নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইকবাল সুমন

"ঘোড়ার ডিমের খোঁজে নয়, ডিমওয়ালা-ঘোড়ার খোঁজে...

ইকবাল হোসাইন সুমন

আমি ইকবাল সুমন। মাঝে মাঝে টুকটাক লিখা লিখি করি। এছাড়া কোন কিছু করি না।

ইকবাল হোসাইন সুমন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গিনিপিগদের সুখ দুঃখ ( পর্ব-২ )

২০ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ৯:১৫







দুপুরের খাওয়া-দাওয়া, রহিমের বার্থডে, একটু আধটু ঘুরাঘুরি করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। আর দেরী না করে আমরা বাসার দিকে ফিরতে হল। নীলাদের বাসাটা আমার বাসায় যাওয়ার পথেই পড়ে। একটু পরেই রহিমকে নামিয়ে দিতে হবে।



রহিম তার দূরসম্পর্কের এক মামার কাছে থাকে। কাঁচা-পাকা একটা ঘর। থাকা এবং খাওয়া বাবদ প্রতিমাসে তার মামাকে ১৬০০ টাকা দিতে হয়। মামী তাকে রাখতে প্রথমে রাজী হয়নি। কারণ রহিমকে রাখতে গেলে তাদের অভাবটা আর বেড়ে যাচ্ছিল। এখন রহিমের মামী আর না করে না। কারণ রহিম তাদের সংসারে অনেকটা সাহায্য করে। ১৬০০ টাকার বাহিরেও তার ইনকামের সব টাকা রহিম এখানে খরচ করে।



৩টার দিকে মাহিন কে ফোন করেছিলাম। বললাম, তোর ওখানে কয়েকদিন থাকতে হবে। মাহিন জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে, মেস কি ছেড়ে দিলি। আমি বললাম, না, ছাড়িনি। অন্য একটা ব্যাপার। তোকে এসে বলছি।



আমাদের মেসে আমরা মোট চারজন থাকি। সিরাজ ভাই, সেলিম ভাই আর আমি আর কৌশিক। কৌশিক সিটি কলেজে ইন্টারে পড়ে। আজ সে বাড়ি যাবে মিনিমাম ১৫ দিনের জন্য। সিরাজ ভাই কয়েকদিন হল অফিসের কাজে জাপান গেছে। সুতরাং আমি এবং সেলিম ভাইই বাসায় আছি আগামী কয়েকদিন।



মাহিন আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ওকে ভালই জ্বালাই। যে সব ব্যাপার শেয়ার করা যায়, সবটুকু শেয়ার করি। তাকে প্রায় মজা করে বলি, “পুনর্জন্ম নামে যদি কিছু থাকে, তাহলে আমি সেই জন্মে তোকে আমার বাপ হিসেবে চাইব”। এ কথা শুনে মাহিন দাঁত কেলিয়ে হাসে।



আমরা রিক্সায় যখন বাসার পথে যাচ্ছিলাম। তখন প্রায় শেষ বিকেল। সূর্যের শেষ রশ্মিটা একটুআধটু দেখা যাচ্ছে। আমি নীলার দিকে অনেকটা ইচ্ছে করে তাকিয়ে ছিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি, চুলগুলো অনেকটা মুখের উপর সরে এসেছে। কিন্তু মুখে কোন বিস্বাদ নেই। অনেকটা সাবলীল। চোখগুলো তন্দ্রাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে রিক্সার ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা ভঙ্গ হচ্ছিল। আমি শক্ত করে নীলাকে ধরে আছি অনেকটা , যেন পড়ে না যায়। রহিম নীলার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগে। তাকেও অন্য একটা হাত দিয়ে ধরে রাখতে হচ্ছে।

আমাদের রিক্সা যখন অলিগলি দিয়ে চলছে, শহরের প্রতিটা দালান অতিক্রমের সাথে সাথে বিকেলের শেষ আলোগুলো নীলার মুখে পড়ে অনেকটা মাদকতায় পরিপূর্ণ করে দিচ্ছিল। আমি একপাশ থেকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছি তার মুখে তাকিয়ে আছি অনেক্ষন ধরে। সে ভাল লাগাটা অন্য সব ভাল লাগা থেকে আলাদা।



একটু বেশি ঝাঁকুনিতে নীলা তন্দ্রা থেকে জেগে উঠল। দৃষ্টিটা সরাসরি আমার চোখের দিকে পড়ল। একটু মুস্কি হেঁসে বলল,

-তাকিয়ে আছ কেন?

