নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জাহিরুল ইসলাম

আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যকুল ...

জাহিরুল ইসলাম

কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।

জাহিরুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেখা

১০ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:১২

বগুড়ায় আমার এক রুমমেট ছিল। রুমে ওঠার সময় পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ত সে। বৃত্তি পরীক্ষা দেবে বলে ভালো পড়ালেখার জন্য মা-বাবা তাকে পাঠিয়েছিল শহরে। প্রায় পাঁচ বছর এক রুমে ছিলাম আমরা। যে গল্পটা এখানে বলব, সেটা তার নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়ের। ওই বয়সেই প্রেম করত সে। গল্পটা বলার জন্য তার ও তার প্রেয়সীর নাম দিলাম যথাক্রমে— সুমন ও সোমা।



যতদূর মনে পড়ে, সে-ই আমার একমাত্র রুমমেট যার সঙ্গে সম্বোধন ‘তুই’ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। বয়সের ব্যবধান থাকলেও সে আমাকে ব্যক্তিগত কোনো কথা বলতে দ্বিধা করত না। প্রেয়সীকে নিয়ে তার নিত্যদিনের ভাবনা অকপটে শেয়ার করত আমার সঙ্গে। আমিও শুনতাম। মাঝে মধ্যে এটা-ওটা পরামর্শ চাইত। সে ব্যাপারেও সহযোগিতা করতাম।



মোবাইল ফোন তখনো হাতে হাতে আসেনি। চিঠিরই প্রচলন ছিল। প্রত্যেক মঙ্গলবার সুমনকে চিঠি লিখত সোমা। দেখতাম, প্রত্যেক মঙ্গলবার সুমন টিফিন পিরিয়ডে স্কুল পালাত। আমাদের মেস পর্যন্ত আসতে পিয়নের ২-৩টা বাজত। তার আগেই চলে আসত সে। পিয়নের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে পড়তে যাতে বিন্দুমাত্র দেরি না হয়, সেজন্য। ওইদিন যে কয়টা ক্লাস সে করত সেগুলোয়ও যে তার মন বসত না, এ কথাও সে আমাকে বলেছে অনেক দিন। তার বয়োসন্ধিকালীন আবেগ দেখে নিজেকেই প্রশ্ন করতাম, আমার কী করা উচিত?



আমার মনে এমন ভাবনার উদয় কেন হলো, সে কারণটাও বলা দরকার। ওই বছর ষান্মাসিক পরীক্ষায় সে ৭ বিষয়ে ফেল করল। স্কুল থেকে বলল, গার্ডিয়ানকে নিয়ে যেতে। সে এসে বলল, ভাই আপনি যদি না যান তাহলে আমার কপালে দুর্গতি আছে। কী আর করা! বড় ভাই সেজে গেলামও। ক্লাস চিটারকে বললাম, এবারের মতো মাফ করেন। ফাইনাল পরীক্ষায় পাস না করলে আপনারা ব্যবস্থা নিয়েন। সে-ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।



সে কেন পরীক্ষায় পাস করতে পারত না, তাকে আমি কোনোদিন এর কারণ জিজ্ঞাসা করিনি। তবে উত্তরটা এমনিতেই পেয়ে গেছি। বইয়ের র্যা ক পরিষ্কার করার সময় নজরুলের ‘লেখার রেখায় রইল আড়াল’ বইয়ের মধ্যে একটা হলুদ খাম পেলাম। প্রাপকের ঠিকানায় কারো নাম লেখা নেই দেখে কৌতুহল হলো। ভেতরের কাগজটায় দোয়াতের কালি ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে আছে। তবু লেখাটা পড়া যায়। তাতে লেখা—

সোমা,

“আমাকে দিয়ে পড়ালেখা হবে না। আমার মন অর্ধেক পড়ে থাকে তোমার কাছে। বাকিটা আমার কাছে। অর্ধেক মন দিয়ে কি পড়া হয়, বলো?”

