নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে \"আমার কবিতা নামে\" আমি ব্লগিং করি মূলত নিজের ভেতরে জেগে উঠা ব্যর্থতা গুলোকে ঢেকে রাখার জন্য । দুনীতিবাজ, হারামখোর ও ধর্ম ব্যবসায়িদের অপছন্দ করি ।

সাখাওয়াত হোসেন বাবন

আমার পরিচয় একজন ব্লগার, আমি সাহসী, আমি নির্ভীক, আমি আপোষহীন । যা বিশ্বাস করি তাই লিখি তাই বলি ।

সাখাওয়াত হোসেন বাবন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মায়াবিনী - ভোতিক গল্প

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:২৬



এক

দূর থেকে সব কিছু ভালো,আনন্দময় ও সুখের মনে হলেও ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায় সবই মরীচিকা, প্রহেলিকা। নিরবচ্ছিন্ন সুখে কিংবা শান্তি বলতে জগতে আসলে কিছুই নেই। যারা কথায় কথায় বলেন, আপনি ভাই বেশ আছেন,ভালো আছেন, ব্যাচেলর মানুষ, " বিয়ে থা করেন নাই। ছেলে পুলে নাই । সকাল, বিকাল স্ত্রী ঝামটা নাই । হাত, পা ঝাড়া স্বাধীন মানুষ । জীবনটা মাস্ত ইনজয় করছেন।" তাদের জন্য বলছি, "ব্যাচেলরদের লাইফ" দূর থেকে যতোটা সুখকর আনন্দদায়ক মনে হয় না কেন বাস্তবের চিত্র কিন্তু পুরোপুরি ভিন্ন। মাথার চিরুনি থেকে অন্তর্বাস,সবই নিজ হাতে পরিষ্কার করতে হয়। এক বেলা খেয়ে হাত ধুতে না ধুতেই পরেই পরের বেলা কি খাবেন সেটা ভেবে রাখতে হয় । বুয়ার হাতে খাবার খেয়ে খেয়ে অসুখ, বিসুখে পড়লে সেবা,শুশ্রুষা, যত্ন-আত্তি করার জন্য আশে পাশে কেউ থাকে না । জীবন যুদ্ধে ধুকে ধুকে টিকে থাকতে হয় । রান্না বান্না করতে গিয়ে হাত, পা,পুড়িয়ে ফেলা কিংবা কেটে ফেলা নতুন কোন বিষয় না । বিবাহিত পুরুষের অন্তরে মান অভিমানের দাগ থাকলেও ব্যাচেলর মানুষের দাগ থাকে হাতে পায়ে। একটু যে,আয়েশি জীবন যাপন করবেন সে উপায় নেই । সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলতে হয়, বিবাহিত মানুষেরা পৃথিবীতে থেকেই স্বর্গের সুখ ভোগ করছেন।

ব্যাচেলর জীবনে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় সেটা হচ্ছে, বাসা ভাড়া । বরশি'তে আটকা পড়া মাছের মতো বছর জুড়ে তা বুকের খচখচ করতে থাকে । ঢাকা শহরে এতো সুন্দর, সুন্দর, নয়নাভিরাম অট্টালিকা গড়ে উঠলেও ব্যাচেলদের জন্য সেখানে কোন স্থান নেই । মাঝে মাঝে এ কারণে নিজেকে জঙ্গলের প্রাণীর চেয়েও অধম বলে মনে হয়।

মোহাম্মদপুরের বসিলায় আন্ডার কন্সট্রাকশন দোতালা যে বাড়িতে দীর্ঘ তিন বছর যাবত মেস ভাড়া করে বসবাস করে আসছিলাম সেটা হুট করে ছেড়ে দেবার নোটিশে মাথায় যেন বাজ পরলো । আমার অফিস মতিঝিলে । বসিলা টু মতিঝিল যাতায়াতে একটু কষ্ট হলেও দিন শেষে বাসায় ফিরলে সেটা আর গায়ে লাগতো না । একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের হওয়ায় অন্য কারো সাথে রুম,শেয়ার করে থাকা আমার জন্য অসম্ভব এক ব্যাপার । এক বেলা কম খেতে রাজি আছি, কিন্তু দিন শেষে নিজের জন্য আলাদা বিছানা আর ওয়াশরুম আমার মতো মানুষের জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি । যে প্রাপ্তির জন্য দরিদ্র জীবনের সকল দু:খ কষ্ট মুহূর্তে সুখে বদলে যায় ।

