নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানুষের মন, ভাবনা, অনুভূতি ও ভালবাসা বৈচিত্র্যময় বলেই পৃথিবীটা এত সুন্দর!https://www.facebook.com/akterbanu.alpona

আলপনা তালুকদার

ড.আকতার বানু আলপনা,সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

আলপনা তালুকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

যেকোন সম্পর্ক ভাল রাখবেন বা তিক্ত সম্পর্ক মধুর করবেন কিভাবে?

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:০৫



যেকোন সম্পর্ক ভাল রাখবেন বা তিক্ত সম্পর্ক মধুর করবেন কিভাবে?

সম্পর্ক মানে পরম নির্ভরতা; সম্পর্ক মানে প্রিয় মানুষগুলোকে আগলে রাখা; সম্পর্ক মানে অন্যকে ভাল রেখে নিজে সুখী হওয়া; সম্পর্ক মানে আত্মার শান্তি; সম্পর্ক মানে জীবন।

সম্পর্ক হল সেতুর মত। প্রতিটা মানুষ এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। আর সম্পর্ক হল এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম। কখনো সে সেতুগুলো হয় ইট-কঙ্ক্রিটের তৈরী মজবুত, কখনো বাঁশের, আবার কখনো হয় রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতুর মত। আপনি চাইলে এ সম্পর্কগুলোকে যেমন আজীবন মজবুত রাখতে পারবেন। আবার চাইলে ভেঙ্গেও ফেলতে পারবেন। এই সম্পর্কের টানাপোড়েন আমাদের জীবনে সুখ-দুঃখের কারণ। তাই যেকোন সম্পর্ক ভাল রাখতে বা খারাপ হয়ে যাওয়া সম্পর্ক ভাল করতে আপনার চেষ্টা প্রয়োজন।

আমাদের দেশের অধিকাংশ পুরুষের পাশাপাশি অধিকাংশ মহিলারও মানসিকতা উন্নত হওয়া প্রয়োজন। কারণ পুরুষদের মত মহিলাদের মানসিকতাও সমাজ-সংসারে অনেক অশান্তির জন্য সমানভাবে দায়ী।

সবচেয়ে বৈরী সম্পর্ক হয় সাধারণত শাশুড়ী-বৌ এর। এছাড়া ননদ-দেবর-ভাশুরের সাথেও সম্পর্ক খারাপ হয় ভাই-বৌ এর। কখনও কখনও জায়ে জায়ে সম্পর্ক হয় প্রতিহিংসামূলক আর্থিক ও নানা কারণে। এই সম্পর্কগুলো আরো বেশী খারাপ হয় মানুষগুলো একসাথে বা কাছাকাছি থাকলে। মাঝে মাঝে সম্পর্ক খারাপ হয় স্বামী-স্ত্রীর মাঝেও। জামাইয়ের সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী ভাল হয় শ্বশুরকূলের লোকেদের সাথে যদি সেখানে যৌতুক বা সম্পত্তির বিষয় জড়িত না থাকে। সন্তান, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী, .. ইত্যাদি যেকোন সম্পর্ক কখনও কখনও খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। খারাপ হলে সেটাকে ভাল করার জন্য কি কি করা উচিত? আসুন জানি।

যেকোন সম্পর্ক ভাল রাখতে বা ভাল করতে হলে প্রথমেই আপনার চেষ্টা থাকা প্রয়োজন। কারণ যেকোন সম্পর্ক লালন করতে হয়। আর সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করাটাও জরুরী। সম্পর্ক না থাকলে আপনার বা আপনার প্রিয়জনদের কেমন লাগবে, সেটা ভেবে দেখাও জরুরী। আর আপনার কোন দোষ, ভুল বা আচরণের কারণে সম্পর্ক খারাপ হলে নির্দিধায় সরি বলুন। অপরপক্ষ সরি বলবে, সে অপেক্ষা না করে নিজেই আগে সরি বলুন। এতে আপনি ছোট হবেন না, বরং আপনার মহানুভবতার জন্য অন্যের শ্রদ্ধা পাবেন।

নিজের পরিবারের লোকেদের সাথে সম্পর্ককে সেভাবে লালন না করলেও চলে। যেমন- নিজের বাবা-মা-ভাই-বোনের সম্পর্ক। মনের টানেই এসব সম্পর্ক ভাল থাকে, সহজে খারাপ হয়না । কিন্তু বৈবাহিক কারণে তৈরী হওয়া সম্পর্ককে সযত্নে লালন করতে হয়। কারণ এসব সম্পর্কে কোন রক্তের টান থাকেনা। শ্বাশুড়ী, ননদ, জা, - এরা নতুন বৌকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। এখান থেকেই সমস্যার শুরু। কেন তা মনে করে?

