নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানুষের মন, ভাবনা, অনুভূতি ও ভালবাসা বৈচিত্র্যময় বলেই পৃথিবীটা এত সুন্দর!https://www.facebook.com/akterbanu.alpona

আলপনা তালুকদার

ড.আকতার বানু আলপনা,সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

আলপনা তালুকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

পাশ্চাত্যের তুলনায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের উদ্বিঘ্নতার কারণ ও বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা

০৭ ই জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৪



বিখ্যাত দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদদের মতে, শিশুরা শিখবে তাদের চারপাশোর পরিবেশ, প্রকৃতি থেকে। সহজ থেকে কঠিণ, জানা থেকে অজানা, মূর্ত থেকে বিমূর্ত কিছু। চেনা পরিবেশ, প্রকৃতি থেকে শিখলে তারা শিখবে আনন্দের সাথে। ফলে তাদের দেহ-মনের পরিপূর্ণ বিকাশ হবে। শিশু তার পরিবেশের সাথে যথাযথভাবে খাপ খাওয়াতে পারবে, সে সুখী হবে, প্রকৃত মানুষ হবে।

কিছুদিন আগেও আমরা পরিবেশ থেকেই শিখতাম। নদী, পুকুর, বিল আমাদের শেখাতো সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, নৌকা চালানো। গাছ শেখাতো কিভাবে গাছে চড়ে ফল, ফুল, খড়ি পাড়তে হয়, বাবার পেশা ( কৃষক, কামার, কুমার, জেলে তাঁতি, যাই হোক) ও মায়ের কাজ শিশুদের শেখাতো জীবিকা বা সাংসারিক কাজ। এখন আমাদের শিশুরা আর প্রকৃতি থেকে শেখেনা। শেখে প্রাইভেট আর কোচিং সেন্টার থেকে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এখনও শিশুরা পরিবেশ থেকেই শেখে। নিজের কাজ নিজে করা, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, সাঁতার কারা, কাদায় নামা, পাহাড়ে চড়া, খেলা, গান, নাচ, আঁকা,.... এগুলো পড়াশুনার অংশ।
বিদেশে হোটেল, দোকান, কফিশপগুলোতে স্কুলের ছেলেমেয়েদেরকে পার্ট টাইম কাজ দেয়া দোকান মালিকদের জন্য বাধ্যতামূলক। কারণ ওদেরকে ছোটবেলা থেকেই ওভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য কাজ পাওয়াটা নিশ্চিত করা জরুরী যাতে তারা আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী হতে পারে। সমাজ তাদের জন্য নানা সুবিধা নিশ্চিত করে রেখেছে। যেমন, পড়াশুনা, চাকরী, চাকরী দিতে না পারলে বেকারভাতা, পেনশন, ফ্রি মেডিকেল সুবিধা, বাড়ী, ব্যাংক লোন, ওল্ড হোম ইত্যাদি।

আমাদের দেশে এসবের নিশ্চয়তা নেই। ফলে আমাদের অভিভাবকরা যেকোন উপায়ে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করতে চান তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যাতে তারা কোন অসুবিধায় না পড়ে। এটিই আমাদের সমাজে নানা অনিয়মের মূলে। এর সাথে আইনের প্রকৃত শাসনের অভাব মানুষকে অপরাধী বানায়। কারণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি হয়না।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা যে কি সীমাহীন দূর্ভোগের মধ্যে আছেন, তা আমরা সবাই জানি। আমি পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি যাতে কেন, কিভাবে, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কি কি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, তা স্পষ্ট জানা যায়।। প্রথমেই আসি ভর্তি প্রক্রিয়ার পার্থক্য বিষয়ে।

