নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যেয়

আনিসুর রহমান এরশাদ

আমি আমার দেশকে অত্যন্ত ভালবাসি ।

আনিসুর রহমান এরশাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিক্ষকদের গুরুত্ব, প্রত্যাশা ও করণীয় (দুই)

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:১১



শিক্ষকদের প্রতি করণীয়
সামাজিক মর্যাদা ও চাকরির নিশ্চয়তা প্রদানঃ শিক্ষকদের নিকট সমাজের প্রত্যাশা অনেক। শিক্ষকগণ সমাজের প্রত্যাশা শতকরা যত ভাগ পূরণ করতে পারবেন সমাজও ন্যূনতম তত ভাগ সম্মান শিক্ষকদের দেবেন। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও চাকরির নিশ্চয়তা নেই বলেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই পেশায় আসতে চান না। ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু বই পড়ে শিক্ষা লাভ করে সুনাগরিক হওয়া যায় না। একজন প্রকৃত সুনাগরিক গড়ে তুলতে হলে সুশিক্ষার প্রয়োজন। সুশিক্ষার জন্য চাই নিবেদিতপ্রাণ জ্ঞানী শিক্ষক। মেধাবী শিক্ষক ছাড়া সুশিক্ষা গ্রহণ সম্ভব নয়। মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে তাদের চাকরির নিরাপত্তা ও আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। একজন শিক্ষক যাতে তার পরিবার-পরিজনের লেখাপড়া, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নূন্যতম চাহিদা মেটাতে পারে তার দিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষকদের প্রয়োজন মেটাতে হবে। তাহলে একজন শিক্ষকের কোচিং-প্রাইভেট-টিউশনির দিকে উৎসাহ কমে যাবে। কারণ অনেক শিক্ষক ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিতান্তই বাঁচার তাগিদেও প্রাইভেট পড়ায়।

পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদানঃ মানসম্মত শিক্ষা প্রদান ও আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন বিপুল সংখ্যক শিক্ষক প্রয়োজন। এক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, শিক্ষক পেশাগত ও সামাজিক নানা সমস্যায় জর্জরিত হবেন না। সে কারণে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের পেশাগত মান উন্নয়নে শুরুতেই যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিতকরণ ও তা অব্যাহত রাখা, বিদ্যালয়ে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি এবং সঠিকভাবে তদারকির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাঃ নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সময়োপযোগী লক্ষ্য অর্জনে সকল স্তরের নাগরিককে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। স্বাক্ষরতা অর্জনের মাধ্যমে শুধু লেখাপড়া নয়, মানুষের জ্ঞান, সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায় যা সুস্থ সমাজ ও উন্নত দেশ গঠনে কার্যকরি ভূমিকা রাখে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করতে সুশিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং দেশের নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ এবং ‘ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করেছে। সেই পরিকল্পনার মধ্যদিয়েই শিক্ষকদের আরও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।

শিক্ষকদের ভূমিকার কথা তুলে ধরাঃ মানব সন্তানকে শিক্ষিত করে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে বলেই শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। মা-বাবা যেমন শিশুকে জন্মদান করে, লালন করে, তেমনি শিক্ষক তার সকল মেধা, শ্রম ও সাধনা দিয়ে তাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই বাংলাদেশের সকল শিক্ষকের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এদেশের সকল শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁদের ভূমিকার কথা তুলে ধরতে হবে; যাতে সামাজিকভাবে তাঁরা মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।

শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মূল্যায়নঃ
প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে থানা, জেলা, বিভাগ পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বাছাই এবং তাদেরকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা উচিৎ। ভালো শিক্ষককে সম্মাননা ও আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান চালু করলে গুণগত শিক্ষাপ্রদানে শিক্ষকদের মাঝে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হবে।

শিক্ষকদের করণীয়
সমাজের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট থাকাঃ সমাজের প্রত্যাশা মোতাবেক একজন শিক্ষক হবেন জ্ঞান তাপস, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান, চৌকস, শ্রেণি কক্ষে আগ্রহী পাঠদানকারী ও জ্ঞান বিতরণে আন্তরিক। তিনি সুবিচারক, সুপরীক্ষক, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রক, যুক্তিবাদী, গবেষক এবং উদ্ভাবকও। তিনি সঠিক পথের দিশারী, পথ প্রদর্শক। অবশ্যই সৎ ও ধার্মিক। শিক্ষক সহজ হবেন, সরল হবেন, নির্মল হবেন, হবেন অকুতোভয় সত্যবাদী। সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ববান, সমাজ হিতৈষী, পরোপকারী এবং আধুনিকতামনস্ক বিচক্ষণ সমাজ সংস্কারক। শিক্ষক হবেন চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন, পরিশ্রমী, নিরপেক্ষ, হাস্যোজ্জ্বল, সুপরামর্শক ও প্রাণবন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক হওয়াঃ ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সুন্দর সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকের আচরণ ও চিন্তা-বিশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতার দিক থেকেও আদর্শস্থানীয় হওয়া উচিত। পূর্ণতার পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষেরই দুই ডানা প্রয়োজন। এর একটি হচ্ছে জ্ঞান এবং অপরটি নীতি-নৈতিকতা। পত্রিকা খুললে প্রায়ই শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী হেনস্থা কিংবা ছাত্রদের ওপর শিক্ষকের কঠোর ও অশোভ আচরণের নানা খবরাখবর আমরা পাই। অথচ বাবা মায়ের পর শিক্ষকরাই হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বিতীয় প্রধান আশ্রয়স্থল বা ভরসার কেন্দ্র। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হওয়া উচিত বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক।

