নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যেয়

আনিসুর রহমান এরশাদ

আমি আমার দেশকে অত্যন্ত ভালবাসি ।

আনিসুর রহমান এরশাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল: একটি পর্যালোচনা (এক)

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫৭

হাওরের কথা বলতে গেলে সাগরর দৃশ্য মনে ভেসে উঠে। সাগর শব্দের অপভ্রংশ শব্দ হাওর। কালক্রমে উচ্চারণ বিবর্তনে সাগর থেকে সায়র এবং সায়র থেকে হাওর শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে পণ্ডিতগণ ধারণা করেন। বর্ষাকালে বড় বড় হাওরে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যোগাযোগের জন্য পাড়ি জমালে এবং নৌকা ভাসালে মনে হয় অকুল দরিয়ার কূল নাই কিনারা নাই। হাওর হলো বিশাল বাটি বা গামলা আকৃতির ভূ-গাঠনিক অবনমন বা নোয়ানো অবস্থা। হাওর শব্দটি সংস্কৃত শব্দ সাগর এর বিকৃত রূপ বলে ধারণা করা হয়। বর্ষাকালে হাওরে পানিরাশির ব্যাপ্তি এত বেশি থাকে যে দেখে মনে হয় তীরহীন সমুদ্র। প্রধানত বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে হাওর দেখা যায়। এই হাওরগুলো নদী ও খালের মাধ্যমে জলপ্রবাহ পেয়ে থাকে।



পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে ছোট-বড় ৪১৪টি হাওর, জলাশয় ও জলাভূমি রয়েছে। জলমহাল রয়েছে ২৮ হাজার। বিল রয়েছে ছয় হাজার ৩০০। এর মধ্যে হাওরের আয়তন ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর। ভাটির দেশ হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জে রয়েছে ১৩৩টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে ৪টি; কিশোরগঞ্জে ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওর রয়েছে। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় এসব হাওর, জলাভূমি ও জলাশয়ের অধিকাংশের অবস্থান। এর বাইরেও সব জেলায়ই ছোট- বড় জলাশয়, জলাভূমি ও বিল রয়েছে। আয়তনের দিক থেকে যা দেশের এক-পঞ্চমাংশ। প্রায় দুই কোটি মানুষ হাওর, জলাভূমি ও জলাশয় সন্নিহিত এলাকার অধিবাসী। সারাদেশের মৎস্য চাহিদার ২০ ভাগ এ সাত জেলায় উৎপাদিত হয়। ধান ফলে ১৮ শতাংশ। এখানকার কৃষি উৎপাদন ও মৎস্যের পরিমাণ জনসংখ্যা অনুপাতে উদ্বৃত্ত। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ হয় দেশের অন্য জেলাগুলোতেও।



হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য :

বাংলাদেশের ষড়ঋতুতে হাওরের ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। বড় হাওরের জলরাশি ভেদ করে রঙ্গিন সূর্য উদিত হয় এবং দগদগে লাল সূর্যটি জলের ভিতরেই ডুবতে দেখা যায়। শীতকালে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাওরগুলো বিশাল, দিগন্তবিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরে রূপ নেয়। জেগে ওঠা উর্বর জমিতে শুরু হয় ফসলের আবাদ। গরু-মহিষের পাল ঘুরে বেড়ায় বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরে। বর্ষাকালে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ নিন্মাঞ্চলে হাওরের সৃষ্টি হয়। বর্ষাকালে হাওরের সৌন্দর্য অপরূপ রূপ ধারণ করে।



শুকনো মৌসুমে যেখানে ধু-ধু প্রান্তর, বর্ষায় তা সমুদ্রসম রূপ ধারণ করে। যতদূর চোখ যায়, শুধুই অথৈ জলরাশি। ছোট-বড় ঢেউ গর্জন করে আছড়ে পড়ে তীরে। দূর থেকে ছোট ছোট গ্রামগুলোকে দ্বীপের মতো মনে হয়। মনে হয় যেন হাওরের পানিতে ঢেউয়ের দোলায় ভাসছে সেসব গ্রাম। এ সময় হাওরে চলাচল করে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা। রঙিন পাল তোলা নৌকাও দেখা যায়। জাহাজ আকৃতির মালামাল পরিবহনকারী বড় বড় কার্গোও সদা চোখে পড়বে। দাঁড় বেয়ে চলা নৌকা ও মাঝিদের কণ্ঠের সুরেলা গানও শোনা যায়। ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে জেলেদের জাল দিয়ে মাছ ধরা তো নিত্যদিনকার চিত্র।



হাওর কোনো স্থায়ী জলাশয় বা জলাধার নয়। বর্ষায় যেখানে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। শুষ্ক মৌসুমে সেখানেই মাইলের পর মাইল চোখ জোড়ানো সবুজ ধানের ক্ষেত। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও, এইডাই উজান-বাডির বাও।বর্ষাকালে বাংলাদেশে ভ্রমণের উত্তম জায়গা হাওর। হাওর ভ্রমণে লাভ শুধু আনন্দেই নয়; এতে শিকড়েরও সন্ধান মিলে। বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানে হাওর অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। হাওর অঞ্চলের মানুষের দেখা হাওর আর বাইরের লোকের ধারণায় হাওর এক নয়। হাওর হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গমস্থল।