আগেই বলেছি, আমাদের দেশে সবচেয়ে বৈরী সম্পর্ক হয় শ্বাশুড়ী-বৌয়ের। তার কারণও আছে। মা সীমাহীন কষ্ট করে তিল তিল করে ছেলেকে মানুষ করেন। ছেলেকে অসম্ভব ভাল বাসেন। ছেলের কাছে প্রত্যাশাও বেশী। কারণ ধর্মমতে বাবা-মার দেখাশোনার দায়িত্ব ছেলে-মেয়ে উভয়ের হলেও ছেলেদের দায় বেশী বলে সমাজ মনে করে। বউ চায়না ছেলে সে দ্বায়িত্ব পালন করুক। ফলে সম্পর্ক খারাপ হয়। সারাজীবন মা ছেলের কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। বিপত্তি ঘটে তখন, যখন বিয়ের পরে ছেলের কাছে স্ত্রী মায়ের চেয়ে বেশী প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজনে। তাছাড়া বেশীরভাগ স্ত্রী বিয়ের পর স্বামীকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে চায়, তার আত্মীয়দের কাছ থেকে আলাদা করার চেষ্টা করে। ফলে স্বামী ও তার আত্মীয়দের সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক খারাপ হয়।

কেন শ্বশুরবাড়ীর লোককে বউরা অপছন্দ করে? কেন মেয়েরা স্বামীকে শ্বশুরবাড়ীর লোকদের থেকে আলাদা করতে চায়?

নতুন বৌয়ের সাথে শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের সম্পর্কটা কেমন হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে বিয়েটা কিভাবে হয়েছে, তার উপর। পরিবারের মতে বিয়ে হলে সেখানে নতুন বৌয়ের গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা বেশী থাকে। কিন্তু পরিবারের অমতে বা প্রেম করে বিয়ে করে আনলে পরিবারের সবাই বৌকে পছন্দ করেনা, ঈর্ষা করে এবং দোষ খুঁজতে থাকে।

আমার এক ডাক্তার বন্ধু প্রেম করে বিয়ে করেছে। কিন্তু তার স্ত্রী তার বাড়ীর লোকেদের সাথে কথা বলেনা, ভাল আচরণ করেনা। তার কারণ আমার বন্ধুর পরিবার তার স্ত্রীর সাথে বিয়েকে মেনে নিতে চায়নি বলে।

আমাদের দেশের বেশীরভাগ মেয়েরা আর্থ-সামাজিক কারণে স্বভাবগতভাবেই ভীষণ কৃপণ। বিয়ের পর আরও কৃপণ হয়ে যায়। কারণ মেয়েরা সারাজীবন পরনির্ভশীল। বাবা, স্বামী বা ছেলের উপর। তারা জানে স্বামীর অবর্তমানে ওদের অবস্থা কতটা নাজুক হয়। তাদেরকে সবসময় আর্থিক দিক থেকে বঞ্চিত করা হয়। বাবার সম্পত্তিতে অংশ বা বিধবা হলে স্বামীর সম্পত্তি ঠিকমত দেয়া হয়না। নিজে উপার্জন করলেও নিজের ইচ্ছামত স্বামী তা খরচ করতে দেয়না। এমন কি দেনমোহরটাও বেশীরভাগ সময় দেয়না। তাই সারাজীবন, বিশেষ করে বিয়ের পর মেয়েরা হয় হিসেবী। তাই তারা শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের পিছনে টাকা খরচ করা পছন্দ করেনা, অপচয় মনে করে। তাই তারা স্বামীকে আলাদা করতে চায়। ফলে শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের সাথে বৌদের সম্পর্ক ভাল হয়না। ফলে এই কারণে স্বামীর সাথেও তাদের সম্পর্ক কখনো কখনো খারাপ হয়।

বৌরা বরকে নিয়ে আলাদা থাকতে চায় প্রাইভেসীর কারণে। নিজেদের মত আলাদা, স্বাধীন থাকবে, যা খুশী করবে, যেখানে খুশী যাবে, বিলাসিতা করবে, কারো কথা মেনে চলতে হবেনা ইত্যাদি। বউ নিজে তার পরিবার ছেড়ে এসে স্বামীর সাথে থাকতে পারলে স্বামী পারবেনা কেন?

