নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডোন্ট টেক মোমেন্টস ফর গ্রান্টেড!

আমিনা মুন্নী

আমিনা মুন্নী › বিস্তারিত পোস্টঃ

মধ্যবিত্তের গল্পটা \'বড় মেয়ে\'র হলেই তা সমালোচকের কাছে ক্লাসিকের মর্যাদা পেত!

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:২২



প্রতিটা মানুষ একজন আরেকজনের চেয়ে আলাদা। তাদের ভালোলাগা খারাপ লাগা আলাদা। আমার কাছে কোন বিষয় ভালো নাই লাগতে পারে। তবে নিজের খারাপ লাগা কে জাহির করতে গিয়ে অন্যের ভালোলাগাকে বা মতামত কে অশ্রদ্ধার চোখে দেখাটা তো উচিত নয়।

কথাগুলো বলছি ‘বড় ছেলে’ নাটক প্রসঙ্গে।
গত কয়েকদিন মোটামুটি ঝড় বয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে নাটকটা নিয়ে। রীতিমত অভাবনীয় একটা দৃশ্য । উন্নাসিক দর্শক যারা বাংলাদেশের ভালো গল্পের নাটক হয় না মনে করে এদেশের নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলে দাবী করেন, একটা নাটককে কেন্দ্র করে তাদের এই মাতামাতি আশাব্যাঞ্জক। এই মাতামাতি এই ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত মানুষগুলোকে ভালো কাজে করতেও উৎসাহিত করবে নিশ্চয়।

স্বভাবতই যে কাজ নিয়ে আলোচনা হবে, সেই কাজ নিয়ে কিছু সমালোচনাও থাকবে। যেটা বড় ছেলের ক্ষেত্রেও হয়েছে। কিছু কিছু উচু জাতের দর্শকের নাটকটি ভালো লাগেনি। কেউ ফেসবুকে, কেউ ব্লগ লিখে বিষয়টি জানিয়েছেন, কেউ কেউ কারো পোস্টে কমেন্ট করে মতামত দিয়েছেন। কারো কারো কাছে এটিকে অতি সাধারণ একটা গল্প মনে হয়েছে, কারো কাছে মেকি মনে হয়েছে নাটকের ডায়ালগগুলো। কারো কারো কাছে মনে হয়েছে মেকিং এ দুর্বলতা রয়েছে, কেউ কেউ আবার গল্পেও দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছেন।

অবশ্যই যারা এত চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করে নাটক বা সিনেমা দেখতে বসেন, তারা সাধারণ দর্শক নন। তারা অন্তত জ্ঞানী। ফিকশন নির্মাণের বিষয়ে তাদের সঠিক জ্ঞান আছে বলেই তারা সমালোচনা করতে পারেন। সহজেই বলে দিতে পারেন এটা একটা ‘...লের নাটক’। কিন্তু যারা সাধারণ দর্শক, তারা কিন্তু এত বড় বোদ্ধা নন। তাই তাদের ভালোলাগার বিষয়টাও একটু অন্য ভাবে সজ্ঞায়িত হয় অধিকাংশ জায়গাতেই।

‘বড় ছেলে’ একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি পরিচিত গল্প। এখানে জীবনের মধ্যবিত্ত জটিলতা খুব সহজ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে প্রেম সম্পর্কের টানাপড়েন, পরিণতি সবকিছু খুব স্বাভাবিক সরল অংকে দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। যে গল্পটা অনেকের। নিজেদের পরিচিত গল্পই তারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পেয়েছে। নিজেকে একাত্ম করতে পেরেছে নাটকের গল্পের সাথে, চরিত্রগুলোর ব্যক্ত করা অনুভুতির সাথে। তার তাই সেই মধ্যবিত্ত দর্শকেরাই ‘বড় ছেলে’ নাটকটির প্রশংসা করেছেন ঢালাও ভাবে।
সমস্যা হচ্ছে, কিছু মানুষ সিনেমা সমালোচকদের মতন ‘বড় ছেলে’ নাটকটিকে ফালতু বা যা-তা বলে এই নাটকটি শিল্পের এক মহাঅবমূল্যায়ন ছাড়া আর কিছুই হয় নি সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। প্রশ্ন হলো তারা এটা কেন করছেন? গত ১০ বছরে কতগুলো নাটক আসলে তারা দেখেছেন? এর আগে কেন কোন নাটক নিয়ে তারা এমন ভাবে সমালোচনা করেন নি এবং তারা এত ভালো নাটকবোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও কেন ইন্ডাস্ট্রির এই অবস্থা? কেন তারা ভালো কিছু নির্মাণ করে দর্শককে দেখিয়ে দিচ্ছেন না যে নাটক বানানো কাকে বলে! ভাবতে অবাক লাগে যে, এত এত সুচিন্তা করার মানুষ থাকতেও বাংলাদেশের নাটকের মান নিয়ে কেন মানুষের এত অভিযোগ!

