নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যেয়

আনিসুর রহমান এরশাদ

আমি আমার দেশকে অত্যন্ত ভালবাসি ।

আনিসুর রহমান এরশাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অতীত থেকে বর্তমান বাংলাদেশ ও ধর্মীয় রাজনীতি প্রসঙ্গ

৩০ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৭:৪৮

ভারতবর্ষে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংরেজগণ ১৬০০ সালে ২১৮ জন সদস্য নিয়ে লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি বণিক সংঘ গঠন করে এবং ৩১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের কাছ থেকে ভারতে বাণিজ্যের একচেটিয়া সনদ লাভ করে। অল্পদিনের মধ্যে তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন যায়গায় কুঠি স্থাপন করে। ১৬৬৮ সালে ঢাকা শহরে কোম্পানি কুঠি স্থাপন করে আর কোলকাতায় ১৬৯৮ সালে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলার সুবেদার শাহজাদা সুজা ইংরেজ চিকিৎসক জিব্রাইল ব্রাউটনের চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হয়ে মাত্র তিন হাজার টাকা করের বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার প্রদান করেন। ১৬০০ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড়শত বৎসর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে বাণিজ্য করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হলে, নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বণিকের মানদন্ড দেখা দেয় রাজদণ্ডরূপে।



পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ কম্পানি আশংকা করেছিল যে, এদেশের মানুষ এই ষড়যন্ত্র এবং সরাসরি বিদেশি শাসন মেনে নিবে না। তাই তারা ১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত নবাব নামধারী মীরজাফরের বংশধরদের দিয়ে প্রকৃত শাসন ও শোষণ চালাতে থাকে। তবে ভারতবাসিগণ কম্পানির শাসন-শোষণকে মেনে নেয়নি বরং প্রয়োজনবোধে কম্পানির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। মীরকাশিম শেষ চেষ্টা করেছিলেন তাঁর শ্বশুর মীরজাফর এবং নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে, ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন দেশীয় জমিদারদের আর ফকির যোদ্ধাদের ইংরেজের বিরুদ্ধে, কিন্তু বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল, পরপর কাটোয়া, গিরিয়া, উদয়নালা, মুঙ্গের ও পাটনায় ইংরেজের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই করেও তিনি পরাজিত হন। এভাবে চট্টগ্রাম, বর্ধমান আর মেদিনিপুরের জমিদারের অধিকার ইংরেজদের ছেড়ে দেওয়ার মূল্য দিতে হয় মীরকাশিমকে। তার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার মসনদের মালিকানা ও ক্ষমতা এ দেশীয় রাজ পুরুষদের হাতে রাখার সংগ্রামের অবসান ঘটে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় থেকে শুরু কওে ১৭৯৯ টিপু সুলতানের মৃত্যু পর্যন্ত এদেশে স্বাধীনতা রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিটি সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন রাজা, মহারাজা ও নবাব বাদশাগণ। কিন্তু এরপর থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন ভাগ্যাহত-নির্যাতিত মানুষের মধ্য থেকেই কোন অকুতভয় ও আপোসহীন স্বাধীনতাকামী ব্যাক্তি ।



মুঘল শাসনের শেষের দিকে মূলত ফকির ও সন্ন্যাসীদের আবির্ভাব ঘটে ভারতবর্ষে । এরা প্রধানত কৃষক ও কারিগর ছিল কিন্তু তারা রঙিন আলখাল্লা ও কৌপিন পরিধান করত। তারা উত্তরবঙ্গ জুড়ে বসবাস শুরু করে কিন্তু ইংরেজরা তাদের বিভিন্ন প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও তীর্থ যাত্রার উপর কর আরোপ করে। তারা কম্পানির দৈতশাসন ও উৎপীড়নে সর্বশান্ত হয়ে পড়ে এবং ইংরেজ শাষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটাই ছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে বাংলার সাধারণ মানুষের প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল চল্লিশ চৎসর ধরে চলেছিল। ১৭৬৩ সালে একদল সন্ন্যাসীরা রংপুর আক্রমন করে এবং লেফটেন্যান্ট কীনের নেতৃত্বে পরিচালিত একদল ইংরেজী সেনাকে পরাস্ত করে এবং লেফটেন্যান্ট কীন নিহত হয়। ১৭৭২ সালের ৩০ ডিসেম্বর রংপুর শহরের কাছ শ্যামগঞ্জে সন্ন্যাসীরা সমবেত হয়। এখানে ক্যাপ্টেন টমাসের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সন্ন্যাসীদের সংঘর্ষে টমাস নিহত হয়। ফকির বিদ্রোহের প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন মজনু শাহ এবং তার শিষ্যেদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন মুসা শাহ, চেরাগ আলি শাহ, পাগল শাহ, সোবহান শাহ, করিম শাহ, মাদার বক্স, নুরুল মোহাম্মদ, ভবানী পাঠক, কৃপানাথ, পৃতাম্বর, অনুপ নারায়ণ, দেবী চৌধুরানী প্রমুখ।



ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা ফকির ও সন্ন্যাসীদের ‘দস্যু, বলে অভিহিত করেছেন, কারণ ঐ বিদ্রোহের জন্যে কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থাৎ অবাধ লুন্ঠনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু ফকির বা সন্ন্যাসীদের শক্তির আসল উৎস ছিল স্থানীয় জনসাধারণ। অন্যথা ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত চল্লিশ বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলতে পারত না। উইলিয়াম হান্টারের মতে, ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহে উৎসাহিত হয়ে মুঘল সাম্রাজের ধ্বংসপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর বেকার ও বুভুক্ষ সৈন্যগণও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল। হান্টারের ও ওম্যালের মতে বিদ্রোহীদের সংখ্যা এক সময় পঞ্চাশ হাজারে উন্নীত হয়েছিল। ১৮০০ সালের দিকে এ আন্দোলন প্রশমিত হয়ে যায় । একটা গণ আন্দোলন সফল হওয়ার জন্য যে যে বৈশিষ্ট থাকা জরুরী যেমন আদর্শ, লক্ষ্য, নেতৃত্ব, সংগঠন, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি কোনটিই এ আন্দোলনের ছিলনা। তবে এ আন্দোলন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে এবং ভারতীয়দের মনে ব্রিটিশদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।



১৭৯৩ সালে ইংরেজরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূচনা করে যার মধ্য দিয়ে এদেশে তারা একধরণের দেশীয় জমিদার শ্রেণী সৃষ্টি করে। এ জমিদার শেণী খাজনা আদায়ের নামে কৃষকদের উপর শুরু করে অকথ্য নির্যাতন । তারপর থেকে ইংরেজ সাহায্যপুষ্ট এই জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকদের সশস্ত্র বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরে পরগনার অত্যচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে ১৮৩৩ সালে শেরপুরের পার্বত্য জাতি গারো এবং হাজংরা এক গণ আন্দোলন গড়ে তোলে । করম শাহ নামক জনৈক দরবেশের নেতৃত্বে এ আন্দোলন সংগঠিত হয়। করম শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র টিপু এ আন্দোনের নেতৃত্ব দেন । প্রায় পাঁচ হাজার কৃষককে তিনি বিদ্রোহে সম্পৃক্ত করেন। তারা শেরপুরের কাছারি আক্রমন করে, থানায় আগুন দেয়, ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘেরাও করে এবং সর্বপরি এক তুখোড় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এর জন্ম দেয়। টিপুর নেতৃত্বে গারো পাহাড় ও শেরপুরের মধ্যবর্তী অঞ্চলের বিদ্রোহীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। টিপুর নাম পাগল চিল বলে সাধারণ মানুষের কাছে এই বিদ্রোহ পাগলপন্থী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। স্মরণীয় যে, মনি সিং-এর নেতৃতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর হাজং অঞ্চলে পুনরায় বিদ্রোহ হয়েছিল। কৃষকদের এ বিদ্রোহ তদানিন্তন জমিদারদের বিরুদ্ধে হলেও এটি মূলত ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল ।



ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চাপে ভারতীয় মুসলমানরা তাদের দীর্ঘ পাঁচশত বছরের প্রভুত্ব হারায় । তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি, সরকারী মান-মর্যাদা ও ভাষা বিপন্ন হয়ে উঠে । সরকারী কাজকর্মে ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ফার্সী ভাষার পরিবর্তে ইংরেজী ভাষার প্রচলন মুসলমানদের মনে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আর মূলত: তাদের এ ক্ষোভ, হতাশা ও বিদ্বেষ প্রকাশ পায় ওয়াহাবী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আব্দুল ওয়াহাব নামে এক আরবীয় ধর্মপ্রমাণ ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম সংস্কারের জন্য এ আন্দোলনের সূচনা করেন তাই এটি ওয়াবী আন্দোলন নামে পরিচিত যার অর্থ হচ্ছে নবজাগরণ। ১৮২০ সালে সৈয়দ আহম্মদ আরবের ওয়াহাবীদের অনুকরণে ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন এর প্রচারাভিযান শুরু করেন । তবে কোলকাতা থেকে মাত্র একুশ মাইল দূরে নীলকুঠি সমাকীর্ণ বারাসত থেকে ১৮৩১ সালে তিতুমীরের নেতৃত্বে ওয়াহাবীদের বিদ্রোহ চুড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে । উত্তর ভারতের বিখ্যাত ও সনামধন্য ওয়াহাবী ধর্ম প্রচারক, ইসলামকে বিশুদ্ধরূপে পুনরুজ্জীবন দানের আন্দোলনের নেতা এবং বিধর্মী ইংরেজ ও শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকারী সৈয়দ আহমদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম শিষ্য তিতুমীর বা নিসার আলী কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। এই বিদ্রোহ ছিল গরিব মুসলমান কৃষকদের বিদ্রোহ যা জমিদার, নীলকর ও পুলিশের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল।



বিদ্রোহীরা স্থানীয় জমিদার কৃষ্ণ রায়ের কাছারি আক্রমণ করে, নীলকুঠি পুড়িয়ে দেয়, নীল সাহেবদের নাজেহাল এবং থানার দারোগাকে হত্যা করে। বিদ্রোহী ওয়াহাবীদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন গোলাম মাসুল। ১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর ক্যালকাটা মিলিশিয়ার একটি বাহিনী ওয়াহাবীদের দমনের জন্যে ঐ অঞ্চলে যায় কিন্তু তারা বিদ্রোহীদের তোপের কাছে পরাজিত হয়। কোলকাতা থেকে তখন আরও পদাতিক ও অশ্বরোহী সৈন্য পাঠান হয়, বিদ্রোহীরা নারিকেল বেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা স্থাপন, প্রতিরক্ষা ব্যূহ স্থাপন করে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন। ৩৫০ জন ওয়াহাবী বন্দি হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজনের ফাঁসি ও ১৪০ জনের কারাদণ্ড হয়। ওয়াহাবীরা গোড়ামীর আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের দৃষ্টি ছিল পশ্চাৎমুখী। ওয়াহাবীদের প্রভাবেই বাঙালি মুসলমান দীর্ঘকাল পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষায় বিমুখ ছিল, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ওয়াহাবীদের ইংরেজবিরোধী চরিত্র ও সংগ্রামের কোন তুলনা নেই। উইলিয়াম হান্টারের মতে, ওয়াবীরা ধর্মের দিক দিয়ে ছিল ইওরোপের চরমপন্থী “অ্যানাবাপটিস্ট” ও “ফিফথমনারকি”-র ন্যায় এবং রাজনীতির দিক দিয়া ছিল “রিপাবলিকান” বা “কমিউনিস্টদে”র ন্যায়। যাহা হউক, ওয়াহাবী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে পরণত হয় ।



“ফারায়েজী” শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ “ফরজ” থেকে যার অর্থ হল অবশ্য পালনীয় । ১৮০৪ সালে ফরিদপুর নিবাসী এ আন্দোলনের সূচনা করে । পরবর্তীতে এটি ওয়াহাবী আন্দোলনের সাথে একীভূত হয়ে যায় । যার ফলে তিতুমীরের মৃত্যুতে ওয়াহাবী আন্দোলন থেমে যায়নি বরং ১৮৩৮ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত তাদের সংগ্রাম অব্যাহত গতিতে চলেছিল। ফরিদপুর জেলা এবং তার আশপাশ এই সময় এই আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল । ফরিদপুরের সংগ্রামীরাই মূলত: ‘ফরাজী’ নামে পরিচিত ছিল আর হাজী শরিয়তউল্লাহ ছিলেন এই আন্দোলনেরর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ওয়াহাবী মতাদর্শে অর্থাৎ ইসলামী শাসন ব্যাবস্থায় বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিদেশী ও বিধর্মী শাসনের অধিনে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিকাশ সম্ভব নয় । যার জন্য তিনি ব্রিটিশ ভারতকে দারুল হারব বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তিনি মুসলমানদেরকে জুমআ ও ঈদের নামাজ বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার আহ্বানে ফরিদপুর ও তার আশেপাশের কারিগর, কৃষক, তাঁতী, জেলে সাম্প্রদায়ের মুসলমানগণ ব্যপকভাবে সাড়া দেয়। তার মৃত্যুর পরে আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তারই পুত্র দুধু মিয়া। ১৮৩৮ থেকে ১৮৪৬ সালের মধ্যে বেশ কয়েকবার ফরাজীরা জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আস্ত্রধারণ করে এবং দুদু মিয়া কারাবরণও করেন। ১৮৪৬ সালের ৫ ডিসেম্বর দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরাজীরা পঞ্চচরের নীলকুঠি ও জমিদার লুঠ করে নেয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় দুধু মিয়া পুনরায় বন্দি হন এবং আলিপুর জেলে আটক থাকেন। পূর্ব বঙ্গের মুসলমান সমাজে ফরাজীদের প্রভাব পড়েছিল খুব বেশি। এ আন্দোলনের প্রভাব ছিল অত্যন্ত সূদুর প্রসারী। যদিও শরিয়তুল্লাহর আন্দোলন বাংলাকে স্বাধীন করতে ব্যর্থ হয়েছিল তথাপি এটি মুসলমানদের ভিতর এক আলোড়ন সৃস্টি করেছিল। এ আন্দোলন তৎকালীন বাংলার মুসলমানদেরকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করেছিল। মুসলমানরা তখন সুসংগঠিতভাবে অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর বণিকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা যুক্তিবাদী ও আত্মবিশ্বাসী হয়।



১৮৫৬ সালে লর্ড ক্যানিং ভারতের গভর্নর-জেনারেল পদে নিযুক্ত হয়ে আসেন। তাঁর আমলের সর্বাধিক গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনা হল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ ঘটনার নামকরণ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। সরকারী বিবরণে, এটি সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। তবে ভারতীয় ঐতিহাসিকগণ একে জাতীয় সংগ্রাম নাম দিয়েছেন। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের ঠিক একশত বৎসর পরে ১৮৫৭ সালে ঘটে সিপাহী বিদ্রোহ। ভারতীয় ঐতিহাসিক কর্তৃক এ বিদ্রোহ ‘প্রথম জাতীয় অভ্যুত্থানে’র মর্যাদা লাভ করে। সিপাহীদের এরকম ছোটখাট বিদ্রোহ আগেও একাধিকবার হয়েছিল। যখন ১৭৬৪ সালে ইংরেজরা নবাব মীরকাশিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল তখন দেশীয় সৈনিকদের একটি ব্যাটেলিয়ান বিদ্রোহ করে এবং তাদের ২৪ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। বাংলাদেশের ইংরেজী ভাষায় শিক্ষিত ও প্রভাবশালী দেশীয় সমাজ নিরপেক্ষ থাকলেও অন্য দিকে বহরপুর, ব্যারাকপুর, জলপাইগুড়ি, ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিপাহীরা এই বিদ্রোহে যোগদান করে যখন ১৮২৪ সালে ব্যারাকপুরে দেশীয় সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। হাবিলদার রজব আলির নেতৃত্বে একটি পদাতিক বাহিনী ১৮৫৭ সালের ১৮ই নভেম্বর চট্টগ্রামে বিদ্রোহ ঘোষণা করে আর এটিই মূলত: সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ নামে পরিচিত। এখানে উল্লেখ্য যে, এই চট্টগ্রামেই ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্য সেন আর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন রফিক বিদ্রোহ করেন।



