নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

থার্ড আই

তাপস কুমার দে

থার্ড আই

তাপস কুমার দে › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্টেপ পেরেন্টস (Step parents)

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:৪৫

লেখক-
‘স্টেপ পেরেন্টস’ গল্পটি এ সমাজের। গল্পটি কাউকে আহত করার জন্য নয়। এ সমাজের চিত্র তুলে ধরার ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র। এ সমাজের কিছু অসঙ্গতি, ভাল-মন্দ যা আমাদের সমাজে নিহিত আছে। আমরাই তার বক্ষে। আবার আমরাই এ সমাজ সৃষ্টির স্রষ্টা।তাই ভাল-মন্দ দু’টা আমাদেরই।

(তিন)
জীবনের মেলা

রাফুর বাবা বাক্সের ভিতর চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে উঠোনে একা একা। প্রতিরাতে রাফুর মাকে ডাকতো। রাফুর মার মনটা কাঁদতো। স্বামীর সাথে প্রতিরাতে কথা বলতো উঠোনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে। যেতে পারতো না ছোট নিতুকে রেখে। স্বামীকে স্বান্তনা দিয়ে রাখতো,তার মন মানতো না আর কত দিন একা একা থাকবে, ভালো লাগতো না স্বামীর। নিতুর জন্য মার এত কষ্ট। এতো বুঝায় শুনতো না। ছোট বেলা থেকেই ওর দুষ্টমিতে ভরা জীবন। স্বামীর কবরে মাথার কাছে কংক্রিটের ক্রুশের উপর মোমবাতি জ্বেলে রাখতো রাতে রাফুর মা। চোখের জলে স্বামীর স্মৃতিগুলো ভেসে আসতো ফোটায় ফোটায়। প্রথম দর্শনেই বিয়ে হয়েছিল তাদের। তারপর কতগুলো বছর কেটে গেছে একসাথে কত স্মৃতি জড়িয়ে ছিলো জীবনের পরতে পরতে। আজ দু’জন দু’দেশের বাসিন্দা। একজন ভবজগত অন্যজন ইহজগতের বাসিন্দা । কত দূরে থাকে প্রাণেশ্বর মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছা করতো তার । দেহটা নাই মনটা তার মনের ভিতরই আগলে রেখেছিল। রাফুর মার ভবজগত ঘেরা তার প্রাণেশ্বর । সে ডাক দিলে মনোজগত থেকে চলে আসতো ভবজগতের প্রাণেশ্বর। সব কথা বলতো।মনে মনে আদান প্রদান হতো সে কথা। চোখের সামনে ভেসে বেড়াতো প্রাণেশ্বর। কেউ বোঝে না। কেউ দেখতে পারতো না। কেউ বুঝতেও পারবে না।বিনা সুতার মালা। অদৃশ্য গাঁথুনি। ভালোবাসার গাঁথুনি এ বড় শক্ত। দেখা যায় না ,ছোঁয়া যায় না, ছেঁড়াও যায় না। বারবার ফিরে আসতো তার স্মৃতির ছিন্ন পাতায়। রাফুর মা আস্তে আস্তে কথা বলতো প্রাণেশ্বর কান পেতে শুনতো মনোযোগ দিয়ে। প্রাণেশ্বর মৃদু বাতাসে দুলে দুলে নীরবে উত্তর দিতো রাফুর মাকে। রক্তরাঙ্গা জবা দুলতো,শিউলি দুলতো আর গোলাপ।ফুল গাছে সে সাজিয়ে রাখতো প্রাণেশ্বরের সমাধী মন্দিরটা। যাবার সময় রাফুর মা হাত বুলিয়ে,‘আমি আসবো তুমি অপেক্ষা করো, অনেক রাত হয়েছে তুমি ঘুমাও এখন, আমি আসি’ বলে চলে আসতো। তার কিছুদিন পর দু’জন একসাথে সাজানো ফুলের বাগানে হাত ধরে হাটছিল পরলোকে। ঈশ্বর জোড়া সৃষ্টি করে যেভাবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন আবার জোড়া করে পরজগতে নিয়ে যান।

