নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যেয়

আনিসুর রহমান এরশাদ

আমি আমার দেশকে অত্যন্ত ভালবাসি ।

আনিসুর রহমান এরশাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অমসৃণ পথ ও অনিশ্চিত গন্তব্যে বেকার: জন-অরণ্য

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৫০

বেকার হওয়ার আগেই বেকারত্বের জ্বালা উপলব্ধি করা যাবে সত্যজিত রায়ের জন অরণ্য দেখলে। সিনেমার গ্র্যান্ডমাস্টার খ্যাত সত্যজিত রায় পরিচালিত বাংলা চলচ্চিত্র জন অরণ্য ইংরেজি হচ্ছে The Middleman. প্রযোজক-ইন্দাস ফিল্মস (সুবীর গুহ)। বহুল আলোচিত এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয় ১৯৭৫ সালে, মুক্তি পায়: ২০ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৬। মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস জন্য অরণ্য অবলম্বনে চিত্রায়িত এটি সত্যজিত রায়ের কলকাতা ত্রয়ী সিরিজের ৩য় চলচ্চিত্র। ৭০ এর দশকের সাদাকালো যুগের এই ছবিটির আবেদন এখনও হারায়নি। মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের “জন-অরণ্য” উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপদান করে তাকে অমর করে রেখে গেছেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার ও চিত্রনাট্য রচয়িতা সত্যজিৎ রায়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অনার্স ফাইনাল পরীক্ষাকেন্দ্রের দৃশ্য দিয়ে জন অরণ্য ছবিটি শুরু। পরীক্ষার্থীরা পরিদর্শকদের সামনেই নির্দ্বিধায় নকল করে যাচ্ছে। পরিদর্শকদের একজন ঝিমুচ্ছেন আর একজন পায়চারী করছেন। কারো মনই পরীক্ষার হলে নেই, অন্য কিছু নিয়ে ভাবছেন তারা।পরীক্ষার্থীরা বগলের ভাজ থেকে কাগজ বের করে নকল করছে। মাঝে মাঝে কাগজ পুরো ক্লাস পরিভ্রমণ করছে, হাত থেকে হাতে। বহিরাগত একজন পরীক্ষার কক্ষে ঢুকে বই দিয়ে যাচ্ছে পরিক্ষার্থীদের হাতে। বই হাতে পেয়ে সবার মাঝে উত্তেজনা আর চাঁপা শোরগোল। এবার শিক্ষক বলে উঠলেন, কি হচ্ছে? সাথে সাথে পুরো ক্লাসের সমস্বরে উত্তর, পরীক্ষা হচ্ছে স্যার।

পরীক্ষা শেষে শীলগালা লাগিয়ে খাতার বান্ডেল শিক্ষক মশায়ের বাড়িতে পাঠানো হলো।সবাই পার পেয়ে গেলো কিন্তু ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছেলেটা, যে নকল করে না, ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র, মেধাবী ও আদর্শবান যুবক সোমনাথ(প্রদীপ মূখার্জী) পরীক্ষায় খুব কম নম্বর পেয়ে পাশ করে। কারণ তার খাতা মূল্যায়নের দায়িত্ব পড়েছিল একজন দুর্বল দৃষ্টির পরীক্ষকের উপর যিনি সোমনাথের ছোট হাতের লেখা পড়তেই পারেন নি। সোমনাথের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

“এও এক আদিম অরণ্য শহর কলকাতা/ অগণিত জীব পোশাক- আশাকে মানুষের দাবিদার/ প্রকৃতি তালিকায় জন্তু মাত্র-।” সহপাঠিনী তপতীর অপমানে দংশিত হয়ে “জন-অরণ্য” নামে এই কবিতা লিখে উপহার দিয়েছিল তরুণ কবি সোমনাথ ব্যানার্জি। আকস্মিক এই ধরনের উপহারে মুগ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ তা মুখস্থ করে সোমনাথকে তপতী বলেছিল- “তুমি একদিন অনেক বড় কবি হবে সোম”। কিন্তু মাত্র দু’বছরের মাথায় পরিস্থিতি বদলে গেল কত সহজেই। কবিতারা বিদায় নিল সুখের পায়রার মতন, সংসার হয়ে উঠল যন্ত্রণাময় অগ্নিকুণ্ড আর আত্মবিশ্বাস নামক জিনিসটি উড়াল দিল সপ্ত আকাশে।

