনও চকোলেট পছন্দ করবে? মনে হয় না।
সকালে উঠে চমকে গেলাম। আমার বুক খালি। চারিদিকে খুঁজতে লাগলাম আদরের বোনকে। পেলাম না। ও কি তবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে? হতে পারে। লাজুক বোনটি কীভাবে মুখ দেখাবে আমাকে!

দুঃসহ এসব স্মৃতি মুছে যাবার নয়। ক্রোধের জ্বলন্ত অঙ্গার নিভে যাবার নয়। নয় কভু শান্ত হবার। ক্ষোভ বুকে চেপে রেখেই হেঁটে চলি এখানে-ওখানে। সবখানেই শুনি বিদ্রোহীদের আওয়াজ। মানুষ এখন জীবনের চেয়েও স্বাধীনতাকে ভালোবাসে। স্বপ্ন দেখি, এসব স্বাধীনতাকামী প্রতিরোধ-যোদ্ধা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে স্বাধীনতার মশাল জ্বালবে।

এক রাতে। আমি নিজেকেও স্বাধীনতাকামীদের মিছিলে আবিষ্কার করি। এগিয়ে যাচ্ছি ক্রমেই। বাংকার উড়িয়ে দিচ্ছি। কাঁটাতারের বেড়া ভেদ করে ছুটে যাচ্ছি শত্রুমহলে। স্বাধীনতাকে খুঁজছি সরাসরি সেনাদের মেশিনগানের নলের ভেতর তাকিয়ে। শত্রুর গাল খামচে ধরে চোখে চোখ রেখে বোঝাতে চাচ্ছি। প্রাণের ভাষা। কিন্তু ওরা বোঝে না। বুঝবে কীভাবে? ওরা তো অমানুষ! তাই মানবতার সংজ্ঞায় বারবার ভুল করে বসে। ওরা কাপুরুষ! তাই অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র মানুষের সাথে খেলতে আসে।

আমরাও ছাড়বার পাত্র নই। আমাদের আছে হাজারও বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। তাই জেগে উঠছি রক্তের টানে। তুমিও এসো! পরাধীন উপত্যকাজুড়ে অবিরত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হোক স্বাধীনতার নাকারা। বিশ্বাস করো। ওদের তাড়াতে অস্ত্র লাগবে না। স্বাধীনতাকামীদেও চোখের বারুদ দেখলেই ছুটে পালাবে কাপুরুষের দল। এসো! উপহাস ছুড়ে দিই অসংখ্য “আবু গারিব”-এর দিকে…

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.