নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন মানুষের প্রকৃত অর্থে যাহা গুণ থাকা দরকার সেরুপ গুন নিজের মধ্যে না থাকলেও চেষ্টায় আছি প্রকৃত মানুষ হয়ে বাঁচার।

এন.এ.আনসারী

একজন মানুষ হিসাবে আমিও সত্যক ভালবাসি। তাই আমারো চেষ্টা থাকে সত্য প্রকাশ করার আপ্রাণ চেষ্টা। অন্যের মত সহনশীলতার সাথে শুনা এটাই মনুষ্যত্য

এন.এ.আনসারী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফেইসবুক....একটি নিরব শোকগাথা

১৩ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১২:২৮


নাদিম বয়সে ছোট হলেও চমৎকার মেধার অধিকারী। যে কোনো পড়া একবার দেখলেই পাথরে খোদাইয়ের মতো অন্তরে বসে যায়। পঞ্চম, অষ্টমে ধর্মঘর বিদ্যালয়ে তার হাত ধরেই প্রবেশ করলো ট্যালেন্টপুল বৃত্তি। নাদিম ছাড়া ক্লাসটি যেনো শুকতারাহীন আকাশ। শিক্ষকরা ক্লাসে এসে প্রথমে আড়চোখে দেখে নেয়- নাদিম এলো কীনা! ও থাকলে ক্লাস থাকবে প্রাণবন্ত।
নবমে বিজ্ঞান বিভাগে আবাসিক ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলো উপজেলা সদরের মডার্ন হাইস্কুলে। নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ। ১ম সেমিস্টারে সকল বিষয়ে এ+ পেয়ে ছাত্র- ছাত্রী, শিক্ষক- শিক্ষিকাগণের বিশেষ নজরে এলো নাদিম। বন্ধুতো অনেক! কিন্তু বিশেষভাবে মিনহাজ, কৌশিক, সাজিদ, শ্রীকান্ত, আদিল, পাভেল ও জুনায়েতের সাথেই বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিলো। নয় বন্ধুর মাঝে সাজিদ ছিল হতদরিদ্র। পিতা নেই, মা সুলতানা বেগম নিকটাতœীয়দের সহযোগিতা, কুটির শিল্প, হাঁস- মুরগি পালনের মাধ্যমে চালাচ্ছেন সাজিদের পড়ার খরচ। বন্ধুরা দল বেঁধে নাস্তা খেতে যেতো হোটেল সালাহউদ্দীনে; আর সাজিদ অন্য কিছুর বাহানা করে ছোলা- মুড়িতে নাস্তা সারতে যেতো ঝুপড়ি ঘর-বদ্দার দোকানে।
নবমের বার্ষিক ফলাফলে নাদিম ১ম, শ্রীকান্ত ২য় আর বিনা কোচিং প্রাইভেটে সাজিদ ৩য় হলো। সবাই এখন নতুন দশম শ্রেণিতে। বিদ্যালয়ে প্রতিটি স্থানে দশমের দাপট। নবম-দশমের ছাত্র- ছাত্রীরা তুলামূলক চঞ্চল ও আবেগী হয়ে থাকে। এই দুটো ক্লাসে যারা চঞ্চলতা আর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে ভালো পড়াশোনা করে, ভাল চরিত্র গঠন করে, ভালো সহপাঠীর সাহচর্য লাভ করে, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করে চলে; পরবর্তী জীবনে তারাই সুপথে থাকে এবং জীবনের সঠিক পথ থেকে হারিয়ে যায় না।
নাদিমের বন্ধুদের অনেকেই নবম শ্রেণিতেই মোবাইল নিয়েছিল। দশমে উঠার পর থেকে প্রাই সবার হাতে হাতে এনড্রুয়েড মোবাইল। কারোটা পিতা শখ করে পুত্রকে দিলেন, কারোটা মামার দেয়া, কারোটা বড় ভাইয়ের দেয়া, কারোটা মিথ্যে বলে বই কেনার নাম করে একাধিক বার পরিবার থেকে টাকা এনে কেনা, কারোটা বা কোচিং প্রাইভেটের নাম করে আনা মিথ্যে টাকায় কেনা। মোবাইল নেই কেবল নাদিম আর সাজিদের।
