নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানুষের মন, ভাবনা, অনুভূতি ও ভালবাসা বৈচিত্র্যময় বলেই পৃথিবীটা এত সুন্দর!https://www.facebook.com/akterbanu.alpona

আলপনা তালুকদার

ড.আকতার বানু আলপনা,সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

আলপনা তালুকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

মায়াবী শৈশব

২৯ শে জুন, ২০১৭ দুপুর ২:১৮



মায়াবী শৈশব

এখনকার শিশুদের কোন শৈশব নেই। এরা বাবামা হলে তাদের সন্তানদেরকে শোনানোর মত কোন গল্প থাকবেনা এদের স্মৃতিতে। আমার ছোটবেলার আরো কিছু ঘটনা বলি।

আমি তখন নানার বাড়ীতে থেকে একটি ক্রিশ্চিয়ান মিশনারী স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ি। নানার বাড়ী থেকে স্কুলের দূরত্ব ৪ কিলো। রোজ দল বেঁধে আমরা ১০/১২ জন ছেলেমেয়ে হেঁটে স্কুলে যাই, আসি। তাদের মধ্যে আমি সবার ছোট। রাস্তায় যার বাড়ী আগে পড়ে, সে চলে যায়। এভাবে ছেলেমেয়ের সংখ্যা কমতে থাকে। নানার বাড়ী সবার শেষ মাথায়। তাই আমি ও আমার খালারা ফিরি সবার শেষে।

স্কুল থেকে একজন আয়া ঠিক করে দেয়া আছে। সেই আয়া আমাদেরকে এগিয়ে দেয় স্কুল থেকে আধা কিলো দূরে নদীর ঘাট পর্যন্ত। আমরা নৌকায় করে নদী পার হয়ে চলে আসি। বর্ষার সময় নদী ভরে গেলে নদী পার হতেই সময় লাগতো আধা ঘণ্টা। তাই স্কুলে যাবার জন্য আগে বাড়ী থেকে বের হতে হত। ফিরতামও অনেক পরে। সকালে গরম ভাত খেয়ে স্কুলে আসতাম। বিকেল পাঁচটায় আবার বাড়ী গিয়ে ভাত। আমাদের সময় কেউই টিফিন নিয়ে স্কুলে যেত না। তবে হোস্টেলের ছেলেমেয়েরা টিফিন পিরিয়ডে হোস্টেলে যেয়ে খেয়ে আসতো। আমরা টিফিন পিরিয়ডে খেলতাম। স্কুলের বাউন্ডারীর ভিতরে কোন দোকানদারকে ঢুকতে দেয়া হতনা। তাই কিছু কিনে খাবার সুযোগও ছিলনা। এখনকার ছেলেমেয়েরা এত কষ্ট করে লেখাপড়া করে কি?

নানার শান বাঁধানো লম্বা বারান্দায় রোজ সন্ধ্যাবেলা হারিকেন জ্বালিয়ে আমরা পড়তে বসতাম। যৌথ পরিবারের সবাই একসাথে। ক্লাস টু থেকে কলেজ পর্যন্ত আলাদা আলাদা ক্লাসের মোট নয়জন পড়ুয়া। যে যার মত পড়ে। নানা হাতপাখা নিয়ে বসে বাতাস করেন। রাতের খাবার না দেয়া পর্যন্ত পড়া চলতো। নানা সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে ভাত খেতেন। তারপর ঘুম। আমি ঘুমিয়ে যেতাম সবার আগে। কোন কোন দিন না খেয়েই শুয়ে পড়তাম। নানী জোর করে তুলে খাইয়ে দিতেন।