বসিলার বাসাটিতে আমরা মোট চারজন দোতলার তিন রুমের একটা ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করে আসছিলাম । এক রুমে আমি । একটিতে বেতারে চাকরী করা জগলুল ভাই। অন্যটিতে সাদি ও রাফি নামে ঢাবি'র দুই ছাত্র । বেশ ভালই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো । কিন্তু হুট করে একদিন বাড়ির কেয়ারটেকার সানু মিয়া খুন হয়ে গেলেন । সাদা মাটা ভোলা, ভালা লোকটাকে কারা খুন করলো , কেন খুন করলো সেটা কেউ খুঁজে বের করতে পারলো না । লাশ পরে ছিলো তৃতীয় তলার ছাদে যাবার সিঁড়িতে । বাড়ির মূল গেট ১২টার পরে বন্ধ হয়ে যায় । সেদিনও বন্ধ ছিলো ।

অনেক খুঁজে পেতেও খুনের কোন মোটিভ পাওয়া গেলো না । খুনিরা থেকে গেলো ধরা ছোঁয়ার বাহিরে । থানা পুলিশ করে করে কয়েকটা দিনে যে, কি মহা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেলো, তা বলে ক'য়ে শেষ করা যাবে না । ৬ মাসের দৌড় ঝাপ শেষে যেখানকার পানি সেখানে রেখে পুলিশ অজ্ঞাত নামাদের নামে মামলা দিয়ে বিভিন্ন শর্ত যুক্ত মুছ লেখা নিয়ে আমাদের দায় মুক্তি দিলো । কথায় আছে, বাঘে ছুলে ষোল ঘা আর পুলিশে ছুলে নাকি আঠারো ঘা । কথাটার মর্ম হাড়ে হাড়ে টের পেলাম ।

পরিস্থিতি একটু অনুকূলে আসতেই বাড়িওয়ালা স্রেফ জানিয়ে দিলেন সবাইকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। তিনি আর মেস বাড়ি রাখবেন না । ফ্যামিলি দেখে ভাড়া দিবেন । না হয় বাড়ি খালি রাখবেন । তবুও ঝামেলায় যাবেন না । কর্তায় ইচ্ছেই যেখন কর্ম সেখানে আমাদের আর কিছু বলার থাকলো না ।

পুলিশের অনুমতি নিয়ে একে একে সবাই বাসা ছেড়ে দিলো । আমি অধমের অধম কোথাও কিছু খুঁজে না পেয়ে অগত্যা বাড়িওয়ালার ঘ্যানঘ্যান প্যান প্যান সহ্য করে আরো একটা মাস ফ্ল্যাট পরে রইলাম । তবে এখানে একটা কথা বলে রাখি , ভাড়াটিয়ারা কিন্তু শুধুমাত্র বাড়িওয়ালার চাপে বাড়ি ছাড়ে নাই । বাড়ি ছাড়ার পেছনে অন্য একটি কারণ আছে । আর সেই কারণটি হচ্ছে, ভুতের উপদ্রব । যদিও আমি ভূত-প্রেত এই সবে বিশ্বাস করি না । তবু সবার কথা শুনে শুনে বিচলিত না হয়ে পারলাম না ।

