নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ক্ষুব্ধ সবল জনস্রোতে

কবিতা ও যোগাযোগ

তপন বাগচী

ঢাকায় থাকি। জন্ম বাংলাদেশের শ্যামল গ্রামে। শাহবাগে আড্ডা দিই মাঝেমাঝে। কবিতা লিখে আনন্দ পাই। লেখার চেষ্টা করি।

তপন বাগচী › বিস্তারিত পোস্টঃ

মঙ্গলবারের গল্প ।। তপন বাগচী

২৭ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ৮:৪১

মঙ্গলবার কী করে মঙ্গলবার হলো

তপন বাগচী




এক দেশে ছিল এক বানিয়া। তাকে সকলে বেনে বলে ডাকে। তার ছিল এক সুন্দরী বউ। তাদের কোনো সন্তান নেই। এই নিয়ে তাদের মনে কিছুটা দুঃখ রয়েছে। কিন্তু তা কারো কাছে প্রকাশ করে না। মনের দুঃখ মনেই চেপে রাখে।

একদিন তাদের বাড়িতে এক সন্ন্যাসী এসে বলে, ‘আমাকে কিছু ভিক্ষা দাও গো? কে আছেন? ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে কিছু খাবার দাও।’ এই কথা বলে সন্ন্যাসী সুর করে উচ্চারণ করেন-

‘কে আছ গো, মা-জননী

একটা কথা শোনো

দু’দিন ধরে উপোস আমি

খাইনি খাবার কোনো।

আমার ঝুলি ভরবে মাগো

এক মুঠো চাল পেলে

কোথায় গেলে মা-জননী

আমি তোমার ছেলে!’

বেনে তখন বাড়িতে ছিল না। বেনের বউ ঘর থেকে বাইরে আসে। সন্ন্যাসীকে দেখে আবার ঘরের ভেতরে যায়। ঘর থেকে নিয়ে আসে কিছু খাবার। সন্ন্যাসীর সামনে গিয়ে বলে, ‘এই নিন’।

সন্ন্যাসী বলে, ‘মা, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। কিন্তু মা তোমার ছেলেমেয়েরা কই? তাদের তো দেখছি না!’

: আমাদের কোনো সন্তান নেই।

: সে কী? তাহলে, আমি তো তোমার দেয়া কিছু নিতে পারব না।

: কেন ঠাকুর? তুমি খাবার চেয়েছিলে বলেই তো আমি তোমার জন্য এই খাবার এনেছি। আমার ঘরে আর তো কিছু নেই।

: সে ঠিক আছে, মা। যার কোলে সন্তান নেই, তার হাত থেকে আমি তো কিছু খাই না।

সন্ন্যাসী চলে যায়। বেনে-বউ খুব কষ্ট পায়। সন্তান নেই বলে সন্ন্যাসী তার কাছ থেকে ভিক্ষা নেয় না, এটা যে কতটা অপমানের, তা সে কাকে বোঝাবে? কিন্তু প্রতিদিনই আসে এবং খাবার চায়। কিন্তু খাবার দিতে গেলে একই কথা বলে চলে যায়।

একরাতে, বেনে ঘরে ফিরে এলে, বউ তাকে এই ঘটনা জানায়। সন্ন্যাসীকে জব্দ করার জন্য বেনে তার বউকে একটা কৌশল শিখিয়ে দেয়। পরদিন আবার সন্ন্যাসী আসে, এবং আগের মতো একই সুরে বলেÑ

‘কে আছ গো, মা-জননী

একটা কথা শোনো...’

এবার আর বেনের বউ সামনে আসে না। স্বামীর শেখানো কৌশল মতো, দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। একফাঁকে সে সন্ন্যাসীর ঝোলার মধ্যে একটা সোনার মুদ্রা ফেলে দেয়। ভেবেছিল কেউ দেখব না। কিন্তু সন্ন্যাসী তা দেখে ফেলে। সন্ন্যাসীর ভীষণ রাগ হয়! সে সঙ্গে-সঙ্গে তাকে অভিশাপ দেয়--

‘মুদ্রা দিয়ে ইচ্ছেমতো

যায় না কিছু কেনা

তোমার ঘরে সন্তানাদি

কখনো আসবে না।’

সন্ন্যাসীর অভিশাপে বেনে-বউ খুব বিচলিত হয়। কান্নায় বুক ভরে ওঠে। এই অভিশাপ থেকে সে মুক্তি চায়। সে সন্ন্যাসীর পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চায়।

‘একটা না হয় ভুল করেছি

হয়তো কিছু পাপ!