১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রামের বিদ্রোহীরা ব্যারাক ত্যাগ করে যায় এবং ট্রেজারি লুঠ করে, জেলখানা খুলে দেয়, অস্ত্রাগারে আগুন দেয়। এ সময় হাবিলদার রজব আীল তাদের নেতৃত্ব দেন । বিদ্রোহী সিপাইরা সীতাকুন্ড ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পথে উদয়পুর হয়ে পার্বত্য ত্রিপুরার আগরতলার দিকে যাত্রা করে । কিন্তু ত্রিপুরার রাজা ইংরেজ পক্ষ অবলম্বন করে যার কারনে বিদ্রোহীরা সিঙ্গারবিল হয়ে মনিপুরে যায়। পথিমধ্যে বিদ্রোহীরা সিলেটের লাতুত নামক স্থানে ইংরেজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় । এই যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি বায়ঙ্গ নিহত হয়। যখন বিদ্রোহীরা মনিপুরে উপস্থিত হয় স্থানীয় এক রাজপুত্র তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। কিন্তু সিলেট থেকে আর এক দল সেনাবাহিনী মনিপুরে পাঠানো হয় এবং তাদের কাছে বিদ্রোহীরা সোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। চারশত বিদ্রোহী সৈনিক এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কিন্তু তাদের তিনশত জনই তাদের প্রাণ দেয়। বাকিরা বিদ্রোহীরা পালিয়ে যায় কিন্তু আত্মসমর্পণ করে না। চট্টগ্রামের বিদ্রোহের চারদিন পরে ২২ নভেম্বর তারিখে, ঢাকার সিপাহীরা বিদ্রোহ করে আর সেই দিনই দেশীয় গোলন্দাজ বাহিনীকে নিরস্ত্র করা হয়।¡ ইংরেজ বাহিনী লালবাগের বিদ্রোহী সিপাহীদের ঘেরাও করায় চেষ্টা করলে উভয় পক্ষই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে । এটি লালবাগ যুদ্ধ নামে পরিচিত । আর এ যুদ্ধে লে. লাইস ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ।



সর্বপ্রথম বাঙালি পুলিশ বাহিনী সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিল ১৮৫৮ সালের ১৩ ই জুলাই। তদানীন্তন জিওসি ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৩/৮ নং কোম্পানী এই বিদ্রোহ দমন করতে গেলে সংঘর্ষে উভয় পক্ষে প্রায় ২৫ জন হতাহত হয়েছিল। এ মহা সিপাহী বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে, লালবাগ যুদ্ধে, ঢাকার বিদ্রোহী সিপাহীদের অনেকেই ইংরেজের হাতে বন্দি হয় এবং তাদের সবাইকে ভিক্টোরিয়া পার্কে অর্থাৎ বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্কে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল । সিপাহী বিদ্রোহের সময় তবে লালবাগ যুদ্ধের পর বিদ্রোহীদের একটি বাহিনী জলপাইগুড়ি যাত্রা করে । কিন্তু পথিমধ্যে তারা রংপুরের নিকটে ইংরেজ সেনাবাহিনী দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয়। সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয় । এই সংঘর্ষের বিদ্রোহীরা মূল বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ভুটান ও নেপাল হয়ে অযোধ্যায় গমন করে। সেখানে বিভিন্ন যুদ্ধে এই বীর সৈনিকদের সকলেই একে একে নিহত হয়। এই বিদ্রোহকে জাতীয় অভ্যুত্থান বলে আখ্যা দেওয়া হয় কারণ সিপাহী বিদ্রোহে দেশীয় রাজা ও সামন্তদের অনেকেই যোগদান করেছিলেন । এই বিদ্রোহের নেতারা ইংরেজের বিরুদ্ধে দেশের সর্বশ্রেণীর ও সর্বসম্প্রদায়ের মানুষকে একতাবদ্ধ করার যে চেষ্টা করেছিল তা এ বিদ্রোহের বিভিন্ন ঘোষণাপত্র ও আলোচ্য সূচী থেকেও প্রমাণ করা যায়। জাতীয় অভ্যুত্থান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, সিপাহী বিদ্রোহের সময় হিন্দু ও মুসলমানেরা একযোগে যুদ্ধ করেছিল এবং শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহকে নেতৃত্বে বরণ করতে চেয়েছিল যার কারণে এ বিদ্রোহ ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ ।প্রাচ্যে বিশেষ করে ভারতবর্ষে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংরেজগণ ১৬০০ সালে ২১৮ জন সদস্য নিয়ে লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি বণিক সংঘ গঠন করে এবং ৩১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের কাছ থেকে ভারতে বাণিজ্যের একচেটিয়া সনদ লাভ করে। অল্পদিনের মধ্যে তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন যায়গায় কুঠি স্থাপন করে। ১৬৬৮ সালে ঢাকা শহরে কোম্পানি কুঠি স্থাপন করে আর কোলকাতায় ১৬৯৮ সালে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলার সুবেদার শাহজাদা সুজা ইংরেজ চিকিৎসক জিব্রাইল ব্রাউটনের চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হয়ে মাত্র তিন হাজার টাকা করের বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার প্রদান করেন। ১৬০০ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড়শত বৎসর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে বাণিজ্য করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হলে, নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বণিকের মানদন্ড দেখা দেয় রাজদণ্ডরূপে।



পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ কম্পানি আশংকা করেছিল যে, এদেশের মানুষ এই ষড়যন্ত্র এবং সরাসরি বিদেশি শাসন মেনে নিবে না। তাই তারা ১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত নবাব নামধারী মীরজাফরের বংশধরদের দিয়ে প্রকৃত শাসন ও শোষণ চালাতে থাকে। তবে ভারতবাসিগণ কম্পানির শাসন-শোষণকে মেনে নেয়নি বরং প্রয়োজনবোধে কম্পানির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। মীরকাশিম শেষ চেষ্টা করেছিলেন তাঁর শ্বশুর মীরজাফর এবং নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে, ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন দেশীয় জমিদারদের আর ফকির যোদ্ধাদের ইংরেজের বিরুদ্ধে, কিন্তু বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল, পরপর কাটোয়া, গিরিয়া, উদয়নালা, মুঙ্গের ও পাটনায় ইংরেজের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই করেও তিনি পরাজিত হন। এভাবে চট্টগ্রাম, বর্ধমান আর মেদিনিপুরের জমিদারের অধিকার ইংরেজদের ছেড়ে দেওয়ার মূল্য দিতে হয় মীরকাশিমকে। তার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার মসনদের মালিকানা ও ক্ষমতা এ দেশীয় রাজ পুরুষদের হাতে রাখার সংগ্রামের অবসান ঘটে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় থেকে শুরু কওে ১৭৯৯ টিপু সুলতানের মৃত্যু পর্যন্ত এদেশে স্বাধীনতা রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিটি সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন রাজা, মহারাজা ও নবাব বাদশাগণ। কিন্তু এরপর থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন ভাগ্যাহত-নির্যাতিত মানুষের মধ্য থেকেই কোন অকুতভয় ও আপোসহীন স্বাধীনতাকামী ব্যাক্তি ।



মুঘল শাষণের শেষের দিকে মূলত ফকির ও সন্ন্যাসীদের আবির্ভাব ঘটে ভারতবর্ষে । এরা প্রধানত কৃষক ও কারিগর ছিল কিন্তু তারা রঙিন আলখাল্লা ও কৌপিন পরিধান করত। তারা উত্তরবঙ্গ জুড়ে বসবাস শুরু করে কিন্তু ইংরেজরা তাদের বিভিন্ন প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও তীর্থ যাত্রার উপর কর আরোপ করে। তারা কম্পানির দৈতশাসন ও উৎপীড়নে সর্বশান্ত হয়ে পড়ে এবং ইংরেজ শাষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটাই ছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে বাংলার সাধারণ মানুষের প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল চল্লিশ চৎসর ধরে চলেছিল। ১৭৬৩ সালে একদল সন্ন্যাসীরা রংপুর আক্রমন করে এবং লেফটেন্যান্ট কীনের নেতৃত্বে পরিচালিত একদল ইংরেজী সেনাকে পরাস্ত করে এবং লেফটেন্যান্ট কীন নিহত হয়। ১৭৭২ সালের ৩০ ডিসেম্বর রংপুর শহরের কাছ শ্যামগঞ্জে সন্ন্যাসীরা সমবেত হয়। এখানে ক্যাপ্টেন টমাসের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সন্ন্যাসীদের সংঘর্ষে টমাস নিহত হয়। ফকির বিদ্রোহের প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন মজনু শাহ এবং তার শিষ্যেদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন মুসা শাহ, চেরাগ আলি শাহ, পাগল শাহ, সোবহান শাহ, করিম শাহ, মাদার বক্স, নুরুল মোহাম্মদ, ভবানী পাঠক, কৃপানাথ, পৃতাম্বর, অনুপ নারায়ণ, দেবী চৌধুরানী প্রমুখ।



ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা ফকির ও সন্ন্যাসীদের ‘দস্যু, বলে অভিহিত করেছেন, কারণ ঐ বিদ্রোহের জন্যে কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থাৎ অবাধ লুন্ঠনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু ফকির বা সন্ন্যাসীদের শক্তির আসল উৎস ছিল স্থানীয় জনসাধারণ। অন্যথা ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত চল্লিশ বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলতে পারত না। উইলিয়াম হান্টারের মতে, ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহে উৎসাহিত হয়ে মুঘল সাম্রাজের ধ্বংসপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর বেকার ও বুভুক্ষ সৈন্যগণও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল। হান্টারের ও ওম্যালের মতে বিদ্রোহীদের সংখ্যা এক সময় পঞ্চাশ হাজারে উন্নীত হয়েছিল। ১৮০০ সালের দিকে এ আন্দোলন প্রশমিত হয়ে যায় । একটা গণ আন্দোলন সফল হওয়ার জন্য যে যে বৈশিষ্ট থাকা জরুরী যেমন আদর্শ, লক্ষ্য, নেতৃত্ব, সংগঠন, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি কোনটিই এ আন্দোলনের ছিলনা। তাছাড়া নানাবিধ সমস্যার কারনে এ আন্দোলন তেমন কোন সুসংহত রূপ পরিগ্রহ করতে পারে নাই। তবে এ আন্দোলন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে এবং ভারতীয়দের মনে ব্রিটিশদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।



