নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কুসংস্কার

তরিকুল ফাহিম

মানুষ

তরিকুল ফাহিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমরা কোন আই.এস নই

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১০:২৩

এবারই জীবনের প্রথম গরুর হাটে গিয়েছিলাম কোরবানির গরু কিনতে। আশ্বিনের মধ্য দুপুরের সূর্যের তাপ যতটুকু তার থেকে অধিক তাপ গরুর দামে। বাবা দাম জিগ্যেস করছে। মাথা চুলকাচ্ছে। বিক্রেতাদের সাথে রস করে কথা বলছে। স্বাদ সাধ্যে গরু হচ্ছেনা। বাজেট সংকট। অবশেষে গৃহস্থের এক গরু। উথলে পড়া স্বাস্থ্য নেই। গৃহস্থের আথালে খড় কুটো খেয়ে যা স্বাস্থ্য। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আনন্দমনে বলল 'দেখিস, গোসত খুব স্বাদ হবে'। বাবা অতো সহজে ছেড়ে দেয়ার মানুষ না। প্রচণ্ড দর কষাকষি শেষে বিক্রেতা বাবার হাতে গরুর রশি তুলে দিলো। ততক্ষণে বাপ বেটা দুজনেই ক্লান্ত। এবার গরু বাড়ি নিয়ে আসার দায়িত্ব আমার। বাবা বললেন, 'আমি অন্যসব বাজার তরকারি কিনে আসছি, তুই হাঁটতে থাক।' কি মুসীবত! কিচ্ছু করার নেই। পাকা পাঁচ কিলোমিটার পথ এবার আমাকে গরুর সাথে হাটতে হবে। একটা লাঠি দিয়ে আলতো করে পিটুনি দিয়ে বললাম, চল যাই। ওমা! গরু হাঁটছে না। লেজটা ধরে একটু মোচড় দিয়ে ধাক্কা মেরে সামনে আগানোর চেষ্টা করলাম। কাজ হচ্ছে না। গরু কিছুতেই সামনের দিকে যেতে নারাজ। পেছনে তাকিয়ে দেখি গরুর মালিক আমাদের দিকে দিব্যি তাকিয়ে আছে। শীর্ণ দেহ, এক মুখ লম্বা দাড়ি, কপালে বার্ধক্যের ভাঁজ, তেল চিপচিপে মাথায় একটা জালি টুপি। চোখে মুখে দরিদ্রের সহস্র প্রকাশ। বাবার দেয়া টাকাগুলো তখনো বৃদ্ধের হাতে মুঠিবদ্ধ। আমি থমকে দাঁড়ালাম। একবার বৃদ্ধের দিকে তাকাচ্ছি একবার গরুর দিকে। বাজারে হাজারো মানুষের ঢল। এরকম দাঁড়িয়ে থাকাটা মুশকিলের। বৃদ্ধ কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এ যেন শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের গফুর। নিতান্ত অভাবে না পড়লে সন্তানসম পশুকে কে দেয় মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে? বিশ পঁচিশ গজের দূরত্ব আমার আর বৃদ্ধের মাঝখানে। হঠাৎ দেখি বৃদ্ধ ছুটে এলেন। এবার হয়তো মুঠিবদ্ধ টাকাগুলো আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলবেন ‘এই লন আমহের টাহা, গরু মুই বেচমুনা’। কিন্তু না। বৃদ্ধ তা করলেন না। তিনি এসে আমার হাত থেকে রশিটা নিলেন। গরুটার গায়ে হাত দিয়ে বললেন ‘আট আট, এইডাই দুন্নইর নিয়ম’। গরুটা হাঁটছে। আমি বিস্মিত! কোথায় লাঠির আঘাত, লেজ ধরে মোচড়, চড় থাপ্পড়ে কাজ হচ্ছিলো না সেখানে গরুটা বৃদ্ধের কথামতো হাঁটছে। এতদিন মহেশ গল্পের গফুর আর মহেশের কথাবার্তাকে নিছক গল্প ভেবেছিলাম। আজ দেখি সত্যি। পশু মানুষের ভাষা বোঝে, প্রেম বোঝে। বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চলেন বাবা, আমহেরে বাজারডা ছাড়াইয়া দিয়া আই। ভরা বাজারে ভিড় ঠেলে আমরা তিনজন হাঁটছি। কুঁকড়ে যাওয়া চামড়ায় শির মোটা হওয়া একটা হাত বার বার গরুটার পিঠ স্পর্শ করে যাচ্ছে। কত সহস্র প্রেম জড়িয়ে আছে সে স্পর্শে তা বোঝানোর সাধ্যি কার আছে? গরু ও বৃদ্ধের প্রেম আমি স্ববিস্ময়ে দেখছি আর ভিড় ঠেলে হাঁটছি।