বিনয়ী হওয়াঃ আদর্শ শিক্ষকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো- 'বিনয়'। নবী বংশের অন্যতম সদস্য ইমাম সাদেক (আ.) শিক্ষকদের বিনয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, 'জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে বিনয়'। বিনয় হচ্ছে শিক্ষকদের সৌন্দর্য। একজন বিনয়ী শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়াদি ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সুযোগ দেন। এর মাধ্যমে ছাত্ররা শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান শেখার পাশাপাশি বিনয়ী হওয়ার মতো সৎ গুণের দীক্ষাও নেন। যিনি বিনয়ী তিনি সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন। বিনয় কখনোই একজন শিক্ষকের দুর্বলতা নয় বরং এটা তার এক বিশেষ গুণ। শিক্ষকের বিনয় ছাত্রদের মধ্যে আত্মিক প্রশান্তির জন্ম দেয়। যেহেতু অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছাত্ররা শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়, সে কারণে শিক্ষকের জন্য দয়ার্দ্র ও উদার হওয়া জরুরি। কাজেই এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে হবে যে, শিক্ষার্থীরা কেবল উপদেশের মাধ্যমে সংশোধিত ও আদর্শ হিসেবে গড়ে উঠে না বরং শিক্ষকের কথার পাশাপাশি তার কাজের গুরুত্বও এক্ষেত্রে অপরিসীম।

ধৈর্যশীল হওয়াঃ শিক্ষকের শত চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক ছাত্র সঠিক পথে এগোয় না। কিন্তু তাতে শিক্ষককে ধৈর্য হারালে চলে না। এ কারণে একজন শিক্ষককে ধৈর্যশীল, ন¤্র ও ক্ষমাশীল হওয়া উচিত। ইমাম সাদেক (আ.)ও ছাত্রদের সঙ্গে সদাচারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ছাত্রদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করবেন না। তাদের সঙ্গে দয়ার্দ্র ও সুন্দর আচরণ করতে হবে।’ কারো ভুল-ত্রুটি খুঁজে না বেড়ানো ও তিরস্কার না করার পাশাপাশি ধৈর্য ধারণ ও ক্ষমা করার মতো গুণাবলি ধারণ করতে হবে।

সব সময় সুন্দর আচরণ করাঃ অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষক তার ছাত্রদের মধ্যে অন্যায় আচরণ লক্ষ্য করেন এবং অযৌক্তিক কথা শোনেন। এ জন্য ছাত্রকে বারবার তিরস্কার না করে তার ভেতর লুকিয়ে থাকা গুণাবলি আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে হবে। অল্প বয়সি ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে দুষ্টুমি ও জেদের মাত্রা বেশি দেখা যায়। কিন্তু এসব শিশুর মাঝেই লুকিয়ে আছে ব্যাপক প্রতিভা। সে কারণে ছাত্রদের সঙ্গে সব সময় সুন্দর আচরণ করতে হবে। এতে ছাত্র ও শিক্ষক-উভয়ই উপকৃত হবে।

ছাত্রদের মধ্যে বৈষম্য না করাঃ ভালো শিক্ষক কখনও শিক্ষার্থী বা ছাত্রের ব্যক্তিত্বকে হেয় করেন না। ভালো শিক্ষক শিক্ষণের সময় ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পরিবেশ গড়ে তোলেন এবং কখনও কোনো ছাত্রকে অপমানজনক কথা বলেন না। এ ব্যাপারে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘কাউকেই ছোট মনে করো না, কারণ, তাদের মধ্যে কম সম্মানিত ব্যক্তিও মহান আল্লাহর কাছে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী।’ একজন যোগ্য বা ভালো শিক্ষক কখনও ছাত্রদের মধ্যে বৈষম্য করেন না। মহানবী (সা.) বলেছেন, যেসব শিক্ষক ছাত্রদের মধ্যে বা শিষ্যদের মধ্যে বৈষম্য করেন, তারা আল্লাহ থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থানকারী দুই গ্রুপের মধ্যে অন্যতম। বিশ্বনবী (সা.) এর আহলে বাইত বা নবী বংশের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ছাত্রদের শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য না করা ও সব ছাত্রকেই সমান চোখে দেখে সমপরিমাণ বা সমমানের শিক্ষা দেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষার উপকরণগুলো সমানভাবে বণ্টন করাও এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষা নেয়া ও নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রেও শিক্ষককে বৈষম্য থেকে দূরে থাকতে হবে যাতে প্রকৃত দুর্বল ছাত্রকে সনাক্ত করা যায়।

একতাবদ্ধ থাকার মানসিকতাঃ ছাত্রদের সমস্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা থাকা শিক্ষকের অন্যতম গুণ। শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনের জন্য দরকার কোনও গুজব বা রটনায় কান না দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ, কোনও ছাত্র যদি তার পরিবারের অশান্তির কথা শিক্ষককে জানায়, তাহলে শিক্ষকের উচিত সেই কথা নিজের মধ্যেই রেখে দেওয়া, পাঁচ কান না করা।
দৃঢ়চেতা এবং অনুসন্ধিৎসু হওয়াঃ ছাত্রদের সমস্যা বোঝা এবং তা সমাধানে সাহায্য করার জন্য শিক্ষককে হতে হবে প্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা। সেই সঙ্গে তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনোভাবের দ্বারা ছাত্রদের সঠিক সমস্যা বুঝে তার সমাধান খোঁজা উচিত।

সুসম্পর্ক স্থাপনঃ একজন শিক্ষকের সুপরামর্শদাতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটিই প্রথম ধাপ। শিক্ষকের উপস্থিতি যেন ছাত্রের কাছে স্বস্তিদায়ক হয় এবং সে মন খুলে যাতে তার কথা শিক্ষককে জানাতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষক যতক্ষণ না ছাত্রের আস্থা অর্জন করছেন ততক্ষণ ছাত্র তার সমস্যা বিশ্বাস করে সেই শিক্ষককে বলতে পারবে না। তাই এই ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠা একান্ত কাম্য।

ছাত্রকে মনের ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়াঃ শিক্ষার্থীরা যখন তাদের সংকটের কথা শিক্ষককে জানানো শুরু করবে, তখন তাদের সমস্যা মন দিয়ে শুনতে হবে শিক্ষককে। কোনওরকম বাধা না দিয়ে ছাত্রদের প্রাণ খুলে বলার স্বাধীনতা দিতে হবে। এই অবস্থা ছাত্রের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে শিক্ষকের সহমত পোষণ করা একান্ত জরুরি। এইভাবে ছাত্র-শিক্ষকের চিন্তার মধ্যে স্বচ্ছতা আসবে। ফলে ছাত্রদের মূল সমস্যাটি চিহ্নিত করে ধীরে ধীরে তার সমাধানের পথ খোঁজা শুরু করা যাবে।