১৭৯৩ সালে ইংরেজরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূচনা করে যার মধ্য দিয়ে এদেশে তারা একধরণের দেশীয় জমিদার শ্রেণী সৃষ্টি করে। এ জমিদার শেণী খাজনা আদায়ের নামে কৃষকদের উপর শুরু করে অকথ্য নির্যাতন । তারপর থেকে ইংরেজ সাহায্যপুষ্ট এই জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকদের সশস্ত্র বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরে পরগনার অত্যচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে ১৮৩৩ সালে শেরপুরের পার্বত্য জাতি গারো এবং হাজংরা এক গণ আন্দোলন গড়ে তোলে । করম শাহ নামক জনৈক দরবেশের নেতৃত্বে এ আন্দোলন সংগঠিত হয়। করম শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র টিপু এ আন্দোনের নেতৃত্ব দেন । প্রায় পাঁচ হাজার কৃষককে তিনি বিদ্রোহে সম্পৃক্ত করেন। তারা শেরপুরের কাছারি আক্রমন করে, থানায় আগুন দেয়, ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘেরাও করে এবং সর্বপরি এক তুখোড় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এর জন্ম দেয়। টিপুর নেতৃত্বে গারো পাহাড় ও শেরপুরের মধ্যবর্তী অঞ্চলের বিদ্রোহীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। টিপুর নাম পাগল চিল বলে সাধারণ মানুষের কাছে এই বিদ্রোহ পাগলপন্থী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। স্মরণীয় যে, মনি সিং-এর নেতৃতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর হাজং অঞ্চলে পুনরায় বিদ্রোহ হয়েছিল। কৃষকদের এ বিদ্রোহ তদানিন্তন জমিদারদের বিরুদ্ধে হলেও এটি মূলত ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল ।



ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদেও চাপে ভারতীয় মুসলমানরা তাদের দীর্ঘ পাঁচশত বছরের প্রভুত্ব হারায় । তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি, সরকারী মান-মর্যাদা ও ভাষা বিপন্ন হয়ে উঠে । সরকারী কাজকর্মে ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ফার্সী ভাষার পরিবর্তে ইংরেজী ভাষার প্রচলন মুসলমানদের মনে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আর মূলত: তাদের এ ক্ষোভ, হতাশা ও বিদ্বেষ প্রকাশ পায় ওয়াহাবী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আব্দুল ওয়াহাব নামে এক আরবীয় ধর্মপ্রমাণ ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম সংস্কারের জন্য এ আন্দোলনের সূচনা করেন তাই এটি ওয়াবী আন্দোলন নামে পরিচিত যার অর্থ হচ্ছে নবজাগরণ। ১৮২০ সালে সৈয়দ আহম্মদ আরবের ওয়াহাবীদের অনুকরণে ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন এর প্রচারাভিযান শুরু করেন । তবে কোলকাতা থেকে মাত্র একুশ মাইল দূরে নীলকুঠি সমাকীর্ণ বারাসত থেকে ১৮৩১ সালে তিতুমীরের নেতৃত্বে ওয়াহাবীদের বিদ্রোহ চুড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে । উত্তর ভারতের বিখ্যাত ও সনামধন্য ওয়াহাবী ধর্ম প্রচারক, ইসলামকে বিশুদ্ধরূপে পুনরুজ্জীবন দানের আন্দোলনের নেতা এবং বিধর্মী ইংরেজ ও শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকারী সৈয়দ আহমদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম শিষ্য তিতুমীর বা নিসার আলী কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। এই বিদ্রোহ ছিল গরিব মুসলমান কৃষকদের বিদ্রোহ যা জমিদার, নীলকর ও পুলিশের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল।



বিদ্রোহীরা স্থানীয় জমিদার কৃষ্ণ রায়ের কাছারি আক্রমণ করে, নীলকুঠি পুড়িয়ে দেয়, নীল সাহেবদের নাজেহাল এবং থানার দারোগাকে হত্যা করে। বিদ্রোহী ওয়াহাবীদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন গোলাম মাসুল। ১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর ক্যালকাটা মিলিশিয়ার একটি বাহিনী ওয়াহাবীদের দমনের জন্যে ঐ অঞ্চলে যায় কিন্তু তারা বিদ্রোহীদের তোপের কাছে পরাজিত হয়। কোলকাতা থেকে তখন আরও পদাতিক ও অশ্বরোহী সৈন্য পাঠান হয়, বিদ্রোহীরা নারিকেল বেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা স্থাপন, প্রতিরক্ষা ব্যূহ স্থাপন করে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন। ৩৫০ জন ওয়াহাবী বন্দি হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজনের ফাঁসি ও ১৪০ জনের কারাদণ্ড হয়। ওয়াহাবীরা গোড়ামীর আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের দৃষ্টি ছিল পশ্চাৎমুখী। ওয়াহাবীদের প্রভাবেই বাঙালি মুসলমান দীর্ঘকাল পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষায় বিমুখ ছিল, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ওয়াহাবীদের ইংরেজবিরোধী চরিত্র ও সংগ্রামের কোন তুলনা নেই। উইলিয়াম হান্টারের মতে, ওয়াবীরা ধর্মের দিক দিয়ে ছিল ইওরোপের চরমপন্থী “অ্যানাবাপটিস্ট” ও “ফিফথমনারকি”-র ন্যায় এবং রাজনীতির দিক দিয়া ছিল “রিপাবলিকান” বা “কমিউনিস্টদে”র ন্যায়। যাহা হউক, ওয়াহাবী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে পরণত হয় ।



“ফারায়েজী” শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ “ফরজ” থেকে যার অর্থ হল অবশ্য পালনীয় । ১৮০৪ সালে ফরিদপুর নিবাসী এ আন্দোলনের সূচনা করে । পরবর্তীতে এটি ওয়াহাবী আন্দোলনের সাথে একীভূত হয়ে যায় । যার ফলে তিতুমীরের মৃত্যুতে ওয়াহাবী আন্দোলন থেমে যায়নি বরং ১৮৩৮ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত তাদের সংগ্রাম অব্যাহত গতিতে চলেছিল। ফরিদপুর জেলা এবং তার আশপাশ এই সময় এই আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল । ফরিদপুরের সংগ্রামীরাই মূলত: ‘ফরাজী’ নামে পরিচিত ছিল আর হাজী শরিয়তউল্লাহ ছিলেন এই আন্দোলনেরর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ওয়াহাবী মতাদর্শে অর্থাৎ ইসলামী শাসন ব্যাবস্থায় বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিদেশী ও বিধর্মী শাসনের অধিনে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিকাশ সম্ভব নয় । যার জন্য তিনি ব্রিটিশ ভারতকে দারুল হারব বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তিনি মুসলমানদেরকে জুমআ ও ঈদের নামাজ বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার আহ্বানে ফরিদপুর ও তার আশেপাশের কারিগর, কৃষক, তাঁতী, জেলে সাম্প্রদায়ের মুসলমানগণ ব্যপকভাবে সাড়া দেয়। তার মৃত্যুর পরে আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তারই পুত্র দুধু মিয়া। ১৮৩৮ থেকে ১৮৪৬ সালের মধ্যে বেশ কয়েকবার ফরাজীরা জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আস্ত্রধারণ করে এবং দুদু মিয়া কারাবরণও করেন। ১৮৪৬ সালের ৫ ডিসেম্বর দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরাজীরা পঞ্চচরের নীলকুঠি ও জমিদার লুঠ করে নেয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় দুধু মিয়া পুনরায় বন্দি হন এবং আলিপুর জেলে আটক থাকেন। পূর্ব বঙ্গের মুসলমান সমাজে ফরাজীদের প্রভাব পড়েছিল খুব বেশি। এ আন্দোলনের প্রভাব ছিল অত্যন্ত সূদুর প্রসারী। যদিও শরিয়তুল্লাহর আন্দোলন বাংলাকে স্বাধীন করতে ব্যর্থ হয়েছিল তথাপি এটি মুসলমানদের ভিতর এক আলোড়ন সৃস্টি করেছিল। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা যুক্তিবাদী ও আত্মবিশ্বাসী হয়।



