নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন সুখী মানুষ, স্রষ্টার অপার ক্ষমা ও করুণাধন্য, তাই স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধাবনত।

খায়রুল আহসান

অবসরে আছি। কিছু কিছু লেখালেখির মাধ্যমে অবসর জীবনটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছি। কিছু সমাজকল্যানমূলক কর্মকান্ডেও জড়িত আছি। মাঝে মাঝে এদিক সেদিকে ভ্রমণেও বের হই। জীবনে কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করিনি, এখন তো করার প্রশ্নই আসে না। জীবন যা দিয়েছে, তার জন্য স্রষ্টার কাছে ভক্তিভরে কৃতজ্ঞতা জানাই। যা কিছু চেয়েও পাইনি, এখন বুঝি, তা পাবার কথা ছিলনা। তাই না পাওয়ার কোন বেদনা নেই।

খায়রুল আহসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

মনে গাঁথা শৈশবের কিছু স্থায়ী স্মৃতিকথা (প্রতিযোগিতার জন্য নিবেদিত)

০৫ ই জুন, ২০২৩ রাত ১১:৫১

(আমার এ স্মৃতিকথাগুলো কিছু নতুন সংযোজনসহ মূলতঃ ইতোপূর্বে এ ব্লগে প্রকাশিত কয়েকটি স্মৃতিকথামূলক পোস্ট সম্পাদনা, পরিমার্জন ও সংকলন করে আজ প্রকাশিত হলো। দ্বিরুক্তি পাঠকদের বিরক্তির কারণ হলে দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।)

জন্মক্ষণঃ
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে কোন এক শীতের বিকেলে অগ্রহায়ণের শেষ দিনটিতে আমার জন্ম হয়েছিল সায়াহ্নের প্রাক্কালে । পৃথিবীর বুকে আমার আসার সেই সময়টা ছিল পাখিদের নীড়ে ফেরার সময়। ছোটবেলা থেকে আজ অবধি আমার এ সময়টাকে খুব ভালো লাগে। সুযোগ পেলেই এ সময়টাতে একটু থেমে নীড়ে ফেরা পাখিদের কলকাকলি শুনি। বাসার কাছেই বড় বড় কিছু গাছ আছে। সুযোগ পেলেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পাখিদের ঘরে ফেরা দেখি। সম্প্রতি হাকালুকি হাওড়ের একটি জায়গায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সহস্র পাখির সুশৃঙ্খল সারি বেঁধে উড়ে এসে যার যার নির্দিষ্ট বৃক্ষশাখায় বসে পড়ার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাদের কলকাকলিতে এলাকাটি কিছুক্ষণ মুখরিত ছিল। ঠিক মাগরিবের আযানের আগে আগে সব পাখি নিশ্চুপ হয়ে যায়। প্রার্থনার জন্য সময়টা মনে হয় খুবই তাৎপর্যময়, তাই এতদুদ্দেশ্যে মানুষ ও প্রকৃতি সময়টাকে যেন ভাগ করে নেয়!

খুব ছোট বয়সের কিছু কিছু স্মৃতিঃ
অবসর জীবনে বোধকরি মানুষের শৈশবের স্মৃতিকথা বেশি করে মনে পড়ে। বিরানব্বই বছর বয়সেও স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত আমার মা’কে দেখেছি নিত্যদিনের কোন কথা উনি স্মরণ করতে পারতেন না, কিন্তু শৈশবের কথা উঠলে তিনি গড় গড় করে স্মৃতিকথা বলে যেতে পারতেন। আমারও খুব ছোট বয়সের কিছু কিছু স্মৃতিকথা মনে যেন স্থায়ী ভাবে গেঁথে আছে। যেমন আইউব খানের প্রথম মার্শাল ল’ জারির সময় সবার মনে একটা আতঙ্ক নেমে আসার কথা মনে আছে, সে আতঙ্ক থেকে পথে ঘাটে চারিদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ধুম পড়ে গিয়েছিল। ১৯৫৮ কি ৫৯ সালে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক স্কাউট জাম্বরী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন আমি স্কাউট সম্বন্ধে কোন কিছু জানতাম না, কিন্তু বাসার অদূরে জাম্বরী মাঠ প্রস্তুতির তোড়জোড়ের কথা মনে আছে। সারাদিন ধরে রোলার, গ্রেডার আর ক্যাটারপিলার ঘর ঘর শব্দ করে মাটি সমান করা ও শক্ত করার কাজ করতো। ওসব যন্ত্রদানব থেকে থেকে ঘন ঘন উদগীরিত কালো ধোঁয়া আর পোড়া মবিল ও ডিজেল এর গন্ধ যেন আজও আমার নাকে লেগে আছে।

আমার ছোট বোনের জন্মঃ
আমাদের সাত ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ভাইটা ছাড়া আমাদের সবার জন্ম ঘরেই হয়েছিল। তখন সরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে স্বল্প প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফরা (ধাত্রী) ঘরে এসে শিশুজন্মের এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে দিতেন, প্রতিবেশি অভিজ্ঞ রমণীরা সাথে থেকে সহায়তা করতেন। এক আষঢ়স্য রাতের শেষ প্রহরে প্রবল বর্ষণের মাঝে আমার ছোট বোনের জন্ম হয়েছিল। থেকে থেকে শোঁ শোঁ আওয়াজ করে দমকা হাওয়া বইছিল। ওর জন্মের পরপরই বৃষ্টির শব্দের মাঝেও ফজরের আযান শোনা গিয়েছিল। আমাদের প্রতিবেশি সিদ্দিক চাচী (আব্বার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু’র স্ত্রী) সেই প্রলয়ের রাতে আমার বোনের জন্মের সময় সারারাত মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সহায়তা করেছিলেন। সেই চাচীর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে। তখন আমরা ঢাকার শহীদবাগে থাকতাম। চাচী আমার আম্মার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন, তাই আম্মাকে তিনি ছোট বোনের মত স্নেহ করতেন এবং ভালোবাসতেন। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও, বহুদিন পর পর হলেও আম্মার সাথে দেখা করার জন্য আমরা যেখানেই থাকি, চাচা-চাচী সপরিবারে আমাদের বাসায় আসতেন। আমার জন্মের সময়ও চাচী আম্মার পাশে ছিলেন বলে আম্মার মুখে শুনেছি, তাই বুঝি আমাকেও তিনি বিশেষ স্নেহ করতেন। দেখা হলেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন। আজ এতদিন পরেও চাচীর মুখটা আমার মনে ভাসে। বকের মত সাদা (ফর্সা) রঙের সেই চাচীর ওষ্ঠ সবসময় পান-চুনের রসে লাল হয়ে থাকতো, মুখ দিয়ে জর্দার খুশবু ছড়াতো। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে অনেক কষ্টে খিলগাঁওয়ে অবস্থিত সেই চাচা-চাচীর বাসার সন্ধান পেয়ে, চাচীর সাথে দেখা করানোর উদ্দেশ্যে আম্মাকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম। গিয়ে তাদের মেজ ছেলের (তপন ভাই) কাছে শুনি, চাচী ও চাচা বহু বছর আগেই প্রয়াত হয়েছেন। এ কথা শুনে আম্মা খুব মন খারাপ করেছিলেন।

১৯৬০ সালের সাইক্লোনঃ
চট্টগ্রামে ১৯৬০ সালের অক্টোবরে এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝর বয়ে যায়। ঝড়ের সময় দেখেছিলাম, মিজাইলের মত উড়ন্ত টিনগুলো শোঁ শোঁ শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে এবং গাছের ডালপালায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ছে। ঝড়ের প্রকোপে একটা জাহাজও ফৌজদারহাটের ডাঙায় এসে আছড়ে পড়ে। সে সময় একটা উড়োজাহাজেরও যেন কি হয়েছিল তা স্পষ্ট মনে নেই, কিন্তু বেশ কয়েকদিন সে উড়োজাহাজটি অচল অবস্থায় আটকে ছিল। আমার এটুকু মনে আছে যে উৎসুক দর্শনার্থীদেরকে উড়োজাহাজের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিল এবং এক বিকেলে আমরা কয়েকটি প্রতিবেশি পরিবার পতেঙ্গায় গিয়ে উড়োজাহাজের ভেতরটা দেখে এসেছিলাম। সেটাই ছিল আমার প্রথম কোন উড়জাহাজের অভ্যন্তরে প্রবেশের ঘটনা। আর কিছু নয়, ছোট ছোট জানালাগুলো দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম।