সানু মিয়ার মৃত্যুর পর তাকে বেশ কয়েক'বার গেটে এবং ছাদে বসে থাকতে দেখা গেছে । গভীর রাতে কারা যেন এসে দরজায় টোকা দেয় । দরজা খুলে কাউকে দেখা যায় না । যখন তখন বিকট শব্দ করে মেইন গেটের তালা খুলে যায় আবার বন্ধ হয় । এক রাতে মেইন গেটের তালা খোলার শব্দ আমিও পেয়েছি । বাড়ি ছাড়ার জন্য এরচেয়ে বেশি আর কিছু লাগে না । তবে, জগলুল ভাইয়ের ধারণা সব শয়তান বাড়িওয়ালার কাছে । বাড়ি খালি করাবার জন্যই নাকিই বাড়িওয়ালা এই শয়তানি ফন্দি এঁটেছিলেন । তবে আমি যে, একমাস অতিরিক্ত থেকেছি, তখন মাঝে মাঝে গভীর রাত্রিরে গেটের তালা খোলা আর বারান্দায় হাঁটার শব্দ ছাড়া কিছুই দেখিনি ।

অবশেষে অফিসের পিয়ন সুমন কমলাপুরের পেছনে একটা বাড়ির ঠিকানা যোগার করে এনে দিলো । তিন তলা বাড়ির ছাদের একটা কামড়া নাকি ভাড়া হবে। তবে সাথে এটাচ বাথরুম নেই । ছাদের আরেক প্রান্তে বাথ রুমের ব্যবস্থা । নাই মামার চেয়ে কানা মামা অনেক ভাল মনে করে একদিন একটু সময় করে বাসাটা দেখতে বের হয়ে গেলাম ।

 আমার অফিস থেকে হাটা দূরত্ব মিনিট পনেরো । ঠিকানা ধরে খুজে পেতে খুব একটা কষ্ট হলো না । সরু একটা গলির শেষ মাথায় বাড়িটির অবস্থান । আশে পাশে সব বড় বড় দোলান কোঠার ভিড়ে পুরাতন বাড়িটি যেন বড্ড বেমানান । বাড়ির চেহারা দেখে হতাশ হতে হলো ।
অন্ধকার ছন্ন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠেতে বুঝতে পারলাম, একতলার পুরোটা জুড়ে ছাপাখানা । দোতালার পুরোটা ছোট বড় খুপরির মতো রুমে নানান ধরনের অফিস । প্রতিটি দরজার সামনে অফিসের নাম সম্বলিত সাইনবোর্ড ঝুলছে । তৃতীয় তলার পুরোটা নিয়ে যে বাড়িওয়ালা থাকেন সেটা তৃতীয় তলার সিঁড়ির মুখে কলাপসিবল গেট বিশাল আকৃতির একটা তালা ঝুলছে দেখে বুঝতে পারলাম। 

অনেকক্ষণ ধরে তালা নাড়াবার পরেও কেউ তালা খুলতে এলো না । গেটের ওপাশে তৃতীয় তলায় সিঁড়ির সামনের দরজায় হালকা খয়েরি রং এর একটা পর্দা ঝুলতে দেখা যাচ্ছে । পর্দা যেভাবে বাতাসে একটু একটু করে দোল খাচ্ছে, সেটা দেখে বুঝা গেলো রুমের ভেতরে ফ্যান চলছে ।

আমি একটু জোড়েই কড়া নাড়তে শুরু করলাম । গুমট একটা ভেপসা গরম চেপে ধরেছে । অনেকটা পথে হেটে এসে সিঁড়ি বেয়ে উঠার ক্লেশে কপালে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে । বাড়ির চালচিত্র, পরিবেশ দেখে মনে হলো ফিরে যাই । কিন্তু পুরাতন বাড়িওয়ালার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে মনে হলো, এসেছি যখন তখন শেষটা দেখিই যাই । বলা তো যায় না পছন্দ হয়েও যেতে পারে । নতুন উদ্দীপনায় আরো কিছুক্ষণ কড়া নাড়াবার পর মধ্য বয়স্ক শাড়ি পরিহিত এক ভদ্র মহিলা পর্দা সরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উকি দিলেন । দেখে মনে হলো রান্না বান্না করছিলেন ।

আমি সালাম দিয়ে ,বললাম, "আমি সরফরাজ ,আমাকে সুমন পাঠিয়েছে ।" কোন অজানা এক কারণে বিরক্তিতে মহিলার কপাল কুচকে গেলো। বুঝতে পারলাম , সুমন, কে, উনি সেটা বুঝতে পারেন নাই । আমি আর একটু সহজ করে বললাম, "আমি আপনাদের ছাদের রুমটা ভাড়া নেবার জন্য এসেছি ।"

