নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইকবাল সুমন

"ঘোড়ার ডিমের খোঁজে নয়, ডিমওয়ালা-ঘোড়ার খোঁজে...

ইকবাল হোসাইন সুমন

আমি ইকবাল সুমন। মাঝে মাঝে টুকটাক লিখা লিখি করি। এছাড়া কোন কিছু করি না।

ইকবাল হোসাইন সুমন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গিনিপিগদের সুখ দুঃখ ( ‪পর্ব-৭‬)

২৮ শে জুন, ২০১৫ রাত ২:৩২


৩ দিন পর...
গত ৩ দিন নীলার সাথে আমার দেখা হয়নি। আমি ২/১ বার ফোন দিয়েছিলাম। আজ খুব সকালে নীলা আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করল, আমার সময় হবে কিনা।
আমি বললাম, কোথাও যাবে নাকি?
-হ্যাঁ যাব। একটু গাউছিয়া মার্কেটে যাব। কিছু কেনাকাটা করতে হবে। ভাবছি একটা লিপস্টিক কিনবো।
আমি অনেকটা অবাক হলাম। কারণ নীলাকে কখনো সাজগোজ তো দূরে থাক, সাজগোজ নিয়ে কথা বলতেও শুনিনি।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। বললাম, আমি ১ ঘণ্টার মধ্যে আসতেছি।
সকাল ১১ টার দিকে আমরা গাউছিয়া মার্কেটে পৌঁছলাম। নীলা দেখি অনেক কিছু কিনল। আমি অনেকটা খুশিই হলাম। কারণ গত যে কয়টা বছর আমি ওকে চিনি। খুব প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া ও তেমন কিছু কিনে না। নীলা ৩ টা লিপস্টিক কিনল। সবকটা একদম কড়া কালার।একটা লাল, একটা গোলাপি। আরেকটা যেন কি কালার আমি চিনিনি। লিপস্টিকের এত দাম হয় আমার জানা ছিল না।

অনেকক্ষণ হল আমরা একটা দোকানে আছি। নীলা এখনো কি কি যেন দেখছে।
হঠাৎ নীলা আমাকে বলল, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ?
-কি?
-বাহিরের দিকে তাকাও।
আমি বাহিরের দিকে তাকালাম। কিন্তু আমার কিছু নজরে পড়ল না।
নীলা বলল, বাহিরে দেখ। একটা পিচ্চি দাড়িয়ে আছে। বয়স ৬/৭ তের বেশী হবে না। আমি দোকানটায় ঢুকার সময়ও পিচ্চিটাকে দেখেছি। অন্তত ২০ / ২৫ মিনিট ও দাড়িয়ে আছে।এর আগে থেকেও দাড়িয়ে থাকতে পারে। দোকানটার বাহিরের দিকে থাকা শো-কেইজের দিকেই ও তাকিয়ে আছে”

এর ১০ মিনিট পরেও দেখলাম পিচ্চিটি দাড়িয়ে শো-কেইজের দিকে তাকিয়ে আছে।
নীলা আমাকে বলল, যাও পিচ্চিটাকে ডেকে নিয়ে আসতো। আমি বের হয়েই পিচ্চিটাকে ডাকলাম। ডাকার সাথে সাথে পিচ্চিটা দৌড়ে দোকানের ভিতর ঢুকল।
নীলা অনেকটা মমতা নিয়ে পিচ্চিটাকে জিজ্ঞাসা করল, “ তুমি কি কিছু কিনবে, বাবু”?
পিচ্চিটা সাথে সাথে শো-কেইজের ভিতরে থাকা একটা ক্লিপ দেখিয়ে দিল।
দোকানদার মিজান ভাই নীলার পূর্ব পরিচিত ছিল। মিজান ভাই বলল, এটা তো ছোট মেয়েদের ক্লিপ । তুই কি করবি? তুই তো ছেলে।
পিচ্চিটা মিজান ভাইকে কিচ্ছু বলল না, শুধু জিজ্ঞাসা করল, ‘দাম কত’?
আমরা সবাই অনেকটা অবাক হলাম।
তাও মিজান ভাই বলল, “৭৫ টাকা। তোর কাছে টাকা আছে”?...
এর পরে পিচ্চিটা তার পরনে থাকা ময়লা পেন্ট থেকে ভাংতি কিছু টাকা বাহির করল। নীলা খুব আগ্রহ ভরে টাকাগুলো গুনে দেখল। সব মিলিয়ে ৩২ টাকা হয়।
নীলা পিচ্চিটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “বাবু তোমার এ টাকা দিয়ে তো তুমি ক্লিপটা কিনতে পারবে না”।
এই কথা শুনে পিচ্চিটা কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই টাকাগুলো নিয়ে পকেটে রেখে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল। আমারা সবাই অনেকটা অবাক হলাম।
মিজান ভাই বলল, “এরা এমনি। অনেক সময় কিছু চুরি করতে আসে। সুযোগ পেলে কোন কিছু নিয়ে দৌড় দেয়। এদের জ্বালায় না বাঁচি না”।
আমি নীলার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মিজান ভাইয়ের কথাটি নীলা পছন্দ করেনি। কারণ এই পিচ্ছিটার মতনই একজন আছে যে নীলার জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। তার নাম রহিম।