হাওর অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ:

হাওরাঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদ গুলির মধ্যে ২৬০ প্রজাতির মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশের আহরিত মৎস্যের শতকরা ২৫ ভাগ মৎস্য হাওরাঞ্চল থেকে আহরণ করা হয়ে থাকে। হাওর এলাকায় দেশের শতকরা ১৮ ভাগ চাল উৎপাদিত হয়। দেশের শতকরা ২২ ভাগ গবাদিপশু এ এলাকায় পালিত হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্যখাতের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় দেড় কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল। সরাসরি প্রায় ১৩ লাখ মৎস্যজীবীর সার্বক্ষণিক পেশা মাছ ধরা। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মৎস্যখাতের অবদান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কৃষিজ আয়ের শতকরা ২২ দশমিক ২৩ ভাগ আসে মৎস্যখাত থেকে। আমাদের প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৬০ ভাগ যোগান দেয় মৎস্য খাত।



হাওরাঞ্চলের সাতটি জেলাতে ঝিনুক চাষ করে প্রাকৃতিক সম্পদ মুক্তা উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং জাতীয় বেকার সমস্যা দুরীকরণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। হাওরাঞ্চলে খাল-বিল, নদী-নালা ও জলাশয়ে প্রচুর শামুক, ঝিনুক ছড়িয়ে, ছটিয়ে থাকে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এ শামুক ঝিনুক মাঠে ঘাঠে পরে থাকতে দেখা যায়। ইহা এক শ্রেণীর গরিব মানুষ বিভিন্ন জলাশয় থেকে কুঁড়িয়ে এনে ঝিনুক ব্যবসায়িদের নিকট সস্তা দামে বিক্রি করে বাড়তি উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে। কোন কোন ঝিনুকের বুক ছিড়ে মহামূল্যবান দাতু মুক্তা (মুতি) তাও মুক্তা ব্যবসায়িদের নিকট নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে। শামুক ঝিনুকের গুড়া ও নাড়ি ভূড়ি মিল মালিকরা হাঁস মুরগি ও মৎস্য খাবার হিসেবে বিক্রি করে প্রচুর টাকা উপার্জন করে। এতে অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। শামুক ঝিনুক হতে পারে অন্যতম আরেকটি সম্পদ।



২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকে হাওর এলাকার সংসদ সদস্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলা হয়, দেশের ৪১১টি হাওরের মধ্যে ৪৬টি থেকেই বছরে ৭০০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন সম্ভব। আর সবকটি হাওরকে উন্নয়নের আওতায় আনা গেলে শুধু হাওরাঞ্চল থেকে উৎপাদিত ফসল দিয়েই সারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে চাল রফতানি করা যেতে পারে।



হাওর অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান:

হাওর অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান ভিন্ন এবং অসমতল। এ এলাকার বক্ষ বির্দীণ করে শিরা উপশিরার ন্যায় পেঁচিয়ে আছে অনেক নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর-বাওর। বর্ষাকালে সাগরের ন্যায় বিশাল জলরাশি দূর থেকে গ্রামগুলি ভাসমান দ্বীপের ন্যায় পানির উপর টলমল করে। এ সময় নৌকা এলাকার একমাত্র যানবাহন। শুকনো মৌসুমে ধুঁ-ধূঁ মাঠ কৃষকের কলকাকলীতে মুখরিত হয়। মাঠের পর মাঠ মাঝে মাঝে গ্রাম। কোন সময় সবুজ, কোন সময় সর্ষে ফুলের হলুদ দৃশ্য যেন সবুজ রঙে মিশ্রিত হলুদের সমারোহ। আবার বৈশাখে মাঠ ভরা পাকা ধান সোনালী রঙের বাহার। এ দৃশ্য কত যে নয়নাভিরাম, যা প্রকৃতির নৈস্বর্গিক লীলাক্ষেত্র। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ৭ টি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সোনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে হাওরাঞ্চলের অবস্থান।



ভৌগলিক অবস্থানের দিকে হাওরাঞ্চল খুবই দর্গম এবং গ্রামগুলি বিচ্ছিন্ন। পুরো সুনামগঞ্জ জেলা, হবিগঞ্জ জেলার বড় অংশ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মৌলভীবাজার জেলার অংশবিশেষসহ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল এবং কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বড় অংশ হাওর দিয়ে বেষ্টিত। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ হাওরগুলো হলো- শনির হাওর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর, ডাকের হাওর, মাকার হাওর, ছাইয়ার হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, কর্চার হাওর, চন্দ্র সোনারতাল এবং কাওয়া দীঘি হাওর। বৃহত্তর ময়মনসিংহের উলেখযোগ্য হাওরগুলো হলো- ডিঙ্গাপোতা, নাওটানা, চর হাইজদিয়া, লক্ষ্মীপাশা, কীর্তনখোলা, লক্ষ্মীপুর, গোবিন্দডোবা, চাকুয়ার হাওর, জোয়ানশাহী। হাওরগুলোকে বাংলাদেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল জলাভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়।