এবার মহিলার মুখের কুঞ্চিত রেখাগুলো পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেলো । এবং কিছু না বলেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন। আমি ঠায় দাড়িয়ে রইলাম । অপেক্ষার পালা সব সময় দীর্ঘ হয় । কিন্তু অচেনা অজানা পরিবেশে সে দীর্ঘতা যেনো কয়েকগুণ বেড়ে যায় । অবশেষে প্রতীক্ষার ক্ষণ শেষ হলো । আট,দশ বছরের রোগা পাতলা একটা ছেলে এসে তালা খুলে দিয়ে, "বলল মামা ছাদে আছেন । আপনি উপড়ে যান ।"

তিন তলার বারান্দা দিয়ে ছাদে যাবার সিঁড়ি । বারান্দায় দেয়ালে খাঁচায় একটি টিয়ে পাখি দেখতে পেলাম । আমাকে দেখেই পাখিটা টিটি করে ডেকে উঠলো । আমি খাঁচাটা আলতো করে নাড়া দিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম ।

ছাদে যাবার সিঁড়ির অবস্থা নিচের সিড়ির মতো ততোটা খারাপ না হলেও সিঁড়ির তাকগুলো খসে গিয়ে ভেংচি কাটছে । পাশের দেয়ালের ক্ষতগুলো চুনকাম করে ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে । ছাদে উঠে দেখি, লুঙ্গি পড়া উদোম শরীরে ছোটখাটো আকৃতির মধ্যবয়স্ক এক লোক কবুতর উড়াচ্ছেন । আমাকে উপড়ে উঠতে দেখে, তিনি ভ্র কুচকে তাকালেন । আমি সালাম দিয়ে বললাম, "আমার নাম সরফরাজ , রুম ভাড়ার জন্য এসেছি ।"

লোকটা আমার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আকাশে ঝাঁক বেধে উড়তে থাকা কবুতরের দিকে তাকিয়ে বা হাত দিয়ে সিঁড়ির সাথে লাগোয়া একটা রুম দেখিয়ে বলল, "ওই যে, ওটা ভাড়া হবে । তোমাকে কি সুমন পাঠিয়েছে ? আমি রুমটার দিকে তাকিয়ে, হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম । ভদ্রলোক আকাশে উড়ন্ত কবুতরের ঝাঁক থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, "দেখো পছন্দ হয় কিনা । একা মানুষের জন্য যথেষ্ট বড় । ঝুট ঝামেলা না থাকলে আইডি কার্ড আর দু'মাসের এডভান্স দিয়ে উঠে পরো । "

আমি চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিতে লাগলাম । পুরো ছাদটা কোমর পর্যন্ত দেয়াল দিয়ে ঘেরা । সিঁড়ির ঠিক উল্টো দিকে দেয়াল ঘেঁষে একটা মোটামুটি বড় সাইজের বাথরুম । সেটার টিনের দরজা খোলা থাকায় ভেতরের দেয়ালের সঙ্গে লাগানো কল দেখা যাচ্ছে । কলের নিচে একটা ছোট রং এর ডিব্বা রাখা ।
বাথরুমের ডানদিকে দেয়াল ঘেঁষে কবুতর বসার জন্য বাশের মাথায় একটা "বাম" দেয়ালের রডের সাথে বেধে রাখা হয়েছে । যারা কবুতর উড়ান তাদের বাড়িতে এ ধরনের ভাম দেখা যায় । বামে'র নিচের একটি কবুতরের খাঁচা । তাতে দু'টো পার্টিশন করা । খাঁচার ভেতরে কয়েকটা কবুতর ছোট ছোট মাটি খোঁড়ার উপর বসে ডিমে তা দিচ্ছে ।

