নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

বিএম বরকতউল্লাহ

জানতে চাই।

বিএম বরকতউল্লাহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটোগল্প: নারী ও প্রকৃতি

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৫

আমাদের বাংলা ঘরের কোণায় তিরিশ বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যে তালগাছটি, সে আমাদের পরিবারের সদস্য। জন্মের পর থেকেই তাকে দেখছি। তার সাথে খেলাধুলা করেছি, আড্ডা দিয়েছি, কারণে-অকারণে কত মান-অভিমান করেছি, তার সুশীতল ছায়ায় বসে প্রাণ জুড়িয়েছি। মায়ের বকুনি খেয়ে লাফিয়ে তার চূড়ায় গিয়ে উঠেছি। সে তখন সন্তান স্নেহে কোলে তুলে রাখত। সে আমাদের পরিবারের সুখ-দুখ ও নানা ঘটনা-রটনার জীবন্ত সাক্ষী। ঘর থেকে বেরুতে তাল গাছ, ঘরে ফিরতেও তাল গাছ। তার বিশাল দেহ ষ্পর্শ করা ছাড়া আমাদের যাওয়া-আসা হয় না।

মা-বাবা প্রায়ই বলেন, ‘তালগাছটি আমাদের সন্তানের মত। পরিবারের সবার মায়া-মমতায়, আদর-স্নেহে সে বড় হয়েছে। আমরাও তার কাছ থেকে কম পাইনি, কম শিখিনি। আমাদের সে উদারভাবে দিয়েছে ফল, ছায়া-মায়া, আদর-স্নেহ, ভালবাসা আর সব কিছু সয়ে যাওয়ার কঠিন শিক্ষা। আমরা কোনো দুখে, যন্ত্রণায় তালগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে, তাকে ধরে ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে-কেটে চোখের জল ফেলি। তার কাছে কত যে মান অভিমান করি। সে তার অদৃশ্য হাতের কোমল ¯পর্শে আমাদের শান্তনা দেয়। অসীম কষ্টে সীমাহীন ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়। আমাদের বিপদে-আপদে, শত কষ্টের মাঝেও তালগাছটি যেন সব সময় পাশে এসে দাঁড়ায়। আমাদের কোনো আনন্দ সংবাদে সে যেন ফুর্তিতে নেচে উঠে। আমাদের সব কাজে, আনন্দ বেদনায় তার নীরব উপস্থিতি অনুভব করি। সে আমাদের সাথে বসে খায় না, শোয় না, পরে না অথচ মনে হয় সবসময় সে আমাদের পাশেই আছে। তার উন্নত মাথা আমাদের হৃদয়ে অফুরন্ত সাহস যোগায়।’

দুই.
তালগাছটির সাথে আমাদের পরিবারের শিশুদেরও বেজায় ভাব। তারাও এর সাথে খেলে, মান-অভিমান করে, আদর-আপ্যায়ন করে, কারণে-অকারণে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে আবার শাসনও করে। "এ বয়সে লেখাপড়া আর খেলাধুলা ছাড়া তোর কোনো কাজ-কম্ম আছে? না, নেই। ইস্কুলের পড়া যদি না শিখে আসিস, তবে তোর দফা রফা করে ছাড়ব বলে দিলাম, বুজেছিস, ফাজিল কোথাকার? যা বেটা, সিটে গিয়ে ব।’ ভারী গলায় এসব আদেশ-উপদেশ আর ঝাল উদগীরণ করে হাতের অবশিষ্ট ভাঙ্গা বেতটা আছাড় মেরে ফেলে দিয়ে পরেই না ক্ষান্ত হন নয় বছরের রাগী শিক্ষক মশাই।

তালগাছটার সাথে আমার বোন লাবনীর নিবিড় সম্পর্ক। সে কতবার যে তালগাছটাকে কনে সাঝিয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়েছে, আর কতবার যে বর সাঝিয়ে বিয়ে করিয়ে লাল টুকটুকে বউ এনে ঘরে তুলেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ঘরে নতুন বউ আনার আনন্দে ও কনেকে স্বামীর ঘরে পাঠিয়ে দেয়ার কষ্টে অসংখ্যবার তার চোখ অশ্রুসজল হয়েছে। এ ক্ষুদ্র নারীটির সাথে তালগাছটার হৃদয়ের নীরব স¤পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। তার সেই পুতুল খেলার বয়স আর নেই। এখন বিয়ের প্রস্তাব এলেই সে সবার অগোচরে তালগাছটি ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে নালিশ করে। তালগাছটি তার সব কথা শুনে শান্ত¦না দেয়; অতঃপর কষ্টগুলো নিংড়ে নিয়ে আদর করে অবুঝ শিশুর মত ঘরে পাঠায়।
ইদানীং তালগাছটার আরেকটি কর্তার আবির্ভাব ঘটেছে সে আমার সাত বছরের মেয়ে বিন্তি। ছোট কর্তাটি তার ফুফু লাবনীর অনুকরণে তালগাছটাকে অতি আপন করে নিয়েছে। কখনো দু জনে এক হয়ে কখনো বা প্রতিযোগিতা করে আদর-সোহাগ করে, আবার মান-অভিমান ও শাসন-বারণ করে। তাদের আদর-শাসন রাগী স্যারের মত নয়; মার্তৃস্নেহে পরিপূর্ণ।