হাওর ও জীববৈচিত্র:

ব্যাপক জীববৈচিত্র্য ধারণ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে হাওরের গুরুত্ব অপরিসীম। স্থায়ী ও পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থল হিসেবে হাওরগুলো সুপরিচিত। বন্যার পানি চলে যাওয়ার পর হাওরে প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন প্রকার ছোট-বড় মাছ, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে জেগে ওঠে পশুচারণভূমি। হাওর এলাকা অতিথি পাখিদের সাময়িক বিশ্রামত্রে হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বিচিত্র ধরনের জলজ পাখিসহ অসংখ্য হাঁসের আবাসস্থল ছাড়াও বহু বন্য প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল এইসব হাওর। এই জলাভূমির বনাঞ্চলে একসময় জলসহিষ্ণু উদ্ভিদ, যেমন- হিজল (Barringtonia acutangula), করচ (Ponogamia pinnata), বরুণ ( Crataeva nurvala), ভুই ডুমুর ( Ficus heterophyllus), জলডুমুর (এক ধরনের Ficus ), হোগলা ( Typha elephantina) নল (Arundo donax), খাগড়া (Pharagmites karka), বনতুলসী (Ocimum americanum), বলুয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে জন্মাত।



জীববৈচিত্রের এই পৃথিবীতে জলাভূমি হলো সবচেয়ে উর্বর। একটি গম ক্ষেতের চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বেশি সবুজ উদ্ভিদ জন্মায়। বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ মাছের জোগানও আসে হাওর-বাঁওর-বিল জাতীয় জলাভূমি থেকে। পানির প্রাকৃতিকচক্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানও জলাভূমি। পানির দূষণ এবং দবীভূত পলি মুক্ত করতে, উদ্ভিদ জন্মাতে মিঠা পানির সরবরাহচক্রে জলাভূমির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শীতের অতিথি পাখিদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে সারাদেশে পরিচিত এ হাওর। প্রতিবছর প্রায় ২০০ প্রজাতির লাখ খানেক অতিথি পাখির অগমণ ঘটে এ হাওরে। আগে এ সংখ্যা ছিল আরো অনেক বেশি। বিশ্বের অনেক বিপন্নপ্রায় প্রজাতির পাখি শীতকালে অস্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তোলে এ হাওরে।



হাওরের ইতিহাস-ঐতিহ্য:

হাওরাঞ্চলকে ভাটি এলাকাও বলা হয়। ইতিহাস-ঐতিহ্যে বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধশালী জনপদ হিসেবে পরিচিত এই এলাকা। এককালে এ অঞ্চলের হাওর ও নদী থেকে তোলা উৎকৃষ্ট মুক্তা রফতানি হতো সুদূর ইউরোপে। এখানকার ঘি, মাখন, পনির ইত্যাদির খ্যাতি ছিল ভারতবর্ষজুড়ে। রফতানিও হতো এসব নানা দেশে। হাওরাঞ্চলের মিঠা পানির মাছের মতো এমন সুস্বাদু মাছ অন্য কোনো দেশে পাওয়া কঠিন।কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের একটি আকর্ষণীয় দিক হাওর। কেবল ভু-প্রকৃতিগত বৈচিত্রের কারনে নয়, অর্থনৈ্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রকৃতিক সৌ্ন্দর্য্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও হাওর গুরুত্বপূর্ণ।



বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হাওরসমৃদ্ধ ভাটি অঞ্চলের ভূমিকা অপরিসীম। এ অঞ্চলেই ১৫৮০ সালে কোচ রাজাকে পরাজিত করে জঙ্গলবাড়ি দুর্গ দখলের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের বিস্ময় ঈশা খাঁর উত্থান। মোগলদের বিরুদ্ধে তার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও শেষ পর্যন্ত ম-স-ন-দে আ-লা-র স্বীকৃতি লাভ। যার সূত্র ধরেই পরবর্তী ৪০০ বছর বাংলার মানুষ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন, অর্থনৈতিক মুক্তিলাভ ও নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তোলার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছে। পিছনে তাকালে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ঈশা খাঁ কেন তার অবস্থান এই হাওরসমৃদ্ধ ভাটি অঞ্চলে করেছিলেন।



হাওর সংক্রান্ত গবেষণা:

আইডবিউএমের এক সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের হাওরগুলোর পানির উচ্চতা প্রাকবর্ষা মৌসুমে দশমিক ৩ থেকে দশমিক ৬ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, হাওর হলো মাদার ফিশারি। এখানে মিঠা পানির মাছ আছে ১৫০ প্রজাতির। আছে ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ। হাওর টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরণ ও ইকোটুরিজম শিল্প বিকাশের অসাধারণ আধার।