তাতেই তুমি উঠলে ক্ষেপে

করলে অভিশাপ?

আমায় তুমি ক্ষমা করো

ভুল হবে না আর

তোমার কাছে এই মিনতি

করছি বারংবার।’

কান্নকাটিতে সন্ন্যাসীর কিছুটা দয়া হয়। নারীর কান্নায় কার না হৃদয় গলে! সন্ন্যাসী তার অভিশাপ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু তার সঙ্গে কিছু শর্ত জুড়ে দেয়। তাদের ছেলে হবে বলে আশীর্বাদ করে। তারপর বেনে-বউকে সে কিছু উপদেশ দেয়। বলে--

তোমার স্বামীর পরতে হবে নীলরঙা এক জামা

কিনতে হবে একটি ঘোড়া, রঙ হবে তার নীল

ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে হবে, নয় যে সহজ থামা-

সামনে যখন আরেক ঘোড়া-- রঙে রঙে মিল-

থামবে তখন ঘোড়ার চলা, নামবে গভীর বনে

খুঁড়তে হবে গর্ত সেথায়, খুবই সংগোপনে।’

এটুকু বলে সন্ন্যাসী একটু থামে। মন দিয়ে শোনে বেনে-বউ। সন্ন্যাসী থামলে সে বলে, ‘তারপর কী হবে, সন্ন্যাসী ঠাকুর? গভীর বনে একা-একা সে কী করবে?’

সন্ন্যাসী বলে, ‘অত উতলা হচ্ছ কেন? সকল কথাই বলছি। গর্ত খুঁড়তে-খুঁড়তে সে একটা মন্দির দেখতে পাবে।’

: কীসের মন্দির, কার মন্দির, সন্ন্যাসী ঠাকুর?

: সে কথাই তো বলছি। ওখানে আছে পার্বতী দেবীর মন্দির। মন্দিরে আছে পার্বতী দেবীর মূর্তি। তোমার স্বামী সেখানে গিয়ে পার্বতী দেবীকে প্রণাম করবে। তারপর তাঁর কাছে সন্তান চাইবে।

: ঠিক আছে, সন্ন্যাসী ঠাকুর। আমি আমার স্বামীকে আজকেই দেবীর কাছে পাঠাচ্ছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

বেনে-বউ বাড়ি গিয়ে স্বামীর কাছে সকল ঘটনা খুলে বলে। বেনে তখনই নীল জামা পরে, নীল ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গলের দিকে রওয়ানা হয়। সঙ্গে কোদাল নিতে সে ভুল করে না।

যেতে-যেতে, যেতে-যেতে এক নীল ঘোড়ার সঙ্গে দেখা হয়। এই তো সেই নীল ঘোড়া! এখনই তো তার থামার সময়। এখানেই তো তার নামার জায়গা! সাত-পাঁচ ভেবে সময় নষ্ট না করে বেনে তখনই ঘোড়া থামিয়ে নেমে পড়ে। তারপর সেই গভীর জঙ্গলে বাড়ি থেকে আনা কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকে। মাটি খুঁড়তে-খুঁড়তে একসময় এক মন্দির দেখা যায়। এই সেই পার্বতী মন্দির। পুরো মন্দিরই সোনা, হীরা ও মাণিক্য দিয়ে বানানো। বেনে তখন মন্দিরের ভেতর ঢুকে পড়ে। সেখানে সে পার্বতী মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গড় হয়ে প্রণাম করে। তারপর প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলে--

‘আমার আছে ঘর-বাড়ি আর

গোরু-ঘোড়া-টাকা

কিন্তু আমার সোনার সংসার

লাগছে ফাঁকা-ফাঁকা!