দই ওয়ালাঃ
চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় আমি কোন স্কুলে ভর্তি হই নি, তবে বাসায় পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়েছিল। সকাল দশটা নাগাদ বড় ভাইবোনেরা যে যার মত স্কুলে এবং আব্বা অফিসে চলে গেলে বাসায় শুধু আম্মা আর আমি থাকতাম। আম্মা সে সময়টাতে একটু শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতেন। কখনো হয়তো চোখদুটোও তার একটু বুঁজে আসতো। প্রতিদিন সময় করে এগারটা বারটার দিকে এক শীর্ণকায় দই ওয়ালা বাসার কাছে এসে দই বিক্রীর জন্য হাঁক দিত। শরীরের তুলনায় তার হাঁকডাক অধিকতর ওজনদার ছিল। এতে আম্মার নিদ্রাভঙ্গ হতো। অনেক সময় তিনি দই কিনতেন এবং আমরা দুজনে বসে তা খেতাম।

উড়ন্ত চিলের পতনঃ
সে সময়ে আমাদের বাসায় বেশ একটা খোলা প্রাঙ্গণ ছিল। সেখানে আব্বা মুরগি পালার জন্য একটা মাঝারি সাইজের ঘর বানিয়েছিলেন। সেই ঘরে অনেক মোরগ-মুরগি থাকতো এবং মুরগিগুলো পালা করে ডিম পাড়তো বলে আমাদের ঘরে সব সময় অনেক ডিম মজুদ থাকতো। একটার পর একটা মুরগি বাচ্চা ফোটাতো। একদিন বিকেলে একটা চিল হঠাৎ কোথা থেকে যেন উড়ে এসে ছোঁ মেরে মুরগির একটি বাচ্চা নিয়ে উড়ে যায়। সেই বাচ্চাটির জন্য আমার ভীষণ মায়া হচ্ছিল। বাচ্চাটি বেশ একটু বড়সড়ই ছিল। সাধারণতঃ এত বড় বাচ্চাকে কাক চিল নিয়ে যেতে পারে না। আমি তখন বিকেলে বাগানে পানি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম, ঘাতক চিলটি বাগানের উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। একটু পরেই সেটা ধপাস করে পড়ে গেল। তার জন্য খাদ্যবস্তুটি একটু বেশিই বড় হয়ে গিয়েছিল। ফলে গলায় আটকে চিলটি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা পড়ে। সেই প্রথম একটি চিলকে হাতে ধরে দেখেছিলাম। তার দেহ তখনও গরম ছিল।

টাইফয়েডঃ
চট্টগ্রামে থাকাকালীন আমি একবার মারাত্মক টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়েছিলাম। তখনকার দিনে আমাদের কারও জ্বর হলে আব্বা আম্মার প্রথম কাজ হতো ভাত বন্ধ করে দেয়া। ভাতের বদলে আটার রুটি কিংবা পাউরুটি খেতে দিত। আর সাথে চলতো ‘রবিন্সন্স বার্লী’। বার্লী মোটেই খেতে ইচ্ছে হতো না, তাই আম্মা মাঝে মাঝে নিজেদের গাছের কাগজি লেবুর রস মিশ্রিত করে দিতেন। তখন খেতে ভালো লাগতো। আরেকটা অখাদ্য খেতে হতো, সেটা হচ্ছে দুধে মেশানো সাগুদানা। এই সবগুলো নিয়মই তখন ঘরে ঘরে প্রচলিত ছিল। সেবারে টাইফয়েড আমাকে অনেক ভুগিয়েছিল। একটানা তিন সপ্তাহ জ্বর ছাড়েনি, ফলে আমাকে ভাতও খেতে দেয় নি। পরে ডাক্তারের পরামর্শে আম্মা নিজ হাতে বানানো চিকেন স্যুপ খেতে দিতেন। ঘরে পোষা বাচ্চা মুরগি জবাই করে সে স্যুপ বানানো হতো। প্রথম প্রথম সেটা খেতে খুব ভালো লাগতো, পরে তাতেও অরুচি এসেছিল।

নাকের ভেতর ন্যাপথিলিন বলঃ
একদিন দুপুরে আম্মা শাড়ি গোছাচ্ছিলেন। শাড়ির ভাঁজ থেকে একটা ন্যাপথিলিন বল মাটিতে পড়ে গেলে আমি সেটা আম্মার অলক্ষ্যে কুড়িয়ে নেই। ন্যাপথিলিনের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগতো। আমি একটু দূরে গিয়ে সেটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকতে থাকি। এক অসতর্ক মুহূর্তে সেটা নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে। আমি সেটাকে যতই বের করার চেষ্টা করতে থাকি, ততই সেটা ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। একসময় অস্বস্তি লাগা শুরু হলো। উপায়ন্তর না দেখে আম্মার কাছে দৌড়ে গেলাম। প্রথমে বকা ঝকা, পরে কান্নাকাটি শুরু হলো। এক অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস করতে শুরু করলো। অবশেষে অনতিবিলম্বে ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর শেষরক্ষা হয়েছিল।

জন্মদিনের কেকঃ
আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার ছিলাম, এখনকার মত উৎসব করে জন্মদিন কখনোই পালন করতাম না। তবে আম্মা ঠিকই মনে রাখতেন, কোনদিন কার জন্মদিন। যেদিন যার জন্মদিন, সেদিন মূলতঃ তার জন্য আম্মা একটা কেক বানাতে চেষ্টা করতেন, যদিও সেটা সবসময় সম্ভব হতো না। তবে সেই কেকটা এখনকার কেকের মত ছিল না। ডিম (ঘরের মুরগি’র) ফেটে এবং ময়দা মিশিয়ে একটা টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিতে বসিয়ে কয়লা বা কাঠের আগুনের তাপে আম্মা সেটা বানাতেন। যখন বানাতেন, তখন সাড়া ঘরে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তো আর আমি কিছুক্ষণ পর পর এসে দেখে যেতাম। আমাদের মুখে সেটাই অমৃতের মত লাগতো। যার জন্মদিনে এ সামান্য আয়োজনটুকু হতো, সেও খুব খুশি হতো, অন্যরাও।

মোয়াজ্জেম ভাই এর স্প্রিন্টঃ
আমাদের বড় ভাই এর একজন বন্ধু ছিলেন, তার নাম ছিল মোয়াজ্জেম হোসেন ভূঞা। ওনারা কিশোরগঞ্জের লোক ছিলেন। ওনাদের স্কুলে একবার বাৎসরিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে মোয়াজ্জেম ভাই ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নিয়েছিলেন। ঝড়ের বেগে দৌড়ে কোঁকড়া চুলের মোয়াজ্জেম ভাই প্রথম পুরস্কারটি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। তার সেই দৌড়ের দৃশ্যটি এখনও চোখে ভাসে। পরবর্তীতে পড়াশুনা শেষ করার পর মোয়াজ্জেম ভাই ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় চাকুরি লাভ করে সেখানে চলে যান। বড়ভাইয়ের সাথে তিনি নিয়মিত পত্র যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তিনি চিঠিগুলো ইংরেজীতে লিখতেন। লেখার স্টাইল এবং ভাষা বেশ উন্নত ছিল। মাঝে মাঝে বড়ভাই শুধু আমাকে ইংরেজী শেখানোর উদ্দেশ্যে তার চিঠিগুলো পড়তে দিতেন। আমি তখন উচ্চশ্রেণীর স্কুল ছাত্র। তার চিঠিগুলো পড়ে তার প্রতি আমার বেশ সমীহ জাগতো। ২০০০ সালে আমি নিজে যখন চাকুরিরত অবস্থায় সিলেটে বদলি হ’লাম, তখন বড়ভাইয়ের থেকে সামান্য কিছু ক্লু নিয়ে মোয়াজ্জেম ভাইকে খুঁজে বের করি। তিনি আমার পরিচয় পেয়ে অভিভূত হন এবং আমাকে অনুরোধ করেন, বড়ভাই এবং আম্মাকে যেন ঢাকা থেকে নিয়ে এসে তার বাসায় একদিন দাওয়াত খেতে যাই। আমি তার সে অনুরোধ রক্ষা করেছিলাম এবং এতদিন পর এমন একটি চমৎকার মিলনমেলার আয়োজন করার জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলাম। পরে একদিন ওনারাও নিমন্ত্রণে আমার বাসায় এসেছিলেন। আজ বড়ভাই এবং আম্মা, উভয়েই প্রয়াত। আমি সিলেট থেকে চলে আসার এবং একই সাথে মোয়াজ্জেম ভাই অবসরে যাওয়ার পর তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জানিনা, আজ তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন।