রুমের বাম পাশের অনেক অংশ জুড়ে খালি জায়গা । রোদ পোহানোর জন্য আদর্শ জায়গা । সেখানে তিনতে খালি ফুলের টব উল্টো হয়ে পরে আছে । রুমটা দেখতে আহামরি কিছু না । ফ্ল্যাট বাড়ির ছেড়ে এসে এটা থাকার জন্য মোটেও আদর্শ নয় । কিন্তু কি করবো উপায় নেই । রুমের বাহিরটা প্লাস্টার করা । কিন্তু চুনকাম করা হয়নি । সামনে দিকে সিঁড়ির দিয়ে উঠতেই ডানপাশে একটা দরজার আর টিক মাঝ খানে একটা জানালা । জানালায় দাঁড়ালে পুরো ছাদটা নজরে চলে আসবে ।

ঘরের দরজাটা ভেজানো রয়েছে । আমি এগিয়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা খুলে ফেললাম । মোটামুটি আকৃতির একটা রুম । ভেতরে সদ্য চুনকাম করা হয়েছে । রং এর ঝাঁজালো একটা গন্ধ । মেঝেতে ফোটা ফোটা চুন পরে আছে । রুমের ভেতরে পেছনে মাঝ বরাবর একটা জানালা সেটা বন্ধ করে রাখা । আমি রুমের ভেতরে ঢুকে পেছনের জানালাটা খুলে দিলাম । সঙ্গে সঙ্গে কমলাপুর রেল স্টেশনের একটা অংশ চলে এলো চোখের সামনে । এভাবে কখনো কমলাপুরের ভেতরটা কখনো দেখা হয়নি ।

বাড়িটা একেবারে কমলাপুর স্টেশনের দেয়ার ঘেঁষে হওয়ায় রেল স্টেশনের ভেতরের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যায় । জানালা থেকে বা দিকে তাকালে মূল স্টেশন একটা অংশ দেখা যায় । আর সরাসরি তাকালে পরপর সাজানো তিনটি রেল লাইন দেখা যায় । অজগর সাপের মতো একে বেকে রেল স্টেশন থেকে বের হয়ে গেছে । জানালায় দাড়িয়ে থাকতেই কু ঝিক কু ঝিক ঝক্কর ঝক্কর করে একটা ট্রেন এসে স্টেশনে প্রবেশ করলো । ট্রেনের ছাদের উপর এলোমেলো ভাবে নানান শ্রেণীর যাত্রী বসে আছে । ঈদের ছুটি ছাটায় এমন দৃশ্য দেখা যায় । কি মনে হতে , মোবাইলটা বের করে একটা ছবি তুললাম ।

দৃশ্যটা আহামরি কিছু না হলেও । মনের ভেতর দোল দিয়ে গেলো । কেন যেন আমার খুব ভাল লেগে গেলো । মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, বাসাটা আমি ভাড়া নিবো । সঙ্গে সঙ্গে এক পসলা দমকা হওয়া এসে সঙ্গতি প্রকাশ করে গেলো । আমি গুনগুন করে গান ধরলাম।

দুই

শুক্রবার বসিলা থেকে চলে এলাম নতুন বাসায় । সুমন সারাদিন আমার সাথে থেকে মালামাল উঠাতে নামাতে, গোছগাছ করতে সাহায্য করলো । ভাড়া কম । খোলা মেলা পরিবেশে মানিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট করতে হলো না । সমস্যা শুধু একটাই সেটা ওয়াশরুম নিয়ে । ঘর থেকে বের হয়ে ছাদ পেরিয়ে ওয়াশরুমে যেতে হয় বলে প্রথম প্রথম বিরক্তি লাগলেও ধীরে ধীরে সেটাও মানিয়ে গেলো । মানুষ অভ্যাসের দাস । সব পরিস্থিতিতেই মানিয়ে চলতে পারে ।