মনে আমার দুঃখ অনেক

নাই কোনো সন্তান

আমি এখন তোমার কাছে

চাইছি কৃপা-দান।’

বেনের প্রার্থনায় দেবী সন্তুষ্ট হন। তিনি মূর্তির আবরণ থেকে বেরিয়ে আসেন। তারপর বলেন--

‘তোমার প্রার্থনায় আমি সন্তুষ্ট। তুমি কোন্ ছেলে নেবে? একটি ছেলে দিতে পারি, যে হবে সুস্থ ও সুন্দর কিন্তু বেশি দিন বাঁচবে না। অথবা আরেকটি ছেলে দিতে পারি, যে দীর্ঘদিন বাঁচবে, কিন্তু সে হবে অন্ধ।’

এই কথা শুনে বেনে চমকে ওঠে। ঠিক করতে পারে না, কোনটি সে চাইবে। কিন্তু একটি ছেলে হলেই হলো। তাই সে চাইল, ‘অত কিছু বুঝি না, দেবী। আমাকে একটি সুন্দর ছেলে দাও।’

: ছেলে তুমি পাবে, কিন্তু সে জেনো

বাঁচবে না বেশিদিন

আট বছরেরই তোমরা দু’জনে

হবে সন্তানহীন।

: তবু আমি একটি সুন্দর ছেলে চাই। মা, আমাদের তুমি কৃপা কর। আমি খালি হাতে ফিরে যাব না।

: বেশ, তাই হবে। তুমি আমার পেছেনের দিকে যাও। সেখানে আমগাছের তলে একটি গণপতির মূর্তি দেখতে পাবে। তুমি গণপতির পেটের ওপর উঠে একটি আম পেড়ে নেবে। মনে রেখো, কেবল একটি আম নেবে!

: তারপর?

: তারপর তো বাড়ি ফিরে যাবে

বউকে বলবে খেতে আমার আম

আমার দেয়া আমটি যদি খায়

ন’মাস পরে পুরবে মনস্কাম!

এরপর পার্বতী চোখের আড়ালে চলে গেলেন। বেনে চারিদিকে তাকিয়ে তাঁকে দেখতে পায় না। দেবীর কথামতো বেনে তখন গণপতির মূতির কাছে যায় মূর্তির পেটের ওপর উঠে আমগাছের নাগাল পায়। হাত দিয়ে গাছ থেকে একটি আম পাড়ে। দেখে গাছে অজস্র আম। তার ইচ্ছে হয়, সকল আম যে বাড়ি নিয়ে যাবে। তাই যত ইচ্ছা তত আম পাড়ে। তারপর সকল আম থলিতে ভরে ফেরার পথে পা বাড়ায়। কিন্তু দরোজার কাছে এসে দেখে তার থলিতে মাত্র একটি আম রয়েছে। বাকি আম কোথায় গেল? বেনে বুঝে উঠতে পারে না। সে আবার গাছের কাছে যায়। আবার আম পেড়ে থলি ভরে। কিন্তু দরোজার কাছে আসতেই দেখে আবার সেই একই কাণ্ড। থলিতে মাত্র একটি আম। কী আর করা! তাঁর মনে পড়ে, দেবী তাকে একটি আম নিতে বলেছে, তাই একটির বেশি নেয়া যাবে না--

বেনে বুঝতে পারে।

বেনে মন্দির থেকে বেরিয়ে সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা নীল ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি এসে বউকে সকল কথা খুলে বলে। বেনে-বউ আমটি নিজ হাতে কেটে খুব যত্ন করে খায়।

বেনে আর বেনে-বউ প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় পার্বতী দেবীর নাম নেয়। তাঁর পূজা করে। নয় মাস পরে পার্বতীর কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে একটি ছেলে। বেনের ঘরে আনন্দ আর ধরে না! সন্তান না হওয়ার অপবাদ ঘুচে যায়। এতদিনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়। ছেলের জন্ম দিতে পেরে বাবা-মা দু’জনেই খুশি! পাড়াপড়শীও খুশি! দেখতে-দেখতে ছেলে সাত বছর পেরিয়ে আট বছওে পা দেয়। এদিকে, ছেলেটি দিনে-দিনে বেশ ধর্মপরায়ণ হয়ে ওঠে। বাবা-মায়ের আশঙ্কা-- হয়তো ছেলেকে হারানোর সময় এসেছে!

বেনে-বউ ভাবে, এবার ছেলেকে বিয়ে দিলে হয়তো সংসারের দিকে মন থাকবে। আর সত্যিই যদি মারা যায়, তার আগে বিয়ে দেওয়াটাও হলো। জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে বিধাতার দেয়া এই তিন অভিজ্ঞতাও পূরণ করা হলো। স্বামীকে একথা জানায়। কিন্তু স্বামী এই প্রস্তাবে রাজি হয় না। সে বলে, ‘আট বছর বয়সের গোটা সময় তীর্থস্থানে কাটালে ভালো হয়। এতে ঈশ্বরের কৃপায় হয়তো অভিশাপ কেটেও যেতে পারে। তাই এখন ওকে তীর্থস্থানে পাঠাই। সেখান থেকে সুস্থভাবে ফিরে এলে বিয়ের কথা ভাবা যাবে।’