ঈদুল আযহার ছুটিতে বাড়িতে এসে কোচিং প্রাইভেট আর গ্রুপস্টাডির সুবিধার কথা তুলে ধরে মোবাইল কেনার জন্য মা শায়েলা বেগমের কাছ থেকে সাত হাজার টাকা আদায় করে নিলো নাদিম। পৃথিবীর সকল মায়ের মতো শায়েলা বেগম ও তাঁর সন্তানকে যতটুকু ভালোবাসেন ঠিক ততটুকু বিশ্বাস ও করেন। তাঁর পবিত্র মনে সরল বিশ্বাস ছিলো আদরের মেধাবী সন্তান মোবাইল পেয়ে কখনোই মেধার অবমূল্যায়ন করবেনা। হযরত শেখ সাদী (র ঠিকই বলেছেনে, দুনিয়ার সমস্ত মা-ই মনে করে তাঁর সন্তানটিই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর এবং সবচেয়ে ভালো।
নাদিম ছাত্রাবাসে ফিরে মোবাইল কেনার কথাটি প্রথম জানালো মিনহাজকে, মিনহাজ জানালো কৌশিককে। কৌশিক পড়াশোনায় যথেষ্ট দুর্বল হলেও মোবাইল আর ইন্টারনেট চালনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পারদর্শী। কৌশিক তড়িঘড়ি করে প্রবেশ করলো নাদিমের ২০৬ নং রুমে।
ঃ দোস্ত! শুনলাম মোবাইল কিনবি!
ঃ হ্যাঁ, কিনবো বলে ভাবছি।
ঃ কত টাকার মধ্যে?
ঃ আম্মুতো দিলো সাত হাজার। ভাবছি শ্রীকান্তর মতো Nokia C1 নেবো।
ঃ দূর দোস্ত! ওসব ফালতু সেট চালানোর চেয়ে না চালানোই ভালো। তোর দরকার এনড্রুয়েট স্ক্রিন টাচ্ মোবাইল। তুইতো লেখাপড়া করিস- বাংলা ইংরেজি ডিকশনারী, বিভিন্ন বই, গ্রামার, অনে– ক কিছু মোবাইল থেকে পড়তে পারবি। আমার রঞ্জু আংকেলের দোকান থেকে নিয়ে দেবো। ওয়ারেন্টি দেবে, ভালো হবে। চল্ …..।
রাতেই কৌশিক, পাভেল আর জুনায়েত মিলে কিনে দিলো Symphony x-prol H2100 মোবাইল। ১৩ জিবি মেমোরিতে বন্ধুরা যার মোবাইলে যা যা অ্যাপ আছে শেয়ার ইট্ করে পঠিয়ে দিলো নাদিমের নতুন মোবাইলে। নাদিমের মোবাইল উর্ভর হলো গুগল, ইউটিউব, ফেইসবুক অপেরা মিনি, ফায়ার ফক্স, ডিকশনারী, কণা, হৃদয় খাঁন, বাজরাঙ্গী ভাইজান, এক্ থা টাইগার আরো অনেক কিছুতে।
সাজিদের মোবাইল নেই আর্থিক কারণে। এ না থাকার মাঝেই সে সান্ত¦না খুঁজে নেয়। অন্যদের মতো মোবাইলে গেমস খেলার নেশা নেই তার, মোবাইল চার্জ দেওয়ার টেনশন নেই, এম.বি কেনার দরকার নেই, বিভিন্ন কৌতুক, নাটক, গান দেখে দেখে মূল্যবান সময় নষ্ট করার সুযোগও নেই তার।
একদিন এক আড্ডার ফাঁকেই নাদিমের মোবাইলে ফেইসবুক আই.ডি খুলে দিলো কৌশিক। নাদিম ফেইসবুকের প্রাথমিক কিছু নিয়মাবলী বুঝে নিলো কৌশিক থেকে। শুরু হলো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আদান- প্রদান, গ্রহণ- বর্জন। মাসখানেকের মধ্যে নাদিম প্রচন্ডভাবে সক্রিয় হয়ে পড়ে ফেইসবুকে। যেমন- লাইক দেয়া, কমেন্ট করা, কৌতূহলী প্রোফাইলে প্রবেশ করা, নিজে লিখলে বা ছবি আপলোড করলে পাঁচ দশ মিনিট পরপর দেখা কয়টি লাইক কয়টি কমেন্ট পড়লো! লাইক পড়লে ভালো লাগে, কমেন্ট পড়লে আরও ভালো লাগে! এ যেন এক লাইক- কমেন্টের নেশা। এমনকি টিচারদের ফাঁকি দিয়ে ক্লাসের ফাঁকেও দেখে নেয়-কটি লাইক! কটি কমেন্ট!
