নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

https://www.facebook.com/asadali.ht

মোহাম্মদ আসাদ আলী

সাংবাদিক

মোহাম্মদ আসাদ আলী › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তচিন্তার আবরণে মানসিক দাসত্বের জয়ধ্বনি

০৭ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০৩

কিছুদিন আগেও মানুষের শরীর কেনা-বেচা হতো। গবাদি পশুর মতো জীবন্ত মানুষকে নিয়ে চলত দরকষাকষি। শক্ত-সামর্থ পুরুষ ও রূপবতী নারীর দাম ছিল সর্বোচ্চ; অন্যদিকে শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বিক্রী হতো খুবই অল্প মূল্যে। গরু-মহিষ দিয়ে যেভাবে জমিতে হালচাষ করা হয়, পণ্য পরিবহন করানো হয় এদেরকে দিয়ে তার চেয়েও কষ্টসাধ্য কাজ করানো হতো বিনা প্রশ্নে, বিনা শর্তে। এক আদম সন্তানের শরীর নিয়ন্ত্রণ করতো আরেক আদম সন্তান। কিন্তু সেদিন কি আর আছে? আজ যুগের হাওয়া বদলেছে। মানুষের যান্ত্রিক সফলতা আকাশ ছুঁয়েছে। উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরুর রহস্য, তারকারাজি, সূর্য-চন্দ্রের অবস্থান, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও কার্যপ্রণালী, আসমান-জমিনের স্তরবিন্যাস, সমুদ্রের তলদেশের বৃহদাকার প্রাণী, কিংবা সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতম কীট-কীটানুকের, জীব-অনুজীবের, উদ্ভিদরাজির প্রতিটি কোষ থেকে অণু পরমাণু- সব আজ মানুষের নখদর্পনে; মানুষের নিয়ন্ত্রণে, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক পদচারণায় মেতে উঠেছে বিশ্বজগৎ। গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ির জায়গা দখল করেছে বাস, ট্রাক, টেম্পু, রেল। কর্দমাক্ত বা ধূলি-ধূসরিত বন্ধুর রাস্তার দখল নিয়েছে পিচঢালা রাজপথ। কুপের দখল নিয়েছে পাম্প। অন্ধকার খুপড়ি রূপ নিয়েছে বিশাল বিশাল সুরম্য অট্টালিকায়। পত্রবাহী দূতের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে মোবাইল ফোন, টিভি, ইন্টারনেট। আর এভাবেই যুগের পরশে বদলেছে দাসত্বের ধরনও। যুগের চাহিদা অনুসারে শারীরিক দাসত্ব পর্যবসিত হয়েছে মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বে, যার শিকার পৃথিবীর সাতশ’ কোটি মানুষ।

মুক্তচিন্তার প্রধান ঘাতক: গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থা

আগের দিনে দাসদের অন্তত এটুকু বোঝার সামর্থ্য ছিল সে আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক নয়, সে দাস, মুক্ত হাওয়ায় মুক্ত মানুষের জীবন উপভোগ করতে সে ব্যর্থ। এ ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু বর্তমানের যে সাতশ’ কোটি মানসিক দাসের কথা বলা হচ্ছে তাদের দ্বৈন্যদশা এতই করুণ যে, তারা বুঝতেও পারছে না তারা পরাধীন, দিবারাত্রি তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, মিথ্যা হাওয়ায় ফুলিয়ে রাখা হয়েছে তাদের স্বাধীনতার বেলুন। বস্তুত স্বাধীন কর্মের সুযোগ যা একটু আছে, স্বাধীন চিন্তার সুযোগ তাদের একেবারেই নেই। মানবজাতির চিন্তা-চেতনায় পরোক্ষ সীমারেখা টেনে দিয়েছে পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতাপ্রসূত সিস্টেম। মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করার এ নিদর্শন ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই।

মানুষ তার চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান, বুদ্ধি খাটিয়ে যে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারে। তবে সে জন্য মুক্তবুদ্ধি বা মুক্তচিন্তা অতি প্রয়োজনীয়। কারণ মানুষের সিদ্ধান্ত রচিত হয় চিন্তা থেকে। আবার মুক্তচিন্তার জন্য প্রয়োজন মুক্ততথ্য, এ কথা সকলেই স্বীকার করবেন। সে তথ্যে কারও হস্তক্ষেপ থাকা যাবে না, কারও স্বার্থ জড়িত থাকা যাবে না। কারণ জ্ঞানের সাথে স্বার্থের মিশ্রণ ঘটা মানেই ওই জ্ঞান বিষাক্ত হয়ে যাওয়া। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো- প্রচলিত সিস্টেমে জনসাধারণ যে দু’টি মাধ্যম থেকে সরাসরি তথ্য পায় অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যম, এগুলোর সাথে শুধু স্বার্থের মিশ্রণ আছে তাই নয়, পুরোটাই স্বার্থের উপরে প্রতিষ্ঠিত। মানুষকে সত্য ও নিরপেক্ষ তথ্য প্রদান করে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করার বদলে এই মাধ্যমগুলো প্রয়াস চালায় জনসাধারণকে প্রভাবিত করে স্বীয় সিদ্ধান্ত সকলের উপর চাপিয়ে দিতে। এর কারণ নির্ণয় করা খুব সহজ। শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যম উভয়ই নিয়ন্ত্রণ করে শাসকগোষ্ঠী এবং কর্পোরেট ব্যবসায়ী শ্রেণি। কাজেই রাষ্ট্রে শাসকের অপকর্ম ফাঁস হতে পারে বা শাসকের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো তথ্য বা শিক্ষা এ মাধ্যম থেকে আশা করা যায় না। অন্যদিকে পুঁজিবাদী বিশ্বের সরকারগুলো সাধারণত নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিপতি-শিল্পপতিরা। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড, থার্ড ওয়ার্ল্ড দিয়ে কথা নয়, সকল দেশেরই রাজনীতি ও সরকার পুঁজিপতি বুর্জোয়া শ্রেণি দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। বর্তমান পৃথিবীর সুপার পাওয়ার খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও নিয়ন্ত্রিত হয় সে দেশের বিলিয়নারদের দ্বারা। এরাই আবার মিডিয়ারও মালিক। কাজেই পুঁজিপতি অনুগত সরকারের নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা ও পুঁজিবাদের হাতের পুতুল মিডিয়া সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে স্বার্থকে আগ্রাধিকার দেবে- সেটাই তো স্বাভাবিক। সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, সেই গণমাধ্যমের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ মানসিকভাবে পুঁজিবাদের দাসত্ব করবে সেটাও খুব অস্বাভাবিক নয়। এখন দেখা যাক শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে মুক্তচিন্তার বিকাশ রুদ্ধ করে সাধারণ মানুষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দাসত্বে পর্যবসিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা কী কী কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে।