বেনের শ্যালক তাকে তীর্থস্থানে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেয়। শুভ দিন দেখে মামা-ভাগ্নে বারানসী তীর্থস্থানে রওয়ানা হয়। পথে তারা একটি গ্রামে বিশ্রাম নেয়। তারা দেখতে পায় একটি বাড়ির পাশে কয়েকটি ছোট মেয়ে খেলা করছে। একটি মেয়ে বলে, ‘আমি তো বিধবা মেয়ে, আমাদের দুঃখ কে বোঝে!’

আরেকটি মেয়ে বলে, ‘না, না, আমাদের ঘরে কোনো বিধবা নেই। তাই আমি কখনো বিধবা হব না। কারণ--

আমার মা তো রোজ সকালে

গায় পার্বতীর নাম

দুঃখ-কষ্ট আসে না তাই

হয় না বিধি বাম।’

মেয়েদের এই কথাবার্তা মামার কানে আসে। সে ভাবে, যে মেয়েটি কখনো বিধবা হবে না বলছে, তার সঙ্গে যদি ভাগ্নের বিয়ে দেয়া যায়, তাহলে ভাগ্নেটির আর অকালে মরার আশঙ্কা থাকবে না। অল্প বয়সে মরে যাওয়ার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। ‘সতীর পুণ্যে পতির মুক্তি’! তাই মামা ওই মেয়ের সঙ্গে নিজের ভাগ্নে বিয়ের পরিকল্পনা করে। আপাতত বিশ্রামের জন্য গ্রামের কোণে একটি অতিথিশালায় যায়।

মজার ব্যাপার হলো, ওই মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বাগদানের আগেই পাত্রটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই বিয়ে করতে আসেনি। লগ্ন মতো বিয়ে না হলে মেয়ের অমঙ্গল হয়। বাবা-মায়েরা এই কথা বিশ্বাস করে। তাই তারা গোধূলি লগ্ন পেরিয়ে যাওয়ার আগেই অর্থাৎ দিনের মধ্যেই মেয়েকে অন্য কোনো বরের হাতে তুলে দেয়ার চিন্তা করে। মেয়েটির বাবা-মা নতুন বর খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। তারা ভাবে, এই গ্রামে আজ প্রথম যে অতিথিকে দেখা যাবে, তার সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দেবে। তারা গ্রামের অতিথিশালায় যায়, কোনো নতুন অতিথি এসেছে কিনা, তা দেখতে। সেখানে তারা মামা-ভাগ্নেকে পেয়ে যায়।

মেয়েটির বাবা-মা ছেলেটির মামাকে তাদের ইচ্ছের কথা জানায়। মামা মুহূর্তেই রাজি হয়ে যায়। এবং ওদিনই গোধূলি লগ্নে বিয়ের আয়োজন করা হয়।

ভালোয়-ভালোয় বিয়েটি হয়ে যায়। তারা একটি ঘরের দেয়ালে শিব ও পার্বতীর ছবি আঁকে। এবং সেই ঘরে নতুন বর-কনেকে ঘুমাতে দেয়।

মেয়েটি স্বপ্নে দেখে দেবী পার্বতী তার কাছে এসেছে। পার্বতী তাকে বলে, ‘একটি সাপ এসে তোমার স্বামীকে কামড়াতে আসবে। তুমি তাকে দুধ খাওয়াবে। এই বলে একটি মাটির ঘড়া বিছানার পাশে রাখে। সাপ এসে ঘড়ায় রাখা দুধ খাবে। তারপর সে খড়ার মধ্যে ঢুকে পড়বে। তখন তোমার গায়ের জামা খুলে ঘড়ার মুখটি বেঁধে ফেলবে। সকালে তুমি মুখ বাঁধা ঘড়াটি তোমার মায়ের কাছে দেবে। আর মনে রেখো--

সাপটা দেখে চমকাবে না

ভয় পাবে না কোনো

স্বামীর মঙ্গল চাইলে এখন

সময়টুকু গোনো।’