ভর্তি ও কোচিং:
পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে স্কুলে শিশু ভর্তি নেয়া হয় কোন ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া। তিন/সাড়ে তিন বছর বয়সে বাড়ীর কাছের কোন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করালেই বাবা-মার দায়িত্ব শেষ। বাচ্চারা ওদের মেধা অনুযায়ী উপরের ক্লাসে উঠতে থাকবে। ছয় বছরে ওরা যাবে প্রাথমিক স্কুলে। মেধা অনুযায়ী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে। মেধা অনুযায়ী বৃত্তি ও পাঠ্য বিষয় পাবে। অর্থাৎ শিশু যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশী পারদর্শী বা সবার চেয়ে ভাল করে, তাকে সেই বিষয়েই পড়তে দেয়া হয়। তার বিভিন্ন বিষয়ে প্রাপ্ত ধারাবাহিক স্কোর দেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে দেয় শিশু ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, আর্টিস্ট, ব্যাংক এমপ্লয়ি নাকি গায়ক হতে পারবে। বাবা-মা শিক্ষকদের পরামর্শের ভিত্তিতে ঠিক করেন, শিশু কি পড়বে। অর্থাৎ ওসব দেশে ছেলেমেয়েরা যোগ্যতা থাকলে নিজের ইচ্ছামত যা খুশী পড়তে পারে, যা খুশী হতে পারে। তার ফলাফল দেখে স্কুল তার মেধার জন্য সবচেয়ে সামন্জস্যপূর্ণ বিষয় জানিয়ে দেয়। আমাদের মত বাবামার ইচ্ছা বা চাপে কিংবা পছন্দের বিষয়ে সুযোগ না পেয়ে বাধ্য হয়ে কেউ অপছন্দের কোন বিষয় পড়েনা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় - কোথাও ভর্তি হবার জন্য কোন শিক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টারে বা বাসায় প্রাইভেট পড়তে বা ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়না।

শিক্ষকদের সীমাহীন লোভ, বর্তমানে বাংলাদেশে পিএসসি-জেএসসি পরীক্ষা, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু এবং বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা - এই চারটি কারণে মূলত কোচিং ব্যবসার লাগামহীন প্রসার ঘটেছে গোটা বাংলাদেশে। শহর তো বটেই, গ্রামের স্কুলগুলোতেও প্রাইভেট ব্যবসা জমজমাট। শিক্ষকরূপী এসব কোচিং ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি সব শ্রেণী-পেশার অভিভাবকরা।

৪ এপ্রিল ২০১৭ এর দৈনিক যুগান্তরের রিপোর্টে দেখলাম, স্কুলে ও প্রাইভেটে পড়ার করণে তৃতীয় শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে রোজ গড়ে ১২/১৩ ঘণ্টা, এবং এসএসসি-এইচএসসি র শিক্ষার্থীকে গড়ে ১৫/১৬ ঘন্টা পড়তে হয় স্কুল-কোচিং বাসা- সব মিলিয়ে। এবার ভাবুন, এত বেশী পড়ার চাপ সহ্য করতে হলে ছেলেমেয়েদের মানসিক অবস্থা কেমন হবার কথা।

বাংলাদেশের সব ভাল স্কুলগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা না দিয়ে কোন শিশু ভর্তি হতে পারেনা। অর্থাৎ স্কুলে আসার আগেই শিশুকে অনেক কিছু শিখে আসতে হয় যা তার স্কুলে আসার পরে শেখার কথা।

বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্রাইভেট পড়ানো শুরু হয় মূলতঃ ভাল স্কুলগুলোতে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করানোর তাগিদ থেকে। কারণ ওসব স্কুলের রেজাল্ট ভাল। তাই ধরেই নেয়া যায়, একবার ওসব স্কুলে ভর্তি করাতে পারলে ভাল ফল সুনিশ্চিত। ঢাকার ভাল স্কুলগুলোতে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করানোর জন্য একবারে চান্স না পেলে দুই/তিন বার করে শিশুকে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ানো হয়। মোটা অংকের ডোনেশন দিয়েও ভর্তি করানো যায়না। এসব স্কুলে দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ভর্তি ফরম জোগাড় করতে হয়, বিভিন্ন কোচিং করিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াতে হয়। রীতিমত ভর্তি যুদ্ধ। বাংলাদেশের সব ভাল স্কুলগুলোর অবস্থা একই। এসব স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকরা দিনের পর দিন এসব স্কুলের শিক্ষকদের বাসায়, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে শিশুকে পড়ানোর কারণে তাঁদের টাকা, সময়, এনার্জি খরচ তো হয়ই, তারপরেও ভর্তির সুযোগ পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই আসন সংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে।

অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে থেকে সীমিত আসনের জন্য অল্প শিক্ষার্থী বাছাই করার জন্য কোন কোন স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন এতটাই কঠিণ করা হয় যে তা তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির উপযুক্ত। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক, উভয়কে সীমাহীন পরিশ্রম করে পড়া শিখতে ও শেখাতে হয়। এতে শিশুদের মেধার উপর চাপ পড়ে, পড়ার প্রতি বিরক্তি আসে, শিশুরা খেলাধুলা বা বিনোদনের সময় পায়না।