অপ্রয়োজনীয় মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকাঃ ছাত্রদের অনুভূতির প্রতি সহানুভূতি এবং প্রত্যয়ী মনোভাব দেখানো শিক্ষকের অবশ্য কর্তব্য। যেমন কোনও ছাত্র যদি শিক্ষককে এসে বলে যে সে প্রতিদিন ৬০টি সিগারেট খায়, তাহলে তার উত্তরে শিক্ষকের সেই ছাত্রকে গালমন্দ করা কখনোই উচিত নয়। এক্ষেত্রে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করা একজন প্রকৃত শিক্ষকের প্রধান কাজ।

নিজের অনুভূতিগুলিকে চাপিয়ে না দেয়াঃ
নিজের ধ্যান-ধারণা এবং অনুভূতিগুলির সদ্ব্যবহার করা একজন শিক্ষকের অন্যতম দায়িত্ব। এর সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব মেজাজ-মর্জি ও অনুভূতিগুলি ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়। তাঁর উচিত ছাত্রদের জায়গা থেকে বিচার করে তাদের সমস্যার সমাধান করা।

গোপনীয়তা রক্ষার জন্য আন্তরিক চেষ্টাঃ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তাদের সমস্যা জানার পর কখনোই তা তৃতীয় কোনও ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করা সঠিক নয়। সেগুলি গোপন রাখাই বাঞ্ছনীয়। একমাত্র যদি এমন কোনও ঘটনা, যা স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের ক্ষতি করতে পারে, সেই বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানানো দরকার।

বার বার অনুশীলনের ব্যবস্থাঃ শিক্ষকের মধ্যে থাকতে হবে জ্ঞান, ধৈর্য, দয়া, ন্যায়বিচার ও অন্যান্য পছন্দনীয় গুণ। এ ছাড়াও তার মধ্যে থাকতে হবে ভালোভাবে বোঝানোর ক্ষমতা বা দক্ষতা। মিষ্টভাষী হওয়া ও সদালাপী হওয়াও শিক্ষকের জন্য জরুরি। নৈতিক শিক্ষা দেয়া আদর্শ শিক্ষকের অন্যতম দায়িত্ব। ছাত্র বা শিষ্যদের আধ্যাত্মিক উন্নয়নও তার লক্ষ্য হওয়া উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্য হল ভালো গুণগুলোকে মানুষের জন্য স্বভাবে বা অভ্যাসে পরিণত করা। ভালো নৈতিক গুণগুলো যদি মানুষের বদ্ধমূল স্বভাবে পরিণত না হয় তাহলে সেগুলোর গুরুত্ব খুব একটা থাকে না। তাই এসব গুণকে স্বভাবে পরিণত করার জন্য বার বার অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে হবে শিক্ষককেই। ভালো স্বভাব বা গুণকে জাগিয়ে তোলার জন্য সতর্ক করে দেয়া ও স্মরণ করিয়ে দেয়াও অত্যন্ত মোক্ষম পদ্ধতি।

নিজেকে পরিশুদ্ধ করাঃ শিক্ষক যতক্ষণ নিজেকে পরিশুদ্ধ, আত্মগঠিত ও আত্মসচেতন করতে সক্ষম নন, ততক্ষণ তার কথা বা ভালো উপদেশেও সুফল আশা করা যায় না। পবিত্র কোরআন এ আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কেন সেকথা বল যা নিজে কর না?’ তাই ভালো ও সুযোগ্য ছাত্র গড়ে তোলার জন্য আগে শিক্ষকদেরকেই উন্নত গুণ, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক যোগ্যতা অর্জন করা উচিত। এ ব্যাপারে ইরানের বর্তমান শীর্ষ ধর্মীয় নেতা খামেনি শিক্ষকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, 'ছাত্রদেরকে এটাও শেখানো দরকার নকল করে পাস করলে সেই সার্টিফিকেট দেখিয়ে সারা জীবন ধরে সে যে অর্থ আয়-রোজগার করবে তা সবই হারাম বলে বিবেচিত হবে'।

শিক্ষার্থীদের কল্যাণসাধনে নিয়োজিত থাকাঃ শিক্ষকরা যেমন শিক্ষার্থীদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকেন তাঁদের শিক্ষাদানের জন্য, তাছাড়া তাদের সহমর্মিতা ও সহানুভূতিশীল আচরণও তাঁকে ছাত্রদের কাছের মানুষ হতে সাহায্য করে। একজন উৎকৃষ্ট মানের শিক্ষকের মধ্যে এই দুই গুণের উপস্থিতি প্রায়শই চোখে পড়ে। যেহেতু ছাত্রাবস্থায় একজন ছেলে বা মেয়ের জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে স্কুল বা কলেজের চৌহদ্দিতে, সেহেতু ছাত্রদের চরিত্র গঠনে একজন শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলর বা পরামর্শদাতার উপর ছাত্রদের নানাবিধ মানসিক সমস্যা যেমন, ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক, বাবা-মায়ের সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের সম্পর্কের পারস্পরিক টানাপোড়েন, আত্মবিশ্বাস ও শরীরগত সমস্যা, মাদকাসক্তি এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বা ক্যারিয়ার গঠনে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মতো সমস্যা সমাধানের ভার থাকে; সেখানে একজন শিক্ষক, যিনি প্রতিনিয়ত ছাত্রদের সংস্পর্শে থাকেন এবং ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও অনুপ্রেরণা দানের ক্ষেত্রে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। এইভাবে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন কাউন্সেলর যেমন ছাত্রদের সুবিধার্থে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন, তেমনি সকল শিক্ষকই প্রাথমিকভাবে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের কল্যাণসাধনের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেন।

ছাত্রদের সমস্যা মন দিয়ে শোনা এবং সমাধানঃ
একজন শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক ভাব আদান-প্রদান খুব সহজ বিষয় নয়। এই ক্ষেত্রে শিক্ষককে হতে হবে উদারমনস্ক এবং সহানুভূতিশীল। শিক্ষক যদি এই ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হতে চান, তাহলে ছাত্রদের মনে তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা জাগিয়ে তোলা একান্ত জরুরি। ব্যক্তিগত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে খোলা মনে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্ব গঠনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মন জয় করাই একজন শিক্ষকের প্রকৃত দায়িত্ব। যিনি বহুদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এবং নিজের কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্পষ্ট, এমন ব্যক্তিই যোগ্য পরামর্শদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। এছাড়া যে শিক্ষক তাঁর কাজের মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে একান্ত গ্রহণযোগ্য এবং শ্রদ্ধার পাত্র, তিনিই হতে পারেন একজন দক্ষ পরামর্শদাতা।