এরপর তার ঘুম ভেঙে যায়। কিছুতেই আর ঘুম আসে না। তাই স্বামীর শিয়রে বসে থাকে।

কিছুক্ষণ পরে দেখে যে, দেবীর কথাই সত্যি হতে চলছে। রাতের শোবার ঘরে সাপ আসে। সাপ এসে সামনে দুধের ঘড়া পেয়ে দুধ খায়। দুধ খেয়ে ঘড়ার ভেতর ঢুকে পড়ে। মেয়েটি তখন গায়ের জামা খুলে ঘড়ার মুখ বেঁধে ফেলে।

সকালে ছেলেটি তার বউয়ের হাতে একটি সোনার আংটি পরিয়ে দেয়। মেয়েটি তার স্বামীকে মিষ্টি খাওয়ায় এবং মিষ্টির বাটিটি তাকে উপহার দেয়।

সকালে মামা-ভাগ্নে তীর্থপথে যাত্রা শুরু করে।

তারা চলে যাওয়ার পরে মেয়েটি তার মায়ের কাছে গতরাতের সকল কথা খুলে বলে। তারপর মুখ-বাঁধা ঘড়াটি তার মায়ের কাছে দেয়। মা ঘড়ার মুখ খুলে দেখতে পায় সেখানে কোনো সাপ নেই। সাপের বদলে ঘড়ার তলায় একটি মালা পড়ে আছে। মা তখন মালাটি তুলে মেয়ের গলায় পরিয়ে দেয়। কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যায়। বর ও তার মামা ফেরে না। মেয়টির বাবা-মা খুব চিন্তায় পড়ে।

এদিকে যে ছেলের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ের কথা ছিল, সেই ছেলেটি রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠে। পছন্দ করা মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে সে ব্যথিত হয়। কিন্তু সে আর তাদের মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায় না। এদিকে তাদের জামাইয়ের ফিরে আসার লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। নিরাশ হয়ে তারা গ্রামের মাঝে একটা অতিথিশালা তৈরি করল। সেখানে যত তীর্থযাত্রী যায়, প্রত্যেককে আপ্যায়ন করে। এদের মধ্যে তাদের জামাই একদিন এসে হাজির হবে, এই আশা তাদের মনে।

এই ভাবে দিন যায়। মা অতিথিদের জল খাওয়ায়। মেয়ে অতিথিদের যতœআত্তি করে। মেয়েটির ভাই অতিথিদের কপালে চন্দন এঁকে দেয়। মেয়েটির বাবা অতিথিদের পান-সুপারি খাওয়ায়।

কিন্তু হায়! সবকিছুই নিরাশা। মেয়েটিকে যে সোনার আংটি দিয়েছিল সেই যাত্রী আর ফিরে আসে না। মেয়েটি যাকে মিষ্টির বাটি উপহার দিয়েছিল, যার মুখে মিষ্টি তুলে দিয়েছিল, সেই মুখটির দেখা আর পাওয়া যাচ্ছে না।

এদিকে, মামা-ভাগ্নে বারানসী গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে তারা বেশ কিছু সাহায্য পায়। ফলে তারা সকল পবিত্র স্থান ঘুরে দেখে। এবং সাধু-সন্ন্যাসীদের আশীর্বাদ লাভ করে। একদিন ছেলেটি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে সে স্বপ্নে দেখে যে যমদূত তাকে টেনি নিতে চায়। তার হাত ধওে টানে আর যমদূত বলে-

‘তুই তো এখন পা দিয়েছিস

সাত পেরিয়ে আট-এ

বন্ধ হলো কোনাবেচা

আজকে ভবের হাটে।

আর হবে না তোমার থাকা

এমন সোনার বঙ্গে

আমি তোমায় নিতে এলাম

চল আমার সঙ্গে।’

এমন সময় দেবী পার্বতী এসে সামনে দাঁড়ায়। যমদূতকে উদ্দেশ্য করে বলে--

‘আমার কথা দু’কান দিয়ে

শোন হে যমদূত

মঙ্গলগৌরী দেবী আমি

নইকো মরা ভূত!