বউরা মনে করে স্বামীর কাছে যেহেতু সে অত্যাবশ্যক, তাই স্বামীর আর কারো প্রয়োজন নেই। স্বামী ও স্বামীর আয় হলেই যেহেতু তার সব প্রয়োজন মিটে যায়, তাই বৌরা স্বামীর অন্য রিলেটিভদের 'আগাছা' মনে করে। দূরে সরিয়ে রাখতে চায়।

মেয়েরা ভুলে যায়, যে স্বামী ও স্বামীর আয় নিয়ে স্ত্রীর এত ভরসা-গর্ব, সেই স্বামীকে তিল তিল করে বড় করেছে স্বামীর পরিবার। তাই স্বামীর রোজগারে তাদেরও হক আছে।

একাত্তরে আমার শ্বশুর শহীদ হলে আমার শ্বাশুড়ী মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে চার সন্তান নিয়ে বিধবা হন। এখন ঐ বয়সে অনেক মেয়ের বিয়েই হয়না। তখন আমার স্বামীর বয়স দুই বছর, ছোট ননদের বয়স দশ মাস। বেকার-অসহায় অবস্থা থেকে স্কুল মাস্টারীর চাকরী নিয়ে অনেক কষ্ট করে চার ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমার স্বামীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানিয়েছেন। সেই মাকে যদি বউ হয়ে এসে আমি দেখতে না পারি, তাঁর প্রতি কর্তব্য করতে স্বামীকে বাধা দিই, তাহলে শ্বাশুড়ী কিছুই করতে পারবেননা। কিন্তু আমি বিবেকের কাছে হেরে যাব। শেষ বয়সে আমার সন্তানরাও অবধারিতভাবে আমার সাথেও একই আচরণ করবে। বেশীরভাগ মেয়েদের এই উপলব্ধি হয়না।

মেয়েরা যদি একটু উদার হয়ে শ্বশুরবাড়ীর লোকদের আপন করে নিতে পারে, স্বামী বলার আগেই তাঁদের প্রতি কর্তব্য করতে পারে, যদি মেনে নেয় যে স্বামীর রোজগারে তাঁদেরও হক আছে, যেহেতু তাঁরা তাকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন - তাহলে স্বামী ও স্বামীর পরিজন বউদের মাথায় করে রাখতে বাধ্য। তখন স্বামীও স্ত্রীর আত্মীয়দের দিকে খেয়াল করবে, স্ত্রীর মতের দাম দেবে, ভালবাসবে। অশান্তি কমে যাবে। সম্পর্ক ভাল হবে।

শ্বাশুড়ী-ননদরা বউকে দেখতে পারেনা, তাই বউরাও তাদের দেখতে পারেনা। এ এক অদ্ভূত প্যারাডক্স ! কেন শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা বউদের দেখতে পারেনা?

এর কারণ বউয়ের বাবা, ভাইদের জামাইকে যৌতুক দিতে না পারা, বউদের প্রতি বদ্ধমূল নেতিবাচক ধারণা, বিয়ের পর ছেলে বা ভায়ের কাছে হঠাৎ করে বউয়ের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা, পরিবারের মতকে অগ্রাহ্য করে বউকে ঘরে আনা,.... ইত্যাদি । উড়ে এসে জুড়ে বসার মত।

বৌরা আলাদা পরিবেশ থেকে আসে। তাই তাদের পছন্দ-অপছন্দ, ভাললাগা-মন্দলাগা, অভ্যাস, আচরণ, মানসিকতা ইত্যাদি অনেক কিছুই শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সাথে মিলবেনা, এটাই স্বাভাবিক। তাই কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও মানিয়ে চলতে হবে উভয়পক্ষকে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সেটা হয়না বলেই এত সমস্যা। সবাই সবকিছুতে পটু হয়না। বউরা সব কাজে পারদর্শী হবেনা, এটাও মেনে নিতে হবে।

