![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সূচী:
১. কালের সাক্ষী বটবৃক্ষ ।
২. কাঠঠোকরার কষ্ট।
৩. জীবনের মেলা।
৪. দুষ্টুর কালো হাত
৫. স্টেপ পেরেন্টস।
৬. গ্রামের নাম সোনাডাঙ্গা।
৭. বিষাক্ত ছোবলে লাশের নগরী।
(দুই)
কাঠঠোকরার কষ্ট
নারিকেল-সুপারির গাছগুলো তর তর করে বেড়ে আকাশ ছুঁতে চায়।এ অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ীতে নারিকেল ও সুপারির গাছ চোখে পড়ার মতো।বঙ্গোপসাগরের তীরে এ অঞ্চল,পানিতে লবন বেশি হওয়ায় গাছগুলোর বৃদ্ধি বেশি।
হাবুদের বাড়ীর পিছনে নারিকেল গাছটায় একটা কাঠঠোকরাটা সারাদিন ধরে ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে একটা গর্ত করে কোথায় যে চলে গেল কেউ জানে না।কাঠঠোকরাটা আর ফিরে এল না কোনদিন।হাবু এয়ার গানের মাথা উচিয়ে ওকে নিশানা করছিল।আর কাঠঠোকরা ঠোকাতে ঠোকাতে পিছন ফিরে বন্দুকের নল দেখে ভয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল বেচারা।বেচারা পাখিটা এত কষ্ট করল সেখানে অন্য একটি পাখি এসে বাচ্চা ফুটিয়ে দিব্যি ঘর সংসার করছিল।
একেই বলে কপাল,তপ্ত রোদে গর্ত করলো কাঠঠোকরা আর বৌকে নিয়ে আহ্লাদে সংসার করছিল শালিক।
পাশের ঘরের কালার মা উজ্জলের ছেলে-মেয়ে দেখাশুনা করতো।উজ্জলের মেয়ে পিউ,পলি আর ছেলে পাশা,কালার মার কথা শোনে সব সময়।মা মরার শোক তাপ ততটা বুঝতে পারে না ওরা।ছোট ছেলে পল্লল মা-মা করে কেঁদে মরতো সারাক্ষণ।
কে বুঝ দেবে ঔ দুধের শিশুটিকে।ভাই-বোনেরা ভাগাভাগি করে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। যতক্ষণ ঘুমায় ততক্ষণ শান্তি।ঘুম ভাঙ্গলে মা-মা কান্না-কাটি।কচি চিকন কন্ঠের চিৎকার সবার মনে দাগ কেটে যেত।মুখখানা খুললে হতো।হা হা হা চিৎকার শুরু করতো।বাশি বাজতে থাকতো সারা দিন-রাত। কারো কোলে উঠতে চাইতো না,ও।
কালার মা মাঝে মাঝে রেগে বলতো,‘মাগি মইরা বাচছে।বেচে থাকলে বুঝত জ্বালা।’
উজ্জল অফিস শেষে বাড়ি এসে গা বিলিয়ে দিতো বিছানায়।ছোট্ট ছেলেমেয়েরা বাবাকে পেয়ে আহ্লাদে তার কাছে ঘুর ঘুর করতো সারাক্ষণ।
কালার মা তার প্রতিবেশী।দীর্ঘদিনের চেনা পরিচিত।তাকে দিদি বলে ডাকতো।
কালা তার একমাত্র সন্তান।
স্বামী নাই।
কালা বাবার ব্যবসা বাণিজ্য দেখাশুনা করতো।
লিলিকে কালার মা অনেক ভালোবাসতো। তাদের মধ্যে ভাল ভাব ছিল।