-তোমাকে দেখছিলাম।

-নতুন করে দেখার কি আছে।

-না, আমি পুরাতন করেই দেখছিলাম।এই বলে একটু মৃদু হাসলাম।

-না, কখনো এভাবে দেখিনি তো। তাই জিজ্ঞাসা করলাম।

-না, আমি তো তোমাকে সব সময় দেখি।

-মিথ্যা কথা। আমি কখনোই দেখিনি যে তুমি আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছ।



আমি আবার মৃদু হাসলাম। আর মনে মনে বললাম, মুখের দিকে দৃষ্টি দিয়ে মানুষকে দেখার চেয়ে , অন্য দিকে দৃষ্টি দিয়ে ইমাজেনেশান করে হাজার গুনে ভাল দেখা যায় এবং এ দেখাটার মধ্যে একটা স্বাধীনটা আছে। কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দেখাটা মানুষের স্বাধীনতা অনেকটা খর্ব করে। “এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?” “বোকার মত তাকিয়ে আছ কেন?” “তোমার তাকানোর স্টাইলটা ঠিক নাই” “একটু রোম্যান্টিকভাবে তাকাতে পার না”। এ সব কথা শুনার চেয়ে, হয়তো এক সেকেন্ড দৃষ্টিপাত করে, হাজার সেকেন্ড কল্পনা করে একটা মানুষটাকে অবলোকন করা অনেক ভাল।



নীলা রহিমের মাথায় বিনি কেটে দিতে দিতে কথা বলছিল। সত্যি কথা বলতে কি অদ্ভুত একটা মায়া পড়ে গেছে রহিমের উপর। সে মায়াটা এখন এর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। এর অনেকটা অংশ দখল করে নিয়েছে নীলা। প্রথম প্রথম রহিমের ব্যাপারটা নিয়ে নীলা আমার উপর অনেকটা বিরক্ত ছিল। মনে মনে অনেকটা কষ্টও ছিল। কারণ রহিমের জন্য অনেকবার আমি নীলার সাথে দেখা করার শিডিউল বাদ দিয়েছি। তার সাথে সময় কাঁটাতে যেয়ে কতবার যে নীলার কথা ভুলে গেছি তার ইয়াত্তা নাই। গত ভালবাসা দিবসে রহিমকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম নীলার সাথে দেখা করার জন্য। আমারও নিজের ইচ্ছে ছিল না রহিমকে নিয়ে আসতে। কিন্তু রহিমের জন্য কেন জানি একটা আবেগ সব সময় তাড়া করে বেড়ায়।

ভালবাসা দিবসে দিন সকালে রহিম আমাকে বলেছিল, “ মামা, সবাই কি আজ ভালবাসা করে”। আমি মুস্কি হেসে বললাম, “করে তো। তুই বড় হলে তুইও করবি”।

-মামা একটা কথা বলতাম।

-বল।

-আজ আমি মিন্টু মামা থেকে ছুটি নিয়েছি। বলেছি অমিত মামার সাথে বাহিরে যাব। সবাইকে ভালবাসা করতে দেখব।



সেদিন আমি ছোট্ট এ মানুষটাকে না বলতে পারিনি। নীলা অনেকটা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছুই বলেনি। কিন্তু আমি যে তার মনের ভাষাটা একদম বুঝি না তা কিন্তু নয়। কিন্তু আমাদের সময়টা খারাপ কাটেনি। কিন্তু ভালবাসা দিবসের ‘ভালবাসা করাটা’ রহিমের দেখা হয়নি। কারণ রহিম সারাদিন গেম নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভালবাসার সংজ্ঞাও পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন রহিমের কাছে তার ‘ভালবাসা করা’টা হচ্ছে তার গেম খেলা। আমার কাছে অনেকটা আমার বাবা-মা, নীলা, রহিম। সেই ভালবাসা দিবসের শেষ বিকেলে যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন আমার এবং নীলা ২ জনেইই মোবাইলের চার্জ শেষ। রহিম গেম খেলে পুরো চার্জটাই শেষ করে দিয়েছিল। তার বিনিময়ে প্রাপ্তি আমাদের কম কিসের। আমরা আমাদের মত সারাদিন থেকেছিলাম রহিমকে আমাদের কাছে রেখেও।

“দাগ থেকে হয় যদি ভাল কিছু, দাগটাই ভাল” - অনেকটা এ ধরনের... হা...হা...



