![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রত্যক্ষবাদীরা বলেন যে প্রত্যক্ষই একমাত্র জ্ঞানের উত্স | কথাটা আংশিক সত্যি যদি প্রত্যক্ষ মানে চোখে দেখা বাইরের রূপ হয় | ন্যায় দর্শন প্রত্যক্ষের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন সেটা যদি গ্রহণ করা যায় তাহলে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের একমাত্র উত্সই হয় | কি সেই সংজ্ঞা ? ন্যায় দর্শনের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম আহ্নিকের চতুর্থ সুত্রে বলা আছে :
“ ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষত্পন্নং জ্ঞানমব্যাপদেশ্যমব্যভিচারী ব্যাবসায়াত্মকং প্রত্যক্ষম |”
শ্লোকটা যদি সন্ধিবিচ্ছেদ করা যায় তাহলে দাঁড়ায় :
ইন্দ্রিয়-অর্থ-সন্নিকর্ষ-উত্পন্ন জ্ঞান-অব্যপদেশ-অব্যাভিচারী ব্যবসায়-আত্ম প্রত্যক্ষ |
অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সাথে তার অর্থ বা বিষয়বস্তুর সংযোগের ফলে উত্পন্ন যে জ্ঞান অব্যাভিচারী এবং অব্যপদেশ এবং কার্যকরী বা ব্যাবসায়াত্মক, তাকেই প্রত্যক্ষ বলে |
তাহলে প্রত্যক্ষের কয়েকটা বৈশিষ্ট্য হলো :
১] ইন্দ্রিয় ও তার বিষয়বস্তুর সংযোগে জ্ঞান উত্পন্ন হবে |
২] সেই জ্ঞান অব্যাভিচারী হবে | অর্থাৎ তা কখনো থাকবে কখনো থাকবে না : এমন হবে না |
৩] সেই জ্ঞান অব্যপদেশ হবে | অর্থাৎ অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত তিনকালে সত্য হবে |
৪] সেই জ্ঞানের বাস্তব কার্যকারিতা বা ব্যবসায় থাকবে |
তার মানে দেখুন ন্যায় দর্শনে প্রত্যক্ষের ব্যাপ্তি কি বিরাট | পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষবাদিদের সাথে নৈয়ায়িকদের এখানেই তফাৎ যে পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষবাদিরা শুধু প্রথম শর্তটাকে মানে আর নৈয়ায়িকরা চারটি শর্তই মানে | তাহলে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মধ্যে কে ঠিক ?
ইন্দ্রিয় ও তার বিষয়ের সংযোগে যে জ্ঞান উত্পন্ন হয় তা কেবলি বাইরের রূপ | তা ব্যভিচারী এবং তিনকালে সত্য নাও হতে পারে | সুতরাং সেটাকে প্রত্যক্ষ বলা যায় না | ওই জ্ঞান ভাসা ভাসা এবং ওর কোনো বাস্তব কার্যকারিতা থাকতেই পারে না | উপরন্তু যে জ্ঞান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য , অপরিবর্তনশীল এবং তিনকালে সত্য, সেইরকম জ্ঞানেরই বাস্তব কার্যকারিতা আছে | অতএব প্রাচ্যের ন্যায় দর্শনই ঠিক | লক, বেন্থাম ইত্যাদি প্রত্যক্ষবাদিরা ভুল |
ন্যায় দর্শনের এই প্রত্যক্ষ কেবল ধ্যানে হতে পারে | বস্তুর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপের মধ্যে যে অংশটি চিরন্তন সেটিকে নির্বাচন করতে গেলে ওই রূপের পরিবর্তনশীল অংশগুলিকে বাদ দিতে হবে | যেমন একটা উদাহরণ দেয়া যাক | একজন নৈয়ায়িক একটি ঘটকে কেমন প্রত্যক্ষ করবে ? ঘটের রূপ, তার ঘটাকার, তার রং, তার কারুকার্য : সবই পরিবর্তনশীল | পৃথিবীতে বহু ঘট দেখা যায় তাদের আকার, বর্ণ ও কারুকার্য আলাদা | ঘটার কার্যও বহু রকম | সুতরাং এইগুলি কোনভাবেই চিরন্তন হতে পারে না | তবে ঘটার উপাদান মাটি পৃথিবীর সর্বত্র এক | পৃথিবীর তামাম ঘট , সে যেমনি দেখতে হোক না কেন , মাটি ছাড়া অন্য কোনভাবে তৈরী না | তিনকালেও এর ব্যভিচার সম্ভব নয় | সুতরাং নৈয়ায়িকদের দৃষ্টিতে ঘট মানে মাটি |
কিন্তু একজন আধুনিক পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষ বাদীর মতে ঘট হলো তার বিভিন্ন রূপ , বর্ণ , কারুকাজ, এবং উপাদান | কিন্তু এতে সমস্যা কোথায় ? সমস্যা হলো যদি আমরা সার্বজনীন চিরন্তন বিষয়কে না জানি তাহলে আমাদের জ্ঞান সার্বজনীন হবে না | আমরা সর্বত্র পূজা পাব না | যেমন পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষ বাদী দার্শনিকরা পাননি |
