নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

দিনলিপি: নাকি বাবাই আমার মতো হচ্ছেন!

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ ভোর ৪:৫৩

আগষ্ট-১৯৯৬।
পশ্চিম চাঁনপুর, গয়ামবাগিচা রোড, কুমিল্লা।

আমার জীবন একেবারেই অন্যরকম। আমার বাবার সঙ্গে আমার ঠিক যতটা মিল, ঠিক ততোটাই আবার অমিল। তাই বাবার সঙ্গে আমার আজকাল এতো তর্ক-বিতর্ক চলে।
বাবাকে আমি একবিন্দুও দেখতে পারি না। আবার বাবাকে ছাড়া একবিন্দুও বাঁচি না। যতই বড় হচ্ছি, ততোই লোকে বলছে আমার চেহারা ক্রমাগত বাবার মতোই হচ্ছে। তবে কি আমি এখন আমার বাবার যেসব স্বভাব পছন্দ করি না, সেসব স্বভাব আমার জীবনেও বর্তাবে!
বাবা সারাক্ষণ তার জীবন-সংগ্রামের কথা বলবেন। আমি এটা শুনতেই পারি না। ভীষণ মগ্ন হয়ে পড়ছিলাম বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী উৎপল দত্তের একটি সাক্ষাৎকার। বাবা এসে, আমার ভবিষ্যৎ চিন্তায় দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলেন মায়ের সঙ্গে। যে নেশা নিয়ে শুধুই পড়ে, তার পেশা কী হবে...এই ভাবনা তার। আমিও গেলাম ক্ষেপে। তেড়ে গিয়ে বললাম, আমি চাঁদাবাজি করি, ভিক্ষা করি, না খেয়ে মরি, বেকার থেকে আত্মহত্যা করি...এসব আপনার দেখার বিষয় নয়। আমার জীবন আমার। একান্তই আমার। আপনি আমাকে জন্ম দিয়ে আমার জীবনটাকে একেবারে কিনে ফেলেননি। আমার জীবন নিয়ে আপনার এতো ভাবার কিছু নেই।
অথচ আমার এই বাবাকে যখন পড়তে দেই সাহিত্যের বিভিন্ন বই, তখন তিনি নিজেও নিবিষ্ট হয়ে পড়েন। চর্যাপদ পড়ে আমি বুঝলাম, যুগে যুগেই আমার মতো লোক নিশ্চয়ই এই বাংলায় জন্মেছেন। কিন্তু আব্বা বলেন, লেখালেখি করা হলো রবীন্দ্রনাথের মতো জমিদারের কাজ। কিন্তু আমি বলি, তাহলে কাজী নজরুল কিংবা জীবনানন্দ দাশ কোন জমিদার ছিলেন? আমি ঠিক জানি না, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে আমার মতো এতো যন্ত্রণা বহণ করতে হতো কী না।
পড়তে গেলাম ঢাকায়। কুমিল্লায় একজনের প্রেমকে উপেক্ষা করেই চলে গেলাম। কিন্তু কোনো লাভই হলো না এতে। কারণ ঢাকায় আমি আবার পাগল করে দিলাম ফারজানা ইসলাম রূপালিকে। রূপালি আমাকে নিয়ে পালাতে চাইলো। অথচ আমি বারবারই প্রেমকে উপেক্ষা করে গিয়েছি। কিন্তু প্রেম আমার পিছু ছাড়েনি কোনোদিনও।
আর আমাকে এই প্রেমে উন্মাদ করে ছেড়েছেন স্বয়ং শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই ঋষি আমাকে নিঃশেষ করে দিয়েছেন। কোনো চেষ্টাতেই আমি তাঁর বাঁধন কাটাতে পারলাম না। এই লোকের যে এতো শক্তি, কোনোদিনও ভাবতেও পারিনি। কাজী নজরুল ইসলামকেও অতিক্রম করেছি আমি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসভুক্ত বেগম রোকেয়া, মীর মশাররফ হোসেন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনানন্দ দাশ...সবই পড়েছি। কিন্তু কোনো পোষ মানিনি কারো। বশ্যতা মেনেছি জীবনানন্দ দাশের। আর সুকান্ত ভট্টাচার্য ও সোমেন চন্দ তো আমার বিপ্লবী বন্ধু। শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভালো লাগে। মাথায় রক্ত ওঠে হুমায়ূন আহমেদ পড়তে গেলে। লেখাকে হুমায়ূন বিনাশ করে ছেড়েছেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর গল্প বাবার মুখে শুনতে ভালো লাগতো ওই ছেলেবেলাতেই। এখন ভালো লাগে না।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হয়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগের চর্যাপদ - মঙ্গলকাব্য - বৈষ্ণব পদাবলি ও অনুবাদ সাহিত্য - বাউল গান রামায়ণ, মহাভারত অনেক কিছুই পড়েছি আমি। কিন্তু আমার সাবেরুল ইসলাম ( মাহাম্মদ আলী) জ্যাঠা বলেন, কলকাতা শহরকে না দেখলে বাংলা লিখতে পারবি না। তিনি কলকাতা ছিলেন। লিখতেন। কবিতা আর উপন্যাস। আমার লেখালেখির প্রথম প্রেরণা তিনি। কিন্তু বাংলায় পড়তে গিয়ে আবিদ হোসেনের মতো প্রতিভা দেখে আমি তো অবাক। যার কাছে আমি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি চৈতন্যজীবনীসাহিত্য