এটা খুবই স্বাভাবিক। যখন চাকরি নামক সোনার হরিণের পিছে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে একটি মানুষ তখন তার পরিনতি এমনি হয়। যখন সাতটা সিটের জন্যে পরীক্ষা দিতে আসে সাতাশ হাজার পরীক্ষার্থী, যখন পনেরোটি সিটের জন্যে জমা পড়ে এক লক্ষ ফর্ম, যখন বাসায় রান্না করা ডাল ভালো না লাগলে শুনতে হয় ছোট বোনের কাছে, “এত ভুল ধরতে এসো না, পারলে নিজে রেঁধে খাও” তখন একটি মানুষের এমনই হয়।

সোমনাথের বান্ধবী (অপর্ণা সেন) পরিবারের চাপে অন্যত্র বিয়ে করতে বাধ্য হয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুকুমারের(গৌতম চক্রবর্তী) সাথে সোমনাথ চাকরী খুঁজতে শুরু করে। সোমনাথ আর সুকুমার বাঙালি বেকার যুবক। যারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বড় অফিসের ম্যানেজার হওয়ার মতন যোগত্যা নিয়ে বড় হয়নি। অতি সাধারণের কাতারের লোক এই দুইজন যুবক, স্বপ্ন দেখে একটি চাকরির। বড় অফিসের বড় বাবু হওয়ার নয়, সামান্য কেরানির চাকরিতেই খুশি তারা। এই ধরনের ছোট স্বপ্ন দেখা তারা শিখে গেছে দু’বছর নানা জায়গায় ঠোকর খেতে খেতে।

বিশ্বের সবচেয়ে ছোট প্রজাতন্ত্রের নাম কি, জাম্বিয়া কোথায় এই সব প্রশ্নের উত্তর না জানার আফসোসে চোখে পানি এসে যায় সুকুমারের, তাঁর বাবা যে সামনের মাসেই রিটায়ার্ড করবে, তখন সমস্ত সংসারের দায় ভার যে তাকেই তুলে নিতে হবে কাঁধে। সুতরাং তাকে বাড়াতে হবে জেনারেল নলেজ, পেতে হবে যে কোন মূল্যেই একটি চাকরি। তাই তো উপন্যাসের এক পর্যায়ে তাকে দেখা যায়, অফিস গমনে ব্যস্ত লোকদের থামিয়ে প্রশ্ন করতে – “আচ্ছা দাদা, চাঁদের ওজন কত আপনি বলতে পারবেন?”

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সোমনাথ পড়াশুনা শেষ করে চাকরি খুঁজছে। অনেকগুলো নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও কোন চাকরি জোটাতে পারে না সে। পশ্চিম বঙ্গের প্রচন্ড কর্মসংস্থান সংকটের সময় সোমনাথকে কিছু অদ্ভূত ইন্টারভিউ দিতে হয়, এমন সব প্রশ্ন তাকে করা হয় যার সাথে চাকরীর কোন সম্পর্ক নেই। ঘটনাক্রমে সোমনাথের দেখা হয় এক পূর্ব-পরিচিত বয়স্ক ব্যবসায়ী বিশুদার(উৎপল দত্ত) সাথে। ধুরন্ধর বিশুদা, সোমনাথকে চাকরীর আশা বাদ দিয়ে অর্ডার-সাপ্লাইয়ের ব্যবসা অর্থাৎ দালালির কাজ করার পরামর্শ দেয়।