ইতি

সুমন



চিঠিটা পড়ে আমি কতক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকলাম। সুমনের হৃদয়াবেগ আমার হৃদয়েও একটা নাড়া দিল। চিঠিটা রেখে দিলাম যথাস্থানে। ওটা সে কেন পোস্ট করেনি, জানি না। ঢাকায় আসার অনেক দিন পর হঠাৎ বইটার কথা মনে পড়ল। খুলে দেখি, চিঠিটা আছে ওভাবেই। সযত্নে রেখে দিলাম। এটা স্পষ্ট হওয়ার পর আমি ওকে নানাভাবে পড়ালেখার গুরুত্ব বুঝাতাম। বলতাম, ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করলে আমি কিন্তু আর যেতে পারব না। সে হাসত। বলত, এখন না বললেও আপনি ঠিকই যাবেন। আমি বিপদে পড়লে আপনি উদ্ধার করতে যাবেন না, সেটা আমি বিশ্বাস করি না।



এ ঘটনার কয়েকদিন পর এক মঙ্গলবার দুপুরে সুমন যথারীতি স্কুল থেকে পালিয়ে এলো। দেখলাম, অন্যান্য দিনের তুলনায় তার মধ্যে অস্থিরতা একটু বেশি। আমাকে বলল, ভাই আজ কেমন জানি লাগতেছে। বললাম, কেন রে? সে বলল, কী জানি! জানলে তো আপনাকে বলতাম। বলেন তো কী করি? আমি বললাম, গোসল করে আয়। খাওয়া-দাওয়া কর। ভালো লাগবে। সে বলে, চিঠি আসুক। পড়ে তার পর খাবোনে।



আমাদের ঘরের জানালাটা রাস্তার দিকে। সব সময় খোলাই থাকে। জানালার পাশে বিছানায় বসে গল্প করতেছিলাম আমরা। সে বলে ভাই, ভালো লাগতেছে না। চলেন বাইরে যাই। গেটের সামনে বসার জন্য ইট দিয়ে তৈরি করা একটা পাকা বেঞ্চ। সেখানেই বসে আমরা গল্প করি। অপেক্ষা করতে থাকি ডাক পিয়নের।



যথা সময়েই তিনি এলেন। দূর থেকে তাকে দেখে সুমন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। মনে হলো, হাজার বছর অপেক্ষার পর প্রেয়সীর সঙ্গে মিলনের মাহেন্দ্রক্ষণ। পিয়ন এসে আমাদের সামনে সাইকেল দাঁড় করিয়ে একটা চিঠি বের করে দিলেন। প্রাপকের ঠিকানায় সুমনের নয়, লেখা আমার নাম। বাড়ি থেকে বাবার চিঠি। আমরা দুজনেই চেয়ে রইলাম একে অপরের পানে। একটু পরেই নিরবতা ভেঙ্গে সুমন পিয়নকে জিজ্ঞাসা করল, আমার চিঠি আসে নাই? তিনি উত্তর দিলেন, না। সুমনের মাথায় মনে হয় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। আবার জিজ্ঞাসা করল, সত্যি বলতেছেন? ডাকপিয়ন বললেন, হ্যাঁ। আপনার চিঠি আসে নাই।



মুহূর্তের মধ্যেই সুমনের উচ্ছ্বসিত মুখটা মলিন হয়ে গেল। বৈশাখ মাসে কালবোশেখী ঝড়ের সময় রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশে হঠাৎ করে যেমন মেঘ জমে, ঠিক তেমন। আমি বললাম, কী করবি? চল ঘরে যাই। ঘরে যেতে যেতে সে বলল, “ভাই চিঠি তো মিস হওয়ার কথা না। সোমা আমাকে চিঠি না লেখার কারণ কী হইতে পারে, বলেন তো। আমার তো মনে হচ্ছে, সামথিং ইজ রং।‍” বললাম, রং হইতে যাবে কেন। কোনো কারণে হয়তো সে সময় মতো চিঠি পোস্ট করতে পারে নাই। সে বলে, না ভাই এটা হতেই পারে না। আমি সিওর, একটা কিছু হইছে।



আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল। নানাভাবে আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেছিলাম, চিঠি পোস্ট না করার কত কারণ থাকতে পারে। সে বিষয়টা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। আরো খেয়াল করলাম, ধীরে ধীরে তার মধ্যে অস্থিরতা ও টেনশন বেড়ে যাচ্ছে। বললাম, যা গোসল করে আয়। ভাত খাই। আজ না এলেও কাল হয়তো চিঠি আসবে। সে কিছুক্ষণ কী জানি ভাবল। ঘড়ি দেখে জিজ্ঞাসা করল, তিনটা বাজে। পদ্মরাগ ট্রেনের হুইসিল আপনার কানে পড়ছিল নাকি? বললাম, না তো। সে বলে, থাকেন তাইলে। আমি বাড়ি যায়া কাহিনীটা দেখে আসি।



সুমন ওই দিনের পদ্মরাগ ট্রেনেই বাড়িতে গেল। সাধারণত সে বাড়িতে গেলে দুই-তিনের আগে আসে না। এবার তার ব্যতিক্রম ঘটল। পরের দিন সকালেই সে উপস্থিত। আমি বাইরে যাচ্ছিলাম। গেটেই দেখা। জিজ্ঞাসা করলাম, কী রে চলে আসলি যে? ওর মন মরা। কোনো কথা বলল না। বলল, কই যান? বললাম, স্যারের কাছে। ফিরতে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। তুই থাক আমি আসতেছি।



ঘরে এসে দেখি সুমনের জিনিসপত্র গোছানো। বললাম, কি রে কাহিনী কী? সে কোনো কথা বলে না। বলল, ভাই আমি আর মেসে থাকব না। পড়ালেখা হবে না। হুদাই মেসে থেকে বাপের টাকা নষ্ট করে লাভ কী? আমি ওর কথার কোনো মানে বুঝলাম না। সোমার খবর বার বার জিজ্ঞাসা করাতেও সে কোনো উত্তর দিল না। বিকেলের ট্রেনেই সে বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। বললাম, কী রে পড়ালেখা করবি না? সে বলে, ভাই সত্যিই আমাকে দিয়ে আর ওসব হবে না।



সুমনের কাণ্ড দেখে মেসের সবাই অবাক। আমি বললাম, তোর সঙ্গে আমিও যাবো। সে বলে, অনেকদিন তো সাধলাম। গেলেন না। আজ যদি যাইতে চান, তাইলে আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকবে না। কথার ব্যাপারে সে খুব সিরিয়াস। কার কার সঙ্গে সে বছরের পর বছর কথা বলে না, সেসব ঘটনা আমি জানি। বললাম, চল তাইলে তোকে স্টেশন পর্যন্ত আগায়ে দিয়ে আসি। পথে যেতে যেতে বলল, ভাই আজ কিছু বলব না। কয়েক দিন পর আপনাকে চিঠি লিখব। সেখানে সব কথা উল্লেখ করব। আমরা এক সঙ্গে অনেক বছর ছিলাম বটে। তবে আমাদের পরস্পরের বাড়ির ঠিকানা যে কারো কাছে নেই, সেটাও মনে পড়ল তখনি। স্টেশনে গিয়ে সুমন আমাকে ওর বাড়ির ঠিকানা দিল, আমি দিলাম।



সোমার কথাও একটু বলা দরকার। মেয়েটার সঙ্গে আমার দুই বার দেখা হয়েছিল। ভারী মিষ্টি চেহারা। তার মন ভোলানো হাসি আমার এখনো মনে পড়ে। সুমনের কাছে লেখা চিঠিতে আমার খবরও সে জানতে চাইত। কয়েকবার আমার জন্য আলাদা চিরকুটও লিখেছিল সে। প্রত্যেকবারই একই লেখা—