ঘোড়ার গাড়ি টমটমঃ
আব্বার বদলিজনিত কারণে আমরা ১৯৬১ সালে ঢাকায় চলে আসি। কোন এক রাতে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি পরেরদিন পূর্বাহ্নে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে এসে থামলো। মালপত্রসমেত নেমে আমরা কিছুক্ষণ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইলাম। আব্বা বাইরে গেলেন রিক্সা ডাকার জন্য। খানিক বাদে তিনি ফিরে এলেন। একজন কুলি তার মাথায় আমাদের কিছু ভারী মালামাল তুলে নিল। বাকিগুলো আমরা হাতে হাতে নিয়ে কুলির পিছু পিছু বাইরে এসে দেখি একটি ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কুলি সেখানেই এক এক করে মালপত্র উঠালো। জীবনে প্রথম ঘোড়ার গাড়ি 'টমটম' এ ওঠার আনন্দে আমি এবং আমার বড় বোন পুলকিত হ’লাম। ছোটবোন তখনও অবুঝ শিশু। গাড়ির গারোয়ান ছিল ঢাকাইয়া কুট্টি সম্প্রদায়ের। আব্বার সাথে যখন তিনি কথোপকথন করছিলেন, আমি তার কিছুই বুঝিনি। তবে সব কথার শেষে তার মুখে একটা বাঁকা হাসি ভেসে উঠতো, এটা আমার কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়েছিল। ঘোড়া টানা গাড়ি যখন ঘোড়ার মতই দুলকি চালে চলতে লাগলো, আমরা তা বেশ উপভোগ করতে থাকলাম। এক সময় আমি গাড়ির দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। গাড়ি থামার পর আব্বার কথায় ঘুম ভাংলো। দেখি, একটা কাঁচা রাস্তার পাশে গাড়িটা থামা। গারোয়ান ঘোড়া দুটোকে গাড়ি থেকে অবমুক্ত করে দিল। আমরা এক এক করে নেমে পড়লাম। আব্বা গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে দিলেন মাত্র কয়েকটি মুদ্রায় (কয়েন)। অর্থাৎ, ভাড়া সাব্যস্ত হয়েছিল এক টাকারও কিছু কমে। ভাড়া বুঝে পাবার পর গারোয়ান গাড়ি নিয়ে টক টক করে চলে গেল। আমরা তিন কক্ষ বিশিষ্ট একটা বড় ঘরে প্রবেশ করলাম, যার মেঝেটা পাকা হলেও ছাদ ছিল টিনের।

18, Republic Second Lane:
ঘরের প্রধান দরজার পাশে লাগানো কাঠের একটা ছোট্ট বোর্ড সাঁটা ছিল, সেখানে লেখা ছিল “18, Republic Second Lane”। অনুসন্ধিৎসু মন জানতে চেয়েছিল এটা সেকেন্ড লেন হলে ফার্স্ট লেন কোনটি। কিন্তু কাউকেও এ প্রশ্ন করার সাহস বা ফুরসৎ হয়নি বলে প্রশ্নটার উত্তর আজও অজানাই রয়ে গেছে। কমলাপুর রেলস্টেশন নির্মাণ কাজ তখনও শুরু হয়নি। কমলাপুর মোড় থেকে যে রাস্তাটি ‘পীর জঙ্গীশাহ মাজার’ এর মোড় পর্যন্ত চলে গেছে, সে রাস্তাটি তখনও পাকা ছিল। ঐ রাস্তাটির ঠিক মধ্যবর্তী স্থান থেকে মাত্র ২০/২৫ গজ পূর্বে ছিল আমাদের বাসাটা। অনুমান করি, কমলাপুর স্টেশনের এখন যেখানে পার্সেল অফিস, তারই কাছাকাছি কোন জায়গায় ছিল আমাদের সেই বাসাটা। আমাদের বাসা থেকে পাকা রাস্তাটির সাথে সংযোগ সড়কটি ছিল কাঁচা, মেঠো পথ। পাকা রাস্তাটির পূর্ব পাশ জুড়ে ছিল কয়েকটি বাড়ি। একটি বাড়ির নাম ছিল “ইলি-দিদার হাউস”। সেই বাড়িটার সাথেই একটা গম/ডাল ইত্যাদি ভাঙানোর কল ছিল। সেখান থেকে আমরা সিভিল রেশনের গম ভাঙিয়ে আটা করে নিতাম।

রমজানের স্মৃতিঃ
ঠিক কত বছর বয়সে রমজানের প্রথম রোযাটা রেখেছিলাম, তা আজ সঠিক মনে নেই। অনুমান করি, ৬/৭ বছর হবে। আরো আগে থেকেই এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিলাম, কিন্তু আম্মা রাখতে দেন নি। মনে আছে এখনকার মত বড় দিনেই প্রথম রোযাটা রেখেছিলাম। দুপুর পর্যন্ত ভালই ছিলাম, তার পর থেকে দিন আর কাটছিল না। ঘড়ি দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম থেকে উঠে দেখি ইফতারের সময় আসন্ন। সাথে সাথেই প্রসন্ন বোধ করতে শুরু করলাম, ক্লান্তি দূর হতে শুরু করলো। ছোলা, পিঁয়াজু, বেগুনী, সেমাই আর নানারকমের অন্যান্য সামগ্রী ভাজার সুগন্ধ নাকে আসছিল। এসব ছাড়াও আমাদের ইফতারে সব সময় একটা কমন মেন্যু ছিল কাঁচা ছোলা, সাথে কাটা আদা, মুড়ি আর লেবুর শরবত তো থাকতোই। মাঝে মাঝে কিছু কেনা জিনিসও আনা হতো। ইফতার সামগ্রী খাওয়ার চেয়ে পানি পান করে বেশী তৃপ্ত হয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। ইফতার টেবিল থেকে যখন উঠি, তখন ছোট পেটটা ফুলে ঢোলের মত হয়ে গিয়েছিল এবং ভরা পানিতে ঢক ঢক করছিলো।

ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বাসায় পুরো মাস ধরে রোযা রাখা হয়নি। প্রথম প্রথম একটা দুটো, আস্তে আস্তে সংখ্যাটা বাড়ছিলো। এখন যেমন প্রায় সব পরিবারেই বাসার ছোট বড় সবাই রোযা রাখে, আমাদের সময় আমাদের পরিবারে নিয়মটা অন্ততঃ দশ বার বছর পর্যন্ত এতটা কড়াকড়ি ছিলনা। ক্যাডেট কলেজে গিয়েই প্রথম নিয়মিতভাবে প্রতিদিন রোযা রাখা শুরু করি। প্রায় পনের রোযা পর্যন্ত কলেজে থাকতাম, তাই বাসায় এসে স্বাভাবিকভাবেই বাকীগুলো সব পুরো করতাম। ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার কয়েক বছর পর রমজান মাস আসতো শীতের সময়। এমনি সেখানে প্রাকৃতিকভাবে গ্রামীন পরিবেশ ছিল, তাই খোলামেলা জায়গায় শীতটাও বেশ জাঁকিয়ে আসতো। সেহরীর সময় আমরা ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য গায়ে পুল ওভারের উপর দিয়ে কম্বল পেঁচিয়ে এক দৌড়ে ডাইনিং হলে যেতাম। কিছু খাওয়ার রুচি হতো না, তবে দুপুরে লাঞ্চের ব্যবস্থা থাকবে না, প্রথম প্রথম একথা ভেবেই জোর করে কিছুটা খেতাম। আরেকটু বড় হয়ে অবশ্য ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি শ্রদ্ধার কারণেই চেষ্টা করতাম যতটুকু পারা যায়, রোযার হুকুম আহকামগুলো পরিপূর্ণভাবে পালন করতে।

ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় আমাদের এক চাচা থাকতেন, হারিছ চাচা। রক্তের সম্পর্কীয় কেউ নন, আব্বার বন্ধু এবং অফিস কলীগ। আমার জন্মের সময় চট্টগ্রামের আগ্রাবাদেও আমরা পাশাপাশি বাসায় থাকতাম। ওদের আর আমাদের পরিবারের মাঝে প্রায় সমবয়সী ভাইবোন থাকাতে অভিভাবক লেভেলে এবং সিবলিং লেভেলে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। পরে অবশ্য বৈবাহিকসূত্রে আমরা আত্মীয়তেও পরিণত হই। আব্বা এবং হারিছ চাচা উভয়ে প্রায় একই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলী হয়ে আসেন, কিন্তু এবারে দুই পরিবারের দুই বাসার মাঝে বেশ দূরত্ব থেকে যায়। কিন্তু তা থাকলে কি হবে, সুযোগ পেলেই আমরা একে অপরের বাসায় বেড়াতে যেতাম। হারিছ চাচা খুবই ধর্মপরায়ন ব্যক্তি ছিলেন। রোযার মাসে উনি তার নিজের বাসায় একটা বড় রুম খালি করে তারাবীর নামায পড়ার ব্যবস্থা করতেন। একজন হাফেজ রেখে উনি এবং হাফেজ সাহেব মিলে তারাবীর নামায পড়াতেন। তখন পাড়ায় পাড়ায় এখনকার মত এতটা নৈকট্যে মাসজিদ ছিল না। রোযার মাস এলেই আমার কানে ভাসে হারিছ চাচার সুললিত কন্ঠে ক্বোরআন তিলাওয়াতের সুর- “কুলিল্লাহুম্মা মালিকাল মুলকি তু’তিল মুলকা.....” এটা ওনার খুব প্রিয় আয়াত ছিল। আমি রোযার মাসে কখনো ওনাদের বাসায় বেড়াতে গেলে অন্ততঃ দু’চারদিন না থেকে আসতে পারতাম না। চাচা পড়াশুনায় ভাল ছাত্রদের খুব স্নেহ করতেন। শৈশব এবং কৈশোরে আমার পড়াশুনার রেজাল্ট সমবয়সী ওনার সন্তানদের তুলনায় ভাল থাকাতে ওদের তুলনায় আমি চাচার কাছ থেকে স্নেহ আদর একটু বেশীই পেতাম। তা’ছাড়া আমার প্রায় সমবয়সী, অর্থাৎ আমার চেয়ে দু’বছরের বড় থেকে দু’বছরের ছোট ওনার চার ছেলে ছিল, যাদের সঙ্গ সান্নিধ্য আমি উপভোগ করতাম, আমাদের মাঝে খেলাধূলোও বেশ জমে উঠতো। মনে পড়ে, সেহেরী খাবার পর চাচা মুখে মুখে কয়েকবার আওড়িয়ে আমাকে রোযার নিয়্যাৎ শিখিয়েছিলেন, যা সেই থেকে আজও আমার মুখস্থ আছে। এখনও আমি সেহেরীর পর রোযার নিয়্যাৎ পড়ার সময় হারিছ চাচাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

সে সময়ের কেনা ইফতার আমার খুব ভাল লাগতো। বিশেষ করে পেঁয়াজু আর বেগুনী। পেঁয়াজু সত্যিকার অর্থেই পেঁয়াজ দিয়ে বানানো হতো, এখনকার মত শুধু খেসারীর ডাল দিয়ে নয়। ছোলাভাজারও একটা আলাদা স্বাদ ছিল। একটা বিশেষ দিনের কেনা ইফতারের স্বাদ এখনও জিহ্বায় লেগে আছে। তখন রোযাটা পড়েছিল শীতকালে। আমরা স্কুল ছুটির পর দাদাবাড়ী-নানাবাড়ী ঈদ করতে যাচ্ছিলাম, রোযার মাসেই। যমুনা নদী রেলের স্টীমারে পার হয়ে ঠিক ইফতারের সময় কানেক্টিং ট্রেনযোগে বোনারপাড়া রেলওয়ে জংশনে পৌঁছলাম। সেখানে ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় লাগে। তাই কুড়ি মিনিটের মত সময় পাওয়া যায়। আব্বা প্লাটফর্মে নেমে রেলের রিফ্রেশমেন্ট রুম থেকে আমাদের সবার জন্য ইফতার সামগ্রী কিনে আনলেন। খুবই মজার এবং সুস্বাদু ছিল সেই ইফতার। তবে আরেকটা কারণে সেই সন্ধ্যাটা স্মরণীয় হয়ে আছে। ইফতারের পর আম্মা চা খেতে চাইলেন। ট্রেনের জানালার পাশে হাঁক দেয়া এক চা ওয়ালার কাছ থেকে এক কাপ চা কিনে আম্মাকে দেয়া হলো। আম্মার কোলে তখন আমাদের চতুর্থ ছোট ভাইটা, ওর বয়স তখন দেড় দু’ বছর হবে। আম্মা গরম চা খাবেন, চা ছলকে ওর গায়ে পড়তে পারে ভেবে উনি কিছুক্ষণের জন্য ওকে আমার বড় বোনের কাছে দিলেন। এদিকে আম্মার চা খাওয়া শেষ হবার আগেই, রেলের ইঞ্জিনটা প্রান্ত বদল করে সজোরে আঘাত করে বগির সাথে জোড়া লাগলো। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে আপির কোল থেকে ছোটভাইটা ট্রেনের ফ্লোরে পড়ে গেল, তবে কোল থেকে পা গড়িয়ে নীচে পড়েছিল বিধায় আঘাতটা ততটা গুরুতর হয়নি। সামান্য কিছুক্ষণ কান্না করার পর সবার সম্মিলিত আদরে ভাইটা কান্না থামিয়ে মুখে এক টুকরো হাসির ঝলক এনেছিল। সেই সাথে সবার উদ্বিগ্ন মুখেও হাসির প্রশান্ত রেখা ফুটে উঠেছিলো।

ময়মনসিংহের স্মৃতিঃ
কৈশোর পরবর্তী জীবনে বহুবার আমাকে বাড়ী যেতে হয়েছে ময়মনসিংহ জংশনের উপর দিয়ে। রাতের ৭ আপ "নর্থ বেঙ্গল মেইল" যোগেই বেশী যাওয়া পড়তো। ট্রেন কমলাপুর ছেড়ে আসার পর জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখতে দেখতে টঙ্গী পৌঁছানোর আগেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম ভাংতো আবার সেই ফেরীওয়ালাদের হাঁক ডাকেই। বুঝতে পারতাম, ময়মনসিংহে এসে গেছি। তখন ট্রেনটা ময়মনসিংহে পৌঁছতো রাত প্রায় দু’টোয়। কান খাড়া রাখতাম ফ্যাসফ্যাসে গলায় এক চা ওয়ালার ডাক শোনার জন্য। বহু বছর ধরে আমি তার "গরম চা... চা গরম" ডাক অবধারিতভাবে শুনতে পেতাম। চোখ রগড়াতে রগড়াতে এক কাপ গরম চা খেয়ে রাতের ব্যস্ত ময়মনসিংহ স্টেশনের নানা খুঁটিনাটি বিষয় লক্ষ্য করতাম। সেখানে ঢাকা থেকে আসা আমাদের ট্রেনটা দু'ভাগে ভাগ হয়ে যেত। এক ভাগ যেত বাহাদুরাবাদ ঘাটে, আরেক ভাগ জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে। বাহাদুরাবাদ ঘাটের ওপাড়ে ছিল তিস্তামুখ ঘাট (বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর আর বগুড়া জেলার যাত্রীদের জন্য), আর জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের ওপাড়ে ছিল সিরাজগঞ্জ ঘাট (বৃহত্তর পাবনা ও রাজশাহী জেলার যাত্রীদের জন্য)।