অভিভাবকরা প্রাইভেট পড়ান বাধ্য হয়ে। কারণ যেভাবেই হোক, শেখার চেয়ে ভাল নম্বর পাওয়াটা বেশী জরুরী। কেননা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নম্বর না পেলে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগই দেয়া হয়না। এখন তো আবার ভাল নম্বর পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে একবারের বেশী ভর্তি পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়না। আগে দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়া ছাত্রও বুয়েটে চান্স পেয়েছে যেটা এখন অসম্ভব। এখন ভাল ফলাফল নির্ধারণ করে টাকা। অর্থাৎ টাকা খরচ করে স্কুলের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ালে শিক্ষকরা ভাল শেখান, পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন বলে দেন। ফলে রেজাল্ট ভাল হয়। শিক্ষকরা ইচ্ছে করে ক্লাসে ঠিকমত পড়ান না। কারণ পড়ালে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়বেনা।

আগে কোন ছাত্র প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষকরা তাকে বাধ্য করতেন না। এখন শিক্ষকরা প্রাইভেটে ছাত্র আনার জন্য নম্বর কম দেয়া, শিক্ষার্থীদের মারা, ইচ্ছে করে কঠিণ প্রশ্ন করা, যারা পড়ে তাদেরকে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন আউট করে দেয়া, তাদেরকে নম্বর বেশী দেয়া, যারা পড়েনা, তাদেরকে কম নম্বর দেয়া, অভিভাবকদেরকে নানাভাবে চাপ দেয়া, ইত্যাদি নানা কূটকৌশল অবলম্বন করেন। এ কারণে অভিভাবকরা প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হন। পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্ন ফাঁসের সাথে শিক্ষকরা ও কোচিং সেন্টারগুলো জড়িত। তাই প্রশ্ন পেয়ে ভাল ফল করার আশায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা প্রাইভেটের পিছনে ছুটতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্যবহারিক পরীক্ষার পুরো নম্বর শিক্ষকের হাতে। ফলে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করতে পারেন।

সৃজনশীল পদ্ধতি না বোঝার কারণে এখনকার বাচ্চারা সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়ে। ধর্ম, সমাজ, এমন কি মাতৃভাষা বাংলাও। ক্লাসের প্রথম যে ছাত্র, সে সবচেয়ে বেশী প্রাইভেট পড়ে। অর্থাৎ রেজাল্টের কৃতিত্ব ছাত্রের নয়, প্রাইভেটের।

এখন শিক্ষার্থীদের মূল বইয়ের বাইরেও মোটা মোটা গাদা গাদা গাইড বইগুলো পড়তে হয়। এত বই শুধু রিডিং পড়তে হলেও কি পরিমাণ সময় দরকার তা অনুমান করা যায়। এত পড়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এই তথাকথিত ভাল ছাত্ররা অনেকেই পাস নম্বর পায়না। এসব শিক্ষার্থীরা প্রচুর পড়ছে। কিন্তু কিছু শিখছেনা। কারণ তারা জানে, উত্তর সঠিক না লিখলেও ভাল নম্বর পাওয়া যায়। শিক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হয়, নম্বর বেশী দেবার জন্য। এ এক অদ্ভুত সিস্টেম!


পড়ানোর ধরণঃ

পশ্চিমা দেশগুলোতে আধুনিক শিক্ষা উপকরণ সমৃদ্ধ সুসজ্জিত স্কুলগুলোতে ক্লাসের পড়া ক্লাসেই করানো হয়। বাড়ীর কাজ দেয়া হয়। তবে অভিভাবকদের কঠোরভাবে নিষেধ করা থাকে, যেন কোন অভিভািবক শিক্ষার্থীদের বাড়ীর কাজ করে না দেন। শিশু নিজে নিজে চেষ্টা করে শিখুক। তাতে ওরা স্বাবলম্বী হবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে, লেখাপড়ায় তথা নিজের কৃতিত্ব বা সাফল্যে আনন্দ পাবে। শিশু পড়া করতে না পারলে শিক্ষক করাবেন। তবে হ্যাঁ, যে সমস্যার সমাধান শিশু পারছেনা, তার কাছাকাছি কোন সমস্যা তৈরী করে সেটার সমাধান করে দেয়া যেতে পারে। শিক্ষার্থী কোন বিষয় না বুঝলে শিক্ষক সেটা বুঝিয়ে দিতে বাধ্য। দূর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষককে অতিরিক্ত যত্ন নিতে হয়। প্রয়োজনে ক্লাসের বাইরে অবসর সময়ে শিক্ষার্থীদের বিনা পয়সায় পড়াতে হয়। কারণ কোন শিক্ষকের ক্লাসে ছেলেমেয়ে ফেল করলে পরের বছর তাঁকে ক্লাস দেয়া হয়না। এসব দেশের ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষার কোন স্তরেই প্রাইভেট পড়তে হয়না, বাবামাকে বাসায় বা কোচিং সেন্টারে বাচ্চাকে পড়তে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেও হয়না।