গর্ভপাতের সময় অনেক রক্তক্ষরণে নিঃশেষ হয়েছিল লিলি।রক্তহীন সাদাটে গায়ের বর্ণ।কঙ্কালসার চেহারা। চোখ দু’খানা কোটরে ভরা,মেলতে পারছিল না কোনো মতে।চোখের পাতা মেলার শক্তিও ছিল না তার শরীরে।মরার সময় শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কালার মার হাত দু’খানা হাতে নিয়ে শেষ অশ্রু বিন্দু দিয়ে বলে গিয়েছিল লিলি,‘দিদি, ওদের দেইখেন।’
শেষ কথাগুলো কালার মার কানে আজও বাজে,
ফেলতে পারে না সে।কাঠঠোকরাটা যেদিন চলে গেলো ঠিক তার তিন দিন পর লিলি মারা গেলো।লিলির জীবনটা কাঠঠোকরার মতো সাজানো সংসার ছেড়ে চলে গেলো চিরদিনের মতো বিদায় নিলো।
পিরোজপুর থেকে প্রতি মাসে ঝুড়ি ভরে নাতি-নাতনীদের জন্য চাল-ডাল,পুকুরের মাছ,ফল,তরি-তরকারী,পাঠিয়ে দিতো নানী।বস্তা ভরে ভরে।কখনও নিজে নিয়ে আসতো।মাসে মাসে নগদ টাকা উজ্জলের হাতে গুজে দিয়ে যেতো।
উজ্জলের সংসারে অভাব নাই কোন কিছুর।
তারপরও হাহাকার।কি যেন নাই।এই শুন্যতা পূরণ হবার নয়, উজ্জল ভাবতো মনে মনে।তার ক্লান্ত চোখ দুটি সেই শূন্যতার ভারে বুজে আসতো।
চেয়ারে বসে বাড়ীওয়ালা কবিরাজ চায়ের কাপে ফু দিয়ে ঠান্ডা করে জোরে জোরে ফুৎ ফুৎ শব্দে চা পান করছিল তৃপ্তিভরে।দু’পাশের মাড়ির দাঁতগুলো না থাকায় দু’ চোয়াল ভিতরে ঢুকে গতের্র সৃষ্টি হয়েছিল।যেন প্রাণ কম্পানির চুষে খাওয়া লিচুর প্লাস্টিকের খালি খোসার মতো দেখাচ্ছিল।পাশের চেয়ারে উজ্জল তাকিয়েছিল চায়ের কাপে।বাড়ীওয়ালার শুকনাদেহ চুলহীন টেকো মাথা সোজা করে সে উজ্জলকে বলছিল-‘শোন বাবা,তুমি বাচ্চাদের জন্য আর একটা বিয়ে কর।ওদের কদ্দিন দেখবে প্রতিবেশীরা,ওদের নানীও আর পারে না।বয়স হইছে তার।’
ভাঙ্গা মন। জোড়া লাগে না।
উজ্জলের হৃদয়ে গভীর ক্ষত এঁকে দিয়েছিল লিলির বিয়োগ। সংসারে তার মন নাই।
বাঁচতে হবে তাই বাঁচা।লিলির কথা,চাল-চলন,আদর যত্ম কিছুই ভুলতে পারতো না সে। চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় লিলি।তার কথা এখনও কানে বাজে।তার স্পর্শ অনুভূত হয় সবসময়। সমগ্রতার মাঝে এক নিরবিচ্ছিন্ন শূন্যতার আবেশ।কিন্তু সময় সেতো বহুরূপী স্রোতের আধার।সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিন পার হয়ে আসে বছর।
বাড়ীওয়ালার মতো অনেকে এমন ধারার কথা প্রায়ই উজ্জলেরর কানে তুলতো।
কি করবে উজ্জল? ভেবে পায় না সে চিরশূন্যতার উপরে যে লিলি তার হৃদয়ের সম্পূর্নতায় বিরাজ করতো। তার সে শূন্য বেদীতে অন্য বিগ্রহ কেমন করে সে বসাবে!