একবার আমরা তিন বন্ধু মিলে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি'র ফরম সংগ্রহের জন্য। এদের মধ্যে একজন প্রয়াত মেরিন ইঞ্জিনীয়ার আলী মুনীর রানা, আরেকজন শরীফ হাছান, আজকের প্রখ্যাত প্লাস্টিক সার্জন। আমার বায়োলজী ছিলনা, তাই আমি মেডিক্যালে ভর্তির অযোগ্য ছিলাম। আমি গিয়েছিলাম কেবলই ফাও-নিজের আনন্দের জন্য আর বন্ধুদের সঙ্গ দেয়ার জন্য। ২/৩ দিন ছিলাম, ফিরে এসেছিলাম ০৫ই সেপ্টেম্বর তারিখ বিকেলে। তারিখটা মনে আছে কারণ, যখন ফিরে আসি, তখন ময়মনসিংহ রেল স্টেশনের এক চায়ের দোকানে উচ্চস্বরে এক রেডিও বাজছিল। সেই রেডিওর খবরেই শুনেছিলাম যে প্রখ্যাত পল্লীগীতি শিল্পী আব্দুল আলীম সেদিন সকালে মারা গিয়েছিলেন। সে সময় এক বিকেলে ব্রহ্মপুত্রের তীর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শরিফ হাছান আমাকে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য "শ্যামা" থেকে অনেকটা অংশ মুখস্ত শুনিয়েছিল। ওর এই ভিন্নমুখী প্রতিভার পরিচয় পেয়ে আমি সেদিন ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। সন্ধ্যার আযান পড়াতে পুরোটা শুনতে পারিনি, তাড়াতাড়ি করে ঘরে ফিরে আসতে হয়েছিল (ঘর মানে ঐ দু'জনের এক জনের চাচার বাসায়, কার সেটা মনে নেই, চরপাড়ার যে বাসায় আমরা তিনদিনের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম, সে বাসায়)।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকমাস কাটিয়েছিলাম। কৃষি প্রকৌশল বিভাগের ডাকসাইটে ডীন মজিবর রহমান বিশ্বাস স্যারের কথা মনে পড়ে। এরতাজুল ইসলাম স্যার রসায়ন পড়াতেন। খুবই ভদ্র, অমায়িক এবং নরম মনের পন্ডিত মানুষ ছিলেন তিনি। আমরা উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে তার লেখা রসায়ন বই পড়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ফাহমিদা খাতুন তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিদ্যা পড়াতেন। উনি ভাল পড়াতেন, তবে ঠিকভাবে ক্লাস সামলাতে পারতেন না। তাঁর প্রথম ক্লাসেই যশোর কুষ্টিয়া অঞ্চল থেকে আগত এক শ্মশ্রুমন্ডিত ছাত্র তাঁর প্রতি ক্রাশ খেয়ে হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল। তিনি এতে একটু অস্বস্তি বোধ করে তাকে তার হাঁ করা মুখটা বন্ধ করতে বলেছিলেন। ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল। পরে সে সহজ সরল ছাত্রটি আমাদেরকে জানিয়েছিল, তিনি ক্লাসে এলে সে তাঁর থেকে চোখ ফিরাতে পারতোনা। এছাড়া ছিলেন স্ট্যাটিস্টিক্সের খোদা দাদ খান স্যার, ওনার লেখা বইও আমরা উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়ন করেছিলাম। কৃষি অর্থনীতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র বকুল মামা ছিলেন শরীফ হাছানের আপন মামা, সেই অর্থে আমারও মামা। তিনি ভাল হকি খেলতেন, আমাকে একদিন খেলতে ডেকে নিয়ে গেলেন। খেলা দেখে বলেছিলেন রেগুলার বিকেলে তার সাথে মাঠে নামতে। বিকেল বেলা খেলাধুলা শেষে নিকটবর্তী ব্রহ্মপুত্রের চরে নানা জাতের রংবেরং এর পাখি দেখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যাওয়া সুতিয়াখালী রোডের মোড়ে একটা ভাল চায়ের দোকান ছিল। সেই দোকানের মালাই (ঘন দুধের সর) এখনো মুখে লেগে আছে। রাতের বেলা বিছানার পাশের জানালা দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলা ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দ্রুত অপসৃয়মান খোপ খোপ জানালার আলো দেখতে খুব ভাল লাগতো। ভেতরের যাত্রীদের কথা ভাবতাম। একবার এক শীতের রাতে যাত্রাগানের আয়োজন করা হয়েছিল। যাত্রায় তেমন আকৃষ্ট না হলেও, বন্ধুদের সাহচর্য আর গল্পগুজব উপভোগ করার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। ময়মনসিংহে একবার “সুজন সখী” সিনেমার শুটিং হয়েছিল। সে উপলক্ষে নায়ক ফারুক আর নায়িকা কবরী সেখানে এসেছিলেন। শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ থেকে নায়িকা কবরীর ঝাঁপ দিয়ে নীচে পড়ার একটা দৃশ্য ছিল। খুব সম্ভবত একজন স্থানীয় ‘ডামী’ সে দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন। এ ছাড়াও ফারুক কবরী ব্রহ্মপুত্র নদে গান গেয়ে নৌকো বেয়েছিলেন বলে মনে পড়ে। সেসব এখন শুধুই স্মৃতি! স্মৃতিচারণ সতত সুখময়!

ত্রিশ বছর পর পুনরায় ময়মনসিংহেঃ
চাকুরী জীবনে এই একুশ শতকের প্রথম দিকে আবার ময়মনসিংহে তিন বছর কাটিয়েছি। আমার অফিসটা তখন ছিল ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে। যাওয়া আসার পথে বহুদিন গাড়ী থেকে নেমে যেতাম, উদ্দেশ্যহীনভাবে নদীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে জেগে ওঠা চরে কাশফুল আর নানারকমের পাখপাখালি দেখার জন্য। ময়মনসিংহের কৃষ্ণা কেবিন আমার একটা প্রিয় জায়গা ছিল। অন্যান্য জায়গার চেয়ে ময়মনসিংহে মিষ্টি বেশ সস্তা ছিল, সুস্বাদুও ছিল। মুক্তাগাছার মন্ডা বহুযুগ ধরে প্রসিদ্ধ ছিল, কিন্তু আমাকে সেটা সেভাবে টানেনি। তবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুক্তাগাছার রাজবাড়ীতে আতিথ্যে থাকাকালীন মুক্তাগাছার মন্ডা খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন, সেকথা ঐ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিকের বংশধরেরা আজও বেশ গর্ব ভরে বলে থাকে। ময়মনসিংহের গাঙ্গিনার পাড়ের একটা চায়ের দোকানের কথাও বেশ মনে পড়ে। সেখানকার গরম সিঙাড়া খুব উপাদেয় ছিল। মুক্তাগাছা রোডে খুবসম্ভবতঃ খাগডহর নামক একটা জায়গার একটা বড় মাসজিদে প্রায় নিয়মিতভাবে জুম্মার নামায পড়তে যেতাম, নয়তো কখনো কখনো কাঁচিঝুলি'র ঈদগাহ মাসজিদে।