শুধু চাকরি নয়, সুনাগরিক গড়াঃ
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড-কথাটি সর্বজনবিদিত এবং চিরন্তন সত্য। শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতি তার ভাগ্যের উন্নয়ন করতে পারে না। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেসব জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অগ্রগামী ছিল তারাই যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব করেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রাচীন গ্রীস, পারস্য, মিশর প্রভৃতি জাতির কথা বলতে পারি। বর্তমান বিশ্বেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে যারা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানী প্রভৃতি রাষ্ট্র শুধু অর্থ সম্পদ ও সামরিক শক্তিতেই বলীয়ান তা নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তারা অনেক দূর এগিয়ে। আর এসব কিছুর মূলে রয়েছে প্রকৃত শিক্ষার প্রসার তথা সুশিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ। একটি দেশ তখনই ভালো হবে যখন সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো হবে। কেবল সনদ সর্বস্ব শিক্ষা কিংবা একটি ভালো চাকরি লাভের উদ্দেশ্যে বিদ্যার্জন কখনোই উন্নত জাতি গঠনে সহায়ক হতে পারে না ।

কথা ও কাজের মধ্যে সমন্বয়ঃ শিক্ষককে অবশ্যই ছাত্রের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের কথাবার্তার মধ্যে স্থিরতা এবং কথা ও কাজের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। যেমন-শিক্ষক যদি ছাত্রের সঙ্গে কোনও কথা বলার জন্য নির্দিষ্ট সময় ধার্য করেন, তাহলে সেই কথা অনুসারে কাজ করা শিক্ষকের অন্যতম দায়িত্ব।

ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্কে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনাঃ যদি একজন শিক্ষক তাঁর ক্লাসের কোনও ছাত্র বা ছাত্রীর আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন এবং এহেন পরিস্থিতিকে ভালো করে যাচাই করতে চান, তাহলে তিনি ওই ক্লাসেরই অন্য আরেকজন শিক্ষকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। খুব সতর্ক হয়ে এই কাজটি করতে হবে এবং যে সহকর্মীর সঙ্গে একজন শিক্ষক এই বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছেন, তাঁকে পুরো বিষয়টি গোপন রাখতে হবে। তবে একজন শিক্ষককে একটি ছাত্র যখন তার জীবনের সমস্যার কথা খুলে বলে, তখন সেই শিক্ষকের প্রতি ওই ছাত্রের অগাধ বিশ্বাস থাকে। এই ক্ষেত্রে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে সেই বিষয়টি আলোচনা করা একজন শিক্ষকের কখনোই উচিত নয়। যদি ছাত্রটির সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের কোনও অসুবিধা হয়, তাহলে কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া জরুরি।

থাকবে স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গীকারঃ শিক্ষক হবে স্নেহশীল, বিশ্বাসযোগ্য, চরিত্রবান, ধৈর্যশীল, প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষক। তাঁর থাকবে স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গীকার। তিনি হবেন উত্তম, দক্ষ ও সুশীল ব্যক্তি। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান সাধনায় হবেন সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে হৃদয়স্পর্শী ও লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রত্যয়ী। সাহসী, সেবাদানকারী দৃঢ়, প্রত্যয়ী, নির্মল, সৎ, মানবতাবাদী, ধার্মিক ও সমাজহিতৈষী পন্ডিত ব্যক্তি।

আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে তৎপর থাকাঃ সমাজ যেহেতু একজন শিক্ষককে আলোকিত মানুষ হিসেবে দেখতে চায় সেকারণে একজন জ্ঞানী শিক্ষক সমাজের সুশীল মানুষের অন্যতম হিসেবে সংকীর্ণ মনের হবেন না, মোসাহেবি, দালালি বা চামচামি করবেন না, ধূমপানসহ নেশাদ্রব্য ধরবেন না, অসৌজন্যমূলক আচরণ করা থেকে বিরত থাকবেন, দলাদলি পরিহার করবেন, কপটতা থেকে দূরে থাকবেন, অসৎ সঙ্গ পরিহার করবেন, সক্রিয় দলীয় নোংরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন, হালাল খাবার খাবেন। তিনি কখনো পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করবেন না। যেহেতু চাকরিবিধির পরিপন্থী সে কারণে শুধুমাত্র অর্থলোলুপতার জন্য অনৈতিক কোচিং ব্যবসার সাথে জড়িত হবেন না। পাঠদান করিয়ে ‘হারাম’ অর্থ নেবেন না, অর্থাৎ প্রাইভেট পড়াবেন না। তিনি কখনোই দেশের কল্যাণ ভাবনা থেকে পিছিয়ে পড়বেন না। মেধা বিকাশে, অজ্ঞতা দূরীকরণে, মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে, নৈতিকতার উন্নয়নে, উদ্ভাবনী কাজে, গবেষণায়- শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে তৎপর থাকবেন। মনে রাখতে হবে একজন শিক্ষক শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষক নন, তিনি সমাজের শিক্ষক-দেশের শিক্ষক-জাতির শিক্ষক।