“ভাইয়া,

কেমন আছেন? আপনার খবর জানাবেন। সুমনকে দেখে রাখবেন। ও ভালো মতো পড়ালেখা না করলে কিন্তু আমি আপনাকেই দায়ী করব।”

ইতি

সোমা



আমিও বার কয়েক তার চিঠির জবাব দিয়েছি। আমার খবর জানিয়েছি। সুমন যে পড়তে বসে হঠাৎ হঠাৎ আনমনা হয়ে যায়, তা-ও উল্লেখ করেছি সবিস্তারে। সে বাড়ি যাওয়ার সময় তার জন্য আমি যে চকোলেট পাঠিয়েছিলাম, সেটা সে ঠিকমতো পেয়েছে কিনা, তাও জানতে চেয়েছি। এভাবে সুমন তো বটেই, নিয়মিত পত্রালাপে সোমাও যে কখন আমার একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছিল, বুঝতে পারিনি। সুমন চলে যাওয়ার পর আমিও কেন জানি বিচলিত হয়ে উঠলাম। কী হলো সোমার? সুমন কেন চলে গেল? বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত আমরা সম্ভাব্য কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম।



সপ্তাহ দুয়েক পর সুমনের চিঠি পেলাম। ওর কাছে পাওয়া সেটাই আমার প্রথম ও সর্বশেষ চিঠি। তার পর অনেক চিঠি দিয়েও কোনো উত্তর পাইনি। ওই চিঠির কথাগুলো মনে পড়লে এখনো আমার দুচোখে জল চলে আসে। সে লিখেছে—

ভাই,

“আপনাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্যই আজ লিখতে বসলাম। কী আর লিখব! আপনার মনে আছে, আমি মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যেতাম। এটা নিয়ে আপনারা হাসাহাসি করতেন। বলতেন, আমি প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। আপনাদের মজা নষ্ট হোক, আমি সেটা কোনোদিনই চাইনি। তাই আপনার কাছেও একটা সত্য গোপন করেছি। আজ সেটা বলব।

সোমার বড় একটা রোগ ছিল। সেজন্য মাঝে মধ্যেই যন্ত্রণায় ছটফট করত সে। চিঠি পড়ে প্রেমের আবেগের পাশাপাশি আমিও ওর যন্ত্রণা অনুভব করতাম। সেজন্যই আনমনা হয়ে পড়তাম। আমার মনে হয়, ও যখন যন্ত্রণায় ছটফট করত, আমিও ঠিক তখনই আনমনা হয়ে পড়তাম। সোমার জন্য আমার যে অনুভব, সেটা আপনি জানেন। আপনিই বলেন, এ অবস্থায় ইচ্ছা করলেই কি আমার পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?

এবার বলি আসল কথাটা। ওইদিন সে আমাকে আসলেই চিঠি পাঠায়নি। সে অবস্থা তার ছিল না। কারণটা জানেন? ওই রোগই তার কাল হয়েছে। বাড়িতে এসে জানতে পেলাম সে আর ইহজগতে নেই। এখন থেকে আমি বা আপনি— আমরা কেউই সোমার চিঠি পাবো না। আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। যে মানবীর মূর্তিকে হৃদয়ে ধারণ করে আমি প্রতিনিয়ত পথ চলতাম, সে-ই তো নেই। তাহলে আমার পড়ালেখা করে কী হবে?