আমাদের দেশে ছাত্র-ছাত্রী ফেল করলে শিক্ষকের কোন জবাবদিহিতা নেই বা শাস্তি হয়না। ফলে শিক্ষকরা স্কুলে কম, কোচিং বা প্রাইভেটে বেশী পড়ান।

উন্নত দেশগুলোতে শিশুরা শেখে হাতে-কলমে দেখে, পড়ে বা নিজে করে। ওদের স্টাডি ট্যুর বা আউটিং এ যাওয়া বাধ্যতামূলক। ওরা নানা দর্শনীয় স্থান, ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখবে, সেগুলো সম্পর্কে জানবে। শুধু মুখস্থ করবেনা। স্কুল থেকে শিশুদের নিয়ে যাওয়া হয় পাঠ্যবিষয় স্বচক্ষে দেখে শেখানোর জন্য। যেমন- গ্রামে খামারবাড়ীতে কৃষকরা কিভাবে ফসল ফলায়, ফসল মাড়াই করে, বাজারজাত করে, সংরক্ষণ করে, গবাদি পশু-পাখি লালন-পালন করে- এসব নিজে চোখে দেখে অনুভব করবে তাদের কাজটা কত কঠিণ। তারা কষ্ট করে ফসল ফলায় বলেই আমরা খেতে পাই। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধাবোধও তৈরী হবে শেখার পাশাপাশি।
এতে শেখার আনন্দ পাবে, শেখা সহজ হবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা শেখার বা আনন্দের জন্য পড়েনা। পড়ে ভাল নম্বর পাওয়ার জন্য।

মূল্যায়ন পদ্ধতিঃ

উন্নত দেশে শিক্ষকরা যেমন শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা মূল্যায়ন করেন, তেমনি শিক্ষার্থীরা মূল্যায়ন করে কোন শিক্ষক কতটা ভাল বা মন্দ। এই মূল্যায়নের উপর শিক্ষকের পদোন্নতি, পাঠদানের অনুমতি দেয়া বা না দেয়া নির্ভর করে। তাই শিক্ষকরা তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। আর আমাদের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের পাঠদান দক্ষতা বা আচরণ মূল্যায়ন করতে পারেনা। ফলে শিক্ষকরা ক্লাসে না পড়িয়েও থেকে যান বহাল তবীয়তে।

আমাদের দেশে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেন শুধু এটুকু বলার জন্য যে, একজন ছাত্র কোন বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছে। আর ওসব দেশে পরীক্ষা নেয়া হয় একজন শিক্ষার্থীর সবল ও দূর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করার জন্য যাতে শিক্ষক দূর্বলতাগুলো দূর করতে পারেন এবংশিক্ষার্থীর সবল দিকগুলো জানিয়ে দিতে পারেন তার ভবিষ্যত পাঠ্যবিষয় নির্ধারণ করার জন্য।

চাকরীঃ

উন্নত দেশে শিক্ষার্থীরা পাস করে পছন্দমত চাকরীও পাবে। কোথাও কোন ধরাধরি নাই। ঘুষ, মামুর জোর, রাজনৈতিক পরিচয়, কোটা,.... কিছুই লাগেনা। চাকরী না পেলেও বেকার ভাতা দেয়া হয় যাতে শিক্ষার্থীরা হতাশায় না ভোগে, হতাশার কারণে কোন অপরাধে না জড়ায় সেজন্য। আমাদের দেশের অবস্থা আমরা জানি।