অর্থনীতিক উন্নয়নের মরিচিকা ও রাজনীতিক সিস্টেমের জাল

প্রথমত, মানবজীবনের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নতিকেই মানুষের সার্বিক উন্নয়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারাটা সাম্রাজ্যবাদ ও স্বার্থবাদের বড় কৃতিত্ব। কারণ মানুষ যতই অর্থের পেছনে ছুটবে, রুজি-রোজগার নিয়ে পড়ে থাকবে, অর্থনৈতিক উন্নতি নামক মরিচিকার ভ্রমে ডুবে থাকবে ততই সে স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক প্রাণীবিশেষে পরিণত হবে। সমাজ, দেশ ও জাতি নিয়ে তার কোনো ভাবনা থাকবে না। পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যবাদীরা যে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে তার প্রাথমিক ফল হলো সম্পদের ভারসাম্যহীনতা, সহস্র জন ক্ষুধার্ত মানুষের বিপরীতে একজন মিলিয়নার। একজন মিলিয়নারের চাহিদা পূরণে প্রাণপণে শ্রমব্যয় করতে হচ্ছে এক সহস্রকে। ভাগ্যচক্রে এক বেলা উপার্জন ব্যাহত হলে আরেকবেলা উপোস করা যাদের অবধারিত, তারা অর্থনীতিক উন্নতিকেই জীবনের লক্ষ্য জ্ঞান করবে না তো কী করবে? ফলে অর্থনীতিক উন্নতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে গিয়ে জীবনের অপরাপর বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা নিয়ে ভাবার সময় ও সুযোগ কোনোটাই তাদের নেই। এসব নিয়ে ভাবছে কেবল ওই মিলিয়নার এবং বিলিয়নাররা যারা ইতোমধ্যেই সাধারণ মানুষের মনিবের আসনে আসীন। এদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া সাধারণ মানুষকে যা ভাবাতে চায় মানুষ তা-ই ভাবে, যা বিশ্বাস করাতে চায় মানুষ তা-ই বিশ্বাস করে।

দ্বিতীয়ত, অথর্নীতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী শোষক শ্রেণির পাতানো শৃঙ্খল ভেঙ্গে যদি কিছু মানুষ বের হয়েও পড়ে এবং অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, সেই সোচ্চার হবার পথেও ফাঁদ পেতে রেখেছে সাম্রাজ্যবাদীরা। র‌্যালি, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি, অনশন, প্রতিকী অনশন, মিছিল, মৌন মিছিল, ঘেরাও, স্বারকলিপি প্রদান ইত্যাদি হাজারো চিত্তাকর্ষক প্রতিবাদের প্রক্রিয়া তৈরি করে রাখা হয়েছে। এটা করা হয়েছে যেন মানুষের ক্ষোভ উথলে না পড়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সুযোগ পেয়ে রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে, আখেরে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত না হয়, শোষক-নিপীড়ক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষিত হয়।

বিষাক্ত ফল প্রদায়ক বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা কেটে লাভ নেই, বিষফল থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সমুলে উৎপাটন, এ কথা কে না জানে? একইভাবে যে সিস্টেম এত অন্যায়, অবিচার, অশান্তির জন্ম দিচ্ছে তাকে টিকিয়ে রেখে শুধু গুটিকয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সমীচীন নয়, প্রয়োজন পুরো সিস্টেমের পরিবর্তন। কিন্তু এ সত্য বোঝার মতো মানসিক অবস্থা কয়জনের আছে?

রেলগাড়ি উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম যে দিকেই যাক রেললাইনের উপর দিয়েই যেতে হয়, লাইনের বাইরে গিয়ে চলতে পারে না। একইভাবে আপনি যতই স্বাধীনতার কথা বলুন, মুক্তির কথা বলুন, মুক্তচিন্তা বা মুক্তমনের ধুয়া তুলুন, সেসব কথার কথা। বাস্তবে আপনার জীবন নামক রেলগাড়িটি চালিত হচ্ছে সিস্টেম নামক রেললাইনের নির্দিষ্ট রাস্তা ধরে, নির্দিষ্ট গন্তব্যে। আসলে আপনি কিছুই করছেন না, আপনাকে দিয়ে করানো হচ্ছে। আপনার মস্তিষ্ক, আপনার চিন্তা-ভাবনা, আপনার সিদ্ধান্ত- সবই সাম্রাজ্যবাদের কষা ছকের অন্তর্ভূক্ত। আপনি বাস্তবায়ন করছেন মাত্র।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.