তোমার সাথে যাবে না সে

থাকবে আমার কোলে

ভালোয় ভালোয় এখান থেকে

এক্ষুনি যাও চলে।’

এই কথা বলে দেবী পার্বতী যমদূতকে তাড়িয়ে দেয় এবং তাকে রক্ষা করে। ছেলেটি ঘুম থেকে জেগে উঠে স্বপ্নের কথা তার মামাকে জানায়। কিন্তু মামা খুব খুশি। কারণ আট বছর বয়স পেরিয়ে গেলেও ভাগ্নে এখনো জীবিত রয়েছে। মামা তাকে বলে, ‘তৈরি হও, আমরা কালকেও বারানসী ছেড়ে যাব।’

ফেরার পথে তারা সেই গ্রামে এসে উপস্থিতি হয়। গ্রামের একটি পুকুরপাড়ে বসে তারা সকালের নাস্তা খেতে বসে। ইচ্ছে করেই খায়। এক চাকরাণী তাদেরকে ডেকে নিয়ে যায় সেই ঘরে, যেখানে ছেলেটির শ্বশুরের পরিবার তাদের অপেক্ষায় রয়েছে। মামা প্রথমে যেতে রাজি হয় না। তখন তাদের নেয়ার জন্য পাল্কি আসে। তারা দুজনে সেই পাল্কি চড়ে রওয়ানা হয়। মেয়েটির তার পা ধুয়ে দেয়ার সময় তাকে চিনতে পারে। সে হাতের আংটিটি দেখায়। ছেলেটি তার হাতের মিষ্টির বাটিটি দেখায়। মেয়েটির বাবা-মা খুব খুশি হয়। তারা ছেলেটির বাবা-মাকে খবর দিতে লোক পাঠায়।

ছেলেটির বাবা-মা খুব খুশি হয়। খবর পেয়েই ছুটে আসে। তারা মেয়েটির বাবা-মাকে ধন্যবাদ জানায়, কৃতজ্ঞতা জানায়। তখন মহাধুমধামের সঙ্গে পার্বতীর পূজা দেয়া হয়। যেহেতু পার্বতীর বরে ছেলেটি বেঁচে যায় এবং মেয়েটি তার স্বামীকে খুঁজে পায়। তাই ওই দিনটিকে পার্বতীর নামে রাখা হয়। পার্বতীর আরেক নাম মঙ্গলগৌরী। দিনটির নাম হয় মঙ্গলবার। ওটি ছিল সপ্তাহের তৃতীয় দিন। সপ্তাহের তৃতীয় দিনের নাম সেই থেকে মঙ্গলবার।

মঙ্গলগৌরীর ব্রত থেকেই

মঙ্গলবারের নাম

পরনকথার গল্প শুনেই

এই কথা জানলাম।

পূজা সবাই দাও পার্বতীর

বিপদ যাবে দূরে

এই কথাটি আজকে আমি

জানাই ছন্দ-সুরে।

মঙ্গলবারের মঙ্গলগৌরী

পার্বতীর এক নাম

ব্রত পালন করলে সবার

পূরবে মনষ্কাম।

................................................





মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ৯:০৫

রোডায়া বলেছেন: হুম, মেলা জটিল কাহিনী৷ যে দেবী বলল ছেলে আট বছর বাঁচবে, সেই আবার তাকে রক্ষা করলো কেনো বুঝলাম না৷ দেবীদের বোঝা বড় দায়! এরা খালি পেঁচায়৷

২৯ শে জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১:৪৩

তপন বাগচী বলেছেন: দেবীদের বোঝা বড় দায়!
ওই যে তার আরেক ব্রতকারীর মন রক্ষা করা আর কী!

২| ২৭ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ৯:১২

হীরণ্ময় বলেছেন: অতি জটিল ঘটনা ! তবে নায়ক নায়িকার মিল হইসে এইডা বহুত আনন্দের কথা !:)

২৯ শে জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১:৪৪

তপন বাগচী বলেছেন: ধন্যবাদ!

৩| ২৭ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ৯:৩৩

মাহবুবুল আলম লীংকন বলেছেন: ভাল লাগলো। '"সংবাদ" -এ আপনার লেখাটা দেখেছি।

২৯ শে জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১:৪৫

তপন বাগচী বলেছেন: পত্রিকায় দেখতে ভালোই লাগে! ধন্যবাদ!

৪| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৩২

মেহবুবা বলেছেন: সাতদিনের লিঙ্ক একসাথে করে দেবেন ।
আমার মেয়েকে অনেকদিন আগে আপনার এই লেখার কথা বলেছিলাম , পরে ভুলে গিয়েছি ।

২৩ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:১৪

তপন বাগচী বলেছেন: সাতদিনের লেখা নিয়ে আমার বই বেরুচ্ছে সাতদিনের সাতকাহন নামে। ঠিকানা পাঠাবেন আপনার মেয়ের জন্য বই পাঠাবো। মেয়েকে শুভাশিস!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.