গুণগত শিক্ষাদানে নিবেদিত হবেনঃ শিক্ষক শিক্ষাদান করেন। শিক্ষাদান করার অন্তর্নিহিত ক্ষমতাই তার যোগ্যতা। তার যোগ্যতার মাপকাঠি অর্জিত শিক্ষা সফলতা, অভিজ্ঞতা এবং নিয়মিত পড়াশোনা। নিয়মিত পড়াশোনা, চর্চা- অনুশীলন তার সক্ষমতাকে বৃদ্ধি ও সচল রাখতে এবং হালনাগাদ করণে সাহায্য করে। শিক্ষকের ক্ষমতার মাপকাঠি হলো, তিনি কতটা সফলতার সাথে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করতে পারছেন। সকল শিক্ষার্থী যদি তার বিতরণ করা জ্ঞান শতভাগ বুঝতে ও আত্মস্থ করতে পারে এবং উদ্দীপ্ত হয় তবে তার দক্ষতা পরিপূর্ণ বলে ধরা যায়। বাংলাদেশকে একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সময় এসেছে একজন শিক্ষকের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ কার্যক্রমে সাড়া দিয়ে আধুনিক শিক্ষাদান কার্যসম্পাদনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার এবং যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের। একজন উত্তমমানের শিক্ষকই পারেন প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ভালোভাবে শেখাতে। যেহেতু পরিবার, সমাজ এবং জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে বর্তমান প্রজন্মের সৃজনশীলতা, দক্ষতা, জ্ঞানের পরিধির উপর। অবশ্যই শিক্ষক প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে শিক্ষার্থীর প্রতিভাকে প্রতিপালন ও বিকশিত করার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং জ্ঞানসম্বলিত মানব সম্পদ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। গুণগতমানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ শিক্ষাথীদের কৃতিত্ব অর্জনের একটি প্রধান উপাদান। শিক্ষার্থীদের এই সুযোগ সৃষ্টি করা শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

শ্রেণিকক্ষে সফলভাবে পাঠদানে আন্তরিক হবেনঃ একজন শিক্ষকের নিজ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা থাকা প্রয়োজন, একই সাথে শ্রেণিকক্ষে পঠনীয় বিষয় কীভাবে উপস্থাপন করা যায়, শিখন শেখানো পদ্ধতি ও কলাকৌশল কী হবে, শিখন সহায়ক শিক্ষা উপকরণ কখন কীভাবে ব্যবহার করা যায়, শ্রেণির সকল ছাত্র-ছাত্রীর প্রতি সমানভাব রেখে সমভাবে গুরুত্ব দিয়ে কীভাবে পাঠ পরিচালনা করা যায়, পাঠে শিক্ষার্থীদের ঔৎসুক্য সৃষ্টি এবং তাদের চিন্তা ও কল্পনা শক্তির উন্মেষ ঘটানোর উপযোগী অগ্রগতি নিরুপণের জন্য মূল্য যাচাই কীভাবে ব্যবহার করা যায় ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে শিক্ষকের সুস্পষ্ট জ্ঞান ও ধারণা থাকা বিশেষভাবে প্রয়োজন। একজন শিক্ষককে এসব বিষয়গুলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে কার্যকর পাঠদান করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকা দরকার।

পাঠের ধারাবাহিক উপস্থাপন নিশ্চিত করবেনঃ একটি দেশ ও জাতির শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করে একটি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেণিকক্ষ। বস্তুত শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে জানতে হলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার গুণগতমান সর্ম্পকে সবার আগে জানতে হবে। শিক্ষকগণ শ্রেণিকক্ষে যথার্থ, মানসম্পন্ন, কার্যকর পাঠদানে সক্ষম হলেই কেবল সার্থক শিখন সম্ভব হয়। বস্তুত শ্রেণিকক্ষে কার্যকরী পাঠদানের উপর শিক্ষকের সাফল্য নির্ভর করে। পাঠদান যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। পাঠদান সম্পূর্ণ মানসিক প্রক্রিয়া। শিক্ষকের বয়স, অভিজ্ঞতা, ধারণক্ষমতা সব কিছুই বেশি। পক্ষান্তরে শিক্ষার্থীর বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম কিন্তু জানার আগ্রহ বেশি। শিক্ষক শ্রেণিতে একটি বিষয়বস্তু উপস্থাপনে সচেষ্ট থাকেন। তাঁর সময় সসীম। তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিষয়বস্তুর পারস্পরিক ধারাক্রম বজায় রেখে শিখন সঞ্চালনের কাজটি সুসম্পন্ন করতে হয়। একটি পাঠের সাথে অন্য পাঠের একটি আনুক্রমিক যোগসূত্র থাকে। শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও একটি অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রয়েছে। এ কারণে একটি পাঠ সেই একটিতে শেষ হয়ে যায় না। অন্য পাঠের সঙ্গে তার সম্পর্ক সূত্র রচিত হয়। শিক্ষকের শ্রেণিতে পাঠ উপস্থাপন কালে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে। অন্যদিকে পাঠ্য বিষয়টিও ধারাবাহিকভাবে বিস্তৃত। শিক্ষককেও শ্রেণিতে পাঠ উপস্থাপন কালে বিষয়বস্তুর নিরিখেই তার পাঠদান কৌশল ও পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সুশৃঙ্খল উপস্থাপনার জন্য বিষয়বস্তুর বিস্তার অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে বিষয়বস্তুকে ছোট ছোট পর্বে ভাগে করে নিতে হবে শিক্ষককে। বিষয়বস্তু ভালোভাবে পড়ে সুশৃঙ্খল উপস্থাপনার জন্য একটি সুনিদিষ্ট পর্যায়ক্রম অনুসরণ করতে হবে।

সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করবেনঃ সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপনের জন্য নির্দিষ্ট পর্যায়ক্রম অনুসরণ করা যেতে পারে। শিক্ষককে পাঠে পূর্বাপর সঙ্গতি রক্ষা করতে হবে। একটি পর্বের উপস্থাপন, মূল্যায়ন শেষে পরবর্তী পর্বের উপস্থাপন শুরু করতে হবে। পর্ব ও পর্যায়ক্রম মেনে পরিকল্পিত পাঠ শিক্ষককে স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে থাকে। পর্ব ও পর্যায়ক্রম অনুসরণ করে পাঠ দিলে পাঠ বিন্যস্ত ও দৃঢ় গাঁথুনীর উপর স্থাপিত হয়। পাঠদানের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে- শিক্ষকতা পেশায় সফলতা লাভের জন্য বিষয়বস্তু শ্রেণিকক্ষে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের কাজটি শিক্ষককে নানাভাবে পূর্ব পরিকল্পিত পথে ধীরে ধীরে করতে হয়। শ্রেণিকক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শিক্ষক বিভিন্ন করণীয় নির্ধারণ করেন। এ করণীয়গুলো শিক্ষকের প্রধান কাজ। প্রথম পর্যায়ে শিক্ষাদানের জন্য পাঠক্রম বিন্যাস করা, এরপর আসে বিষয়মুখী বা পাঠাংশের বিন্যাস। এই দুই ধরনের কাজ শেষেই শিক্ষকের পরবর্তী কাজ হল শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা। এটাই হল শিক্ষকের প্রত্যক্ষ শিক্ষণমূলক কাজ। এ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রয়োজন হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল নির্বাচন করে তা শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করতে হয়। উপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে শিক্ষক সময় শ্রম বাঁচাতে প্রয়াসী হবেন।