মনে রাখা প্রয়োজন, স্বামী বা স্ত্রীর, উভয়দিকের সম্পর্কগুলো অবিচ্ছেদ্য এবং পরিপূরক। তাই সেগুলো সচল ও ভাল রাখা খুব জরুরী। মন থেকে স্বামী-স্ত্রী-উভয়ের শ্বশুরপক্ষের লোকজনকে মেনে নিন যে সে সম্পর্কটা আপনার জন্য অপরিহার্য। তাই যেকোন মূল্যে সেটাকে টিকিয়ে বা ভাল রাখার গরজ আপনার বেশী হওয়া ভাল। তাহলে অপর প্রান্তের মানুষটিও আপনার কাছে আসবে, আপনার ভাল লাগবে। এক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা বেশী। তাদের করণীয় -

- বউরা ধীরে ধীরে সচেতনভাবে আগ্রহ নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের পছন্দ-অপছন্দগুলো জেনে নিন এবং পছন্দ-অপছন্দগুলোকে সম্মান করুন, গুরুত্ব দিন। সেভাবে আচরণ করুন।

- নিজের ফোনে টাকা তোলার সময় অল্প হলেও শ্বাশুড়ী-ননদের ফোনেও টাকা দিন। এতে তারা আপনার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হবে। এরকম ছোটখাট বিষয়গুলো সম্পর্ক উন্নয়নে খুব ভাল ভূমিকা রাখে।

- বাজারে গেলে খালিহাতে ফিরবেন না। সামান্য হলেও খাবার, ছোটখাট উপহার নিয়ে আসুন। তাহলে শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা বুঝবেন আপনি তাঁদের কথা ভাবেন, তাঁরা আপনার কাছে প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।

- একসাথে বসে নাটক-সিনেমা,খবর, টকশো দেখুন। তবে অবশ্যই ভারতীয় বাংলা সিরিয়ালগুলো দেখবেন না। কিভাবে কুটনামী করা যায়, কিভাবে অন্যকে কষ্ট দেয়া যায়, বিপদে ফেলা যায়- এসব শেখার চেয়ে না শেখা অনেক অনেক বেশী ভাল।

- মাঝে মাঝে তাঁদের পছন্দের খাবার তৈরী করুন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে। সবাই একসাথে বসে গল্প করতে করতে খান। তাতে আন্তরিকতা বাড়ে।

- নতুন টেকনোলজি শিখিয়ে দিন। যেমন- শ্বাশুড়ীকে শেখান কিভাবে ফেসবুক চালাতে হয়। আমার শ্বাশুড়ীর প্রথম ফোনটা আমার দেয়া। পরে আরো একটা কিনে দিয়েছি।

- স্বামী ও শ্বাশুড়ীর কর্তব্য ভাগ করে নিন। যেমন শ্বাশুড়ীর মেয়ে বা জামাই এলে যত্ব করা, উৎসবে উপহার কিনে দেয়া, নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। শ্বাশুড়ীর প্রিয় মানুষরা, যাঁরা দূরে থাকেন, তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন, নিয়মিত খোঁজ নিন। ননদ-দেবর, কার কি দরকার, স্বামী বলার আগেই আপনি বলুন। সাধ্যমত তাদের দরকার মেটান।

(আমার ননদ কফি পছন্দ করে। আমি শ্বশুরবাড়ী যাবার সময় দুধ-কফি সাথে করে নিয়ে যাই, ওকে বানিয়ে খাওয়াই। বিয়ের পর পর আমি গেলে ননদ মহাখুশী হতো ( এখনো হয়)। কারণ পুরো বাড়ী পরিস্কার করা, ননদের ছেলেকে খাওয়ানো, গোসল, ঘুম, রান্না - সব আমি করতাম ননদকে ছুটি দিয়ে। পরে আমার জায়ের ছোট ছেলেটাকে আমার কাছে রেখে জা স্কুলে যেত। আমি যে ক'দিন শ্বশুরবাড়ী থাকতাম, সেক'দিন ভাশুরের পরিবারকে নিয়ে একভাতে খেতাম। আমি চলে এলে আবার ওরা আলাদা খেত। এখনও ঈদের সময় ক'দিন আমরা একসাথে খাই। আমি তখন বাচ্চাদের পছন্দের খাবারগুলো রান্না করি। সবাই আনন্দ করে খায়। আমার দেখেই ভাল লাগে! বাচ্চাদের নিয়ে কাছাকাছি বেড়াতে যাই। প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা ভ্যানে চড়ে পা দোলাতে দোলাতে বাদাম, চানাচুর মাখা, পেপসি,... খেতে খেতে আমরা বেড়াই দুইঘণ্টা। বাচ্চারা অপেক্ষা করে থাকে আমি কখন যাব, ওরা ভ্যানে চড়ে বেড়াবে।)