প্রথম বিয়ের মতো ধুমধাম না হলেও কমতি ছিলো না কোনো কিছুর। ঢোলক এসেছিল সানাই বেজেছিল উজ্জল সেজেছিল বর বেশে।ওর পছন্দের সোনালী পাড়ের ধুতি-পাঞ্জাবী কিনেছিল।আত্মীয়রা এসেছিল নতুন পোষাকে।বাড়ীওয়ালা ছোট ছোট সাদা দাড়ি-মোচ কামিয়ে ফেলেছিল সেলুনে গিয়ে সে দিন। অনেক দিন পর সেলুনে দাড়ি কামিয়েছিল একটু আরাম করে হুইল চেয়ারে বসে। নাপিতেরও দশটাকা বেশি রোজগার হয়েছিল।চুল কাটার ফাকে ফাকে রশা নাপিত ছোট ছোট কথা বলে কতচেষ্টা করতো দাড়ি মুড়িয়ে দিয়ে আরও দশটাকা বুড়ার পকেট থেকে বের করতে।কিন্তু বুড়া কম যায় না সব সময় গুনে গুনে টাকা নিয়ে আসতো। চুল কাটিয়ে পরে বাড়িতে গিয়ে সামনে ভাঙ্গা আয়না রেখে বাটিতে একটু পানি আর সাবানের গোলায় দাড়ি ভিজিয়ে ব্লেড দিয়ে চাচঁতো। বাড়ীওয়ালাকে আসতে দেখে রাজ্জাক দুয়ারে বসে হাসতে হাসতে টিপ্পনি কাটছিল,‘আজকে বুড়োর সাথে পিউর বিয়ে দেবো।’উজ্জলের ছেলে-মেয়েরা নতুন পোষাক পড়েছিল।বাবার বিয়ে জন্য।ওরা দেখবে বাবার বিয়ে।নতুন মা আসবে।এলাকার চেংড়ারা চলার পথে টিপ্পনি কাটছিল,‘বাবার বিয়ে,সব কপালে জোটে নারে।তোদের জুটেছে।’সত্যি তাই সব কপালে যেন না জোটে।ঘর সাজিয়েছিল উজ্জল নতুন রূপে।পুরানো স্মৃতিগুলো পিছে পড়ে রইল চিরদিনের মতো।সে স্থান দখল করবে নতুন কেউ।

উজ্জলের নতুন বউ।দ্বিতীয়।
বউ উজ্জলের নজর কাড়ে।
সব চিন্তা দূর হয়ে যায়।কাজ শেষে ঘরে ফেরে উজ্জল। শিশ্ন তেজে উঠছিল নতুন স্বাদে।অভিজ্ঞ খেলোয়ার,নতুন ময়দান,নতুন বল হলেও অভিজ্ঞতার জোরে জবর খেলা খেলতে চায় উজ্জল। কিন্তু সোনালী জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।মাটিতে পরে যাবার অবস্থা।তাতে কি,উজ্জল বোঝে প্রথম প্রথম মেয়েরা এমন করে। একটু শান্ত করে নেয়।ভাব করে উজ্জল কিন্তু সে অন্য কিছুর ইঙ্গিত পায় সোনালীর কথায়।তারপরও উজ্জল কম যায় না। বলে বলে ছক্ক হাকে সীমানা পার করে উজ্জল সে রাতে। শক্ত যৌবন,নতুন বৌও হার মানে। টেষ্ট ক্রিকেট খেলছিল।

সোনালী অষ্টাদশী। গোপালগঞ্জের গোপালপুরে বাপের বাড়ী। খালের ওপারে। কথায় পটু।চালাক চতুর ছিল। গাঁ গ্রামের ম্যাইয়া। ডাঙ্গর-ডোঙ্গর ছিল,দেখতে ভাল,প্রতিবেশিরা বলে। হ,এই ম্যাইয়া কি এতো বড় সংসার সামলাইতে পারবে,বিয়ে যহন হইছে সামলাইতে হবে প্রতিদিন নতুন বৌ দেখতে এসে নানা ধরনের উক্তি করতো।কেই ভালো কেই মন্দ।নতুন বৌ কান খুলে শুনতো উত্তর দিতো না।