পাঠদান শেষে আত্মপর্যালোচনা করবেনঃ পাঠদান শেষে শিক্ষক যে বিযয়গুলো পুনঃবিবেচনা করবেন তাহচ্ছে- পাঠদানের প্রতিটি পদক্ষেপ সঠিক ও লক্ষ্যাভিমুখী ছিল কিনা। পাঠগ্রহণে তিনি শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট সহায়তা করতে পেরেছেন কিনা। শিক্ষার্থীর সাড়া যথেষ্ট ছিল কিনা। পাঠদানে পদ্ধতি ও কৌশলগুলো যথাযথ ছিল কিনা। শিখন অর্থবহ এবং কার্যকর হয়েছে কিনা। এভাবে পর্যালোচনা করা শিক্ষকের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। পাঠদান কাজটা হলো ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া। এ ধাপগুলো আবার পাঠ সমাপন থেকে আরম্ভ হওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখতে হয়- কোন্ কোন্ পথ বেয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে। এই পথপরিক্রমায় কি কি বাধা ছিল? বাধাগুলো কিভাবে অতিক্রম করা হলো? সাফল্যের উপাদানগুলো কী কী? ভবিষ্যতে এই কাজটি আবারো করলে কী কী সংযোজন বা বিয়োজন করা যাবে।

শিক্ষণ-শিখন কৌশল জানবেনঃ শিক্ষণ-ইশখন একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। কাজটি শ্রেণিকক্ষে যিনি যত সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারেন, তিনি তত দক্ষ শিক্ষক। আর এজন্য শিক্ষককে পাঠদানের পূর্বে পাঠদানের কলাকৌশল সম্পর্কে গভীরভাবে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার উপর পাঠদানের আধুনিক কলাকৌশল নির্ভরশীল। যিনি শিক্ষার্থীর সক্রিয়তা অর্জনে বেশি পারদর্শী তিনি তত ভালো শিক্ষক। বিষয়বস্তুর উপর শিক্ষকের পান্ডিত্য ও দক্ষতার ওপর পাঠদান কলাকৌশল যেমন নির্ভর করে, তেমনি শিক্ষার্থীর বয়স, মেধা, আগ্রহ ও গ্রহণ ক্ষমতার ওপর ও পাঠদানের কলাকৌশল নির্ভর করে। আধুনিক উপকরণ সমৃদ্ধ উন্নত পরিবেশ ও উচ্চ বৃদ্ধির শিক্ষার্থীর জন্য শ্রেণি পাঠদানের যে কলাকৌশল হবে অনুন্নত পরিবেশ ও দুর্বল পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর জন্য নিশ্চয়ই আলাদা কলাকৌশল প্রয়োগ করতে হবে। তাই একজন যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষককে শ্রেণি পাঠদানের পূর্ব চিন্তা করতে হবে তিনি কাদেরকে পাঠদান করাবেন, শেখাবেন? কেন শেখাবেন? কি শেখাবেন? কিভাবে শেখাবেন? কখন শেখাবেন এবং কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য একজন যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের বয়স, মেধা ও গ্রহণ ক্ষমতা বিবেচনায় আনতে হবে। শিক্ষককে জানতে হবে তিনি কোন্ শ্রেণির শিক্ষার্থীকে পাঠদান করছেন।

পাঠদানের শিখনফল অনুধাবনঃ পাঠদানের শিখনফল কি হবে এসব শিক্ষককে অনুধাবন করতে হবে; পাঠদানের বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীর গ্রহণ উপযোগী হতে হবে। বয়সের তুলনায় জটিল বিষয় হলে তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কোন্ পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন তা পূর্বে থেকে নির্ধারণ করতে হবে। পাঠদানে মাঝে মাঝে বৈচিত্র্য আনতে হবে। শিক্ষক কখন পাঠদান করবেন এবং কত সময় যাবৎ পাঠদান করবেন এটা পূর্ব নির্ধারিত হতে হবে। একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর সার্বিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা জানতে হবে। শিখনফল অর্জিত হয়েছে কিনা শিক্ষক মূল্যায়নের মাধ্যমে বিচার করবেন।

শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হবেনঃ গতানুগতিক ধারায় শিক্ষকই শ্রেণিকক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। কিন্তু আধুনিক শিক্ষণ ও শ্রেণিকক্ষ পাঠদান ব্যবস্থাপনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাঠদান করা হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আলোচনার মাধ্যমে পাঠের উদ্দেশ্য, শিখনফল, পাঠদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন ইত্যাদি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা এককভাবে, জোড়ায় ও দলীয় কাজের মাধ্যমে মতামত উপস্থাপন করার সুযোগ পায়। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ফলে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব, বিশ্বাস, আস্থা ও সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে ওঠে। পাঠ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক কিভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন, শিখন- শেখানো কার্যাবলি কেমন হবে, যথাযথ উপকরণের ব্যবহার কেমন করে করবেন, মূল্যায়ন কিভাবে করবেন তা জানা আবশ্যক। ফলপ্রসূ পাঠদানের জন্য শিক্ষকের প্রস্তুতি হচ্ছে- ক) পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন (খ) শ্রেণি ব্যবস্থাপনা ও শ্রেণি বিন্যাস করবেন (গ) বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও প্রেষণা সৃষ্টি করবেন। শিখন-শেখানো কার্যাবলিঃ (ক) বিষয়বস্তু উপস্থাপন/আলোচনা করবেন আকর্ষণীয়ভাবে, প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে (খ) সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে (গ) বিষয় সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের গভীরতা থাকতে হবে (ঘ) যথাযথ শিখন-কৌশলের ব্যবহার করতে হবে। (ঙ) পাঠে একঘেয়েমি পরিহার করে পাঠদানে বৈচিত্র্য আনতে হবে (চ) পাঠের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে (ছ) প্রশ্ন করার কৌশল, ধারাবাহিকতা ক্রমোচ্চ কাঠিন্যমান রক্ষা করতে হবে (জ) শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা সাড়া প্রদান করবে। শিক্ষক ফিডব্যাক দিবেন (ঝ) শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পারিক ক্রিয়া অত্যন্ত আকর্ষণীয় হবে (ঞ) শিক্ষকের প্রফুল্লতা ও রসবোধ থাকতে হবে (ট) শ্রেণি উপযোগী কণ্ঠস্বর ও উচ্চারণের বিশুদ্ধতা থাকতে হবে (ঠ) শ্রেণি কক্ষে চলাচল ও দৈহিক ভাষার প্রয়োগ করবেন।