আপনাকে আরেকটা কথা বলি। খুব কাছাকাছি থেকেও কোনো মানুষের সব কথা জানা যায় না। যেমন মেসের সবার মতো আপনিও আমাকে জানতে পারেননি। কিন্তু আমার দীর্ঘ নিরবতা বা আনমনা হওয়া দেখে সঠিক কিছু না জেনে আপনারা যখন হাসাহাসি করতেন, তখন আমার হৃদয়টা ভেঙ্গে যেত। সৃষ্টিকর্তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, তিনি কেন মানুষের মনের খবর জানার শক্তি দেননি।

আপনাদের কারোই দোষ নেই। দোষ আমারই। আমিই তো আপনাদের সত্য কথাটা এতদিন বলিনি। আর বলিনি কেন জানেন? সোমাই আমাকে বলতে নিষেধ করেছিল। ওর কাছে পণ করতে হয়েছিল, তার জীবদ্দশায় কাউকেই এ ব্যাপারে কিছু জানাব না। আমাদের দুজনকেই আপনি অনেক স্নেহ করতেন। নিকটাত্মীয়দের অনেকের কাছেও এতটা স্নেহ পাইনি। আমি জানি, এ চিঠি পাওয়ার পর আপনারও অনেক খারাপ লাগবে। তবে আপনার স্বাভাবিক জীবন যাপনে এ ঘটনা যেন কোনো প্রভাব না ফেলে, সেই প্রার্থনাই করি।”

ইতি

সুমন



এ চিঠি পাওয়ার পর আমার মনটা যেমন ভেঙ্গে গেল, অনুশোচনাও হলো। অজান্তেই কতটা মানসিক অত্যাচার করেছি তার ওপর। রাগও হলো। সব কথাই তো সে আমাকে বলত। এ সত্য প্রকাশ করলে কী এমন ক্ষতি হতো? প্রেয়সীর কাছে করা ওয়াদ ভঙ্গ করলে পাপ কি খুব বেশি হয়? এমন আরো অনেক প্রশ্নের উদয় হলো আমার মনে। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, আমার কি এ চিঠির কোনো উত্তর দেয়া উচিত? আর যদি দেই, তাহলে তাতে কী লিখব?



এভাবে একদুই দিন করে মাস পার হলো। আমিও চলে এলাম ঢাকায়। এখানে এসে নতুন ঠিকানা দিয়ে সুমনকে চিঠি লিখলাম। বললাম, শোককে শক্তিতে পরিণত করে নতুনভাবে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে। বেশ কয়েকটা চিঠি লেখার পর উত্তর না পেয়ে আমিও ক্ষান্ত দিলাম। কেন সে আমাকে উত্তর দেয়নি? দীর্ঘ দিনের জমানো অভিমান নাকি ক্ষোভ? এ প্রশ্নের উত্তরও আমি কখনো খুঁজে পাই না।



সুমনের কাছে একেকটি চিঠি যখন লিখতাম, তখন আমার সোমার মুখচ্ছবি তখন আমার সামনে ভেসে উঠত। মনে পড়ত, চিরকুটে লেখা তার অনুরোধ— সুমনকে দেখে রাখবেন। ও ভালো মতো পড়ালেখা না করলে কিন্তু আমি আপনাকেই দায়ী করব। এ কথা যখন মনে হতো, তখন পড়ালেখার জন্য তাকে অনুরোধের বিষয়টি আরো দীর্ঘ হতো। সোমা যে আমাকেই দায়ী করবে, সে কথাও মনে করিয়ে দিতাম তাকে।



আমি চিঠি লেখা বন্ধ করার পর সুমন কি খুশি হয়েছিল? নাকি ওর অভিমান আরো বেড়ে গিয়েছি? জানি না। তবে মাঝে মধ্যেই ওকে আমার মনে পড়ত। ঢাকায় আসার পর যে কয়েকবার মেসে বেড়াতে গেছি, পরিচিতদের কাছে ওর খবর জিজ্ঞাসা করতাম। কেউ বলতে পারত না। মোবাইল ফোন আসার পর এর-ওর মাধ্যমে অনেক চেষ্টা করেও সুমনের নাম্বারটা জোগাড় করতে পারিনি। মাঝে মাঝে আমারও খুব ক্ষোভ হতো। আমার বন্ধুদের সবাইকে সে চেনে। সে-ও কি কারো কাছে আমার নাম্বার নিয়ে একবার ফোন দিতে পারে না?