বিকালে রাজ্জাকের মেয়ে রুকসানা মাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে গিয়েছিল। সোডিয়াম বাতির নিচে। গরীব শ্রমিকদের জন্য ফুটপথের উপর বাজার বসতো প্রতিদিন। লাল-নীল লেইস ফিতা,কাচের চুড়ি,নেইল পলিশ,¯েœা,পাউডার আরো প্রশাধনী সাজিয়ে গলা হাকতো হকাররা,কেউ কেউ হাত ধরে টানতো ,‘আসেন,আসেন,ভাল নতুন জিনিষ আছে।’হেটে যেতে যেতে কান আর মুখের দূরত্ব যেন এক ইঞ্চি ব্যবধানে থাকতো। চিৎকারে ডান পাশের কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার মতো,শিউলি শিউরে উঠতো। দ্রুততার সাথে পা দু’খানা সামনের দিকে বাড়াতো। রুকসানা চুল বাধার লাল ফিতা ও কপালের লাল টিপ কিনছিলো। সারিবাধা দোকান সাজিয়ে বসেছিল রাস্তার দু’পাড় ধরে। থরে থরে সাজানো টক-মিষ্টি-ঝালের মুখরোচক খাবার জিনিস। জামা-কাপড়,প্লাষ্টিকের খেলনা সমগ্রী।
রাস্তার এক কোনে ইলিয়াস আলীর সাজানো কবিরাজী ঔষধ। প্রতি মোঙ্গলবার তার লেকচার মন্ত্রমুগ্ধর মতো শুনতো সাধারন পথচারীরা। তার ভাজপরা মুখের মিঠা মিঠা লেকচার আর কমেডিয়ানদের মতো অঙ্গভঙ্গির টানে চুম্বুকের মতো আটকে থাকতো শ্রোতা-দর্শকরা। সব জাতীর প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা ফুটে উঠতো তার ঠোটে,হিন্দু ভাই নমস্কার,মুসলমান ভাই সালাম,খ্রীষ্টান ভাই প্রণাম বলেই শুরু করতো যৌন রোগের প্যাচালী। শহরের সবচেয়ে বড় কবিরাজ ছিল ইলিয়াস আলী। সে কবিরাজ হলেও এ শহরের কত বড় বড় ডাক্তারের চড়াই পাখির মতো ছোট অঙ্গ বড় করেছিল কবিরাজী ঔষধে তার হিসেব নাই। সে হিসেব কেউ কোনো দিন চাইলে দিতে পারবে না সে। কেননা তার শিক্ষা নাই লিখে রাখে নি সে কোনো দিন। মুখে মুখে বলে। শহরের বড় বড় লোকের গোপন অঙ্গ মোটা-তাজা করতো সে অতি গোপনে। তার দিলে বড় মায়া তাই রাস্তার গরীব মানুষগুলোর জন্য সে রাস্তায় নেমেছিল চড়াই পাখির মহাওষুধ নিয়ে। তার ওস্তাদ মোঘলদের দরবারে সেবাযতœ করতো। আজ তারা নাই তাই সে গরীবদের সেবা করছে। সে তার ওস্তাদের কাছে দীক্ষা নিয়েছিল। সেখান থেকে কবিরাজী বিদ্যা আয়ত্ত করেছিল।
পাশেই জাদুর লাঠি হাতে আসতো জাদুশিল্পী নোমান পকেট থেকে রুমাল বের করে ম্যাচের কাঠি দিয়ে ঘষা মেরে আগুন ধরিয়ে দিতো রুমালের এক কোনায়।দাউ দাউ করে পুড়তে থাকা রুমাল হাতে ঝুলিয়ে রাখতো কিছুক্ষণ।পরমুর্হূতে উপস্থিত দর্শকদের রুমালটি দিয়ে বলতো,‘পোড়া চিহ্ন বের করে দিন।’দর্শকরা খুজে পেতো না রুমালের পোড়া অংশ। গোপনে রেকটিফাইড স্প্রিট মিশানো জাদুর রহস্য। বায়াঁন্ন তাঁসের চমকপ্রদ জাদুখেলার মজায় মেতে উঠতো বাচ্চা-বুড়ো সবাই।লাটিমের মতো ঝিম মেরে বসে থাকতো ওরা।
সার্কাস আলীর একপেয়ে ছয় ফুট উচ্চতায় ব্যালেন্স বজায় রেখে সাইকেল চালানোর কৌশলে চুপচাপ সবাই,এই বুঝি পড়ে যায়,এই বুঝি পড়ে যায়। র্দশকদের চোখ যেন আটাশ দিয়ে ছিল,স্থির ছিল সবাই,তিন চক্কর দিয়ে লাফিয়ে পড়লো সাকার্স আলী ওমনি দম ছাড়লে লম্বা দম। খুশি হয়ে হাতে তালি দিয়ে এক,দু’ও পাঁচ টাকার নোট ছুড়ে দিতো রাস্তায় বিছানো গামছাটার উপর।