রান্নার ব্যবস্থা ঘরের ভেতর । আমি সাধারণত দুপুরে বাহিরে খাই । তাই রান্নার ঝামেলা খুব একটা নেই । অফিস থেকে ফিরে চাল ডালে কিছু একটা বানিয়ে নিলেই চলে যায় । গ্যাসের চুলা লাগাবার ব্যবস্থা আছে । এক বিকেলে সুমনকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে চুলা কিনে আনলাম । চুলা লাগাবার পর মনে হলো লাইফটা জিংগো ঢালা হয়ে গেলো । ইদানীং চায়ের নেশা হয়েছে । সকাল বিকাল দু কাপ চা না হলে চলে না । অফিসে লিকার চা দেওয়া হয়। দেখলেই বমি পায় । তাই আমি খাই না । মাঝে মাঝে দোকানে গিয়ে খেতাম । কিন্তু দোকানে চা খাওয়ার চেয়ে ঘরে বানিয়ে খেলে বেশি সাশ্রয় । তাই দুধ, চিনি, চা পাতা কেনা হয়েছে । এ জন্য অনেকগুলো টাকা বের হয়ে গেলো ।

বাসায় ফেরার পর রান্নাবান্না করছি, চা বানাচ্ছি, খাচ্ছি ধাচ্ছি । প্রায়ই তৃতীয় তলা থেকে ছোটু মানে, ছোটন নামের ছেলেটা এসে গল্প গুজব করে যায় । নামে ছোটু হলেও কাজে বেশ ট্যাটনা । দু'দিন লাগলো ওর সাথে খাতির জমাতে । 

প্রথম প্রথম বাউন্ডারি দেয়ালে পা তুলে বসে বসে আমার কাজকর্ম দেখেছে । বুঝতে পারলাম আমাকে অবজারভেশনে রেখেছে । দশটা কথা জিজ্ঞাসা করলে,একটার উত্তর দেয়,তাও না দেওয়ার মতো করে । একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি ছোটু গলির দিকে মুখ করে দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে । আমি রুমের দরজা না খুলে পা টিপে টিপে ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম । তারপর দু'কাঁধ ধরে "ভু" শব্দ করে এমন ভঙ্গি করলাম যেন ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো । তাতে ভয়াবহ চমকে গেলো ছোটু; কিন্তু খুব মজা পেলো । এরপর হতে আমার অফিস থেকে ফেরার সময় হলে ছোটু ইচ্ছে করে দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে ।

সেই থেকে ছোটুর সাথে খাতির শুরু । নানান বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভালবাসে ছোটু । যতক্ষণ আমার কাছে থাকে ততোক্ষণ বকবক করতেই থাকে । যে বিষয় নিয়েই কথা বলি না কেন, ছোটু এমন একটা ভাব করে, যেন, সে বিষয়ে ও আমার চেয়ে বেশি জানে । ছেলেটার কথা শুনতে খারাপ লাগে না । কথা বলার সময় চোখ, মুখের এমন সব ভঙ্গি করে যে, আমি বেশ মজা নিয়ে ওর কথা শুনি । মুগ্ধ হই । সব শিশু মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে না । কিছু কিছু শিশু সে ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় ছোটু সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন ।

নানা গল্পের ফাকে ফাকে ছোটু বাড়িওয়ালা সম্পর্কে নানা তথ্য দিলো আমায় । বাড়িওয়ালী কবুতর পালা পছন্দ করেন না । এই দিয়ে সারাদিন রাত ঝগড়া হয় । দুই মেয়ে কলেজে ভার্সিটিতে পড়ালেখা করে । এক ছেলে থাকে বিদেশে । সে একজন কালো কুচকুচে বিদেশিকে বিয়ে করেছে । এ নিয়েও বিস্তর অশান্তি । বড় আফার মেজাজ সবচেয়ে বেশি খারাপ । ছোট আফা ভালো । ইত্যাদি ইত্যাদি । জগলুল ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছি, বাড়িওয়ালাদের বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখাতে হয় না । বিবাহ যোগ্য মেয়ে থাকলে তো আরো না । তাতে বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া সর্ম্পক ভালো থাকে ।

বাড়িওয়ালা মোজাফফর সাহেবও দারুণ মানুষ । তার বিষয় হচ্ছে, কবুতর । পৃথিবীর কোন কোন দেশে কোন কোন জাতের কি কি কবুতর পাওয়া যায়, সেগুলোর কোনটার কত দাম সব তার নখদর্পণে । ভদ্র কবুতর ছাড়া পৃথিবীর অন্যকিছু বুঝেন বলে মনে হয় না ।