বাবুরাম সাপুড়েঃ
সময়টা ছিল ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর আমরা সপরিবারে ট্রেনে করে দেশের বাড়ী যাচ্ছিলাম। ট্রেনের নাম “দ্রুতযান এক্সপ্রেস”, ঢাকা থেকে সকাল আটটায় ছাড়তো। আব্বা আম্মাসহ আমরা পাঁচ ভাইবোন যাচ্ছিলাম। ভাই বোনদের মধ্যে সবার বড় ছিল আমার বড় বোন, আমি ছিলাম দ্বিতীয়। আনুমানিক দুপুর দু’টার দিকে ট্রেনটা জামালপুরের ইসলামপুরে পৌঁছেছিল। আমরা জানালা দিয়ে দেখছিলাম, ট্রেন থেকে নেমে অনেক মানুষ বিস্তীর্ণ মেঠো পথ ধরে নিজ নিজ গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। সদ্য লাঙল-কর্ষিত জমিগুলোতে তখনও বড় বড় মাটির ঢেলা ছিল, কৃষকেরা একটি বিশেষ ছন্দে কাঠের দুরমুশ দিয়ে একবার ডান থেকে বামে, আরেকবার বাম থেকে ডানে হাত চালিয়ে ঢেলাগুলো ভাঙছিলো। একটা সরু আ’ল ধরে মাথায় গামছা পেঁচানো একজন কৃষক ঘাড়ে একটা বংশদন্ডের দু’প্রান্তে দুটো ডালাতে করে (সেই জিনিসটার নাম ভুলে গেছি, আমাদের এলাকার স্থানীয় ভাষায় ভার-বাঁকুয়া বলে) তার গৃহস্থালী সম্ভার (যেমন হাটে বিক্রয় করার সামগ্রী) বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমার ছোট বোনটা তখন কেবল ছড়ার বই পড়া শুরু করেছে। তার ছড়ার বই এ ঠিক ঐ ধরণের একটা মানুষের ছবি দিয়ে তার নীচে ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ কবিতাটি লেখা ছিল। সে ঐ লোকটার দিকে তাকিয়ে আঙল তুলে বলে উঠলো, “ঐ যে, বাবুরাম সাপুড়ে যাচ্ছে”!

গুণ টানা নৌকোঃ
আমাদের ট্রেনের লাইনের শেষ প্রান্তে ছিল বাহাদুরাবাদ ঘাট। সেখানে নেমে স্টীমারে উঠতে হতো, ঘন্টা তিনেক স্টীমার জার্নি করে অপরপ্রান্তে তিস্তামুখ ঘাটে পুনরায় ট্রেনে উঠতে হতো। বেশীরভাগ সময়ে স্টীমারে থাকতে থাকতেই সূর্য অস্ত যেত। শীতকালে নদীতে অনেক চর ভেসে উঠতো। পানির গভীরতা বুঝে কখনো মাঝ নদী দিয়ে আবার কখনো নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে চালক মাস্টার স্টীমারটিকে চালিয়ে নিয়ে যেত। সেদিন লেইট লাঞ্চ করে আমি আর আমার বড় বোন সামনের খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা “আমি যা দেখি তুমি কি তা দেখো?” খেলছিলাম। স্টীমারটি তখন দ্বিতীয় পন্থায়, অর্থাৎ নদীর প্রায় তীর ঘেঁষে চলছিল। হঠাৎ দেখি, সেই তীরের উপর দিয়ে দু’জন লোক একটি মাল বোঝাই নৌকোকে গুণ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তাদের পেছনে পেছনে অন্য কয়েকজন লোক খালি হাতে হেঁটে যাচ্ছিল, সম্ভবতঃ একই গন্তব্যে। অনেকক্ষণ ধরে আমরা প্রায় একই লয়ে চলছিলাম, কালক্রমে যন্ত্রের কাছে পেশীর পরাজয় হয়, আমরা তাদের ছেড়ে অনেকদূর এগিয়ে যাই। সেদিনের আসন্ন সন্ধ্যায়, অস্তগামী সূর্যের ম্লান আলোতে আমাদের স্টীমারের সমান্তরালে সেই লোকগুলোর ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলার দৃশ্যটি আমার মনে আজও গেঁথে আছে।

এক অভিশপ্ত মানসিক রোগী'র স্মৃতিঃ
যারা কোন কারণে মনোবৈকল্যের শিকার হন, তাদের প্রতি আমি সহজাতভাবে সমব্যথী এবং তাদের ব্যাপারে কৌতুহলী। তাদের মনের এহেন আকস্মিক ভারসাম্যহীনতার কারণ জানতে ইচ্ছে হয়। সেই লালিত কৌতুহল থেকেই পাবনা মানসিক হাসপাতাল পরিদর্শনের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। স্থানীয় এক প্রভাবশালী বন্ধুর সহায়তায় সে ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল। সেখানে বিভিন্ন প্রকারের মানসিক রোগী দেখেছিলাম; কেউ সরব, কেউ নীরব, কাউকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, কেউ বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে একটি বিন্দুর দিকে তাকিয়ে আছে, কেউ গলা ছেড়ে গান গাচ্ছে, কেউ ভাষণ দিচ্ছে, ইত্যাদি। এদের আচরণে এবং কার্যে ভিন্নতা থাকলেও, এদের মধ্যে একটা নিবিড় মিল রয়েছে- এদের সবার মনটা কোন কারণে পীড়িত হয়েছে। কারো মন ভেঙ্গেছে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, কারো বিশ্বাসভঙ্গের কারণে, কারো ভয়-ভীতিতে, কারো নানাবিধ নির্যাতনে। একটা ওয়ার্ডের সামনে এসে একটা পরিচিত গানের কলি শুনতে পেলামঃ “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ ....”। দেখলাম, বয়স ত্রিশের আশে পাশে এক মহিলা আনমনে গানটা গেয়ে গেয়ে পায়চারি করছেন।

আমাদের গাইড জানালেন, ঐ মহিলা সারাদিন ধরে শুধু ঐ গানটিই গেয়ে চলেন এবং গাইতে গাইতে কখনো কাঁদেন, কখনো হাসেন। দেখলাম ঠিকই, গান গাইতে গাইতে তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে তিনি বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছেন গানের এই অংশটি গাইতে গিয়েঃ
“ও যে আমায় ঘরের বাহির করে
পায়ে পায়ে পায়ে ধরে...
ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে
যায় রে কোন চুলায় রে...
আমার মন ভুলায় রে”।।
আমরা তাকে দেখছিলাম একটা গ্রিলের এপার থেকে, তিনি গাইছিলেন ওপারে। গান শেষ হলে তিনি গ্রিলের কাছে এসে আমাদেরকে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “ও আমারে ঘরের বাহিরে কেন আনলো স্যার”? আমরা কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে অন্য একটি ওয়ার্ডের দিকে অগ্রসর হ’লাম, কিন্তু আমি তার প্রশ্নটাকে ক্যারী করলাম।

একটা মানসিক হাসপাতালের কিংবা অন্য যে কোন হাসপাতালের ‘মানসিক রোগ’ বিভাগের ওয়ার্ডগুলোর দেয়ালে দেয়ালে অনেক দীর্ঘশ্বাস এসে আঘাত করে করে ফিরে যায়। সেখানে অনেক চাপাকান্না গুমরে মরে। চিকিৎসার পাশাপাশি এসব শিশুসম ‘মন ভোলানো’ (‘যাদের মন ভোলানো হয়েছে’, এমন অর্থে) রোগীরা মানবিক আচরণ এবং স্নেহ ভালবাসার পরশ পেলে অনেক সময় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান (উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘সাগরিকা’ ছায়াছবিটি’র কথা মনে পড়ছে)। আবার অনেকে চিরতরে বাকি জীবনটা বিচরণ করতে থাকেন নিত্য নিপীড়িত হয়ে এক প্রতিকূল জগতে- ব্যর্থতার গ্লানি, বিশ্বাসভঙ্গের শূন্যতা, প্রিয়জন হারানোর বেদনা অথবা ভয়ঙ্কর সব ভয়ভীতির প্রতিবিম্বকে সঙ্গী করে।