কিন্তু লিলির শেষ স্মৃতি চিহ্নগুলোকে তো বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। বাচ্চাদের মুখে মামরা চিহ্নগুলো মুছিয়ে দিতে নারীসত্তা আবশ্যক।
রাজ্জাক,কবিরাজের ছোট এক ঘর ভাড়া নিয়েছিল।কাজ পাগল মানুষগুলো জড়ো হয়েছিল এ শহরে। র্দীঘ দশ বছর ধরে রাজ্জাক কাজ করছিল এ টেক্সটাইল মিলে।খট খট শব্দে দিন কেটে যেতো তার।সাত সকালে কাজে বের হয়ে সন্ধ্যায় বাজারের থলি হাতে ঝুলাতে ঝুলাতে ঘরে ঢুকতো।বাজারের থলে ঘরের কোনে ঠেস দিয়ে ক্লান্ত দেহ খানা বিছানায় বিলিয়ে দিল রাজ্জাক।
রাজ্জাকের বৌ শিউলি বাজারের থলে মাটিতে ঢেলে দিয়ে মাছ-তরকারী আলাদা করে বটী নিয়ে বসেছিল কাটাকাটিতে।রাজ্জাকের ছেলে রিপন ও মেয়ে রুকসানা বাজার দেখে দৌড়ে আসলো মায়ের কাছে, ‘বাবা আইছে মা।’ মা,‘ঐ দেখ ঝুড়িতে......।’বলার আগেই রিপন কাগজে মোড়ানো মিষ্টিগজা খুলে খাওয়া শুরু করলো।এদিকে রুকসানা মাটিতে গড়াগড়ি,রিপন একটা গজা বেশি খেয়েছিল কেন।
রাজ্জকের বিশ্রাম শেষ হতে না হতে শিউলি কাঁচের কাপে লাল চা সামনে নিয়ে হাজির হল।মাথার পাশে রেডিও ছেড়ে দিয়ে গান শুনছিল।‘আজ কি কাজের চাপ বেশি ছিল তোমার’বলে রেডিওর তেজ কমিয়ে দিল শিউলি।রাজ্জাক,‘এখন কাজের চাপ প্রতিদিন বেশি হবে।নতুন অর্ডার আছে তাই চাপ বেশি ওভার টাইম করতে হয় সবাইকে।’
রাজ্জাক মেশিন অপারেটর।খট খট শব্দের মধ্যে সারাদিন কাটিয়ে দিতো। প্রথম প্রথম মাথার মধ্যে মেশিনের খট খট শব্দ সারাদিন ঘুরপাক খেত।এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। এখনও মাথার ভিতর শব্দ ঘুরপাক খায় মালুম হতো না তার।
রাত হলে চারদিকে গমগম করতো।আলোর ঝলকানিতে তেজে ওঠতো এ শহর।চারিদিকে আলো আর আলো।দিনরাত সমান।কখন দিনের আলো মুছে যেতো,রাতের আধাঁর নেমে আসতো চারদিকে বোঝা দায় ছিল। হুইসেলের উচ্চ শব্দ নগরজীবনের প্রতিটি মানুষকে ছুঁয়ে যেতো।অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল সবাই। প্রতিদিন নতুন নতুন মুখের আনাগোনা এ শহরে।পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও শহর থেকে লোকজন আসতো ব্যবসা-বানিজ্য করে রাতে ফিরে যেতো।পা মিলিয়ে চলছিল তারাও। ফুলের বাগানে ফুটন্ত ফুলে মধুর খোজে আসা লোভী মৌমাছির মতো। ফুলের মধু খাওয়ার জন্য হাজির হতো দলে দলে গুণগুণ শব্দে।