একদিন কি কারণে যেন আমার ক্লাস ছুটি হয়ে গেল একঘণ্টা আগে। আমি একা স্কুল থেকে বের হলাম। আমার সাথে আর যারা আসে, তাদের ছুটি হয়নি। চার কিলো পথ আমাকে একা ফিরতে হবে। ভীষণ রোদ আর গরম। আমি একাই হাঁটছি। নদীর ঘাটের কাছে আছে লাশকাটা ঘর আর শ্মশান। আমি দেখলাম শ্মশান ঘরের কাছে রাস্তার উপরে একটি ভ্যানের উপরে চাটাই দিয়ে মোড়ানো একটা রক্তাক্ত লাশ। মনে হয় বাসি। লাশকাটা ঘরে নিয়ে যাবে। পোস্টমর্টেমের পর দাহ হবে। লাশ থেকে দূর্গন্ধ বের হচ্ছে। দেখে আমি ভয় পেলাম। তাড়াতাড়ি হেঁটে সামনে এগোতে লাগলাম। হঠাৎ কেন জানিনা আমার মনে হল, নানার বাড়ীতে আগুন লেগেছে। এই সময়টা গ্রামে প্রায়ই আগুন লাগে।, নদীতে, পুকুরে পানি কম থাকে। আমি হাঁটু পানিতে নেমে নদী পার হলাম। তাড়াতাড়ি হাঁটছি। সত্যি যদি আগুন লাগে! আবার একটু পরেই মনে হল, আগুন লাগেনি। আমার এমনি এমনি মনে হচ্ছে। আমি বাড়ী ফিরে দেখলাম, সত্যি আগুন লাগেনি। আমি নিশ্চিন্ত মনে ভাত খেয়ে বাড়ীর উঠানের পেয়ারা গাছে বসে পেয়ারা খাচ্ছি। নীচে চুলার পাড়ে কাজের মেয়ে ধান সেদ্ধ করার জন্য বিশাল দুইটা পাতিলে ধান দিয়ে জ্বাল দিচ্ছে। চুলার মুখের কাছে জড়ো করে রাখা আছে আখের পাতা। আমার সমান গাদা করা। আমি পেয়ারা গাছ থেকে নেমে কেবলি বাড়ীর সদর দরজার দিকে যাচ্ছি। কাজের মেয়ের চিৎকারে পিছনে তাকিয়ে দেখি, আখের শুকনো পাতার গাদিতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। এক নিমেষে আগুন লেগে গেল রান্নাঘরের চালে। বারান্দায় ১০/১২ টা ছাগল বাঁধা ছিল। বড় বড় ছাগল। আমি এদের পিঠে চড়ি। তারা আর্ত চিৎকার আর ছোটাছুটি করতে লাগলো। হাটবার। তাই বাড়ীতে কোন পুরুষ মানুষ নাই, হাটে গেছে। আগুন টিনের চালের দিকে এগুচ্ছে। আমি বাড়ীর বাইরে দৌড়ে গিয়ে দেখি, বাইরের বৈঠকখানায় গ্রামের দু'জন কাকুর সাথে আমার সানোয়ার মামা বসে আছে। আমি কিছুই বলতে পারছিনা। চিৎকার করে কাঁদছি। মামা জিগ্যেস করল, "কি হয়েছে?" আমার ভীত চেহারা দেখে মামা দৌড়ে বাড়ীর দিকে আসতেই আগুন দেখতে পেয়ে ছুটে গেলেন। বটি দিয়ে দড়ি কেটে রান্নাঘরের চাল মাটিতে নামিয়ে দিলেন। তারপর ছাগলগুলোর দড়ি কেটে দিলেন। গ্রামের লোকজন পুকুর থেকে পানি এনে ঢালতে লাগলো। পুকুরের পানি আরো কমতে লাগলো। এই সুযোগে কেউ কেউ মাছ তুলে নিয়ে গেল। তবে একটু পর আগুন নিভে গেল।

আমি এখনও ভেবে পাইনা, কেন সেদিন মনে হয়েছিল, বাড়ীতে আগুন লেগেছে? মন কি তবে সত্যিই আগে থেকে বিপদের ইঙ্গিত পায়? কিভাবে?

