নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আনোয়ার কামাল

আনোয়ার কামাল

আমি কবিতা,গল্প,প্রবন্ধ,বই ও লিটলম্যাগ আলোচনা লিখে থাকি । ‘এবং মানুষ’ নামে একটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করি। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। ব্লগারের অনুমতি ছাড়া কোন লেখা কপি করে অন্য কোথাও ছাপানো নিষেধ।

আনোয়ার কামাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোট গল্প

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৫

মুঠো ফোনে বন্দি



আনোয়ার কামাল



একাকিত্ব কাকে বলে তা কখনো বুঝে উঠতে পারেনি পারভেজ। ঈদের ছুটিতে এবার বেশ কয়েক দিন অফিস বন্ধ পাওয়ায় ঈদের এক সপ্তাহ আগেই সে পরিবারের সবাইকে দেশের বাড়িতে পাঠায়। বাসায় সে একা একা গান শুনে বই পড়ে কাটায়। বাইরে বেরুতেও ইচ্ছে করেনা। নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হয়।



ফ্লাটে মুখ বুজে কাটাতে হয়। কেমন যেন এই ঢাকা শহরের বাসিন্দারা। একই ফ্লাটে বাস করছে অথচ কেউ কারো সাথে তেমন একটা মেলামেশা করে না। দুই একজনের সাথে কথার আদান প্রদান হলেও কেমন যেন একটা কৃত্রিমতার গন্ধ পাওয়া যায়। এসব পারভেজের একেবারেই ভাল লাগে না। পারভেজের মনে হয় মফস্বল শহরের লোকজন বেশ ভালো তারাও শহরে চাকরি বাকরি করলেও তাদের মধ্যে অনেক আন্তরিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। একে অপরের সুখ-দুঃখের খোঁজ খবর নেয়। আর এই ঢাকা শহরের মানুষজন যেন কলুর বলদের মত কেবল জীবন জীবিকার তাগিদে খেটেই চলছে।



সেই ছোট বেলায় পড়েছিল পিপিলিকা পিপিলিকা দলবল ছাড়ি একা / কোথা যাও যাও ভাই বলে/ একবার দাঁড়াওনা ভাই। শীতের সঞ্চয় তাই খাদ্য খুঁজিতেছি ভাই দাঁড়াবার সময়তো নাই। আসলে ঢাকাবাসীর সেই দশা হয়েছে। পিপিলিকার মত তাদেরও দাঁড়াবার সময় নাই। এসবই একা একা বসে ভাবছিল পারভেজ। হঠাৎ করে সেল ফোনে রিং টোন রমজানের ঐ রোজার শেষে বেজে উঠতেই তার সম্বিত ফিরে আসে।



- হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে ভারি মিষ্টি মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে:

- কেমন আছো ?

কন্ঠটা তার বেশ পরিচিত মনে হয়। তবে এবার তার কাছে বেশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এতো তারই সেই অতি পরিচিত জনের কন্ঠ। সে বুঝে ওঠার আগেই বলে ফেলে-

- ভালো। তুমি কেমন আছো ?

- আমি ভালো আছি। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে।

- আমি এখন ঢাকা শহরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি কয়েদী।

এমন কথার উত্তর বুঝে উঠতে পারে না নন্দিতা। তাই বলে:

- অর্থ বুঝলাম না।

- সোজা সাপ্টা অর্থ হলো পরিবারের সকলকে বাড়িতে পাঠিয়ে আমি এখন এই ফ্লাটে বন্দি হয়ে আছি। বড়বেশি একাকিত্বে পেয়ে বসেছে আমাকে। তোমার একটা ফোনে অনেকটা প্রশান্তি পাওয়া গেল।

- তাই নাকি ? এখনো তুমি আমার ফোন পেলে প্রশান্তি পাও নাকি?

- তোমার কি মনে হয় ?