হতাশায় ভূগতে থাকা সোমনাথ অবশেষে নিজেই ব্যবসা করবে বলে ঠিক করে। সে মধ্যসত্ত্বভোগী হিসেবে ব্যবসা শুরু করে কিন্তু ব্যবসা তেমন জমে উঠে না। কুলীন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রধান সোমনাথের প্রবীন, আদর্শবাদী পিতা(সত্য ব্যানার্জী) ব্যবসার ব্যপারে পুরোপুরি সমর্থন দিতে পারেন না, ছেলের নৈতিক স্খলনের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে তিনি শংকিত হয়ে পড়েন। সোমনাথ ধীরে ধীরে ব্যবসার কৌশলগুলো শিখে নেয়, দ্রুত উন্নতির জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম করে যেতে থাকে, হয়ে উঠে একজন কমিশনভূক দালাল। অন্যদিকে হতদরিদ্র বিশাল পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান সুকুমার কোন রকম ভদ্র জীবিকার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভিং শুরু করে এবং সাথে সাথে ব্যবসা গুছিয়ে নেয়ারও চেষ্টা অব্যহত রাখে।

কাপড়ের মিলে অপটিক্যাল হোয়াইটনারের একটি বড় অর্ডার পাবার জন্য সোমনাথ তৎপর হয়ে উঠে। কিন্তু কারখানার ম্যানেজার মোটা কমিশনের লোভে অন্য একজন দালালকে কাজটি দিতে চায়। সোমনাথের অনুরোধে পাবলিক রিলেশন অফিসার মিত্রবাবু(রবি ঘোষ) টাকার বিনিময়ে ম্যানেজারকে কয়েকদিন অনুসরণ করে তার দুর্বলতার জায়গাগুলো খুঁজে বের করে। মিত্রবাবুর পরামর্শে সোমনাথ, ম্যানেজারের হোটেল কক্ষে পতিতা সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

বড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কাজ আদায় করার জন্য ঐ ব্যবসায়ীকে সোমনাথের বাধ্য হয়ে একজন দেহপসারিনী জোগাড় করে দিতে হয়। অনেক দ্বিধা দ্বন্দের মধ্যে সোমনাথ পতিতালয়সহ বিভিন্ন স্থানে একজন দেহপসারিনীর খোঁজ করে। অবশেষে সে একটি মেয়ে জোগাড় করে। ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয় যখন সে এই নির্মম সত্যটি আবিষ্কার করে যে এই দেহপসারিনী তার বন্ধুর ছোট বোন।রক্ষণশীলতার দায় বাঁচাতে নিরীহ, সন্ত্রস্ত সোমনাথ সেদিন সুকুমারের বোন কণাকে বলেছিল শরীর না বেচে ফিরে যেতে |মেয়েটি অবশ্য সেই প্রস্তাবে রাজি হয় নি |

এভাবে চাকুরি খোঁজার পথ ছেড়ে সোমনাথ ব্যবসা করবে বলে মনস্থির করার পর সেই ব্যবসার পথও খুব মসৃণ হয়না।পড়াশুনায় ভাল এক মধ্যবিত্ত যুবককে সিস্টেম কী করে একটু একটু করে প্রথমে মালের দালালি আর তারপরে মেয়েছেলের দালালি করতে শেখায় | সাদামাটা ভাল ছেলে সোমনাথকে (প্রদীপ মুখার্জি) সেদিন সে ছবিতে যেভাবে ব্যবসা-কেরিয়ারের পাঠ দিয়েছিলেন তার বিশুদা (উৎপল দত্ত), এত বছর পরেও তা কানে বাজে: 'অর্ডার সাপ্লাই|একদিকে ক্রেতা, অন্যদিকে বিক্রেতা|আর মধ্যিখানে তুমি|বাংলায় যারে বলে দালাল'|