এরই মাঝে নাদিম টের পেল তার বাম চোখের মৃদু মন্দ ব্যথা; হয়ত মাত্রাতিরিক্ত ফেইসবুক চালানোর কারনেই এমনটি হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ফেইসবুকের নেশায় এতই বিভোর থাকে যে, পাঁচ মিনিট পর রেখে দেব, পাঁচ মিনিট পর রেখে দেব করে করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। মাঝে মাঝে দু’এক ওয়াক্ত নামায পড়লেও তাও আবার অলসতা করে একদম শেষ ওয়াক্তে আদায় করাটা এখন নিয়মিত অভ্যাস।
বিদ্যালয়ের মোবাইলধারী ছোট বড় শিক্ষার্থীদের নতুন রোগ দেখা দিলো ‘সেলফি রোগ’। শ্রীকান্ত আপলোড করলো তালগাছের পাশে দাঁড়ানো সেলফি, গোসলের জন্য গেঞ্জি খুলতে থাকা মিনহাজ সেলফি তুলে ক্যাপশন দিলো “গোসলের প্রস্তুতি।” একজন দুজন করে প্রতিদিন বেড়েই ছলছে ফেইসবুক ব্যবহারকারী ছাত্র- ছাত্রীর সংখ্যা। ইদানিং ক্লাসে বেড়ে যাচ্ছে চঞ্চলতাহীন ঝিমুনো ছাত্র- ছাত্রীদের সংখ্যা। ঝিমুবেনা বা কেনো! অনেকেই যে ফেইসবুকে গভীর রাত পর্যন্ত আচ্ছন্ন থাকে।
দশমের নির্বাচনী পরীক্ষার সাতাশ দিন বাকী। নাদিমের এখন এফ.বি বন্ধু চার হাজার দুইশত সত্তর জন। শাহজালাল ব্যাংকে চাকরি হওয়ার পূর্বে ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে থাকা হাসান স্যার ফজরের নামাযের জন্য সবাইকে ডেকে দিতেন। স্যারের পরিবর্তে এখন ছাত্রাবাসের দায়িত্ব পেলেন রসায়নের দীপক কুমার চন্দন স্যার। আর ছাত্ররা ও মুক্তি (!) পেলো নামাজ আদায়ের মধুর অনুশীলন থেকে।
ছাত্রাবাসের ফেইসবুক ব্যবহারকারী ছাত্রদের অনেকেই এগারোটায় শুলে ফেইসবুক চালাতে চালাতে ঘুমায় বারোটায়, বারোটায় ঘুমালে একটায়! এখন আর সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মনে পড়ে না আরবি সেই ঘুমের দোয়া। বেশি রাত করে ঘুমানোর ফলে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে হয়ে যায় বেলা সাতটা। হাতটা বাড়িয়ে মোবাইলটা নাও হাতে, ডাটা চালু করো তাতে, কটা লাইক- কমেন্ট এলো রাতে! প্রায় প্রতিদিনই সাজ সকালের মূল্যবান দশ বিশ মিনিট ফেইসবুক হাতে কেটে যায় মশারীর নিচে।
নাদিমের পাশের ২০৫ নম্বর রুমে আদিল, সাজিদ, সৌরভসহ সাতজন থাকে। যে কজন ছাত্র ফেইসবুক চালানোর ক্ষেত্রে সতর্ক, সচেতন আদিল তাদের অন্যতম। যেদিন পড়ার চাপ বেশি সেদিন মোটে ও ধরেনা ফেইসবুক। মাঝে মাঝে দুতিন দিন পর পর খোলে। রুটিন মোতাবেক সামান্য সময় ¯স্রেফ শিক্ষার জন্য ফেইসবুক চালায় ও। অন্যান্যদের মতো ঘণ্টার পর ঘন্টা ননস্টপ অসতর্ক ফেইসবুক ব্যবহারে গা ভাসিয়ে দেয়নি আদিল।