আমাদের মোটামুটি কেনাকাটার পর আমরা নীলক্ষেতের দিকে যাচ্ছিলাম। নীলা এবং আমার ২ জনেই কিছু বই কিনতে হবে। নীলক্ষেত পুরাতন বইয়ের মার্কেটের রাস্তাটির অনেকটা ভিতরে আমরা চলে এসেছি।এখানে দেখলাম কোন একটা বিল্ডিঙের কন্সট্রাকশন কাজ হচ্ছে। বিল্ডিং এর নিচের দিকটা রাস্তার উপর ইট ভাঙ্গা হচ্ছে। হঠাৎ করে নীলা এখানে এসে কেন জানি থেমে গেল।
ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে বলল, “আমি আজ সারাদিন নীলক্ষেতে থাকব। তুমি কি আমার সাথে থাকবে”?
-আমি অনেকটা অবাক হয়ে বললাম, “কেন বই কেনার পরে তোমার আর কোন কাজ আছে”?
- না, কোন কাজ নাই। আমি এমনিই নীলক্ষেতে বসে থাকব।
আমি নীলার কথার মধ্যে কিছুটা রহস্যের গন্ধ পেলাম। কিন্তু আর বেশী প্রশ্ন করলাম না। কারণ আমি জানি প্রথম সেকেন্ডে নীলা যে কথা বলেনি। বারবার জিজ্ঞাসা করলেও সে, সে কথা আর বলবে না।
আমি নীলাকে বললাম, “২ টার দিকে আমাকে ফার্মগেট যেতে হবে। নুহা, মাহিনরা থাকবে সবাই। অনেক দিন ওদের সাথে আড্ডা দেই নাই। গেলে একসাথে সবার দেখাও হয়ে যাবে। তাছাড়া ওদের মধ্যে কার যেন আজ বার্থ ডে। আমাকে কিছু জানায়নি। মাহিন তো তোমাকে আমার সাথে যেতে বলল”।
-কোন সমস্যা নাই। তুমি যাও। আমার মনে হয় যাওয়া হবে না। আমি এখানেই থাকব। আর তোমার কাজ যদি শেষ হয়ে যায়। সাথে সাথে আমাকে একটা ফোন কর।, নীলা বলল।
আমরা বই কেনার পরে নীলক্ষেতেই লাঞ্চ করে নিলাম। খাওয়া দাওয়া করে নীলা আর আমি আবার পুরাতন বই মার্কেটের ঐ রাস্তা ভিতরে গেলাম।

নীলা আর আমি টঙ্গের দোকানের লাল চা খেলাম। এই করতে করতে প্রায় দেড়টা বেঝে গেল। আমি নীলাকে বললাম, ‘তাহলে আমি এখন যাই’।
নীলা বলল, “বই গুলোও আমার কাছে থাক। তুমি আমার থেকে পরে নিয়ে যেও”।
আমি আসার সময় পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, নীলা সেই টঙ্গের দোকানের টুলের উপর বসে আছে। আর দৃষ্টিটা একটু দূরে কতোগুলো মানুষ ইট ভাঙ্গছে তাদের দিকে। হয়তো আজ সারাদিন ও ইট ভাঙ্গা দেখবে।

