নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

থার্ড আই

তাপস কুমার দে

থার্ড আই

তাপস কুমার দে › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্টেপ পেরেন্টস (Step parents)

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ২:৩৩



(এক)

কালের সাক্ষী বটবৃক্ষ



আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। মেঘ ডাকছিল গুড়ুম গুড়ুম।বৃক্ষরাজি ডালপালা মেলে ধরে সিক্ত করছিল দেবতার পরশে।চারদিকে সবুজের মহাসমাবেশ।আষাঢ় মাস বৃষ্টি হচ্ছিল মুষলধারে।রাফুদের একতলা পুরানো বাড়ির ছাদের কোণে দূর্বাঘাসগুলো গজিয়ে উঠছিল সুযোগ পেয়ে।কুনো ব্যাঙেরা স্কুলের খালিমাঠে ডাকাডাকি করে রতিক্রিয়ায় মজেছিল বেশ।ঘন বৃষ্টিতে সমীর দোবের পুকুর ভেসে মাছগুলো এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছিল।এলাকার ছোকরারা মাছ ধরছিল মনের আনন্দে।

রংচটা ঝিনুক সিনেমা হলে বুনো কবুতরগুলো গা এলিয়ে অলসের ঢঙ্গে শুয়েছিল।খিচুরীর ম ম ঘ্রাণ নাকের চিপা গলিতে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল বারবার।ষড় ঋতুর এ দেশে ছয়টা রং সমান তালে দর্শণ দেয়।পুঁই বিনা যতেœ বেড়ে উঠছিল বেড়া বেয়ে।বৃষ্টিতে হাটু পানি জমেছিল সেন্ট জোসেফস হাই স্কুলের মাঠে।চায়ের দোকানগুলোতে লোকজন জড়ো হচ্ছিল এক ঢোক গরম চা গেলার জন্য।শিমুদের শেওলা পড়া চৌবচ্চাতে কই,শিং,তেলাপিয়া মাছ বৃষ্টির পানি পেয়ে মনের আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছিল।খাবারের খোজে ন্যাংট্যা কাউয়্যা বিদ্যুতের তারে বসে দিব্যি ভিজছিল।

খুলনা প্রি-ক্যাডেট স্কুলের মাঠে বিকালে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলার প্রস্তুতি চলছিল জোড়েসোরে।

কদম ফুল ন্যাড়া বানিয়ে ক্রিকেট খেলছিল ছোকরারা।

বুনো প্রেম কাননে বৃদ্ধ মাস্টার মশায় রোদ ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে পড়িয়ে যাচ্ছিল সারা দিন-রাত।

প্রতিদিনের মতো ঢং ঢং ঢং বারোটার ঘন্টা বাজতেছিল ক্যাথলিক র্গীজায়।



উজ্জল,মাথায় বৃষ্টি নিয়ে সাইকেলে চড়ে বাড়ি এসে হাজির হলো।লিলি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিল বৃষ্টিতে থেতলে যাওয়া উজ্জলের মুখের দিকে।অন্য দিনের তুলনায় আজ লোকজন কম রাস্তায়। প্রয়োজন ছাড়া কেউ রাস্তায় বের হচ্ছিল না। দুরন্ত ছেলের দলেরা ঝ্যাপ্যাং ঝ্যাপ্যাং লাফাচ্ছিল বৃষ্টির পানিতে। হাবুদের জাম গাছের কালোজাম পড়ে একস্তর জমেছিল নিচে। হোসেন লুঙ্গি আধাকাচা দিয়ে দু’হালি ইঁলিশ দু’হাতে নিয়ে ভিজতে ভিজতে ঘাট থেকে বাড়ী ফিরছিল।টেক্সটাইল মিলের তাল গাছে তারির ঠিলা বৃষ্টির জলে ভরেছিল। অনিল গাছি বাকের দু’মাথায় দশটা ঠিলা বেধে নিয়ে চলছিল।বৃষ্টির কারনে আজ তারি পানসে লাগবে। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় দোকানের গ্লাসের উপর পয়সা জমে যাচ্ছিল, দোকানী পয়সা টেনে তুলতে গিয়ে অবাক হচ্ছে আজ,কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না।রানের সাথে অন্ডকোষ ঝুলিয়ে কসাই গরুর গোস্ত বিক্রি করছিল।