- নিজের বিছানার চাদর ( বা এরকম আরো কিছু) কিনলে শ্বাশুড়ীর জন্যও কিনুন। তাতে তিনি নিজেকে আপনার কাছে সমান ও সম্মানিত বোধ করবেন। (আমি আমার বানানো হাতের কাজের ব্যাগ, পাপোষ, ওয়ালম্যাট এসব দেই শ্বাশুড়ী, ননদ, জা কে। শ্বাশুড়ীকে বেশী শাড়ী দিতাম রোজ স্কুলে যেতেন বলে। এখন বানানোর সময় পাইনা বলে শৌখিন জিনিস কিনে দেই বেশী)

- একসাথে বেড়াতে যান। সবসময় স্বামী-সন্তান নিয়ে না গিয়ে মাঝে মাঝে শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, ননদ-দেবর-ভাশুরদেরকে সাথে নিন। এতে নিজেদের মধ্যে ভালবাসা বাড়বে।

- মাঝে মাঝে শ্বশুর-শ্বাশুড়ীকে ছুটি দিন। হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বেড়াতে পাঠান। কোন আত্মীয়ের বাড়ী বা কাছাকাছি কোথাও, যেখানে যেতে চান। আমি যখন গাড়ী নিয়ে যাই, তখন শ্বাশুড়ীকে এখানে ওখানে নিয়ে যাই।

- সবার বিশেষ বিশেষ দিনগুলো উৎসাহ নিয়ে উৎযাপন করুন। ভাল খাবার রান্না করুন। সাধ্য থাকলে মাঝে মাঝে ভাল রেস্টুরেন্টে খেতে যান। বিশেষ দিনে ছোট হলেও উপহার দিন। যেমন- শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর বিয়ে বার্ষিকী বা জন্মদিনে শাড়ী বা পাঞ্জাবী দিন।

- যেকোন সমস্যা বা অসুবিধা শ্বশুর, শ্বাশুড়ী বা ননদ, দেবরের সাথে শেয়ার করুন, গোপন করবেন না। তাঁদের পরামর্শ নিন। তাতে তাঁরা নিজেদেকে আপনার থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করবেননা।

- বাইরে যাবার আগে শ্বশুর/শ্বাশুড়ীকে বলে যান কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, কখন ফিরবেন। তাহলে তিনি আপনাকে তাঁর কাছে অধীনস্ত বোধ করবেন, আপনাকে নিয়ে অকারণ টেনশন করবেন না।

- শ্বশুরবাড়ী থেকে দূরে থাকলে ছুটির দিন গুলোতে বাচ্চাদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ী বেড়াতে যান বা তাদের আসতে বলুন। চাকুরীজীবী বউরা ব্যস্ততা বা জার্নির অযুহাতেে যেতে চায়না। তারা বোঝেনা রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর সংগ বাচ্চাদের জন্য কতবড় আশীর্বাদ।

- স্বামীর সাথে কলহ হলে নিজেরা সমাধান করতে না পারলে কলহের কারণ শ্বশুর/শ্বাশুড়ীর সাথে শেয়ার করুন। ( স্বামী কোন কারণে আমার সাথে রাগ করলে আমি শ্বাশুড়ী-ননদকে বলে দেই। ওদের বকা খেয়ে স্বামী সাইজ হয়ে যায়।)

- শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের দোষগুলোকে মেনে নিন। তাহলে তাঁরাও আপনার দোষগুলোকে মেনে নিবে। (আমার শ্বাশুড়ীর স্বভাব হল সবকিছু জমা করে রাখা। কোন কিছু ফেলতে দেবেননা। পুরনো টিন, লোহা, কৌটা, প্লাস্টিক কন্টেইনার,..
সব। আমি শ্বশুরবাড়ীতে তিনতলায় ছয় বেডরুমের বাড়ী করার পর পুরনো, ভাংগা, ঘুণে খাওয়া ফার্নিচারগুলো নীচতলায় রেখে বাড়ী গুছিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। পরের বার গিয়ে দেখি যাবতীয় জিনিস তিনতলায় উঠে গেছে। আমি কিছুই বলতে পারিনি।)

- বউয়ের সব আচরণ ভাল নাও লাগতে পারে। তবে তা নিয়ে কথা শোনানো বা বাধ্য করা উচিত নয়। (আমি নামাজ পড়ি, রোজা করি, শালীন পোষাক পরি, যাকাত দেই। তবে নিজে বোরখা পরা পছন্দ করিনা। শ্বশুড়ী হজ্ব থেকে ফেরার সময় তসবীহ, জায়নামাজ এনেছেন, বোরখা আনেননি। আমি ভেবেছিলাম দুই বৌ আর দুই মেয়ের জন্য আর কিছু না এলেও বোরখার আগমন অনিবার্য। কেন আনেননি জানতে চাইলে বললেন, "জানি তোমরা পরবেনা। টাকা নষ্ট।" আমরা হেসে বলেছিলাম, "আপনার মাথায় এত বুদ্ধি?")

- তাঁদের ভাল গুণগুলোকে শ্রদ্ধা করুন, স্বীকৃতি দিন। যেমন- আমার শ্বাশুড়ীর কিছু কিছু রান্না খুবই সুস্বাদু। এখন আর রান্না করতে পারেন না। তবু যতবার সে খাবারগুলো রান্না হয়, ততবার আমি বলি, মায়ের রান্নার মত হয়নি। হয়ও না। যেমন টাকীর মাছের ভর্তার স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে। আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, খাসীর মাংস ছাড়া আমার আর কোন রান্নাই তেমন ভাল হয়না। আমার জঘন্য রান্নার সুখ্যাতি আমার পরিবারের সবার মুখে মুখে। আমি রান্না করেছি শুনলে তারা হাজার বার ভাবে, আজ খাওয়া যাবে তো? অথচ আমার শ্বাশুড়ী নিজে কখনও খারাপ বলেননি। আমি শ্বশুরবাড়ীতে রান্না করে সবাইকে খাওয়াই শুনে আমার ভাই বলে, "তুই রান্না করছিস, সেই রান্না আবার লোকে খাচ্ছে???"

- অনেক সময় কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সবার মন রাখা সম্ভব হয়না, অনেককিছু করার সাধ্যও সবার থাকেনা। ফলে অনেকে মন খারাপও করে। কিন্তু ভেবে দেখা দরকার, বিনা কারণে কেউ কোন নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয় না। তবে তেমন কিছু হলে স্বামীর পরিবার কষ্ট পেলে স্বামীর খারাপ লাগে, আবার স্ত্রীর পরিবার কষ্ট পেলে স্ত্রীর খারাপ লাগে। তাই উভয়কে সেটা মাথায় রেখে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সবাইকে ভালভাবে বুঝিয়ে বা নিজের অক্ষমতার কারণ বলে সেভাবে আচরণ করতে হবে।

- শ্বশুরকূলের কেউ অসুস্থ হলে বউদের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো, সেবা করা, খোঁজ নেয়া। তাহলে স্বামীরাও তাই করবে। (আমার বর যখন নেদারল্যান্ডে, তখন আমার শাশুড়ী হার্ট এটাক করে বেডরেস্টে। আমি বরকে না জানিয়ে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার পড়া ফেলে রেখে শ্বাশুড়ীর কাছে ছিলাম টানা পঁচিশ দিন। শাশুড়ী ভাল হলে ফিরে এসেছি। আমার বরকে অসুখের কথা জানতেইে দিইনি।পরে দেশে এসে শুনেছে।)

- আপনি শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের যত্ন করুন, তারাও আপনার, আপনার বাচ্চাদের যত্ন করবে, সুখে-দুখে পাশে দাঁড়াবে। আজ থেকেই শুরু করুন।