পৃথিবীতে পছন্দ-অপছন্দের জন্য যে পরিমান রিলেশান ভেঙ্গেছে, ভালবাসার অত্যাচারে তার থেকে বেশী রিলেশান ভেঙ্গেছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমি পৃথিবীর সবচে সুখিতমদের মধ্যে একজন। কারণ নীলা থেকে আমি কখনো ভালবাসার অত্যাচার সহ্য করতে হয় না।

যে কোন রিলেশানের প্রথম দিকে ২ জনের মধ্যে পছন্দ অপছন্দগুলো মিলে গেলে যে রিলেশানটা অনেক সুন্দর হবে এমন কোন কথা নেই। কারণ পছন্দ অপছন্দ গুলো সব সময় তার স্থান পরিবর্তন করে। ভিন্ন পছন্দ অপছন্দের মানুষগুলোর সাথেও রিলেশান টিকে যেতে পারে দীর্ঘ পরিসরে। কারণ সুদীর্ঘ একটা সময় পরে প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীদের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারগুলো এক বিন্দুতে এসে অনেকটা ব্রেক ইভেন্ট পয়েন্ট এর মত কাজ করে। নীলা আর আমি অনেকটা ব্রেক ইভেন্ট পয়েন্টে দাড়িয়ে আছি। সরাসরি হয়তো আমাদের ভালবাসার পরিসরটা দৃষ্টিগোচর না। কিন্তু আরও হাজার মানুষ থেকেও আমাদের ভালবাসার পরিমাণটা বেশী বৈকি, কম না।



পথে রহিমকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় রেখে আসলাম। আমি আর নীলা রিক্সায় আর একটু পথ যেতে হবে। বিকেলের শেষ আলোটা এখন আর নেই। নীলা আমার হাতটা ধরে আছে, মাথাটা আমার কাঁদে সামান্য ছুঁয়ে আছে। এখনো অনেকটা তন্দ্রাচ্ছন্ন। হুটখোলা রিক্সায় শহরের মৃদুমন্দ আলো এবং কোলাহলগুলো কেন জানি ভাল লাগছে। হাতে এখনো অনেকগুল কাজ, বাসায় যেতে হবে, খেয়ে আবার যেতে হবে মাহিনের বাসায়। তাকে আগেই বলা হয়েছে। বিকেল ৪ টার দিকে বুয়াকে ফোন করে বলেছি, একজনের বেশী খাওয়া দিতে। আমার একজন গেস্ট আসবে। বুয়া বলল, “কোন সমস্যা হবে না ভাইজান, ফ্রিজে সব কিছুই আছে”।



পকেটে টুংটাং করে রিং বেজে উঠল, দেখি সেলিম ভাইয়ের ফোন। কেন জানি মনে হচ্ছিল কিছুক্ষনের মধ্যেই উনি ফোন দেবে, তাই হল। ফোন করেই উনি হাও মাউ করে কেঁদে উঠল।

-মিলিকে পাওয়া যাচ্ছে না।

-কি বলেন ভাই, কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না? !!!

-দুপুর থেকে। ওর মা বলল, দুপুরের দিকে বের হয়ে গেছে। গাড়ি নিয়েও ও বের হয়নি। শুধু কয়েকটা কাপড় সহ একটা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেছে।

-কেন ফোন করেননি।

-ফোন সুইসড অফ। (এই বলে আবার মেয়েলি কান্না শুরু করল সেলিম ভাই)

-আরে ভাই চিন্তা কইরেন না। হয়তো উনার বান্ধবীর বা অন্য কোন বাসায় গেছে। সেখানে হয়তো ফোনে চার্জ শেষ হয়ে গেছে আর আর কি। কিচ্ছু হবে না। দেখবেন ফিরে আসবে।

-তুমি বুঝতে পারছ না। ও এমন কোন দিন করেনি। আমি এখন কি করব কিছুই বুঝতে পারছিনা, তুমি এখন কোথায়?