বাজারের শেষ প্রান্তে এসে বৃদ্ধ আমার হাতে রশিটা তুলে দিয়ে বলল, ‘এহন যান। তয় বাজান গরুডা আটতে না চাইলে পিডাইবেনছোন। আমাগো খুব আদরের গরু। আমহের চাচী বাড়ি এহনো বুজি কান্দে। গরুডারে খুব মহব্বত করতো সে’। আমি নির্বাক। কোন কথা মুখে আসছে না। পায়ে হাঁটা এক ঘণ্টার পথ তিন ঘণ্টায় বাসায় ফিরেছি।
ঈদের দিন। নামাজ শেষে আমরা সবাই গরুটার পাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি। সবার মনে আনন্দের ফল্গুধারা। গরুটা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চোখের নীচটা ভেজা। হয়তো জেনে গেছে কিছুক্ষণ পড়েই ওর মস্তক দেহ থেকে আলাদা করে দেয়া হবে। আমার শিশুর মতো খুব জানতে ইচ্ছে করে গরুটার অনুভূতি। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে ওর বুঝি সেই বৃদ্ধ লোকটা আর তাঁর বৌকে দেখতে ইচ্ছে করে। যারা ওকে সন্তানের মতো আদর করতো, খাওয়াত এবং ওর সাথে কথা বলতো। বাবা জবাই করার জায়গাটা ঠিকঠাক করছেন। আমি একটু পানি এনে গরুটার সামনে ধরলাম। খাচ্ছে না। যদি প্রিয় সন্তান কোরবানির করার নিয়ম বহাল থাকতো তাহলে আজ গরুটার জায়গায় আমি থাকতাম। এবং আমার সামনে এই মুহূর্তে যদি ডিনাসটি এবং ডেলিসিয়াস খাবার ধরা হতো আমি কি খেতাম? পানিটুকু ফেলে দিলাম। খানিকক্ষণ বাদে মসজিদের ইমাম সাহেব এলেন। তাঁর গায়ে আজানুলম্বিত পাঞ্জাবী। মাথায় টুপি। মুখে স্মিত হাঁসি। হাতে চকচকে লম্বা ছুরি। সবাই তাকে স্বাগত জানালো। সবার মুখে কি আনন্দের রেশ! অনেক অনেক শিশু জমা হয়েছে, সবাই গরু জবেহ দেখবে। শুধু আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটা মুখ। লম্বা দারী, তেল চিপচিপে মাথায় ময়লা টুপী। চেহারায় দরিদ্রের সহস্র প্রকাশ। কর্ণকুহরে আঘাত হেনে যাচ্ছে কয়েকটা কথা, ‘তয় বাজান গরুডা আটতে না চাইলে পিডাইবেনছোন। আমাগো খুব আদরের গরু। আমহের চাচী বাড়ি এহনো বুজি কান্দে। গরুডারে খুব মহব্বত করতো সে’।
গরুটাকে জবাই করার নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেন ফাঁসির কাষ্ঠে আসামী যাচ্ছে। জোর করে সামনের দিকের পা দুটো ভাঁজ করে মাটিতে শোয়ানো হল। একজন চেপে ধরছে মাথা, একজন হাঁটু ভর করে পেট চেপে ধরছে, পেছনের দুই পায়ের মাঝখান থেকে লেজ টেনে এনে একজন কৌশলে চেপে ধরছে, যে যার মতো পারছে ধরছে। পশ্চিম মুখী গরুটার মাথা। ইমাম সাহেব বাবার কাছে জেনে নিচ্ছে শুধু কোরবানি নাকি কোন আকিকাও আছে? এরপর আল্লাহুআকবর বলে চালানো হল ছুরি। গরুটার গোঙানি, কষ্টে একধরনের ক্যোঁৎ ক্যোঁৎ শব্দ বের হচ্ছে ওর পেট থেকে। মাটিতে রক্তের স্রোত। সাঙ্গ হল পালা।
গরু কাটার কাজে পাশের বাড়ি থেকে যারা সাহায্য করতে এসেছিলেন তাদের ভেতর একজন রক্তে পা ভেজাচ্ছে। কি একটা উপকার আছে নাকি। গরুটাকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে বললাম ‘ আমরা কোন আই.এস নই। এটা আমাদের ধর্ম। অভিশাপ দিস না প্লিজ’।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১০:৪৭

এই আমি রবীন বলেছেন: " যদি প্রিয় সন্তান কোরবানির করার নিয়ম বহাল থাকতো তাহলে আজ গরুটার জায়গায় আমি থাকতাম। এবং আমার সামনে এই মুহূর্তে যদি ডিনাসটি এবং ডেলিসিয়াস খাবার ধরা হতো আমি কি খেতাম?"

যদি প্রিয় সন্তান কোরবানির করার নিয়ম বহাল থাকতো, আজোকি কোরবানীর প্রচলন থাকতো?

খুবই মানবিক একটা গল্প! পোস্টে প্লাস !!!

২| ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:১৯

আহলান বলেছেন: ছোট বেলায় পুটু নামে এমনই একটি গল্প পড়েছিলাম ...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.