প্রথম দিন কবুতরের উপর তার এক ঘণ্টা লেকচার শুনার পর পালিয়ে বেড়াছি । পারত পক্ষে ওনার মুখোমুখি হচ্ছি না । বলা চলে এক প্রকার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি । কবুতরের বাকবাকম শব্দে ছাদটা মুখরিত হয়ে থাকে । বেশ ভালে শুনতে । অল্প ক'দিনের মধ্যে ভালো লেগে গেলো জায়গাটা ।

আজ সকাল থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে । অফিস থেকে কাক ভেজা হয়ে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরেছি । ফ্রেশ হয়ে চুলায় ডালে চালে খিচুরী চড়িয়ে দিয়ে গরম এক কাপ চা নিয়ে জানালার পাশে এসে বসলাম । ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে প্রকৃতি। কবি হলে , লিখে ফেলতাম, "এমন ও বর্ষায় তারে বলা যায়, এমন বর্ষায় তার হওয়া যায় ...."

কমলাপুর স্টেশনের ভেতরটা ফাকা হয়ে আছে । লোকজন নেই বললেই চলে । বৃস্টির হাত থেকে বাচাবার জন্য এখানে সেখানে কিছু জিনিসপত্র ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে । করত করত শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । মনে হচ্ছে আজ সারারাত বৃস্টি হবে । শূণ্য দৃষ্টি তাকিয়ে আছি রেল লাইনটার দিকে । শূণ্য রেল লাইন বৃষ্টি স্নাত হয়ে সিক্ত হয়ে আছে । ল্যাম্প মৃর্দু পোস্টের আলোতে রেল লাইনের পাতগুলো বৃষ্টিতে ভিজে চকচক করছে । চা'য়ে চুমুক দিতে দিতে প্রকৃতি দেখতে খারাপ লাগছে না । মনে মনে ভাবছি সামনের মাসে বেতন পেয়ে একটা টেলিভিশন কিনবো । টেলিভিশন হলে, সময় কাটাতে অসুবিধা হবে না ।

হঠাৎ নড়েচড়ে বসলাম । প্রথমে ভাবলাম ভুল দেখছি, কিন্তু পরক্ষণে'ই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা, না , ভুল দেখছি না । স্টেশনের ল্যাম্পপোস্ট থেকে একটু দূরে ,আধো আলো, আধো অন্ধকারে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে রেল লাইন ধরে হাঁটছে । এখানে থেকে মেয়েটির চেহারা বোঝা না গেলেও বৃষ্টিতে ভিজে মেয়েটির পোশাক যে শরীরের সাথে লেপটে আছে সেটা বুঝা যাচ্ছে। পাগল নাকি ? এমন আবহাওয়ায় কেউ বৃষ্টিতে ভেজে ? নির্ঘাত ঠাণ্ডায় পরবে ।

চায়ের মগে শেষ চুমুক দিয়ে খিচুড়ি নেড়ে চেড়ে আবার জানালায় এসে চোখ রাখলাম । উদ্দেশ্য মেয়েটিকে দেখা । হাটতে হাটতে মেয়েটি ততোক্ষনে লেম্পপোস্টের নিচে গিয়ে বসলো তারপর সরাসরি তাকালো আমার দিকে । আমি তাতে কিছুটা ভরকে গেলাম । কি অশোভন বিষয়টা । একটি মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে আর আমি তা তাকিয়ে, তাকিয়ে দেখছি । জানালা থেকে সরে যাবো কি না ভাবছি । ঠিক সে সময় মেয়েটি আমার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার হাটতে লাগলো ।


মেয়েটি কে , কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে , কেন বৃষ্টিতে ভিজছে ইত্যাদি নানা চিন্তায় আবার ভেতর তখন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে । অল্পতেই কোন বিষয় নিয়ে অস্থির হয়ে উঠা আমার একটি মুদ্রা দোষ ।