আমি প্রায় ২ টা ২০ এর দিকে ফার্মগেট পৌঁছলাম। মাহিন জিজ্ঞাসা করল, নীলা আসেনি কেন?
আমি বললাম, “নীলক্ষেতে বসে আছে”।
মাহিন জিজ্ঞাসা করল, “কেন”?
আমি বললাম, “এমনিই বসে আছে। কারণ জানি না”।
ফ্রেন্ডরা সবাই অনেকটা অবাক হল। মাহিন, নুহারা অবশ্য নীলা সম্পর্কে জানে। সুতরাং তারা কিছু বলল না। অনেকদিন পর ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করার মজাটা অন্য ধরণের। এসেই শুনলাম। আজ সামির জন্মদিন। সে আমাদের সবাইকে ইনভাইট করে সেই এখনো আসে নাই। ফোন পর্যন্ত সুইসড-অফ করে রেখেছে। আমরা ভাবলাম বিপদ হয়নি তো। কিন্তু দেখলাম ৩ টার দিকে সে হেলে দুলে উপস্থিত হয়েছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, “কিরে তোর ফোন বন্ধ কেন”?
সামি বলল, “ইচ্ছে করে বন্ধ করে রেখেছি। তোদেরকে অনেকদিন টেনশন দেয়নি। এই জন্য একটু দিলাম”।
সামি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিরে ঐ দিন নীলা রে দেখলাম একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াতে”
আমি স্বাভাবিক ভাবে বললাম, “ ওর হয়তো ফ্রেন্ড হতে পারে।“
সামি বলল, “ঐ ছেলে ওর ফ্রেন্ড হতেই পারে না। বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। খোদার কসম, ছেলেটা ওর বয় ফ্রেন্ড ই হবে”।
সামির কনফিডেন্টলি কথা দেখে আমি নিজেকে অনেকটা অসহায়ের মত মনে হল। কিন্তু মুখে অসহায়ত্ব প্রকাশ করলাম না।
এর পরে সামি বিকট একটা হাসি দিয়ে বলল, “ভয় পাইস না দোস্ত, ছেলেটা আসলে তুই ছিলি”
আমরা সবাই একসাথে হেসে উঠল।

বিকেল সাড়ে ৪ টা পর্যন্ত ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিলাম। খাওয়া পর্ব আবার হল ওখানে।
এর মধ্যে আমি নীলাকে ফোন দিলাম। ভাবলাম হয়তো বাসায় চলে আসছে। ফোন দিয়ে জানলাম, সে এখনো নীলক্ষেতে বসে আছে ঐ টঙ্গের দোকানে। আমি অনেকটা অবাক হলাম। বললাম, “তুমি থাক। আমি আসতেছি”।
নীলা বলল, “একটু তাড়াতাড়ি আসো”।

৫ টার একটু পরে আমি নীলক্ষেত পৌঁছলাম। আমার হাতে একটা খাবারের প্যাকেট। আসার সময় সামি আমাকে দিয়েছে নীলার জন্য।
এসে দেখলাম নীলা তখনো সে টঙ্গের দোকানের টুলটাতে বসে আছে। দৃষ্টি এখনো যে লোকগুলো ইট ভাঙ্গছে তাদের দিকে।
আমি এসেই খাবারের প্যাকেটটা নীলার হাতে তুলে দিলাম। নীলা প্যাকেটটা টুলের উপর রাখল। আমি এসে তার পাশে বসলাম।
নীলা এখনো তাকিয়ে আছে সে দিকে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু বুঝতে পারলাম, সেই দেড়টা থেকে সে এখানে বসে আছে।
দুপুর হলেও, শীতকাল হওয়াতে পরিবেশটা অনেক ঠাণ্ডা। নীলাকে দেখে অনেকটা পরিশ্রান্ত মনে হল। হওয়ারই কথা, সারাদিন তো বাহিরেই আছে। কিন্তু চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম না, ভাল আছে, না খারাপ আছে।
আমি নীলার পাশে বসেই আছি অনেক্ষন ধরে। কিছুই বললাম না। কি বলব বুঝতেও পারছিলাম না। কেন যে সে এখানে বসে আছে তাও আমি জানি না। যাক, মনে মনে বললাম, বসে থাক। আমার তো আর্জেন্ট কোন কাজ নাই। দেখি কতক্ষণ বসে থেকে।
হঠাৎ করে নীলা আমাকে আমাকে বলে উঠল, “দেখতো , দূরে বসা পিচ্ছিটা দেখে বেশি ক্লান্ত লাগছে, নাকি আমাকে দেখে বেশি ক্লান্ত লাগছে?”

আমি এতক্ষণে মনোযোগ সহকারে ‘যে মানুষ গুলো ইট ভাঙছে’ তাদের দিকে তাকালাম। দেখলাম, সেখানে মোট ৫ জন মানুষ ইট ভাঙছে। ৩ জন মহিলা, ১ জন পুরুষ আর একটা পিচ্ছি। আমি একটু মনোযোগ সহকারে খেয়াল করে দেখলাম, এটা তো সেই পিচ্চিটা যাকে আমরা গাউছিয়া মার্কেটে দেখছিলাম।
আমার আর বুঝতে বাকি থাকল না নীলার এখানে সারাদিন বসে থাকার কারণ কি। কিন্তু আমি জানি না নীলার মনের ভিতর কি আছে।