হাওরবাসীর জীবন চিত্র

নানা সমস্যায় জর্জরিত হাওরবাসী। দৃষ্টিসীমার একেবারে কিনারে বক্ররেখার মতো কালো আঁকা-বাঁকা, ছড়ানো-ছিটানো অগোছালো গ্রামগুলো দূর থেকে দেখলে মনে হয় অথৈ সাগরের মাঝে কি যেন ভেলার ওপর ভাসছে। বাস্তবিক অর্থে তাদের জীবনটা ভাসমান ভেলার মতোই নড়বড়ে। প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে তাদের টিকে থাকতে হয় হদয়হীন এই পৃথিবীতে। বর্ষাকালে বাড়ির চারপাশে তৈরি করতে হয় আড়া (বাঁশের বেড়া)। এর ভেতর খড়কুটা, কচুরিপানা ভরে স্পঞ্জের মতো করা হয়। যার মাধ্যমে দানব আকৃতির ঢেউ থেকে নিজেদের রক্ষা করে হাওরবাসী। আর বর্ষা মৌসুমে পর্যটকরা এসব এলাকায় ভিড় জমান বিনোদনের জন্য।



হাওরবাসীর জীবিকা:

হাওরাঞ্চলের মোট আয়তন ৫ হাজার বর্গমাইল। এক তথ্যে জানা যায়, হাওরাঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। বর্ষায় হাওর এলাকা ৮-১০ ফুট পানিতে ভরপুর থাকে। হাওরাঞ্চলের অধিবাসীদের ৯০ ভাগই কৃজিকাজের ওপর নির্ভরশীল। বাকিরা মৎস্য আহরণ, মৎস্য চাষ, ব্যবসা, চাকরি ও অন্যান্য পেশায় জড়িত। এখানে রয়েছে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। আর্থিক দুরবস্থা, স্থায়ী কর্মসংস্থানের অভাব, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা আর বিদ্যুৎহীনতার মতো বহুমুখি জটিল সমস্যা।



হাওরের ভূপ্রকৃতি যেমন আলাদা, তেমনি এ এলাকার জীবন-জীবিকাও অন্য এলাকা থেকে ভিন্ন। বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও হাওরে রয়েছে মাত্র দুটি ঋতু। এ দু’ঋতু ভেদেই আবর্তিত হচ্ছে হাওরের জীবন-জীবিকা। কৃষি এ এলাকার প্রধান জীবিকা এবং মৎস্য চাষ উপজীবিকা। কিন্তু সীমাহীন সমস্যা ও বৈরী আবহাওয়া সত্বেও এ অঞ্চল খাদ্য ও মৎস্য ভান্ডার নামে পরিচিতি লাভ করে জাতীয় অবদানে উজ্জল স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশের হাওর ধান ও মাছ উত্পাদনের এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। দেশে মোট ৩৭৩ টি হাওরে ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমি রয়েছে যা থেকে বছরে উত্পাদন হয় ৫.২৩ মিলিয়ন টন ধান। বিশাল এ ধান উত্পাদন ক্ষেত্র আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখছে।



হাওর অঞ্চলের সম্ভাবনা

হাওরের অফুরন্ত সম্ভাবনা এখনো অব্যবহূত। শুধু ধান চাষ নির্ভরতা কমিয়ে এনে কৃষি বহুমুখীকরণ, সমন্বিত কৃষি, ফসলের নিবিড়তা বাড়ালে মানুষের আয় বাড়বে, পাবে পুষ্টি। কৃষি বিন্যাস, ফার্মিং সিস্টেম, সমন্বিত বালাই দমন ও শস্য ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করতে হবে। হাওরে ধান রোপণ ও কর্তন উপোযোগী যন্ত্র দিতে হবে। বিদ্যুত বা বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে। বহুমুখী ব্যবহারের জন্য উঁচু ভিটা, কাটা ধান আনা-নেয়ার জন্য হালকা কিন্তু টেকসই পরিবহন এবং বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। দাদনের ছোবল থেকে রক্ষায় রক্ষা করতে হবে। হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুরগুলো খনন করা হলে হাওরের ৮০ ভাগ সমস্যার সমাধান হবে। জল, জলা ও চাষভূমি সুরক্ষায় হাওরে পরিকল্পিতভাবে সুবিধাজনক স্থানে 'গ্রাম সৃজন' করতে হবে। নদী বা পুকুর খননের মাটি দিয়ে তৈরি স্বপ্নের এ গ্রামে থাকবে আধুনিক সকল সুবিধাসহ বহু স্তর বিশিষ্ট বিল্ডিং। গ্রামের মধ্যে বা চারপাশে থাকবে অনেক পুকুর। সারা বছর এ পুকুরে বিভিন্ন স্তরে মাছ চাষ হবে, পাড়ে থাকবে বিভিন্ন জাতের ফল গাছ, শাক সবজি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি এবং পরিণত করা হবে পর্যটন বিনোদনের 'জলপুরী'; আয় ও খাদ্য উত্পাদন হবে অকল্পণীয়।