সন্ধ্যায় হালকা শীত শীত অনুভব হচ্ছিল।পাড়ায় একটি মাত্র সাদাকালো টিভি ছিল দাদুর।রূপসা নদীতে পানি বাড়ছিল। রেডিওতে মোংলা বন্দরকে দুই নাম্বার সংকেত,আবার বলছি দুই নাম্বার সংকেত দেখিয়ে যেতে বলছিল বারবার। রাস্তার উপর সোডিয়াম বাতিটা এক পায়ে দাড়িয়ে ছিল নিরুপায় হয়ে। টিনের ঘরের নিচে বসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ব্রিটিশের স্টার সিগারেট ফুকছিল ল’র বাবা।

আযানের সুমধুর সুর বাতাসে ভেসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল আর মন্দিরে শঙ্খ ধ্বনি বেজে উঠছিল। ঘরে ঘরে যুবতীরা উলু ধ্বনি দিচ্ছিল। উলু ধ্বনি প্রচীন প্রথা। এতে স্বরধ্বনি স্পষ্ঠ হয়,উচ্চারণ শুদ্ধ হয়। বায়ুকে চাপ প্রয়োগ করে সামনের দিকে নির্গত করার সময় জিহ্ববার অগ্রভাগ সঞ্চালন করার ফলে শব্দের সৃষ্টি হয়। আফ্রিকার আদিবাসিরা শিকারের সময় একে অপরকে সংকেত দেয় এ শব্দের মাধ্যমে। যে কোনো শুভ কাজেও ব্যবহৃত হয়ে আসছিল উলু ধ্বনি।

সন্ধ্যায় হাতকাটা রমজানের গল্প শুনে ভিতু হচ্ছিল রিপন ও রুকসানা।

সাপের মত সর্পিল গতিতে চলা কেডিএ এপ্রোচ রোড সোনাডাঙ্গা মেইন রোডকে ছেদ করে যোগ চিহ্নের সৃষ্টি করেছে চৌরাস্তার মোড়ে। মোড়ে প্রবাসের হোটেলে বিবিসির তাজা খবর শুনতে বুঁদ হয়ে ছিল এলাকার রাজনীতি সচেতনরা। গরম লাল চা আর বিবিসির সংবাদ এক পেয়ালায় বন্দি হতো ওখানে। ম্যাক গাইভার সিরিজের নায়ক রিচার্ড ডিন এন্ডারসনের রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানের যাদুতে মস্ত সবাই। নিশিতে বাবুর লন্ড্রিতে মোহাম্মদ রফির হিন্দি গানের আসর জমেছিল বেশ। হু হু শব্দে ট্রেন ছুটছিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। হাতেগোনা কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান বাচিয়ে রেখেছিল খুলনাকে। মুষ্টিমেয় শিল্পপতিরা আরো ধনশালী হচ্ছিল শ্রমিকদেরকে শোষণ করে। কিছু রাজনীতিবিদ রাজার হালে ছিল।সোনার সিংহাসনে বসে উজির দিয়ে প্রজা শাসন করছিল বছরের পর বছর। রক্তচোষা জোঁকের মতো ক্লিনিকগুলো গজাচ্ছিল পাড়ায় পাড়ায়। কিন্ডার গার্ডেনের বিলাসী ফ্যাশানে পিছিয়ে পড়ছে হতদরিদ্র সরকারী প্রাইমারী স্কুলের নবীন শিক্ষার্থীরা। সন্ত্রাসীরা লালিত হচ্ছিল রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায়। টাকার বিনিময়ে বধ করছিল রাজপথের সৈনিকদের। নীরবে শব্দরা কলম ভাঙছিল পত্রিকায় পাতায় পাতায়।অসহায় শব্দগুলো জড়ো হচ্ছিল প্রতিদিন।শব্দের গগণবিদারী চিৎকার।আর মায়ের বুকে ক্ষুধার্ত শিশুর আর্তনাদ। দূর গগণে নীল আসমানের উর্দ্ধে গোংগাচ্ছিল এক সরল রেখায় মিলিত হয়ে। সবার অজান্তে......। বৃদ্ধ পোষ্ট মাষ্টারের চোখের জ্যোতি ম্লান হয়ে আসছিল এমন সময় দূরন্ত বেগে ধেয়ে আসল অত্যাধুনিক গতি সম্পন্ন নতুন প্রযুক্তির ইন্টারনেট সেবা। অবহেলিত সুন্দরবন তলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্র বক্ষে। রাজপথে রক্তস্নানে সংগ্রামরত অবহেলিত খুলনাবাসী।