দৃষ্টিনন্দন খুলনার নিউ মার্কেটের সৌন্দর্য্য বাড়াতে অভিজাত শ্রেণীর সুন্দরী রমনীদের ঢল নামতো সকাল-সাঁঝে। বিজ্ঞাপনের ভারে খসে পড়ছিল নিউমার্কেট।তরুণীর খোলামেলা লোভনীয় দেহের বিজ্ঞাপনে লালা পড়তো কার্তিক মাসের কুকুরের জিহ্বা বেয়ে। প্যারাসুট তেলে পা অব্দি কালা মেঘাচুল, ক্লোজ আপের ঠোট ফাটা হাসির মাঝে মুক্তার দানা, আপনের সোনার গহনার সাজে সেই কবে থেকে সেজে বসে আছে নব গৃহবধু,কেউ তুলে নেয় না তাকে। নেইল পালিশের রং ধনুর সাত রঙা নখ সাজিয়ে বসেছিল মডেলরা। মডেল কন্যার হাতে নতুন মডেলের মোবাইলটা সেক্স পয়েন্টের সামনে হাইলাইট করে রেখেছিল বেশি বিক্রির আশায়, প্রবেশ মুখে অন্তঃবাস পরিধেয় বিদেশীনিকে এক পলক দেখে পথের কষ্ট আর রিক্সা ভাড়ার কথা ভুলে যেতো তরুণরা। জীবনের মেলায় কত রং কত রূপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে পথের বাঁকে বাঁকে।বাজারে বিক্রি হয় মেয়েদের লোভনীয় দেহ।টোল খাওয়া হাসি,গোলাপের মতো বাক খাওয়া মিষ্টি ঠোট,কাজল কালো হরিণীর চোখ,কোকাকোলার মতো জিরো ফিগারের নিটল দেহ,মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ প্রর্যন্ত।