-ঠিক বুঝি না। এ ধরনের হেয়ালিপনা উত্তর দেয় নন্দিতা।

পারভেজ সরাসরি বলে বসে:

- তোমার ফোন পেয়ে মনে হচ্ছে বর্ষণমুখর দিনে হঠাৎ না চাইতেই এক চিলতে রোদের পরশ যেন গা ছুঁয়ে গেল।

- থাক আর কাব্য করতে হবে না, বলেই নন্দিতা জানতে চায় ফোন করো না কেন ? ভুলে গেলে নাকি ?

- ইচ্ছে করলেও পারিনা ,পারা যায় না। তোমাকে ভোলার অনেক চেষ্টা করে দেখেছি। পারিনা।

- তেমার কর্তা কোথায় ? পারভেজ জানতে চায়।

- কর্তা গেছেন দেশের বাড়িতে; তার মা অসুস্থ।

- ছেলে মেয়েরা কোথায় ?

- ছেলে গেছে বাইরে আর মেয়ে প্রাইভেট পড়তে গেছে।

- তাইতো বলি হঠাৎ করে তোমার এ সময়ে ফোন।

- তুমিতো ফোন করো না তাইতো আমিই ফোন করলাম।

-তোমাকে সব সময়ই ফোন করতে ইচ্ছে করে কিন্তু একরাশ পাহাড় এসে দাঁড়ায় আমার সামনে। তাইতো ইচ্ছে করলেও ফোন করতে পারিনা। পরে তোমার স্বামী ছেলে-মেয়ে জেনে ফেললে কেমন হবে এ সাত-পাঁচ ভেবেই ফোন করিনা। আচ্ছা তুমি কেমন আছো ? পারভেজ জিজ্ঞেস করে।

- আমার ভালো থাকা। আছি বেশ । নন্দিতার কথায় যেন হতাশার সুর ভেসে ওঠে। কোথায় যেন ও কিছু খুঁজে ফিরছে। হতাশা ওকে গ্রাস করে কুরে কুরে খাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে পারভেজের কাছে। সেই প্রায় বিশ বছর আগে একে এপরের থেকে ছাড়া-ছাড়ি হয়েছে কিন্তু দুজনে কেউ কাউকে ভুলতে পারেনি। এটা কি কেবলই পরম ভালোবাসার জন্যে। পারভেজ বুঝতে পারেনা একে অপর থেকে দূরে থাকলেও আজ প্রায় বিশ বছর পরে দুজনেই মধ্য বয়সে এসেও মনের কাছে এখনো তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি। পারেনি হৃদয় থেকে একে অপরকে সরিয়ে দিতে। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা এখনো একে অপরকে ধরে রেখেছে। দুজনেরই ছেলে মেয়ে আজ কলেজে পড়ছে। তার পরেও নন্দিতা ও পারভেজের ভালোবাসা ।



পারভেজ হারিয়ে যায় সেই পুরোনো দিনের ফেলে আসা দিনগুলোতে। সেই আশির দশকের কথা। মফস্বলের ছোট্ট এক শহরে একই কলেজে পড়তো দুজনে। কলেজে পড়তে পড়তেই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা তারপর মন দেওয়া নেওয়া। পারভেজের বাবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার কারনে তাদের বদলি হয়ে যেতে হয়। তারপর থেকে একে অপরের চোখের আড়াল হয়ে যাওয়া। তাহলে কি চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়ে যাওয়ার যে প্রবাদ রয়েছে সেটাই কি ঘটেছিল পারভেজের জন্য। হয়তোবা তাই। যতই দিন যেতে থাকে ততই যেন একে অপরকে অচেনায় পরিণত হতে থাকে। সে সময়ে আজকের মত সেল ফোনের এত দাপট ছিলো না। একমাত্র ভরসা ছিলো ডাকবিভাগ। তাও আবার পাঠাতে হতো আরো একজনের ঠিকানায়। দুজনের দেখা সাক্ষাৎ ছিলো না।