নানার বাড়ীর ঠিক পিছনে ছিল ঘন বাঁশঝাড়। সেখানে থাকতো অনেক কুলীন সাপ। কখনও দেখতে পেলে কেউ পিটিয়ে মারতো, কখনো পালিয়ে যেত। আমার নানীর (ছোট নানার বৌ) হাতে একবার কামড়ও দিয়েছিল। তবে নানী সেযাত্রা প্রাণে বেঁচে যান।

গরমের সময় একদিন আমার এক খালা বারান্দায় ঘুমিয়েছে। ভোররাতে তার হাতে ঠাণ্ডা কিছুর ছোঁয়া লাগলে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাকিয়ে দেখে বিশাল এক গোখরো সাপ তার পাশে শুয়ে আছে। এক লাফে বিশাল চিৎকার দিয়ে খালা উঠানে নেমে হাঁপাতে থাকে। পরে সাপটাকে পিটিয়ে মারা হয়।



নানার বাড়ীর কাছে দুইটা নদী। গ্রামের লোকেরা বলে ছোট নদী আর বড় নদী। বড় নদীতে বর্ষার সময় প্রচুর পানি থাকে। নদীর পাড় ভেঙ্গে পড়ে নদীতে। উজান থেকে গাছপালা, দরজা, বড় বড় সাপ, লাশ ভেসে আসে। মাটির বড় হাঁড়ির মধ্যে ছোট বাচ্চার লাশও দেখেছি একবার। নৌকা বাইচের নৌকা আসে একসাথে অনেকগুলো। মাছ ধরা নৌকাও আসে। ব্যবসায়ী নৌকাও আসে নানা সওদা নিয়ে। নৌকাতেই তারা এক/দেড় মাস থাকে, খায়।। আর নদীতে আসে শুশুক। মাঝে মাঝে মাথা তুলে লাফ দিয়ে আবার ডুবে যায়। আমরা ভয় পাইনা। আমরা ছেলেমেয়েরা নদীতে রোজ দু'ঘণ্টা সাঁতার কেটে গোছল করি। চোখ লাল হয়ে যায়। তবু উঠিনা। নদীর উঁচু পাড় থেকে একসাথে ৪/৫ জন নদীতে লাফ দেই। পাড় ভেঙ্গে পড়া দেখি। বালির উপরে ঘর বানাই। কাউকে কোমর পর্যন্ত বালিতে পুঁতে দিয়ে উঠতে বলি। মজার খেলা!

একবার আমি অনেক উঁচু থেকে নদীতে লাফ দিয়ে পানির নীচে তলিয়ে যাচ্ছি। তারপর উপরের দিকে উঠতে গিয়ে দেখি, কে যেন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমার জামা ধরে। আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম।এদিকে দম ফুরিয়ে আসছে। আমি সাহস করে জামা ধরে টান দিতেই একটা গাছের গুড়ির শিকড় আমার হাতে লাগলো। ভয় কেটে গেল। একটানে জামা ছাড়িয়ে নদীর তলায় পা দিয়ে জোড়ে ধাক্কা দিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। পানি যেন ফুরায়না। দম বন্ধ হবার ঠিক আগে পানির উপরে আমার মাথা বের হল। আমি শ্বাস নিলাম। গায়ে কোন জোর নেই। সাঁতার কাটার শক্তিও নেই। আমি স্রোতে গা ভাসিয়ে ভেসে যাচ্ছি। কিছুদূর গিয়েই নদীর ঘাট পেলাম। সেখানে নদীর দুই পাড়ে দড়ি বাঁধা আছে সেই দড়ি ধরে ধরে মাঝি নৌকা পারাপার করে। আমি দড়ি ধরে ঝুলে থাকলাম। নৌকা এলে মাঝি আমাকে নৌকায় করে ঘাটে নামিয়ে দিল। তীরে উঠে দেখি জামা ছিঁড়ে গেছে।