এবার দেখা যাক নৈয়ায়িকদের ঘটজ্ঞানের বাস্তব কার্যকারিতা কি ? যদি ঘটার উপাদান মাটির ব্যাপারে বিশদে জানা যায় তাহলে উত্তম ঘট পৃথিবীর সর্বস্থানেই প্রস্তুত করা সম্ভব | ঘটের আকার, বর্ণ, কারুকাজ এবং কাজ এই মাটির চরিত্রের উপরই নির্ভর করে | সুতরাং এটা ভীষনই ব্যবহারিক |
গ্রিক দার্শনিকদের জ্ঞানের সাথে মিলে যাচ্ছে | তাঁরাও বলেছিলেন যে জ্ঞান পরিবর্তনশীল হবে না , অপরিবর্তনীয় হবে | প্লেটো ও অ্যারিস্টট্ল এই কথাই তাদের বইতে বলেছিলেন | তবে তার মানে এই নয় যে গ্রিকরা ভারত থেকে দর্শন শিখেছিলেন বা ভারতীয়রা গ্রিকদের থেকে শিখেছিলেন | সর্বত্র এক মানবজাতি বাস করে | তাদের বুদ্ধিও একইরকম | সুতরাং তারা যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন তারা একই রকম দার্শনিক বিচারে অভ্যস্ত ছিল |
পরে গ্রিক দার্শনিকদের সাথে পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষবাদিদের বিচ্ছেদ ঘটে | গ্রিক দর্শনের শুধু নামাবলিটুকু গায়ে চাপিয়ে পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষবাদিরা নিজেদের অপরিনত দর্শন চর্চা শুরু করে | এখানে তাই পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষবাদী বলতে গ্রিক দার্শনিকদের বুঝবে না |
নিচে আধুনিক পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষ বাদের বিবরণ সংক্ষেপে দেব :
প্রত্যক্ষবাদ-এর বিবর্তনকে ছয় ভাগে ভাগ করে বলছি | গোড়ার দিক, নবজাগরণ, ব্রিটিশ প্রত্যক্ষবাদ, ফেনোমেনা বাদ, যুক্তিবাদী প্রত্যক্ষবাদ (লজিকাল পজিটিভিসম বা ইমপিরিসিস্ম), ব্যবহারিকবাদ [প্রাগমাটিজম] | গোড়ার দিকে প্রত্যক্ষবাদ বলছিল যে মানুষের মন হলো সাদা কাগজের মত [ট্যাবুলা রাসা ] যার ওপরে অভিজ্ঞতা ছাপ ফেলে যায় | ইউরোপ আর আরবের বিজ্ঞানীরা সবাই এই মতে বিশ্বাসী ছিল | ইতালির নবজাগরণের সময় এই ধারণা পাল্টে হলো তুমি যা দেখবে তার সাথে যদি অথরিটির মতের অমিল হয় তাহলে তুমি অথরিটির কথা অগ্রাহ্য করবে | লেওনার্দ দা ভিঞ্চি থেকে মাকিয়াভেলি সবাই এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন | ইংরেজ প্রত্যক্ষবাদিদের মধ্যে লক বলেছেন মানুষের মন টাবুলা রাসা ও তাতে অভিজ্ঞতা ছাপ ফেলে | বিশপ বার্কলে বলেছেন সকল জ্ঞানই মানসিক অনুভুতি মাত্র | হিউম বলেছেন যে জ্ঞান দুই রকম নিশ্চিত আর অনিশ্চিত |
ফেনমেনাবাদিদের মতে সকল বাহ্যিক জ্ঞানই মানসিক অনুভুতি | অনেকটা হিউমের কাছাকাছি যায় | মিলের প্রত্যক্ষবাদ হলো জ্ঞান আসে প্রত্যক্ষভিত্তিক অনুমান থেকে | যুক্তিবাদী প্রত্যক্ষবাদ হলো প্রত্যক্ষ জ্ঞান আর গাণিতিক যুক্তির মিশ্রণ | প্রাগমাটিস্ম হলো জ্ঞানের প্রত্যক্ষ কার্যকারিতার পরীক্ষা | এই হলো সংক্ষেপে পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষবাদ |
সব মিলিয়ে মনে হবে যেন জ্ঞানসমুদ্রে ভাসছি কিন্তু আসলে একই কথা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বলা হচ্ছে | হিউম ছাড়া কেউই নিশ্চিত জ্ঞান আর অনিশ্চিত জ্ঞানের মধ্যে ফারাক করেন নি | এটাই দেখার মত বিষয় | নৈয়ায়িকরা নিশ্চিত জ্ঞান প্রত্যক্ষকেই প্রত্যক্ষ বলেন | অনিশ্চিত জ্ঞানকে জ্ঞানই বলেন না | শুধু হিউম এদের খুব কাছে গিয়েছিলেন |
যেহেতু পাশ্চাত্য দার্শনিকেরা চিরন্তন তত্বকে প্রত্যক্ষ না করে কেবল পরিবর্তনশীল বিষয়গুলির অনুশীলন করে , তাই পাশ্চাত্যের জ্ঞান ভাসা ভাসা , গভীর নয় | নৈয়ায়িকদের জ্ঞানই গভীর যেহেতু তারা চিরন্তন তত্বকে প্রত্যক্ষ করেছে |
©somewhere in net ltd.