স্টেশনে নানান কিসিমের লোকজন ঘোরাফেরা করে । খারাপ মেয়ে মানুষেরও অভাব নেই । কিন্তু সে রকম কেউ হলে তো এভাবে বৃষ্টিতে ভেজার কথা নয় । আমার আকাশ পাতাল নানা ভাবনার মাঝে মেয়েটি খুব ধীর গতিতে হাটতে হাটতে দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে গেলো ।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা থেকে উঠে এসে খিচুড়ির কড়াইটা নামিয়ে দু'টো আলু, দুটো ডিম সিদ্ধ বসিয়ে দিয়ে আবার জানালায় এসে দাঁড়ালাম । মেয়েটি তখন আবার রেল লাইন ধরে হেটে আসছে । আর একটু পর পর জানালাটির দিকে তাকাচ্ছে । আমি নিজেকে একটু আড়াল করে দাড়িয়ে রইলাম । ঠিক সে সময় তীব্র হুইসল দিতে দিতে স্টেশন থেকে একটি ট্রেন বের হলে এলো , এবং মেয়েটি কিছু বুঝে উঠার আগেই ট্রেনটি মেয়েটি উপর দিয়ে সোজা চলে গেলো।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি চিৎকার করে উঠলাম । কড় কড় কড়াত করে দূরে কোথাও বাজ পড়লো । ট্রেনটি চলে যেতেই আমি জানালায় দাড়িয়ে মেয়েটির ছিন্নভিন্ন দেহ রেল লাইনের একটি পাশে পরে থাকতে দেখলাম । হায় খোদা । মেয়েটি কি তাহলে আত্মহত্যা করার জন্য এখানে এসেছিলো ?

চোখের সামনে একটা আত্মহত্যা দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলাম । কি করবো বুঝতে পারছি না । একবার মনে হলো , ছুটে গিয়ে দেখে আসি মেয়েটি বেচে আছে কিনা । আবার মনে হলো , কি দরকার উটকো ঝামেলার মধ্যে যাবার । কিন্তু অস্থির হয়ে উঠলাম, কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না । বিবেকের কাছে হেরে গেলাম । দ্রুত চুলা নিভিয়ে দিয়ে ছাতাটা টেনে নিয়ে দরজা ভেজিয়ে রেখে ঘরে থেকে বের হয়ে গেলাম ।

আমার রুমের জানালা থেকে স্টেশনের ভেতরটা যতোটা কাছে মনে হয় আদতে যে সেটা ততো কাছে নয় সেটা সেখানো পৌছতে গিয়ে বুঝলাম। নানান অলি, গলি ঘুরে, দুটো ফুটওভার ব্রীজ পেরিয়ে । এক্সিডেন্ট এর কথা বলে স্টেশন মাস্টারের অনুমতি নিয়ে একজন রেল কর্মীকে সাথে করে সেখানে পৌছে তন্ন তন্ন করে খুজেও কোন নারীর ছিন্নভিন্ন দেহ কিংবা রক্তের দাগ খুজে পেলাম না । একবার ভাবলাম, বৃস্টিতে হয়তো রক্ত ধুয়ে গেছে । কিন্তু দেহটি যাবে কোথায় ? অনেক খুজে,পেতে কিছু না পেয়ে বোকা হয়ে লেম্পপোস্টের নিচে ঠায় দাড়িয়ে রইলাম । রেল কর্মী নানা কিছু বলে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলো ।

হাল ছেড়ে দিয়ে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে বসলাম । এখানেই মেয়েটিও বসেছিলো । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার জানালার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম । বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো। ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা বাতির আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম, একটি নারী মূর্তি দাড়িয়ে আছে আমার জানালায় ।

চলবে ..........।
চিত্র : ইরিনা তারাসোভা

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১২:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: গল্পটি পড়ে ভালো লাগলো।

২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:০৯

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: ধন্যবাদ , পাঠাকের সংখ্যা থেকে গল্প পোস্টাতে ইচ্ছে করে না ।। আপনার ভাল লেগেছে শুনে খুশি হলাম । গল্পটা যেভাবে চিন্তা করেছিলাম সময়ের অভাবে সেভাবে বাঁধতে পারছি না । তবে আজ ২য় পর্বটা দিবো ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.