-আমি বাসায় আসতেছি। সাথে নীলা আছে। ওকে বাসায় রেখে আমারও বাসায় যেতে হবে। সারাদিন বাহিরে ছিলাম। একটু চেঞ্জ করব।

-ভাই , আমার মাথায় এখন কিছুই আসতেছে না। আমি কি করব, তুমি একটু বলে দাও।

-বাদ দেন তো ভাই। দেখবেন কিছুক্ষণ পরে খবর পাবেন।

-তুমি বলতেছো তো ভাই!!!

-ভাই, আপনার সাথে কি গাড়ি আছে।

- হা গাড়ি আছে। কিন্তু ড্রাইভার তো নাই।

-ড্রাইভার দরকার নাই। আপনি ড্রাইভ করে চলে আসেন। বাসার সামনে থেকে আমাকে পিক কইরেন। আমার খুব আর্জেন্ট কাজ। ১ ঘণ্টার মধ্যেই আসলে হবে।



আমি মনে মনে চিন্তা করছিলাম, আমার কথা শুনে সেলিম ভাইয়ের চেহারার অবস্থা কেমন হবে। মনে মনে বলবে, আমি আমার বউকে খুজে পাচ্ছি না। আর এই ছেলে বলছে ওর আর্জেন্ট কাজ আছে। কিন্তু আমি এটা জানতাম, উনি মনে মনে যাই ভাবুক, ঠিকেই উনি সময় মত চলে আসবে। কেন জানি উনি আমাকে অপ্রয়োজনীয় বিশ্বাস করেন। আমার প্রত্যেকটা কাজে কোন না কোন অর্থ খুজে পান। সেটা আমার কাছে রীতিমত একটা বিস্ময়ের ব্যাপার।



নীলাকে রেখে বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা ৭ টা। ২৫/৩০ মিনিটের মধ্যে রেডি হতে হতে নিচে সেলিম ভাইয়ের গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেলাম। এর মধ্যে আমি খাওয়াটাও খেয়ে নিলাম। দেখলাম বুয়া মোট ৫ জনের রান্না করেছে। আমি জানতাম বুয়াকে গেস্টের কথা বললে সব কিছু একটু বাড়তি রান্না করে এবং খাওয়ার মানটাও ভাল হয়।



নিচে নেমেই সেলিম ভাইকে বললাম, “শুক্তাবাদের দিকে চলেন”।

সেলিম ভাইয়ের চেহারাটা দেখার মত। বিধ্বস্ত প্রায়। অনেকটা আমার প্রতি বিরক্ত। বউ হারানোর শোকে যে কারো এ ধরনের চেহারা হবে এটাই স্বাভাবিক। পরিবেশের সাথে মিলিয়ে আমিও আমার মুখটাকে অনেকটা গম্ভীর করে রাখলাম।



শুক্রাবাদ পৌছতে আমাদের প্রায় ৮ টা বেজে গেল। শ্যামলী কাউন্টারে ডুকে দেখি মিলি ভাবি বসে আছে। ১৫/২০ মিনিট আগে উনি কুষ্টিয়া থেকে এসেছেন। অনেক দিন পরে ঢাকা এসেছেন। সেলিম ভাই ভাবির দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে রইল। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিজের হারানো বউ তার সামনে দাড়িয়ে।

২ মিনিট পরে মৃদু মৃদু হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকাল। বলল, “প্লানটা তোমার, না?”

এর আগেই আমি দৌড় দেওয়ায় প্লান করতেছিলাম।

আমি দাঁত কেলিয়ে একটু হাসলাম। বললাম, “ক্ষমা দিয়েন ভাই, ৫/৬ দিন পরে আপনার সাথে দেখা হবে। সে পর্যন্ত আমার ছুটি, আর আপনার ব্যস্ততা।

এই বলে আমি হাঁটা শুরু করলাম। আমি জানি ২ জনেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

বুয়াকে ফোন করে বললাম, ২০ মিনিটের মধ্যে বাসায় যান। খাওয়াগুলো গরম করেন। আর সেলিম ভাই আসা পর্যন্ত কোথাও যাবেন না।



আমাকে এখন মাহিনের বাসায় যেতে হবে। তারপর সুদীর্ঘ একটা ঘুম দেব।...



( চলবে )

মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.