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া চাকরী পাবার ক্ষেত্রে কোন কাজে লাগেনা। চাকরীর জন্য নতুন করে পড়তে হয়। দেশে প্রচুর বেকার। সেই তুলনায় কর্মসংস্থান নেই। তার উপর কোটা ব্যবস্থা, মামার জোর, রাজনৈতিক প্রভাব, ঘুষ, এসব অনিয়ম তো আছেই। ফলে চাকরী না পেয়ে হতাশ হয়ে অনেকে অমানবিক জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। সম্প্রতি ঢাবি ছাত্র তারেক আজিজ ও জাবি ছাত্রী শম্পা চাকরী না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। বেশীরভাগ পরিবারের ছেলেমেয়েদের আর্থিক সংগতি নেই যে আত্মকর্মসংস্থানমূলক কিছু করবে। ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ বা সহজ শর্তে সরকারী লোনের সুযোগ নেই। বেকারভাতাও নেই।

উন্নত দেশগুলোর সাথে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ার পার্থক্যঃ

পৃথিবীর সব চাইতে উন্নত দেশগুলো যেমন ফিনল্যান্ড, জাপান, নরওয়ে ইত্যাদি দেশগুলোতে স্কুল শিক্ষকতা হচ্ছে ঐ দেশগুলোর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং সবচেয়ে বেশি বেতনের চাকরিগুলোর মধ্যে একটি। কারণ তারা ভালোভাবেই জেনে গেছে একটি দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের শীর্ষে নিতে হলে দেশের শিক্ষাব্যাবস্থাকে সবচেয়ে ভালো হতে হবে। আর একটি দেশের শিক্ষার মান উন্নত হয় ঐ দেশের শিক্ষকদের কারণে। তাই শিক্ষক নির্বাচন করা হয় দেশের সেরা গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে থেকে।

যেমন - ফিনল্যান্ডের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেতে চাইলে ক্লাসে প্রথম ১০ জনের মধ্যে থাকতে হবে। এর বাইরে হলে অ্যাপ্লাই করা যায় না।

অ্যাপ্লাই করার পর প্রতি প্রার্থী এক বছরেরও বেশি সময় কোনও না কোনও স্কুলের সাথে যুক্ত হন। এই সময় চলে তাদের নানারকম প্রশিক্ষণ। স্কুলের সবচেয়ে ভালো শিক্ষকদের সাথে তাকে থেকে থেকে তাদের ক্লাস দেখতে হয়। এরপর কিছুদিন পর সে নিজে ক্লাস নেয়ার উপযুক্ত হলে তাকে নিজে নিজে ক্লাস নিতে দেয়া হয়। তখন আবার সিনিয়র শিক্ষকরা তার ক্লাসগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। মাঝে মাঝে আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রশিক্ষকরা এসে সেই ক্লাসগুলো মূল্যায়ন করেন।

শিক্ষকতার নানা উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর উপর প্রার্থীর মূল্যায়ন হয় – সে ক্লাসটা কত ইন্টারেস্টিংভাবে নিচ্ছে, তার গ্রুপওয়ার্কগুলো কেমন হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মনোযোগ দিচ্ছে কিনা, ঠিকমতো শিখছে কিনা ইত্যাদি।

এক বছরের এই প্রশিক্ষণে থাকে ভাইভা, থাকে লিখিত পরীক্ষা আর সবশেষে প্র্যাকটিক্যাল (আসল ক্লাস নেয়া) পরীক্ষা। এই এক বছরের প্রশিক্ষণের পর সব প্রার্থীদের মধ্যে থেকে বাছাই করে সেরা ১০% প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে।

অর্থাৎ ইউনিভার্সিটির সেরা ১০ জন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকে প্রাথমিক বাছাইকরাদের মধ্যে থেকে ছেঁকে মাত্র সেরা ১০% কে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে। তাহলে গাণিতিক হিসাবে ফিনল্যান্ডের সেরা ১% গ্রেজুয়েটরা আসলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন।

বাকিদের মধ্যে পরের সেরা প্রার্থীরা সুযোগ পায় হাইস্কুল এবং কলেজ লেভেলে শিক্ষক হওয়ার। আর সব শেষে যারা থাকেন তারা এরপর সুযোগ নেন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হওয়ার। এবং এই ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক নেয়ার সময় তারা যে এক বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এই ব্যাপারটিকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। এটার জন্য তারা এক্সট্রা কিছু মার্কস পায়।

যারা ইউনিভার্সিটিতেও শিক্ষক হতে পারলেন না, তারা এই এক বছরকে তাদের জীবনের সেরা প্রশিক্ষণ এবং নিজের দক্ষতা উন্নয়নের একটি সুযোগ হিসাবে দেখেন। কারণ তারা জানেন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে প্রতিদিন যে পরিমাণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় সেটি অন্য কোন পেশাতে করতে হয় না। যারা ফিনল্যান্ডের স্কুল শিক্ষক হওয়ার এই প্রশিক্ষণ পেয়েছে তারা অন্য যেকোনো সেক্টরে ভালো করে।