মেয়েরাই পরিবারকে আগলে রাখতে পারে তার মমতা, উদারতা, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। তাই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে বৌদেরই। তাই আজ থেকেই শুরু করুন সম্পর্কের তাজমহল তৈরীর কাজ। আমি শতভাগ নিশ্চিত, যে পদক্ষেপগুলো নিতে বলেছি, তার অর্ধেকটাও যদি নিতে পারেন, তাহলেই আপনার জীবন বদলে যাবে। একমাস করে দেখুন। নিশ্চিত সুফল পাবেন। তখন কষ্ট করে আমার ইনবক্সে দু'লাইন লিখবেন প্লিজ।

খুব খুব ভাল থাকবেন বান্ধবী ও বন্ধুরা....

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:২৩

আমি চির-দুরন্ত বলেছেন: ভালো পরামর্শ। এখনকার দিনের কমন সমস্যার সহজ সমাধান।দিলেন।

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:৩২

আলপনা তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।

২| ০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:৪৩

রাজীব নুর বলেছেন: আপা, বউ শ্বাশুড়ির সম্পর্ক কখনও সহজ সরল হবার নয়। দ্বন্দ চলতেই থাকবে। আইনস্টাইনও এর সমাধান করতে পারবে না। নো নেভার।

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:৪৭

আলপনা তালুকদার বলেছেন: ভাল রাখা সম্ভব, যদি সত্যিকারের সদিচ্ছা থাকে। নাহলে কোনদিনও সম্ভব না। ধন্যবাদ।

৩| ০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:৫৮

লর্ড অফ দ্য ফ্লাইস বলেছেন: সব মেয়েই ঘরের কর্ত্রী হতে চায়। ইসলাম ধর্মও স্ত্রীদের এই অধিকার দিয়েছে।
কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারে তা পারে না। সব কিছু শাশুড়ি নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে চান।
আর স্বামীর বড় ভাই থাকলে তো কথাই নেই। আমার স্ত্রীর মেঝ ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা সবচেয়ে ভালো হলেও তাকে ও তার স্ত্রীকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হতো না। বড় জনের মতামতকেই প্রাধান্য দিত। এখন তারা ঢাকায় থাকেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমি একান্নবর্তী পরিবারের বিপক্ষে।

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:০৯

আলপনা তালুকদার বলেছেন: সেটাই বলতে চেয়েছি। কোন একজনের (শ্বাশুড়ী, বড় ছেলে,...) মতের প্রাধান্য থাকলেই সমস্যা। সম্পর্ক ভাল রাখার জন্য তাই নারী, পুরুষ উভয়ের মানসিকতা উন্নত ও উদার হওয়া প্রয়োজন।

নানা বাস্তবতার কারণে একান্নবর্তী পরিবার ভাঙ্গতে বাধ্য। ভাঙ্গছেও। তবে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিশুদের তথা মানুষের সব ধরণের বিকাশের জন্য যৌথ পরিবার বেশী ভাল। ধন্যবাদ।

৪| ০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:০৭

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: অনেক সুন্দর ও উপকারী একটি পোস্ট দিয়েছেন। ধন্যবাদ।

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:১২

আলপনা তালুকদার বলেছেন: আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।

৫| ০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:৩৩

মূর্ক্ষের পিতা হস্তী মূর্ক্ষ বলেছেন: Good

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:৪২

আলপনা তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ।

৬| ০৬ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:২০

রানা আমান বলেছেন: খুবই ভালো লিখেছেন ।

০৬ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:৩৮

আলপনা তালুকদার বলেছেন: তাই? ধন্যবাদ।

৭| ০৬ ই জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৪:১৬

রাসেল ০০৭ বলেছেন: আপু মন থেকে বলছি। লেখাটা অসম্ভব ভালো হয়েছে এবং সময়োপযোগী হয়েছে । ছেলে মেয়ে নির্বিসেষে সবার জন্যই অবশ্যই পাঠ্য । সবাই যদি আপনার মত করে ভাবতে পারতো তাহলে সম্পর্ক গুলো কতইনা মধুর হত । মানুষের জীবনাচরণও এত কুটিলতায় ভরা থাকতোনা ।

০৬ ই জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৬

আলপনা তালুকদার বলেছেন: ঠিক। ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.