ঝিনুক হলের সামনে তিন রাস্তার মোড়ে কালের সাক্ষী হয়ে ঐ বটবৃক্ষটা বড় হচ্ছিল অদ্ভুত এক দৃষ্টি নিয়ে।

সব দেখে,সব শোনে সে!



সকাল বেলায় পানিতে ডোবা ভাঙ্গা রাস্তার দু’পাশ ধরে নারী-পুরুষ হেঁটে যাচ্ছিল।অনেক দিনের পরিচিত পথ ধরে হেটে চলছিল।রাস্তার ইট,বালু,ধুলা আর পাশের মাটিতে জর্ন্মানো দুর্বাঘাস যেন তাকিয়ে থাকতো তাদের পথচেয়ে। অনেকে দূর থেকে আসতো আর বাড়ি ফিরে যেতো বিকালে।তাই কাপড়ের পুঁটলিতে খাবার বেঁঁধে নিয়ে আসতো সাথে করে। সাদা রঙের পুরানো দেহ বসে যাওয়া করোলা গাড়ীটি র্কাটুনের মতো হেলে দুলে আসতে দেখে সাবধানে মিলের শ্রমিকরা হাটা মন্থর করে দেঁয়াল ঘেষে দাড়ালো ডোবা থেকে খানিকটা দূরত্বে,কাদা-পানি ছিটকে কাপড় নষ্ট হতে পারে এ ভয়ে। সারারাত টিপ টিপ বৃষ্টিতে রাস্তার ভাঙ্গা অংশ পানিতে ভরে ডোবায় রূপ নিয়েছিল। যতদূর চোখ যায় ততদূর রাস্তা নদীতে জেগে ওঠা চরের মতো দেখাচ্ছিল। রাস্তার চেয়ে ডোবার সংখ্যা বেশি ছিল। ড্রাইভার এক্সেলেটর থেকে ডান পা ব্রেকে তুলে অভ্যস্ত হাতে গাড়ীর সামনের চাক্কা ভাঙ্গা রাস্তার ডোবায় ধীর গতিতে ডুবিয়ে চলে যাওয়ার পর হাটা শুরু করলো দ্রুত পায়ে। হুইসেলের হু হু শব্দ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গেট বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে তাড়াহুড়ো আর ব্যস্ততা।

খুলনা টেক্সটাইল মিলস। সোনাডাঙ্গা ও বয়রার মাঝে আবস্থিত এটি।এ মিলকে কেন্দ্র করে এখানকার ঘনবসতি বেড়েছিল দিন দিন। বাংলাদেশের সব বিভাগের লোকের দেখা মিলতো এই খুলনা শহরে নোয়াখালী,ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল ও পিরোজপুরের মানুষ জন একটু বেশি এ শহরে।