হঠাৎ করেই পারভেজের চাকরি হয়ে যায়। রাজধানী ঢাকাতে তার পোস্টিং। চাকরিতে যোগদান করে নন্দিতাকে চিঠি দেয়। তার চাকরির সুসংবাদটা দেয় গভীর আগ্রহ ভরে। নন্দিতা তাকে উৎসাহ দেয়। তোমার এবার বিএ পাশ করতে হবে। পারভেজ তাতে সায় দেয়। পড়াশুনা শুরু করে। পরীক্ষা দেয়। বিএ পাশ করে। এদিকে নন্দিতা ও পারভেজের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে কিন্তু তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয় না। এমনিভাবে মাসের পর মাস কেবল প্রেমপত্র চালাচালি চলতে থাকে। দুজনের মধ্যে চিঠি লেখার প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। একেক জনের চিঠি ১৩ /১৪ পাতা পর্যন্ত গড়ায়। পারভেজ ঢাকায় থাকার কারণে নিউমার্কেট ,এলিফেন্ট রোড, বায়তুল মোকাররম থেকে বিদেশি ভিউ কার্ড সংগ্রহ করে প্রতিটি চিঠির সাথে পাঠায় সেই সাথে জিপিও এর ফিলাটেলিক ব্যুরো থেকে, বেরুনো ষ্ট্যাম্প খামের উপর লাগায়ে চিঠিকে আরও আকর্ষণীয় করে।



হঠাৎ করেই নন্দিতার চাকরি হয়ে যায়। সে সংবাদটা নন্দিতা পারভেজকে দিলে উভয়েই গভীর ভাবে তাদের মধ্যে ভাবের লেনদেন করে, পুলকিত বোধ করে। বেশ কিছুদিন এভাবেই চলতে থাকে। নন্দিতা তার ছবি পাঠায়। পারভেজ নন্দিতার ছবি তার বাবা মাকে দেখায়। পারভেজের বাবা-মা তার ছবি দেখে পছন্দও করে। এ সংবাদটা পারভেজ নন্দিতাকে জানায়। নন্দিতা বেশ পুলকিত বোধ করে। বেশ কিছুদিন এভাবে পরভেজ স্বপ্ন দেখতে থাকে। তার স্বপ্ন পূরণের জন্য দিন বোধ হয় ঘনিয়ে এলো। তারপর কেমন যেন নন্দিতার চিঠিপত্র কম আসতে থাকে। হঠাৎ করে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। পারভজ বুঝতে পারে নন্দিতা এখন চাকরি করছে। সে কারণেই বুঝি তাকে এড়িয়ে চলা। পারভেজও অভিমান করে আর পত্র দেয়না।



- কী হঠাৎ করে চুপ করে গেলে যে ? কথা বলছো না কেন ?

নন্দিতার কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় পারভেজ। হঠাৎ করে সে কোন রাজ্যে চলে গেছিল।

- না । এই ফেলে আসা দিনের কথাই ভাবছিলাম আর কি।

- তা ভেবে ভেবে কী পেলে?

- শূন্যতা ছাড়া আর কিই বা পাওয়ার আছে!

পারভেজের কথায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে নন্দিতা।

পারভেজ কবি শামসুর রাহমানের কবিতার ভাষায় কাব্য করে বলে-

-তোমাকে পাবার জন্য হে নন্দিতা আর কত কাল ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায় ?

- তাহলে আমাকে পাবার আশা এখনো বুঝি ছাড়তে পারোনি ?

- ধরে রাখতে পারলাম কোথায় ?

- যারে নিজ হাত মালা দিতে পারোনি

কেন মনে রাখো তারে, ভুলে যাও তারে ভুলে যাও চির তরে।

-ভুলে যেতে চাইলেও ভুলে যাওয়া যায় না। ফেলে আসা দিনের কথা স্মৃতিতে জ্বল জ্বল করে।



হঠাৎ করে নন্দিতার মোবাইলের কানেকশন কেটে যায়। পারভেজ বার বার রিং করেও আর সংযোগ পায় না। একরাশ স্মৃতি কেবলই হাতড়াতে থাকে। #

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.