কাজলা দিদিঃ
ছোটবেলায় স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর আমরা প্রতিবছর নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি বেড়াতে যেতাম। রুটে প্রথমে নানাবাড়ি পড়তো, তারপরে দাদাবাড়ি। দুটোই ছিল দশ-বার কি.মি. এর মধ্যে। নানাবাড়ি ছিল লালমনিরহাট জেলার সদর উপজেলার হাড়িভাঙ্গা গ্রামে, দাদাবাড়ি একই জেলার আদিতমারি উপজেলায়। আমি তখন হয়তো বড়জোর পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সেবার একই সময়ে আমার মেজ খালাও নানাবাড়ি এসেছিলেন। আমার চেয়ে দেড় বছরের ছোট এক খালাতো ভাই ছিল, তার চেয়েও দেড় বছরের ছোট এক খালাতো বোন ছিল, যার নাম ছিল রানী। অর্থাৎ রানী আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট ছিল। ওরা ছাড়াও নানাবাড়িতে আমার ছোট খালাও এসেছিলেন, তার বড় ছেলেটাও আমার থেকে বছর তিনেকের ছোট ছিল । সেবারে আমরা খুব আনন্দে নানাবাড়িতে কাটিয়েছিলাম। সারাদিন ধরে নানা ধরনের খেলা খেলতাম, গাছের বড়ই পেড়ে খেতাম। পাখির বাসা খুঁজতাম, চড়ুইভাতি খেলতাম। একটা পেয়ারা গাছ ছিল যেটার ডালপালা এমনই সুবিন্যস্ত ছিল যাতে আমরা চার পাঁচজন সহজেই গাছে চড়ে একেকজন একেকটা ডালে বসতে পারতাম। আমরা ডালে বসে পেয়ারা চিবাতাম আর নানা রকমের গল্প করতাম। একদিন এ রকমের গল্প করার সময় নানার বাড়িতে আগন্তুক এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এই বানরেরা, তোরা সবাই গাছে বসে কী মীটিং করছিস”? গল্প ছাড়াও আমরা যে যার মত গলা ছেড়ে গানও গাইতাম, আবার কবিতাও আবৃত্তি করতাম। তখন 'কাজলা দিদি' কবিতাটা আমাদের সমবয়সী সবারই মুখস্থ ছিল। আমরা সুর করে কবিতাটি আওড়াতাম (‘আমরা’ আবৃত্তি করতাম বললে ভুল হবে, সেজন্যই ‘আওড়াতাম’ বললাম। আমাদের মধ্যে একমাত্র রানীই খুব সুন্দর করে আবৃত্তি করতো। বাকি আমরা যা করতাম, তা আবৃত্তি হতো না।)।

স্কুল খোলার সময় হয়ে যাওয়াতে আমাদের সুখের দিনগুলো খুব দ্রুত পার হয়ে গেল। আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম, রানীরা খালুর কর্মস্থল কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারিতে চলে গেল। এর কয়েকমাস পরে নানার চিঠিতে এক ভয়ানক দুঃসংবাদ পেলাম। তখন তো ঢাকা থেকে মফস্বল এলাকার সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি অথবা বড় জোর টেলিগ্রাম। চিঠিতে নানা জানিয়েছিলেন যে রানী হঠাৎ করে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আমরা যখন চিঠিটি পেয়েছিলাম, ততদিনে মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এই দুঃসংবাদটি আমার বালক মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। আজও মনে পড়ে সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম। বেশি করে কেঁদেছিলাম নানার চিঠির ঐ অংশটুকু পড়ে, যেখানে তিনি লিখেছিলেন যে মৃত্যুশয্যায় রানী কয়েকদিন ধরে অনবরত, এমনকি ঘুমের মধ্যেও 'কাজলা দিদি' কবিতাটি আওড়াতো। এমনিতেই 'কাজলা দিদি' একটা দুঃখের কবিতা। তার উপর মৃত্যুশয্যায় রানী'র অনবরত এ কবিতাটি আওড়ানোর তথ্যটা আমার অপরিণত মানসে শেলের মত বিঁধেছিল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমি আর কখনো এই কবিতাটি পাঠ সম্পূর্ণ করতে পারি নাই। জীবনের এ দীর্ঘ চলার পথে অনেক সময় অনেকবার অনেক জায়গায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কণ্ঠে সুর করে এ কবিতা পাঠের শব্দ শুনে আমি থমকে দাঁড়িয়ে শুনেছি, তারপর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আবার পথ চলা শুরু করেছি। কখনো হয়তো নীরবে দু'ফোঁটা চোখের জলও ফেলে এসেছি।

শব্দ সংখ্যাঃ ৪৫৬০






মন্তব্য ২০ টি রেটিং +১০/-০

মন্তব্য (২০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ১২:১৪

ডার্ক ম্যান বলেছেন: আপনার জন্মস্থান সিজিএস কলোনি পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে। বিশাল বিশাল অট্টালিকা হচ্ছে এবং সম্ভবত একটা সুইমিংপুলও হতে পারে।
জাম্বুরি মাঠ এখন উদ্যানে পরিণত হয়েছে।

০৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ১:২১

খায়রুল আহসান বলেছেন: বহুবছর যাবৎ চট্টগ্রাম যাওয়া হয় নাই। শেষ বোধহয় ওদিকে গিয়েছিলাম ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে। এর পরে গেলে উন্নয়ন(?) দেখে আসবো।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

২| ০৬ ই জুন, ২০২৩ ভোর ৪:০০

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন:
সময় নিয়ে পড়বো। স্মৃতিচারণ মুলক অনেক পোষ্ট। ধীরে ধীরে পড়বো।

০৬ ই জুন, ২০২৩ ভোর ৪:০৫

খায়রুল আহসান বলেছেন: আচ্ছা, ধন্যবাদ।

৩| ০৬ ই জুন, ২০২৩ ভোর ৬:৫২

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:



শৈশবের স্মৃতিমাখা বর্ণনাগুলি অপুর্ব হয়েছে ।
অপনার ঢাকা ও ময়মনসিংহের স্মৃতিময় স্থান ও বিষয় বস্তু সমুহের সাথে আমার কিছুটা পরিচয় আছে। ষাটের দশকে
ঢাকার যে এলাকায় আপনারা থাকতেন সে এলাকায় আমার বাল্যকালের অনেকটাই কেটেছে । তাই ফুলবাড়িয়া
স্টেশন , ঘোড়ার টানা টমটম , শাহজাহানপুরের মেঠোপথ সকলেই আমার জানা ।

ময়মনসিংহ যাতায়াতের জন্য রাতের 7 Up ভোড়ের 8 Down সকাল ও সন্ধার দ্রুতযান এক্সপ্রেসের কথা এখনো
স্মৃতিতে ভাস্কর হয়ে আছে । ময়মনসিংহ রেলজংসনে ট্রেন বদল করে কিশোরগঞ্জে নানার বাড়ী যাওয়ার পথে ষ্টেশনে ফেরিওয়ালার মাথায় করে কাচের বেড়া দেয়া মিষ্টির বাক্স মাথায় ও হাতে কেটলিতে করে এই চা মিষ্টি বলে বলে
ফেরিওয়ালার ডাকের অপেক্ষায় থাকতাম । সে মিষ্টি খেতেও ছিল অপুর্ব , নো ভেজাল দুধের ছানার খাটি ছোট ছোট
গোল্লা মিষ্টি ছিল সেগুলি।

মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মন্ডা কেন যে আপনাকে টানেনি সেটা একটা বিষ্ময়ের ব্যপার । আপনি হয়তবা মুক্তাগাছার নকল
মিষ্টির খপ্পরে পরে এর প্রতি টান হারিয়ে ফেলেছিলেন । সম্ভবত এই মিষ্টি তৈরীর ইতিহাসটি আপনার জানা । তবু
অন্য পাঠকদের অবগতির জন্য এই মিষ্টির একটু সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত বলে গেলাম এখানে ।
মুক্তাগাছার মন্ডার একটি ছবি

আজ হতে প্রায় ২০০ বছর বৃর্বে ১২৩১ বঙ্গাব্দে (১৮২৪ খ্রিঃ) রাম গোপাল পাল স্বপ্নে মিষ্টি তৈরির রেসিপি পান।রেসিপি
অনুযায়ী তিনি যে মিষ্টি তৈরী করেন তা স্বাদে গন্ধে ছিল অপুর্ব এক মিষ্টি । যা পরবর্তীতে বিশ্বব্যপী খ্যাতি অর্জন করে।
গোপন কৌশলে তৈরী বিশ্ব বিখ্যাত এই মিষ্টি তৈরি কারখানা ও ব্যবসা বর্তমানে গোপাল পাল পরিবারের পঞ্চম বংশধর
শ্লী রামেন্দ্রনাথ পাল ভ্রাতৃদ্বয় পরিচালনা করেন। এই মিষ্টি মুক্তাগাছা ছাড়া আর কোথাও তৈরী হয়না । স্বাদে গন্ধে মুল
মুক্তাগাছার মিষ্টির তুল্য না হওয়ায় অনেকে মুক্তাগাছার মন্ডা নকল করতে গিয়ে ফেল মেরেছেন ।