এ শহরটা খুব বড় না। ছোট্ট হলেও মিল-কলকারখানার জন্য নামটা অনেক বড় শিল্পনগরী খুলনা। টেক্সটাইল মিল,নিউজপ্রিন্ট মিল,র্হাডবোড মিল,জুট মিল ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরী,শিপ ইর্য়াড ও লবন শিল্পসহ অনেক ছোট বড় শিল্প কারখানা এখানে।দিন রাত কাজ চলতো।সবাই ব্যস্ত যার যার কাজে।হু হু শব্দে ঘন্টায় ঘন্টায় মিলের বাঁশি বেজে উঠতো।বৈদ্যুতিক যন্ত্রের বুকচিরে ওঠা গগণভেদী বাঁশির শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে ঠিক মানুষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে জানান দিত সময় হয়েছে।একদল কাজে যোগ দিত।অন্যরা কাজ শেষে ঘরে ফিরে শান্তিতে ঘুমাতো।ক্লান্ত হলেও মানুষগুলো সুখী ছিল।তাদের চোখে-মুখে হাসি ছিল।



সুন্দরবন এবং ভৈরব ও রূপসা নদী খুলনাকে রূপে গুণে সুন্দরী করে তুলেছে।তার প্রেমের অনবদ্য ফসল মারাঠীর প্রেমকানন। কি প্রেমসুধা পান করেছিলেন মারাঠী মহাশয় রূপসার বক্ষ থেকে।তার প্রেমে ব্যাকূল হয়ে প্রেমের বাগান করেছিলেন এ নগরীতে।যা আজও শহরবাসীর স্মৃতির পাতায় কড়া নাড়ছে।

সুন্দরবন থেকে কাঁচা মাল আসতো মিলগুলোতে এবং মোংলা বন্দরের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজতর ছিল খুলনা থেকে।



ভৈরব ও রূপসা নদী।এ নদীর পাশ দিয়ে গড়ে উঠেছিল ঘাটগুলো।বর্ষার মৌসুমে ইঁলিশ মাছে বোঝাই ট্রলার এসে ভরে যেত।মাছ নিয়ে আসে জেলেরা এ ঘাটে।ট্রলারে ট্রলারে সারি বাধা থাকতো মাঝ নদী প্রর্যন্ত।ইঁলিশ,রূপচাঁদা,শাপলা,কঙ্কন,ছুরি সহ শত প্রকার মাছ সাগর ও নদী থেকে ধরে আনতো এখানে।গরীব দিনমজুরা ইঁলিশের বোঝা মাথায় নিয়ে চলতো ট্রলার থেকে আঁড়তের দিকে।তাদের পিছনে তেল মাখানো লাঠি হাতে মোটা তাজা পালোয়ানও চলতো সমতালে। তীক্ষè দৃষ্টি ছিল তার,চোখ ফাকি দেওয়া মোটেও সহজ না।



পিরোজপুরের উজ্জল ও লিলি। বারো বছরের লিলি। বিয়ে হয়েছিল কুড়ি বছরের উজ্জলের সাথে। লিলির বিয়ের বয়স বাড়তে বাড়তে পাঁচ সন্তানের মা হল সে। লিলি মা শব্দের অর্থ জানার আগেই তার সন্তানরা তাকে মা বলে ডাকতো। মা-জন্মদাত্রী,মাতৃভূমি,জগৎজননী। মা শব্দের অর্থ বহুমুখী,ব্যাপক। ষষ্ঠ সন্তান সম্ভবা লিলি। গভীর রাতে প্রসবকালে ব্যাথায় ছটফট করতে করতে মা ও আগত সন্তান দু’জনই মারা গিয়েছিলো। রেখে গেলো মা হারা পাঁচ সন্তান।



লিলির স্বামী সরকারী অফিসে চাকরী করতো। অফিস শেষে ক্লান্ত দেহে বাড়ী ফিরতো উজ্জল। লিলির মৃত্যুতে উজ্জল দিক্শুন্য।

চারিদিকে শুধু শুন্য! আর শুন্য!



ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকালে কষ্ট দিগুণ বেড়ে যেত। মা-মরা দুধের সন্তান। সব সময় কাঁদে। এদিক ওদিক তাকায় মাকে খোঁজে। ছেলে-মেয়েরা মায়ের চেহারা পেয়েছে।

কোথায় গেছে মা?

কবে আসবে ?

এমন সব অবুঝ প্রশ্ন বাবার কাছে ছিল।

কি সান্তনা দেবে বাবা?

কোথায় এসব প্রশ্নের উত্তর?

নিস্তব্ধ চেহারা,অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো উজ্জল ওদের চোখের দিকে। উত্তর খোঁজে বারবার।

প্রশ্নগুলো বাতাসে মিলে যায় নিঃশব্দে।বাচ্চাদের দেখলে ওদের মায়ের কথা মনে পড়ে যেত.........।সীমাহীন শূন্যতার কি নিদারুণ আহাকার?



উজ্জল অফিসের কাজ শেষে ঘরে ফিরলে লিলি কুঁয়া থেকে বালতি ভরে পানি তুলে দিতো।ঠান্ডা পানিতে উজ্জল মুখ-হাত ধুয়ে গোসল করে নেয়।লিলি গল্প করতে করতে গামছা-লুঙ্গি এগিয়ে দেয়।

রসিকতা করে উজ্জলের দু’ঠোট ফাটায়,লিলি।

লিলির মিষ্টি কথা আর ঠোঁটের কোণের হাসিতে উজ্জলের মন ভরে যায়।

এখন তা অতীত।

শুধু স্মৃতি।

একটি সরু কাঁচা রাস্তা কুঁয়ার পাশ ঘেঁষে সোজা সামনের দিকে সরকারী পাকা রাস্তায় মিলেছে।দিনের আলো ভরা আকাশ,পাখির ডাক,উঠোনে দাড়িয়ে থাকা নিম গাছটা,সামনের সুউচ্চ শিল্প ব্যাংক ,টবে আনা ক্ষুদে মরিচ গাছটা,আলনায় সাজানো লাল নীল শাড়ী,পছন্দের কালো হাইহিল জুতাটা ,ফ্রেমে বাধা রঙ্গিন সুতোয় কাপড়ে ফোড়ানো গাছের ডালে সবুজ টিয়ে পাখিটি,ঝুলতে থাকা গীর্জার সোনালী রঙের ঘন্টাটা, দিন শেষে নেমে আসা আধাঁর কালো রাত সবই ছিল।শুধু লিলি নাই।

মা ছাড়া একদ- থাকতে পারতো না এক বছরের ছোট ছেলে পল্লল। ঘরের ভিতর কেবল মা-মা রব।

যে আসে তাকে জিজ্ঞাসা করতো মা-মা?

মাঝ রাতে দুধের তৃষ্ণায় কেদে ওঠে পল্লল।

বাবার বুকে মায়ের স্তন খুজতো।



পিরোজপুর বাসস্টান্ড থেকে পায়ে হেঁটে অল্প কিছুদূরে লিলির মা’র বাড়ী।মেটো গন্ধভরা ভাঁজপড়া অনেক দিনের গোছানো টাকা কাপড়ের থলিতে নিয়ে রওনা দিয়েছিল খুলনার উদ্দেশ্যে,নাতি-নাতনীদের দেখতে। নানী খুবই সহজ-সরল। প্যাচগোচ বুঝতো না।লিলি গ্রামের সকলের আদুরে।লিলি মারা যাওয়ার খবরে গ্রামের সবাই সমব্যাথি।গ্রামের পথে পথে যার সাথে দেখা হতো সেই জানতে চায়,‘কোথায় যাও গো নানী ?’ জবাব ছিল না নানীর।