এই দালালি করতে নেমে বন্ধুর কলগার্ল-বোনের শরীর নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে একদিন, সেটা অবশ্য সেদিন বিশুদা খুলে বলেন নি, হাতে কলমে কাজে নেমে জানতে পেরেছিল সোমনাথ|এই পথ কি সেই সব সাধারনের জন্যে, যারা তাদের মায়ের কাছে কথা দিয়েছিল তারা ভালো থাকবে, সৎ থাকবে? প্রথম ব্যবসা থেকে উপার্জিত টাকায় কেনা শাড়ি, মা-সমতুল্য বউদিকে দিয়েও কেন সোমনাথ বলে- “এই শাড়ি আপনি পড়বেন না বউদি, এই শাড়িতে অনেক নোংরা লেগে আছে?” কেন বলে? নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেও রাতের বেলায় বালিশে মুখ গুজে হু হু করে কেন কেঁদে ওঠে সোমনাথ? সেও কি তবে মিশে গেছে জন-অরণ্যে আর সবার মতন? তার শরীরেও কি লেগে গেছে এই নষ্ট সমাজের নোংরা কাদা?

জন অরণ্য হচ্ছে দুর্নীতির ধূসর আখ্যান।এই কাজটি অসামান্য মানবিক আবেদন সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষায় নির্মিত এই ছবিটিতে সম্পর্ক-দ্বন্দ্ব-আবেগ, আনন্দ-বেদনার অপূর্ব সংমিশ্রণ রয়েছে। এটি ভারতবর্ষের সীমানা অতিক্রম করে সমগ্র মানবগোষ্ঠীর আবহমান জীবনচিত্রের সার্থক রূপায়ন হয়ে উঠেছে। এই ছবিটিতে দেখানো হয়েছে মেধাবী, সম্ভাবনাময়, আদর্শবান তরুণরা কিভাবে দুর্নীতির উপযোগিতা আবিষ্কার করে একসময় অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:২১

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: +++++++++++

২| ০২ রা আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৩০

সৌভিক ঘোষাল বলেছেন: সোমনাথের সামনে সোমনাথদের সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। এক এই রাষ্ট্র কাঠামো ভাঙা ও দুই এই রাষ্ট্র কাঠামোর অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়া। কোলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে তখন বিপ্লবের ডাক। চেয়ারম্যাম মাও সে তুং এর ছবি আর চারু মজুমদারের আহ্বান - সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন। সোমনাথ বিপ্লবের জন্য প্রাণ দিতে পারে না তাই ওপথে সে যায় নি। দালালির মধ্য দিয়েও বাঁচবার ইচ্ছে অবশ্য তার ছিল না। একটা চাকরি, ময়দানের খেলা, সহপাঠিনীকে জীবন সঙ্গিনী করে সে এক মধ্যবিত্ত পরিচিত ছকেই বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু চাকরি জুটল না, প্রেমিকারও অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেল। ব্যবসায়ে তার জড়িয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় আর ছিল না। ক্রমশ অবশ্য ব্যবসা ও তার নিয়ম কানুনই তাকে জড়িয়ে নিল অনৈতিক কাজে। মালের দালাল থেকে মেয়ে মানুষের দালালও হতে হল অর্ডার পেতে, চিনে নিতে হল ব্যবসা জগতের সব অন্ধকার গলিঘুঁজি। সোমনাথের বন্ধু সুকুমার ও চাকরি পেল না আর তার পরিবারের অবস্থা আরো খারাপ। তাই তাকে বেছে নিতে হল ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাজ, তারও পারমিট বের করতে হল এলাকার নেতাকে তোষামদ করে। সোমনাথের বোন কণা কলগার্ল থেকে শরীর বিক্রি করতে লাগল। বিপ্লব হল না শহরের বুকে, প্রতিবিপ্লবের সব লক্ষণ বুকে বয়ে সুকুমার মন বন্ধুর বোনকে তুলে দিল ব্যবসায়ীর শয্যায়, ভালো অর্ডারের আশায়। যন্ত্রণা দগ্ধ করল, কিন্তু বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর অন্য কোনও পরিণতি বোধহয় সেই সত্তরের দশকে অপেক্ষা করে ছিল না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.