নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানুষের মন, ভাবনা, অনুভূতি ও ভালবাসা বৈচিত্র্যময় বলেই পৃথিবীটা এত সুন্দর!https://www.facebook.com/akterbanu.alpona

আলপনা তালুকদার

ড.আকতার বানু আলপনা,সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

আলপনা তালুকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

মাধবী

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৮



আট

আমার স্ত্রী সোমা যখন সন্তানসম্ভবা, তখন আমি পেটারনিটি লিভ নিয়ে বাসায় থাকতাম। সোমাও মেটারনিটি লিভে আছে।দু'জনেই উইথ পে তে আছি। এদেশে এরা এটা করে মায়ের শারীরিক-মানসিক যত্নের কথা ভেবে। সকালে সোমা যখন বমি করে করে নেতিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ত, আমি তখন বিন্দুমাত্র ঘৃণা ছাড়া ওর বমি পরিস্কার করতাম, বাথরুমে ফিনাইল দিতাম, এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করতাম। আর অবসর সময়ে পড়ে পড়ে ঘুমাতাম। একদিন সোমা বলল, "বেবী হচ্ছে আমার, আর দিন দিন সুন্দর হচ্ছ তুমি।"

আমি বাবা হবার অপার্থিব আনন্দে যেমন উদ্বেলিত ছিলাম, তেমনি ওর কষ্ট দেখে খারাপও লাগতো। বেচারা! কিছুই খেতে পারেনা। শুধু বলে, "গন্ধ লাগে।" কাল আমি ওর পছন্দের ইলিশ মাছের ভাজি আর কচু শাকের ভর্তা করেছিলাম একটু ঝাল ঝাল করে। সাথে লেবু আর কাঁচা মরিচ। এই আশায়, যদি এটা অন্তত খেতে পারে। বার চারেক মুখে দিয়ে ও দৌড় দিল টয়লেটে। বড় কষ্টকর।

আমাদের দেশে শহরে অবস্থাপন্ন ঘরের গর্ভবতী মায়েদেরকে দেখা হয় 'অসুস্থ' হিসেবে। এদেশে উল্টো। এরা মনে করে 'সন্তানধারণ' আমাদের জীবনের অতি সাধারণ ও কাংখিত ঘটনাগুলোর মতই একটি। তাই এ সময়ও এরা স্বাভাবিক সব কাজকর্ম করে। নিয়মিত ব্যায়ামও। প্রথম প্রথম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ৮/৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা যখন বিশাল পেট নিয়ে আসতো, আমি দেখে ভাবতাম, এ অবস্থায় না এলে কি হত? এরা সবকিছু উপভোগ করে। জীবনের প্রতিটি স্তরের মত এ স্তরটাও। আমরা লজ্জায় গোপন করি, বড় পেট নিয়ে মানুষের সামনে যাইনা। আর এরা ফলাও করে বলে, "মা হচ্ছি! ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেতে যাচ্ছি, এতে লজ্জার কি আছে? শারীরিক পরিবর্তন? সেতো হতেই হবে। নাহলে 'মা' হব কিভাবে???"

ডেলিভারীর জন্য যখন সোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করি, ও বলল, "সিজার হোক। আমি অত যণ্ত্রণা সহ্য করতে পারবনা।" সপ্তাহ দুই আগে পেটে গ্যাস হওয়ার কারণে পেইন হচ্ছিল। ডাক্তার সব দেখে বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিল, "দেরী আছে।" সোমার সিজারের আবদারে তারা নাখোশ। "কিছু হবেনা, আমরা আছি। ভয় কি?" এরা চায় সবকিছু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে হোক। আর আমাদের দেশের ডাক্তাররা "নরমাল ডেলিভারী" শব্দটা ডিকশনারী থেকে তুলে দিতে পারলে বাঁচে।

তীব্র ব্যথায় ও যখন ছটফট করছে, গা ঘেমে একাকার, দু'চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি, ওর চিৎকারে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম। আমি বললাম, "সরি ডাক্তার, আমি থাকতে পারবনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।" ভ্রু কুঁচকে ডাক্তার বলল, "এসময় আপনাকে তার সবচে বেশী দরকার। আর আপনি তাকে ফেলে চলে যাবেন?"

