নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন গাধামানব

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন

ডাল দিয়ে ভাত খাই, রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মানুষ আমি ভেজাল হলে'ও আমার লেখাগুলো খাঁটি ।

মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডাক্তার ওষুধের কোন নাম লিখবেন? ব্র্যান্ড নাম নাকি জেনেরিক?

০১ লা জুলাই, ২০১৭ রাত ১২:৫৮

আমার এক অচিকিৎসক বন্ধু ফেসবুকে লিখলেন, ওষুধ কোম্পানির নির্ধারিত ‘ব্র্যান্ড নাম’ না লিখে ওষুধবিজ্ঞান প্রদত্ত ‘জেনেরিক নাম’ লেখা শ্রেয়তর। এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ভাবনা, ফেসবুকসহ যেকোনো জনমাধ্যমে নিজের মত প্রকাশের অধিকার তার অবশ্যই আছে। সেই মতের বিপরীত প্রতিক্রিয়া জানাবার অধিকারও অন্যদের আছে। দু’জন চিকিৎসক বন্ধুকে দেখলাম সেই অধিকারের প্রয়োগ করেছেন। তাদের ভাষ্য, ওষুধের বাণিজ্যিক নামের বদলে জেনেরিক নাম লিখলে রোগীর ক্ষতি ও ওষুধের দোকানদারের সমূহ ফায়দা হবার সম্ভাবনা আছে। উদাহরণস্বরূপ একই ওষুধের দাম কোম্পানিভেদে ৫-৩০ টাকা ওঠানামা করতে পারে, ফলে রোগী ওষুধের মানে ও দামে প্রায়শই ঠকবেন- এই তাদের ধারণা।

তাদের মৃদু বাদানুবাদ পড়তে গিয়ে ভাবলাম, এই লেখালেখির ব্যাপারে বিজ্ঞানের বক্তব্য কী? আসলে কোন পদ্ধতিতে ওষুধ প্রেসক্রাইব করা উচিৎ? এতে কার কী লাভ, কী ক্ষতি? সামান্য ঘাঁটাঘাঁটি করে যা পেলাম তার সারমর্ম অনেকটা এরকম-

বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে জেনেরিক প্রেসক্রিপশন চালু আছে। তাদের এই প্রক্রিয়া চালুর শুরুর দিককার অভিজ্ঞতা তেমন সুখের না। চিকিৎসকরা বিভ্রান্ত, এই নতুন প্রক্রিয়ায় ওষুধ লিখে কী হবে? জেনেরিক নাম এক হলে ওষুধের মান এক নাও হতে পারে। তাদের এসব চিন্তার কারনে একটি বড় অংশের চিকিৎসকরা নতুন নিয়ম বাধ্যতামূলক না হওয়া পর্যন্ত পারতপক্ষে জেনেরিক নাম লিখতেন না।

রোগীদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। যে ওষুধের দাম রোগীর নাগালে, রোগী সেই ব্র্যান্ডের ওষুধ নিজের ইচ্ছেমত কিনবার স্বাধীনতা পেল। তবে যেসব ক্ষেত্রে দোকানদারের পছন্দে ওষুধ দেয়া হল, সেখানে নিম্নমানের অথচ উচ্চমূল্যের ওষুধ দেয়া হল। এক পর্যায়ে রোগীদের মাথায়ও ঢুকে গেল, সব ওষুধের মান তো আর এক রকম নয়! কেউ কেউ একই জেনেরিক নামের নানা ব্র্যান্ডের ওষুধ খেতে লাগল, অনেকের ওষুধ খাওয়া হয়ে গেল অনিয়মিত। উচ্চ রক্তচাপের একদল রোগীর উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেল জেনেরিক ওষুধ লেখার পর সবার উন্নতি একরকম নয়, এসব কারনে ওষুধের মান নিয়ে সংশয় সমাজে আরও বদ্ধমূল হল।

রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে জেনেরিক নাম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কারনে ব্যাপারটি নিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থার ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা গবেষণা চালানো হয়। গবেষকরা দেখলেন, যদি বাণিজ্যিক নামে ওষুধ লেখা হয় তাহলে সবার ওষুধ চিনতে সুবিধা হয় বটে, কিন্তু এর অসুবিধাও অনেক। প্রথমত, এতে রোগীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের কোন গুরুত্ব থাকে না, ডাক্তারবাবু যা লিখে দিয়েছেন কেবলমাত্র ঐ ওষুধটিই খেতে হবে। তখন ডাক্তারের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপর পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করে, এই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে নানা আয়োজন তো আছেই! দ্বিতীয়ত, নামী ব্র্যান্ডের ওষুধের নকল হয় বেশি, ফলে রোগী বেশি পয়সা দিয়ে ভুয়া ওষুধ খাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তৃতীয়ত, ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যাল্যু বাড়াতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ (নৈতিক ও অনৈতিক) করে, তার সিকিভাগও ওষুধের মান উন্নয়নে ব্যয় করে না। চতুর্থত, একটি রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যয়ের একটি বড় অংশ যায় ওষুধখাতে, আমেরিকায় জেনেরিক নাম ব্যবহারে বার্ষিক সাশ্রয়ের পরিমাণ ১৫৮ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাজেটের তিনগুণ!