হাওরের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাইলে এখনই দীর্ঘমেয়াদি দূরদর্শী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে দ্রুত বাড়ছে জনসংখ্যা কিন্তু বাড়ছে না সম্পদ। দেখা দিয়েছে খাদ্য ঘাটতি। এসব সমস্যা সমাধানে হাওর এলাকা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। হাওরাঞ্চলের অবস্থা, প্রকৃতির ধরন, অবকাঠামোর বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণের সাথে মতবিনিময়, সভা, সেমিনার করে আইডিয়া কালেক্ট করা যেতে পারে। হাওর এলাকার ওপর জরিপ চালিয়ে এলাকাভিত্তিক জনশক্তি ও কর্মসংস্থানের চিত্র তুলে আনতে হবে। অতঃপর বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবক, শিক্ষক, পেশাজীবী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি করে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে হবে। প্রকল্প প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর উপযোগিতা যাচাই সাপেক্ষে সরকারি, ব্যক্তি উদ্যোক্তা ও এনজিও প্রতিষ্ঠানকে আগ্রহের ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দেয়া যেতে পারে। হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে প্রশাসনিক, অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক দিয়ে শক্তিশালী করে গড়ে তোলতে হবে। হাওর মৎস্য ও কৃষি ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা যেতে পারে। কৃষকের উপার্জনের একটা সিংহভাগ ব্যয় হয় বাড়ি রক্ষা ও মেরামতের পিছনে। হাওরের ঢেউয়ের আঘাত হতে অরক্ষিত ভিটেবাড়ি সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে।



এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হাওরাঞ্চলের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও পাঠ পরিক্রমা চালু করা যেতে পারে। শুকনা মৌসুমে হাওরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য বিশেষ ধরনের রাস্তা নির্মাণ করা যেতে পারে। যে রাস্তা বর্ষায় পানির নিচে থাকলেও নষ্ট হবে না। শুকনো মৌসুমে হাওরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য বিশেষ ধরনের যানবাহন ব্যবস্থা ভাবা যেতে পারে। হাওর এলাকার বিস্তীর্ণ ফসলী জমি প্রতিবছর আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাঁধ ভেঙে ঢুকে যায় পানি। প্রায় প্রতিবছরের ঘটনা এটি। বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।সৌর বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র এবং শিক্ষক ও চিকিৎসক নিয়োজিত করতে হবে। বর্ষায় ভাসমান স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতে পারে। নারীদের কর্মমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। হাস, মুরগি, কবুতরসহ গৃহপালিত পশু পালন, সবজি উৎপাদন, মুড়ি, চিড়া, খৈ তৈরি ও প্যাকেটজাতকরণ, শুঁটকি তৈরি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, হস্ত ও কুটিরশিল্প খাতে নারীদের নিয়োজিত করা যেতে পারে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখর করতে হলে তাদের মেয়াদি ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্ষায় হাওরের পানিতে দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা ব্যাপকভাবে অবমুক্ত করতে হবে। নির্দিষ্ট স্থানে ঘের করে এই পোনা বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে পরে তা মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্ত করা যেতে পারে। মুক্ত জলাশয়ে ঘের পদ্ধতিতে মাছ চাষ এবং ভাসমান সবজি চাষের কথা ভাবা যেতে পারে। গবেষণার মাধ্যমে বিকল্প ব্যবস্থা বের করতে হবে। হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে সচ্ছল ও কার্যক্রম করতে হবে। উন্মুক্ত উঁচুস্থানে এমন গাছ লাগানো যেতে পারে যেসব গাছ পানিতে বেঁচে থাকে এবং বাড়ে। এভাবে জঙ্গল তৈরি করে জ্বালানি কাঠের চাহিদা মিটানো যেতে পারে। জঙ্গলে বর্ষায় মাছের উত্তম জায়গা হবে। প্রচুর খাবার মিলবে। পাখিদের অভয়াশ্রম তৈরি হবে।



শুকনা মৌসুমে দেখা যায় মাঠের পর মাঠ। ঘাস আর ঘাস। এই ঘাস আর মাঠকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে দুগ্ধ খামার ও গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প। ছাগল প্রকল্পও করা যেতে পারে। তবে দুগ্ধ খামারের ক্ষেত্রে বর্ষায় গরুর বিকল্প খাবারের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। শুকনা সময়ে পতিত এলাকাকে কী করে উৎপাদনশীল হিসেবে তৈরি করা যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেখানে পুরো ৬ মাসে উপযোগী সবজি ও শস্য উৎপাদনের কথা ভাবা যেতে পারে। হাওরবাসীদের ফসল রক্ষার জন্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাজা-মজা পুকুর-ডোবা জরুরিভাবে স্বেচ্ছাশ্রমের নিরিখে খনন করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বন্যা প্রতিরোধকারী সামগ্রী সঞ্চয় করে রাখতে হবে। নদীর দু'পাড়ে হাওরের সর্বত্র ব্যাপক হারে পানিসহিষ্ণু বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। হাওরবাসী কৃষককে শুধু ধান চাষে নির্ভরশীল না করে তাদের বহুমুখী শস্য চাষে আগ্রহী করতে হবে। এভাবে শুকনা ও বর্ষায় হাওরাঞ্চলের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে উদ্যোগ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিয়ে খুলে যাবে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে কমবে বেকারত্ব। হাওরের ঢেউয়ের মতো ফুলে ফেঁপে উঠবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্রোত।