তিন
হঠাৎ করেই পাশের গ্রামের বিদেশগামী ছেলের সাথে লাবনীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। তিন দিনের মাথায় বিয়ে এবং এক শ’ লোক খাওয়াতে হবে। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবার মুখরক্ষা করে এত বড় আয়োজন করার কোনো পূর্ব প্রস্তুতি আমাদের নেই। অনেকগুলো টাকা যোগাড়-যন্তের ব্যাপার।
একে তো সর্বকণিষ্ঠা কন্যা তার উপর পাত্রটিও ভাল। বাবা কাধে পাঞ্জাবিটা ফেলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ঘন্টা দুই পরে বাড়ি এসে বললেন, ‘বিয়ের আয়োজন শুরু করে দে। টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’

আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হলো।

বোনটিকে চোখের জলে বিদায় দিলাম। বোনটিও একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। সবশেষে নববধূটি সবার মধ্য থেকে ছুটে গিয়ে তালগাছটার গায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে প্রলাপে-বিলাপে কান্না জুড়ে দিল। বাড়ির ছোট বড় কেউ আর অশ্রু সম্বরণ করতে পারল না; মমতাময়ী নির্বাক তালগাছের পক্ষে সবাই চিঁ চিঁ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তালগাছটাকে দেখ, ‘নিয়মিত পানি দিও, ওর গায়ে যেন কেউ পেরেক না ঠুকে’ এসব বলতে বলতে সে চোখের জলে বিদায় হয়ে গেল।

দুদিন পর ব্যাপারীরা এসে ফিতা টেনে তালগাছের বেড় মেপে এর কি পরিমাণ সার-পাগাল ও টানা- ধরনা হবে এসব হিসেব-নিকেস করল। গাছটার মোড় কোনদিকে এবং কাটার পর কোন দিকে ফেলা হলে পরে ঘর বাড়ি ও অন্যান্য গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, ঘুরে ফিরে এসব পরখ করে ব্যাপারীরা মোটা রশির টানা দিয়ে চলে গেল। মা এসব দেখে বিচলিত হয়ে বাবাকে অসংখ্য প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলেন। বাবা কোনো জবাব দিলেন না; মাথা নিচু করে বসে রইলেন।

আমার ছেলে-মেয়ে শামস ও বিন্তি স্কুল থেকে এসে দেখে, তালগাছটার গলায় মোটা রশি বেধে অদূরে একটা খোলা জায়গায় খুঁটি গেড়ে টানা দেয়া হয়েছে। তারা যাকে সামনে পেল তাকেই এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগল। কেউই এর সদুত্তর না দিয়ে বিরক্তির সুরে জবাব দিল, ”জানিনা”।

শিশু দুটি রশির শক্ত টানা খুঁটি ঢিলা করার ব্যর্থ কসরত করে ঘরে এসে চিৎকার করে দাদাকে বলছে, ‘আমাদের তালগাছের গলায় ফাঁশি লাগাল কে। গাছের শ্বাস তো বন্ধ হয়ে যাচেছ। ওর খুব কষ্ট হচেছ। তাড়াতাড়ি বান খুলে দাও দাদা, এক্ষুনি। কথা বলছ না কেন?’

-‘গাছ বিক্রি করে দিয়েছি। ব্যাপারীরা আগামীকাল গাছ কেটে নিয়ে যাবে। ফাঁশ লাগিয়েছে, ভাল করেছে। এত প্যারপ্যারি করিস না, যা এখান থেকে, বলেই তিনি ধপ ধপ পা ফেলে দ্রুত বাইরে চলে গেলেন।

চার.
‘রাখ, এক্ষুিণ লাবনী ফুফুকে গিয়ে বলছি’ বলেই শিশু দুটি হন হন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
পরদিন সকালে ঝড়ের গতি নিয়ে বাড়িতে ঢুকল লাবনী। এ অবস্থায় তাকে দেখে সবাই হতবাক। ব্যাপারীরা বাইরের উঠোনে বসে রেত দিয়ে করাতের দাঁতে শান দিচেছ। শান দেয়ার কর্কশ শব্দে লাবনীর অন্তরাত্মা মোচড় দিয়ে উঠল। সে দৌড়ে গিয়ে তালগাছটা বুকে আগলে ধরে আদর করে কেঁদে কেঁদে বলল, ‘আমি বেঁচে থাকতে তোর গায়ে একটা আঁচড় কাটতে পারবে না কেউ।’

উপায়হীন বাবা তার কুড়ি বছরের আদরের কন্যাকে সুপাত্রস্ত করার আনন্দে তিরিশ বছরের সন্তানতুল্য তালগাছটাকে বিসর্জন করেছেন। এখন নীরব তালগাছটার জন্য কন্যার সরব উত্তেজনা নীরবে হজম করছেন অপরাধী পিতা। তিনি আসামীর কাঠগড়ায় মাথা নত করে সংকোচে দাঁড়িয়ে রইলেন। সবার চোখে পানি।

লাবনী তার আঁচল থেকে এক তোড়া টাকা বের করে বাবার হাতে দিয়ে বলল, যাও, ‘এক্ষুনি ব্যাপারীকে টাকাটা ফেরত দিয়ে আসো।’
বাবা টাকাটা ফেরত দিয়ে এসে সবার সাথে আনন্দে যোগ দিলেন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.