সন্ধ্যায় রাজ্জাকের ছেলে-মেয়েরা মাস্টারের কাছে পড়তে বসেছিল। ওরা আজ হাতকাটা রমজানের ভয়ঙ্কর রোমর্হষক গল্প শুনতে চাইলো মাস্টারের কাছে। দেশের সর্বত্র যার র্চচা ছিল বাতাসে ছড়িয়ে পরা তুলার মতো। মাস্টার একগ্লাস পানি পান করে বলেন,‘এ গ্রামের পাশে ভৈরব নদীর পাড় ঘেষে সাতটা বড়ঘাট। রমজান নামে এক দিনমজুর ছিল। মাছের ঝুড়ি,চাল,ডাল ও গমের বস্তা মাথায় নিয়ে যায় গুদামে। সুযোগ পেলে এক দু’টা মাছ বা গমের বস্তা চুরি করা মামুলি ব্যাপার রমজানের কাছে। তার মত হাত কারো নাই এ ঘাটগুলোতে। তার নাম ডাক ছিল ঘাটে।’
শুনেছি,‘রমজানের নামেরও বাহার ছিল সঙ্গীরা তাকে কালু,ধলু ও বিভিন্ন নামে ডাকতো। ঘাট এলাকার বস্তিতে এরা বসবাস করতো। রাতে ঘাটের বস্তির বটতলায় মদ-জুয়া,গাঁজার আসর বসতো। রমজানের হাত সাফাইয়ের তারিফে মশগুল ছিল ঘাটের লিডাররা। গোপনে চুরির আধাআধি ভাগ দিতো তাদেরকে। সেই টাকায় রাতারাতি বড় লোক হল লিডাররাও। চালের বস্তা,গমের বস্তা আর মাছই শুধু না।এক রাতে সরকারী রেল লাইনের বড় লম্বা লোহার পাত চুরি করতে গেলে পুলিশ তার ডান হাতে গুলি করেছিল অনেকগুলো। সঙ্গী সাথী নিয়ে আহত রক্তাক্ত অবস্থায় লোহার লম্বা পাত নিয়ে সে পালিয়ে গিয়েছিলো।ডানহাত কেটে ফেলেছিল তার। সে থেকে তার নাম হাতকাটা রমজান। লাখ লাখ টাকা রাতের আধারে রমজান পকেটে পুরেছিল। তার সঙ্গী-সাথী অনেক। যে যেখানে চুরি করে তার ভাগা পেতো সে।তার আধিপত্যের বিস্তার ঘটতে থাকলো চারিদিকে। তার নামে চাঁদাবাজি চলতো লঞ্চ ঘাট,মাছ ঘাট,হাট,বাজার সর্বত্র।রাতে জোড়া শিব মন্দিরে চলতো সুন্দরী রমনীদের নৃত্যের আসর। দিন-দুপুরে মানুষ খুন করে নিশ্চিন্তে ঘুমাতো সে। সবাই জিম্মি ছিল হাতকাটা রমজানের কাছে।’

গল্প বলতে বলতে মা লাল চা ও বিস্কিট নিয়ে আসলো ।
মাস্টার চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,‘ঘাটের দিনমজুর রমজান এভাবে অনেক টাকা-পয়সার মালিক হয়ে ওঠে। চেলাও অনেক।এলাকায় অনেক প্রভাব।এগুলোকে বৈধ করার প্রয়োজনে রাজনীতি নামক হাতিয়ার দরকার ছিল তার। নেতাদের সহযোগীতায় হাতকাটা রমজান রাজনীতিতে যোগদান করেছিল ঢাকঢোল পিটিয়ে। রাজার নামের সাথে প্রজার নামের মিল হলে প্রজার সিনা চওড়া হয়ে যায় অনেকখানি, হাতকাটা রমজানেরও তাই হয়েছিল। হাতকাটা রমজান নিজেকে রাজার সমকক্ষ ভাবছিল। ভাবে আমিও তো রাজা...........।তখন দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেনও রমজান। জবর দখল করে চেয়্যারম্যান সাজে।এলাকার গন্ডি পেরিয়ে অন্য এলাকায় প্রবেশ করেছিল। তার সাঙ্গ্য-পাঙ্গ্যরা খুলনার সবর্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। যেখানে যা মনে চায় তাই করতো ওরা। কোনো বাধা নাই তাদের। হাতকাটা রমজানের নাম সবর্ত্র। নামের সাথে আরো বাড়তে থাকে অর্থ-কড়ি,বাড়ি-গাড়ী। প্রশাসন তার হাতের মুঠোয় ছিল।তার কথায় সবাই ওঠতো বসতো। অবৈধ্য ব্যবসা-বানিজ্যও অনেক বেড়েছিল। অবৈধ অস্ত্র, সোনা ও মাদকের বড় কারবারী সে। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে চলে মাদকের রমরমা ব্যবসা।’