হাওরে প্রচুর ধান জন্মায়, হাওরে পাওয়া যায় দেশের সবচেয়ে বেশি মিষ্টি পানির মাছ। সম্ভাবনা আছে যে হাওরে তেল ও গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। এমনকি হাওরে যে বিপুল পরিমাণ জলরাশি বর্ষায় প্লাবন সৃষ্টি করে সেই পানিকে কোথাও সংরক্ষণ করে তার যথাযথ ব্যবহার করা যেতে পারে। হাওর এলাকার প্রায় দুই কোটি লোক যুগ যুগ ধরে বছরের ছ’মাস বেকার থাকে। তাদের কর্মসংস্থানে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় নাই। অথচ উন্মুক্ত জলাশয়ে, খাড়িতে মৎস্য-মুক্তা চাষ, ভাসমান কৃত্রিম ভূমিতে, মাচায় সব্জি চাষ, কুটির শিল্পের প্রসার, হাঁস পালন, সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি, পর্যটন শিল্প বিকাশের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। গার্মেন্টস শিল্পের একটা অংশ হাওর এলাকায় স্থানান্তর করা যেতে পারে। সহজে ও সস্তায় নেী চলাচলের জন্য হাওর ইপিজেড বা শিল্প পার্ক স্থাপন করা যেতে পারে।



হাওর জনপদের জনস্বাস্থ্য:

হাওড় অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতি অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জনস্বাস্থ্য অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের।বর্তমানে তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির অভাব,নদী ভাঙ্গন এবং স্যানিটেশনের তীব্র সংকট। বাড়ীর পাশে,নদীতে,খোলা ও ঝুলন্ত পায়খানার ফলে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ বালাই লেগেই থাকেও হাওড় অঞ্চলে। সারা বছর কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয়, কৃমি ও জন্ডিস ইত্যাদি রোগের পেছনে প্রায়ই তাদের মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী এসব রোগে সময়মত চিকিৎসা অর্থ ব্যয় করতে না পারায় প্রতি বছর হাজার হাজার শিশু মারা যায়। বছরে ছয় মাস হাওড় অঞ্চলের শ্রমজীবী কৃষকরা বেকার থাকে।এরা কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম প্রভৃতি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের তোড়ে হাওড়ের জনপদ ও বাড়িঘর যখন ভাঙ্গতে থাকে তখন ধনী গরীব নির্বিশষে অনেকে শহর এলাকায় আশ্রয় নেয়। স্ত্রী ও সন্তানেরা তাদের ভিটা মাটি আকড়েঁ ধরে টকে থাকে কিংবা আশেপাশের আত্নীয় বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে থাকে। অনেকের ভিটা মাটি বিলীন হয়ে যায়,তছনছ হয়ে যায় ঘর বাড়ী। প্রচন্ড রকম অভাব দেখা দেয়। নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসন্মত পায়খানার।



হাওড় এলাকা যেহেতু দুর্গম এবং ডায়রিয়া প্রবণ এলাকা সেহেতু এসব এলাকায় নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি জরুরী। অথচ প্রচুর নলকূপ অকেজো ও আর্সেনিকযুক্ত এবং এ প্রবনতা দিন দিন বাড়ছে।



আজকের দেশ পত্রিকার এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা যায় যে,কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড়ঞ্চলের ৬ টি উপজেলার বর্তমানে ৩৫% পরিবার স্বাস্থ্যসন্মত পায়খানা ব্যবহার করছে। গড়ে ৬৫% পরিবার এখনও ঝুলন্ত পায়খানা বা কাচাঁ পায়খানা ব্যবহার করছে। জেলার হাওড়ঞ্চলে স্বাস্থ্যসন্মত পায়খানা ব্যবহারের প্রবণতা খুবই কম।বছরের ৬ মাস হাওর অঞ্চলের বিপুল সংখক মানুষ ক্ষেতখামার, ঝোপ-জংগল, পুকুর পাড়, হাওড় বাওড়, নদীর পাড়,বর্ষা মৌসুমে খোলা ও ঝুলন্ত পায়খানায় মলমূত্র ত্যাগ করে।উন্মুক্ত জলাশয়ে মলমূত্র ত্যাগ করায় বিস্তীর্ণ হাওড় অঞ্চলের পানি দূষিত হচ্ছে। যার ফলে কলেরা টায়ফয়েড ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে।পরিবেশ মারাত্নক ভাবে দূষিত হচ্ছে। দূষিত নদীর পানি দিয়েই লোকজন গোসল ও অন্যান্য গ্রহস্থালীর কাজ সেরে নিচ্ছে।এমন কি বিশুদ্ধ পানি থাকা সত্বেও অজ্ঞতা ও অশিক্ষার কারনে দূষিত পানি পান করার ফলে সুবিশাল হাওড় অঞ্চলে প্রতি বছর ডায়রিয়া, আমাশয়,নিউমোনিয়া ,কৃমি,জন্ডিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মারা যায়।উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর চিকিৎসকের তথ্য অনুযায়ী হাসপাতালে যে সব রোগী আসে তার অধিকাংশই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত।