আমজনতা, যারা অতি শিক্ষিত নয়, যারা মেকিং ফেকিং বোঝে না, যারা টেলিভিশনের সামনে বসে রিমোট ঘোরায় কিছু ভালো সময় কাটানোর জন্য, ‘বড় ছেলে’ নাটকটা তাদের ভালোলাগার নাটক। নাটকটা দেখে তাদের মন খারাপ হয়েছে, তারা কেঁদেছে, তারা তাদের অনুভুতি শেয়ার করেছে। এই আমজনতার ভালোলাগাকে জ্ঞানী সমালোচকেরা খাটো করে তুলে ধরে কোন যোগ্যতায়? একজন ডিরেক্টর বা একজন গল্পকার যদি গু বানিয়েও সেটা দিয়ে দর্শকের মন জয় করে নিতে পারে, তাতে নাটকবোদ্ধাদের সমস্যাটা কোথায়?
উদাহরণ হিসাবে প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রসঙ্গে চলে আসি। মধ্যবিত্তের অনুভুতি নিয়ে তিনি লিখতেন বলে অনেকেই তার লেখাকে মানসম্মত লেখা বলে মনে করতেন না। উনার লেখাকে শিল্পের মর্যাদা দিতে চাইতেন না বা সাহিত্যের ক্যাটাগরি তে ফেলতেন না। তাতেই হুমায়ূন আহমেদের কিচ্ছু এসে যায় নি। হুমায়ূন আহমেদ লিখতেন নিজের জন্য, পাঠকের জন্য। তিনি নিজেও খুশি ছিলেন, তার বইয়ের পাঠকও খুশি ছিল। উনার ইচ্ছা, উনি খেলতেন আমাদের সেন্টিমেন্ট নিয়ে। আমাদের ভালো লাগতো সেই খেলা। আমরা সাঁতার কাটতাম সেই সেন্টিমেন্টের নদীতে। যারা উনার সমালোচনা করতেন, তারা এখনও সমালোচনা করেন। তারা নিজেদের অনেক বড় ঔপন্যাসিক দাবী করেন। সভা সেমিনারে গিয়ে গালে হাত দিয়ে অনেক কিছু ভেবে চলেছেন, ভাব নিয়ে বসে থাকেন। বক্তব্য দেন। কলাম লিখেন, বইমেলায় বই ছাপেন। তাদের বইগুলো বিক্রি হয় না। পাবলিশার এর গুদামে বইগুলো উই পোকায় কাটে, পত্রিকাতে তাদের কলাম দেখা পাতাগুলো মা খালারা বিক্রি করে দেন কেজি দরে।

মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট কে পুঁজি করে কিছু করলেই এ দেশের এক শ্রেণীর জ্ঞানগর্ভ মানুষ আছেন, যারা জাত জাত গেল করে তেড়ে আসেন। সেই নির্মাতা, সেই লেখক কে টেনে নামানোর অভিপ্রায়ে তাকে তুচ্ছ করতে থাকেন, এর কারণ টা কি? এতে তাদের লাভটাই কি? তাতে তো তার বা তাদের শিল্পচর্চার পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না? তবে কেন মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্টের প্রতি তাদের এই উন্নাসিকতা কেন?
বড় ছেলে নাটকটা আমি দেখেছি একদম হটাত করেই। নাটকটি নিয়ে কোন রিভিউ, আলোচনা বা সমালোচনা কোন কিছুই চোখে পড়ে নি তার আগে। ভোর রাতে ঘুম আসছিল না বলে ইউটিউবে গুঁতোগুটি করতে গিয়ে নাটকটা দেখি। তখন কেবল দিনের আলো ফুটেছে। নাটক দেখে আমি হাউমাউ করে কাঁদছি। কারণ কি জানেন? বড় ছেলে আমাদের গল্প। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা মানুষগুলোর জীবনের কঠিন সমীকরণের গল্প সোজাসাপটা করে নির্মাতা বলেছেন। আমাদের বুঝেতে অসুবিধা হয় নি। প্রেমিকের সাথে থাকতে না পারার যে কষ্টের অনুভুতিগুলো, সেটা গল্পকার সোজাসাপটা তুলে ধরতে পেরেছেন। আমরা সেখানে নিজেদের চাপিয়ে রাখা অনুভুতিগুলোকে খুঁজে পেয়েছি। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় নি। অধিকাংশ জ্ঞানী নির্মাতা যা বানান, তা কোন লেভেলের শিল্প হয়, জানি না, তবে তা আমাদের মাথার উপর দিয়ে যায়... তাই আমাদের ভালোও লাগে না। আমরা তা দেখে ভাবি না, হাসি না, কাঁদিও না। দুর্ভাগ্য আমাদের। আমাদের চিন্তার ব্যপ্তি নিন্মগামী। তাই তথাকথিত সুপ্রিম বিষয়গুলো আমাদের বোধ কে নাড়া দিয়ে যায় না!
আমার অফিসে একজন হাসিখুশি কলিগ আছেন। নোয়াখালির মানুষ। সারাক্ষণই মজার মজার কথা বলে সবাইকে মাতিয়ে রাখেন। ৩/৪ দিন আগে দেখি সেই মানুষটা মন খারাপ করে অফিসের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম মন খারাপ কেন? কারণ এটা বিস্মিত হওয়ার মতই বিষয়। আমি দুই বছরে তাকে হাসিমুখ ছাড়া দেখি নাই। আমি জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আর বলিস নারে মুন্নি, একটা নাটক দেখছি সকালে। তারপর থেকেই মন খারাপ।। আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন নাটক, বড় ছেলে?’ উনি মাথা নেড়ে বলল, ‘হু’। একদম আমার জীবনের কাহিনী রে। এটুকু বলতে বলতেই তার দু’চোখ ভিজে উঠলো।
আরে, মেয়েমানুষ না হয় কথায় কথায় কাঁদে বলে অনেকের ধারণা, কিন্তু পুরুষ মানুষ? পুরুষ মানুষ এর চোখ দিয়ে খুব সহজে জল গড়ায় না। ফালতু এই নাটকটি দেখে এমন অনেক পুরুষ মানুষ কেঁদেছে।
সমালোচকেরা যত বড় জ্ঞানী গুণী বা যোগ্যতারই হোক না কেন, তাদের আসলে অধিকার কেউ অন্য কারো অনুভুতি বা ভালোলাগাকে ছোট করে দেখার। আর যারা এই কাজ টা করে তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়!
শিল্পগত যোগ্যতা, নির্মাণ ত্রুটি, গল্পের দুর্বলতা সহ আরও শ’খানেক দোষ থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে অন্য কোন নাটক এতটা গ্রহণযোগ্য তা পায় নি। অন্য কোন নাটক নিয়ে নাকউঁচু দর্শকেরা এত সমালোচনা করার সুযোগ পায় নি, ফেসবুকি আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ ভাব নিয়ে সমালোচকেরা দু’ কলম লেখার সুযোগ পান নি। ‘বড় ছেলে’ নাটক টি তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। নাটকটি তৃতীয় শ্রেণীর অতি বোকা মধ্যবিত্ত দর্শক কে কাঁদিয়েছে, উন্নাসিক দর্শক কে নাক সিটকানোর, স্ট্যাটাস দেয়ার আর সমালোচকদের দু’কলম জ্ঞান কপচানোর আর ট্রল করার সুযোগ করে দিয়েছে, যেই সুযোগটা সাম্প্রতিক সময়ে নাটকের ক্ষেত্রে অন্তত বিরল ঘটনা।