১৮৫৬ সালে লর্ড ক্যানিং ভারতের গভর্নর-জেনারেল পদে নিযুক্ত হয়ে আসেন। তাঁর আমলের সর্বাধিক গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনা হল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ ঘটনার নামকরণ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। সরকারী বিবরণে, এটি সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। তবে ভারতীয় ঐতিহাসিকগণ একে জাতীয় সংগ্রাম নাম দিয়েছেন। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের ঠিক একশত বৎসর পরে ১৮৫৭ সালে ঘটে সিপাহী বিদ্রোহ। ভারতীয় ঐতিহাসিক কর্তৃক এ বিদ্রোহ ‘প্রথম জাতীয় অভ্যুত্থানে’র মর্যাদা লাভ করে। সিপাহীদের এরকম ছোটখাট বিদ্রোহ আগেও একাধিকবার হয়েছিল। যখন ১৭৬৪ সালে ইংরেজরা নবাব মীরকাশিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল তখন দেশীয় সৈনিকদের একটি ব্যাটেলিয়ান বিদ্রোহ করে এবং তাদের ২৪ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। বাংলাদেশের ইংরেজী ভাষায় শিক্ষিত ও প্রভাবশালী দেশীয় সমাজ নিরপেক্ষ থাকলেও অন্য দিকে বহরপুর, ব্যারাকপুর, জলপাইগুড়ি, ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিপাহীরা এই বিদ্রোহে যোগদান করে যখন ১৮২৪ সালে ব্যারাকপুরে দেশীয় সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। হাবিলদার রজব আলির নেতৃত্বে একটি পদাতিক বাহিনী ১৮৫৭ সালের ১৮ই নভেম্বর চট্টগ্রামে বিদ্রোহ ঘোষণা করে আর এটিই মূলত: সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ নামে পরিচিত। এখানে উল্লেখ্য যে, এই চট্টগ্রামেই ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্য সেন আর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন রফিক বিদ্রোহ করেন।



১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রামের বিদ্রোহীরা ব্যারাক ত্যাগ করে যায় এবং ট্রেজারি লুঠ করে, জেলখানা খুলে দেয়, অস্ত্রাগারে আগুন দেয়। এ সময় হাবিলদার রজব আীল তাদের নেতৃত্ব দেন । বিদ্রোহী সিপাইরা সীতাকুন্ড ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পথে উদয়পুর হয়ে পার্বত্য ত্রিপুরার আগরতলার দিকে যাত্রা করে । কিন্তু ত্রিপুরার রাজা ইংরেজ পক্ষ অবলম্বন করে যার কারনে বিদ্রোহীরা সিঙ্গারবিল হয়ে মনিপুরে যায়। পথিমধ্যে বিদ্রোহীরা সিলেটের লাতুত নামক স্থানে ইংরেজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় । এই যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি বায়ঙ্গ নিহত হয়। যখন বিদ্রোহীরা মনিপুরে উপস্থিত হয় স্থানীয় এক রাজপুত্র তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। কিন্তু সিলেট থেকে আর এক দল সেনাবাহিনী মনিপুরে পাঠানো হয় এবং তাদের কাছে বিদ্রোহীরা সোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। চারশত বিদ্রোহী সৈনিক এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কিন্তু তাদের তিনশত জনই তাদের প্রাণ দেয়। বাকিরা বিদ্রোহীরা পালিয়ে যায় কিন্তু আত্মসমর্পণ করে না। চট্টগ্রামের বিদ্রোহের চারদিন পরে ২২ নভেম্বর তারিখে, ঢাকার সিপাহীরা বিদ্রোহ করে আর সেই দিনই দেশীয় গোলন্দাজ বাহিনীকে নিরস্ত্র করা হয়।¡ ইংরেজ বাহিনী লালবাগের বিদ্রোহী সিপাহীদের ঘেরাও করায় চেষ্টা করলে উভয় পক্ষই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে । এটি লালবাগ যুদ্ধ নামে পরিচিত । আর এ যুদ্ধে লে. লাইস ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ।



বাঙালি পুলিশ বাহিনী সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিল ১৮৫৮ সালের ১৩ ই জুলাই। তদানীন্তন জিওসি ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৩/৮ নং কোম্পানী এই বিদ্রোহ দমন করতে গেলে সংঘর্ষে উভয় পক্ষে প্রায় ২৫ জন হতাহত হয়েছিল। এ মহা সিপাহী বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে, লালবাগ যুদ্ধে, ঢাকার বিদ্রোহী সিপাহীদের অনেকেই ইংরেজের হাতে বন্দি হয় এবং তাদের সবাইকে ভিক্টোরিয়া পার্কে অর্থাৎ বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্কে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল । সিপাহী বিদ্রোহের সময় তবে লালবাগ যুদ্ধের পর বিদ্রোহীদের একটি বাহিনী জলপাইগুড়ি যাত্রা করে । কিন্তু পথিমধ্যে তারা রংপুরের নিকটে ইংরেজ সেনাবাহিনী দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয়। সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয় । এই সংঘর্ষের বিদ্রোহীরা মূল বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ভুটান ও নেপাল হয়ে অযোধ্যায় গমন করে। সেখানে বিভিন্ন যুদ্ধে এই বীর সৈনিকদের সকলেই একে একে নিহত হয়। এই বিদ্রোহকে জাতীয় অভ্যুত্থান বলে আখ্যা দেওয়া হয় কারণ সিপাহী বিদ্রোহে দেশীয় রাজা ও সামন্তদের অনেকেই যোগদান করেছিলেন । এই বিদ্রোহের নেতারা ইংরেজের বিরুদ্ধে দেশের সর্বশ্রেণীর ও সর্বসম্প্রদায়ের মানুষকে একতাবদ্ধ করার যে চেষ্টা করেছিল তা এ বিদ্রোহের বিভিন্ন ঘোষণাপত্র ও আলোচ্য সূচী থেকেও প্রমাণ করা যায়। জাতীয় অভ্যুত্থান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, সিপাহী বিদ্রোহের সময় হিন্দু ও মুসলমানেরা একযোগে যুদ্ধ করেছিল এবং শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহকে নেতৃত্বে বরণ করতে চেয়েছিল যার কারণে এ বিদ্রোহ ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ ।



১৭৭৭ সালে এ বাংলায় লুই বন্নো নামে এক ব্যাক্তি প্রথম নীল চাষের সূচনা করে । ক্যারেল ব্লম নামক একজন ইংরেজ প্রথম এদেশে নীলকুঠি স্থাপন করে এবং কম্পানিকে নীলচাষের লাভজনক দিক সম্পর্কে অবহিত করে । ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে নীলের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ইংরেজরা নানা কৌশলে চাষীদেরকে নীল চাষে বাধ্য করে । কিন্তু এ নীল চাষ ছিল চাষীদের নিকট একটা লোকসানের বিষয় এবং নীলক দের নিকট ছিল একটা অল্প পুঁজিতে অধিক মুনাফা অর্জনের মাধ্যম। তাছাড়া এ নীল চাষ জমির উর্বরতা নষ্ট করে ফেলে। তাই ইংরেজরা কৃষকদেরকে নীল চাষে বাধ্য করত আর চাষীরা তা অস্বীকার করত যার ফলশ্রুতিতে নেমে আসে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন । নীলকরদের অত্যাচারের কারনে, কালক্রমে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা প্রথম জাতীয় অভ্যুত্থান (ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও এই বিদ্রোহের প্রভাবে) বাংলায় প্রজা বিদ্রোহে রূপ নেয়। ১৮৫৯-৬০ সালে নীল চাষের বিরুদ্ধে নীল চাষীদের প্রতিরোধ চরম আকার ধারণ করে। যশোর, নদীয়া ও পাবনা ইত্যাদি জেলায় নীল চাষ বেশি এবং ভালো হত। নীলকরদের অত্যাচার যখন চরমে ওঠে তখন সশস্ত্র কৃষকেরা একযোগে সরকারী অফিস-আদালত ও কাছারি আক্রমণ করে এবং তাতে আগুণ লাগিয়ে দেয়। হিন্দু ও মুসলমান সকলে নির্বিশেষে নীল বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল বাংলার কৃষক হিসেবে। তারা তখন সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব এককথায় ভুলেই গিয়েছিল।