নীলা আমাকে আবার জিজ্ঞাসা করল, “বললে না তো কাকে বেশী ক্লান্ত লাগছে?”
আমি কোন উত্তর দিলাম না। পিচ্চিটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
“জানো, ও সেই সকাল থেকেই ইট ভেঙ্গে যাচ্ছে। ঐ যে দেখছ অন্য সব কটা মানুষের মাথার উপর ছাতা ছিল। কিন্তু পিচ্চিটার মাথার উপর কোন ছাতাও ছিল না। কিন্তু সে সারাদিন একটুও থামেনি। দুপুরে কিছু খায়ও নি। এই বাড়ির মালিকের সাথে কথা হল, উনি বললেন, সাড়ে ১১ টার দিকে পিচ্চিটা এসে আমাকে আকুতি করে বলল কাজ করবে। আমি আর কি করব, কাজে লাগিয়ে দিলাম” , নীলা বলল।
আমরা ২জন পিচ্চিটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
সন্ধ্যা নামার একটু আগে দেখলাম, ঐ বাড়ির কেয়ারটেকার যারা ইট ভাঙছে সবাইকে ডেকে নিয়ে যায়।
নীলা আমাকে বলল, “কিছুক্ষণ পরে পিচ্চিটা তার মজুরী নিয়ে বের হবে এবং মিজান ভাইয়ের দোকানের দিকে ছুটবে”
নীলা বলল, “চল মিজান ভাইয়ের দোকানে যাই। পিচ্চিটা ওখানেই আসবে”।
আমরা মিজান ভাইয়ের দোকানে পৌঁছাবার ১০ মিনিটের মধ্যে পিচ্চিটা এসে পড়ল। কিন্তু দোকানে ঢুকল না। আগের মত বাহিরে দাড়িয়ে থাকল। নীলা পিচ্চিটাকে ডাকল। আগের মত পিচ্চিটা দৌড়ে দোকানে ঢুকল।
ডুকেই তার পকেট থেকে সবগুলো টাকা বের করল। নীলাই টাকাগুলো গুনে দেখল সব মিলিয়ে ১১৩ টাকা।
নীলা মিজান ভাইকে জিজ্ঞাসা করল, “ক্লিপটা কত রাখতে পারবেন?”
মিজান ভাই বলল, “৬০ টাকা পর্যন্ত রাখা যাবে”।
নীলা সেখান থেকে ৬০ টাকা মিজান ভাইকে দিল। এর ৫৩ টাকা পিচ্চিটার পকেটে ঢুকিয়ে দিল।
নীলা পিচ্চিটাকে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার নাম কি”
পিচ্চিটা বলল, “শান্ত”
-তুমি এ ক্লিপটা কার জন্য নিচ্ছ শান্ত?, নীলা জিজ্ঞাসা করল।
-আমার ছোট বোনের জন্য।
-তোমার ছোট বোনের বয়স কত?
-৪ বছর
আমি আর নীলা অনেকটা অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চিন্তা করলাম, ছোট্ট একটা মানুষ কিন্তু তার বোনের প্রতি ভালবাসাটা যেন ঠিক একটা আকাশের মত।
-আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তাহলে এগুলো খেয়ে নাও। এর পরে বাসায় যাবে। এই বলে নীলা সামির দেয়া সে প্যাকেটটা শান্তকে দিয়ে দিল।
শান্ত দোকানের বাহিরে গিয়ে সারাদিন অভুক্ত পেটে খাওয়া খাচ্ছিল। আমি আর নীলা তাকিয়ে থাকলাম ৭ বছর বয়সী এ ছোট্ট মুখটির দিকে। আমি জানি নীলা এই ছোট্ট মুখটির মধ্যে বারবার রহিমকে খুঁজে পাচ্ছে।