রিপন ও রুকসানা চুপ করে শুনছিল আতংকে ওদের শরীর চুপসে আসছিল।

মাস্টার,‘রমজানের শুধু নাম নয়।তার নিজস্ব আইন-কানুন ও আদালত ছিল এলাকায়। কেউ অন্যায় করলে তার আদালতে বিচার করতো।সে নিজেই বিচারক ছিল।তার নিজস্ব বাহিনী ছিল এলাকায়। কবরের নিচে তার অস্ত্রের গোপন ভান্ডার ছিল । অস্ত্রের বড় কারবারী সে।নদী পথে অস্ত্র এনে কবরের নিচে লুকিয়ে রাখতো,নিশি রাতে চলে তার কারবার।সে যে পথে চলে সে পথে বোমা উৎসব করতো চেলারা। ফিল্মি খলনায়কের স্টাইলে চলা ফেরা, কাজ কর্ম ছিল তার। আর আতঙ্কিত এলাকাবাসীরা চুপচাপ থাকতো তার ভয়ে। ক্ষমতাশালীরা রাস্তায় একা হাটতে ভয় পায় সব সময়।

ক্ষমতা চলে যাওয়ার ভয়ে দল বদল করে অন্যদলে যোগ দিয়েছিল সে। সময়ের সাথে পরিবর্তন ঘটে তার চিরচেনা চেহারার। আরো হিংস্র হয়ে উঠলো সে। কাম-লোভ-লালসা তাকে ঘিরে ধরে উন্মাদে পরিণত করে তুলেছিল।এ মাটির মানুষ না সে।কোন অতি দানব।যার মস্ত বড় দেহ।যে পারে না এমন কিছু নেই। যার হুংকারে এ ধরিত্রি ভয়ে কেঁপে উঠতো।যার পদ ধ্বনিতে ভীতু হয়ে উঠতো সবাই।কার সাধ্য ছিল এ দানবকে বধ করে।অমরত্ব লাভের আশায় সে ব্যাকুল ছিল।তার পথের কাটা তুলে ছুড়ে ফেলতো নদী বক্ষে। যে রাজনীতি তাকে দিয়েছিল নাম-যশ,প্রভাব-প্রতিপত্তি। সেই রাজনীতির নিষ্ঠুর খেলায় তাকে হারাতে হয়েছিল তার প্রিয় প্রাণ।’

আজ সেই একই পথে আবার হাটছে অন্যকোনো মানুষরূপী দানব অতি সংগোপনে.....। কিন্তু সময় সে তো বড় নিষ্ঠুর ও নির্মম। সত্য সর্বদা উজ্জল। প্রকাশিত দিবালোকের মতো চিরসত্য। সে তার নিয়ম পালন করে নিজের মতো করে।

সারাদিন উজ্জলের দু’মেয়ে পিউ-পলি ঘরের সব কাজ করে রাখতো ছোট্ট কচি হাতে।এভাবে অভ্যস্ত হয়ে ছিল। কোনো কাজ দেরী হলে কড়া ভাষায় বকাবকি শুরু হতো। তিনি বসে হুকুম দেন আর ছেলে-মেয়েরা পালন করতো।পান থেকে চুন খসলে সাথে সাথে মুখ খিচুনী। চোখের নোনা পানি নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়তো পলির। পিউ,পলির দিকে চেয়ে কেদে ফেলতো,ওদের একজনের মনে ব্যাথা লাগলে অন্যজন সমান ব্যাথা পেতো। সৃষ্টির রহস্য বড় অতি অলৌকিক। সতমা,‘এটা কর ওটা কর। পানি ভরে আন,থালা-বাসন ধুয়ে আন ঘর পরিস্কার কর।’একটু বসলে কাজের তাড়া। তিনি ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দিতো আর বাচ্চারা সে কাজ করতো দেহের জোরে। মা নাই তাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতো না। সহ্য করতো সব।
ছেড়া নোংরা জামা কাপড় পড়ে থাকতো সারাদিন,কাজের বিনিময়ে তিন বেলা খাবার জুটতো এই পোড়া কপালে। ভালো খাবারটা সতমা নিজেদের জন্য সরিয়ে রাখতো গোপনে।
মা বেচে থাকলে কি এ কাজ করতে হতো। শত কষ্ট হলেও মা নিজে করতো। কপালে কি এই লেখা ছিল ওদের। পোড়া কপাল। বাপের সামনেও একই রকম। কিছু বলে না সে। মা চেচ্যাঁমেচী করতো। তাই ভয়ে ভয়ে কাজ করতো তারা।
কিসের যেন ভয় মনের ভেতর।মা হারা ছোট্ট একটা মন।ছোট্ট একটা ভয় বড় হয়ে ফিরে আসতো বারবার।শতচেষ্টা করে,ভয়ের জানালা বন্ধ করে দিতে চায় কচি দুটি হাতে কিন্তু পারে না কোথা থেকে ছুটে আসতো সে ভয় বারবার।উকি দিতো সে বিভৎস্য চেহারায়। হঠাৎ আঁতকে ওঠতো,কচি মনে রেখাপাত করতো সতমায়ের চিৎকার চেঁচ্যামেচী।
নতুন মা কখন বকবকানি শুরু করে তাই আগেভাগে কাজ শেষ করতো। বাবা ঘরে ঢুকলে হাসি মুখে তার আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল সতমা।বলতো,‘দেখিস না তোর বাপ আইসে পানি দে,গামছা দে,লুঙ্গি দে।’