রাতে মা,রিপন ও রুকসানাকে ভুত তাড়ানো দাদুর গল্প বলে ঘুম পাড়াতো,‘ভুত তাড়ানো এক দাদু থাকে এখানে।তার অ-নে-ক সাহস।সে জ্বিন পোষে একটা।জ্বিনকে যা বলে তাই করে।রাতে ভুত তাড়ায় দাদু।’ রিপন মুখটা তুলে,‘মা-তারপর।’ ‘এ পাড়ার রাস্তার শেষ প্রান্তে তার টালির বড় বাড়ি।পাশে তার কাছারি ঘর। উচা-লম্বা মস্ত তার শরীর।তাকে দেখলে ভুত ভয়ে পালায়।গভীর রাঁতে বাহিরে যায়।তেঁতুল গাছ,বাঁশের ঝোপ,শ্মশান ঘাট এমন সব জায়গায় ভুত-পেতিœ বাস করে।রাত হলে ওরা বাহিরে বের হয়।কাচা মাছ-মাংস ওদের পছন্দ।ঘরে কাচা মাছের গন্ধ পেলে মানুষের মতো সেজে ঐ ঘরে যায়। আবার বাড়ির কোনায় গিয়ে নাকে নাকে ডাকে,আনুম-নো খানুম-নো মাছের গন্ধ পানুম-নো,নাম ধরেও ডাকে।ওদের কাচা মাছ খেতে না দিলে বাড়িতে রাতে হাটাহাটি করে।ভয় দেখায়। সেখানে তাবিজ বেঁধে দেয়, দাদু।কেউ রাতে মাছ নিয়ে বাহিরে গেলে তার ঘাড়ে ভুত-পেতিœ আসড় করে।দাদু ঝাড়-ফুঁ আর তাবিজ বেধে সে ভুতকে বিদায় করে।’
রুকসানা চোখ বড় বড় করে কপালে ভাজ তুলে জিগায়,‘মা-ভুত দাদু একা একা যায়।’
মা বলে,‘হ।এখন ঘুমা,চোখ বন্ধ কর।
আবার কাল রাতে।’
পাড়ার ছোট ছেলেরা মায়ের কথা না শুনলে,ভাত না খেলে, ঘুমাতে না গেলে, দুষ্টামি করলে দাদুর ভুতের গল্প বলে মায়েরা স্বস্তি পেতো।
রাতে শহরের বড়বাজারের মানুষ ঠেলা ভিড়ের মধ্যে পাতলা পাতলা গলির মুখে দাড়িয়ে থাকতো মাদক ব্যবসায়ীরা।গলির মুখের কাঠের খ্যাম্বায় ফিলিপস বাতিটা ভেঙ্গে অন্ধকার করে রেখেছিল তারা।অর্ধেক ভাঙ্গা ফিলিপস বাতিটা এক চোখ মেলে চেয়েছিল নিবোর্ধ মানুষগুলোর দিকে।যারা আলোর রাস্তা ছেড়ে অন্ধকারের পথে চলছিল।চেনা মানুষগুলো অন্ধকারে হারিয়ে যেত বাজারের সরু অলি-গলিগুলিতে।রাত যত বাড়ে আড্ডা তত বাড়তে থাকতো।মদের পেয়ালায় চুমুকে চুমুকে জাগতো নিশি রাতের নেশা।সাথে ছিলো কাঁচা ছোলা আর বিট লবন মদের তীব্র ভোটকা গন্ধ কাটানোর জন্য।অনেকে আবার বমি করে ফেলতো টেবিলের উপর।টেবিলের উপর লোদ লোদ র্দুগন্ধ যুক্ত বমির আস্তরণ তার পাশে রাখা মদের গ্লাস। গ্লাস তুলে আরেকজন এক চুমুক দিয়ে বলে উঠলো,‘শালা কম কম খা।’
নদীর দুই পাড়ে দুই দৃর্শ্য মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। মাঝে নদী দ্রুততালে বাতাসের সাথে জলকথায় মগ্ন হয়ে সময় পার করে ধেয়ে চলছে সমুদ্রবক্ষে মিলনের তীব্র নেশায়।জন্ম থেকে সে নিরবধী ছুটে চলছে।যে দিনটির জন্য তরুণীর অপেক্ষা সেই সন্ধিক্ষণের দোড়গোড়ায় আজ। শতকথা কয় বাতাস তার কানে কানে।সে কথায় ধ্যান নাই।তরুণীর ছুটে চলাই তার কাজ। কে যেন অপেক্ষা করছে তার জন্য। সেও ব্যকূল হয়ে আছে তরুণীর জন্য,মনে হয় তাড়া দিচ্ছে তাকে বার বার।এই পাড়ে আলোয় পূর্ণ শব্দযুক্ত ঝলমলে ব্যস্ত শহর আর নদীর ঐ পাড়ে মনে হতো সাদা কাগজে পেন্সিলে আঁকা গ্রামের ছবির উপর ঢেলেপরা দোয়াতের কালির মতো আধার কালো নিঃশব্দ রাত্রি।
©somewhere in net ltd.