আমি আর নীলা ততক্ষণে শান্তর কেনা ক্লিপটা নিয়ে দোকানের বাহিরে অপেক্ষা করতে থাকলাম।
খাওয়া শেষে নীলা শান্তকে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার বাসা কোথায়”?
শান্ত জানালো, “কাঁটাবনের ঐ পাশে’।
–আমাদেরকে তোমার বাসায় নিয়ে যাবে?, নীলা বলল।
শান্ত আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকল, কিছু বলল না। কিন্তু চেহারায় অনেকটা সন্দেহ যে, আমরা তার সাথে মজা করছি কিনা!!!
আমি, নীলা আর শান্ত গাউছিয়া থেকে কাঁটাবন পর্যন্ত হেটে হেটেই গেলাম। পথে নীলা সাথীর জন্য অনেকগুলো চকলেট কিনল এবং শান্তর হাতে দিল।শান্তর ছোট বোনের নাম সাথী।কিন্তু শান্তর চকলেট গুলোর প্রতি কোন মনোযোগ নেই। সে অনেকটা মুগ্ধ হয়ে বারবার তার নিজের কেনা বোনের জন্য ক্লিপটা দেখছে। আসলেই ক্লিপটি অনেক সুন্দর। ক্লিপের উপরের দিকটায় গোলাপি এবং সাদা অনেকগুলো ফুল দিয়ে সাজানো।
আমি নীলার দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম। নীলা শান্তর কাঁদের উপর একটা হাত রেখে হাঁটছে। একটা ব্যাপার আমি অনেক মনোযোগ সহকারে ভেবে দেখলাম, আজ সকালে যখন নীলা শান্তকে কাজ করতে দেখেছে তখনই সে শান্তকে সেই কাজ থেকে উঠিয়ে নিয়ে নিজেই সেই ক্লিপটা কিনে দিতে পারত। কিন্তু নীলা এটা করেনি । কারণ, নীলা দেখতে চেয়েছিল। কার জন্য শান্ত এ ক্লিপটি কিনতে সারাদিন পরিশ্রম করেছে। যার জন্যই শান্ত এ ক্লিপটি কিনুক না কেন, তার প্রতি শান্তর ভালবাসাটা নীলা কমাতে চায়নি। যদি শান্তকে নীলাই এ ক্লিপটা কিনে দিত, শান্তর এই মহুরতের যে প্রাপ্তির আনন্দ, সেটা কখনই প্রকাশ হত না। শান্তর চেহারার দিকে তাকালেই বুঝা যাচ্ছে, যেন সে বিশ্ব জয় করে এসেছে।
আমরা শান্তদের বাসা পর্যন্ত যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা ৭ টা। কাঁটাবন থেকে একটু দূরে প্রায় ফুটপাতের উপরেই বানানো একটা ঝুপড়িতে ওরা থাকে।
কিছুক্ষণ আগে শান্ত নীলার কিনে দেয়া চকলেট এবং তার কেনা ক্লিপটা নিয়ে সেই ঝুপড়িতে ঢুকেছে। প্রায় ৫ মিনিট পরে শান্ত বের হয়ে আসল। সে কাঁদছে। নীলা প্রায় ছুটে গেল তার কাছে। একটু পরে দেখল একটা ছোট্ট মেয়ে এবং শান্তর মা বের হয়ে আসল ঝুপড়ি থেকে। আমি এবং নীলা দেখলাম, ছোট্ট মেয়ে সাথীর চুলগুলো ছোট ছোট করে ছাঁটা।আমি আর নীলা বুঝলাম, এই ছোট ছোট চুলের মধ্যে কোন ক্লিপ পরানো যাবে না।
তার মা জানালো, “তাদের পাশে থাকা বিল্ডিং থেকে কিছু ছোট ছোট বাচ্চা নীচে খেলতে আসে। এদের মধ্যে মেয়ে বাচ্চাগুলো সবাই মাথায় সুন্দর সুন্দর ক্লিপ পরে। এই দেখে সাথী সারাদিন ক্লিপের জন্য কান্না কাটি করে। আমি আর সহ্য করতে না পেরে আজ তার মাথার চুলগুলো ছোট করে ছেঁটে দিয়েছি। যেন আর ক্লিপের জন্য কান্না করার বাহানা না পায়”।
পুরো অবস্থাটা দেখে আমি আর নীলা আমাদের নিজেদেরকে খুব অসহায় মনে হল।

আমরা শান্তদের বাসার কাছে থেকেই রিক্সা নিলাম। রিক্সা থেকে যত দূর আমরা দেখতে পেলাম, শান্ত কাঁদছে। তার চোখের অশ্রু গুলো সরকারী সোডিয়াম আলোর সামান্য আলোতেও চিকচিক করে উঠছে।
রিক্সার পুরো পথ ধরে নীলা কেঁদেছে। আমি নীলাকে কাঁদতে বাঁধা দেয়নি। তার এভাবে কান্নাটা দেখে আমি অবাকও হইনি। কারণ আমি জানতাম, নীলা এক অসাধারণ মৌলিক মমতার অধিকারী। তার মমতার কাছে শুধু আমি কেন, পৃথিবীর সমস্ত মমতা-লোভী মানুষগুলো ছুটে আসতে বাধ্য। সুতরাং কান্নার অধিকার তারই আছে।
একটু পরে আমি লক্ষ্য করলাম, আমার চোখটাও যেন ভারি হয়ে আসছে...

চলবে...

প্রকাশকালঃ ০৩-০৬-২০১৫

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.