উপকরণের যথাযথ ব্যবহার করাঃ শিক্ষক সঠিক সময়ে উপকরণ প্রদর্শন করবেন। শিক্ষকের ব্যবহৃত উপকরণের অবশ্যই যথার্থতা থাকবে। প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্লাসে প্রদর্শনের পর উপকরণ সরিয়ে রাখবেন। চকবোর্ডের/হোয়াইট বোর্ডের যথাযথ ব্যবহার করবেন। মূল্যায়নের জন্য- শিখন ফলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ প্রশ্নের প্রয়োগ করবেন। প্রত্যাশিত শিখনফল অর্জনে সফলতা পরিমাপ করবেন। প্রয়োজনে বাড়ির কাজ প্রদান করবেন সময় ব্যবস্থাপনা মেনে চলবেন। ধন্যবাদ দিয়ে ক্লাস শেষ করবেন।

সুষ্ঠু শিক্ষাদান পদ্ধতি অবলম্বনঃ সুষ্ঠু, বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিপূর্ণ শিক্ষাদান পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। প্রশ্ন আসে, কি কি বৈশিষ্ট্য থাকলে শিক্ষাদান পদ্ধতিকে সার্থক বলা যায়? এর উত্তরে বলা যায়- পদ্ধতি হবে লক্ষ্যভিত্তিক। প্রথমে লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিয়ে লক্ষ্যের অনুকূলে বিষয়বস্তু উপস্থাপন ও লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সর্বশেষ লক্ষ্য অর্জন নির্ণয়ের জন্য যথাযথ মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রয়োগকে একটি সুষ্ঠু রূপদান করে। সুষ্ঠু নীতির উপর ভিত্তি করে সুপরিকল্পিত পদ্ধতি প্রয়োগ হতে হবে। জানা থেকে অজানা, বাস্তব থেকে অবাস্তব, মূর্ত থেকে বিমূর্ত, বিশ্লেষণ থেকে সংশ্লেষণ ইত্যাদি হল সুষ্ঠু পদ্ধতি প্রয়োগের নীতি। প্রয়োজন নীতির অন্যথা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটি নির্ভর করে শিক্ষকের দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা ও কল্পনা শক্তির উপর। শিশু যা শিখে তাই তার আচার-আচরণে রূপান্তরিত হয়ে জীবনের প্রতিক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয়। তাই শিক্ষার্থীর বয়স, সামর্থ্য, আগ্রহ, ইচ্ছা, অভিরুচি অনুযায়ী শিক্ষাদান কার্য পরিচালনা করা বাঞ্ছনীয়। সুতরাং পদ্ধতি হবে মনোবিজ্ঞানভিত্তিক। উত্তম পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হল শিক্ষার্থীর মনকে যুক্তি ও চিন্তাধর্মী করে তোলা। শিক্ষার্থী যত বড় হতে থাকে, তার ভিতর ধীরে ধীরে যুক্তি ও বিচারবুদ্ধিও তত জাগ্রত হয়।

সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমান দৃষ্টি রাখাঃ সার্থক শিক্ষাদান পদ্ধতি ব্যক্তি ও শ্রেণি উভয়কেই প্রাধান্য দেয়। একজন সার্থক শিক্ষক ব্যক্তি বিশেষের বিভিন্নতার দিকে যেমন খেয়াল রাখেন, তেমনি সমগ্র শ্রেণির প্রতি তার দৃষ্টি সদা জাগ্রত থাকে। স্বল্প মেধা, গড় মেধা এবং উচ্চ মেধা এই তিন শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমান দৃষ্টি রেখেই তাকে শিক্ষাদান করতে হয়।

শিক্ষাদান পদ্ধতিকে সজীব ও প্রাণবন্ত করাঃ সুষ্ঠু শিক্ষাদান পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য জানা থাকলে একজন শিক্ষকের শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজ হয়। কারণ পাঠদানের কলাকৌশলের মধ্যে অন্যতম উপাদান হল শিক্ষাদান পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে সক্রিয় করেন এবং তথ্য সরবারাহ ও বিনিময় করেন। শিক্ষাদান পদ্ধতি একদিকে বিজ্ঞানধর্মী এবং অপরদিকে সৃজনশীল শিল্পকলা। এ দুয়ের মাঝে সংযোগ সাধনের ক্ষেত্রে রয়েছে পদ্ধতি প্রয়োগের সার্থকতা। সেই সঙ্গে নিজ চিন্তা, যুক্তি ও বিবেচনা দিয়ে পদ্ধতিকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে তুলতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে মুহূর্তেই জানা যায় পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের ঘটনাপ্রবাহ। কাজেই শিক্ষাকে নতুনভাবে রূপ দেবার এবং পদ্ধতিকে নতুনভাবে সাজাবার সময় এসেছে। পাঠদানে বৈচিত্র্য আনয়ন করা বা উপযুক্ত পদ্ধতি ব্যবহার করা একজন শ্রেণি শিক্ষকের অন্যতম কাজ।