নানীর নাম কমলাসুন্দরী।মাঝে মাঝে আসতো,খুলনা।নাতী-নাতনীরা নানীকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না কাটি করতো।নানী ছাড়া তাদের দুঃখ যন্ত্রনা বুঝবে এমন কেউ ছিলো না।কিছু বলতে চায়,মুখ থেকে বের হয় না,পাশে মা দাড়িয়ে থাকতো। বোবা কান্না বুঝিয়ে দিতো সব নানীকে। নানী একটু আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো মা কিছু বলবে না,বল কি হইছে?
উজ্জলের হাতে নিজের নামের জমির দলিল পত্র টাকা-পয়সা সব দিয়েছিল। আর কান্না জড়ানো কণ্ঠে উজ্জলকে বলেছিল,‘বাবা, মা-মরা ছেলে-মেয়ে ওদের দেখে রেখো।
ওরা তো তোমার সন্তান।
আমার যা আছে সব দিলাম।
আমি আর কত কাল।’
একমাত্র মেয়ের মৃত্যুতে চোখের জল তার নিত্য সঙ্গী।একটা দু’টা শব্দ দু’ঠোট ভেদে বের হওয়ার আগেই চোখের নোনা জল সমুদ্রের ঠেউয়ের মতো আছড়ে পড়তো তার এ মাতৃনয়নে।এ অশ্রু যেন তার ঝর্ণা ধারা।অবিরত ঝরছে তারপরও সিক্ত হয়নি তার দেহমন।

কে বলে ঝর্ণা দূর পাহাড়ে,গহীন অরণ্যে।ঝর্ণা আজ এক দুখিনী মায়ের দু’নয়নে।

সারাদেহ শীতল হয়ে যেতো তার ,বুকের ভিতরটা খা খা করতো। কমলাসুন্দরী ভাবতো আমি বেচে আছি কেন। আমার মৃত্যু হলো না কেন লিলির আগে। মেয়ের শোকে গোপনে গুমড়ে গুমড়ে কাদতো কমলাসুন্দরী। চোখের জল আর নাকের স্যাৎ শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতো বারবার। মেয়ের শোকে কমলাসুন্দরী ধীরে ধীরে রোগগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল।

নিয়তির নির্মম পরিহাসে সেই মরমিয়া নানীও পৌষমাসে গভীর রাতে প্রচ- ঠান্ডায় বুকে শ্মেষ্মা জমে মারা গেলো। শোকাহত এ মা দুনিয়ার সকল মায়া ত্যাগ করে মেয়ের কাছে নিজেকে শোর্পদ করে দিল।

নানীর মৃত্যুর খবর শুনে উজ্জল, রাজ্জাক,কালা সহ আরো প্রতিবেশী তার বাড়িতে গিয়েছিল।নানীর বড় চৌ-চালা বাড়ী।বড় পুকুর।ফসলের ক্ষেত আর ক্ষেত।আম বাগান,কাঠাঁল বাগান,নারিকেল ও সুপারীর বাগান।আরও কত কি।গ্রামের প্রায় সব মানুষ এসেছিলো সেদিন।সবার মুখে একই কথা উচ্চারিত হলো ‘লিলির শোকে মারা গেলো নানী।’