উল্লেখ্য ‘মণ্ডা তৈরির মূল রেসিপিটা তাদের পারিবারিক। গোপনীয় এই কৌশলটা শুধু তারাই জানেন। ফলে মণ্ডার
নামে এখানে-সেখানে যা বিক্রি হয়, তা কোনোভাবেই আসল না। ময়মনসিংহ, ঢাকাসহ দেশের কোথাও তাদের
কোনো শাখা, এজেন্ট, শোরুম, বিক্রয়কেন্দ্র বা বিক্রয় প্রতিনিধি নেই। আসল মণ্ডার স্বাদ পেতে হলে মুক্তাগাছায়
তাদের সেই দোকানেই যেতে হবে।

যাহোক , এই সুযোগে এই প্রসিদ্ধ মন্ডার ইতিহাসটা এখানে একটু যর্যালোচনা করে গেলাম।পরে সুযোগ পেলে
মুক্তাগাছার আসল মন্ডার স্বাদ চেখে দেখার জন্য মুক্তাগাছা ভ্রমন করে আসতে পারেন ।

বিশ্ব কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর এ মিষ্টি খেয়ে যে মুগ্ধ সেটা আপনি অবশ্য উল্লেখ করেছেন ।এছাড়াও উপমহাদেশের
প্রখ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ বরেন্য
ব্যাক্তিদেরকে মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতে আপ্যায়ন করা হয়েছে এই মণ্ডা দিয়ে। রাশিয়ার জোসেফ স্তালিনকে মণ্ডা
পাঠালে তিনি মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেন এবং পাকিস্তানের আইয়ুব খান একে “পূর্ব পাকিস্তানকা মেওয়া“ বলতেন।
মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মণ্ডার স্বাদে বিমুগ্ধ হয়ে তিনি চীনের মাও ৎসে-তুং এর
জন্যও নিয়ে গিয়েছিলেন এই মন্ডা । মাও ৎসে-তুং এর স্বাদের প্রশংসা করেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ভারতের
ততকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বৃটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকেও আপ্যায়ন করা হয়েছে এই মুক্তাগাছার
মণ্ডা দিয়ে।

উল্লেখ্য ব্রিটিশ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ২ বার বাংলাদেশ সফর করেছিলেন , এটা আবশ্য আপনারও জানা কথা ।
প্রথম বার বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে, ১৯৬১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি রাজকীয় সফরে ঢাকায় এসেছিলেন ।
সে সময় তিনি ঢাকার সুগন্ধা স্টেট গেস্ট হাউজে অবস্থান করার সময় তাকে পরিবেশন করা হয়েছিল মুক্তাগাছার
বিখ্যাত মন্ডা ।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। ১৯৮৩ সালে ৪ দিনের সরকারি সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন রানী। সে সময় তিনি বাংলাদেশের গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বৈরাগীরচালা গ্রাম দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে গ্রামীণ নারীদের অবস্থান
দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। মুক্তাগাছার মন্ডার কথা তার মনে ছিল । সেখানেও তাঁকে আপ্যায়নের জন্য রাখা ছিল
অন্যান্য খাবারের সাথে মুক্তাগাছার মন্ডা ।

বিশ্ব সেদিন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিল ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথের গ্রাম বাংলার নিভৃত পল্লীর মানুষের
মিছিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার অনন্য দৃশ্য।

সেদিন রানীর ভ্রমনকালীন সময়ে বৈরাগীর চালায় উপস্থিত থেকে ঐ মনোহর দৃশ্য অবলোকনের সৌভাগ্য আমার
হয়েছিল।

অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল ।
কানাডায় ভ্রমনকালীন দিনগুলি আনন্দে কাটুক সে কামনাও রইল ।

০৬ ই জুন, ২০২৩ সকাল ৮:৫৫

খায়রুল আহসান বলেছেন: আমার শৈশবের স্মৃতিকথা নিয়ে মন্তব্যের কারণে আপনারও শৈশবের স্মৃতিমাখা কিছু বর্ণনা উঠে এলো, তাই জানা হলো। ভালো লাগল। + +

মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মন্ডা'র ইতিবৃত্ত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এর দু'শ বছরের ইতিহাস ও প্রসিদ্ধি'র উপর ছবিসহ চমৎকার আলোকপাত করেছেন, এজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের আমাদের দেশে দুইবার আসার প্রসঙ্গটি সংক্ষিপ্ত হলেও দ্বিতীবারের সফরের সময় বৈরাগীর চালায় আপনার স্বশরীরে উপস্থিত থাকার কারণে আলোচনাটির বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেড়ে গেল।

৪| ০৬ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ১২:২৭

গেঁয়ো ভূত বলেছেন: ওয়াও! এত বর্নিল! এত সুন্দর! এত গভীর! এক কথায় চমৎকার স্মৃতিচারণ!!

০৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ৮:০৫

খায়রুল আহসান বলেছেন: এত বড় লেখাটা আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন, এ জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আর এত প্রশংসা! এর জন্য ধন্যবাদ জানানোর ভাষা অপ্রতুল।

৫| ০৬ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ১:২৪

আমি সাজিদ বলেছেন: আপনার খালাতো বোন রানীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর অংশটি পড়ে খুব ব্যথিত হলাম। পোস্টটির স্মৃতিকথাগুলো পড়ে চমৎকার যে অনুভূতি হলো, তা পরবর্তীতে এই পোস্টেই অন্য একটি মন্তব্যে প্রকাশ করার চেষ্টা থাকবে।

ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

০৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ৯:৪৭

খায়রুল আহসান বলেছেন: মন্তব্য এবং পাসের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। পুনঃমন্তব্য নিঃসন্দেহে একটি প্রতীক্ষীত এবং কাম্য বাসনা হয়ে রইলো।

৬| ০৬ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ১:৪৭

জটিল ভাই বলেছেন:
অপূর্ব স্মৃতিচারণ! জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও সাহসী পোস্ট। জটিলবাদ জানবেন অগ্রজ।

০৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ১১:২১

খায়রুল আহসান বলেছেন: মন্তব্য এবং পাসের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। প্রীত ও প্রাণিত।

৭| ০৬ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ২:১৬

রাজীব নুর বলেছেন: অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।

০৭ ই জুন, ২০২৩ রাত ৯:৫২

খায়রুল আহসান বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ।

৮| ০৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ১১:২৪

শেরজা তপন বলেছেন: পুরোটা পড়ার জন্য কালকে আসব ফের। আপনার লিখা এত অল্প সময় নিয়ে পড়া যাবে না।

০৮ ই জুন, ২০২৩ রাত ২:৪২

খায়রুল আহসান বলেছেন: আচ্ছা, ধন্যবাদ।

৯| ০৭ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ১:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্টে আবার এলাম। কে কি মন্তব্য করেছেন সেটা জানতে।

০৮ ই জুন, ২০২৩ সকাল ১০:৫৬

খায়রুল আহসান বলেছেন: তেমন বেশি কেউ মন্তব্য করেন নি। তিনজন পরে আবার আসবেন বলে জানিয়ে গেছেন। তবে তার পরেও আপনি পুনরাগমন করেছেন, এজন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

১০| ০৭ ই জুন, ২০২৩ বিকাল ৩:৫৫

পলক শাহরিয়ার বলেছেন: স্মৃতিকথা,পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ আমার খুব ভালোলাগার টপিক। পরে এসে আয়েশ করে পড়বো।
বেশ কদিন পরে ব্লগে এসেছি। প্রতিযোগিতা কতদিন চলবে?

০৯ ই জুন, ২০২৩ রাত ২:৪৭

খায়রুল আহসান বলেছেন: “প্রতিযোগিতা কতদিন চলবে?” - আমি যতদূর জানি, প্রতিযোগিতার জন্য লেখা জমা দেয়ার বর্ধিত সময়সীমা ছিল ০৬ জুন ২০২৩। এর পরে আবার তারিখ বর্ধন করা হয়েছে কিনা, তা আমি জানিনা।
আপনার পুনরাগমনের অপেক্ষায় থাকলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.