হাওর অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র অশিক্ষা ও নানা প্রকার কুসংস্কারের জন্য মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিস্থি্তি খুবই নাজুক।বন্যার সময় এ পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ ধারণ করে।বিশাল জলরশি অতিক্রম করে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ প্রদাণ দুইই কঠিন হয়ে পড়ে।ফলে মানুষ স্থানীয়ভাবে ঝাড়ঁ-ফোঁক ও পানি পড়া,তাবিজ কবজ ব্যবহার করে রোগ মুক্তির প্রচেষ্টা চালায়।বিশেষ করে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবা পায় না।হাওড়ঞ্চলের নারীদের খাদ্য সংস্কৃতি আর দশটি গ্রাম অঞ্চলের মতই ঐতিহ্যবাহী।অর্থাৎ নারীরা খাওয়া দাওয়া শেষে যা-ই অবশিষ্ট থাকুক না কেন তা খেয়েই সন্তুষ্ট থাকে।বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারীদের যেন এতা নিয়তি নির্ধারিত।অভাবের সময় হাওড়ের দরিদ্র নারীদের এ অবস্থা আরো তীব্র আকার ধারণ করে।পুরুষদের যখন কোন কাজ থাকেনা তখন খাদ্যভাব দেখা দেয়।হাওড় অঞ্চলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানসম্ভবা মায়েরা মারাত্নক পুষ্টিহীনতার শিকার হয়। এ কারণে মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যায়।

হাওড় অঞ্চলে অশিক্ষা,কুসংস্কার,স্বাস্থ্যহীনতা,অন্ধবিশ্বাস,কুপ্রথা হাওড়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পশ্চাতমুখী করে রেখেছে। ফলে বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের গুরুত্ব এখনও হাওড় অঞ্চলের লোকেরা বুঝতে অক্ষম। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি গ্রহনে অনীহা আছে। হাওড় অঞ্চলেরর জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা চিহ্নিত করা গেছে।সমস্যাগুলো হলো, প্রাকৃতিকবন্যা, দূর্যোগ, খরা এবং নদী ভাঙ্গন, বিশুদ্ধ পানির অভাব,স্যানিটেরী ল্যট্রিনের অপর্যাপ্ততা, পুষ্টিহীনতা । এছাড়া বর্ষাকালে বেকারত্ব ও তীব্র খাদ্যাভাব, চিকিতসা ও স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল, দারিদ্র প্রকট, জনগনের কৃষির উপর নির্ভর শীলতা, শিক্ষার সুযোগ সুবিধার অভাব, যাতায়াত সংকট দেখা যায়।



হাওর এলাকার মানুষের সংকট:

হাওর এলাকার মানুষ পশ্চাদপদ জীবনযাপন করে;একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তার যে নূ্ন্যতম পাওনা সেটিও সে পায় না। প্রধানত কৃষিভিত্তিক এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রেই সংকট রয়েছে। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, কৃষি ইত্যাদির কোনটাই এমনকি দেশের অনুন্নত অঞ্চলের সঙ্গেও তুলনীয় নয়। হাওর এলাকায় দেশের অন্য এলাকার সঙ্গে তুলনীয় কোন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যকর নয়। নদী-খাল-বিলসম্পন্ন এ এলাকায় যথাযথ নৌ-যোগাযোগও নেই। এখানে শিক্ষার হার দেশের সবচেয়ে কম। প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না। এখানকার মানুষ বেঁচে থাকে আল্লাহর ইচ্ছায়। কোন স্বাস্থ্যসেবা এখানে পাওয়া যায় না। দাদন এখানকার মানুষের রক্ত চুষে নেয়। কৃষি উপকরণ বা সহায়তা এখানকার মানুষের কাছে দুর্লভ। খাল-নদ-নদী-বিলগুলো শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এখানকার পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য ও জীবন বিপন্ন। জলমহালগুলো থাকে লুটেরাদের দখলে। তার বাড়ির কাছের মৎস্যসম্পদ থাকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। দেশের অন্য এলাকার চেয়ে এ এলাকার মানুষ সবচেয়ে বড় যে বিপদটির মুখোমুখি হয় সেটি হচ্ছে প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাত থেকে নিজের বাড়িটা রক্ষা করা। এখানে চোরের উপদ্রব, সরকারি কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতি, সরকারি সেবার অভাব- এসব তো আছেই।