নাটক বা টেলিফিল্ম, বোকাবাক্সের দর্শকের জন্য। যাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম টেলিভিশন। এটা কোন সিনেমা না, সমাজ বদলানোর প্রোপাগান্ডাও না। এটা কোন উপ্যনাসও না যা দিয়ে সমাজ বদলানো যাবে বা সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচিত হবে। এটা আমজনতার জন্য বানানো একটা সাধারণ নাটক। যার উদ্দেশ্য ছিল জনগণের ভালো লাগা। আর সেই দিক দিয়ে ফুল মার্কস নিয়ে নাটকটি পাশ করে গেছে।
এই নাটকটা নিয়ে আসলে এত সমালোচনা হতোই না যদি এই মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট পুঁজি করে ‘বড়ছেলে’র জায়গায় 'বড়মেয়ে' কে দেখানো হত। পরিবারে দায়িত্ব আর তার ভালোবাসার জীবনের টানা পড়েন তুলে ধরলেই সেটা হয়ে তখন সেটা হয়ে যেত বাংলা নাটকের একটা মাস্টারপিস! রচিত হত আরেকটি সাতকাহন!
নাট্যকার ভুলটা করে ফেলেছেন এখানেই!

কেন জানি না পুরুষকেন্দ্রিক সেন্টিমেন্ট মেনে নিয়ে অতি আধুনিক সমালোচক ও নারীবাদীরা খুব অপারগ। পুরুষকে কেবল শাসকের আর অত্যাচারীর ভূমিকাতে দেখতে ভালবাসি আমরা। পরিবারের পুরুষদের কোন দুঃখ বেদনা, পরাজয়, সাক্রিফাইস বা কষ্ট থাকতে নেই!
ভাই, পুরুষরাও মানুষ। তাদের ভেতরও মানবিক অনুভুতি আছে। তাদের জীবনেও কিছু না বলা কষ্ট, সাক্রিফাইস আর পরাজয়ের হতাশা থাকে। বাইরের পুরুষতান্ত্রিক শক্ত খোলসটাই একজন পুরুষ মানুষের মানবিক পরিচয়ের সবটা নয়।


মধ্যবিত্ত সেন্তিমেন্ট বেঁচে থাকুক। আর মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে তৈরি হোক সুন্দর গল্প, আর সুস্থ নাটক, এই প্রত্যাশা রইল!

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৩৭

মেঘনা পাড়ের ছেলে বলেছেন: অনেকদিন পরে ফেরত আসলেন, পুন:স্বাগত ব্লগে।লেখার স্টাইল ও পরিষ্কার বক্তব্য পাঠকদেরকে পোস্টে ঢুকতে বাধ্য করে...........নিয়মিত থাকার চেষ্টা করুন, অনেক ভালমানের লেখা আপনার হাত দিয়ে বের হবে ..............।

পোস্টের কন্টেন্টে সহমত জানালাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.