এসব কারনে বিশ্বের অধিকাংশ সচেতন জাতি তাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় জেনেরিক নাম ব্যবহারের চেষ্টা করছে। অনেক দেশে চিকিৎসকদের বিভিন্নভাবে জেনেরিক নামে ওষুধ লিখতে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। রোগীদের জেনেরিক ওষুধ ব্যবহারের সুবিধা বোঝানোর নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রোগী ও চিকিৎসক- উভয়ের একই অভিযোগ, জেনেরিক নামে ওষুধ লিখলে নিম্নমানের ওষুধ পাবার সম্ভাবনা থাকে। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও আমেরিকায় জেনেরিক নামে বিক্রিত ওষুধের মানে তারতম্য কঠোরহস্তে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এসব দেশে ৭০-৮০ শতাংশ প্রেসক্রাইবড ওষুধ জেনেরিক নামে লেখা হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন আগামীতে প্রায় সব ওষুধই জেনেরিক মানে নিয়ে আসা সম্ভব হবে, কারন অধিকাংশ ওষুধের পেটেন্ট আগামী ২০ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে আসবে, ফলে নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছে একটি ওষুধের উৎপাদন, বিপণন ও নামকরণের সত্ত্ব আর সীমাবদ্ধ থাকবে না। গবেষকরা আশা প্রকাশ করেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে ওষুধের যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এবং চিকিৎসাব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত সবাই জেনেরিক নাম ব্যবহারে সচেতন হলে ওষুধের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রাণরক্ষাকারী একটি পণ্যে কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাণিজ্য ও অসাধু কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের মতো দেশে, বিশেষত যেখানে স্বাস্থ্যখাতে নানা নৈরাজ্য বিদ্যমান এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে স্বাস্থ্যখাতের মানোন্নয়নে দৃশ্যমান উদ্যোগ খুবই কম, সেখানে জেনেরিক নামে ওষুধ লেখার প্রসঙ্গে রোগী ও নীতি নির্ধারকদের সচেতন করার ক্ষেত্রে চিকিৎসক সম্প্রদায়সহ সচেতন সকল নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।

(লেখক- চিকিৎসক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, ইন্সটিটিউট অব হেলথ ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ, ভারত এবং জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র)

লেখাটি লিখতে যেসব গবেষণাপত্রের সাহায্য নেয়া হয়েছেঃ
১. Kesselheim et al. Clinical equivalence of generic and brand name drugs used in cardiovascular disease: a systematic review and meta-analysis. JAMA. 2008;300(21)2514-2526
২. Toverud et al. Norwegian patients on generic antihypertensive drugs: a qualitative study of their own experiences, European Journal of Clinical Pharmacology, January 2011, Volume 67, Issue 1, pp 33–38.
৩. Heikkila et al. Customers’ and physicians’ opinions of and experiences with generic substitution during the first year in Finland, Elsevier Journal of Health Policy
Volume 82, Issue 3, August 2007, Pages 366-374.
৪. Davit et al. Comparing generic and innovator drugs: a review of 12 years of bioequivalence data from the United States Food and Drug Administration. Ann Pharmacother. 2009;43(10):1583-97.
৫. SAVINGS An Economic Analysis of Generic Drug Usage in the U.S., GPhA, September 2011, page 1.
৬. Weiss et al., Challenges to medicine: the case of prescribing, Sociology of Health and Illness, June 1997, Available at: Click This Link
৭. Hill A., Generic prescribing — a change of habit, J R Coll Gen Pract 1985; 35 (271): 89-90.

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জুলাই, ২০১৭ রাত ১:০৭

মেঘনা পাড়ের ছেলে বলেছেন: গুরুত্বপূর্ন বিষয়। আপনি চিকিৎসক হয়েও আমাদের বাংলাদেশের চিকিৎসকদের মতপোষন না করে যেটা হওয়া উচিত সেই পক্ষাবলম্বন করেছেন দেখে সত্যিই ভাল লাগলো

২| ০১ লা জুলাই, ২০১৭ রাত ১:১৮

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: ধন্যবাদ ভাল বিষয় নিয়ে লিখেছেন ।
এ বিষয়ে অনেক কথা বলার আছে ।
তবে আমি ঔষধের জেনেরিক নাম ব্যবহারের পক্ষপাতি।
শুভেচ্ছা রইল

৩| ০১ লা জুলাই, ২০১৭ রাত ১:৩৩

ভ্রমরের ডানা বলেছেন:


জেনেরিক নাম বুঝে ওষুধপাতিরর ডোজ দেবার মত কত জন ফার্মাসিস্ট রয়েছে দেশে? বিদেশবিভূঁই গেলে এসব দেশপ্রেম মাথা চাড়া দেয়। বাস্তবতা হল আমরা এখনো ফাইফ পাশ ফার্মাসিস্ট থেকে ওষুধ নেই! আপনি পোষ্টে দারুণ উচ্চাসা দেখিয়েছেন। আঘামী একশত বছরেও তা পূরণ হবে কিনা সন্দেহ। কারণ ফাইভ পাস ফার্মাসিস্টরাই এখন নামের আগে ডাঃ লেখে এটাই বন্ধ হচ্ছে না। আর আপনি জেনেরিক ফেনেরিকে বন্দি। হা হা হা!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.