এবং মঙ্গলকাব্য বুঝেছি টিচার-ম্যাডামদের চেয়ে আরও অনেক ভালোভাবে। কিন্তু রবীন্দ্রসাহিত্য বুঝবার জন্য আমি সবসময়ই বিভিন্ন লাইব্রেরীতে পড়ে থাকতাম। এ জন্য আমি নিয়মিত ক্লাসেও যেতাম না। ক্লাসে আরেক কারণে যেতাম না। ঢাকার দীননাথ সেন রোডের মেয়ে শ্রাবন্তী রায় ছিলো আমার ক্লাসের মেয়ে। প্রথম ক্লাসেই তাকে দেখে খুন হয়েছিলাম আমি। সেটা ১৯৯১ সালে। এতো সুন্দরী কোনো নারী হতে পারে, শ্রাবন্তী রায়কে না দেখলে কেউ তা বিশ্বাস করবে না। সাক্ষাৎ দেবী নেমে এলেন আমাদের কাছে। কিন্তু তার সঙ্গে ছিলো আমার বিশাল শ্রেণিগত পার্থক্য। তাই তাকে বছর বছর চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলাম না। তার রূপ ছিলো এমনই ভয়ানক যে, এই রূপে উজ্জ্বল হওয়া বা আলোকিত হওয়ার বদলে পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই ছিলো বেশি। তাঁর কাছ ঘেঁষে তাই কেউ তেমন হাঁটতোও না। একসময় প্রশান্ত রায় হাঁটতে গিয়ে রূপের তাপ দেখে নিজেই সরে গেল। খন্দকার জাহিদ একবার তাকে নিয়ে আকারে প্রকারে এক কবিতা লিখে পাঠও করলো। শ্রাবন্তী পাত্তাও দিলো না।
বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য চর্যাপদ এর বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ়ার্থ আমার মাথায় প্রবেশ করতো না। আবিদ যে কতো ভাবে আমাকে ওই সাংকেতিক পদগুলি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছে। লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ পড়ে আমার অগাধ অর্থ উপার্জন হয়নি ঠিক। কিন্তু আমি আমার তৃষ্ণা নিবারণ করে বেঁচে থেকেছি।
আমাদের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর ক্লাসে ম্যাডামগণ ‘কৃষ্ণকথা’ বলতে গিয়ে প্রেমের আলাপও জুড়ে দিতেন। অবশ্য তা শিল্পিত আর সাহিত্যিক প্রেম। আর বৈষ্ণব পদাবলি! সেও তো ওই ‘প্রেম’ নিয়েই ক্লাস। বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস পড়তে গিয়ে আমরা যে পারস্পরিকভাবে ধর্মবর্ণনির্বিশেষে প্রেমে সিক্ত হইনি, তা কিন্তু নয়। নারায়ণগঞ্জের পাগলার শেলীও তা জানতো। শেলীর সঙ্গে শ্রাবন্তী রায়ের একটি বিশাল পার্থক্য: শেলী চিঠির উত্তর লিখে। শ্রাবন্তী লিখে না। ভক্তের জন্য তাঁর হৃদয়ে করুণার উদ্রেক হয় না। কৃষ্ণের জন্য এতো লীলার মাধুর্য পাঠ নিয়েও মেয়েটা কেন রোমান্টিক প্রণয়ে আসক্ত হয় না, আমার জানা নেই । বৈষ্ণব কবিরা কৃষ্ণকে যেভাবে প্রার্থনা করেছেন, আমি তার চেয়েও বেশি করে শ্রাবন্তী রায়কে প্রেমিকারূপে প্রার্থনা করেও যখন বিফল হয়েছি, তখন বলতে বাধ্য হয়েছি গ্রিসের ঈশপের সেই গল্পটি ‘আঙ্গুর ফল মনে হয় টক’। ‘সই কেমনে ধরিব হিয়া।/আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়/ আমার আঙিনা দিয়া’ কিংবা ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর।’।/
আমার বাবা আমার ভবিষ্যৎ ভাবনায় এতো উদ্বিগ্ন হয়েও যখন আবার আমার কাছ থেকে নিয়েই রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বাণী রায় এবং হর্ষ দত্তের উপন্যাস পড়েন, তখন আমিও আবার ভাবি, বাবা কি তা হলে আমারই মতো হয়ে যাচ্ছেন! বাবাকে আমি কোনো কোনো বিষয়ে একবিন্দুও দেখতে পারি না। যেমন: আমি লেখাপড়ায় খুব মগ্ন হলে বাবা বলেন, এমন পড়ার নেশা যার, তার পেশা হবে কী! অথচ যতই দিন যাচ্ছে, ততোই দেখছি বাবা আমার মতোই মারাত্মক নেশা নিয়ে গ্রন্থ পাঠ করছেন। তাহলে কি আমি বাবার মতো হচ্ছি! নাকি বাবাই বরং আমার মতো হচ্ছেন ক্রমাগত!

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ ভোর ৫:৩৫

ঢাকার লোক বলেছেন: ভাল লিখেছেন, বেশ লাগল পড়তে। আপনার বাবা ভাগ্য ঈর্ষা করার মত! আপনি ভাগ্যবান, আল্লাহ আপনাকে, আপনার বাবাকে নেক হায়াত দান করুন।

২| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:০৭

রাজীব নুর বলেছেন: বাপ যে কি জিনিস!!
বুকের মধ্যে মোচর দিয়ে উঠে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.