ইংরেজ নীলকরের মতো দেশি জমিদারেরাও ছিল চাষীর শত্রু কারণ অনেক জমিদার নীরকরদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। যেই শত্রুর বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকরা বারবার অস্ত্র ধারণ করেছে। ১৮৭২-৭৩ সালে পাবনা, বগুড়া ও অন্যান্য জেলায় ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ দেখা যায় । পাবনার কৃষক বিদ্রোহ শাসক ও জমিদার মহলে দারুণ ত্রাসের সঞ্চার করেছিল যেহেতু এই বিদ্রোহ ছিল অত্যন্ত সহিংস ও ভয়াবহ। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৮৬৮-৬৯ সালে উত্তর বঙ্গে আবার ওয়াহাবী বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে। আর এই সময়ে বহু ওয়াহাবী নেতাকে বন্দি ও বিচার করা হয়। নীল বিদ্রোহ বাংলার ইতিহাসে একটি সফল গণ-বিদ্রোহ। সাংগঠনিকভাবে এটা ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণ আন্দোলন যা তদানিন্তন নীলকর সাহেব ও কম্পানির ঔপনিবেষিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রচন্ডতম ও সফলতম আঘাত ।



১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন যুগের সুচনা করে ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের আদর্শ রূপায়িত করে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা এক সর্র্বভারতীয় রাজনৈতিক সংস্থা গঠনের ভিত্তি রচনা করেছিল । সিপাহী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, ওয়াহাবী বিদ্রোহ, ফরাজী বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ ইত্যাদি ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম-এর পাশাপাশি ছিল ইংরেজ সমর্থক দেশীয় জমিদার শ্রেণী, ধনী বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এবং দেশীয় অভিজাত শ্রেণী। জাতীয়তাবাদের ধারণা বিকাশ লাভ করে এই ইংরেজ সমর্থকদের মধ্যেই যা পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর এর নেতৃত্বে ১৮৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জমিদার সভা’ । এই সমিতির কার্যক্রম মোটামুটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হইত । ১৮৪৩ সালে ‘বৃটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’ ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ইন্ডিয়ান লীগ’ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয় ইয়ং বেঙ্গলের নেতৃত্বে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ও আনন্দমহোন বসু স্থাপন করেছিলেন ১৮৭৬ সালে ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ ‘বা ‘ভারত সভা’, যা সর্বভারতীয় বৈশিষ্টে মন্ডিত ছিল ।



১৮৮৫ সালে তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনের নির্দেশে ইংরেজ সিভিলিয়ান হিউমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’। ইহার পরবর্তী কুড়ি বছর জাতীয় কংগ্রেস ভারতের রাজনীতিতে গভির প্রতিপত্তি বিস্তার করে এবং ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের আদর্শ রূপায়িত করে। অ্যালান অক্টাভান হিউম এই আদর্শকে রূপ দেয়ার জন্য সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বোম্বাইতে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় যাতে ভারতীয় ধনী, পুঁজিপতি, বুদ্ধিজীবী ডব্লু, সি. ব্যানার্জি, ফিরোজ শাহ্ মেহতা, দাদাভাই নওরোজি, গোপালকৃষ্ণ গোখেল, বদরুদ্দিন তায়েবজী, রমেশচন্দ্র দত্ত ইত্যাদি যোগদান করেছিলেন। স্মরণীয় যে, প্রথম সারা ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ক্ষেত্রে কংগ্রেসই সমর্থন দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, ভারতবাসীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েই অ্যালান অক্টাভান হিউম জাতীয় কংগ্রেস গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের পরে একশত বছরের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ফলে যে নতুন সমাজের উদ্ভব হয়, জাতীয় কংগ্রেস ছিল তার কেন্দ্রীয় সংগঠন।



১৯০৫ সালের পূর্বে “বাংলা প্রেসিডেন্সি” ছিল ভারতের সর্ববৃহৎ প্রদেশ । ১৮৫৪ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম লইয়া বাংলার প্রেসিডেন্সি গঠিত ছিল এবং এর প্রশাসনিক দায়িত্ব একজন লেফটেনান্ট-গভর্নরের হাতে ন্যাস্ত ছিল । ১৯০৫ সালের ৫ই জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত সরকারী ভাবে ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯০৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর লর্ড কার্জনের বাংলা বিভাগকে কেন্দ্র করে বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। তখন পূর্ব বাংলাকে অর্থাৎ ঢাকা, চট্টগ্রাম পার্বত্য ত্রিপুরা, দার্জিলিং ও রাজশাহী বিভাগকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নতুন প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর এটা শাসনকার্যে সুবিধা পাওয়ার জন্যই করা হয়। প্রকৃতক্ষে, এ সিদ্ধান্ত ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে কার্যকর শুরু হয়। স্যার ব্যামফিল্ড ও এন্ড্রু ফ্রেজার বঙ্গভঙ্গের জন্য ভারতের বড় লাট লর্ড কার্জনকে নানাভাবে পরামর্শ ও সাহায্য করেছিলেন যার ফলশ্রুতিতে তারা দু’জনই দুই বঙ্গের গভর্নর নিযুক্ত হন। ঢাকা হয় নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের নতুন রাজধানী।



এখানে উল্লেখ্য যে, ঢাকার নতুন শহর বা রমনা অঞ্চল তখন থেকেই গড়ে ওঠে। সেই সময়ে পাঞ্জাবের একটি অংশকে উত্তর-পশ্চিম এলাকার সঙ্গে জুড়ে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ গঠন করা হয়েছিল। যদিও সেখানে এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ হয়নি তথাপি তখন বাংলাদেশে শিক্ষিত হিন্দু-সমাজের মধ্যে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঢাকার নবাব বাহাদুর স্যার সলিমূল্লাহ সহ অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ এ বঙ্গভঙ্গের সমর্থন দিয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন অচিরেই চরমপন্থীদের প্রাধান্য সাম্প্রদায়িক হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ‘শিবাজী উৎসবের’ মধ্য দিয়ে এই সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ১৮৯৭ সালে বম্মেতে শুরু হয়েছিল। ১৯০৪ সালে কোলকাতায় ‘শিবাজি উৎসব’ আন্দোলন শুরু করেন সখারাম গণেশ দেউসূর। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ১৯০৬ সালে কোলকাতায় ‘শিবাজী উৎসব’-এর আয়োজন করেন। ‘ভবানী পূজা’ ছিল এই উৎসবের অন্যতম অনুষ্ঠান। শিবাজী উৎসব ও ভবানী পূজকে কেন্দ্র করে মহারাষ্ট্র থেকে তিলক খাপার্দে মুঞ্জেকে কোলকাতায় আনা হয়। এই উৎসবের উদ্বোধন হয় লোকমান্য তিলক এর নেতৃতে।



ভারত-মাতার একখানি ছবি শোভাযাত্রার অগ্রভাগে দিয়ে তিলক একদিন ত্রিশ হাজার লোক নিয়ে গঙ্গাস্নানে যান। প্রকৃতপক্ষে, এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সকল নেতা বিশেষ করে তিলক, অরবিন্দ, বিপিনচন্দ্র, ব্রহ্মবান্ধব পৌরাণিক হিন্দুত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবোধে বিশ্বাসী ছিল। এই পথ ছিল বঙ্কিম প্রদর্শিত ও অনুপ্রাণিত । হিন্দু সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের ভাবনাই ছিল অরবিন্দ ও তাঁর দলের জাতীয়তাবোধের আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এসব দিক বিবেচনা করেই ভারতীয় ঐতিহাসিকগণ মনেকরেন যে ‘বঙ্গভঙ্গ, ও ‘স্বদেশী আন্দোলন’ ‘শিবাজী উৎসব’ বা ‘ভবানী পূজার’ রূপ পরিগ্রহ করেছিল। যার কারণেই বাংলার মুসলমান সমাজ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলন রূপে গ্রহণ করতে পারেনি। এ দেশের ইতিহাস অন্যভাবে লিখা হতে পারত যদি এই আন্দোলন ধর্মনিরপেক্ষ থাকত। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর তারিখে সফলতা লাভ করেছিল । দিল্লির দরবারে সম্রাট পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ রদ করেন, তবে ভারতের রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়, আর পূর্ব বাঙলা সান্ত্বনা হিসেবে ১৯২১ সালে লাভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গ রদ হয় কিন্তু বঙ্গভঙ্গকেন্দ্রিক স্বদেশী আন্দোলন এদেশে যে সাম্প্রদায়িক দাংগার সৃষ্টি করে তার অবসান আর হয় না এদেশের মাটিতে। বাংলা তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদেও প্রতি বঙ্গভঙ্গ ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ । হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃস্টিতে ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গকে একটা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছিল ।