এর মধ্যে সাত বছর অতিবাহিত হয়েছে। আমার স্মৃতিতে সুমন ও সোমা এখনো কিশোর। মাঝে মাঝে সুমনের বর্তমান ছবি কল্পনা করি। কেমন হয়েছে সে? হ্যাংলা-পাতলা শরীরে কি মাংস ধরেছে? মাঝখানে সিঁথি করে সে কি এখনো দাঁড়িয়ে থাকে আয়নার সামনে? আর গুনগুন করে— আমারও পরাণ যাহা চায়! একইভাবে মনে সোমার কথাও। তার মুচকি হাসিটা কি ওরকমই থাকত? এখনো কি দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলত, ভাইয়া আজ ওই আইসক্রিমটা খাওয়ান। আমার মাথার চুল পড়া নিয়ে তার উদ্বেগটা কি আরো বাড়ত? আরো কত কী!



এও ভাবি, আমি যেভাবে ভাবছি, সে-ও কি এভাবে আমার কথা মনে করে? দ্বিধাদ্বন্দ্বিত হয়ে পড়ি। সর্বশেষ চিঠিটায় ওকে সেই দ্বিধার কথাই জানিয়েছিলাম। নিতান্তই অভিমান থেকে। লিখেছিলাম—

সুমন,

তোকে আমার খুব মনে পড়ে। আমার কথা কি তোর মনে পড়ে না? নাকি সব ভুলে গেছিস? তোর উপর আমরা সবাই অনেক অত্যাচার করেছি। এটা আমরা না জেনেই করেছি। আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিস। তোর ব্যাথাটা আমি কিছুটা বুঝি। কিন্তু এরকম করার কী মানে? যদি কখনো মনে পড়ে, আমার খবর নিস।

ইতি

তোর ভাই



এর পর প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হয়েছে। বিকেল বেলা অফিসে বসে কাজ করছি। এ সময়টা আমাদের পিক আওয়ার। ডেস্কের ওপর রাখা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে একটা আননোন নাম্বার ভেসে উঠল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জিজ্ঞাসা, ... ভাই না? বললাম, হ্যাঁ। ভাই আমি সুমন, কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে। আমি একটু সচকিত হয়ে উঠলাম। সাধারণত আমি কাউকে খারাপ শব্দে সম্বোধন করি না। কিন্তু ওর বেলায় ব্যতিক্রম ঘটল। বললাম, শয়তান কোথায় ছিলি এতদিন? সে আমার কথা কানে নিল না। বলল, কনভোকেশন শেষ। গ্র্যাজুয়েশনের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা আজ সম্পন্ন হলো। সোমার কাছে আপনি যে দায়বদ্ধ ছিলেন, আজ তা থেকে মুক্ত হলেন। আমি জানি, আপনি ...তে থাকেন। শিগগির আপনার সঙ্গে দেখা হবে। আপনি কি আপনার কোনো বইয়ের মধ্যে আমার একটা চিঠি পাইছিলেন? কোন চিঠি? আমার সব মনে পড়ে গেল। সেটা যে আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি, সে ব্যাপারে তাকে নিশ্চিত করলাম। বলল, ভাই আপনার সঙ্গে যেদিন দেখা হবে, চিঠিটা আমাকে ফেরত দেবেন? আমি বললাম, তোকে দেয়ার জন্যই তো ওটা রেখে দিয়েছি।



সুমনের কথা শুনে আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াই। আমি জানি, এর সঙ্গে তার কত আবেগ ও স্মৃতি জড়িত। তখন তার আনমনা মুখটা আমার মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোমার মুখচ্ছবি। তার সেই মিষ্টি হাসি। শেষবার তাদের দুজনকে একত্রে দেখার স্মৃতিও হঠাৎ করে সামনে এসে হাজির হয়।



অনেক দিন পর আমাদের দুজনের দেখা হবে। সোমার সঙ্গে সুমনেরও যদি এভাবে কখনো দেখা হতো!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.