যথেষ্ট সাহসী মানুষরাও যে কখনও কখনও ভয়ে শিউরে ওঠে, সেদিন বুঝেছিলাম। আমাদের দেশে বউ এর বাচ্চা হবার সময় স্বামী পাশে থাকবে- এটা অকল্পনীয়। ছেলে হবার পর আমার মনে হয়েছিল, আমিও ওকে জন্ম দিলাম।

ইদানিং একটা বিষয় আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। নিজের সন্তানকে আমরা যেমন ভালবাসি, সৎ বাবা-মা সব জেনেশুনে বিয়ে করলেও কেন স্বামী বা স্ত্রীর আগের পক্ষের সন্তানকে তেমন ভালবাসতে পারেনা? এর কারণটা বোধকরি এরকম: বাচ্চা গর্ভে আসার পর থেকে আমরা একটু একটু করে মা- বাবা হই।প্রতিদিন ওদের বেড়ে ওঠা দেখি। শিশুর শরীরের কোমলতা, অসহায়ত্ব তাকে ভালবাসতে বাধ্য করে। বিভিন্ন সময়ে ওদের সাফল্য, ব্যর্থতা, অসুস্থতা, আবেগ, বিভিন্ন ঘটনা আমাদের স্মৃতিপটে ছাপ ফেলতে থাকে। ফলে দিনে দিনে একটু একটু করে বাবামার সাথে সন্তানের সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। সৎ বাবামার সেটা থাকেনা। দায়িত্ববোধ থেকে বা অগত্যা ভালবাসা আর প্রকৃত বা স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসা কখনো এক হয়না। এজন্যই বোধহয় বলা হয়, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ কখনো বেশি হতে পারেনা।

আমার নীল কেমন আছে? তাকে যদি তার সৎ বাবা ভাল না বাসে, আমি তাকে দোষ দিতে পারিনা। আহারে আমার সোনা! তুই কোথায়? ভাল আছিস বাবা? জানি, খারাপ থাকলেও কোনদিন বলবিনা সেকথা। তুই যে আমারি রক্ত! ঠিক আমারি মত। যাদু আমার! তোকে হয়ত আর কোনদিনই সেভাবে কাছে পাবনা। তোর শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে। বড় হয়ে যাচ্ছিস। তোকে নিয়ে কত আনন্দময় সময় কাটিয়েছি, খেলেছি, ঘুরে বেরিয়েছি..। আহ্! চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বড় কষ্ট! বড়ই কষ্ট!

এক জীবনে একে একে সবাইকে হারালাম।কি নিদারুণ কপাল আমার! এদেশে আসার পর হারিয়েছি আত্মীয়-বন্ধুর সংগ, তারপর হারিয়েছি মাধবীকে, তার কিছুদিন পর বাবাও চলে গেলেন, তারপর হারালাম স্ত্রী -পুত্রকে।মা এখনো জীবিত। অনেক বয়স হয়ে গেছে। মা আমার থেকেও নেই। দেখা হয়না কতদিন! কানে কম শোনেন বলে কথাও হয়না। আমি কথা বলতে পারিওনা। মায়ের গলা শোনার সাথে সাথে আমার দু'চোখে বন্যা নামে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয়না। ভয়ও লাগে। মা আমার কষ্ট টের পেয়ে যান যদি!!!

কি চমৎকার জীবন আমার! কখনো ভাবিনি আমার বেঁচে থাকাটা এমন হবে। যারা আমার মাধবীকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে, আমার তাদেরকে খুন করতে ইচ্ছে করে। আজ ও আমার পাশে থাকলে আমার জীবনটা এমন হতনা।বর্ষার দিনে আমি মাধবীর হাত ধরে বৃষ্টি দেখতাম, জোছনা রাতে ছাদে বসে চাঁদের আলোয় গোসল করতাম, বসন্তের বিকেলে নদীর পাড়ে বসে ওকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতাম, প্রত্যেক হলিডেতে....। আর ভাবতে পারিনা। কি লাভ?

চলবে.....

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ২:০৭

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: সুন্দর লিখা ভাল লেগেছে। পরের পর্বের অপেক্ষা রইলাম মেম।

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:২০

আলপনা তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

২| ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:৪১

বিজন রয় বলেছেন: আপনি কেমন আছেন? অনেক দিন ব্যস্ত ছিলাম তাই কথা বলতে পারিনি।
এখন থেকে বলা যেতে পারে।

আপনার পোস্টগুলো পড়তে হবে ।

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:৪২

আলপনা তালুকদার বলেছেন: জ্বি, অবশ্যই।

৩| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ২:০৪

কালীদাস বলেছেন: লেখাটা সুন্দর। ভাল লেগেছে আমার :(

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:০৬

আলপনা তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

৪| ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:২০

অর্ধ চন্দ্র বলেছেন: আজ ও আমার পাশে থাকলে আমার জীবনটা এমন হতনা।বর্ষার দিনে আমি মাধবীর হাত ধরে বৃষ্টি দেখতাম, জোছনা রাতে ছাদে বসে চাঁদের আলোয় গোসল করতাম, বসন্তের বিকেলে নদীর পাড়ে বসে ওকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতাম, প্রত্যেক হলিডেতে....।
বাহঃ কি চমৎকার লেখা! অপেক্ষাই রইলাম চুপটি করে প্রিয়তর কবিতাপাঠ শোনার মধুর সে ক্ষনটির জন্য

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:৪৮

আলপনা তালুকদার বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.