হিন্দুদের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠে এবং জাতীয় কংগ্রেস এই আন্দোলনের সহযোগীতা করে যেতে থাকে। হিন্দু সংগঠন বিশেষ করে জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাব প্রতিপত্তিতে অস্বস্তিবোধ করে মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম জনগণের জন্য একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে । আর সে প্রয়োজনের তাগিদে ১৯০৬ সালে ঢাকায় ‘মুসলিম লীগ’-এর জন্ম হয় যাকে মনে করা হয় যে, ‘মুসলীম লীগ’ বুদ্ধি ‘শিবাজী উৎসব’- এর প্রতিক্রিয়ারই ফল। আর এ ও লক্ষণীয় যে, ‘হিন্দু মহাসভার’ ও জন্ম হয় ১৯০৬ সালে। ১৯০৭ সালে বাংলাদেশে যেমন জামালপুর, কুমিল্লা, পাবনায় প্রথম সরাসরি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়। ১৯০৭ সাল থেকেই সন্ত্রাসবাদীরা ‘অনুশীলন সমিতি’ ইত্যাদির মাধ্যমে রাজনৈতিক হত্যা, লুণ্ঠন শুরু করে ।



১৯০৬ সাল থেকে এই উপমহাদেশের রাজনীতি ধর্ম নিয়ন্ত্রিত রাজনীতিতে অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক আন্দোলনে পরিণত হয়। আর এ জন্য সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ এর লক্ষ্য একটি ভিন্ন মাত্রা নেয়। এর লক্ষ্য ছিল : ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্য সুনিশ্চিত করা। মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ও তাদের দাবি দাওয়া সরকারের নিকট উপস্থাপন করা। কংগ্রেস এর প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করা। অন্যান্য সম্প্রদায়ের সহিত মৈত্রী বজায় রাখা।মুসলিম লীগ বিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমানদের ভাগ্যান্নয়নে ব্রতি হয়। জাতীয় কংগ্রেসের ন্যায় মুসলিম লীগ ভারতীয়দের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে মোটেই পক্ষপাতি ছিল না। মুসলিম লীগ জাতি, ধর্ম, ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য কাজ করেছিল । এটি মূলত: আলীগড় আন্দোলনের আদর্শ ও লক্ষের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল যদিও মুসলিম লীগ ঢাকা থেকে যাত্রা করে । মুসলিম লীগের প্রধান কার্যালয় প্রথমে আলীগড়ে ও পরে লক্ষৌ ছিল। যদিও মুসলিম লীগ ঢাকার নবাব ও তাঁহার সহকর্মীদের প্রচেস্টায় প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলার মসলমানরা কিন্তু এই সংস্থার প্রথম সারির নেতৃপদে কখনও আসতে পারে নাই ।



অনেকে ধর্ম ও রাজনীতিকে একে অপরের পরিপূরক মনে করেন আবার অনেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে চান। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকালে রাজনীতির উত্থান এবং ধর্মীয় মুল্যবোধের জাগরণ ঘটে। অতি প্রাকৃতিক শক্তির নিকট মানুষের পরাজয় যেমন তাকে ধর্মের দিকে ধাবিত করেছে ঠিক তেমনি প্রকৃতিক শক্তির মোকাবেলায় তাদেরকে সংঘবদ্ধ হতে হয়েছে এক জন নেতার অধীনে যেখানে নেতার ক্ষমতায়ন ছিল। এভাবে মানুষের সংঘবদ্ধতা থেকেই সূচনা হয় সভ্যতার।সভ্যতার উত্থান-বিকাশ ও বিনাশের মূলেই ছিল ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় সমতা ও সংঘাত। সভ্রতার ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে -মানুষ তার ক্ষমতায়নে ধর্মকে ব্যবহার করেছে অথবা ধর্ম মানুষকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দান করেছে অথবা ধর্মীয় নেতারাই রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। যেমন প্রচীন মিশরীয়, ব্যবলিনীয় ও সিন্ধু সভ্যতা ইত্যাদি। ইতিহাসের এই ধারা আজ অবধি চলমান।



প্রায় সকল দেশেই, রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব আছে। যেমন - আলজেরিয়ায় ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট, তুরস্কে জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, পাকিস্তানে জামায়েতে ইসলামি, ফিলিস্তিনে হামাস, সুদানে দি উম্মাহ পার্টি, মালয়েশিয়ায় দি প্যান মালয়েশিয়া ইসলামিক পার্টি, ইন্দোনেশিয়ায় দি মুসলিম স্কলার্স পার্টি, জর্ডানে মুসলিম ব্রাদার হুড, শ্রীলঙ্কায় জামায়াতে ইসলামী শ্রীলঙ্কা। প্রমুখ রাজনৈতিক দল নিজ নিজ দেশের রাজনীতিতে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতে ধর্মভিত্তিক দল বিজেপি, জামায়াতে ইসলামী হিন্দ, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, শিব সেনা, ইত্যাদি নামে ধর্মীয় সংঙ্গঠন। ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের যেসব দেশে গণতন্ত্র চালু আছে সেখানেও অন্যান্য ধর্ম ভিওিক দল সক্রিয় ভুমিকা পালন করছে।



ব্রিটিশ যুগে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি (১৮৫৭-১৯৪৭) ছিল। বহু ভাষা,ধর্ম ও বর্ণের বিভিন্ন জনগোষ্টী নিয়ে গঠিত এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনে ধর্মীয় উপদানেই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। বৃটিশরা সর্বভারতীয় স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে দমন ও নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন ক্ষমতা বজায় রাখার লক্ষ্যে ধর্মের ব্যবহার শুরু করে। উল্লেখ্য, লর্ড কার্জনের উদ্যোগে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও ১৯১১ সালে সেটা রদকরণ, ১৯০৫ সালে প্ররোচনা দিয়ে লর্ড মিন্টোর কাছে আগাখানের নেতৃত্বে মুসলিম প্রতিনিধি দল পাঠানোর প্রয়াস, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনে গোপন পরামর্শ এবং ১৯০৯ সালে মর্লিমিন্টো সংস্কার আইন, ১৯৩০ সালে স্যার রামজে ম্যাকডোনাল্ড কর্তৃক ঈড়সসঁহধষ অধিৎফ ঘোষণা, এসব কিছুই ভারতবর্ষে ধর্মীয় রাজনীতিকে স্বীকৃতি দান করে। যার ফলে দুই বৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিষ্টান কংগ্রেস (১৮৮৫) ও মুসলিম লীগ (১৯০৬) এর রাজনীতি হয়ে পড়ে হিন্দু ও মুসলমানদের স্বার্থ আদায়ের রাজনীতি। মূলত গান্ধী ও জিন্নাহ ব্যক্তি জীবনে অসাম্প্রদায়িক হলেও রাজনীতিতে উভয়েই ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। এক পর্যায়ে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে জিন্নাহ ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে বিভক্ত করার প্রস্তাব আনেন এবং ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমেস্বতন্ত্র রাষ্ট্র তথা পাকিস্তান প্রস্তাবের জন্ম দেন। সর্বশেষ পরিণতি হিসাবে ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।



পাকিস্তান যুগ (১৯৪৭-১৯৭১) পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি, ১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্টের সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ধর্মকেন্দ্রীক রাজনীতি পুরোদ্যমে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। রাজনীতির সর্বক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার শুরু হয়। পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী, ইসলামী আর্দশের প্রবক্তা ও মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত মুসলীমলীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই ধর্মকে ব্যবহার শুরু করে। রাষ্টভ্যন্তরের অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক ও শ্রেণী বৈষম্যকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির মাধ্যমে। এক পর্যায়ে নিজেদের স্বার্থে শাসকগোষ্ঠি বাংলার চেয়ে ঊর্দূ বেশি ইসলামিক ভাষা, এই যুক্তিতে ঊর্দুকে রাষ্টভাষা হিসেবে ঘোষনা করে। এ সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী দল হিসাবে পরিচিত আওযামীলীগ ও ধর্মব্যবহার থেকে দূরে থাকেনি। ১৯৫৫ সালে দলটি শরীয়ত সংগত কাজে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারের নিকট ধর্ম প্রচার করার উদ্দেশ্যে তাবলীগ বিভাগ খোলার দাবী জানায়। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারনায় মুসলিম জনগনকে কোরআন ও সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আইন পাশ করা হবে না বলে প্রতিশ্রতি দেয়। উল্লেখ্য ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবীর অন্যতম ছিল অনুরূপ একটি দাবী । ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্টার পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানে ধর্মকেন্দ্রীক রাজনীতি অব্যাহত ছিল ।



১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম একটি প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান হিসেবে ক্রিয়াশীল। ১৯৭২সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট বলে ঘোষনা দেন। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার বৈঠকে যোগদান করেন। এছাড়া ইসলামী ফাউন্ডেশন পুন:প্রতিষ্টা ও মাদ্রাসার উন্নয়নে ব্যাপক সহায়তা করেন। তিনি ধর্মীয় নেতাদের সংগঠন “আওয়ামী উলামা পরিষদ ”কে কার্যক্রম চালাতে দেন। শুধু তই নয়, তিনি পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন।



রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে এ দেশে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ দানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে নতুন ধারা ও বৈচিত্রের সৃষ্টি করেছিলেন। এছাড়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে, সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ‘ বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম ’ সংযোজন করেন এবং ৮(১) নং অনুচ্ছেদে রাষ্টীয় মৌলনীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ন আস্থা ও বিশ্বাস ’ প্রতিস্থাপন করেন। এমনকি, মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে একটি নতুন ধারা সংযোজন করেন,যেখানে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশসমূহের সাথে ইসলামী সংহতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুদৃঢ় সম্পর্ক সৃষ্টি ও বজায় রাখার কথা বলা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংবিধানের এই সংশোধনী ছিল একটা বড় ধরণের পরিবর্তন ।



জেনারেল এরশাদ তাঁর শাসনামলে জিয়া প্রবর্তিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে তাঁর সরকার ও দলের অন্যতম মৌল আর্দশ হিসাবে গ্রহন করেন এবং প্রবল উৎসাহে ‘ ইসলামী করণ ’নীতি অনুসরণ করে চলেন । সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববারের পরিবর্তে শুক্রবার করেন। একাধিক মসজিদ নির্মান করে ঢাকাকে মসজিদের শহরে পরিণত করেন । বায়তুল মোকারম মসজিদের নির্মান কাজ সমাপ্ত করেন, এটাকে জাতীয় মসজিদ হিসাবে ঘোষনা করেন এবং এক পর্যায়ে ১৯৮৮ সালে সংবিধানের ৮ম সংশোধনী ৩০ নং আইন এর ২ ধারা বলে ইসলামকে রাষ্টধর্ম হিসাবে ঘোষনা করেন । এছাড়া , প্রতি শুক্রবার মসজিদের জামাতে ও বিভিন্ন দরগায় (চরমোনাই পীর) গিয়ে ইসলামী আর্দশ ও নীতির কথা আলোচনা করেন। ধর্মকে পুজি করে এরশাদ সুদীর্ঘ ৯ বছর রাষ্টক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।



রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের দিক থেকে খালেদা জিয়া তার পূর্বসূরীদের পথই অনুসরণ করেন।১৯৯১ - এর সংসদ নির্বাচনে বাম, ডান,দক্ষিণপন্থী সব দলই ধর্মকে ব্যবহার করেছে । নির্বাচনের শ্লোগানকে ধর্মীয় মোড়কে আবৃত করতে বিএনপি কালেমা তাইয়্যেবাকে রীতিমত প্যারোডি বানিয়েছিল-‘ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ধানের শীষে বিসমিল্লাহ ’। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে ব্যাখ্যা করেন। তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন জামায়াতে ইসলামের সমর্থন নিয়ে । পরবর্তী ২০০১সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট এবং ধর্মপরিচয়ভিত্তিক দল জাতীয় পার্টিও এক অংশকে নিয়ে নির্বাচনী জোট গঠন করে। খালেদা জিয়া তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন যে ধর্মভিত্তিক দলগুলো আসন কম পেলে ও সারা দেশে তাদের প্রচুর ভোট রয়েছে। কাজেই জোটবদ্ধ নির্বাচন করলে বিজয় অবশ্যম্ভাবী।



১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা দেখতে পাই আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন । কিন্তু এ বিজয়ের পিছনে ধর্মকেই ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের মাস খানেক পূর্বে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ওমরাহ পালনে সৌদি আরব যান এবং সেখান থেকে ফিরে মাথায় কালো স্কার্ফ , শাড়ির বদলে ইসলামী পোশাক হিসাবে বোরকার আদলে সলোয়ার -কামিজ , হাতে তসবিহ পড়ে প্রতিটি নির্বাচনী জনসভা এবং প্রচারণায় অংশগ্রহণকরেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিটি নির্বাচনী পোস্টারে তসবিহ হাতে শেখহাসিনার দু’হাত তুলে মোনাজাতের ছবিটি ব্যবহার করা হয়। আওয়ামীলীগ তাদের নির্বাচনী পোস্টার, ব্যানার , প্রচারপত্র তথা অন্যান্য ডকুমেন্টে আল্লাহ সর্বশক্তিমান লেখাগুলো ব্যবহার শুরু করে। আর রাজনীতিতে ইসলামী মূল্যবোধ এভাবে ব্যবহার করেই মূলত আওয়ামী লীগ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের ধর্মীয় অনুভূতিকে নাড়া দিতে সক্ষম হয় এবং নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিয়ে সরকার গঠন করে।



জামায়াত ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সহযোগী হয়ে তাদের সঙ্গে জোট বেঁধে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে টেনে -হেঁচড়ে নামাতে সচেষ্ট এবং পরে সফলও হয়েছিল। জামায়াতের সাহায্যে বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসলেও জামায়াতকে ক্ষমতার ভাগ দেয়নি। পরবর্তীতে ২০০১ সালের নির্বাচনে এই জামায়াতই বিএনপির সাথে জোট গঠন করে ক্ষমতায় বসে ছিল। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, ধর্মভিত্তিক দলও নিজেদের দলীয় স্বার্থে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করছে।



দেশব্যাপী একযোগে ৬৩টি জেলায় ১৭ আগস্টের (২০০৫) বোমা হামলা ধর্মভিত্তিক রাজনৈক দলগুলোকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। যদিও মূলধারার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই এ কাজে জড়িত ছিল না। এর সাথে জড়িত ছিল চরমপন্থী দল জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি। তাদের সন্ত্রাসীকার্যকলাপ এদেশের ইসলামী রাজনীতি তথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুস্থ চর্চাকে প্রশ্নের সম্মুখীনকরেছিল। এ সময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের জন্য তৎপরতা চালাতে দেখা যায়। অথচ বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতার স্বাদ পেতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে কাছে টেনে নিয়েছে, প্রয়োজনে ব্যবহার করছে।



বাংলাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু সম্প্রদায় একটি গুরত্বপূর্ন ফ্যাক্টর । তারা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত এবং তাদের অধিকাংশের মধ্যে আওয়ামী প্রীতি প্রবল। নির্বাচনের পূর্ববর্তী ও নির্বাচন উত্তর সময়ে এদেরকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী সহিংসতা ঘটতে দেখা যায়। হুমকি, ভীতি প্রদর্শন থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতন, লুটপাট, ভাঙচুর, চাঁদাবাজি ও হামলার শিকার হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়-ভুক্ত নিরহ সাধারণ মানুষ। আওয়ামী ঘোরনার পত্রিকাগুলো হিন্দু সম্প্রদায়কে সহিংসতার মাধ্যমে ভোট কেন্দ্রে যেতে না দেওয়াকে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে চারদলীয় জোটকে সরাসরি দায়ী করেছিল।



১৯৪৭এর স্বাধীনতা আন্দোলন সংঘঠিত হয় ধর্মকেন্দ্রীক রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে। এরপর ধর্মীয় অনূভূতি বিবেচনা করে আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরবর্তীতে হিন্দু ভোট সংগ্রহের জন্যে নাম পরিবর্তন করে শুধু আওয়ামীলীগ রাখা হয়। অনুরূপভাবে বি.এন.পি.,জাতীয় পার্টি এর ব্যতিক্রম থাকেনি। তত্ত্বগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের পক্ষেও এখানে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে রাজনীতি চর্চা করা সম্ভব হয় নি।



(চলবে)



তথ্যসূত্র

ড. এমাজউদ্দিন আহমদ ও মুশফিকুর রহমান (সম্পাদিত), খালেদা জিয়া: রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মসূচী, এশিয়া পাবলিকেশন্স, ঢাকা, মে ২০০১।

আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, আগস্ট ১৯৭৫

বাংলদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার- বদরুদ্দীন উমর

বাংলদেশের রাজনৈতিক উত্থান- তাজুল ইসলাম হাশমী (দৈনিক সমকাল/২২/০১/০৬)

ধর্মের রাজীতি - মতলুব আনাম ((দৈনিক সমকাল/২২/০২/০৭)

ধর্মনিরপেক্ষতা- অধ্যাপক সনতকুমার সাহা

বাংলাদেশের ইতিহাস, আবু বকর সিদ্দিক অনির্বান

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৮:০১

সাঈফ শেরিফ বলেছেন: ১৯৭২সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট বলে ঘোষনা দেন। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার বৈঠকে যোগদান করেন। এছাড়া ইসলামী ফাউন্ডেশন পুন:প্রতিষ্টা ও মাদ্রাসার উন্নয়নে ব্যাপক সহায়তা করেন। তিনি ধর্মীয় নেতাদের সংগঠন “আওয়ামী উলামা পরিষদ ”কে কার্যক্রম চালাতে দেন।

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:০০

আনিসুর রহমান এরশাদ বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.