নানী মারা যাওয়ার পর পল্লব খুলনায় আসলো। বড়ছেলে পল্লব।নতুন মাকে, মা বলতে দ্বিধা করতো। মুখ থেকে মা শব্দ বের হয়নি ওর। কেমন কেমন করতো।
মা কি সবাইকে ডাকা যায় ।
এ সব প্রশ্নের উত্তর ছিল না পল্লবের কাছে।
তারপরও মাঝে মাঝে সতমাকে মা বলে ডাকতো প্রয়োজনে। সোনালী কিছু বলতো না।কালার মা ও তাদের বাড়ীওয়ালা বাচ্চাদের শিখিয়ে দিতো নতুন মাকে মা বলে ডাকতে।

সোনালীর বাবা গ্রামে কৃষি কাজ করতো। কোনভাবে সংসার চলতো তার। বাবা,সোনালীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে দিয়েছিল উজ্জলের সাথে।
উজ্জল সরকারি অফিসে চাকরি করতো। ছেলে ভাল।
কিন্তু বৌ মরা।
বৌ মরা জামাই সোনালীর অপছন্দ।
তার কেমন কেমন করতো বৌ মরার বৌ, বৌ মরার বৌ। শব্দগুলো সোনালীর ভেতরে ভেতরে সুচের মত খোচা দিতো বরংবার।

সোনালী ভালবাসতো গ্রামের এক যুবককে। সর্ম্পক অনেক দিনের। বাবা সব জানতো।
উজ্জল চাকরীজীবি টাকা-পয়সা অনেক শহরে থাকে তাই দেরী না করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল।
সোনালী,বাবার বাড়ীতে সেই যুবকের সাথে দেখা করতো গোপনে।তার সাথে সোনালীর মেলামেশা চলতো সবার অজান্তে।
যুবক ভালবাসে সোনালীকে।সোনালীও।
সোনালীর কোলে নবাগত সন্তান। সন্তানের নব উদ্দীপক তীক্ষè চিৎকারে আলোড়িত হয় তার সমস্ত সত্তা। কোমলদীপ্ত কন্ঠে নতুন করে মা ডাক শুনতে পেলো সোনালী। অন্যদের মা ডাকে সে জোর নাই। ভালবাসা নাই। নিরস ভালবাসা।একেই বলে আপন আর পর।

সতছেলে-মেয়েদের প্রতি ভালবাসায় ভাটা পড়ে।এক বিস্তীর্ণ চর জেগেছিল সন্তান ও সতমায়ের মাঝে। নিজের ছেলের মা ডাক শুনে,মন ভরে ওঠতো সোনালীর। হাতের তালুতে যেন আজ সব কিছু বন্দি ছিল।
বড় ছেলেকে দেখতে পারে না তাই কৌশলে আলাদা করে দিয়েছিল সতমা। দুই মেয়ের বিয়ে হল।

সোনালীর দিনগুলো এখন ভালোই কাটছিল। তবে মাঝে মাঝে তার সেই না পাওয়া প্রেমের বুদবুদ ব্যাথা হয়ে উথলে ওঠছিল হৃদয়ে।সেই যুবক সোনালীকে দেখতে আসতো মাঝেমাঝে। যুবক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে কাকন। সোনালী,কাকনের এক বৎসরের ছোট। একই স্কুলে লেখাপড়া করত। গভীর ভালোবাসা তাদের। আত্মীয়ের ছলে কাকন সোনালীকে দেখতে আসতো,সোনালী কেঁদে গঙ্গা বইয়ে দিত। একদিন সে কাকনের সাথে চলে যাবার জিদও ধরেছিল। কিন্তু কাকন তাকে বাস্তবতার নিগূঢ় তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে,অবশেষে একা বাড়ির পথে রওনা দিল।
সোনালী আবার মা হল। এবার কন্যা সন্তান। সোনালী সন্তানের কান্না বুকে চেপে ধরে এক পরম তৃপ্তি লাভ করেছিল সেদিন।
কিছুদিন পর খবর আসলো কাকন বিদেশ যাবে টাকার যোগার চলছিল।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.