কেন ফিনল্যান্ড পৃথিবীর অন্যতম সেরা একটি শিক্ষাব্যাবস্থা হিসাবে বিবেচিত হয় এখন আশা করি পাঠক বুঝতে পেরেছেন। যেই দেশ নিজের সেরা ছাত্রছাত্রীদের বাছাই করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বানায়, সেই দেশের ছাত্রছাত্রীরা তো পৃথিবীসেরা হবেই।

আমাদের দেশের শিক্ষক নিয়োগ কিভাবে হয়, তা আপনারা জানেন।
এখন বেশীরভাগ শিক্ষক শিক্ষকতা পেশায় আসেন অন্য কোন চাকরী না পেয়ে, ডোনেশন দিয়ে, ধরাধরি করে বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে। শিক্ষকতা পেশাকে ভালবেসে নয়। তাই এ পেশার প্রতি তাদের ভালবাসা, দায়বদ্ধতা, আন্তরিকতা থাকেনা। তাই এ পেশাকে শিক্ষাকরা অন্যসব পেশার মত 'জীবিকা নির্বাহের উপায়' হিসেবে বিবেচনা করেন। নিজেদেরকে চাকুরীজীবী ভাবেন, 'মানুষ গড়ার কারিগর' ভাবেননা। তাই তাঁদের হাতে 'মানুষ' তৈরী না হয়ে অন্যকিছু তৈরী হচ্ছে। নানা অনাচারে ভরে যাচ্ছে দেশ।

বাংলাদেশে প্রায় সব পেশাতে যোগ দেবার আগে ঐ পেশার কাজ সম্পর্কে কিছুটা প্রশিক্ষণ নেবার বিধান আছে। শিক্ষকতা পেশায় তা নিতে হয়না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় - কোথাও যোগদানের পর ক্লাসে যাবার আগে কিভাবে পড়াতে হয়, সে সম্পর্কে শিক্ষকদের কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়না। ফলে শিক্ষকরা নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে যে যার মত পাঠদান করেন। কিন্তু ভাল ছাত্র হবার চেয়ে ভাল শিক্ষক হওয়া অনেক বেশী কঠিণ। শিক্ষার গুণগত মান কমে যাবার পিছনে এটিও একটি বড় কারণ।

এ নৈরাজ্য থেকে মুক্তি ও শিক্ষার মান বাড়ানোর উপায়ঃ

১। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অনেক বেশী বাড়াতে হবে।

২। সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধ্বস নেমেছে সেটা রদ করতে হলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

৩। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

৪। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব পর্যায়ে শিক্ষকদের বেতন আরও অনেক বাড়ানো উচিত, যাতে দেশের সবচেয়ে মেধাবী মানুষগুলো অর্থের পেছনে না ছুটে তাঁদের বেতন দিয়েই একটি সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারেন।













মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ৯:০৭

চাঁদগাজী বলেছেন:



এত প্রয়োজনীয় পোস্টে ব্লগারেরা মতামত জানায়নি কেন?

০৭ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ৯:২৩

আলপনা তালুকদার বলেছেন: জানিনা। আপনি জানিয়েছেন দেখে ভাল লাগলো। অশেষ ধন্যবাদ গাজী ভাই।

আমি ব্লগ ছেড়ে দেবার কথা ভাবছি। আপনাকে খুব মিস করব। ভাল থাকবেন।

২| ০৮ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১২:০৬

করুণাধারা বলেছেন: শিক্ষা বিষয়ক আপনার সকল পোস্টই সুচিন্তিত এবং সুলিখিত। আগের পোস্টেও ইচ্ছা থাকা সত্বেও সময়াভাবে বিষদ মন্তব্য করতে পারি নি, এবারো তাই। শুধু জানাই পোস্টগুলি আমার খুব ভাল লেগেছে- খুব দরকারি কথা লিখেছেন।

আপনার জন্যে শুভকামনা।

০৮ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১২:২৭

আলপনা তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ। জেনে ভাল লাগলো।

৩| ০৮ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১২:২৬

ইমরান আশফাক বলেছেন: সময় নিয়ে পড়তে হবে।

০৮ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১২:২৭

আলপনা তালুকদার বলেছেন: ওকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.