এক সময় পাহড়ি অঞ্চলের বৃষ্টির পানি নেমে ঋতুভিত্তিক বন্যা হতো এবং হাওরেও সে পানি যেত। আবার নদীর পানিতেও হাওর প্লাবিত হতো। তবে পূর্বে এসব পানি নেমে আসার অনেকটা নির্ধারিত সময় ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেসব নিয়মনীতি আর নেই। এখন হাওর এলাকায় হঠাৎ অকাল বন্যার প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাহাড়ি ঢলের এই অকাল বন্যাই হাওরবাসীদের জন্য ডেকে এনেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। বৈরী আবহাওয়া অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অকাল বন্যা ফসলকে কৃষকের হৃৎপিন্ড ছিড়ে কেড়ে নিয়ে যায়। কৃষক প্রকৃতির সাথে লড়াই করে পরাভূত হয়ে অসহায়ের মত চেয়ে থাকে আর বন্যার পানি ধুয়ে নেয় কৃষকের অশ্রুজল। একই সাথে বয়ে আসে বিশাল ঋণের বোঝা। চলতে থাকে দুর্বিসহ জীবন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কত কৃষক যে দিন মুজুর হয় কিংবা রাজপথে ঠেলা গাড়ি চালক বা র্গামেন্টস শ্রমিক হয়ে মানবেতর জীবন কাটায়।



দারিদ্রতা হাওরের কৃষকের চিরদিনের সাথি। কৃষকরা টাকার অভাবে সময়মত সার, তেল, বীজ, কীটনাশক ও কৃষি সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করতে পারেনা। ফলে মহাজনী কিংবা এনজিও ঋণের ফাঁদে পরে সর্বশান্ত হয়। কৃষকরা অশিক্ষিত এবং রাস্তা ঘাটের যোগাযোগ না থাকায় উদ্ভাবিত উন্নত কৃষি প্রযুক্তি কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌছায়না। রাসায়নিক সারের অধিক ব্যবহার কিংবা কম ব্যবহার করে উচ্চ ফলন থেকে কৃষক বঞ্চিত হয়। সুষম সার ব্যবহার এবং উন্নত বীজের জাত নির্বাচন করতে জানেনা বলে অধিক খরচ করে উচ্চ ফলন থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হয়।



নতুন ধান উঠার সাথে সাথে কৃষকরা সংসার খরচ তথা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কম মূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং এক প্রকার টাউট, দালালরা ওজনে বেশি মেপে কৃষককে ঠকিয়ে থাকে। এবং অধিক লাভবান হয় এক শ্রেণীর মৌসুমী ফরিয়া বেপারি, আরতদার ও চাল কল মালিকরা। অনেক সময় ধানে চিটা ও ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে হাওরের কৃষক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তারা দিশাহারা হয়। দায়-দেনা আর সারা বছরের খাদ্যের সংস্থান নিয়ে তারা পড়ে দুশ্চিন্তায়। যে কৃষক তার ধানিজমির আইলে বসে নির্ভাবনার স্বপ্ন বুনে, সে বন্যায় ফসল ডুবলে গামছা দিয়ে চোখের পানি মুছেন। কোন বছর অকাল বন্যা হলে, বোর ফসল নষ্ট হলে কৃষকের শান্তি সুখ বিদায় নেয়।



চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য রক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে হাওরের মানুষ বঞ্চিত। রাস্তা ঘাটের অভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌছতে পারেনা কিংবা কোন রকমে পৌছলেও অতি অপ্রতুল চিকিৎসা এবং নিয়োজিত ডাক্তার ও নার্সের নিয়োগ স্বল্পতা আর নাম মাত্র উপস্থিতি, প্রেষনে থাকা কিংবা আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, প্যাথলজিকেল রোগ নির্ণয় না থাকা প্রভৃতি কারণে চিকিৎসা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ইউনিয়ন কমিউনিটিহেলথ ক্লিনিক পতিত পরে থাকে এবং একেবারেই চিকিৎসা থাকে না। এমনকি কোন কোন কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক হাঁস, মুরগি ও গরু-ছাগলের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়। রাস্তা ঘাটের অভাবে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আধুনিক সদর হাসপাতালে পৌছানো সম্ভব হয়না কিংবা কোন রকমে পৌছতে পারলেও খরচ আর কষ্টের ভূক্তভোগী হয়। দরিদ্র রোগি হলে তাদের ভাগ্যে আর চিকিৎসা জোটেনা। চিকিৎসা বিহীন অবস্থায় মারাও যায়।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা মে, ২০১৭ সকাল ১০:২৪

এস এম কামরুল হাসান বলেছেন: well written.

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.