পাঠদানে বৈচিত্র আনয়ন করবেনঃ সুষ্ঠু পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষক কয়েকটি পদ্ধতির সমন্বয় করে পাঠদান করলে শিক্ষার্থীরা পাঠে আগ্রহী হবে এবং যৌক্তিক চিন্তার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবেন। ফলে পাঠদান কার্যক্রম সুন্দর ও আকর্ষণীয় হবে। পাঠদানে বৈচিত্র আনয়নের জন্য কার্যকর কয়েকটি পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
১. অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিঃ এ পদ্ধতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন। দলীয় কাজ, দলীয় আলোচনা, ব্রেইন স্ট্রর্মিং, প্রশ্ন উত্তর, ঊীঢ়বৎঃ লরমংধি ইত্যাদি এ পদ্ধতির উপাদান। অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে শিক্ষাদানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং দ্বিমুখী যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষাদান পরিচালিত হয়। এ পদ্ধতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাঠদান তাৎপর্যমন্ডিত হয় এবং সফল সমাপ্তি ঘটে। এ পদ্ধতি জীবন সম্পৃক্ত এবং শিক্ষার্থী নিজেকে সঠিকভাবে বিকাশের সুযোগ পায় এবং দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত হয়।
২. মিথষ্ক্রিয়ামূলক পদ্ধতিঃ এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। বিজ্ঞান বিষয়ক ব্যবহারিক ক্লাসে এ পদ্ধতি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয়। কারণ এ পদ্ধতিতে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক আলাপ আলোচনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীর মধ্যে উৎসাহ, সাহস ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় এবং পাঠে আগ্রহী হয়ে ওঠে। শিক্ষক তাঁর বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন ফলে শিক্ষণ শিখনে বৈচিত্র্য নিয়ে আসা যায়। বাংলাদেশে আধুনিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে এ পদ্ধতি ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। এই পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে মাটি ও মানুষের সাথে শিক্ষার সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং একজন শিক্ষকের এ পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি।
৩. সহযোগিতামূলক পদ্ধতিঃ সহযোগিতামূলক পদ্ধতিতে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবেন। শিক্ষণ-শিখন যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক এখানে ঋধপরষরঃধঃড়ৎ বা গড়ফবৎধঃড়ৎ হিসেবে তাদের পাঠদানে সহায়তা করেন মাত্র। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে তাদের চিন্তা, চেতনা, জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করে প্রদত্ত সমস্যা বিশ্লেষণ করতে পারে। সমাধানের জন্য নিজেরা পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এখানে শিক্ষার্থীর ভুলকে তিরস্কার না করে সংশোধন করা হয় এবং ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে প্রয়োগমুখী রাখতে সচেষ্ট হবেন। শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞাতার আলোকেই নতুন কিছু শিখতে পারে ও সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটতে পারে।
৪. শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতিঃ এ পদ্ধতিতে শিক্ষক কতটুকু জানেন সেটা বড় কথা নয়, শিক্ষার্থী কতটুকু জেনেছে বা জানার মধ্যে কোনো ক্রটি আছে কিনা সেটা বড় কথা। পাঠদানে শিক্ষকের অংশগ্রহণ থাকে (৫-১০ শতাংশ ) সহায়কের। কোথাও কোনো ভুলক্রটি হলে শিক্ষক শুধু ভুল সংশোধন করেন।

চৌকস ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের হবেনঃ শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম একটি উন্নত ধরনের শিল্প। শিক্ষকতা একটি পেশা নয় এটি একটি ব্রত। এই মহান পেশায় যারা নিয়োজিত তাদের চৌকস ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের হতে হবে। একজন সফল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গরূপে অনুধাবন করবেন। সময় সম্পর্কে সচেতন থাকবেন। শ্রেণির পরিবেশ ও শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করবেন। শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম সুুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য তিনি বহুবিধ কৌশল সম্পর্কে জানবেন। পদ্ধতি উদ্ভাবন করবেন। সর্বোপরি তিনি শিক্ষার্থীর মানসিক উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য পাঠদানে বৈচিত্র্য আনবেন। তাহলে আশা করা যায়, গুণগত শিক্ষা সম্পাদনের মাধ্যমে একটি নৈতিকতা, মূল্যবোধ সম্পন্ন সুন্দর জাতি গঠনের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।

অবশ্যই জেন্ডার সচেতন হবেনঃ জেন্ডার সচেতনতা অনুসরণে আসন বিন্যাস করবেন। ছেলে ও মেয়েদের পৃথক সারিতে না বসিয়ে পাশাপাশি এবং মিলেমিশে বসার সুযোগ তৈরি করতে পারেন। দলীয়ভাবে বা জোড়ায় কাজ করার সময় তারা যেন পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের সুযোগ পায়। এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রেণিতে অল্প মেধা ও বেশি মেধা বা কম মনোযোগী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পারিক ভাব-বিনিয়ম অত্যন্ত জরুরি একটি পদক্ষেপ। এ উদ্দেশ্যে উভয় প্রকৃতির শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এবং মিলেমিশে বসার সুযোগ তৈরি করতে হবে।

জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়াস চালাবেনঃ সন্ত্রাস দমনে সুন্দর সমাজের অঙ্গীকার নিতে হবে শিক্ষকদের। সন্ত্রাসবাদ দমনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-অভিভাবকদের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ বিষয়ে জাতীয় ঐক্যমত্য তৈরির জন্য যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

মাদকের মূলোৎপাটনের দায়িত্ব নিবেনঃ
দেশ থেকে মাদকের মূলোৎপাটন করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মাদকের ভয়াল নেশা থেকে শিক্ষার্থীদের ফেরাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের ভূমিকাই বেশি। প্রত্যেক শিক্ষককে তাদের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানাতে হবে। তাদের সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে- সন্তান কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে মেশে; সেই খোঁজখবর রাখতে এবং কুসঙ্গ হলে পরিত্যাগ করতে। শিক্ষকদের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাই মাদক নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মাদকাসক্ত হওয়া শুধু ব্যক্তির দোষ নয়। দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই খেলার মাঠ নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড হয় না, বিনোদনের মাধ্যম নেই। এ ধরনের অনেক কারণে শিক্ষার্থীরা মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তাই শিক্ষক নিজেরা সচেতন হবে, শিক্ষার্থীদের সচেতন করবে, শিক্ষার্থীদের তাদের বন্ধুদের সচেতন করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

মূল্যবোধ জাগাতে সচেষ্ট হবেনঃ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে শিক্ষকদের দায়িত্ব নিতে হবে। মানবিক মূল্যবোধের অভাবে বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিপথগামী শিক্ষার্থী হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তাই প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের গ্র্যাজুয়েট দেশের কোনো কাজে আসবে না। বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষকদের কাজ করতে হবে। আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে সর্বোচ্চ মানের পেশাগত দক্ষতা অর্জনে শিক্ষকদের সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

চলবে

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.