যথাসময়ে নাদিমদের এসএসসি পরীক্ষা হলো। অপেক্ষা এখন ফলাফলের। ২৯ এপ্রিল দুপুর বারোটায় ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হলো ফলাফল। নাদিমের বাবা বিদেশ থেকে ফলাফল জানার জন্য বারবার কল দিচ্ছেন। মা শায়লা বেগম জায়নামাযে বসে বসে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করছেন। ছোট বোন সানজিদা, ছোট ভাই নাজিম ও অপেক্ষায় আছে বড় ভাই নাদিমের ফলাফল জানতে। নাদিম মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে ssc din 252233 2015 লিখে 16222 নাম্বারে SMS সেন্ড করতেই ফিরতি SMS এ ফলাফল এলো- ‘কনগ্রাজুলেইশন 4.70। A+ এলো না; বিশ্বাস হচ্ছিল না ম্যাসেজ। আবার পাঠালো; আবার এলো ‘কনগ্রাজুলেইশন 4.70।
নাদিমের আর কারও ফলাফল জানতে ইচ্ছে নেই। তবুও জানা হয়ে গেলো মিনহাজ ৩.৭৫, শ্রীকান্ত ৪.৫০, পাভেল ৩.১০, আদিল ৫.০০, সাজিদ ৫.০০ আর নাটের গুরু কৌশিক ২.৫০। বিজ্ঞান বিভাগের ১৫ জন এ+ পেলো।
আফসোসে বুক ফেটে কান্না আসেছে নাদিমের। কী জবাব দেবে মা- বাবাকে। অনেক করে কান্না করলো। মায়ের গলার চেইন বিক্রির টাকায় ফরম ফিলাপের কথাটি মনে পড়তেই হু হু….. করে কেঁদে উঠলো নাদিম। অন্তর ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে বেদনায়। এ যাতনা এ বেদনা লাগামহীন দিনরাত ফেইসবুক চালানোর আর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অতিরিক্ত ঘুম, গল্প-গুজব ও অলসতায় সময় অপচয় করার। হৃদয়ের রক্তকে কালি বানিয়ে ব্যর্থ যোগ বিয়োগ করছে অপচয় হওয়া নবম দশমের হীরা মনি মুক্তার চেয়েও কোটিগুণ দামী হারানো সময়গুলোর। নিজের মেধার অপব্যয় করার দরুন ভালো ফলাফল না হওয়ায় জীবনে এর ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব নয়। দুনিয়ার সমস্ত সম্পদের বিনিময়েও নয়। নাদিম চোখের পানিতে ওই চির সত্য উপলব্ধি করলো। লাগামহীন ফেইসবুক চালানো আর সময়ের অপচয় জীবনে তাকে যা দিলো তা হলো একটি মাত্র ছোট্ট শব্দ। ‘আফসোস’ মর্মবেদনায় আচ্ছন্ন হলো তার হৃদয়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.