আমার মেয়েরা এসব গল্প বিশ্বাস করেনা। কারণ ওরা কখনও আমাকে নদীতে নামতে দেখেনি। আমি সাঁতার জানি - ওরা এটাও বিশ্বাস করতো না। সেবার দাদার বাড়ী গিয়ে পুকুর সাঁতরালাম। তারপর ওরা বিশ্বাস করল।

কত মজার ছিল সেসব দিন! বর্ষার সময় বন্যা হলে আমরা কলাগাছের ভেলায় চড়ে ঘুরে বেড়াতাম। খুবই মজার ব্যাপার! তবে তখন আমরা নানার আমবাগানে যেতাম না। প্রায় সব গাছে থাকতো সাপ। মাটি ডুবে যাবার কারণে ওদের থাকার জায়গা নেই। আর ভাল লাগতো মাছ ধরা দেখতে। নানার বাড়ীর পিছনে সাঁকো ছিল। সেই সাঁকোর ভেতর দিয়ে বিলের পানি যেত নদীতে। আশপাশের সব পুকুর উপচে মাছ বেরিয়ে যেত। সবাই একসাথে ৪/৫ টা জাল ফেলতো সাঁকোর মুখে। সেই জালে উঠে আসতো বড় বড় রুই, কাতলা আর ছোট নানান রকমের মাছ। রোজ মাছভাত খাওয়া। খড়ির চুলায় রান্না করা টাটকা সব্জি দিয়ে মাছের ঝোল, পেঁয়াজ দিয়ে মাছের ভুনা। অসাধারণ স্বাদ! সে স্বাদ আর পাওয়া যায়না।

এত সুন্দর সময় আমার মেয়েরা দেখতে পায়নি। হয়তো কোনদিন পাবেও না। ওরা সুইমিং পুলের নীল পানিতেই মন ভরায়। আফসোস!!!!!

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৪:১৪

চাঁদগাজী বলেছেন:


"গ্রামের লোকজন পুকুর থেকে পানি এনে ঢালতে লাগলো। পুকুরের পানি আরো কমতে লাগলো। এই সুযোগে কেউ কেউ মাছ তুলে নিয়ে গেল। তবে একটু পর আগুন নিভে গেল। "

- এখানে কাহিনী মিলেনি, ঘরের আগুন নিভাতে কয়েক'শ বালতি পানি তুলে ফেললেও মাছ ধরার অবস্হা হবে না; ধান গাছ থেকে তক্তা তৈরির মতো ঘটনা।

২৯ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৩

আলপনা তালুকদার বলেছেন: পানি খুব কম ছিল। আর অনেক মানুষ পুকুরে নেমে সত্যিই মাছ ধরে নিয়ে যায়। আপনার জানা আছে কিনা জানিনা। এক ধরণের টোপর আছে, যেটা মাটিতে গেঁথে দিয়ে ভিতরে হাত দিয়ে মাছ ধরা হয়। কোমর পানিতে বা কম পানিতে এসব টোপর দিয়েই আমাদের অঞ্চলে মাছ ধরা হয়। আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতেই পারে যদি আপনি টোপর না দেখে থাকেন।

আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।

২| ২৯ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৪:৫১

123456789happy বলেছেন: হয়তো বা পুকুর ছোট ছিল, চাদগাজী ভাই

২৯ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৪

আলপনা তালুকদার বলেছেন: পুকুর বড়ই ছিল, পানি কম ছিল। ধন্যবাদ।

৩| ২৯ শে জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৫

দেবজ্যোতিকাজল বলেছেন: ভাল লিখেছ......

২৯ শে জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৩

আলপনা তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ। ভাল থাকুন। বাসি ঈদ মোবারক।

৪| ২৯ শে জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৬

শাহরিয়ার কবীর বলেছেন: হুমম, মজার দিনগুলো আর ফিরে আসে না !! :(

২৯ শে জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৯

আলপনা তালুকদার বলেছেন: ঠিক। কি আর করা! ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.