নানী খুব রসিক।পথে কারো সাথে দেখা হলে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করা তার স্বভাব।এখন মনমরা।সবাই বোঝে,সান্ত¡না দিয়ে চলে যায়।

খুলনায় যেতে যেতে তার দুপুর হয়েছিল।

নানীর একমাত্র সন্তান লিলি।মেয়ে মরার শোকে পাথর।

নাতি-নাতনীদের বুকে জড়িয়ে মেয়ে হারানোর সান্ত¡না খুজেছিল তখন।



সন্তানের ভারে লিলি মারা গেল।উজ্জল আর রাজনীতিবিদ দু’জনই ক্ষমতার লড়াইয়ে নিমজ্জিত। একজনের যৌন ক্ষমতা তো অন্যের দখলের ক্ষমতা প্রবল। দেশ স্বাধীন হয়েছে,কিন্তু পরাধীনতার শিকলে বাধা আমাদের চিন্তা-চেতনা।এগুলো পুরানো শব্দ কেউ পড়তে চায় না। তারপরও নীরবে বহন করে চলছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম....।

বেঁচে ছিল লিলির বাচ্চারা।

কি হবে এদের ভবিষ্যৎ?

উজ্জল কি ভেবেছিল?ভাবে নাই।

গিজগিজ করে,মানুষ আর মানুষ।এতটুকু জমি তার ষোল কোটী ভাগিদার।

চাষের জমি নাই।

বসবাসের জায়গা নাই।

যা আছে, লুটে-পুটে খাচ্ছে।

একজন খায় পাহাড় অন্যজন খায় নদী।বন-জঙ্গল।বাদ নাই কিছুই।কুকড়ে কুকড়ে খাচ্ছে।সব কিছু। বাতাস খাইছে অক্সিজেন নাই।কার্বন-ডাই-অক্সাইড।

পানি ছিল সুযোগে খাইছে পড়শি।

যা পায় তা নিজের মনে করে।

বাকী আছে কেবল মানচিত্র!



এক সপ্তাহ পর।নানীর সাথে পল্লব পিরোজপুর যাচ্ছিল।নানীর আহ্লাদে পল্লব।নানী যেখানে পল্লব সেখানে।বয়স হয়েছিল।চোখে ছানি পড়েছিল দূরের জিনিস দেখতে পেতো না।দেহের জোরে চলছিল।অনেক হিসেবে।নানীর ভিটে মাটি,সহায়-সম্পত্তি অনেক।পুকুর ভরা মাছ,পাকা ধানের ক্ষেত,সবুজ গাছ-গাছালি সব দেখাশুনা করতো দূরের আত্মীয়রা।



লিলির বড় ছেলে পল্লব।বয়স বারো বছর। মায়ের মতোই শান্ত। মা মারা যাবার পর নানীর সাথে পিরোজপুরে থাকতো।ক্ষণে ক্ষণে মাকে মনে পড়তো ওর। লিলির মুখের ষড়ঋতুর মিষ্টি ছড়াঁ পল্লবের কানে ধ্বনিত হতো সবসময়।পল্লব ছড়াঁ আওরায় আর মাকে স্মরণ করতো



‘গ্রীষ্মে ঝড়-ফল,

বর্ষায় নদী-জল।

শরতে কাশফুল,

হেমন্তে ধান্যকূল।

শীতে শুকনো বিল,

বসন্তে মনের মিল।’



মায়ের সাথে পল্লবের অনেক মিল দেহের গড়ণ-বরণ মায়ের মতো ছিল।ছড়াঁর প্রতিটি শব্দ ও খাতায় লিখে রেখেছিল যদি ভুলে যায়।নিজের অজান্তে চোখ থেকে পানি ঝরছিল গড়গড় করে।চোখের পানি পড়ে ভিজে ফুলে উঠছিল খাতার পৃষ্ঠা।নানী পল্লবকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেছিল তখন। সান্ত¡নার ভাষা ছিল হয়তো সেটা।( চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.